#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৭
এক হাত ঘোমটা টেনে পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছি। মনের মনিকোঠায় জমে রয়েছে দুষ্টু মিষ্টি অনুভূতি। পরবর্তীতে যখন আমাকে দেখতে আসবে, তখন অভিজ্ঞতা থাকবে। নিবিড় ভাইয়ের মা মিসেস হাসি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “হিয়া ঘোমটা সরাও, তোমাকে একটু দেখি।”
চাপা হাসলাম আমি। পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য হাঁসফাঁস করে আলতো হাতে ঘোমটা তুললাম। লাজুক আভা তখন চোখমুখে বিরাজমান। বিলম্বে কাশির শব্দ কানে এলো। বিরতিহীনভাবে কাশির শব্দ চলছে ড্রয়িংরুম জুড়ে। আমি চোখ মেলে নিবিড় ভাইয়ের দিকে তাকালাম। কাশির প্রভাবে লালচে হয়ে এসেছে চক্ষুদ্বয়। বাকিদের চোখেও বিরাজমান স্তম্ভিত ভাব। হাসি আমার থুতনিটা তুলে বলল, “মাশাআল্লাহ। তোর পছন্দ আছে বলতে হবে নিবিড়। কী মিষ্টি দেখতে মেয়েটা!”
নিবিড় ভাইয়ের বাবা মাহবুব আলম খানিক কৌতূহল নিয়ে বলল, “হ্যাঁ। তবে বয়সটা বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ইন্টারে পড়ে।”
আমি লাজুক ভাবটা বৃদ্ধি করে বললাম, “সবাই তাই বলে।”
মিসেস হাসি আমাকে দেখে মাখনের ন্যায় গলে গেছে। পলকহীন চোখে কেবল দেখে যাচ্ছে আমায়। আড়চোখে বাহারাজের দিকে তাকালাম। তার নির্বিকার দৃষ্টি আমার থেকে নড়চড় হচ্ছে না। মিসেস হাসি জুয়েলারি বক্স থেকে জ্বলজ্বল করা হিরার রিং বের করে নিবিড় ভাইয়াকে দিলেন। মৃদু গলায় আদেশ দিলেন, “হিয়াকে পরিয়ে দে। মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে।”
নিবিড় ভাই বিস্ময় থেকে ছুটি পাচ্ছে না। হিরার রিংটা স্পর্শ না করে স্পষ্ট বলল, “কে তুমি? হিয়া কোথায়? হিয়াকে ডাক দাও।”
“মানে? এসব কোন ধরনের বিহেভিয়ার নিবিড়? মজা করো না প্লীজ। সবসময় তোমার মজা আমার ভালো লাগে না।” বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললাম। দাঁড়িয়ে গেল নিবিড়, বাদ গেল না উপস্থিত প্রতিটি সদস্য। পরবর্তী বাক্য তোলার পূর্বে ফের বললাম, “এখানে আমার বাবা মা আছে। প্লীজ সিনক্রেট করো না।”
আমার বাবা তানজিম এতক্ষণের নীরবতার ইতি টানলেন। ভারী গলায় শুধাল, “হানি তুই এখানে, হিয়া কোথায়?”
“মানে? আমিই তো হিয়া। তোমরা আমার কথা বলে হানিকে কিছুতেই গছাতে পারবে না। আমি ওকে ভালোবাসি।” ভালোবাসা নিয়ে দু লাইনের ডায়লগে চোখে পানি ধরা পড়ল আমার। নাক টেনে চোখ মুছতেই মিসেস হাসি বলল, “নিবিড় কথা না বলে হিয়াকে রিংটা পরিয়ে দে।”
নিবিড় ভাই আশেপাশে চেয়ে রিংটা তুলে বারংবার তার হিয়ারানীকে খুঁজছে। আমি আর তার ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে পারলাম না। তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করে ফিক করে হেসে দিলাম। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি হাসতে হাসতে বললাম, “আমি হিয়া নই, হানি। পরিবারের ছোটো কর্ত্রী। আপু এদিকে আয়।”
আপু সিঁড়ি পেরিয়ে নেমে এলো। নিবিড় ভাইয়ের শুষ্ক চোখমুখে শীতল একটা ভাব প্রকাশ পেল। নাদ করে শ্বাস নিল। বাবা আমাদের দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। মিসেস হাসি খানিক ব্যথিত হলেন আমাকে পুত্রবধূ হিসেবে পেয়ে। তবে চমকিত হয়েছেন।
অনামিকা আঙুলে জ্বলজ্বল করছে রিং। অপলক চোখে চেয়ে আছে সেদিন হিয়া। আড়চোখে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে নিবিড় ভাইয়ের দিকে। তাদের প্রয়োজন এক মিশন সাক্ষাত। নিবিড় ভাইয়ের দিকে চেয়ে বললাম, “আপনি আমার সাথে আসুন। আমি আপনাকে এই বাড়িটা ঘুরে দেখাচ্ছি।”
“সমস্যা নে… চোখ রাঙাতেই কথা কাটিয়ে বলল, “আসছি।”
নিবিড় ভাইকে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে কানে এলো বাহারাজের গলা, “তোমরা বড়রা কথা বলো। ভাবি আমাকে বাড়িটা একটু ঘুরে দেখাক।”
আমি নিবিড় ভাইকে আপুর ঘরে নিয়ে এলাম। অপেক্ষা আপু ও বাহারাজের। নীরবতা বিরাজ করার পূর্বে বললাম, “বাহারাজ ভাই আপনার কে হয়?”
“ও আমার ছোটো ভাই।”
“আপনার ছোটো ভাইয়ের নাম আবির না?”
“হ্যাঁ। মায়ের ইচ্ছে ছিল দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে হবে। তাই শখ করে নাম ঠিক করেছে বাহা। পরবর্তীতে দেখা গেল ছেলে হলো। তাই আমার সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে আবির। বড়ো হয়ে মায়ের নামকে সম্মান দেখাতে বাহা’র সাথে রাজ মিলিয়ে নাম রাখল বাহারাজ।” নিবিড় ভাইয়ের কথায় এতক্ষণ পেটের মধ্যে গুড়গুড় করা প্রশ্নগুলো থেমে গেল। ততক্ষণে আপু ও বাহারাজ হাজির। মুচকি হেসে বললাম, “আপনার দুজনে কথা বলুন, যা ইচ্ছে করুন। আমি আমার ঘরে যাচ্ছি।”
দরজা ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই পায়ের পেছনে আরও একটা পা এগিয়ে এলো। আমি ঘাড় করে মানবটি দেখে ক্ষান্ত হলাম। প্রশ্ন করার পূর্বে সেই বলে বসল, “একা একা কী করব? ওদের কথা বলার আগে পর্যন্ত তুমি আমাকে সঙ্গ দাও হানি।”
আমি বন্ধ দরজার দিকে তাকালাম। অতঃপর বাহারাজকে সায় দিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে এলাম। বাহারাজ আশেপাশে গভীর দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করছে। দেয়ালের মাঝে সজ্জিত আমার ও জানভির ছবিটা দেখে বলল, ” জানভি তোমার ফুফাতো ভাই?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি এমনভাবে জান জান করছিলে, আমি ভেবেছি তোমার সত্যিকারের জান।”
“ওহ্।”
“তুমি গান গাইতে পারো?”
“একটু আধটু। গিটারটা জানভি কিনে দিয়েছে। চলুন, আপনাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাই।”
“আমি একটু ওয়াশরুমে যাব।”
“ওয়াশরুম ওদিকে। আপনি যান, আমি আছি এখানে।” আমার দেখানো পথে এগিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকল বাহারাজ। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছি। আজ বাহারাজকে আকর্ষণীয় লাগছে। দিনদিনই ওর প্রতি আমার দুর্বলতা বেয়ে যাচ্ছে। বারান্দার দিকে পা বাড়াতেই খানিক উঁচু দেয়ালে ধাক্কা লেগে শাড়ির কুচিগুলো খুলে গেল। ঝুঁকে কুচিগুলো মুষ্টিবদ্ধ করতেই শাড়ির আঁচল পড়ে গেল বুক থেকে। আমার আড়ষ্টতা ষোলোকলা পূর্ণ করে ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে এলো বাহারাজ। গোলগোল করে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। পিছনে ফিরে ঘনঘন শ্বাস নিতে লাগলাম। নিজেকে ধাতস্থ করে আয়নার দিকে চোখ পড়তেই বাহারাজকে চোখে পড়ল। তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি চেয়ে আছে এদিক। চোখের পলক স্থির। চোখমুখের আকৃতি বদলে বললাম, “প্লীজ অন্যদিকে তাকান।”
বাহারাজ হুঁশে ফিরে এলো। দৃষ্টি পরিবর্তন করে স্বাভাবিক গলায় বলল, “সরি।”
“প্লীজ আপনি এখান থেকে যান।”
“হ্যাঁ।”
বাহারাজ চঞ্চল পা ফেলে বেরিয়ে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। দ্রুত শাড়িটা খুলে বিছানার উপর রাখলাম। কাবার্ড থেকে টপস্ ও জিন্স বের করলাম। কাবার্ড বন্ধ করে পিছু ফিরতেই বাহারাজকে দেখলাম। তড়িৎ গতিতে নিজের দিকে চেয়ে চিৎকার করে করে উঠলাম। বাহারাজ দ্রুত দরজার ছিটকিনি তুলে বলল, “শান্ত হও। ভাই ভাবি এদিকে আসছে। যদি তোমাকে এই অবস্থা দেখে খারাপ ভাববে। তাই এসেছি। তুমি শাড়িটা পরে নাও প্লীজ।”
“অ্যা! আমি শাড়ি পরতে পারিনা। থ্রিপিস পরি।”
“বোঝার চেষ্টা করো। এটা আমাদের সম্মানের প্রশ্ন।”
“কিন্তু আমি তো পরতে পারি না।”
“আমি পরাতে পারি। তোমাকে হেল্প করব?” বাহারাজের দেওয়া প্রস্তাব নাকচ করে পরিত্রাণ পাওয়ার দুষ্কর। তাই বাধ্য মেয়ের মতো মাথা ঝাকালাম। শাড়িটা হাতে নিয়ে বাহারাজের দেওয়া ইঙ্গিত অনুযায়ী পরে নিচ্ছে। শাড়িটা গায়ে জড়াতে পারলেও কুচি করা সম্ভব হচ্ছে না। আমি কুচিগুলো বারবার করেও ধরে রাখতে পারছি না, এলোমেলো হয়ে আসছে। বিরক্ত হয়ে বললাম, “কুচিগুলো আপনি করে দিন। আমার দ্বারা আর সম্ভব নয়।”
বাহারাজ শাড়ির চুলগুলো খুব যত্ন সহকারে করল। তার দৃষ্টি ঘুরেফিরে পৌঁছে যাচ্ছে নিষিদ্ধ জায়গাগুলোতে। তবুও নিজেকে সামলে নিচ্ছে। কুচিগুলো গুছিয়ে আমার হাতে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল। ভাজে ভাজে গুছিয়ে বলল, “এবার গুজে নাও।”
আমি অতি সাবধানে গুজে নিলাম। কিন্তু একটা কুঁচি এলোমেলো হয়ে নষ্ট হয়ে গেল। বাহারাজ তাচ্ছিল্য করে বলল, “সামান্য কুচিও গুজতে পারো না মধুর মা, পারো কী?”
বাহারাজ পুনরায় কুচিগুলো ঠিক করল। একহাত কোমর ধরে অন্য হাতে গুজে দিল সেই কুচিগুলো। তার স্পর্শে এক দফা কেঁপে উঠলাম আমি। শিরশির করে উঠল সর্বাঙ্গ। চোখ বুজে বাহারাজের হাতটা ধরে ফেললাম। পরপর বেসামাল আরও একটা স্পষ্ট কোমরে ছড়িয়ে গেল। আমি চোখ খুলে তাকালাম না। ডানহাতে ড্রেসিং টেবিলের খুটিটা শক্ত করে ধরে ঘনঘন শ্বাস ফেললাম। হাতটা কোমর থেকে নেমে গেল। পায়ের শক্ত শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাতে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “বাহারাজ ভাই, আমার ফিগার দিপিকা পাড়ুকোনের মতো নয়। তবুও আপনি বেসামাল হলেন। যদি দিপিকা পাড়ুকোনের মতো হতো, তবে কী করতেন?”
বাহারাজ তাকাল কিনা জানি না, তবে আমার চোখের পাতা খুলল না। তবু স্পষ্ট বুঝলাম বাহারাজ চলে যাচ্ছে। আমি বিছানায় হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। ঢিপঢিপ করে বাজছে হার্টবিট। সেই মুহুর্তটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না।
চলবে… ইন শা আল্লাহ