#পরিণয়
#চতুর্থ_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা
জ্যেঠু আর কাকুদের সাথে গ্রাম ঘুরে এসেছে নয়না। তাঁদের কাছ থেকে শুনেছে একটি স্কুল তৈরি করতে কী কী করতে হবে। কিছুটা নয়না নিজেও জানে। তবে এখন পরিবারকে পাশে পেয়ে অনেকটা আশার আলো দেখছে সে। গ্রামের বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই এক এক করে দেখা করে গেছে গ্রামের নতুন অথিতির সাথে। নয়না এখানে এসে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সন্তানের মতো আগলে রেখেছে পরিবারের সকলে।
জ্যেঠু-জেঠিমার দুই ছেলে। বড়ো কাকুর এক ছেলে, ছোট কাকুর এক মেয়ে। ভাই-বোনেদের যখন অনেকদিন পর একসাথে দেখা হয় তখন কত আনন্দ হয়। নয়নার মনেও হচ্ছে না সে আজ এই প্রথম ওদের দেখলো। কত আপন করে নিয়েছে সবাই।
… আচ্ছা ঋষভ, তোর কী মনে হয়? সুজয় বাবু আর নয়নার ব্যাপারে?
… দেখ শ্রী, ভালোবাসার অনেক রূপ হয়।
… যেমন?
… সম্মান, দায়িত্ব, এফোর্ট আর বন্ধুত্ব। আমাদের ভালোবাসার রূপ হলো বন্ধুত্ব। সেখান থেকেই শুরু সব কিছু।
… আর নয়না সুজয় বাবুর?
… সেটা সময় বলবে। সুজয় বাবুর সাথে নয়না অ’ন্যায় করেছে, কিন্তু তারপরেও সুজয় বাবু ওকে যথেষ্ট সম্মান করে। আজ যাচ্ছে নয়নার কাছে।
নয়না যেদিন এই এফোর্টটার কথা বুঝবে, সেদিন ও না ভালোবেসে থাকতে পারবে না।
… নয়না তোকে কোনোদিন কিছু বলে নি?
… হুম বলেছিল একবার। যেদিন তোর বিয়ের দিন ছিল, আর আমি ভীষণ আপসেট হয়ে ঘরে বসে ছিলাম, ও সেদিন সুজয় বাবুর ব্যাপারে একটা কথা বলে ছিল।
… কী বলে ছিল?
… বলে ছিল, সুজয় বাবু ভীষণ ভালো মানুষ।
… ব্যস? শুধু এইটুকুই?
… একটা কথা ভেবে দেখ, ওদের দেখা হয়েছিল মাত্র ৩ বার। ওইটুকু সময়ের মধ্যেও নয়না বুঝে গিয়েছিল সুজয় বাবুর ব্যবহার দেখে, মানুষটা কেমন।
… কেন যে নয়না এমন বোকামি করলো?
… হয়তো জীবন অন্য কিছু চাইছে। সব কিছু সহজে মিলে গেলে ভালো লাগে না। মনে করে দেখ আমরা এত কাছাকাছি থেকেও কেউ কোনোদিন মনের কথা বলতে পারিনি।
… আমার কী মনে হয় জানিস ঋষভ?
… কী?
… সব কিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় বাঁধা আছে। তার আগে কিছুই হবে না।
… যা চা কর। সকালে আমি বানিয়ে ছিলাম। এবার তোর পালা।
… যাচ্ছি। তুই একবার করে সুজয় বাবুকে ফোন করে খবর নিস। নয়না তো ফোনই ধরছে না।
বিকেল বেলা বেরিয়েছিল নয়না। একটু একা একা ঘুরতে। একজন মাঝ বয়ষ্ক ভদ্রলোক এসে বললেন, আপনি নয়না?
নয়না বেশ অবাক হয়ে বললো, হ্যাঁ।
ভদ্রলোক বললেন, শহর থেকে গ্রামে এসেছেন ঘুরতে, ভালো করে ঘুরুন দিয়ে চলে যান। এই গ্রামের মধ্যে স্কুল বানানোর কথা ভুলে যান। পাশের গ্রামে স্কুল তো আছেই। সেখানেই ছেলে মেয়েরা যাবে পড়তে।
নয়না বললো, সে তো অনেক দূর। বর্ষায় অনেক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের।
ভদ্রলোক বললেন, এটাই তো বছরের পর বছর হয়ে আসছে।
নয়না বললো, সেটা তো আজীবন হয়ে যাবে, তার তো কোনো মানে নেই। তাছাড়া জায়গাটা আমার। আমি কী করবো না করবো সেটা আমার ব্যাপার।
ভদ্রলোক মেকি হাসি হেসে বললেন, জায়গাটার ভালো দাম পাবেন কিন্তু। ভালো করে ভাবনা-চিন্তা করুন।
কথাটা বলেই ভদ্রলোক চলে গেলেন।
আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নয়না ছাতা নিয়ে আসে নি। এখান থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই ভিজে যাবে। পিছনের দিকে একটি বড় গাছ আছে, সেখানে যাবে বলে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে চমকে উঠলো নয়না। সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুজয় বাবু।
… কী হলো? ভূত দেখলে নাকি? চোখ – মুখের এ কি অবস্থা?
… আপনি… মানে আপনি এখানে? কী ভাবে?
… না ভাবলাম, যে মেয়ে বিয়ের মণ্ডপে আমাকে বিয়ে না করে প্রেমিকের কাছে চলে যায়, তার প্রেমিককে একবার দেখবো না?
… প্রেমিক.. হ্যাঁ হ্যাঁ প্রেমিকই তো।
… আরে এত আমতাআমতা করছো কেন? সেই নয়না কোথায়? যে বিয়ের মণ্ডপে বলেছিল, আপনাকে আমি বিয়ে করতে পারবো না, আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।
নয়নাকে চুপ করে থাকতে দেখে সুজয় আবার বললো,
আরে চুপ করে আছো কেন? এত দূর থেকে এলাম। প্রেমিকের সাথে দেখা করাবে না?
আরে দেখেছ কথা বলতে বলতে খেয়ালই নেই, তুমি তো ভিজে গেলে।
কথাটা বলেই সুজয় নিজের ছাতাটা এগিয়ে দিল নয়নার দিকে। নয়না বললো, আমি ঠিক আছি।
সুজয় এবার নয়নার অনেকটা কাছে গিয়ে বললো, ঠিক তো থাকতেই হবে, সামনে এত বড় কাজ।
নয়না এবার সুজয়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো, বড় কাজ মানে?
সুজয় বললো, আরে নতুন সংসার গোছাতে হবে না তোমাকে, তাই বললাম। চলো এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে দুজনেই ভিজবো, একটা ছাতাতে কিছুই হবে না। তার চেয়ে বরং ওই গাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়াই।
নয়না বাধ্য মেয়ের মতো সুজয়ের কথা শুনে গাছটির দিকে এগিয়ে গেল, একটা ছাতাতে দুজনে মিলে। নয়নার মনে অনেক প্রশ্ন। তবে হঠাৎ সুজয়কে দেখে হার্টবিট খুব ফাস্ট হয়ে গেছে। বুকের ভিতরে ধুকপুক শব্দ যেন নয়না নিজে শুনতে পাচ্ছে।
গাছের নীচে এসে দাঁড়ালো দুজনে। বৃষ্টির পরিমাণ আরও বাড়লো। নয়না গুটিসুটি মে রে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সুজয়ের থেকে এক হাত দূরে। সুজয় তাকালো নয়নার দিকে, তবে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। অবাধ্য বৃষ্টি এসে নয়নাকে যেন জোরপূর্বক ভিজিয়ে দিয়েছে। চুল থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা। একটা ভ য়ে যেন নিজেকে ঢেকে রেখেছে সে। এই ভ য়ের কারণ সুজয় জানে। অনেক জবাবদিহির বাকি আছে।
আবারও নয়নার দিকে তাকালো সুজয়। এবার দুজনের চোখে চোখ পড়লো। সুজয় যেন অনেক অধিকার নিয়ে বললো, আমাকে আগে বলা যেত না কথাটা?
নয়না চোখ নামিয়ে নিল। সে জানে নিজের অপরাধ।
সুজয় গলার আওয়াজ একটু জোর করে বললো, চোখ নামিয়ে নিলেই কী আমি চুপ করে যাবো? আমাকে আজ সব প্রশ্নের উত্তর তোমায় দিতে হবে। বিয়ের মণ্ডপ থেকে যখন বের করে নিয়ে এলাম, তখন তো সময় ছিল। দুজনে একসাথে অনেকটা সময় ছিলাম। তখনও বলা যেত না? কী মনে করেছিলে, একটা মিথ্যে বলে আমার কাছে নিজেকে ঘৃণার মানুষ বানিয়ে সরে যাবে? আর আমি সহজে যেতে দেবো তোমায়?
শেষের কথাটা শুনে নয়না চোখ তুলে তাকালো। আজ পর্যন্ত কেউ নয়নাকে অধিকার দেখিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেনি। আর সুজয়, যে নয়নাকে কয়েকমাস হলো দেখেছে, সে ধরে রাখার কথা বলছে?
… কী হলো চুপ করেই থাকবে?
… আমার ঠিকানা পেলেন কীভাবে?
… সেটা পরে জানলেও হবে। আমি একটা কথা শুধু জানতে চাই।
… কী?
… আমাকে ভরসা করা যেত না?
… আমি কারোর বোঝা হতে চাইনি সুজয় বাবু। আপনি খুব ভালো মানুষ, তা আমি বুঝেছি আগেই। আমার স্বপ্নের কথা, আপনাকে বললে আপনি নিশ্চয় আমার সাথে থাকতেন। কিন্তু এই কাজটা এত সহজ নয়। তাই আপনাকে জড়াতে চাই নি। আরও একটা কারণ আছে। আমি সম্পর্কে এতটাও লাকি না আমি। একজনকে আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিলাম। পরে বুঝলাম সেই মানুষটা আমার না। সরে এলাম। তবে সে অনেক ভালো ছেলে। কিন্তু সব কিছু ভুলে এত তাড়াতাড়ি নতুন করে কোনো সম্পর্কে জড়ানো সহজ ছিল না আমার কাছে। তার প্রতি আমার সেই অনুভূতি নেই। তবে কেমন যেন একটা ভ য় কাজ করে।
… কীসের ভ য়?
… ছেড়ে যাবার। ছোটবেলায় মা-বাবা ছেড়ে গেছেন। বড়ো হবার সাথে সাথে অনেককে হারালাম। পাশের বাড়ির এক দাদুকে, যিনি রোজ আমায় গল্প বলতেন। মাছ বিক্রি করতে আসা সেই মাসিকে, যিনি আমার জন্য একটা করে ফুল নিয়ে আসতেন। আরও অনেকে…. আমি এই দু’হাতে কাউকে আঁকড়ে রাখতে পারিনি।
নয়নার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো….
সুজয় নয়নার চোখের জল মুছিয়ে বললো, আমি যাবো না, কোথাও যাবো না, তুমি যত খুশি বাহানা দিয়ে আমাকে দূর করার চেষ্টা করো, আমি যাবো না।
হঠাৎ জোরালো বাতাসের সাথে বৃষ্টি এসে আরও ভিজিয়ে দিল দুজনকে। তবে দুজনের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে দুজনে।
জ্যেঠু বললেন, ভিজে গেছ তো পুরো। এই অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজলে শরীর খা’রাপ হবে বাবা।
সুজয় বললো, গাড়িতে জামা প্যান্ট আছে, আমি চেঞ্জ করে নেবো।
জ্যেঠু আবার বললেন, বাইরে কোথাও থাকতে হবে না। আমার বাড়িতে থাকবে। তুমি নয়নার বন্ধু। এই বাড়িতেই থাকো, নিজের মনে করে।
সুজয় বললো, না না, আমার এখানের থানাতে কিছু কাজ আছে, দুদিন পরেই আমি ফিরে যাবো কলকাতায়, তবে মাঝেমধ্যেই আসবো কোনো খবর না দিয়ে।
শেষের কথাটা বলেই নয়নার দিকে তাকালো সুজয়। নয়না চোখ নামিয়ে নিল, হয়তো লজ্জায়।
জ্যেঠু বললেন, সে ঠিক আছে, তবে এই বাড়িতেই তুমি থাকো, যখন আবার আসবে এই বাড়িতেই উঠবে। নয়নার দুই কাকুও সেই একই কথা বললেন।
সুজয় আবার তাকালো নয়নার দিকে। নয়না বললো, এত করে সবাই বলছে যখন, এখানেই থাকুন।
মেঘ এখন পরিষ্কার। আকাশ আর দুজনের মনেও। রাত্রি এখন ৮ টা… সুজয় ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশে চারিদিক তারা। মন বলছে, যে ভাবেই হোক নয়না আসবে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, নয়না এলো।
চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বললো, রাতের খাবার খেতে দেরি হবে। এখন গরম চা খান, এমনিতেও অনেক ভিজেছেন আজ।
সুজয় মুচকি হাসলো। সেটা অন্ধকারে নয়না দেখতে পেল কিনা জানে না। চায়ের কাপটা নিয়ে বললো, তুমি বানিয়েছো?
নয়না বললো, হ্যাঁ।
সুজয় চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাবে এমন সময় নয়না বললো, আপনি কী করে এত কিছু জানলেন?
সুজয় বললো, পুলিশের লোক তো, তাই সব খবর থাকে।
নয়নার উত্তরটা যেন ঠিক পছন্দ হলো না, মুখে বললো, ওহ আচ্ছা।
সুজয় মনে মনে ভাবলো এখনই ঋষভ আর সোমাশ্রীর কথা বলা যাবে না। একটু ভাবুক নয়না।
নয়না বললো, আপনি চা খান, আমি আসছি।
নয়না এগিয়ে গেল, পেছন থেকে সুজয় বললো, আমি এখানে থাকলে তোমার অসুবিধা নেই তো?
নয়না বললো, না না আমার অসুবিধা কেন হবে?
সুজয় সাথে সাথে বললো, তাহলে এখানে তুমি কিছুক্ষণ বসে থাকলেও অসুবিধা হবে না তোমার? তাই না?
নয়না মনে মনে হাসলো। কিছুটা দূরত্ব রেখে বসলো নয়না। সুজয়ও বসলো। আকাশের চাঁদ আর অসংখ্য তারা সাক্ষী থাকলো এই মুহুর্তের। আগামীর এক গল্পের।
চলবে…
ভুল ত্রুটি মার্জনীয় 🙏