#শেখবাড়ির_বড়ছেলে
#শেষপর্ব
শেখবাড়ির সেই ঝোড়ো রাতের পর রাফিদের ফ্ল্যাটের সকালটা ছিল অদ্ভুত রকমের শান্ত। গত রাতের ঘটনাপ্রবাহ যেন একটা সিনেমার মতো তার চোখের সামনে ভাসছিল। মায়ের অপমানের প্রতিশোধ সে নিয়েছে, তবে কোনো চিৎকার বা ধ্বংসলীলার মাধ্যমে নয়। নিয়েছে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, নিজের সম্মান আদায় করে। শেখবাড়ির কর্ত্রীকে তার প্রাপ্য আসনে বসিয়ে দিয়ে সে নিঃশব্দে ফিরে এসেছে। সে জানে, তার এই এক পদক্ষেপে ক্ষমতার যে ভারসাম্য সে নাড়িয়ে দিয়ে এসেছে, তা সামলাতে রাহাতের অনেক সময় লেগে যাবে।
কিন্তু রাফিদের মনে এখন আর কোনো প্রতিশোধের আগুন নেই। আছে এক গভীর শূন্যতা আর মুক্তির প্রশান্তি। আজ সে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আজ সে উড়াল দেবে এক নতুন আকাশে, যেখানে অতীতের কোনো ছায়া তাকে তাড়া করবে না।
কোম্পানির অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সুযোগটা ছিল অপ্রত্যাশিত। প্রতি বছর সেরা কর্মীকে এই সুযোগ দেওয়া হয়। রাফিদ তার কাজে এতটাই ডুবে ছিল যে, সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল এই প্রতিযোগিতার কথা। যখন তার নাম ঘোষণা করা হলো, তখন সে প্রথমবার অনুভব করল, ভাগ্য হয়তো তার জন্য নতুন কোনো দরজা খুলে দিচ্ছে। এই শহর, এই চেনা মুখ, এই স্মৃতিগুলো থেকে দূরে যাওয়ার এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর হতে পারে না।
সকালের নাস্তা শেষে গফুর চাচা এলেন। তার চোখেমুখে এখনো গত রাতের বিস্ময় আর মুগ্ধতা লেগে আছে। তিনি রাফিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাবা, তুমি যা করলা, তা রাজার মতো কাজ। নিজের মায়ের সম্মান ফিরাইয়া দিলা।”
রাফিদ মৃদু হাসল। সে ড্রয়ার থেকে একটা খাম বের করে গফুর চাচার হাতে দিল। “চাচা, এটা রিয়ার জন্য। ওর বাসার ঠিকানায় দিয়ে আসবেন। খামের ভেতরে চার লাখ টাকা আছে।”
গফুর চাচা চমকে উঠলেন। “এত টাকা! বাবা, এইটা কি…”
রাফিদ শান্তভাবে বলল, “এটা কোনো দেনা-পাওনা নয়, চাচা। একটা মানুষ নতুন করে জীবন শুরু করতে চাইলে কিছুটা ভরসা লাগে। আমি চাই না, আমার সাথে সম্পর্কের কারণে ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট হোক। এটা ওর কাজে লাগবে।”
এরপর রাফিদ তার সবচেয়ে কঠিন কথাটা বলার জন্য প্রস্তুত হলো। সে গফুর চাচার কাঁধে হাত রেখে বলল, “চাচা, আমি তো আজ চলে যাচ্ছি। আপনি আপনার পরিবারকে গ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসুন। আমার এই ফ্ল্যাটেই থাকবেন। আমি প্রতি মাসে আপনার আর আপনার পরিবারের খরচের জন্য টাকা পাঠিয়ে দেবো। শুধু আমার একটা অনুরোধ রাখবেন।”
গফুর চাচা অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে রইলেন।
রাফিদ বলল, “আমি যে টাকা পাঠাব, সেখান থেকে প্রতি মাসে কিছু টাকা আমার মায়ের খাওয়ার খরচের জন্য শেখবাড়িতে পৌঁছে দেবেন। সরাসরি তার হাতে। যেন তার কোনো কিছুর জন্য কারো মুখাপেক্ষী হতে না হয়।”
এই কথাটা শোনার পর গফুর চাচা আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। “বাবা, এইটা তুমি কী করলা! নিজের মা’রে নিজের কাছে না রাইখা আরেকজনের সংসারে ফালাইয়া রাখলা। রিয়া মারে ছাইড়া দিলা। আর এখন নিজেও দেশ ছাইড়া চইলা যাইতাছ। আমি তোমারে বুঝি নাই, বাবা। তুমি কি কাউরেই ভালোবাসো না?”
রাফিদের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে গেল। সে কীভাবে বোঝাবে এই সরল মানুষটাকে? যে মানুষগুলোকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, তাদের কাছ থেকেই সে সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছে। এই ভালোবাসাটাই তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, তার সবচেয়ে বড় ‘পিছুটান’। এদের সামনে থাকলে সে কোনোদিনও নিজের সাথে করা অন্যায় ভুলতে পারবে না, নতুন করে বাঁচতে পারবে না।
সে চাচাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “চাচা, আপনি হয়তো একদিন বুঝবেন। আমি এই মানুষগুলোকে প্রচণ্ড ভালোবাসি বলেই এদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। কাছে থাকলে এই ভালোবাসাটা শুধু কষ্টই দেবে, শান্তি দেবে না।”
দুপুরে গোছগাছ করার সময় রাফিদ একটা ডায়েরি আর কলম নিয়ে বসল। তার কিছু কথা বলার ছিল, যা সে মুখে বলে যেতে পারবে না। সে একটা চিঠি লিখতে শুরু করল, যা সে যাওয়ার আগে গফুর চাচার হাতে দিয়ে যাবে।
প্রিয় মা, রিয়া, এবং গফুর চাচা,
আমি যখন এই চিঠিটা আপনাদের হাতে পৌঁছাবে, তখন আমি হয়তো এই দেশ থেকে অনেক দূরে। কিছু কথা ছিল, যা সামনাসামনি বলার সাহস বা পরিস্থিতি কোনোটাই আমার ছিল না। তাই এই অক্ষরের আশ্রয় নেওয়া।
মা,
তোমাকে দিয়েই শুরু করি। আমি জানি, তুমি আমাকে কখনোই মন থেকে ভালোবাসতে পারোনি। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম, রাহাতের জন্য তোমার চোখে যে স্নেহ ঝরে পড়ত, আমার জন্য সেখানে থাকত এক উদাসীনতা। আমি কারণ খুঁজতাম, নিজেকে দোষ দিতাম। অনেক পরে খালামনির কাছে শুনেছিলাম, আমার জন্মের দিন নানাভাই মারা গিয়েছিলেন। সেই শোক হয়তো আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার পথে দেয়াল তুলে দিয়েছিল। আমি তোমাকে দোষ দিই না, মা। পরিস্থিতি মানুষকে অনেক কিছু করতে বাধ্য করে। কিন্তু আমিও তো তোমারই সন্তান। তোমার একটুখানি স্নেহের জন্য আমার ভেতরটা হাহাকার করত।
যাই হোক, আমি তোমাকে শেখবাড়িতে তোমার রানির আসনে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছি। কারণ দিনের শেষে তুমি শেখবাড়ির কর্ত্রী, আর আমার মা। তোমার সম্মান রক্ষা করা আমার দায়িত্ব ছিল। আশা করি, রাহাত তোমাকে সেই সম্মান দেবে। আমি দূর থেকে তোমার খোঁজ নেব। ভালো থেকো, মা।
রিয়া,
তোমাকে কী বলব, আমি জানি না। আমাদের ভালোবাসাটা হয়তো সত্যি ছিল, কিন্তু আমাদের ভাগ্যটা ছিল না। যে বিশ্বাস আর ভরসার উপর একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে থাকে, সেই ভিত্তিটাই তুমি নাড়িয়ে দিয়েছিলে। আমি তোমাকে দোষারোপ করে ছোট করতে চাই না। হয়তো তোমার দিক থেকেও কোনো বিষন্নতা ছিল। ডিভোর্স পেপারে তোমার সইটা দেখে বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আমি জানি এটাই আমাদের দুজনের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। জোর করে ধরে রাখা সম্পর্কের চেয়ে সম্মানের সাথে বিচ্ছেদ শ্রেয়।
তোমার জন্য কিছু টাকা পাঠিয়েছি। এটাকে আমার করুণা ভেবো না। এটা আমার শেষ দায়িত্ব। আমি চাই তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াও, নতুন করে জীবনটাকে সাজাও। তোমার জন্য আমার কোনো অভিযোগ নেই, শুধু শুভকামনা রইল।
গফুর চাচা,
আপনি আমার বাবার মতো। যে সময়ে আমার নিজের লোকেরাও পর হয়ে গিয়েছিল, তখন আপনি আগলে রেখেছিলেন। আপনার ঋণের কথা আমি এই চিঠিতে লিখে শেষ করতে পারব না। আমি জানি, আমার সিদ্ধান্তে আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন। আপনি ভাবছেন, আমি সবাইকে ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছি।
পালিয়ে যাচ্ছি না, চাচা। আমি মুক্তি খুঁজছি। আমার মা, রিয়া—এরা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ। কিন্তু এদের দিকে তাকালে আমার শুধু মনে পড়ে যায় বঞ্চনা আর প্রতারণার কথা। এই স্মৃতি নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না। আমার ভেতরের মানুষটা মরে যাবে। তাই আমার এই দূরে যাওয়া। পিছুটান না রাখার জন্যই আমি রিয়াকে ছেড়ে দিয়েছি, মাকে তার সম্মানের জায়গায় রেখে এসেছি। কারণ আমি জানি, এরা আমার সাথে থাকলে আমি সারাজীবন অতীতের ক্ষতেই আটকে থাকব। আপনি আমার পরিবারকে নিয়ে এই ফ্ল্যাটে থাকবেন, এটাই আমার শান্তি। আপনি ভালো থাকলে, আমি বুঝব আমার এখনো কেউ আছে।
বিদায়।
ইতি,
রাফিদ।
চিঠিটা খামে ভরে রাফিদ সেটা যত্ন করে রেখে দিল।
বিকেলে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় তার ভেতরটা অদ্ভুতভাবে শান্ত ছিল। গাড়িতে গফুর চাচা আমার পাশে বসে ছিলেন। তার চোখ দুটো ফোলা।
গফুর চাচা এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।
এয়ারপোর্টে পৌঁছে একটা অপ্রত্যাশিত দৃশ্য অপেক্ষা করছিল রাফিদের জন্য। গফুর চাচার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিয়া। পরনে সাধারণ একটা সালোয়ার-কামিজ, মুখে কোনো প্রসাধন নেই। চোখ দুটোয় রাজ্যের বিষণ্ণতা, কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই। এই প্রথমবার সে রাফিদের একটা কথা রেখেছে। বিদায় দিতে এসেছে। রাফিদ গফুর চাচাকে বলে দিয়েছিলো রিয়া যেনো শেষ বারের মতো একবার এয়ারপোর্টে আসে।
রাফিদ গাড়ি থেকে নামল। রিয়া কয়েক পা এগিয়ে এল। কোনো কথা হলো না। দুজনের চোখেই ছিল হাজারো না বলা কথার ভিড়। রিয়ার চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। সে আঁচলে মুখ ঢাকল।
রাফিদ গফুর চাচার দিকে এগিয়ে গিয়ে চিঠিটা তার হাতে দিল। “চাচা, এটা রেখে দিন। আমার ফ্লাইট কল করার পর পড়বেন। আর সাবধানে থাকবেন।”
গফুর চাচা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। “নিজের খেয়াল রেখো, বাবা।”
এরপর রাফিদ শেষবারের মতো রিয়ার দিকে তাকাল। মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। রাফিদ শুধু আলতো করে মাথা নাড়ল, যার অর্থ হয়তো ছিল—’ভালো থেকো’।
তারপর আর পেছনে না তাকিয়ে সে ঢুকে গেল ডিপারচার লাউঞ্জের দিকে। কাঁচের দেয়ালের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি বিষণ্ণ মুখকে পেছনে ফেলে শেখবাড়ির বড় ছেলে এগিয়ে চলল এক নতুন জীবনের পথে।
বিশাল প্লেনটা যখন রানওয়ে ছেড়ে আকাশে উড়ল, রাফিদ জানালা দিয়ে নিচের ঝাপসা হয়ে আসা ঢাকার দিকে তাকাল। এই শহর তার কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, আবার অনেক কিছু শিখিয়েছে। আজ সে সব হিসেব চুকিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
তার মনে কোনো রাগ নেই, ক্ষোভ নেই। আছে শুধু একরাশ মুক্তি। নির্বাসিত রাজপুত্র আজ স্বেচ্ছায় তার রাজ্য ছেড়ে যাচ্ছে, নতুন এক সাম্রাজ্য গড়ার জন্য। যে সাম্রাজ্যের ভিত্তি হবে আত্মসম্মান, পরিশ্রম আর স্বাধীনতা।
সমাপ্ত