তুমি থেকো দাঁড়িয়ে খোলা বারান্দায় পর্ব-০৩

0
2

#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৩

“হানি, তোর জামা ছিঁড়ল কীভাবে? যাচ্ছেতাই অবস্থা। নতুন ভার্সিটিতে গিয়েও মারামারি করেছিস?” আমার বড়ো বোন হিয়া স্পষ্ট গলায় বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ জানতে চাইল। আমি সৌজন্য হেসেও বিষয়টা এড়িয়ে যেতে পারলাম না। এই সময়টা সে অতিবাহিত করে ফেলেছে ইতোমধ্যে। আমি অলস গলায় বললাম, “বিশ্বাস কর, আমি ইচ্ছে করে করিনি। ও টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে।”

“আই নো, নো ওয়ান ইভার টেয়ারস হিজ ক্লোথ। বাট হোয়াট হ্যাপেন্ড?” আপুর থেকে লুকাতে পারলাম না একটি বর্ণও। মায়ের শাসন থেকে রক্ষার্থে নিজের কক্ষে নিয়ে এলো। দরজার ছিটকিনি তুলে বলল, “তোকে এতদিন আমি কী বুঝিয়েছি? তুই সেই ভুলটাই করলি। এখন কী হতে পারে, ধারণা আছে?”

“কী হবে?”

“আমার বান্ধবী রিমিকে চিনিস? ও র‍্যাগিং এর প্রতিবাদ করার কারণে ওকে ধর্ষণ করা হয়েছিল! এজন্য ফাস্ট ইয়ারে নিবিড়ের সাথে প্রেম শুরু করেছি। যাতে সিনিয়রের গার্লফ্রেন্ড হওয়ার কারণে র‍্যাগিংয়ের শিকার না হতে হয়।” আপুর কথায় শরীরে অসহনীয় কম্পন শুরু হলো। বাহারাজের শেষ মুখশ্রীটা বারবার ভয়ানক কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমার সাথে এমন কিছু হবে নাতো? ভীষণ কাবু হয়ে আওড়ালাম, “আপু, আমাকে বাঁচা প্লীজ।”

“আমি নিবিড়ের ভাইয়ের সাথে কথা বলে তোকে ইনসিউর করব আর তুই কাল ওই ছেলের কাছে গিয়ে সরি বলবি।”

“ও সবার সামনে আমার জামা ছিঁড়েছে, ওকে আমি সরি বলব না।”

“তুই আগে ওর শার্ট ছিঁড়েছিস। ও নিশ্চয়ই তোকে আদর করে চুমু খাবে না। ড্রেস চেঞ্জ করে নিজেকে থার্ড পারসন ভেবে দৃশ্যটা কল্পনা কর, উত্তর পেয়ে যাবি।” আপু ছিটকিনি নামিয়ে চলে গেল। ১৮ বয়সকালে কারো কাছে সরি বলিনি। বাহারাজ সে মানব যাকে সরি বলেছি। আমি যথেষ্ট তর্ক বাদী হয়েও বাহারাজের গায়ে হাত কেন দিলাম। এটা মোটেও ঠিক হয়নি।
____
সকালটা দারুণ। আজ রিকশা পাইনি বিধায় হেঁটে যাচ্ছি রাস্তার ফুটপাত দিয়ে। পাপা বলেছে, ভার্সিটিতে ভর্তির পর স্কুটি কিনে দিবে, কিন্তু হাতে পেতে আরো একদিন লাগবে। পরনে সাদা টপস্ ও কালো জিন্স। চুলগুলো ওপরে তুলে ভাঁজ করে তুলি দিয়ে বাঁধা। উদ্দেশ্য ভার্সিটিতে পৌঁছে বাহারাজকে সরি বলা। মিনিট তিনেকের মাথায় ভার্সিটিতে পৌঁছে গেলাম। প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে আজ বাহারাজের দেখা পেলাম না। অথচ এই স্থানটা তার। আমি সিমেন্ট ও বালি দিয়ে বাঁধাই করা আস্তরনে বসলাম। একপা মাটিতে ও একপা আসনে। উপরের পায়ের ওপর হাত রেখে জিৎ এর বস স্টাইলটা অনুসরণ করলাম। বাহারাজ এখানে এই ভঙ্গিতে বসে র‍্যাগিং করে। তৎক্ষণাৎ ফাস্ট ইয়ারের ছাত্র ছাত্রীরা ক্লাসে যাওয়ার সময় বিনীত শ্রদ্ধায় সালাম দিল। অন্তঃকরণে হানা দিল আ’ম দা বস। দিব্যি চলছিল এই সম্মানটা। কিন্তু মিনিট পাঁচেক বাদে বাহারাজ এলো বন্ধুদের নিয়ে। বিনীত সুরে বলল, “আসসালামু আলাইকুম জুনিয়র।”

প্রথম শব্দে সন্তুষ্ট হলেও পরক্ষণে আঁধার নেমে এলো চোখমুখে। অবিলম্বে চোখ মেলে বাহারাজকে দেখলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “আপনি এখানে!”

“আপনাকে সম্মান দিতে এলাম। সালাম না দিয়ে চলে গেছিলাম।” বাহারাজ বাক্যের সমাপ্তি টানার পূর্বে দাঁড়িয়ে গেলাম। মাথা নত করে বললাম, “আ’ম সরি। কাল অমনটা করা ঠিক হয়নি।”

রুদ্র দৃঢ় গলায় বলল, “মধুর মাকে এত সহজে ক্ষমা করবি না।”

তীব্র প্রিঞ্চ করে বলল, “প্রতিদিন নিয়ম করে এক চামচ মধু খেলে ঠান্ডা লাগবে না। তাই শীত আসার আগে ওকে ক্ষমা করবি না।”

ত্যাড়া গলায় বললাম, “একদম আমার নাম নিয়ে ভ্যাঙাবেন না। হানি ডাকতে অসুবিধা হলে মিমিয়া বলে ডাকবেন।”

বাহারাজ আজ ওদের সাথে তাল মেলাল না। নির্লিপ্ত গলায় বলল, “তোমার সরি একসেপ্ট করতে পারব না।”

“কেন? কেন? কেন?”

“আমার ইচ্ছে।”

“কী করলে সরি একসেপ্ট করবেন?”

“তেমন কিছু না। এক ঘণ্টা কান ধরে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে!”

“না!” বাহারাজের শর্ত শুনে আপনাআপনি আমার মুখ থেকে নির্গত হলো শব্দটি। পরক্ষণে নিজেকে ধাতস্থ করে বললাম, “অন্য কিছু বলুন না। এটা আমি কখনো করিনি।”

“আমার বলার কথা, বলেছি। মানবে কি-না তোমার ইচ্ছা।” বলেই বাহারাজ পা বাড়াল। আপুকে কথা দিয়ে এসেছি, সরি বলতে হবে। এক ঘণ্টারই তো ব্যাপার। বাহারাজের পেছন পেছন হেঁটে বললাম, “ওকে। আমি কান ধরছি।”

রোদে দাঁড়িয়ে কান ধরলাম। আশেপাশের সবাই বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। কালকের তেজস্বী মেয়েটাকে ভেজা বেড়াল হতে দেখে হাসা অপরাধ নয়। বাহারাজ অজানা কারণে লাজুক হাসছে। অতঃপর অন্তরিক্ষে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “এখানে না ঠিক রোদটা লাগছে না। ছাদে চলো।”

প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে হিরহিরিয়ে ছাদের দিকে নিয়ে গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, কেউ আর দেখতে পারবে না। তার বড়ো বড়ো কদম আমার কাছে তিন কদমের সমান। দরজা খুলে ছাদে এসে দাঁড়ালেন। চারতলা থেকে ভার্সিটি চত্ত্বর ভীষণ মোহনীয় লাগছে। দমকা হাওয়া আর রোদ দুটোই বেশ লাগছে‌। ভাবনার মাঝেই তুরি বাজিয়ে বলল, “তোমাকে ভিউ দেখাতে নিয়ে আসিনি। দ্রুত কান ধরো।”

সৌজন্য হেসে কান ধরে বললাম, “হানির জন্য কত ছেলে দিওয়ানা জানেন? আপনি সেই হানিকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন?”

বাহারাজ দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। একপা একপা করে নিকটে এগিয়ে এলো। আমাকে কেন্দ্র করে ৩৬০° ঘুরে সমুখে এসে বলল, “এখানে তুমি আর আমি। এবার যদি অন্য ছেলেদের মতো আমিও তোমার প্রেমে দিওয়ানা হয়ে যাই। তবে…

বাফারাজের চোখের পলক স্থির। শূন্য আকাশে‌ ভয়ের আভা দূরদূরান্ত থেকে ভেসে আসতে দেখলাম আমি। এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে একমাত্র উপায় ছুটে পালিয়ে যাওয়া। সেই উদ্দেশ্য মোতাবেক আমিও দৌড় লাগালাম। তার পরবর্তী পদক্ষেপ যেন নখদর্পণে ছিল বাহারাজের। গতি রোধ করতে হাত দিয়ে আটকে দিল পথ‌। মোচড়ামুচড়ি করে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে আরম্ভ করলাম আমি। তিরতিরিয়ে ঘামগুলো জমতে শুরু হলো আমার। ফ্যাকাসে হয়ে এলো চোখমুখ। কাতর গলায় বললাম, “আমাকে ছেড়ে দিন বাহারাজ ভাই, প্লীজ। আপনার সব শর্ত আমি মানব। প্লীজ।”

“পরে দেখা যাবে ‘আমি আমি হা’, এখনকারটা এখন দেখি।” অতঃপর কিঞ্চিৎ শূন্যতা পূরণ করে কাছে এলো সে। চোখ জোড়া গ্ৰথন করে মনে মনে প্রভুকে ডাকছি। আমাকে বিভ্রান্ত করতে আচমকা বলে উঠল, “তোমার চুলের স্মেলটা সুন্দর। কোন ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু?”

আহাম্মক বনে গেলাম। পিটপিট করে চেয়ে বললাম, “এটা ন্যাচারাল।”

“বডির গন্ধটাও কি ন্যাচারাল?” বাহারাজের প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলাম। এত প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই বললেই চলে। চিলের দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ স্ক্যান করে বলল, “তুমি দেখতে আহামরি সুন্দর নয়। অতিরিক্ত ফরসা, অল্পতেই লাল হয়ে যাও। ডাগর ডাগর চোখ, তবে মেয়েদের টানা টানা চোখে ভালো লাগে। নাকটা বোচা, খাঁড়া হলে সুন্দর লাগতো। গোলাকার আকৃতির মুখমণ্ডল, এখনকার ফ্যাশন ভি আকৃতি। ফিগারটা দিপিকা পাড়ুকোনের মতো নয়, মোটামুটি। তাই তোমার সাথে ইয়ে করে আমার কুমারীত্ব নষ্ট করার আগ্রহ নেই।”

হাত ছেঁড়ে দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেল বাহারাজ। আমার শরীরটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে ছিল তার। হাত ছাড়তেই নিয়ন্ত্রণ হীন হয়ে ঠাস করে পড়লাম মাটিতে। চেয়ে রইলাম বাহারাজের গমন পথের দিকে। আমার মতো সুন্দরী মেয়ে কি-না তার কাছে সুন্দর নয়? দুহাত মুখমণ্ডলে রেখে আলতো হাত বুলালাম। আমি কি সত্যিই সুন্দর নই, হানি সবার সেরা নয়? নিজের দুঃখ বিলাপ করার এই দুঃসময়ে হাজির হলো ঋতুরা। আমাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে আহাদ বলল, “তুই এখানে পড়ে আছিস আর আমরা পুরো ভার্সিটি খুঁজে বেড়াচ্ছি তোকে? ক্লাসে কি যাবি না?”

নাক মুছে বললাম, “দোস্ত আমি কি সুন্দর না?”

চলবে… ইন শা আল্লাহ