শেখবাড়ির বড়ছেলে পর্ব-১০

0
3

#শেখবাড়ির_বড়ছেলে

১০
আজ রাহাতের বিয়ে।

ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই শহরের অন্য প্রান্তে যখন শেখবাড়িতে সানাইয়ের সুর আর আনন্দ-কোলাহলের প্রস্তুতি চলছে, তখন রাফিদের ফ্ল্যাটে বিরাজ করছিল এক গভীর, শান্ত নীরবতা। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভোরের শীতল বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছিল রাফিদ। তার চোখেমুখে কোনো উত্তেজনা নেই, নেই কোনো প্রতিশোধের জিঘাংসা। যা আছে, তা হলো এক শীতল সংকল্প, যা সমুদ্রের গভীরতার মতোই শান্ত কিন্তু অপ্রতিরোধ্য।

দিন দুয়েক আগের কথা। রাফাত নিজেই এসেছিল তার অফিসে, দামি স্যুটেড-বুটেড হয়ে, চোখেমুখে বিজয়ের হাসি। উদ্দেশ্য ছিল আমন্ত্রণ জানানো, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল নিজের সাফল্য আর সুখটা বড় ভাইয়ের ক্ষতের উপর ছিটিয়ে দেওয়া।

“বিয়েতে আসিস কিন্তু,” রাহাত কার্ডটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিল। তার কণ্ঠস্বরে ছিল স্পষ্ট বিদ্রূপ। “নিজের চোখে দেখে যাস, তোর ফেলে যাওয়া সবকিছু আমি কেমন গুছিয়ে নিয়েছি।

রাফিদ চেয়ারে হেলান দিয়ে শান্তভাবে রাহাতের দিকে তাকিয়েছিল। তার চেহারায় কোনো ভাবান্তর ঘটেনি। সে শুধু মৃদু হেসেছিল। সেই হাসিতে করুণা ছিল, কিন্তু কোনো দুর্বলতা ছিল না। “আমার ফেলে দেওয়া জিনিস নিয়ে যার সুখ, তার বিয়েতে যাওয়ার মতো রুচি বা সময় আমার নেই, রাহাত। তুই বরং তোর নতুন জীবন উপভোগ কর।”

রাফিদের এই অপ্রত্যাশিত কঠর ঔদাসীন্য রাহাতের অহংকারে বড় ধাক্কা দিয়েছিল। সে ভেবেছিল রাফিদ জ্বলে উঠবে, চিৎকার করবে অথবা অসহায়ত্ব প্রকাশ করবে। কিন্তু এই শান্ত, আত্মবিশ্বাসী রাফিদকে সে চিনতে পারছিল না। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে বেরিয়ে গিয়েছিল। রাফিদ জানত, এই প্রত্যাখ্যান রাহাতের কাছে পরাজয়ের মতো। সে যায়নি, যেতে পারেনি। যে বাড়ির চৌকাঠ থেকে তাকে অপমান করে বের করে দেওয়া হয়েছিল, সেখানে একজন আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।

ব্যালকনি থেকে সরে এসে রাফিদ ডাইনিং টেবিলে বসল। তার মনটা আজ বারবার বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। একদিকে রাহাতের বিয়ে, অন্যদিকে রিয়া। কাল রাতেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই ঝুলিয়ে রাখা সম্পর্কের ইতি টানা দরকার।

গফুর চাচা ফিরলেন দুপুরের ঠিক আগে। তার মুখটা থমথমে। হাতে একটা ফাইল। রাফিদের সামনে ফাইলটা রেখে তিনি নিচু গলায় বললেন, “বাবা, উনি সই করে দিয়েছেন।”

রাফিদ ফাইলটা খুলল। ডিভোর্স পেপারের নির্দিষ্ট জায়গায় রিয়ার সইটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সইটার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য রাফিদের বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। এই সেই নারী, যাকে সে জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছিল। যার জন্য সে সব ছাড়তে প্রস্তুত ছিল। আজ দুটো আইনের কাগজের উপর একটা স্বাক্ষর তাদের সব স্মৃতি, সব ভালোবাসাকে অতীত বানিয়ে দিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফিদ ফাইলটা বন্ধ করল। যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে। পেছনে তাকানোর আর কোনো সুযোগ নেই।

“উনি কিছু বলেছেন?” রাফিদ শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল।

গফুর চাচা মাথা নাড়লেন। “না বাবা, কিচ্ছু বলেন নাই। আমি যখন কাগজটা দিলাম, উনার চোখ দিয়া শুধু পানি পড়তেছিল। উনার বাবা পাশে দাঁড়ায়া ছিলেন। মাইয়াটার দিকে তাকাইয়া আমার নিজেরই বুকটা ফাইটা যাইতেছিল। একবার শুধু ফ্যালফ্যাল কইরা আমার দিকে তাকাইয়া জিগাইছিলেন, ‘উনি ভালো আছেন তো, চাচা?’”

রাফিদের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। রিয়ার জন্য তার মায়া হচ্ছিল, কিন্তু ভালোবাসার জায়গায় যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা আর সারার নয়। সে জানে, এই বিচ্ছেদ দুজনের জন্যই মঙ্গল। জোর করে ধরে রাখা সম্পর্কের চেয়ে সম্মানের সাথে সরে আসা শ্রেয়।

গফুর চাচা রাফিদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাফিদের এই পরিণত, দায়িত্বশীল রূপটা তাকে মুগ্ধ করছিল। এই ছেলেটা আর আগের মতো আবেগ দিয়ে চলে না, বাস্তবতা দিয়ে চলে।

দুপুরের খাবারের পর রাফিদ নিজের ঘরে এসে বসতেই ফোনটা হাতে নিল। মনটা খচখচ করছে মায়ের জন্য।
এই মা ই তাকে দুচোখ করতো রাহাতের সাথে
রাহাত ছিলো মায়ের প্রান ভ্রমরা।
আর সেই রাফিদই তার মাকে শেখ বাড়িতে সম্মানের সাথে ফিরিয়ে দিয়ে আসে।

শেখবাড়িতে তাকে সসম্মানে ফিরিয়ে দিয়ে এলেও, সে জানে রাহাতের সংসারে মায়ের সম্মান কতটুকু থাকবে। বিশেষ করে আজকের এই বিয়ের দিনে।

সে বাড়ির পুরনো ল্যান্ডলাইন নম্বরে ফোন করল। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে পরিচিত গলা ভেসে এলো। বাড়ির পুরোনো বিশ্বস্ত কাজের লোক করিম।

“করিম চাচা, আমি রাফিদ বলছি।”

ওপাশ থেকে করিমের গলাটা যেন উত্তেজনায় ও ভয়ে কেঁপে উঠল। “বড় সাহেব! আপনি! কেমন আছেন?”

“আমি ভালো আছি। বাড়ির কী খবর? মা কেমন আছেন?”

করিমের গলাটা মুহূর্তেই নিচু হয়ে গেল। “সাহেব, আম্মাজান তো ভালো নাই।”

“কেন? কী হয়েছে?” রাফিদের কপালে ভাঁজ পড়ল।

“ছোট সাহেব তো উনারে ঘর থাইকাই বাইর হইতে দিতাছেন না। সকাল থাইকা মেহমান আসতেছে, বাড়ি গিজগিজ করতেছে মানুষে। কিন্তু আম্মাজান নিজের ঘরে দরজা দিয়া বইসা আছেন। ছোট সাহেবের হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজন আম্মাজানের সাথে একটা কথাও কয় নাই। সবাই এমন ভাব করতেছে, যেন উনি এই বাড়ির কেউ না, একজন বোঝা।”

করিম একটু থেমে আবার বলল, “ছোট সাহেব একবার আইসা খালি কইয়া গেছেন, ‘তুমি নিচে নামার দরকার নাই। মেহমানদের সামনে কোনো সিনক্রিয়েট কইরো না।’ নিজের পোলার বিয়া, আর মা ঘরের মইধ্যে বন্দি হইয়া থাকব, এইটা কেমন বিচার কন তো সাহেব?”

রাফিদের বুকের ভেতর যেন আগুন জ্বলে উঠল। তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সে তার মাকে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছিল শেখবাড়ির রানির মর্যাদা, আর রাহাত তাকে নিজের বাড়িতেই একজন বন্দিনী বানিয়ে রেখেছে! যে মায়ের গর্ভে সে জন্মেছে, সেই মাকে আজ তার নিজেরই আনন্দের দিনে সবার থেকে লুকিয়ে রাখছে? এই অপমান রাফিদের সহ্য হলো না। প্রতিশোধের আগুনটা, যা সে এতক্ষণ নিভিয়ে রেখেছিল, দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। কিন্তু এই আগুন ধ্বংসের নয়, অধিকার প্রতিষ্ঠার।

সে ফোনটা রেখে উঠে দাঁড়াল। তার চোখে এক ভয়ংকর স্থিরতা।

গফুর চাচা রাফিদের ভাবভঙ্গি দেখে চিন্তিত হয়ে এগিয়ে এলেন। “কী হইছে, বাবা? এমন দেখাচ্ছে ক্যান তোমারে?”

রাফিদ গফুর চাচার দিকে ফিরে শীতল গলায় বলল, “চাচা, তৈরি হন। আমরা শেখবাড়ি যাব।”

“শেখবাড়ি! রাহাতের বিয়ায় যাইবা, বাবা? তুমি না কইলা…”

রাফিদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমি রাহাতের বিয়েতে যাচ্ছি না, চাচা। আমি আমার মায়ের কাছে যাচ্ছি। শেখবাড়ির বড় ছেলে হিসেবে যাচ্ছি। আমার মা তার ছেলের বিয়েতে কেন আড়ালে থাকবেন? তিনি থাকবেন সবার সামনে, বাড়ির কর্ত্রী হিসেবে। আজ সবাই দেখবে, শেখবাড়ির আসল وارث কে।”

রাফিদের কণ্ঠস্বরে এমন এক কর্তৃত্ব ছিল, যা গফুর চাচা আগে কখনো শোনেননি। তিনি বুঝলেন, আজ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। আজ শুধু ক্ষমতার খেলা নয়, আজ হবে সম্মানের লড়াই।

রাফিদ নিজের আলমারি খুলল। সেখান থেকে সবচেয়ে দামি, অভিজাত কাজ করা একটা পাঞ্জাবি বের করল। সাদা জমিনের উপর সোনালি সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবিটা পরতেই তাকে যেন সত্যিকারের রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছিল। চুলটা পরিপাটি করে আঁচড়ে, হাতে দামি ঘড়িটা পরে সে যখন আয়নার সামনে দাঁড়াল, তখন সে দেখল এক নতুন রাফিদকে। এই রাফিদের চোখে ভয় নেই, দ্বিধা নেই, আছে শুধু আত্মবিশ্বাস আর অটুট সংকল্প।

গাড়িটা যখন শেখবাড়ির বিশাল গেটের সামনে এসে থামল, তখন ভেতর থেকে ভেসে আসা সানাইয়ের সুর আর হাসির রোল যেন মুহূর্তেই থমকে গেল। গেটের দারোয়ানরা রাফিদকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। তারা পথ ছেড়ে দিতেই রাফিদের গাড়িটা নিঃশব্দে ভেতরে প্রবেশ করল।

বাড়ির সামনে বিশাল প্যান্ডেল। শয়ে শয়ে অতিথি, সবাই জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকে সজ্জিত। রাহাত বর সেজে স্টেজে বসে আছে, তার পাশে নতুন বউ। চারদিকে আনন্দের ফোয়ারা।

গাড়ির দরজা খুলে রাফিদ যখন নামল, প্যান্ডেলের সব কোলাহল যেন এক순হে থেমে গেল। সবার চোখ তার দিকে। রাহাত স্টেজে বসে ভাইয়ের এই অপ্রত্যাশিত আগমনে পাথর হয়ে গেল। তার মুখটা বিস্ময়ে আর আতঙ্কে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে ভাবতেও পারেনি, রাফিদ এখানে আসবে।

রাফিদ কারো দিকে তাকাল না। তার দৃষ্টি সোজা বাড়ির মূল দরজার দিকে। সে কোনো অতিথির মতো আসেনি, সে এসেছে বাড়ির মালিকের মতো। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল মাপা, দৃঢ়। চারপাশের ফিসফাস, অবাক দৃষ্টি কোনোকিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছিল না।

সে সোজা রাহাতের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল, একবারও তার দিকে না তাকিয়ে। যেন রাহাত বা তার এই বিয়ের আসরের কোনো অস্তিত্বই নেই। সে সরাসরি বাড়ির ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল।

পেছনে হতভম্ব, অপমানিত রাহাত আর শত শত অতিথির অবাক দৃষ্টিকে ফেলে রেখে নির্বাসিত রাজপুত্র চলল তার বন্দিনী রানির মুক্তির জন্য।

আজ রাহাতের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিনটাকেই সে তার ক্ষমতার প্রথম প্রদর্শনীতে পরিণত করতে চলেছে। শেখবাড়ির ক্ষমতার ভারসাম্য আজ নতুন করে লেখা হবে।

চলবে…