#শেখবাড়ির_বড়ছেলে
এ এইচ স্পর্শ
৫
টিনের চালার ফাঁক গলে ভোরের প্রথম আলো যখন গ্যারেজের স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে এসে পড়ল, আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। এ ঘুম ভাঙার সাথে আগের দিনের লাথি খেয়ে ঘুম ভাঙার কোনো মিল নেই। আজ কোনো তাড়া ছিল না, ছিল না কোনো অপমান। ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। আমার পাশে, একটা পুরানো চাদর মুড়ি দিয়ে গফুর চাচা ঘুমাচ্ছেন। তার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরটা এক অজানা কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। এই মানুষটা আমার কেউ নয়, অথচ কাল রাতে নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছেন। নিজের ভাগের রুটিটা আমাকে খাইয়েছেন, ঘুমানোর জন্য নিজের গায়ের চাদরটা এগিয়ে দিয়েছেন।
গ্যারেজের ভেতর তখনো ভোরের নিস্তব্ধতা। কয়েকজন চালক কেবল ঘুম থেকে উঠে দিনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘাম, পোড়া মবিল আর ভেজা মাটির একটা মিশ্র গন্ধ আমার নাকে এসে লাগল। এই গন্ধটা আমার পরিচিত জগতের ছিল না, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এটাই এখন আমার আশ্রয়। আমি উঠে বসলাম। ছেঁড়া শার্ট আর প্যান্টটা এখনো গায়ে। নিজের এই অবস্থার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। শেখ বাড়ির রাফিদের হাজার হাজার টাকার পোশাকের আলমারিটা আজ কত দূরের এক স্বপ্ন!
একটু পরেই গফুর চাচার ঘুম ভাঙল। আমাকে বসে থাকতে দেখে তিনি মুখে সেই অমায়িক হাসিটা টেনে বললেন, “উইঠা পড়ছেন, সাহেব? ঘুম হইছিল তো?”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। ‘সাহেব’ ডাকটা এখনো আমার কানে বাজে। এই একটা সম্বোধন আমার খসে পড়া আত্মবিশ্বাসকে আঠা দিয়ে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
চাচা উঠে হাত-মুখ ধুয়ে এলেন। তারপর আমার কাছে এসে একটু নিচু গলায়, যেন কোনো গোপন কথা বলছেন, এমনভাবে বললেন, “সাহেব, একটা কথা আছিল। আইজ দুপুরে এক জায়গায় আমার দাওয়াত আছে। আপনে আমার লগে যাইবেন।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম। দাওয়াত? এই শহরে চাচার আবার কে আছে? তার চেয়েও বড় কথা, আমি এই পোশাকে, এই বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে কীভাবে কোনো দাওয়াতে যাই? আমি বললাম, “চাচা, আমার তো…”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি আমার কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন, “বেশি চিন্তা কইরেন না। আমি সব ব্যবস্থা করতাছি। আপনে খালি না কইরেন না। ওই বাড়িতে গেলে অন্তত আইজ দুপুরে পেট ভইরা দুইটা ভালোমন্দ খাইতে পারবেন। আমার লগে পোলাপান থাকলে হেগোরে লইয়া যাইতাম। আপনেই তো অহন আমার পোলার মতো, আমার মেহমান।”
তাঁর গলার স্বরে এমন এক অধিকার আর আন্তরিকতা ছিল যে আমার ‘না’ বলার সব শক্তি হারিয়ে গেল। কিন্তু কৌতূহলও হচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, “কার বাড়ি চাচা?”
গফুর চাচা একটা টুল টেনে আমার সামনে বসলেন। তার চোখ দুটো যেন অতীতের কোনো গল্প বলতে গিয়ে চকচক করে উঠল। তিনি বলতে শুরু করলেন, “মাসখানেক আগের কথা, সাহেব। রাইতের বেলা এক ভদ্রলোক আমার রিকশায় উঠছিলেন গুলশান থাইকা। দেখেই বুঝা যায়, পয়সাওয়ালা মানুষ, কিন্তু কথায়বার্তায় কোনো অহংকার নাই। তারে আমি বাসার সামনে নামাইয়া দিয়া চইলা আসি। রাইতে গ্যারেজে ফিরা রিকশার ভিতর দেখি, একটা মোটা কালো মানিব্যাগ! খুইলা তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! ভিতরে হাজার হাজার টাকার নোট, কার্ড, জরুরি কাগজ। শয়তানে আমার মাথায় চাপছিল, সাহেব। ভাবছিলাম, এই টাকা পাইলে আমার ছয় মাসের সংসার চইলা যাইব। গ্রামের বাড়িতো পোলাপান না খাইয়া আছে।”
চাচা থামলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন, “কিন্তু পরে ভাবলাম, না। এই টাকা আমার না। পরের জিনিস দিয়া বড়লোক হইলে শান্তি পামু না। আমার বাপে শিখাইছে, কামাই কইরা খাইতে, চুরি কইরা না। সারা রাইত ব্যাগটা বুকে জড়াইয়া রাখলাম। পরদিন সকালে ওই ঠিকানায় গিয়া হাজির হইলাম। দারোয়ান তো আমারে ঢুকতেই দিব না। অনেকক্ষণ খাড়াইয়া থাকার পর সাহেব নিজেই গাড়ি নিয়া বাইর হইতেছিল। আমারে দেইখা জিগাইল, কী চাই। আমি ব্যাগটা বাইর কইরা তার হাতে দিলাম।”
গল্পটা শুনতে শুনতে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এই যুগেও এমন মানুষ আছে!
চাচা বলে চললেন, “সাহেব তো অবাক! উনি নাকি টেরই পান নাই যে ব্যাগটা হারাইছে। আমারে জড়াইয়া ধরলেন। খুশি হইয়া পকেট থাইকা পাঁচ হাজার টাকা আমার হাতে গুঁইজা দিতে চাইলেন। আমি হাত জোড় কইরা কইলাম, ‘স্যার, আমি গরিব এতো টাকা দিয়া কি করুম কই রাখুম? আমার যা হক, রিকশার ভাড়া, তাই দিলেই হইব। এই টাকা আমার লাগব না।’ সাহেব আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ চাইয়া রইলেন। তারপর টাকাটা পকেটে রাইখা কইলেন, ‘গফুর মিয়া, তোমার সততা কেরে নেওয়ার ক্ষমতা আমার নাই। কিন্তু আমার বাড়িতে একদিন তোমার দাওয়াত। না করতে পারবেনা। তোমার পুরা পরিবার নিয়া আসবা। আমার পরিবারের সাথে বইসা একদিন ভাত খাবা।’ সেই সাহেবের বাড়িতেই আইজ দাওয়াত। আমার পরিবার তো গেরামে, তাই আপনেরে লইয়া যাইতে চাই। আপনে আমার পরিবারেরই মতন।”
গল্পটা শেষ করে চাচা আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এসেছে। একদিকে রিয়ার স্বার্থপরতা, যে ভালোবাসার নামে আমার সবকিছু কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, আর অন্যদিকে এই প্রায়-অচেনা বৃদ্ধ মানুষটার সততা আর মহানুভবতা। পৃথিবীটা সত্যিই বড় অদ্ভুত জায়গা।
আমার ভেতরকার শেখ বাড়ির অহংকারী সত্তাটা মরে গিয়েও যেন মরতে চাইছিল না। আমি কীভাবে যাব? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, এই অহংকার আমাকে কী দিয়েছে? রাস্তাতেই তো ফেলে রেখেছে। আমি মাথা নিচু করে বললাম, “যাব চাচা।”
চাচা খুশি হয়ে উঠলেন। গ্যারেজের এক কোণায় তার নিজের একটা টিনের ট্রাঙ্ক ছিল। সেটা খুলে তিনি একটা ভাঁজ করা লুঙ্গি আর একটা পুরোনো কিন্তু পরিষ্কার শার্ট বের করে আমার হাতে দিলেন। বললেন, “এইডা পইরা লন। সাবান আছে, ভালো কইরা একটা গোসল দিয়া আহেন। চলেন, আইজ বাপ-বেটায় একটু সাজুগুজু করি।”
অনেকদিন পর সাবান দিয়ে গোসল করলাম। পুরোনো শার্টটা গায়ে দিতেই মনে হলো, যেন নতুন জীবন পেলাম। আভিজাত্যের খোলসটা ছেড়ে আমি যেন সত্যিই একজন সাধারণ মানুষ হয়ে উঠছি।
দুপুর নাগাদ আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম। গফুর চাচা তার নিজের রিকশাটাতেই আমাকে তুললেন। প্যাডেলে পা রেখে তিনি যখন রিকশা টানতে শুরু করলেন, আমার ভেতরটা কেমন করে উঠল। যে মানুষটা আমাকে ‘সাহেব’ বলে ডাকছে, সেই আমাকে বসিয়ে নিজে টেনে নিয়ে যাচ্ছে! লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছিল। কিন্তু আমি জানতাম, এটাই তার কাজ, তার আত্মসম্মান।
গ্যারেজের ঘিঞ্জি গলি পেরিয়ে রিকশাটা যখন অভিজাত এলাকার চওড়া, মসৃণ রাস্তায় উঠল, আমার বুকের ভেতরটা আবার ধক করে উঠল। এই তো আমার চেনা জগৎ! দুপাশে বড় বড় বাড়ি, দামি গাড়ি, পরিপাটি ফুটপাত। এই রাস্তাগুলো দিয়েই তো আমি রোজ ভার্সিটিতে যেতাম, বন্ধুদের সাথে ঘুরতাম। আজ আমি সেই একই রাস্তায় চলেছি, তবে একজন যাত্রী হিসেবে নয়, একজন নিঃস্ব, আশ্রয়হীন মানুষ হিসেবে।
কিছুক্ষণ পর একটা সুন্দর, ছিমছাম দোতলা বাড়ির সামনে এসে রিকশাটা থামল। চাচা আমাকে নামতে বললেন। গেটটা খুলতেই পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। পরনে সাধারণ পাজামা-পাঞ্জাবি, মুখে অমায়িক হাসি। গফুর চাচাকে দেখেই তিনি এগিয়ে এসে হাত মেলালেন।
“আরে গফুর মিয়া, আসো আসো! আমি তো তোমার অপেক্ষাতেই আছি। ছেলে-মেয়েদের আনোনি?”
গফুর চাচা আমার দিকে ইশারা করে বললেন, “স্যার, ওরা তো গেরামের বাড়িতে। ও আমার নতুন পরিবার, রাফিদ। শহরে আইছে কাজের খোঁজে। আমার লগেই থাকে। ভাবলাম, ওরেই লগে কইরা লইয়া আহি।”
ভদ্রলোক, যার নাম পরে জেনেছিলাম আহসান সাহেব, আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তার চোখে কোনো প্রশ্ন ছিল না, ছিল কেবল উষ্ণ অভ্যর্থনা। তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বেশ করেছো। ও তো তোমার পরিবারেরই একজন। এসো বাবা, ভেতরে এসো।”
ভেতরে ঢুকে আমি আরও অবাক হলাম। বিশাল ড্রয়িংরুম, দামি আসবাবপত্র, কিন্তু সবকিছুতে একটা রুচিশীল আর ঘরোয়া ছাপ। এই পরিবেশ আমার পুরোনো স্মৃতিগুলোকে জাগিয়ে দিচ্ছিল, বুকে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছিল।
আহসান সাহেব আর তার স্ত্রী আমাদের পরম যত্নে আপ্যায়ন করলেন। টেবিলে নানা পদের খাবার সাজানো। বহুদিন পর এমন খাবার দেখে আমার জিভে জল চলে এলেও সংকোচে মাথা তুলতে পারছিলাম না। আহসান সাহেব হয়তো আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছিলেন। তিনি নিজে প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বললেন, “লজ্জা পেয়ো না, বাবা। নিজের বাড়ি মনে করে খাও।”
খেতে খেতে নানা কথা হচ্ছিল। আহসান সাহেব গফুর চাচার গ্রামের বাড়ির খোঁজখবর নিলেন। এক পর্যায়ে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “রাফিদ, তুমি কী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছো?”
আমি ইতস্তত করে জবাব দিলাম, “মাস্টার্স শেষ করেছি, ম্যানেজমেন্টে।”
আমার উত্তর শুনে আহসান সাহেব আর তার স্ত্রী দুজনেই বেশ অবাক হলেন। আহসান সাহেব গফুর চাচার দিকে তাকালেন। গফুর চাচা তখন নিচু স্বরে, কিন্তু খুব দৃঢ়তার সাথে বললেন, “স্যার, পোলাডা খুব ভালো। অনেক শিক্ষিত। কপাল খারাপ দেইখা আইজ বিপদে পড়ছে। যদি পারেন, ছেলেটার একটা চাকরির ব্যবস্থা কইরা দিয়েন, স্যার। পোলাডা সোনা, খাঁটি সোনা।”
গফুর চাচার এই আকুতিতে কোনো দালালি ছিল না, ছিল কেবল এক বাবার তার সন্তানের জন্য আর্তি।
আহসান সাহেব আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তার অভিজ্ঞ চোখ দুটো যেন আমার ভেতরের ঝড়টা পড়ার চেষ্টা করছিল। তিনি আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার কিছু কাগজপত্র আছে কিনা জানতে চাইলেন। আমি জানালাম, সবকিছুই আমার কাছে আছে, একটা ফাইলে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে আমরা যখন ওঠার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, আহসান সাহেব তার পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
“এটা আমার কার্ড। আমার নিজের একটা কনস্ট্রাকশন ফার্ম আছে। কাল সকাল দশটায় এই ঠিকানায় চলে এসো। তোমার সব সার্টিফিকেট সাথে নিয়ে আসবে। আমি দেখব তোমার জন্য কী করা যায়।”
আমি কাঁপা কাঁপা হাতে কার্ডটা নিলাম। ‘Ahsan Constructions’ লেখাটার দিকে তাকিয়ে আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। যে জীবনটা গতকাল পর্যন্ত ছিল অন্ধকার, যেখানে কোনো গন্তব্য ছিল না, সেখানে আজ একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। একটা ঠিকানা, একটা সুযোগ।
গফুর চাচার মুখটা তখন গর্বে আর আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তিনি যেন আমার চেয়েও বেশি খুশি হয়েছেন।
বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আবার রিকশায় বসলাম। গফুর চাচা রিকশা চালাচ্ছেন, আর আমি তার পেছনে বসে আছি। হাতে ধরা ছোট্ট একটা কার্ড, কিন্তু আমার কাছে ওটা তখন শুধু একটা কার্ড ছিল না। ওটা ছিল আমার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রথম সিঁড়ি, আমার নতুন জীবনের ছাড়পত্র।
আমি পেছন থেকে চাচার ঘামে ভেজা পিঠটার দিকে তাকালাম। এই মানুষটার সততার পুরস্কার হিসেবে পাওয়া এক বেলার দাওয়াত, আজ আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াল। জীবন কখন, কীভাবে তার হিসাব মেলায়, তা বোঝা সত্যিই কঠিন।
গ্যারেজে ফেরার পথে আমার মনে হলো, শেখ বাড়ির বড় ছেলের পরিচয়টা হারিয়ে আমি হয়তো খুব বেশি কিছু হারাইনি। বরং আমি এমন কিছু পেয়েছি, যা টাকা বা ক্ষমতা দিয়ে কেনা যায় না—মানুষের প্রতি বিশ্বাস আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। পুরোনো রাফিদ মরে গেছে, কিন্তু এই ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়েই এক নতুন রাফিদের জন্ম হচ্ছে। যে রাফিদ জানে, সম্মানের উৎস দামি পোশাক বা বাড়ির ঠিকানায় নয়, সম্মান থাকে মানুষের কর্মে আর সততায়।
চলবে।