#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ১০
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
“বুড়ো স্বামী তার উপর সে কখনো বাবা হতে পারবেনা এমন লোকের সংসার করতে পারবে সাঁঝ? আমার আগের বিয়ে কিন্তু এই বাবা না হওয়ার অক্ষমতার জন্যই টিকেনি। অবশ্য যে সম্পর্কে বিশ্বাসের ভীতে ফাটল ধরে ভেতর থেকে ভেঙে যায় তাকে ধরেও রাখতে চাইনি। তোমারতো বয়স কম। সাইত্রিশ বছর বয়সের বরের সাথে নিজেকে দেখতে লজ্জা লাগবে না? বাহিরে কোথাও বের হলে যদি তোমার বন্ধুরা কেউ দেখে ফেলে পরবর্তীতে এইটা নিয়ে তোমার সাথে হাসি ঠাট্টা করে তখন নিজেকে সামলে নিতে পারবে? তোমার বয়সের মেয়েরা যখন কম বয়সী সুদর্শন বর নিয়ে তোমার সামনে ঘুরে বেড়াবে তখন তাদের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে? তোমার কাজিনরা যখন তোমাকে প্রশ্ন করবে তখন লজ্জা লাগবে না”?
উজান এক দমে কথাগুলো বলে থামলো। পুরো সন্ধ্যারাত তার মাথার মধ্য যত প্রশ্ন নিয়ে ঘুরছিলো একে একে সব বললো। ঠিকইতো তার বয়সের সাথে সাঁঝের বয়সের তফাত অনেক। মেয়েটার মাত্র চব্বিশ বছর বয়স। মাত্র অনার্স শেষ করলো আর উজান গুনে গুনে ওর চেয়ে তেরো বছরের বড়। শুধু কি বড় এর আগেও উজানের একটা চার বছরের সংসার ছিলো সেখানে ছাড়াছাড়ি হয়েছে তাও আবার কি কারনে বাবা না হতে পারার কারনে। আরও একটা কারনতো আছে। আচ্ছা সেটা কি সাঁঝকে বলা উচিত? হ্যাঁ উচিত হবে কিন্তু কি এখনই বলবো মনে মনে কথা আওড়ায় উজান। বিয়েটা এমন একটা পরিস্থিতিতে হয়েছে মেয়েটাকে কিছু বুঝানোর সুযোগ পেলোনা সে। উজানকে থম মেরে চুপ করে থাকতে দেখে সাঁঝ বললো
” আচ্ছা আমার সাথে কি আপনি একাই আছেন নাকি আরও কেউ আছে বাহিরে? বাবা-মা, ভাইয়া আর বাচ্চারা কোথায় কেমন আছে বলতে পারেন”?
উজান বলে
” না এখন এই মুহুর্তে তোমার কাছে আমিই আছি। ডাক্তার আমাকেই শুধু অনুমতি দিয়েছে তোমার কাছে থাকার। বাবা-মা, তোমার ভাইয়া থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। সারাদিনের অনেক ধকল গেছে তাদের। কারও ঠিকঠাক খাওয়া হয়নি। প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে গেছে উনারা। বেশি চাপ নিলে শরীর খারাপ করবে এজন্য বিশ্রামের প্রয়োজন। তাই সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। আর বাচ্চারা আজকে সারাদিন তোমার মামাতো বোনগুলো আছে না তাদের কাছে ছিলো। ওরাই সামলেছে খাইয়েছে। কাল আসবে বাচ্চারা তোমার কাছে”।
সাঁঝ বলে
“আমার একটা প্রশ্ন ছিলো আপনার কাছে”?
উজান বললো
” বলো কি প্রশ্ন”?
সাঁঝ বলে
” মানুষ জেদের বশে পড়ালেখা করে, চাকরি করে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় কিন্তু নিজের জানের নিরাপত্তার কথা না ভেবে এভাবে হুট করে বিয়ে করে ফেললেন আমাকে। আপনার একটুও দ্বিধা বা ভয় কাজ করলো না? জোর জবরদস্তির বিয়েটা না করলেই পারতেন “।
উজান সাঁঝের চোখে চোখ রেখে তাকায়। তার মনে কোন সংশয় নেই তবে বিগত অভিজ্ঞতার জন্য অনেক প্রশ্ন আছে মনে। সেগুলোর উত্তর সে পরে খুজঁবে। আগে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া জরুরি। উজান গলায় ঝাঁঝ এনে বলে
” প্রথমত আমি একজন স্বাধীন মানুষ। আমার আগে পিছে এমন কেউ নেই যে আমাকে চাপে ফেলে শাসন করে বা জোর করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে বলবে। হ্যাঁ মা বেচেঁ থাকাকালীন এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে আমার। সেগুলোর ফলাফল আমার জন্য ভালো কিছু বয়ে আনেনি। তবে বাবা চলে যাওয়ার পর মায়ের কথার অবাধ্য আমি হতে পারিনি সে আমার যত কষ্ট আর ক্ষতিই হোক না কেন। কিন্তু মা চলে যাওয়ার পর এগুলোর কোন বালাই নেই এখন। তাই এই চিন্তা মাথা থেকে বের করে দাও যে তোমাকে আমি চাপে পড়ে জোর জবরদস্তি পরিস্থিতিতে বিয়ে করেছি। তোমাকে আমি নিজ ইচ্ছায় এবং সজ্ঞানে বিয়ে করেছি”।
সাঁঝ বিদ্রুপের স্বরে বলে
” দয়া দেখাতে বিয়ে করেছেন? এমন প্রয়োজন ছিলো না। যখন আগ্রহ আর ভালোবাসার অনুভূতি জন্মাচ্ছিলো তখন বয়সের আবেগ বলে আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন। আমার বয়স কম। এগুলো দুইদিন পর ভুলে যাবো কত কথা সেদিন বললেন। অথচ আমি আপনাকে সত্যিই…..”।
উজান সাঁঝের দিকে তাকায়। চোখে তার কত অভিমান সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছি বলে। আচ্ছা এই মেয়েটি বুঝতে পারেনা কেন সেদিন এমন করেছিলো সে? এতো অবুঝ কেন নাকি মেয়ে মানুষ বুঝেও বুঝতে চায়না। হবে হয়তো। উজান আরও একটু এগিয়ে যায় সাঁঝের বেড এর দিকে। সাঁঝ নিরুত্তাপ হয়ে উজানের দিকে চেয়ে আছে যেনো সেও চায় উজান আরেক ধাপ এগিয়ে আসুক তার দিকে। এই মানুষটাকে এখনই সে ধরা দিবে না। তাকে পুরো তিনটা মাস পুড়িয়েছে। রাতের পর রাত কাদিঁয়েছে। শেষে বাধ্য হয়ে সাঁঝ বিয়েতে মত দিয়েছে। কি ভেবেছে বিয়ে করলেই সব ভুলে সাঁঝ গলে যাবে? তার বউ হয়ে তার প্রেমে উন্মাদ হয়ে যাবে? সে যেমন কষ্ট পেয়েছে তাকেও এমন করে পোড়াবে সে। বুঝাবে তাকে সে সত্যিই উজানকে ভালোবাসে। বয়সের আবেগ থেকে না। এটা সত্যিকারের চাওয়া আর ভালোবাসা তার। বউকে চুপ করে থাকতে দেখে উজান বললো
” তোমার কি এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি সত্যিই কোন চাপ থেকে বিয়ে করিনি তোমায়? আচ্ছা তোমাদের মেয়েদের এই সহজ কথাটাই বুঝানো মুশকিল হয়ে যায় যে পুরুষ মানুষ এতোটাও অবুঝ না যে তাকে ধরে বেধেঁ বিয়ে করানো যাবে। পুরুষ মানুষ চায় দেখেই সে বিয়ে করে। তোমার মাথায় যে একটা আজাইরা ভিত্তিহীন কথা ঢুকিয়েছো যে তুমি অশুভ অপয়া এই ফালতু কথাটাকেই প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম তুমি অকল্যাণকর নও “।
সাঁঝ চুপচাপ হয়ে আছে। তার মনোযোগ এখন পুরোটাই উজানের দিকে। রাতের বাজে তিনটা। সাঁঝের ঘুমের রেশ এখন নেই। তবে শরীরটা অনেক দূর্বল। উজান তার পাশেই একটা টুল নিয়ে বসে আছে। মনে মনে সাঁঝ চাইছে মানুষটাতো তার স্বামী। হোক না হুটহাট করে বিয়ে। তাই বলে কি মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া যাবে না? একটু হাতে হাতও রাখা যাবে না?আচ্ছা সে কি নিজে থেকে বলবে তার আরেকটু কাছে এসে বসতে? এটাও কি ঘোরের মধ্য দেখা স্বপ্ন নাকি? সত্যি উজানের সাথে তার বিয়ে হয়েছে এইটা বিশ্বাসই হচ্ছেনা। পিনপতন নিরবতা ভেঙে উজান বললো
” একটা কথা বলবো সাঁঝ”?
“জ্বি অবশ্যই বলবেন। একটা কেন হাজারটা বলুন। বউকে জিজ্ঞেস করে করে কথা বলবেন নাকি “? সাঁঝ বলে।
উজান ঠোঁট মেলে হাসে তারপর বললো
” আসলে বিগত ছয় বছর ব্যাচেলর মানুষ ছিলাম কিনা তাই অনেককিছু ভুলে গেছি। এই যেমন ধরো বউ এর সাথে কিভাবে কথা বলা শুরু করবো, তাকে কি বলা যাবে আবার কি বললে সে মন খারাপ করবে না এসব আর কি “।
সাঁঝ হতাশ হয়ে বলে
” শুধু কি তাই? আপনি আরও অনেক কিছুই ভুলে গেছেন। সেগুলোও আবার নতুন করে শেখা দরকার মনে হয়”।
উজান সাঝেঁর কথা বুঝতে পারেনি। হ্যাঁ ভুলেছে সে অনেক কিছুই। সেতো আর কখনো চায়নি মনে করতে বা ভাবেওনি এসব আবার নতুন করে মনে হওয়া বা শেখার চেষ্টা করতে হবে। তবুও কৌতুহল থেকে বললো
” যেমন কি ভুলে গেছি বুঝিয়ে বলতে পারো”?
সাঁঝ বললো
” আমি এখন আপনার কি হই?
উজান সোজাসাপ্টা বলে
” আমার স্ত্রী হও তুমি “।
সাঁঝ আবারও ঝাঁঝ নিয়ে জিজ্ঞেস করে
” তাহলে বউ অসুস্থ হলে কি করতে হয় এটাওতো জানার কথা আপনার। আপনার বউ অসুস্থ। আর আপনি এরকম দূরে দূরে আছেন কেন? একটুতো মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারেন? একটু হাত ধরতে পারেন। আজকে আমাদের বিয়ের প্রথম রাত একটুতো অসুস্থ বউকে জড়িয়ে ধরে রাখতে পারেন নাকি? আচ্ছা একটা কথা বিয়েতো করেছেন। বউ পছন্দ হয়েছে”?
উজান সাঁঝের কথা শুনে হাসে। এই জেনারেশন এর ছেলে মেয়েগুলো এতো পাকা পাকা কথা বলে। কেউ বলবে এই মেয়েটা অসুস্থ। উজান ভনিতা ছাড়াই উত্তর করলো
” তোমাকে ছোয়াঁর অনুমতি এখন নেই আমার তাই বউয়ের সেবা কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে “।
এতো জটিল কথা সাঁঝের মাথায় ঢুকলো না। কিসের অনুমতি নেই? তিন কবুল পড়ে উপরওয়ালার নাম নিয়ে শরীয়া সম্মতভাবে বিয়ে হয়েছে। উজান স্বামী হয় তার। তবুও আরও কি কি অনুমতি লাগবে? নিজের বউয়ের হাত ধরবে তাকে জড়িয়ে ধরতে আবার কোথাকার কার অনুমতি লাগবে সাঁঝের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বউকে চিন্তা করতে দেখে উজান বললো
” আবার কি চিন্তা করছো? এতো বেশি চিন্তা করোনা। ডাক্তার বারণ করেছে এতো বেশি মানসিক চাপ নিতে “।
সাঁঝ বিচলিত হয়ে বলে
” নিজের বউকে ছুঁতে আর কার অনুমতি লাগবে আপনার”?
উজান বললো
” বিয়েটাতো পরিকল্পনা করে হয়নি তাই তোমার দেনমোহর পরিশোধ হয়নি। ওইটা বাকি আছে। দেনমোহর পরিশোধ না হওয়া অবধি বউকে ছোয়াঁটা জায়েজ না। আজকে ব্যাংক বন্ধ আর বাড়িতেও যেতে পারিনি। তাই তোমার দেনমোহর বাকি আছে। এজন্য বউয়ের হাত ধরতে পারছি না”।
সাঝঁ এতোক্ষণে বুঝলো এই জন্য এতো দূরত্ব। কিন্তু সেতো অনেককেই দেখেছে দেনমোহর পরিশোধ না করে বউকে ছুঁতে। এমনকি বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেলেও নাকি স্বামী দেনমোহর পরিশোধ করে না। সাঁঝ বললো
“আচ্ছা বড় আপুর জামাই মানে দুলাভাইতো আপুকে দেনমোহর পুরোটা দেয়নি। গয়না দিয়েছিলো পরে তার শ্বাশুড়ি সেগুলো নিয়ে মেয়েকে দিছে। কিন্তু আপুতো সংসার করেছে ভাইয়ার। কোথায় তাদেরতো অনুমতি লাগেনি “।
উজান সোজাসুজি উত্তর করলো
” বউ যদি ভালোবেসে বিশ্বাস করে স্বামীর উপর আরোপিত দেনমোহর মাফ করে দেয় তাহলে আর কোন অনুমতি লাগে না”।
সাঁঝ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো
“আমিও আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম। আমাকে দেনমোহর দিতে হবে না। শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন তাহলেই হবে”।
অতঃপর সাঁঝ এই কথা বলেই চোখ বন্ধ করে। মনে মনে আওড়ায়
” তুই একেবারে পাগল হয়ে গেছিস সাঁঝ। ওষুধের কড়া ডোজে তোর মাথা ঠিক নাই। বিয়ে করে একদম নির্লজ্জ হয়ে গেছিস”।
চলবে……..