শেখবাড়ির বড়ছেলে পর্ব-০৭

0
1

#শেখবাড়ির_বড়ছেলে
এ এইচ স্পর্শ

( কয়েক দিন পর)

নতুন ফ্ল্যাটের দেয়াল থেকে তখনো নতুন রঙের গন্ধ মুছে যায়নি। ভোরের নরম আলো কাঁচের জানালা ভেদ করে যখন ঘরে প্রবেশ করছিল, আমার মনে হচ্ছিল এ যেন এক নতুন জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। শেখ বাড়ির সেই বিশাল খাঁচা, মায়ের কঠরতা উপেক্ষা আর সমাজের তাচ্ছিল্য পেছনে ফেলে এসে এই ছোট্ট টু-বেডরুমের আশ্রয়টুকু আমার কাছে এক স্বাধীন সাম্রাজ্যের মতো। এখানে কোনো আভিজাত্যের ঝাড়বাতি নেই, কিন্তু গফুর চাচার স্নেহের আলোয় প্রতিটি কোণ উজ্জ্বল। এখানে হুকুম করার কেউ নেই, কিন্তু বাবার মতো আগলে রাখার একজন মানুষ আছেন, যার নিঃশ্বাসের শব্দেও আমি খুঁজে পাই নিরাপত্তা।

আমাদের দুজনের ছোট্ট সংসারটা একটা অদ্ভুত ছন্দে বাঁধা পড়েছে। আমি যখন সকালে অফিসের জন্য তৈরি হই, চাচা জায়নামাজে বসে আমার মঙ্গল কামনায় স্রষ্টার কাছে হাত তোলেন। তার হাতে বানানো এক কাপ গরম চায়ে চুমুক না দিয়ে আমার দিন শুরু হয় না। এই চায়ের স্বাদে যে কী ভীষণ প্রশান্তি মিশে থাকে, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তিনি এখনো আমাকে ‘সাহেব’ বলেই ডাকেন, কিন্তু তার প্রতিটি কাজে, প্রতিটি কথায় মিশে থাকে নিখাদ ভালোবাসা । আমি তার ছেঁড়া লুঙ্গির বদলে দামি পাজামা-পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছি, কিন্তু তিনি গ্যারেজের সেই দিনগুলোর মতোই মাটির কাছাকাছি থাকতেই ভালোবাসেন। আমার জুতোটা চকচকে করে পালিশ করা থেকে শুরু করে শার্টের বোতামটা ঠিক আছে কিনা, সবকিছুতেই তার সতর্ক নজর।
গফুর চাচাকে কতবার নিষেধ করেছি, কিন্তু কে শোনে কার কথা?

সেদিন সকালেও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাইয়ের নটটা ঠিক করছিলাম। চাচা এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা আর আজকের খবরের কাগজটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “সাহেব, চা-টা খাইয়া লন, ঠান্ডা হইয়া যাইব। আর কাগজটাও একটু দেইখা লন। দেশের কী অবস্থা, জানা থাকন ভালো।”

মার্কেটিং হেড হিসেবে নতুন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কাজের চাপ বেড়েছে বহুগুণ। তাই সকাল সকাল বাজারের হালচাল আর দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত থাকাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমি চায়ের কাপে আলতো চুমুক দিয়ে অলসভাবে কাগজের পাতায় চোখ বোলাচ্ছিলাম। রাজনৈতিক খবর, খেলার পাতা পেরিয়ে ‘করপোরেট জগৎ’ কলামে এসে আমার চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল। আমার ছবিসহ একটি সুস্পষ্ট শিরোনাম— “সততার পুরস্কার: অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত রাফিদ ফিরলেন স্বপদে, পেলেন পদোন্নতি ও সম্মাননা।”

খবরের ভেতরে আমার জীবনের গত হয়ে যাওয়া দিনের ঝড়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। কীভাবে আমাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছিল, কীভাবে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ অডিটে সব সত্য উদঘাটিত হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ নিজেদের ভুল স্বীকার করে নিয়েছে। তারা শুধু আমাকে আমার চাকরি ফিরিয়েই দেয়নি, বরং দুই লক্ষ টাকার আর্থিক সম্মাননাসহ মার্কেটিং বিভাগের প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করেছে। খবরটা পড়তে পড়তে আমার ঠোঁটের কোণে একটা ক্লান্তির হাসি ফুটে উঠল। যে সম্মান, যে পরিচয় আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তা আজ দেশবাসীর সামনে কাগজে-কলমে ফিরে এসেছে। কিন্তু আমার বুকের ভেতর যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে, যে অবিশ্বাসের দেয়াল গড়ে উঠেছে, তার কী হবে? এই ফিরে পাওয়া সম্মান সেই ক্ষতকে সারাতে পারবে কি?
—- — — —
শহরের অন্য প্রান্তে, এক ঝকঝকে দোতলা বাড়ির বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে রিয়াও ঠিক একই খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিল। তার সকালটা শুরু হয়েছিল একরাশ দুঃসহ উদ্বেগ আর দমবন্ধ করা ভয় নিয়ে। বাবা-মা গত কয়েকদিন ধরে তার বিয়ের জন্য যে চাপ দিচ্ছেন, তা তার জীবনকে নরকের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। পাত্র, এলাকার এক প্রভাবশালী ব্যক্তির বখে যাওয়া ছেলে, যার নামের সাথে ‘সন্ত্রাসী’ তকমাটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। রিয়া কিছুতেই এই বিয়েতে রাজি নয়, কিন্তু তার বাবা-মায়ের কঠোর জেদ আর সামাজিকতার দোহাইয়ের কাছে তার সব প্রতিবাদ, সব চোখের জল অর্থহীন হয়ে যাচ্ছিল।

হাতে ধরা চায়ের কাপটা কখন যে বরফ হয়ে গেছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। উদাস, শূন্য চোখে সে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছিল, আর ভাবছিল এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তির কোনো পথ খোলা আছে কি না। হঠাৎ ভেতরের পাতায় একটা পরিচিত মুখের ছবি দেখে সে থমকে গেল। তার বুকের ভেতরটা যেন হাতুড়ির মতো আঘাত করল। রাফিদ! তার স্বামী। যে মানুষটাকে সে চরম দুর্দিনে, অপবাদের বোঝা মাথায় চাপিয়ে একা রাস্তায় ফেলে চলে এসেছিল।

ছবির নিচে লেখা শিরোনামটা পড়তে গিয়ে রিয়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। “রাফিদ চাকরি ফিরে পেয়েছে! শুধু তাই নয়, মার্কেটিং হেড হিসেবে পদোন্নতি, দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ!”

রিয়ার হাত থেকে খবরের কাগজটা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। সে অবিশ্বাস্য চোখে খবরটা বারবার পড়ল, প্রতিটি শব্দ যেন তার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল। তার মানে, রাফিদ আর সেই অসহায়, কপর্দকশূন্য, পরাজিত যুবক নয়। সে এখন প্রতিষ্ঠিত। সম্মানিত। যে অপবাদের কালিমা মেখে সে পথে পথে ঘুরছিল, সেই কালিমা মুছে গিয়ে এখন তার কপালে জ্বলজ্বল করছে সাফল্যের তিলক।

রিয়ার ভেতরটা এক মুহূর্তে তোলপাড় হয়ে গেল। একদিকে এক সন্ত্রাসীর সাথে বিয়ের ভয়ংকর ভবিষ্যৎ, অন্যদিকে রাফিদের এই অভাবনীয় প্রত্যাবর্তন। তার মনে হলো, অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে সে যেন এক ফালি রুপালি চাঁদ দেখতে পেয়েছে। এই রাফিদই তার একমাত্র মুক্তির পথ, তার একমাত্র আশ্রয়। তার মনে পড়ল, বিয়ের পর রাফিদকে ছেড়ে আসার মুহূর্তে সে বলেছিল, সে রাফিদের সাথে থেকে নিজের জীবনটা ‘কলুষিত’ করতে চায় না। কী আশ্চর্য পরিহাস, আজ নিজের জীবনটা বাঁচানোর জন্যই তার সেই রাফিদকে দরকার।

আর এক মুহূর্তও সে বাসায় বসে থাকতে পারল না। তার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। সে দ্রুত ঘরে গিয়ে কোনোমতে একটা সাধারণ সালোয়ার-কামিজ পরে নিল। রান্নাঘর থেকে মায়ের জিজ্ঞাসু কণ্ঠ ভেসে এলেও তার কোনো উত্তর না দিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। একটা রিকশা নিয়ে চালককে প্রায় তাড়া দিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি চলেন, মতিঝিল!” তার মাথায় তখন একটাই চিন্তা—যেভাবেই হোক রাফিদের সাথে দেখা করতে হবে। তার মন তাকে বলছিল, রাফিদ তাকে ফিরিয়ে দেবে না। তাদের তো ভালোবাসার বিয়ে হয়েছিল। সেই ভালোবাসার দোহাই দিলে, একটু কাঁদলে, রাফিদের মন নিশ্চয়ই গলবে। সে নিশ্চয়ই তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবে।

মতিঝিলের সেই সুউচ্চ কাঁচের বিল্ডিংটার সামনে রিকশা থেকে নামার সময় তার পা দুটো কাঁপছিল। তখনো অফিস পুরোপুরি শুরু হয়নি, চারপাশটা তুলনামূলকভাবে শান্ত। সে গেটের একপাশে দাঁড়িয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। প্রতিটি দামি গাড়ি গেটের সামনে এসে থামলেই তার বুকটা ধক করে উঠছিল।

কিছুক্ষণ পর একটা কালো, চকচকে সেডান গাড়ি এসে বিল্ডিংয়ের ঠিক সামনে থামল। ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজা খুলে যে মানুষটা রআফিদকে নামিয়েদিলো, রাফিদকে দেখে রিয়ার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। নিখুঁতভাবে ইস্ত্রি করা নেভি ব্লু শার্ট আর ছাইরঙা ট্রাউজার্স, পায়ে আয়নার মতো চকচকে অক্সফোর্ড জুতো, চোখে ব্র্যান্ডেড সানগ্লাস, চুলগুলো পরিপাটি করে জেল দিয়ে আঁচড়ানো। এই কি সেই রাফিদ, যার পরনে থাকতো সাধারণ পাঞ্জাবি আর যার চোখেমুখে সারাক্ষণ লেগে থাকত এক ধরনের সরলতা আর অসহায়ত্ব? এই রাফিদের হাঁটাচলায় ক্ষমতার দম্ভ, তার চেহারায় আত্মবিশ্বাসের কঠোর দ্যুতি। সে আর তার চেনা রাফিদ নেই।

রিয়া আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। রাফিদ যখন বিল্ডিংয়ের মূল ফটকের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসছিল, সে তার সবটুকু শক্তি দিয়ে প্রায় চিৎকার করে নাম ধরে ডাকল, “রাফিদ!”

ডাকটা শুনে ব্যস্ত মতিঝিলের সকালের মৃদু কোলাহলের মাঝেও রাফিদ এক মুহূর্তের জন্য থামল। সে খুব ধীরে, প্রায় নাটুকে ভঙ্গিতে ঘুরল। চোখের সানগ্লাসটা কপালে তুলে সে রিয়ার দিকে তাকাল। তার চোখে কোনো বিস্ময় ছিল না, ছিল না কোনো পুরনো অনুভূতির রেশ। ছিল কেবল নির্লিপ্ত এক চাহনি। সে রিয়াকে দেখল। তার সেই সুন্দরী বউ, যে এক বর্ষণমুখর রাতে তাকে একা রাস্তায় ফেলে চলে গিয়েছিল, কারণ সে একজন ‘চোরের’ সাথে নিজের ভবিষ্যৎ জড়াতে চায়নি। যে নারীটিকে এক নজর দেখার জন্য সে পাগলের মতো দিনের পর দিন তার বাড়ির পাশে ঘুরে বেড়িয়েছে, আর রিয়া তাকে বারান্দা থেকে দেখেও না দেখার ভান করে ঘরের ভেতর ঢুকে গেছে।

রাফিদের বুকের ভেতর পুরোনো ক্ষতটা দপ করে জ্বলে উঠল, কিন্তু তার মুখে তার কোনো ছাপ পড়ল না। সে এমন একটা ভাব করল যেন রিয়াকে সে চিনতেই পারেনি, কিংবা চিনলেও তার উপস্থিতি কোনো গুরুত্বই বহন করে না। সে শান্তভাবে ঘুরে দাঁড়াল এবং অফিসের স্বয়ংক্রিয় কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে মিলিয়ে গেল, পেছনে ফেলে গেল এক হতভম্ব, অপমানিত নারীকে।

রিয়া যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই যেন পাথর হয়ে গেল। তার মনে হলো, কেউ যেন ভরা বাজারের মাঝে তার গালে সজোরে একটা চড় কষিয়েছে। রাফিদ তাকে দেখেও দেখল না? চিনেও চিনল না? এই অপমানটা তার কাছে আসন্ন বিয়ের ভয়ংকর পরিণতির চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক মনে হলো। তার পা দুটো যেন মাটিতে গেঁথে গেছে, সে একচুলও নড়তে পারছিল না। লজ্জায়, অপমানে তার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছিল।

প্রায় এক ঘণ্টা। এক অনন্তকালসম দীর্ঘ ঘণ্টা সে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। অপমান আর হতাশায় ডুবে গিয়ে যখন সে বিধ্বস্ত পায়ে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে, ঠিক তখনই অফিসের একজন পিওন এসে তার সামনে দাঁড়াল।
“আপনাকে রাফিদ সাহেব তার রুমে যেতে বলেছেন।”

পিওনের নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বরে বলা কথাগুলো রিয়ার কানে আশার বার্তার মতো শোনাল। হয়তো রাফিদ সবার সামনে কথা বলতে চায়নি। হয়তো সে এখনো তাকে ভালোবাসে, শুধু একটু অভিমান দেখাচ্ছে। সে কাঁপা কাঁপা পায়ে পিওনকে অনুসরণ করে লিফটে উঠল। মার্কেটিং হেডের বিশাল, কাঠের দরজাওয়ালা ঘরটার সামনে এসে তার বুকটা ধড়ফড় করছিল।

দরজাটা সামান্য খোলাই ছিল। ভেতরে দামি মেহগনি কাঠের টেবিলের ওপাশে একটা রাজকীয় ঘূর্ণি চেয়ারে বসেছিল রাফিদ। তাকে ঢুকতে দেখে সে চেয়ারটা সামান্য ঘোরাল। তার মুখে একটা অদ্ভুত, অর্থহীন হাসি লেগে আছে, যে হাসিতে উষ্ণতার লেশমাত্র নেই, আছে কেবল ধারালো, কঠর বিদ্রূপ।

রিয়া ভেতরে ঢুকতেই রাফিদ খুব শান্ত, প্রায় সুর করে জিজ্ঞেস করল, “কী চাই?”

রাফিদের এই হিমশীতল অভ্যর্থনা রিয়ার শেষ আশাটুকুও ধুলোয় মিশিয়ে দিল। তার চোখ ফেটে জল চলে এল। সে কোনো ভূমিকা না করেই কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “রাফিদ, আমি খুব বড় বিপদে পড়েছি। বাবা-মা জোর করে আমার বিয়ে ঠিক করেছে… এলাকার এক নামকরা সন্ত্রাসীর ছেলের সাথে। ছেলেটা ভালো না, সবাই জানে। এই বিয়েটা না করলে ওরা আমাকে মেরেই ফেলবে। প্লিজ রাফিদ, আমাকে বাঁচাও! আমি তোমার স্ত্রী, আমার এই বিপদে তুমি ছাড়া আর কে আছে?”

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই রাফিদ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। সে ধীরে ধীরে টেবিল ঘুরে রিয়ার একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখের সেই বিদ্রূপাত্মক হাসিটা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠেছে এক ভয়ংকর কঠরতা। সে শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় ইংরেজিতে বলল, “হু দ্য হেল আর ইউ?”

রিয়া চমকে উঠে বলল, “রাফিদ, এ কী বলছ তুমি! আমি রিয়া, তোমার…”

“চুপ!” রাফিদের গলার স্বরে যেন গোটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরটা কেঁপে উঠল। “মনে পড়ে, ঠিক কয়েকমাস আগে এক বর্ষার দুপুরে তুমি আমার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলে, ‘একজন চোরের সাথে, চালচুলোহীন ফকিন্নিরসাথে ঘর করার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো’? সেদিন তুমি আমাকে একা রাস্তায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলে, কারণ আমার গায়ে তখন মিথ্যা অপবাদ। সেদিন তোমার মনে হয়নি আমি তোমার স্বামী? এরপর দিনের পর দিন আমি এক নজর তোমাকে দেখার জন্য, শুধু একবার কথা বলার জন্য তোমার বাড়ির পাশে কুকুরের মতো ঘুরঘুর করতাম। তুমি বারান্দা থেকে আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে ঘরের ভেতর ঢুকে যেতে। মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা? আর আজ? আজ যখন দেখলে আমার সুদিন ফিরেছে, পত্রিকায় আমার ছবি আর সাফল্যের খবর ছাপা হয়েছে, তখন ছুটে এসেছ অধিকারের দাবি নিয়ে?”

রাফিদের প্রতিটি শব্দ ছিল এক একটি ধারালো ছুরি, যা রিয়ার হৃৎপিণ্ডকে ফালা ফালা করে দিচ্ছিল। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোল না।

রিয়া অনেক কষ্টে কান্নাভেজা গলায় বলল, “তুমি কি আমার উপর শোধ নিচ্ছ, রাফিদ?”

রাফিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাঁকা হেসে বলল, “শোধ? না। প্রতিশোধ দুর্বলরা নেয়। আমি শুধু তোমাকে তোমার ফেলে যাওয়া অতীতটা আয়নার মতো দেখিয়ে দিচ্ছি। আমি শুধু ভাবছি, মানুষ কতটা নির্লজ্জ, কতটা বেহায়া আর সুযোগসন্ধানী হলে সব ভুলে গিয়ে এমনভাবে তার প্রাক্তন স্বামীর সামনে এসে দাঁড়াতে পারে!”

রাফিদের শেষ কথাটা রিয়ার অস্তিত্বকে যেন চুরমার করে দিল। তার মনে হলো, তার পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না, শরীরটা যেন ভেঙেচুরে মাটিতে মিশে যেতে চাইছে। রাফিদের চোখে সে দেখল না কোনো ভালোবাসা বা ঘৃণা, দেখল কেবল এক গভীর, অতলস্পর্শী উদাসীনতা, যা ঘৃণার চেয়েও সহস্রগুণ বেশি ভয়ংকর।

ভুল মাফ করবেন।
চলবে..