#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৬
“দেখো বাহারাজ, বিয়েটা তোমরা গোপনে করেছ এবং ডিভোর্সের বিষয়টাও তোমরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছ। এক্ষেত্রে তোমরাই সিদ্ধান্ত নাও।”
বাবা উত্তরের আশায় বাহারাজের দিকে তাকাল। বাহারাজ কিছু বলার আগেই আমি বললাম, “সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছু নেই বাবা। আমি ডিভোর্স চাই। প্রেগন্যান্ট অবস্থা বিয়ে ডিভোর্স কার্যকর হয় না ঠিকই, বাচ্চা পৃথিবীতে আসার পরে তো হবে। আমি ওর সাথে সংসার করব না।”
আপু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, “হানি বোন আমার, তুই বাহারাজ ওপর রাগ করে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস। একবার ভেবে দেখ, তোরা দুজন আলাদা হয়ে গেলে বাচ্চাটার কী হবে!”
আমি ঠোঁট কামড়ে বললাম, “যে বাবা ভরা আসরে স্ত্রী সন্তানের পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করে, সে থাকার থেকে না থাকাই ভালো। তোর বিয়েটা এই বাহারাজের জন্য ভেঙে গিয়েছিল। তুই ও পক্ষ নিয়ে কথা বলিস না।”
বাহারাজ এতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে ছিল। অতঃপর অধৈর্য হয়ে বলল, “তুমি আমার সাথে থাকবে কি-না সেটা আমি নয় মাস পরে ভাববো, আপাতত ভাবার সময় নেই। যেহুতু এখন তুমি আমার স্ত্রী, তাই আমার কথাই তোমাকে শুনতে হবে।”
বাহারাজ জানভির থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিল। শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে পা বাড়াল। জানভি আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, “হানির হাতটা ছেড়ে দাও।”
“আমার স্ত্রীর হাত আমি ধরব নাকি ছাড়ব আমার ব্যক্তিগত বিষয়।” বলেই বাহারাজ জানভির কাঁধে জোরে একটা ধাক্কা দিল। প্রবল ধাক্কায় দুকদম পিছিয়ে গেল জানভি। আমি জানভিকে ধরতে গেলে আমার হাত টেনে ধরল বাহারাজ। রাগে ক্রমাগত ফুঁসছি আমি। বাহারাজ সবাইকে উপেক্ষা করে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল আমায়। ফ্রন্ট সিটের দরজা খুলে আমাকে রেখে দরজা বন্ধ করে দিল। যতক্ষণে আমি বুঝলাম দরজা বন্ধ করে রেখেছে, ততক্ষণে বাহারাজ ড্রাইভিং সিটে এসে বসেছে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, “কী চাই আপনার?”
বাহারাজ আমার দিকে ঝুঁকে গেল। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “আপাতত তোমাকে চাই। কোন সাহসে তুমি কাগজ তৈরি করেছ?”
“কারণ আমি আপনার সাথে থাকতে চাইনা। এক মুহুর্তও না। মুক্তি চাই।” ঘৃণায় দৃষ্টি আমার নত হয়ে এলো। বাহারাজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সরে গেল আমার থেকে। দরজা টেনেও খুলতে পারলাম না। ততক্ষণে অনুভব করলাম গাড়ি চলতে শুরু করেছে। দম নিয়ে বাহারাজের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমার ইচ্ছের কোনো দাম আপনার কাছে নেই? পুতুল মনে হয় আমাকে? আমি আপনার সাথে থাকতে চাইনা, কেন বুঝতে চান না?”
ড্রাইভ করতে করতেই বলল, “তুমি আমার সাথে থাকতে চাও।”
দমে গেলাম আমি। ফোনটা নিয়ে আসা হয়নি, যে বাড়িতে কল করব।
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছি। বাহারাজ এসে হনহন করে উপরে চলে গেছে। যাওয়ার আগে দরজাটা লক করে গেছে। তার ব্যবহারে আমার এখন অতিষ্ঠ লাগছে। যখন স্ত্রীর দাবী নিয়ে তার কাছে গিয়েছিলাম, তখন প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন এসেছে দাবী পূরণ করতে। দরজায় আওয়াজ শুনতে পেলাম। ঘাড় কাত করে দেখলাম বাহারাজের পরিবার ঢুকছে। আন্টির চোখে চোখাচোখি হতেই আমি দৃষ্টি নত করলাম। আন্টি আমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। হাত দুটো ধরে নরম গলায় বললেন, “না জেনে তোমাকে অনেক কথা শুনিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
আমি জবাব দিলাম না। যে কথাগুলো আমার দিকে ধেয়ে এসেছিল, সেই মুহুর্তটা কোনোভাবেই আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়।
___
চোখের পাতা খুলতেই একটা স্নিগ্ধ হাওয়া আমার দেহকে নাড়িয়ে দিল। নিজেকে আজ বেশ হালকা অনুভব হচ্ছে। আধো আধো দৃষ্টিতে তাকাতেই নতুন একটা পরিবেশে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। বাহারাজের বাড়িতে আছি বিষয়টা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। এটা আমার ঘর, আমার সংসার। এখানে বেশ আনন্দের সাথে থাকার কথা ছিল আমার, অথচ আমি আছি বাধ্য হয়ে। সবাই সত্যিটা জানতে পেরেছে, এটা ভেবেই আমার শান্তি লাগছে। শুরু থেকে আমাকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য জানভিকে অসংখ্য ধন্যবাদ দেওয়া উচিত আমার।
পরনে গতকালের বিয়ের বেনারসি। উপযুক্ত পোশাক ও মন মস্তিষ্কের কারণে শাড়িটা খোলা হয়নি। খ্যাক করে শব্দ পেলাম কেউ দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করছে। কৌতূহল নিয়ে তাকাতেই দেখলাম বাহারাজের মা। শাড়ির আঁচলটা কোমরে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল, “হানি, উঠে পড়েছ! কালকে রাতে কিচ্ছু খাওনি। আমি তোমার জন্য খাবার বানিয়েছি, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও।”
আমি মুখ ভার করে বললাম, “এই বাড়ির কোনো খাবার আমি খেতে চাইনা।”
তিনি নরম গলায় বলল, “হানি জেদ ধরো না। তুমি ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলেও, সে পারবে না। খাবারের সাথে রাগ করে তোমার সন্তানের ক্ষতি কোরো না।”
সন্তানের কথা ভেবে আমি একটু নরম হলাম। বিছানা ছেড়ে উঠতেই ফের বলল, “হানি, বাহারাজ কোথায় কিছু জানো?”
“জানি না।” আমার স্পষ্ট উত্তর। তিনি ধীরপায়ে চলে গেলেন। সবকিছু বিরক্ত লাগছে আমার। বউ তুলে এনেছে, অথচ বউয়ের যত্নে জামা আনার প্রয়োজন বোধ করেনি।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে শাড়িটা খুলে বিছানার ওপর রাখলাম। শাড়িটা ভিজে জবুথবু হয়ে গেছে। ভেজা জামাকাপড় পরলে ঠান্ডা লাগার অভ্যাস আমার। কারো পায়ের শব্দ শুনে কাঁথাটা তুলে পরে নিলাম। সেকেন্ড দুই পর বাহারাজকে দেখতে পেলাম। ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ঘরের প্রবেশ করছে। আমাকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বেডশিট টেনে ঠিক করতে করতে বলল, “কাঁথাটা দাও, ভাঁজ করব।”
আঁতকে উঠলাম আমি। কাঁথা দিয়ে দিলে তো…। দুকদম পিছিয়ে গিয়ে বললাম, “আপনাকে ভাঁজ করতে হবে না। আমি ভাঁজ করে রাখব।”
বলতে গিয়ে চোখ পড়ল বাহারাজের দিকে। তার ঠোঁটে অবাধ্য দুষ্টু হাসিটা আমাকে দ্বিধান্বিত করে তুলল। শীতল দৃষ্টিতে তাকাতেই চোখে পড়ল, আমার শাড়ির একপ্রান্ত তার পায়ের নিচে। ছেলেটা ইচ্ছে করে আমাকে লজ্জাবনত করছে। ঠোঁট কামড়ে বিরবির করে বললাম, “ফাজিল একটা। ছেলে জাতটাই লুচুমিতে ফাস্ট ক্লাস।”
“এখানে লুচুমির কী দেখলে তুমি? তুমিই তো! তাছাড়া নতুন করে দেখার কী আছে, আগেই সব দেখা আছে।”
বাহারাজের লাগামহীন কথায় আড়ষ্ট হয়ে গেলাম আমি। বিরবির করে বললাম, “স্ত্রী স্ত্রী করছে। স্ত্রীর জন্য একটা শাড়ি কেনার মুরোদ নেই। যত্তসব ন্যাকামি।”
বাহারাজ উঠে গেল। খট করে আলমারির দরজাটা টেনে দিলাম। অবিলম্বে আলমারির ভেতর থেকে কতগুলো জামাকাপড় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বাহারাজ ব্যঙ্গাত্মক হেসে বলল, “চোখ থাকলেই হয় না, মাঝে মাঝে আশেপাশে তাকিয়েও দেখতে হয়।”
বাহারাজ বিছানা গুছিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল। কাঁথাসহ উঠে আলমারির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। রংবেরঙের থ্রিপিস, শাড়ি, টপস্ দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলাম। তার মধ্যে থেকে ঢিলেঢালা টপস্ নিয়ে সেখানেই পরিধান করলাম। কাঁথাটা ভাঁজ করে বিছানার কিনারে রেখে দিলাম। অতঃপর নিচে নামলাম।
আমার শাশুড়ি মা একা হাতেই পুরো খাবার টেবিল সাজিয়ে ফেলেছেন। নিবিড় ভাই ও তার বাবা খেতে বসেছেন টেবিলে। আমি ইতস্তত করছি একপাশে দাঁড়িয়ে। তিনি আমার হাত ধরে টেনে বসাল চেয়ারে। আদুরে গলায় বলল, “এখন এটা তোমারও বাড়ি। নিবিড় ও বাহারাজের মতো তুমিও এই বাড়িতে মন খুলে থাকতে পারো।”
মনে খুলে থাকা তো দূরের কথা। এখানে যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে বারেবার।
চলবে ইন শা আল্লাহ
#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৭
বাহারাজের আমার প্রতি উৎকণ্ঠা বিষের থেকে জ্বালাময়ী ঠেকছে। যে সন্তানের পরিচয় দিতে অস্বীকার করে, হঠাৎ আমার প্রতি এত যত্ন দেখলে প্রবল হাসি পায় আমার। সকালের নাস্তার পরপরই আমরা বেরিয়ে এসেছি ডাক্তারের চেম্বারের উদ্দেশ্যে। বাচ্চার অবস্থা জানতেই এই পদক্ষেপ তার। আল্ট্রাস্নোগ্ৰাফি করে গাড়িতে বসে আছি। বাহারাজ কিছুক্ষণ মৌন অবলম্বন করে বলল, “কোথাও ঘুরতে যাবে?”
আমি দাঁত চেপে বললাম, “হুঁ। যাব তো! জাহান্নামের চৌরাস্তায়। সেদিকেই চলেন।”
বাহারাজ জানালার কাঁচ তুলে বলল, “জায়গাটা আমি ঠিক চিনি না। তুমি যদি ডিরেকশন দিতে ভালো হতো! জায়গাটা ভালো না, তোমাকে নামিয়ে দিয়েই আমি ফিরে আসব।”
আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম। বাহারাজের গা জ্বালানো হাসিটা দেখলে মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায়। শক্তপোক্ত গলায় বললাম, “বাড়িতে যাব।”
“হ্যাঁ। এখন বাড়িতেই যাব।”
স্পষ্ট বললাম, “আমার বাড়ির কথা বলেছি। আমার সব প্রয়োজন জিনিস ওখানে। ফোনটাও আনা হয়নি।”
বাহারাজ গাড়ি স্টার্ট দিল। ব্যস্ত রাস্তায় মনোযোগী হয়ে ড্রাইভ করতে করতে বলল, “শাশুড়িরা মেয়েদের নানা রকম কুমন্ত্রনা দেয়। তাই তোমাকে আমি ওবাড়িতে ছাড়তে পারব না। প্রয়োজনীয় কোনো জিনিস লাগলে আমাকে বলিও, এনে দিব। আমার ফোন আর তোমার ফোন কি আলাদা? আমারটা ব্যবহার করো।”
বাহারাজ যে আমাকে ‘ফ্যামিলির’ থেকে দূরে রাখতে চায়, তা তার ব্যবহারে স্পষ্ট প্রকাশ পায়। কিন্তু যোগাযোগ যে কীভাবে করব। ভার্সিটির কথা মাথায় এলো। ঝাঁজালো গলায় বললাম, “ভার্সিটিতে কী যেতে দিবেন, নাকি তা-ও বন্ধ?”
“আমার সাথে যাবে আবার আমার সাথেই আসবে।”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সিটে হেলান দিলাম।
বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই একটা অশান্ত পরিবেশ উপলব্ধি করলাম। আপু, মা ও জানভি এসেছে এ বাড়িতে। যেইনা আমি দ্রুতগতিতে ছুটে যাব, ওমনি বাহারাজের মা চ্যাঁচিয়ে বলল, “হানি সাবধানে।”
___
দিনের পর দিন কেটে এখন বহু মাস পেরিয়ে গেছে। সামনেই আমার প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। প্রেগন্যান্সির এই সময়ে পড়াশোনা আমার জন্য এক কঠিন বলে এই বাড়ির সবাই বলেছিল লম্বা একটি বিরতি নিতে। কিন্তু আমি চাই সবটা সামলে নিতে। সময়টা শীতকাল। জানালার ধারে বসে বই পড়ছি। ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘরে ঘুরছে। এরমধ্যে বাহারাজের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কয়েকদিন হলো অফিসে যাচ্ছে। হঠাৎ আওয়াজ পেলাম দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেছে কেউ। আমি একপলক তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলাম। বাহারাজ বিছানায় বসে পা থেকে মোজা খুলছে। এই কয়েকদিনে তার প্রতি আমার এক ধরনের মায়া কাজ করছে। আজ এত রাত হওয়ার কারণ জানতে তীব্র ইচ্ছে করছিল। অদ্ভুত এক জড়তার কারণে পারছি না। বাহারাজ আমাকে আদুরে গলায় বলল, “এত রাত জেগে পড়ছ, দিনে কী করেছ?”
“দিনে ঘুমিয়েছি। এখন পড়ছি।”
“রাত নয়টা থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত ঘুম শরীরের জন্য অনেক উপকারী। আর পড়তে হবে না, ঘুমাও।”
আমি মুখ ভেংচি দিলাম। বইটা বন্ধ করে বললাম, “ঢং। ঘুম কি দেখতে যাবে আমি নয়টা ঘুমিয়েছি নাকি ভোর চারটায়। যতসব কথা।”
বাহারাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, “এটা আমার কথা নয়, ডাক্তারের কথা।”
“হুঁ। ঘুম ডাক্তারের কানে কানে বলেছিল।” বলে উঠতে গেলেই পেটের মধ্যে হঠাৎ করে নড়েচড়ে উঠল বাবু। আমি দেয়াল ধরে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম। হালকা ব্যথা অনুভব হলেও এই অনুভূতি অসাধারণ। বাহারাজ আমার স্থির দেখে বলল, “কী হয়েছে, দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?”
“বেবি কিক করছে।”
বাহারাজ উঠে এলো। আমার ঢিলেঢালা টিশার্ট সরিয়ে দিতেই নজরে এলো পায়ের স্পষ্ট ছাপ। বাহারাজ আলতো স্পর্শ করতেই শিউরে উঠলাম আমি। অতঃপর ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শে কাবু হয়ে গেলাম। সরে আসার প্রয়াস করতে দুহাতে আমাকে চেপে ধরল। কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার ঠোঁটে কিক করেছে প্রিন্সেস।”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, “ও যে প্রিন্সেস, আপনাকে কে বলল? প্রিন্সও হতে পারে।”
“বাবার প্রতি মেয়েদের একটু বেশিই টান থাকে। তাই ও আমার রাজকন্যা।”
দুহাত পেটের ওপর রেখে ধীরে পা ফেললাম। আমার এই ছোটো পেটে দুজন ছোটো বাবু আছে। ডাক্তার বলেছে একজন ছেলে ও একজন মেয়ে। বাহারাজের সাথে আমার সম্পর্কটা এখনো ওইখানেই দাঁড়িয়ে আছে। না ও চাইছে নিজেকে স্বাভাবিক করতে, না আমি পারছি সবকিছু মেনে নিতে। আচমকা বাহারাজ আমার হাত ধরলেন। আমি চমকে তাকাতেই ভুবন ভোলানো হাসি দিলেন। ধীরে ধীরে হাসিটা মিলিয়ে গেল শূন্যতায়। নরম কণ্ঠে বলল, “আমাকে কি আরেকবার মেনে নেওয়া যায়না হানি? আরেকবার?”
“আপনি আমাকে অস্বীকার করেছেন, এটা আমি এখনো মেনে নিতে পারিনি বাহারাজ।”
“আমি তোমাকে অস্বীকার কখনোই করিনি হানি। তোমার প্রতি তীব্র রাগের কারণেই তোমাকে এড়িয়ে গেছি বহুবার। কী করব বলো? আমার ভালোবাসার স্পষ্টটাকে যখন তুমি বি/ষের সাথে তুলনা করলে, তখন বি/ষপান করে নিজের মরে যেতে খুব ইচ্ছে করছিল। ম/রে যেতে ইচ্ছে করছিল। দ্বিতীয়বার রাগ হলো, যখন তুমি আমার অভিমানটাকে না বুঝে একা একা ফিরে এলে। তুমি জানো, সুন্দরবন তছনছ করে তোমাকে খুঁজেছি। যে মেয়েটা বাসে ঠিকমতো উঠতে পারে না, সে কিনা আমাকে হেট করে বাড়িতে চলে গেল! আমি ভার্সিটিতে যেতাম তোমাকে দেখতে। এই বুঝি তুমি আমাকে ডাকবে, এই বুঝি সব মিটমাট করে নিবে। কিন্তু তুমি এলে না। আমাদের মাঝের দূরত্ব ঘুচাতে এলে না। ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পেতে চাওয়া কি অন্যায়? আমরা তো স্বামী স্ত্রী। হক তো আমার আছেই।”
বাহারাজের কথার পৃষ্ঠে আমার কোনো কথা রইল না। ফের বলতে লাগল, “বাচ্চার বাবা হিসেবে একবারও কি তুমি আমাকে বলেছিলে, আমি বাবা হতে চলেছি? তোমার মনে তীব্র রাগ জমে ছিল। তাহলে কোন ভিত্তিতে তোমার অজ্ঞান অবস্থায় নিজেকে সন্তানের পিতা বলে দাবি করতাম? ডাক্তার যখন সবার সামনে একথা বলেছিল, আমি আকাশ থেকে পড়েছিলাম। আমি তোমাকে ওষুধ দিয়েছিলাম, তুমি খেয়েছ কিনা তাও খেয়াল করিনি।”
নত গলায় বললাম, “খাইনি।”
বাহারাজ আমার উত্তর আশা করেনি। ফাঁকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “রাতের খাবার খেয়েছ?”
“হুঁ।”
শার্ট খুলে ওয়াশরুমে ঢুকল বাহারাজ। আমার মনে উদীয়মান হাজারটা প্রশ্ন। সেই থেকে আমি যে বাহারাজকে দোষী সাব্যস্ত করছি, এখানে কি আমার একটা ভুল নেই? স্ত্রী হিসেবে বাহারাজের অভিমান ভাঙানো আমার দায়িত্ব ছিল না? ওকে না বলে আসা কি আমার উচিত হয়েছিল নাকি কনসেভ করার বিষয়টা লুকানো ঠিক হয়েছে? ঠান্ডাতেও আমার শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। কতক্ষণ ওভাবে বসে ছিলাম জানি না। হঠাৎ বাহারাজ এলো সেখানে। দরজায় আওয়াজ করে বলল, “এই ঠান্ডায় এভাবে বসে আছো কেন? ঘরে এসো। ঠান্ডা লেগে যাবে তো।”
“হুঁ। আসছি।”
বাহারাজ এসে হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেল। ইতোমধ্যে বিছানায় শোবার জন্য উপযুক্ত করে ফেলেছে। উজ্জ্বল আলো নিভিয়ে ড্রিম আলো জ্বালিয়ে দিল। অতঃপর দুজনে শুয়ে পড়লাম। রাত ধীরে ধীরে গভীর হচ্ছে, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। আজ বহুদিন পর বাহারাজের দিকে ভালোভাবে তাকালাম। আমার চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি পড়তে লাগল। হঠাৎ অনুভব করলাম হেঁচকি উঠেছে। দুহাতে মুখ চেপে ধরতেই কান্নায় শব্দটা বেড়ে গেল। বাহারাজ ধরফড়িয়ে উঠে বসল। দ্রুত আমাকে ধরে বলল, “মধু, কী হয়েছে? কাঁদছ কেন? ভয় পেয়েছ তুমি?”
আমি কিছু বললাম না। বাহারাজ তার বুকের মাঝে আমাকে লেপ্টে নিল।
চলবে.. ইন শা আল্লাহ
#তুমি_থেকো_দাঁড়িয়ে_খোলা_বারান্দায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৮
বইয়ের পাতায় মুখ গুজে একবার সবকিছু রিভিশন করে নিচ্ছি। বাহারাজ অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে। খাওয়াদাওয়া ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে দুজনের। ব্লেজারটা কব্জিতে নিয়ে বাহারাজ ডাকল, “বইটা নিয়ে নাও। গাড়িতে যেতে যেতে একবার রিভিশন করে নিও। এরচেয়ে বেশি লেট করলে জ্যামে আটকে থাকতে হবে।”
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বইটা নিয়ে বাহারাজের সাথে বের হলাম। যাত্রাপথে দোয়া নিলাম গুরুজনের। বাহারাজের মা আমার যত্নে কোনো ত্রুটি রাখেননা। যাচ্ছি পরীক্ষা দিতে অথচ টিফিন দিয়ে দিয়েছে। চার ঘণ্টার লম্বা পরীক্ষার পর খেয়ে তবেই বের হওয়ার কড়া নির্দেশ। এই অবস্থার ভীড়ের মাঝে ঠেলে কিছুতেই বের হওয়া যাবে না। পরীক্ষার হল পড়েছে অনেকটা দূরে। এক ঘণ্টার রাস্তা, তবে জ্যামের কারণে দেড় ঘণ্টার মতো লেগেছে। গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বাহারাজ আমার হাতটা ধরে বলল, “একটু সাবধানে কেমন। তুমি কিন্তু এখন আর একা নও।”
“আচ্ছা।”
“ভালোমতো পরীক্ষা দিও। খেয়েদেয়ে রিলেক্সে বের হবে। আমি এসে নিয়ে যাব। টা টা। তিনজনকে একসাথে রেখে যাচ্ছি। সাবধানে থেকো।”
বাহারাজের কথায় আমি মাথা নেড়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম। বারবার পেছনে তাকিয়ে বাহারাজের সেই ক্লান্ত মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কেন যেন আজ আমার একদমই ওকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু পরিস্থিতি কাছে আমি অপারগ। আমাকে যেতেই হবে।
আড়াই ঘণ্টা অতিক্রম করেছে ঘড়ির কাঁটা। প্রচণ্ড ক্ষুধায় দুই বাবুও হরতাল শুরু করে দিয়েছে। মাথা ঘুরছে ক্ষুধায়। ক্লাসে সবাই তখন লেখায় মগ্ন। অথচ আমি তখন একটা শব্দও লিখতে পারছি না। একহাত পেটে রেখে খুব ধীরে ধীরে বললাম, “সোনারা আমার, আরেকটু অপেক্ষা কর। মাম্মাকে একটু লিখতে দে। পাস মার্ক লিখেই চলে যাব। প্লীজ।”
ওরা একটু গতি কমাল। আমি মন দিয়ে লিখতে লাগলাম। আচমকা আমার হাত থেকে কলমটা পড়ে গেল। বেঞ্চের নিচে উঁকি দিয়ে কলমটা তুলতে যেতেই মনে হলো কেউ আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। আমি বেঞ্চটা শক্ত করে ধরলাম। জানালার পাশে বসেছি। শা শা বাতাসে মনে হচ্ছে কেউ অনবরত আঘাত করে চলেছে জানালায়। আচমকা ম্যাম বলে উঠল, “সবাই টেবিলের নিচে বসো। ভূমিকম্প হচ্ছে।”
সবাই ঝটপট টেবিলের নিচে বসে পড়ল। আমার ভারী ও উঁচু পেট নিয়ে টেবিলের নিচে ঢুকতেই পারছি না। খুব কষ্ট করে টেবিলের নিচে মাথা ঢুকানোর সাথে সাথে মনে হলো জানালার গ্লাস খুলে আমার ওপরে পড়ল। কিছুক্ষণের জন্য আমি স্থির হয়ে গেলাম। তখনও ভূমিকম্পে কাঁপছিল পৃথিবী। হঠাৎ ম্যাম বলে উঠলেন, “তোমরা এখানে না অপেক্ষা করে, ভবন থেকে নামার চেষ্টা করো। এভাবে চলতে থাকলে ভবন ভেঙে পড়বে।”
সবাইকে দেখলাম ছুটে বাইরে যেতে। আমার মাথা থেকে তখন রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। পুরো মাথা অবশ হয়ে আসছিল। আমার বাচ্চাদের কথা ভেবে ছুটতে খুব ইচ্ছে হলো। একহাতে মাথা ধরে ধীরে ধীরে দেয়াল ধরে নামার চেষ্টা করলাম। একপর্যায়ে নেমে গেলাম নিচে। ততক্ষণে ভূমিকম্প থেমে গেছে। নিচে নেমে আর শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারলাম না। সকল বন্ধন ছেড়ে লুটিয়ে পড়লাম মাটিতে। কেউ বারবার আমাকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। বাহারাজকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল আমার।
___
নিভু নিভু চোখ মেলে তাকালাম আমি। কক্ষটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে অনুধাবন করলাম এটা হাসপাতালের কেবিন। ভারে মাথাটা তুলতে পারছি না। শরীরেও কোনো জোর নেই। আমার সামনে কয়েকজন মানুষ। আমি বুঝে উঠতে পারছি না এরা আবার সাথে কী করছে। হাতটাকে আস্তে করে মাথার কাছে নিতেই শক্ত ব্যান্ডেজের স্পর্শ পেলাম। ধীরে ধীরে পেটের দিকে বাড়িয়ে নিতেই একজন আমার হাত ধরে ফেলল। চমকে উঠে বেশ জোরেই বলল, “প্যাসেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।”
সবার চোখ তখন আমার দিকে। ডাক্তার উত্তেজিত হয়ে বলল, “এতদিন চেষ্টা করেও জ্ঞান ফেরাতে পারিনি। তাই তো সিজারিয়ানের পথ বেছে নিলাম।”
আরেকজন বলল, “বিষয়টা তার হাসবেন্ডকে জানানো উচিত।”
সিজারিয়ান? আমার সন্তান এই পৃথিবীতে এসেছে? এরমধ্যে একটা কান্নার শব্দ ভেসে এলো কানে। আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। আমার খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল। ভেসে এলো আরও একটা কান্নার শব্দ। খুশিতে ওদের দেখার জন্য আমার মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল। আমি শুধু ওদের একবার ছুঁয়ে দেখতে চাইলাম। কিন্তু প্রকাশ করতে পারলাম না। বাহারাজের গলা পেলাম। তিনি বাইরে থেকে অবিরত বলতে রইল, “আমি পেসেন্টের হাসবেন্ড। আমাকে একবার ভেতরে যেতে দিন। এমন করছেন কেন? দিন না?”
নার্স দুজন দুটো সন্তানকে কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম ওদের কথা, “টাকা না দিলে কিন্তু বাচ্চা দেব না। টাকা দিন।”
আমার চোখটা আস্তে করে নেমে এলো। আর এক মুহুর্তও আমি চোখ মেলে থাকতে পারলাম না। দ্বিতীয় দফা চেতনা শক্তি লোপ পেল।
চোখ মেলে তাকাতেই অন্ধকারে আবৃত ঘরে নিজেকে অনুভব করলাম। এসির ঠান্ডা হাওয়াতে শরীর হিম হয়ে আছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারছি না কোথায় আছি। কোমরের নিচের অংশ প্যারালাইজড মনে হচ্ছে। এক চুলও নড়াতে পারছি না। আমাকে মৃত ভেবে দাফন করে ফেলল না তো? আমার সন্তানের মুখ দুটো এখনো দেখতে পেলাম না। ছটফটানির মধ্যে পেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ। কান্নার শব্দ কানে ভেসে আসছে। দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে এলো। চঞ্চল পায়ে কেউ ভেতরে ঢুকল। ফোনের টর্চ জ্বালাতেই বাহারাজের মুখটা নজরে এলো। আমার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বাহারাজ এসে আমার কপালের মধ্যিখানে চুমু খেল। দুহাতে আমার গাল ধরে নরম গলায় বলল, “কতদিন পর তোমার চোখ দুটো দেখলাম হানি।”
শরীর কেঁপে উঠল আমার। কতদিন? এইতো কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “কতদিন?”
বাহারাজ হেসে বলল, “বাবুদের দেখেছ? আমি কিন্তু ওদের নাম ঠিক করে ফেলেছি, আদ্র ও আদ্রিতা।”
“ওদের বয়স তো সাত মাস চব্বিশ দিন। এত তাড়াতাড়ি ডেলিভারি কেন করানো হলো?”
“ওদের পৃথিবীতে আসাটা খুব দরকার ছিল। তাই।”
আমি আবার বললাম, “ওদিকে নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছে। কী খেয়েছে ওরা?”
“তুমি অনেক অসুস্থ। তাই আইসিইউ-তে থাকা এক বাবুর আম্মু ওদের ফিডিং করিয়েছে। দোয়া করি বাবুটা সুস্থ হয়ে উঠুক।”
বাহারাজের কথায় আমার চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। মা বেঁচে থাকতে তার সন্তান অন্য কারো দুগ্ধ পান করছে। বাহারাজ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কাঁদছ কেন? ভাগ্যে যেটা আছে সেটাই হয়েছে। তুমি সুস্থ হয়ে যাও।”
ঠোঁট চেপে বললাম, “আমাকে একটু পানি খাওয়াবেন? মনে হচ্ছে কত জনম পানি খাইনি।”
বাহারাজ তার আঙুল ভিজিয়ে আমার ঠোঁটের উপর রাখল। আমি ক্লান্ত চোখে তাকাতেই বলল, “রাতটা অপেক্ষা করো, সকালে পানি খেও। তোমাকে পানি দেওয়া নিষেধ।”
বাহারাজের এক ফোঁটা পানি আমার তৃষ্ণা বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। ভেতরটা ছটফট করছে পানির জন্য। বাহারাজ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বারবার ঘুমের জন্য পথ তৈরি করে দিচ্ছে।
চলবে… ইন শা আল্লাহ