তুমি থেকো দাঁড়িয়ে খোলা বারান্দায় পর্ব-০১

0
2

#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০১

“আমি তোমাকে গোলাপ দিলাম আর তুমি কি-না আমাকে চুমু দিলে মেয়ে?- সেইম অন ইউ!”

বাহারাজের গলায় স্পষ্ট প্রকাশ পেল হিংস্র প্রতাপ।‌ কুঁচকানো ভ্রু-র সাথে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন চাইছে এর জবাব। উচ্চতার কারণে হাঁটুতে পড়েছে বিশাল এক ভাঁজ। ডানহাতে শুভ্র রাঙা গোলাপটা মুঠো করে, বামহাতে ঢেকে নিলাম নিজের দু’চোখ। ইশ্! কি লজ্জাজনক পরিস্থিতি‌। মনের বদ্ধ কুটিরে কথার ফুলঝুরি সাজিয়ে মাথা খাঁড়া করতেই কর্পূরের মতো উবে গেল। জালার থেকে এক টুকরো রোদ বাড়ি খাচ্ছে বাহারাজের ধূসর চোখে। খানিক অপ্রস্তুত হয়ে পড়তেই ফের ধমকে উঠল, “আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের দিকে আড়চোখেও আমি তাকাইনি, চুমু তো বহুদূর। তুমি আমার কুমারীত্ব নষ্ট করেছ, এর কি শাস্তি চাও?”

হাঁসফাঁস আরম্ভ হলো আমার। এই দুরাবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ ফাঁক করে যক্ষ্মা রোগীদের মতো শ্বাস টেনে বললাম, “আমি ইচ্ছে করে করেনি।”

“করোনি? করেছ! এখন আমার গোলাপ আমায় ফেরত দাও, তোমার চুমু তুমি ফেরত নাও।” বাহারাজের লাগামছাড়া কথায় কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো আমার। আমতা-আমতা করে বললাম, “মানে? ফেরত নিব কীভাবে?”

বাহারাজ প্রত্যুত্তর দেওয়ার পূর্বেই তার বন্ধু তীব্র নম্র গলায় বলল, “মেয়েটাকে যেতে দে, পেছনে লাইন বাড়ছে। তাছাড়া স্যার আছে পেছনে।”

“যে কাজটা করেছে, ওরে এত সহজে ছেড়ে দিব।”

“বলেছি ছেড়ে দিতে। পরে ওর স্পেশাল ক্লাস নিব। তাছাড়া এখন অনেক কাজ আছে।” রুদ্র বলল।
বাহারাজ ক্ষান্ত হলো না। তবুও চুপচাপ বাধ্য ছেলের মতো আপাতত সবকিছু হজম করে নিতে হলো। নবীনবরণে আমাকে দেওয়া ফুলটা অবলীলায় কেড়ে নিল। বিপরীত হাত দিয়ে লাগাতার গালে ঘষতে লাগল। সে হাতে ছিল বেশকয়েকটা শুভ্র গোলাপ। বিলম্বে স্থানটা লালচে রূপ ধারণ করল। যেন গোলাপের কাঁটাগুলো ফুটে গেল। দ্বি মুহুর্তে ফুলগুলো তীব্রর দিকে ছুড়ে দিয়ে ধপাধপ পা ফেলে চলে গেল। তীব্র কেচ করে নিল, অতঃপর বাকিদের বরণ করে নিতে লাগল।

করিডোর দিয়ে হেঁটে নির্জন প্রান্তে এসে দাঁড়ালাম। তরতর করে ওষ্ঠদ্বয় বিরামহীন কাঁপছে। রেলিংয়ের ওপর হাত রেখে মুক্ত হাওয়াতে নিঃশ্বাস ফেললাম। ভার্সিটিতে পা রেখে এমন অজানা এক অনুভূতির সম্মুখীন হয়েছি, যে অনুভূতি কাল অবধি আমার নাগাদ ছুঁতে পায়নি। দৃশ্যপট থেকে নিজেকে বের করে আনা মহা মুশকিল। আমি কল্পনা জল্পনা নিয়ে বিভোর এমন সময় আমার জানে জিগার ‘ঋতু, তাসফি, আহাদ ও জয়’ হাজির। রেলিং থেকে দুহাত বুকে গুজে বললাম, “হানিকে চ্যালেঞ্জ করা জেতা এত সোজা নয়। হানি সবার সেরা।”

“ডায়লগ পরে দিস, বাহারাজ ভাইকে লাঠিসোটা নিয়ে ক্যান্টিনে কাউকে খুঁজছে দেখেছি। মনে হচ্ছে তোকে খুঁজছে। একবার পেলে তোর জিওগ্রাফি চেঞ্জ করে ফেলবে দোস্ত। ভালো চাইছে দ্রুত পালা।” ঋতু ঝরঝর করে বলে ফেলল। অ্যাহ্! শব্দটা অজান্তেই নির্গত হলো মুখ থেকে। বড্ড সাহসের কাজ তুই করে ফেলেছিল হানি, এবার ভাগ। ততক্ষণে নিচ থেকে বাহারাজের ডাক কানে পৌঁছেছে আমার, “ওই ওখানে দাঁড়া, পালাবি না। আমি আসছি।”

তাসফি স্বশব্দে চ্যাঁচিয়ে বলল, “তোর মনে ভয়ডর নেই? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? পালা।”

আমার মস্তিষ্ক ১৮০° অ্যাঙ্গেলে ঘুরে গেল। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম ঘুরেও পালানোর পথ খুঁজে পেলাম না। হকচকিয়ে বললাম, “কিছুই তো চিনি না, কোনদিকে ছুটব? তাছাড়া নিউ ইয়ারদের জন্য এত সুন্দর আয়োজন করেছে। স্যারদের উপদেশ শুনব না?”

চোখ পড়ল পেছন দিকের সিঁড়ির পানে। পায়ের গতি বাড়িয়ে উলটো পথে ছুটলাম। অনেক ক্লাস করেছি, আগামী এক সপ্তাহ আমার নাগাল কেউ পাবে না। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের ভিড়ে হাঁটা মুশকিল। বিশেষ করে পেছন দিকে কপোত কপোতী। বেচারামুখে ফিরে আসতেই বাহারাজকে দেখলাম দলবল নিয়ে এদিকে যেন আসছে। শার্টের উপরের দুই বাটন খোলা, হাতে মোটা লাঠি, বাবরি চুলগুলো, চোখজোড়া এদিকওদিক খুঁজে চলেছে প্রত্যাশিত কিছু। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। তার ওর রূপ যেন- ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। আমি দেয়ালের একপাশে সেঁটে পিঠ দেখিয়ে দাঁড়িয়ে মনে মনে বেচারা পতির জন্য মনস্তাপ করছি। ততক্ষণে যুবকের দল পাশ কেটে চলে গেছে। উল্কার বেগে ভার্সিটি প্রস্থান করতে ব্যস্ত হলাম। এর মাঝে পড়লে আজ আমার রক্ষা ছিল না। পলায়নের মাঝে নিজের পরিচয়টা সংক্ষিপ্ত পরিসরে দিয়ে নেই।
আমি মিমিয়া মাহাতো হানি। কলেজ জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে ভার্সিটি জীবনে পা রেখেছি। পড়াশোনা শেষ করে ভার্সিটি জীবনে চিল করব সে আশা নিরাশা করে এখন বাহারাজের ভয়ে ছুটছি। পড়াশোনায় বরাবরই আমি ভালো। পড়াশোনায় বাইরে চ্যালেঞ্জ ধরা আমার নেশা। পরিবারের ছোট সদস্য হওয়ার সুবাদে কোনো বিষয়ে/সিদ্ধান্তে অটল থাকা আমার ব্যাধি।
আজ প্রথমদিন ভার্সিটিতে ঢুকার পূর্বে ঋতু ছুঁড়ে দিল বিশাল এক চ্যালেঞ্জ, “শুনেছি সিনিয়ররা ফুল দিয়ে নবীনদের বরণ করে নেয়। আজ আমাদেরও সিনিয়ররা বরণ করে নিবে।”

আমি চতুর্দিকে দৃষ্টি মিলিয়ে শুধালাম, “এর আর নতুন কী? আমাদের জন্য নিশ্চয়ই প্রাইম মিনিস্টার এসে ফুল দিবে না।”

তাসফি ভেবে বলল, “ঋতু তুই এমন কোনো পুরষ্কারে জয়ী হোস নি যে, তোকে বরণ করতে বাইরে থেকে লোক আসবে। জাস্ট নবীনদের স্বাগত জানিয়ে দিনটিকে স্বরণীয় করে রাখতে এই আয়োজন।”

“হয়েছে এত জ্ঞান দিতে হবে না। আমি সব জানি। আমি জাস্ট হানিকে একটা চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি।” কথাটা বলে মুখ ফিরিয়ে নিল ঋতু। আমার ভ্রু সরু হয়ে এলো। আপু বারংবার শাসিয়েছে, প্রথমদিন যাতে ঝামেলা না করি। সিনিয়ররা একবার পিছু পড়লে ছাড়ানো মুশকিল। তাই বললাম, “আজ এইসব বাদ দে।”

“ভয় পেয়েছিস?”

“চ্যালেঞ্জ নিবি না সা/লা। হানি সবার সেরা।”

“ওকে! তোর চ্যালেঞ্জ, যে সিনিয়র তোকে ফুল দিবে তুই তাকে চুমু খাবি।”

“ডান।” অতঃপর সবাই মিলে ভার্সিটির ভেতরে গেলাম। প্রবীণ শিক্ষার্থীরা নবীনদের জন্য ঝরা ফুল ও গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। খানিকটা এগিয়ে যেতেই শর্ক খেলাম। মেয়ে হবে ভেবে চ্যালেঞ্জ জেতাটা যতটা সহজ ছিল, ষষ্ঠগুণ বেড়ে গেল এবার। ফাঁকা ঢোক নেমে বেয়ে নেমে গেল। আইডি কার্ডের মাঝে জ্বলজ্বল করছে ‘BAHARAJ’। বাহারাজ না তাকিয়েই ফুলটা তুলে এগিয়ে দিল। নিতে গিয়েও আলগা করে ছেড়ে দিলাম। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে যেইনা ফুলটা তুলতে গেল, অমনি তার গালেই ছোটো একটা চুমু খেয়ে ফেললাম। অতঃপর ফুলটা তুলে যক্ষ্মা রোগীদের মতো কাশতে লাগলাম।
__

ভার্সিটির রাস্তার বিপরীত রাস্তায় এসে বাহারাজ ও তার বন্ধুদের সাক্ষাত পেলাম। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই আমার সন্ধ্যা হলো। তিন হাত দূরে রাস্তার মাঝে কাউকে মা/র/ধর করছে তারা। আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে এগিয়ে গেলাম। ভিড় জমে গেছে ইতোমধ্যে। ততক্ষণে আমার বন্ধুমহল এসে পৌঁছেছে সেখানে। জয় হাঁপিয়ে বলল, “তুই এখানে? আমরা তোকে ভার্সিটি চত্ত্বর খুঁজে ফেলেছি। বাহারাজ ভাই লাঠিসোটা নিয়ে তাহসানকে খুঁজছিল, তোকে নয়।”

হাফ ছাড়লাম। এদের সাথে থাকলে আমার মৃ/ত্যু অনিবার্য। বাহারাজের হিম্মত আছে বলতে হবে, ব্রহ্মচারী অথচ মা/রপি/টে পারদর্শী। এরূপ একটা বয়ফ্রেন্ড থাকলে ভার্সিটিতে আমার রাজত্বই চলত।
এমধ্যে রুদ্র হাত নাড়িয়ে বলল, “এখানে কী? ভার্সিটির ভেতরে যাও।”

এই ছেলেটাই তো স্পেশাল ক্লাসের কথা বলেছে। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। উপায়ান্তর না পেয়ে ফিরে এলাম। জায়গা না থাকায় সবার পেছনে দাঁড়াতে হলো। অমনোযোগী শিক্ষার্থীদের কথোপকথনে কিছু শোনা যাচ্ছে না। প্রতিটা বিভাগের শিক্ষকেরা তখন বক্তব্য রাখছেন।‌ আমার গলা ফাটিয়ে কাঁদছে ইচ্ছে করছে। এই দিনটাকে নিয়ে কত স্বপ্ন আমার, অথচ সব ঘেঁটে ‘গ’ হয়ে গেছে। বাহারাজসহ সিনিয়ররা ছোটো প্যাকেট বিতরণ করতে করতে এদিকেই এগিয়ে আসছে।

চলবে… ইন শা আল্লাহ