নীল সাঝেঁর উজান পর্ব-১৫+১৬

0
35

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ১৫
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

” মধুচন্দ্রিমায় কোথায় যেতে চাও সাঁঝ? দেশের ভেতরে নাকি বাহিরে? কি পছন্দ তোমার পাহাড় নাকি সমুদ্র? সাঁঝ তোমার গহীন বন কেমন লাগে বলোতো? তুমি চাইলে দুই চড়ুই মিলে সেখানেও চষে বেড়াতে পারি। আমারতো ভালো লাগে। ছাত্রজীবনে বন্ধুরা মিলে সুন্দরবন গিয়ে ঘুরে এসেছি বেশ কয়েকবার। জেলে পাড়ার জীবন দেখেছি। জেলেদের ট্রলারে পিকনিক করার অভিজ্ঞতাও আছে। কি দারুণ রান্না করে তারা জানো? ওদের ট্রলারেই একটা ছোটমতো রান্নাঘর থাকে। হাতের কাছে যা থাকে তাই দিয়েই দারুণ রান্না করে আর স্বাদ সেতো অন্য রকমের অভিজ্ঞতা। দারুন স্বাদ হয়। যদি বিদেশে বেড়াতে যেতে চাও তাহলে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এখন বছরের মাঝামাঝি সময়। অফিসে এখন কাজের অনেক চাপ। আর যদি দেশেই কোথাও যেতে চাও কক্সবাজার বা বান্দরবন তাহলে বকেয়া অনেক ছুটি জমে আছে সেখান থেকে দিন চারেক এর ছুটি নেওয়া যায়। এখন বলো বউ তুমি কি চাও”?

আদুরে গলায় বউকে নিজের মধ্য জড়িয়ে ধরেই কথাগুলো নরম গলায় বলে ফেললো উজান। তার না হয় বিয়ে দ্বিতীয়বার হয়েছে তাই বলে কি মধুচন্দ্রিমাতে তারা যাবে না? জীবনের সব রং সেতো একেবারে শেষ করেনি। উচিতও না। প্রতিটা মানুষ নিজের মধ্য একটা ভয় নিয়ে বাচেঁ। নিজের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হারিয়ে যাবার ভয়। অবিশ্বাসের দানা যখন সেই ভয়কে আরও বেশি ঘনীভূত করে তখন মানুষ এর চোখের সামনে সেগুলোই ঘটতে থাকে। এতোদিন সে নিজের জীবনকে জিইয়ে রেখেছিলো এর মধ্য। যেখানে সে নতুন কাউকে প্রবেশাধিকার দিতে ভয় পেতো। যদি তার দূর্বলতা নিয়ে মানুষ তার রক্তক্ষরণ আরও বেশি বাড়িয়ে দেয় এই ভয় পেতো সে। কিন্তু আর সে এগুলো নিয়ে ভাববে না। জীবনটা তার। তাই সে সিদ্ধান্ত নিবে কিভাবে সেটাকে উপভোগ করবে। উজানকে এক ধ্যানে ভাবতে দেখে সাঁঝ বললো

” আমি একটা কথা বলবো বর?

সাঁঝের মুখে কথাটা খুব অদ্ভুত শোনালো। বয়সে বেশ বড় বলে নাম ধরে ডাকতে চাচ্ছে না তাই এইভাবে ডাকছে। শুনতে খারাপ লাগছে না বেশ ভালোই লাগছে। কিন্তু তাকে নাম ধরেই ডাকতে বলবে উজান নয়তো অন্য কোন আদুরে নাম দিক। উজান বললো

” একটা কেন হাজারটা কথা বলো উম হু লক্ষ লক্ষ কথা বলো বউ। নিজের বরের সাথে কথা বলবে এতে অনুমতি নেওয়ার কি আছে। তুমি বলবা আমি মনোযোগ দিয়ে শুনবো।আমি বলবো তুমি শুনবা”।

সাঁঝ কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বলে

” আপনি কাল রাতে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছেন তাই না? আমাকে নিয়েই দেখেছেন। মনে করেছেন আমি আপনার দূর্বলতা, ভালোবাসা এবং অসুবিধার সুযোগ নিয়ে আপনাকে ঠকিয়েছি এমন কিছু দেখেছেন। এই স্বপ্ন আপনাকে কালকে প্যানিক আ্যটাক দিয়েছিলো তাই না”?

উজান সোজাসাপ্টা বললো

” আমার প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে স্বাভাবিক ভাবে ছাড়াছাড়িটা হয়নি। সে আমার সাথেই বিয়ে বলবৎ থাকাকালীন বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়েছিল। সেই ভয়টা সেই কষ্টটা আজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। গত ছয়টা বছর এই বিষয়টা আমাকে তীব্রভাবে বিশ্রী একটা যন্ত্রণা দিয়ে গেছে এবং এখনো যায়। সেখান থেকেই হয়তো কালকে একটা দুঃস্বপ্ন আমি দেখেছি। আমাকে যদি তোমার পছন্দ না হয় তোমার জন্য রাস্তা খোলা সাঁঝ। তুমি যদি মনে করো এই সন্তান দিতে অক্ষম পুরুষ মানুষ এর সাথে সংসার করা সম্ভব না তোমার জন্য একদম সোজাসুজি মুখোমুখি হয়ে আমাকে বলবে। তুমি মুক্ত। তুমি স্বাধীন মানুষ। কিন্তু আমাকে ঠকানোর দুঃসাহস করবে না। আমি সয়ে নিতে নিতে কঠিন পাথরে পরিনত হয়েছি তাই এগুলো নিয়ে কোন ছাড় নেই আর”।

সাঁঝ নরম গলায় বলে

” আমার দিকে আরেকটু গভীর দৃষ্টিতে তাকানতো উজান “?

উজান সাঁঝকে নিজের সাথে আরেকটু ঘনিষ্ঠ করে মুখোমুখি করে তাকে। একদম চোখে চোখ রাখে। সাঁঝ বলে

” কিছু কি দেখতে পারেন এই চোখের গভীরতায়? কোন নিগুঢ় সত্য যা শুধু আপনাকে ঘিরেই এই দুচোখের মধ্য আছে “।

উজান চোখদুটোতে একদম নিবদ্ধ। সে খুব মনোযোগ দিয়ে চোখ দেখছে তার বউয়ের। সে বলে উঠে

” তুমি কি শাক সবজি কম খাও সাঁঝ। চোখ এইরকম সাদা ফ্যাকাশে কেন? মনে হচ্ছে ভিটামিন এ এর অভাব। তুমি কি দূরের জিনিস কম দেখতে পাও”?

স্বামীর এরকম হেয়ালি কথায় সাঁঝের কপট রাগ হয়। সে কি দেখতে বললো আর সে কি দেখলো। সে ভালোবাসার কথা বলছে। আর সে তার চোখে ভিটামিনের অভাব দেখছে। সাঁঝ উজানের বুক থেকে উঠে বললো

” বয়স বাড়লে যে পুরুষ মানুষ এরকম শুকনো চরচরে স্বভাবের হয় তাতো জানতাম না। আমি আপনাকে বললাম আমার চোখে আপনার জন্য কতখানি ভালোবাসা দেখতে পান? আর আপনি ভিটামিনের অভাব খুঁজে পেলেন “।

উজান শব্দ করে হাসে তারপর বলে

” কচি বউ বিয়ে করেছি কি সাধে এজন্যই যাতে শুকনো রুক্ষ মরুভূমিতে আবার প্রাণসঞ্চার করে। আমি না হয় শুকনো নিষ্প্রাণ উত্তপ্ত মরুভূমির প্রখর রোদের মতো। তুমিতো আমার জীবনে বর্ষার এক পশলা বৃষ্টির মতো হয়ে এসেছো। আমাকে তোমার মধ্য নিয়ে আবার প্রানবন্ত উচ্ছ্বসিত করে তোলো। আর বউ তোমার চোখ দুটো কিন্তু অনেক সুন্দর। কাজল দিলে যেমন ভালো লাগে সেটা লেপ্টে গেলে আবার বটতলার শাকচুন্নীর মতো দেখতে লাগে। তবে সত্যি কথা কি জানো”?

সাঁঝ বলে উঠে

” কি কথা “?

উজান সাঁঝের দিকে চেয়ে বলে

” তোমাকে চিনতে, বিশ্বাস করতে, আরও গভীরভাবে বুঝতে সেই সাথে ভালোবাসতে হয়তো বেশ কিছুটা সময় লাগবে। আমি বিনীত নিবেদন জানাচ্ছি তোমার কাছে নিজের স্বামীকে এই সময়টা তুমি দিবে। অতীতের করাঘাত গুলো এখনো মুছে যায়নি। তবে তোমার আদর যত্নের কোন কমতি হবে না সাঁঝ। শ্বশুর শ্বাশুড়ি কেউ নেই বলে যে তোমার সংসার গোছাতে হিমশিম কেতে হবে এমনটা মাথায় আনবে না। তুমি একটা গোছানো সংসারেই যাচ্ছো শুধু তোমার স্বামীটা একটু এলোমেলো ছিলো এতোদিন তাকে গুছিয়ে নিতে হবে তোমাকে। কি পারবে না”?

সাঁঝের চোখে পানি। সে কেঁদে দিবে এমন ভাব তবুও উজানের গলা ছাড়লো না। কোনরকমে ঘাড়ে মুখ গুজে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো

” আমি আপনাকে ভালোবাসি উজান। আমার সেই আবেগ অনুভূতি আপনি যাকে আপনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আপনার জন্য কত রাত না ঘুমিয়ে পার করেছি জানেন? অনেক কেদেঁছি। জীদ উঠেছিলো আপনার সামনে আর কখনো যাবোনা। তাইতো বাবা যখন বিয়ে ঠিক করলো সাত পাচঁ না ভেবেই বিয়েতে মত দিয়েছিলাম। কিন্তু দেখেন নিয়তি কি চাইলো। সেই আপনাকে আবার ফিরিয়ে দিলো কত অপ্রত্যাশিতভাবে। আপনি আমার বর। আপনি বুড়ো হোন, রুক্ষ হোন আর মরুভূমির প্রখর রোদ হোন আপনি আমার শুধু আমার। এই সাঁঝের আপনি। আপনি দিনের শুরুতে আমাকে দেখবেন, বকবেন, শাসন করবেন আবার আমাকেই আদরে আহ্লাদে ভাসিয়ে দিবেন। দিন শেষে আমি আপনার মনোযোগ হতে চাই উজান। রাতের গভীরের স্পর্শ হতে চাই। আপনার শান্তি হতে চাই। সুখ হতে চাই কিন্তু আপনার দুঃস্বপ্ন হতে চাইনা”।

উজান যেনো পাথরের মতো স্থির হয়ে গেছে। সাঁঝের বলা কথাগুলো সে মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তার বলার শক্তি নেই। ব্যক্ত করার মতো কোন ভাষাও নেই। অফিস থেকে আধা বেলার ছুটি নিয়ে এসেছিলো সে। আজ সাঁঝকে হসপিটাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। সাঁঝ ভালো আছে কিন্তু শরীর এখনো পুরো সুস্থ নয়। আরও বেশ কিছুদিন বিশ্রাম নিতে হবে তাকে। বিকাল পাচঁটায় রিলিজ করা হলো তাকে। সে অনেক খুশি নিজের স্বামীর বাড়িতে যাবে। আজকে থেকে তাকে পাকাপোক্ত ভাবে উজানের সাথে থাকতে হবে। গাড়িতে উঠে সে উজানকে বললো

” আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন না আমি কোথায় যেতে চাই সমুদ্র নাকি পাহাড়”?

উজান বললো

“হ্যাঁ তখন এই কথার উত্তর দাওনি তুমি। কোথায় যেতে চাও?

সাঁঝ বললো

” আল্লাহর ঘরে যেতে চাই। তার কাছে নিজের জন্য কিছু ভিক্ষা চাই। নিজের স্বামীর জন্য নিজের সংসারের জন্য। নিয়ে যাবেন?

উজান আরও এক দফা অবাক হলো। কস্মিনকালেও ভাবেনি সাঁঝ এমন কিছু চাইবে। সে এতো বেশি খুশি হলো যে মুখ দিয়ে কথায় বের হচ্ছে না। সে সাঁঝের ডান হাত নিজের হাতের মধ্য নিয়ে বললো

“মার ইচ্ছা ছিলো ছেলের সাথে সেখানে যাওয়ার তাই মাকে নিয়ে একবার ঘুরে এসেছি। এবার বউয়ের সাথে যাবো। তোমার ইচ্ছা শিরোধার্য বউ “।

আসতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। প্রায় পনেরো মিনিট পর তারা বাসায় পৌছাঁলো। যেহেতু উজানের কেউ নেই আর আত্নীয় স্বজন কাউকেই বলা হয়নি তাই যাবতীয় কাজ সাঁঝের মা নিজে থেকেই করলেন। ঘরের দুয়ারে এসে সাঁঝ বুঝলো তার শরীর খারাপ লাগছে। গা টা টলে উঠছে কিন্তু বুঝতে দিলো না কাউকে। সবাই মনে করবে মেয়ে একদম ননীর পুতুল হয়ে গেছে। তাই সে চুপ করে আছে। উজান কিছু একটা ঠাওর করলো। পরমুহূর্তেই সে সাঁঝকে পাজাকোলে করে নিয়ে কোনদিকে না চেয়ে একদম সোজা চলে গেলো তার ঘরে। সাঁঝ লজ্জায় সেই যে মাথা নিচু করেছে আর তুলছে না। মুখটা তুলে বললো

” বাবা-মার সামনে এভাবে নিয়ে এলেন?

উজান বললো

” নিজের অসুস্থ বউকেই নিয়ে এসেছি। অন্য বাড়ির ভাবীকে আনি নাই “।

সাঁঝ শার্টের কলার চেপে ধরে বললো

” এই সাঁঝ ছাড়া আর কাউকে চোখ দিয়ে দেখলেও আপনার খবর আছে বর ওরফে মি. মরুভূমি “।

চলবে…………

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ১৬
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

“মি. মরুভূমি আপনাকেতো একটা কথা বলাই হয়নি। আমার কিন্তু বিছানায় ঘুমানোর অভ্যাস খুবই বাজে। আমি চারদিকে হাত পা ছড়িয়ে বিছিয়ে ঘুমাই। ঘুমের মধ্য অনেক নড়াচড়া করি বলতে গেলে খুবই ভালো রকমের বাজে অভ্যাস এইটা। এজন্য আমার কাছে সহজে কেউ থাকতে চায়না। এজন্য মা আমার কাছে বাচ্চাদেরও রাখেন না যদি তাদের ঘুমের ঘোরে বিছানা থেকে ফেলে দেই। কোথাও বেড়াতে গেলেও এই নিয়ে বিপাকে পরতে হয়। এজন্য নানু দাদু বাড়ি গেলেও ভাইবোনগুলো ঘুমানোর সময় আমার আশেপাশে কম থাকে। একবার কি হয়েছিলো জানেন? ছোটবেলায় স্কুলের গরমের ছুটিতে সবাই মিলে নানু বাড়ি গিয়েছি। তখনতো সবাই লাইন ধরে মেঝেতে মাদুর পেতে ঘুমাতাম। আমার পাশে আমার মামাতো বোন ঘুমিয়েছিলো। সকাল বেলা উঠে দেখি আমি আমার জায়গায়তো নেই কিন্তু তাকেও ঠেলতে ঠেলতে আরেক জনের জায়গায় নিয়ে গেছি। তারপর থেকে আমার ঘুমানোর সময় তারা বেশ দূরে দূরে থাকে। ঘুমের মধ্য আমি যদি আপনাকে লাথি দিয়ে ফেলে দেই আপনি কি কিছু মনে করবেন উজান”?

উজান চেয়ার টেবিলে বসে অফিসের কাজ করছিলো। রাতের বাজে দশটা। কাজ করতে বসলে কোনদিকে হুশ থাকেনা তার। গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করে। সাঁঝের কথা সে হয়তো তেমন ভালো করে শোনার চেষ্টা করেনি। উজানকে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে না দেখে সাঁঝ চুপ হয়ে গেলো। সময়টা বোরিং লাগছে তার। সেই যে হসপিটাল থেকে আসার পর ঘরে ঢুকেছে এরপর আর বের হওয়া হয়নি। শরীর এখনো পুরোপুরি সারেনি। হাতের ক্ষতটা ধীরে ধীরে শুকাচ্ছে। ডাক্তার বলেছে সময় লাগবে বেশ কিছুদিন। কড়া ডোজের ওষুধ খেতে হয় সকাল রাতে। ওষুধ খাওয়ার পর বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারেনা সে। খুব বেশি হলে আধাঘন্টা চোখ মেলে থাকতে পারে তারপর লম্বা এক ঘুমে তলিয়ে যায়। সাঁঝ মনে মনে আওড়াচ্ছে আজকে থেকে তাদের একসাথে থাকতে হবে। এক ছাদের নিচে এক চার দেওয়ালের মাঝে একই বিছানায়। বিয়েটাতো হয়েছে হসপিটালে। সেখানেতো বাসর রাত বলে কিছু ছিলো না। সেই হিসাব মতে আজকে তাদের একসাথে থাকার দিন শুরু। আজকের রাতটা তাদের বাসর রাত। ঘরের চারপাশটা চোখ বুলিয়ে দেখছে সাঁঝ। অনেক গোছানো ছিমছাম একটা ঘর। ঘরের একপাশের দেওয়ালে বইয়ের বিশাল একটা শেলফ। লোকটা ভীষণ বই পড়ুয়া সে ভাবে। তাইতো সব কিছু এতো গভীরভাবে চিন্তা করে। আর সে জীবনে কখনো বই এর ধারের কাছে যায়না। পড়ার বইটাই কত কষ্ট করে পড়েছে সে। উজান এখনো কাজ করছে। সাঁঝ একবার ভাবলো তাকে ডাকবে কিন্তু কাজের ব্যাঘাত হলে যদি রেগে যায় তখন? থাক ডাকবেনা সে। চোখ ভার হয়ে আসছে তার। ঘুম পাচ্ছে। আর জেগে থাকা সম্ভব নয়। আজকেও তার বাসর রাত জেগে থাকা হলো না। কেন যে পাগলামি করতে গেলো। এগুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমে চোখ বুঝলো সাঁঝ। ঠিক দশ মিনিট পরে উজান ল্যাপটপে ফাইলটা সেভ করে মাথা তুললো। একটানা কাজ করার ফলে পিঠ ব্যাথা করছে তার। চেয়ার ছেড়ে উঠে কিছুক্ষণ শরীর এদিক সেদিকে ঘুরালো সে। বিছানায় চোখ পরতেই দেখলো একজন নারী বিছানার অনেকখানি জুড়ে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। উজানের সেই নারীকে দেখে মনে পরলো আজকে থেকে কয়েকদিন আগে তার বিয়ে হয়েছে।তাই তার বিছানায় কোন নারীর ঘুমিয়ে থাকা অমূলক কিছু না। ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগিয়ে যায় উজান। সাঁঝের চেহারা দেখে আকৃষ্ট হয় সে। এতো মায়া এই চেহারায়। হাসলে ফর্সা গোলগাল মুখে তা ছড়িয়ে যায়। এই মেয়েটার সাথে তাকে এখন থেকে থাকতে হবে। পরক্ষনেই উপলব্ধি হলো হিসাবমতে আজকে তাদের একসাথে থাকার প্রথম রাত। মেয়েটা কি তার জন্য অপেক্ষা করেছিলো?ইশ! কাজে এতো ডুবে গিয়েছিলো যে খেয়ালই ছিলো না। কিছুটা ইতস্তত করতে করতে সাঁঝের পাশে শুয়ে পরে সে। ঘুমন্ত বউ এর দিকে চেয়ে বলে

” বউ তুমি কি রাগ করছো? তোমার স্বামীর একটা বাজে অভ্যাস আছে জানো? কাজের সময় কিছু খেয়াল থাকে না। তাইতো ভুলেই গিয়েছিলাম আমি যে বিবাহিত। আমার একটা উড়ন্ত দূরন্ত বউ আছে। আসলে বিগত ছয় বছরের ব্যাচেলর জীবন ছিলোতো তাই মাথা থেকে বেড়িয়ে গেছে। আজকে আমাদের প্রথম রাত বিয়ের পর একসাথে থাকার। বলতে গেলে সোজা বাংলায় বাসর রাত বলে। অথচ কি হলো। ধূর!!! ”

উজান সাঁঝের ব্যান্ডেজ করা হাতটা আলতো করে নিজের হাতের মুঠোয় নেয় তারপর সেটা নিজের বুকের উপর রাখে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা নারীর দিকে। নতুন বউ এর চেহারায় যে উজ্জ্বল ভাব থাকে সেটা কিছুটা মিইয়ে গেছে। শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হয়ে যাওয়ায় একটা বেশ বড় ধকল গেছে। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। উজান কিছুটা ঘেঁষে মিশে থাকে সাঁঝের সাথে। এরই মধ্য সাঁঝ একটা কাজ করে বসে। সে উজানকে কোল বালিশ ভেবে তার গায়ের উপর এক পা তুলে দেয়। উজান চমকে উঠে। সে রীতিমতো পাথর হয়ে শুয়ে আছে। কোন নড়াচড়া করছেনা। বুকের মধ্য ঢিপঢিপ করছে। এইটা যতক্ষনে সামলে নিতে পারলো সাঁঝ আরও একটা কান্ড করে বসলো। উজানকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে তার আধা শরীর উজানের বুকের উপর ছেড়ে দিলো। উজান এর মনে হচ্ছে যে একটু শ্বাস নিচ্ছিলো সে এখন সেটাও আর নিতে পারছেনা। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেলো তার। অবাধ্য ইচ্ছা ভড়কে গেলো। অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পরছে তার ভেতরটা। হঠাৎ কি হলো তার? গত ছয় বছর একা থেকেছে সে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিলো তার। কিন্তু এখন কি হলো? পাশে কোন বিপরীত সৃষ্টি আছে তাই। সে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে এই মানবীর উপর। এই মানুষটা তার একান্ত তার। এখন যদি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কিছু করে বসে সেটা কেমন বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে যাবে। মেয়েটা অসুস্থ এখন তার উপর ঘুমিয়ে আছে। উজান খুব সাবধানে নিজেকে সাঁঝের থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না যতবারই চেষ্টা করছে ততবারই তার স্ত্রী তাকে আরও বেশি আকঁড়ে ধরার চেষ্টা করছে। তাই বাধ্য হয়ে নিজের চেষ্টাকে ক্ষান্ত দিলো সে। তারপর বউয়ের কপালে গাঢ় একটা আদর দিয়ে তাকিয়ে থাকতেই থাকতেই ঘুমিয়ে গেলো। সকাল বেলা ঘুম থেকে পিটপিট করে চোখ খুলে সাঁঝ। কোথায় আছে কিভাবে আছে এটা বুঝার জন্য আরেকটু ভালো করে চোখ মেলে তাকায় সে। তারপর যা দেখে এটা দেখে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। সে উজানের পেটের উপর শুয়ে আছে। উজানকে ঠেলতে ঠেলতে বিছানার একদম কিনারে নিয়ে এসেছে। আর একটু হলেই উজান সহ সে পড়ে যাবে। উজান যদিও তাকে এক হাতে ধরে আছে। কোনরকমে উঠে বসে সে। মনে মনে বলে

” প্রথমদিনই নিজের এই প্রতিভা দেখিয়ে দিলি। তাও আবার কাকে নিজের স্বামীকেই। আচ্ছা রাতের বেলা উল্টো পালটা কিছু করিনিতো? লাথি গুতো বা চড় কিছু দিয়েছি নাকি? এইটাতো উপরওয়ালাই ভালো জানে। কিন্তু এখন যে অবস্থা একটু নড়লেই ধপাস করে পরে যাবে উজান”।

সাঁঝ এক হাতের শক্তি দিয়ে কোনরকমে বিছানার মাঝের দিকে উজানকে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু পারছে না। একেতো সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার একটা দূর্বলতা কাজ করে তার উপর সে এমনিতেই অসুস্থ। আর উজান এর ভারী শরীর এক হাতে পারছেও না। উজানের কাধেঁ হাত দিয়ে তাকে ডাকে

” মি. মরুভূমি এইদিকে সরে আসেন। পরে যাবেন খাট থেকে। উজান শুনছেন”?

উজান গভীর ঘুমে। তার কোন পাত্তা নেই। সাঁঝ আবার ডাকে

” বর ও বর পরে গিয়ে হাত পা ভাঙবেন। বিছানার মাঝের দিকে আসেন”।

না এইবারও উজানের কোন নড়চড় নেই। কুম্ভকর্ণ এর মতো ঘুম। সাঁঝ এবার গায়ের সর্বস্ব দিয়ে উজানকে টানতে থাকে। কিন্তু পারে না উল্টো ধাক্কাতে গিয়ে হাতে টান লাগে। ব্যাথায় কেপেঁ ওঠে সাঁঝে। হাতের বাধঁন আলগা করতেই বেসামাল হয়ে উজানের মুখের উপর পরে যায়। ঘটে আরেক কান্ড। তার অধরে স্পর্শ করে উজানের অধর এবং সেটা বেশ ভালো মতো করেই। কারও বেগতিক স্পর্শে ঘুম ছুটে যায় উজানের। চোখ মেলে দেখে বউ তার গায়ের উপর পরে তাকে…..। এ কি অনিয়ন্ত্রিত মুহুর্ত। সাঁঝের হাতের ব্যাথার কথা কিছু মনে নেই আর। তীব্র লজ্জায় নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে তার। উজান কি ভেবে বসলো কে জানে। হাতটা বাড়িয়ে আগলে নিলো স্ত্রীকে। অনেকক্ষন ধরে তাকিয়ে আছে সাঁঝের দিকে। চোখের পলক পরছে না। সাঁঝ নিজেকে এর মধ্য শখানেক বকা দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সেওতো তাল হারাচ্ছে। ঘোরে চলে যাচ্ছে। শ্বাস ঘন হয়ে আসছে। উজান একটু উঠে সাঁঝকে ধরে বেকায়দা থেকে সোজা ভাবে তাকে ধরলো। আর বললো

” তুমি আমার ঘুমের মধ্য সুযোগ নিতে চাইছিলে? কি দস্যি মেয়েরে বাবা!!!!”

সাঁঝের কথাটা শুনে মনে হচ্ছে এইমুহূর্তে মাটি দুইভাগ হয়ে যাক আর তার মধ্য সে ঢুকে গেলে যেন বাচেঁ। চোখ বন্ধ করে রইলো। উজান বউ এই অবস্থা দেখে হাসছে। উজানের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপে। সে বলে

” মানুষের না হয় বাসর রাত হয় আমাদের না হয় বাসর দিন হোক। কি বলো!!”

চলবে……..