#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ১৯
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
“ওরা আমার মেয়েকে বাচঁতে দিলোনা। আমার মেয়েকে একদম ভেতর বাহির থেকে নিঃশেষ করে ফেলেছিলো ওর এই নিকৃষ্ট শ্বশুর বাড়ির লোকজন। শ্বাশুড়ি এতো দজ্জাল যে আমার মেয়েকে একদম শিল পাটায় পিষতো সবসময়। ননদ সেতো আরেক ডাই*নী ছিলো আমার মেয়েটাকে বিয়ের পরের দিন থেকে অত্যাচার করতো। এদের জ্বালায় মেয়েটা ঠিকমতো আমার দুবেলা খেতেও পারতো না। সারা বাড়ির কাজ একা হাতে আমার মেয়েকে দিয়ে করিয়েছে এই মা -মেয়ে। বিয়ের পরেও ভর বছর ধরে ভাইয়ের সংসারে পরে থাকতো আর মায়ের সাথে মিলে যোগসাজশ করতো কিভাবে আমার মেয়েটাকে দিন রাত নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানো যায়। আর এমন পোড়া কপাল আমাদের পেয়েছি একটা অথর্ব অপর্দাথ জামাই যে বউয়ের সুখ দুঃখ এবং কষ্ট বুঝতো না। তারই সামনে আমার দীপাকে নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ অপবাদ দিতো তার মা-বোন অথচ নির্বিকার হয়ে থাকতো। এই জন্যই আমারে একজন বলছিলো বিয়ের দিন ছেলে হচ্ছে মা অন্ধভক্ত। মেয়ের কপালে দুঃখ আছে। ইশ! রে সেদিন যদি কথাটার গুরুত্ব দিতাম তাহলে আমার মেয়েটা এই অমানুষদের হাত থেকে বেচেঁ যাইতো। কেন শুনলাম না তার কথা। দীপা ও দীপা তুই সব ছেড়ে আমার কাছে আসলি না কেন মা? মা তোকে আগলে রাখতো। তোর বাবা-মাকে দুনিয়ার উপর রেখে তুই নিজে কেন চলে গেলি? ফিরে আয় মা ফিরে আয়”।
দীপার মায়ের বিলাপ আর আহাজারিতে চারপাশ ভারী হয়ে গেলো। উজান মনে মনে বললো মেয়েটা তার শ্বশুর বাড়িতে এতো অশান্তিতে আছে কেউ কখনো বুঝতেও পারেনি। তাকে দেখলে বুঝাও যেতো না। কালে ভদ্রে হঠাৎ সিড়িতে দেখা হতো। খুব একটা বাহিরেও বের হতোনা। এই জন্যই একটা কথা খুব প্রচলিত মেয়েদের বুক ফেটে যায় কিন্তু মুখ ফুটে না। ভেতরে ভেতরে এতো কষ্ট পেয়ে উনি নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। শেষে নিজেকে শেষ করার মতো এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নারী জীবন কেন এতো বিচিত্র? এতো কষ্টের পরেও মেয়েটা দাতেঁ দাতঁ চেপে স্বামী সংসার ছেড়ে যায়নি। অথচ সেই সংসার তার ইহকাল পরকাল শেষ করে দিলো। পুলিশ অফিসার ঘর তল্লাশি করছে যদি কোন নোট পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু কোন নোট পাওয়া যায়নি। তবে তার মোবাইল এ ডায়েরি আ্যপ পাওয়া গেছে। এখানে সে লিখতো। শেষ লিখাটা আজকে সকালের। সেখানে লিখা
” স্বামী নাকি মেয়েদের সবচেয়ে কাছের মানুষ। মেয়েরাতো তার ভরসাতেই বিয়ে করে অন্য বাড়িতে আসে। কিন্তু আমার স্বামী বিয়ের এতোদিনেও স্ত্রীকে সেইটা মনে করাতে পারেনি। তার সামনে তার বোন আমাকে যা তা বলে কথা শোনালো গালি দিলো অথচ সে ঘরে এসে আমাকে বললো ওর বোন যা পছন্দ করে না সেটা আমি করি কেন? না করলেইতো অশান্তি হয়না। অতঃপর বুঝলাম এই মানুষ শুধু নামেই স্বামী হয়ে রয়ে গেছে কোনদিন আমার স্বামী হইতে পারে নাই। আর তার ঘরে অশান্তি শুধু আমিই করি। তার বোন আর মা হচ্ছে তার কাছে শ্রেষ্ঠ নারী। পরের বাড়ির মেয়ে কি কোনদিন তা হতে পারে। এতোদিন শুধু নিজেকে মিথ্যা শান্তনা দিয়ে একটা কাপুরষকে ভালোবেসে এসেছি “।
এইটা পড়ার পর পুলিশ অফিসার সহ আর কারো বুঝতে বাকি থাকে না কেন এই নির্মম সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেয়েটা। পুলিশ অফিসার আদিল সাহেবের দিকে তাকালেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। তারপর বললেন
” আপনার স্ত্রী যে আপনারই বাড়িতে এইভাবে অবহেলা, নিগ্রহ এবং মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছেন এইটা আপনি শুরু থেকেই জানতেন। তারপরেও আপনার ভূমিকা এরকম নিরুত্তাপ ছিলো কেনো? আপনি আপনার মা-বোনকে কখনো কিছু না বলে নিজের স্ত্রীকেই আবার বলতেন কেন মানিয়ে নিতে? যখন জানতেন ঘরেই সব সমস্যা। কি ভেবে আপনার এই বক্তব্য ছিলো”?
পুলিশ অফিসার এর কথায় আদিল সাহেব প্রচন্ড ভাবে চমকে উঠে। বুকের মধ্য ধুকপুক করছে তার। বিয়ে হওয়ার পর থেকেই এই অশান্তি শুরু হয়েছিলো। আদিল আর দীপার বিয়েটা হয়েছিলো পারিবারিক ভাবে দেখাশোনার মধ্য দিয়ে। দীপাকে পছন্দ করেছিলেন আদিলের মা নিজেই। নিজেই যাচাই বাছাই করে ছেলের বউকে ঘরে নিয়ে এসছিলেন। সেই তিনিই বিয়ের পর থেকে ছেলের সংসার নিয়ন্ত্রণ করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। তার একমাত্র মেয়ে আদিলের বোন তাদের মাকে আরও বেশি কুবুদ্ধি দিতো। ঘরের বউকে লাই দিয়ে মাথায় না তোলার জন্য যদি সংসারে তার আধিপত্য বিস্তার করে তাহলে তাদের মা মেয়েকে পায়ের তলায় রাখবে। বিয়ের পরদিন থেকেই কাজে ভুল ধরা, রান্নায় ভুল খোঁজা, কম খেলো নাকি বেশি খেলো সেটা দেখা। দীপাকে দিয়ে এক সংসারের সব কাজ করানো আর মা মেয়ে বসে শুধু হুকুম করে কখন কি করতে হবে। দীপা মেয়েটা শান্ত স্থির স্বভাবের। কখনো কোন অভিযোগ করতোনা। সে আশায় থাকতো স্বামী তার হয়ে কথা বলবে। তার কষ্টগুলো বুঝবে কিন্তু না সে ভুল ছিলো। সারাদিন গাধারখাটুনি খাটার পরেও যখন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে মা বোন এর কাছে বউ এর নামে অভিযোগ শুনতো তখন যাচাই করার প্রয়োজন মনে করতো না কে ভুল আর কে সঠিক। ঘরের চার দেওয়ালে বউকে জ্ঞান দিতো পরবর্তীতে যেন এরকম ভুল আর না হয়। তারা যেভাবে চায় সেভাবেই কাজ করতে অথচ বউকে একবারও বলার প্রয়োজন মনে করতো না তুমি কেন তাদের জন্য এতো করো এরকম বেগার খাটুনি খাটো। তারা নিজেদের মধ্য বুঝে নিবে। পরের বাড়ির মেয়েকে এতো জিজ্ঞেস করলে যদি স্বামীর আত্নসম্মান ব্যাহত হয়, দাপট কমে যায় এজন্য বউকে ঠেলে দিতো আরও জ্বলন্ত উনুনে। অতিরিক্ত মা ভক্ত ছেলেদের এজন্যই আজকাল কেউ বিয়ে করতে চায়না। বিয়েভীতি তৈরী হয়েছে। আদিল বুঝতো তার মা বোন ঠিক করে না তার বউ এর সাথে কিন্তু তবুও কিছু বলতো না। বউকে বলতো মা আর কয়দিনই বা বাঁচবে তারপরতো এই সংসার তোমার একার। কিন্তু সবচেয়ে হৃদয় বিদারক কথা মা ঠিকই রয়ে গেলো কিন্তু বউটা আর বেচেঁ রইলো না। আদিল চুপচাপ হয়ে গেছে। তার বলার শক্তি বা ভাষা কোনটাই নেই। সে কখনো ভাবেনি দীপা ভেতর থেকে এইভাবে ভেঙে গেছে যে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। আদিল সাহেবকে চুপ থাকতে দেখে পুলিশ অফিসার বললেন
” কি ব্যাপার চুপ করে আছেন কেন? একটা সংসার সামলাতে আপনার ভূমিকা কি ছিলো এখানে?
আদিল জবাব দিচ্ছে না দেখে তার মা এবার বাজখাঁই গলায় বললো
“এরকম টুকটাক অশান্তি সবার ঘরেই হয়। বউ মানুষ এতো অধৈর্য হবে কে জানতো। নিজেও গেলো সাথে আমাদেরও ডোবালো”।
আদিলের মায়ের কথা শুনে দীপার মা যেন আরও ফুঁসে উঠলো অগ্নিশিখার মতো। তিনি বসা থেকে উঠে বললেন
” আমার মেয়ে অধৈর্য ছিলো এই কথা বলতে আপনার বুক কাপঁলো না?আজ তিনটা বছর ধরে আমার মেয়েটাকে তীলে তীলে শেষ করে দিছেন নিজের মেয়ের সাথে মিলে তারপরেও আপনার গলার জোর কমে না। উপরওয়ালাকে ভয় করুন। আপনার মনে কি সেটা আসে না?
আদিলের মা এবার থতমত খায় নিজের কথাতেই। তার এখন গা বাচাঁনো নিয়ে প্রশ্ন। তাকেতো ঠাঁট বজায় রাখতেই হবে। দীপার মা নিজের ফোনটা পুলিশ অফিসারকে এগিয়ে দিয়ে বললেন
“স্যার এরা আমার মেয়েকে কি পরিমাণ কষ্ট দিয়েছে দেখেন। আমার মেয়ে ভয়েস রেকর্ড করে পাঠাতো। দীপা বাচ্চা নিতে চাইতো এই মা মেয়ে তাকে নিতে দেয়নি সংসারের খরচ বেড়ে যাবে তাই অথচ নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সারাবছর ধরে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছে। ছয়মাস আগে বাচ্চাও হয়েছে। সেই বাচ্চাসহ বেশিরভাগ সময় এখানেই থাকে। সে আসলে তার সব কাজ আমার মেয়ে করতো”।
পুলিশ অফিসার ভয়েস রেকর্ড অন করে। সেখানে দীপা তার মাকে বলছে
” মা আমার বাচ্চার খুব শখ। আদিলকে বলেছি সেও চায়। কিন্তু আদিলের মা বলেছে মাত্র তোর বোনের বাচ্চা হলো। এখন তোরা নিজেদের বাচ্চা নিলে একসাথে এতো খরচ সামলাবি কি করে? তোরা পরে বাচ্চা নে। তোর বোনের বাচ্চাটা আরেকটু বড় হোক “।
আরেকটা রেকর্ডিং অন করলো
” মা ওরা আমাকে খুব কষ্ট দেয় মা। আমার শ্বাশুড়ি আমার খাবার সময় সামনে বসে থাকে। কি খাচ্ছি কতটুকু খাচ্ছি দেখার জন্য। আজকে ননদের জামাইকে খেতে দিয়েছি। তার জামাই রান্নার প্রশংসা করেছে। আর ওর জামাই আমার সাথে ভালো ব্যবহার করে বলে ওর জামাই এর সামনেই আমাকে কি বিশ্রী ভাষায় অপমান করলো মা। ওরা এমন কেন”?
দীপার মা আবারও বললো
“আমার মেয়েকে আমি নিতেই আসতাম আজ কালের মধ্য। মন বানিয়েই ফেলেছিলাম আর মেয়ের কথা শুনবোনা। এই সংসারে ওরে রাখবোনা আর। আর তার আগেই মেয়েটা আমার এইভাবে চলে গেলো। মা হয়ে কিছুই করতে পারলাম না।”
পুলিশ অফিসার আর কারো কথা শোনার প্রয়োজন মনে করলেন না। সবকিছু তার সামনেই। দীপার নিথর শরীরটাকে ময়না তদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠালেন। আদিল আর তার মাকে গ্রেফতার করা হলো আর আদিলের বোনের বাড়িতেও পুলিশ পাঠানো হলো তাকে গ্রেফতার করার জন্য। তাদের এই বাড়িটাকে সিলগালা করে দেওয়া হলো পরবর্তী নির্দেশ না আসা অবধি বাড়িতে কেউ ঢুকতে পারবে না।উজান এতোক্ষণ আদিল সাহেবের বাসার মধ্যেই ছিলো। যা হয়েছে সবই দেখলো সবই বুঝলো। তাকেও টুকটাক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছে। সে যা জানে উত্তর দিয়েছে। তারপর পুলিশ অফিসার তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন। উজান ত্রস্ত পায়ে নিচে নেমে তার বাড়ি আসলো। তাকে দেখে সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো
” কিভাবে কি হয়েছে”?
উজান একপলক স্ত্রীর দিকে তাকালো। চোখে মুখে তার কত প্রশ্ন। কিভাবে উত্তর করবে? কি উত্তর করবে? কিভাবে একজন পুরুষ মানুষ তার স্ত্রীকে সম্মান দেখাতে পারেনি। কিভাবে দুজন নারী দিনের পর দিন আরেকটা নারীর সংসারে অশান্তি করে গেছে। একটা নারীকে ভেতর থেকে ভেঙে ফেলেছে। তাকে এতোটাই অশান্তি নিগ্রহ করেছে সে তার জীবন শেষ করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। এটা কি শুধু একজনের অপারগতা নাকি এই দায় সবার? উজানের হঠাৎ করে মনে হলো তার মায়ের কথা। ইশার সাথে বিবাহিত জীবনের শেষ দুবছরে তার মা কত অশান্তি করেছে মেয়েটার সাথে। স্বামীর অক্ষমতা শ্বাশুড়ির নিগ্রহ সব মিলিয়ে সে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়ানোর মতো ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে। সে নিজেওতো মায়ের বাধ্য সন্তান ছিলো। ছোটবেলায় তার দাদীও তার মায়ের সাথে যেমন করতো বড় হয়ে সে দেখেছে এসব সয়ে যেতে যেতে তার মাও একরকম খ্যাপাটে আচরণ করতো তার বাবার সাথে। উজান মুহুর্তের মধ্য কেমন দিশেহারা হয়ে গেলো। তীব্র গতিতে সাঁঝকে গিয়ে জাপটে ধরলো আর বললো
” মনের মধ্য কখনো কোন অশান্তি হলে সোজা এসে খোলাখুলি আমাকে বলবে। কোন প্রশ্ন জাগলে আর আমার কথায় কষ্ট পেলে সবার আগে আমাকেই বলবে। মনের মধ্য পুষে রাখবে না। কোন পাগলামি করার কথা মাথায় আনবে না। এটা পাপ। এটা ইহলোক পরলোক শেষ করে দেয়। বুঝেছো”?
সাঁঝ স্বামীকে আরও বেশি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে
” হুম বুঝেছি “।
চলবে………….
#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ২০
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
” উজান তোমার মা আমাদের মাঝে নেই দুই বছর হয়েই আসলো। তুমিওতো তোমার নানাবাড়ি তেমন আসোনাই কখনো। ছোটবেলায় মায়ের সাথে স্কুলের গরমের ছুটিতে যেটুকু সময়ের জন্য আসতে। বড় হয়ে পড়াশোনার চাপ বেড়ে গেলো সাথে বড় আপার সংসারের ব্যস্ততা এই দিকে খুব কমই আসা হতো তোমাদের। তুমি এতো বুঝদার ছেলে বাবা-মা ছাড়া যে একা এতো সাহস করে জীবনের দিনগুলো গুছিয়ে নিয়েছো ভাবতেই বুকের মধ্য হু হু করে উঠে। বোনটা আমার অল্প বয়সে বিধবা হয়ে গেলো তারপর তোমাকে নিয়েই বাকিটা জীবন পার করে দিলো। দেখতে দেখতে উপরওয়ালা তার আয়ুও শেষ রেখা টেনে দিলেন।সবই তাঁর ইচ্ছা। সবাইকেই একদিন না একদিন চলে যেতেই হবে। একটু আগে আর একটু পরে এই হচ্ছে তফাত। বাবা তোমাকে যা বলার ছিলো সেটাই দেখো এখনো বলিনি। আপার অংশের সম্পত্তি তোমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার আছে। এগুলো বেচেঁ থাকতেই নিষ্পত্তি করা ভালো। তোমার নানা আপাকে দিয়ে গেছেন অনেক আগেই। তোমার মা কখনো সমপত্তি নিয়ে ভাইদের সাথে কোনো কথা তোলেননি যার কারণে আপার জমি জায়গা যেখানে যা আছে সব এতোদিন তোমার দুই মামা মিলেই দেখে এসেছি, চাষ করে এসেছি। আমাদেরও বয়স হচ্ছে সন্তান সন্ততি বেড়ে গেছে। এখন তুমি আপার একমাত্র উত্তরাধিকারী। তোমার পাওনা তোমাকে বুঝিয়ে দিতে চাইছি উজান। তুমি যদি সময় করে নওঁগা আসতে তাহলে ভালো হতো। এগুলো ব্যাপার আর বেশিদিন ফেলে রাখাও উচিত নয়। বলা যায়না কার ডাক কখন এসে যায় “।
এতোক্ষণ ফোনের এপার থেকে কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো উজান। তার বড় মামা ফোন করেছে। নানাবাড়িতে মায়ের সমপত্তি বুঝিয়ে নিতে বলছে। বেচেঁ থাকাকালীন তার মা কখনো এসব জমি জায়গা নিয়ে ঘাটাঘাটি করেনি। শুধু আবাদি জমি থেকে বছরকার ফসল হিসেবে ধান ভাঙিয়ে নিতো। আম্মা শহরের কেনা চাল খেতে পারতো না। তার নাকি গন্ধ লাগতো। চাল পছন্দ হতো না। তাই মামাদের বলে ভালোভাবে ধান ভাঙিয়ে চাল করে নিতো। নানাবাড়িতে তার বেশি স্মৃতি নেই। তবে গরমের সময় যেতো ছোট থাকতে। আমের বাগানে ঘুরে বেড়াতো। আমচাষীদের বিশাল বিশাল আমের বাগান দেখতে ভালো লাগতো তার। বাগানে গিয়ে সরাসরি গাছ থেকে পেড়ে কত আম খেয়েছে তখন। তারপর জীবনের ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় আর তেমন যাওয়া হতো না। তবে এবার যাওয়া প্রয়োজন। জমি জায়গা নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেহেতু তার চাকরি ঘর সংসার সব এখানে। সেগুলো তার পক্ষে দেখাশোনা করা সম্ভব না। তাই কি করলে ভালো হয় মামাদের সাথে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সব কথার মাঝে একটা কথাতো তার মামাদের কাউকেই জানানো হয়নি। সে আবার বিয়ে করেছে। ঘরে তার নতুন বউ। সেখানে গেলে বউকেও সাথে নিয়ে যাবে সে। উজান নরম গলায় মামাকে বললো
” জি মামা আমি চেষ্টা করবো অফিস থেকে ছুটি নেওয়ার। তারপর সেই অনুযায়ী নওগাঁ যাবো আমরা”।
উজানের বড় মামা আমরা কথা শুনে একটু ইতস্তত হলেন। উনি বুঝতে পারেননি। তাই জিজ্ঞেস করলো
” আমরা বলতে”?
উজান ধীর গলায় বললো
” মামা প্রথমেই ক্ষমা চাচ্ছি বিষয়টা জানাতে দেরি হয়ে গেলো। আসলে এতো দ্রুত এসব হয়ে গেছে যে জানানোটা সম্ভব হয়নি। আমি বিয়ে করেছি মামা। এই যে দুই সপ্তাহ হয়েই আসলো”।
উজানের বড় মামা বেশ খুশি হয় যে ছেলেটা আবার বিয়ে করেছে। আসলেইতো একজন মানুষের জীবন এভাবে যেতে পারেনা। তার মধ্য শত হলেও পুরুষ মানুষ। পুরুষ মানুষ এর একা থাকাও ঠিক নয়। অলস মস্তিষ্ক মানুষকে বিপথে নিয়ে যায়। তিনি বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে ভাগনেকে বললেন
” আলহামদুলিল্লাহ ভীষণ ভালো কাজ করেছো। আমি খুবই খুশি হয়েছি। আপা তোমার জন্য অনেক চিন্তা করতো। ফোন করলেই কাদঁতো। আক্ষেপ নিয়েই চলে গেলো তার ছেলের একটা সংসার হলো না। তবে তোমার মার দোয়া সবসময় তোমার সাথে আছে। তিনি যেখানেই আছে সেখান থেকেই তোমার জন্য দোয়া করছে। তুমিও তোমার মার জন্য দোয়া করবা বেশি বেশি। তুমিই তার একমাত্র ছেলে। তোমার দোয়াই তাকে ওপাড়ে ভালো রাখবে। নতুন বউকে নিয়েই আমাদের বাড়ি আসবে। রেখে আসবে না তাকে। আর তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবে। আমের মৌসুম চলছে এছাড়াও মৌসুমি ফলের সময় এখন। আমি তোমার মামীদের বলছি তারা যেন নতুন বউকে বরণ করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। খুব খুশির সংবাদ এইটা। আমি খুবই খুশি হয়েছি তোমার বিয়ের কথা শুনে। আচ্ছা বাবা কবে আসবে জানিয়ে দিও মামাকে। এখন রাখছি হ্যাঁ”?
উজান বলে
” জি মামা আমি জানিয়ে দিবো। আসসালামু আলাইকুম মামা। আপনি ভালো থাকবেন । নিজের খেয়াল রাখবেন”।
তার মামা হ্যাঁ সূচক কথা বলে ফোন রেখে দেয়। উজান ভাবলো সামনের সপ্তাহেই তারা মামাদের বাড়ি যাবে। এখন বেশ ভালো একটা সময়। যদিও আবহাওয়া ভালো থাকে না তবুও এখন যাওয়া যায়। অফিসে ছুটির জন্য বলতে হবে। দিন চারেক ছুটি হলেই হবে। সাঁঝকে বলতে হবে মামার বাড়ির কথা। এতোদিন পর নতুন বউসহ যাবে টুকটাক শপিং এরও প্রয়োজন আছে সবার জন্য। সবারই আশা প্রত্যাশা থাকে। মামাদেরও ভাগনেকে নিয়ে আছে। বাড়িতে আরও বড় ছোট ভাইবোন আছে। তাদের আবার বউ বাচ্চাও আছে। বেশ প্রস্তুতির ব্যাপার আছে।তাদেরও গোছগাছের প্রয়োজন আছে। এইসব ভাবতে ভাবতে সাঁঝের ফোন আসলো।
“হ্যা সাঁঝ অনেকদিন বাচঁবে তুমি। তোমার কথাই ভাবছিলাম এখন “।
সাঁঝ অবাক হয় সেই সাথে খুশিও হয়। তার বর তাকে বুঝতে শুরু করেছে। গুরুত্ব দিচ্ছে। তার আদর যত্নের দিকে খেয়াল রাখে। সাঁঝ দুষ্টমি করে বলেো
” শুধু ভেবেই যাচ্ছিলে? বউকে চুমু খেতে মন চায়নি”?
উজান তব্দা খেয়ে যায় বউয়ের কথায়। বউ তার এতো ঠোঁটকাটা। মনে যা আসে টাস করে বলে দেয়। কত সহজে বলে দিলো আদরের কথা। এখন যদি উজান সায় না দেয় মুখ ফোলাবে। উজানও বা কম কিসে সেও বললো
” মন চায়নি আবার বলছো। আমার চোখ মুখ আর ঠোঁট কেমন শুকিয়ে গেছে তোমার আদর না পেয়ে। কেমন পানসে পানসে লাগতেছে আজকের দিন। তুমি কি জাদু করেছো বলোতো তোমাকে দেখলেই খালি আদর নিতে মন চায় বউ “।
সাঁঝ খিলখিল করে হাসে। সেও স্বামীর দুষ্টমি বুঝতে পারে। সেও তাল দিয়ে বলে
” আমারও স্বামী ছাড়া বিরহ লাগতেছে। কেমন ম্যারমেরে চারদিকে সবকিছু। খেতে ভালো লাগছে না। মনটা ভার লাগছে। বুকে একটু একটু ব্যাথা করে চোখটা ভারি হয়ে আসছে। কি অসুখ করলো বলোতো”?
উজান এই কথার মানে বুঝে তারপর বলে
” সাঁঝ আলমারির কাছে যাও। গিয়ে দ্বিতীয় কার্বাডে দেখো একটা প্যাকেট রাখা। খুলে দেখোতো কি আছে এতে”?
সাঁঝ বলে
” এই তুমি আমার জন্য সারপ্রাইজ রেখেছো। বাহ দারুন ব্যাপারতো। দেখেছো রোমান্টিক বউ পাওয়ার কি সুবিধা। তুমিও নিরামিষ থেকে রোমান্টিক হয়ে গেছো”।
উজান হেসে বলে
” জি মহারানী। সবই আপনার জাদু। এই বুড়ো স্বামীকে রোমান্টিক হতে সাহায্য করছেন। এখন দেখে দ্রুত জানান কেমন লেগেছে সারপ্রাইজ”?
সাঁঝ রেগে যায় উজানের কথায়। তেজি গলায় বলে
” কে বুড়ো স্বামী? একদম ভালো লাগে না কিন্তু এরকম কথা বললে। ধুরো আমি কথাই বলবো না তোমার সাথে। মনটাই খারাপ করে দিলো”।
সাঁঝ রেগে গিয়ে ফোন রেখে দেয়। উজান থতমত খেয়ে যায়। আসলেই বউকে খেপানো ঠিক হয়নি। কিন্তু তার বউকে খেপাতে ভালো লাগে। বউ তার স্বামী পাগল একদম। একদম পতিব্রতা স্ত্রী যারে বলে তবে রেগে গেলে তাকে মানাতে উজানের দম বের হয়ে যায়। নিজের আত্নসম্মান নিয়ে খুব তটস্থ একজন মানুষ। সম্মান যেভাবে দিতে জানে ঠিক সেভাবে আদায় করতেও জানে। এতোদিনে সাঁঝকে দেখে সে বউ সম্পর্কে এইটা স্পষ্ট জেনেছে বউ তার খুব অভিমানী আর জেদী। উজান মনে মনে বললো
“তোর কপালে আজকে শনি আছে উজান। কেন যে বউকে রাগাতে গেলি। কপালে আজকে তোর সোফায় শোয়া লিখা আছে “।
সাঁঝ প্রচন্ড রেগে গেছে। কেন উজান নিজেকে বুড়ো বলে। সেতো বুড়ো নয়। যথেষ্ট হ্যান্ডসাম একজন মানুষ। যে কেউ দেখলেই পিছনে লাইন দেওয়া শুরু করবে। তবুও কেন সে নিজেকে নিয়ে এরকম হীনমন্যতায় থাকে বুঝতে পারেনা সে। আজকে আসুক বাড়ি। আজকে কপালে খাবার আর বউ কিছুই জুটবেনা তার। রুম থেকে বের হয়ে সোফায় থাকতে হবে। কি ভেবে আলমারি খুললো। উজানের কথামতো সেকেন্ডে কাবার্ড থেকে শপিং ব্যাগ এর প্যাকেটটা নিলো সে। সেটা খুলে যা দেখলো তাতে তার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। মনে মনে কঠিন একটা পরিকল্পনা করলো সে। বউকে রাগিয়ে দিয় উজান ভালো করেনি । আজকে তাকে উপোস রাখবে সাঁঝ। এইটা যেন তেন উপোস নয় এটাকে বলে বউ সোহাগী উপোস। অফিস থেকে আসার সময় বউ এর মান ভাঙানোর জন্য টকটকে লাল এক তোড়া গোলাপ কিনলো আর সাথে বউয়ের পছন্দের কাচ্চি বিরিয়ানি আর সাথে নিলো বাদামের শরবত। এটা দেখে যদি বউয়ের একটু রাগ কমে। ডোর বেল দিলো সে অনেকটা ভয়ে ভয়ে। গুনে গুনে দুই মিনিট পরে সাঁঝ দরজা খুললো। দরজা খুলতেই ফুলের তোড়া বউকে এগিয়ে দিতেই উজান বউ এর বিধ্বংসী রুপ দেখে পুরো তব্দা খেয়ে আছে। এইটা কে তার সামনে দাড়িঁয়ে আছে। লাল রক্তজবা শাড়ি তার উপর স্লিভলেস ব্লাউজে যথেষ্ট মোহনীয় আর আবেদনময়ী লাগছে তার বউকে। কড়া শেডের লিপ্সটিক এই মেয়ে তার জান উড়াই দিবে আজকে। চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে উজানের। সাঁঝ বুঝতে পেরে বললো
” চুপচাপ অন্য ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হবা। আজকে সেখানেই থাকবা। একদম আমার ঘরে আসবে না। আসলেই খবর আছে। খাবারও সেখানেই দিয়ে আসবো”।
এই বলে সাঁঝ গটগট করে আচঁল উঠিয়ে চলে যায় রান্নাঘরে। উজান পেছন থেকে চিৎকার করে বলে
” বউ এই অধম স্বামীকে একটু দয়া করা যায় না? এই উপোস মেনে নিতে পারবো না। বউ ও বউ বউ শোনো!!!!!
চলবে………..
#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ২১
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
বিছানার উপরে বুকে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে উজান। বুকের বাঁ পাশে তার ডান হাত রাখা। কোন সাড়া শব্দ নেই একদম নিশ্চুপ। মনে হচ্ছে যেন ঘুমাচ্ছে। প্রায় বিশ মিনিট হয়ে গেছে সে কাপড় বদলে হাত মুখ ধুতে এই ঘরে এসেছে। সাঁঝ সত্যিই তাকে তাদের ঘরে যেতে দেয়নি আজকে। কাপড় গুছিয়ে আগেই এই ঘর মানে উজানের মায়ের ঘর যেটা সেখানে রেখে গেছে। আসলেই ব্যাপারটা গুরুতর হয়ে গেছে। উজান এতোটাও গভীরে ভাবেনি যে তার বউ আজকে এতোবেশি রাগ করবে। সাঁঝ উজানের আনা বিরিয়ানির প্যাকেটগুলো থেকে খাবার সব প্লেটে বাড়লো। উজান হাতে মাখা সালাদ পছন্দ করে। শসা, টমেটো, মরিচ, পেয়াঁজ আর গাজর কুচি করে নিলো। লেবু ফালি করলো। সে অনলাইনে খাবারের থালি সাজানো দেখেছে। দেখতে বেশ ভালো লাগে। তাই সে বড় প্লেট নিলো। কাবাব, রোষ্ট, ডিম আর সালাদ দিয়ে ঠিক যেভাবে থালি সাজায় সেইভাবেই সাজালো। সে একটা লেকচারে শুনেছে স্বামী -স্ত্রী এক থালায় ভাত খেলে তাদের মধ্য ভালোবাসা বেড়ে যায়। তাই তারা একসাথে খাবে আজকে। উজানের উপর রাগ তার এখনো আছে। কিন্তু তার বর ফেরার সময় তার পছন্দের ফুল আর খাবার নিয়ে এসেছে তাই মনে মনে ভাবলো বেচারা স্বামীকে আর উপোস রাখা ঠিক হবে না। তার খাবার সাজানো শেষ। কিন্তু উজান এখনো ডাইনিং টেবিলে আসেনি। অনেকটা সময় হয়ে গেছে সে ফ্রেশ হতে গেছে। সাঁঝ খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে উজানকে ডাকতে গেলো। ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখে উজান বিছানায় শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। সাঁঝ অবাক হলো। উজান এখনো কাপড় পরিবর্তন করেনি। অফিসের সাদা শার্ট পরেই আছে। সাঁঝ উজানকে গায়ে হাত দিয়ে ডাকে
” উজান হঠাৎ শুয়ে আছো কেন? কাপড় পরিবর্তন করোনি এখনো”।
উজানের কোন সাড়াশব্দ নেই। উজান চোখ খুলছে না। সাঁঝ আবারও ডাকে।
“উজান কি হয়েছে”?
এবারও কোন সাড়া নেই উজানের। সাঁঝ অজানা ভয়ে চমকে উঠে। বুক কাঁপছে তার। জোরে জোরে ধাক্কাতে থাকে উজানের গায়ে। না উজান চোখ খুলছে না। সাঁঝ উজানের বুকে মাথা রেখে ভয়ে একদম চিৎকার দিয়ে ডেকে উঠে। ডুকরে কেঁদে ফেলে। চিৎকারে উজানের কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম। বউকে ভয় দেখাবে বলে একটু অভিনয় করছিলো সে। অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকার জন্য গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েছিলো সে। এই দিকে তার বউ ভেবেছে উল্টো পালটা কিছু হয়ে গেছে। বউকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তারপর বলে
” কি ভেবেছো বউ আমি ম’রে গেছি? বিরিয়ানি না খেয়ে তোমাকে এভাবে ছেড়ে যাবো বলো? পয়ঁতাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর খাবারের পার্সেল রেডি করে দিয়েছে। সেই তোমার সাথে ডিনার ডেইট না করে এভাবে চলে গেলে ভালো লাগবে না। ক্লান্ত থাকায় হঠাৎ করে চোখ লেগে এসেছিলো তাই এভাবেই ঘুমিয়ে গেছি। মায়ের রুমে আসলাম অনেকদিন পর। এই বিছানায় মা ঘুমাতো। এগুলো সব মায়ের হাতে কেনা চাদর। তাই মাকে মনে পড়ছে আজকে খুব। বিছানায় শোয়ার পর মনে হচ্ছিলো মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কখন যে ঘুমিয়ে গেছি। আমি এতো হতভাগা সন্তান কেন সাঁঝ? বাবাকে হারালাম অল্প বয়সে। মা অনেক শখ করে বিয়ে দিলো। নিঃসন্তান হয়ে রইলাম। প্রাক্তন স্ত্রীর ধোঁকা। শেষে মা ছেলের একটা ছোট্ট সংসার ছিলো। সেও আমাকে এতো বড় দুনিয়ায় একা রেখে চলে গেলো। আজকে হঠাৎ মাকে খুবই মনে পড়ছে। আমার মা কে এনে দিবা সাঁঝ? তুমি যা চাও তাই দিবো। আমার মাকে এনে দাও প্লিজ “।
উজান সাঁঝকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। এতোটাই শক্ত করে মিশিয়ে নিয়ে আছে সাঁজ এর কোন নড়াচড়ার উপায় নাই। উজান ফুপিঁয়ে কাদঁছে। তার চোখের পানি দিয়ে সাঁঝের শাড়ি ভিজে যাচ্ছে। স্বামীর কান্না দেখে সাঁঝের কান্না এমনিতেই থেমে গেছে। এতোক্ষন মনোযোগ সহকারে উজানের কথা শুনছিলো সে। প্রতিটা কথা বুকে এসে লেগেছে তার। দুনিয়াতে উজান এতোদিন পুরো একা ছিলো। পুরোই একা। সাঁঝতো মাত্র কদিন হলো তার জীবনে এসেছে। এতো বড় দুনিয়ায় ছেলেটা এভাবেই একা থেকেছে। উজান আবার বলছে
” আমার মাকে এনে দাও সাঁঝ। আমি আম্মার কাছে যাবো। কতদিন আম্মার হাতে ভাত খাইনা। আম্মা ডেকে বলে না বাজারে গিয়ে বড় বড় গলদা চিংড়ি আনবি। আজকে তোকে নারিকেলের দুধ দিয়ে রেধেঁ দিবো। আর বলেনা আমি ফুল গাছ কিনবো। এই ছুটির দিনে নার্সারীতে নিয়ে যাবি। আমার আম্মা কোথায় গেলো? যাওয়ার আগে আমাকে কিছু বলেও গেলো না। সেই যে চোখ বন্ধ করলো আর খুললো না। আমাকে এতো বড় দুনিয়ায় একা রেখে গেলো। আর এই ঘরে ফিরলো না। আর তাকে আমি বাহিরে হাটঁতে নিয়ে যেতে পারিনা। মিষ্টি পছন্দ করতো কিন্তু ডায়বেটিস এর জন্য খেতে পারতো না। তবুও আমাকে বলতো আজকে একটু পায়েস রান্না করি তোর জন্য? অনেকদিন খাওয়া হয়নি। কত ঈদ চলে যায় কত দিন হয়ে গেছে তাকে নতুন শাড়ি কিনে দেওয়া হয়নি। বেতন আসলেই বলতো আজকে বাজার করে তারপর ঘরে ঢুকবি। শেষের দিকে এসে মা কত নরম হয়ে গিয়েছিলো। বাবার কথা মনে করে আমাকে জড়ায় ধরে কাঁদতো। আমাকে বলতো বাবা একটা বিয়ে করায় দেই। সারাজীবন একা থাকা কি যায়? আম্মা! আম্মা !আম্মা তুমি নাই। দেখো তোমার জন্য একটা নতুন ছেলে বউ আনছি। লাল টুকটুকে বউ। একদম চাঁদ পানা মুখ। আম্মা তোমার গয়না আমি তাকে দিয়ে দিছি। তোমার ছেলে বউ অনেক ভালো কিন্তু তোমার মতো ভালো রান্না করতে পারেনা। অভিমান করে থাকে আর জেদ করে। আম্মা জানো তোমার ছেলে বউ এতো দুষ্টু তোমার ছেলেকে খুব জ্বালায়। আম্মা তুমি একবার আসো। আমাদের দোয়া করে দিয়ে যাও। আসো না একটু!!! আসলে কি হয়। তোমারে অনেক মনে পড়ে আমার। আমারে মাফ করে দিও আম্মা। তোমার অনেক কষ্ট দিয়েছি। আম্মা! আম্মা!আম্মা!”
উজানের কথা শুনে বুক ভেঙে কান্না আসতেছে সাঁঝের। ছেলেটা বাহির থেকে দেখলে কত শক্ত মনে হয়। ভেতরে কতটা নরম মাটির মতো। সময়ের নিয়তির কঠিন বাস্তবতার কাছে মাথা নত করতে হয়েছে তাকে। সাঁঝ মনে মনে আওড়ায়
” উপরওয়ালা তোমার কষ্টগুলো আমাকেও ভাগ করে দিক। তুমি একা কেন কষ্ট পাবা উজান? আমি তোমার স্ত্রী আমারও তোমার কষ্টে সমান অধিকার আছে। আমিও তোমার কষ্টে নিজেকে শরীক করতে চাই। আমাকেও তোমার সাথে নাও প্লিজ”।
কিন্তু কথাগুলো মুখ ফুটে বের হয়না। কেমন জড়িয়ে যায়। ছিন্ন ভিন্ন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সাঁঝ উজানের বুকের উপর থেকে খানিকটা মাথা তুলে উজানকে দেখে। চোখ বন্ধ করে আছে। দুচোখের কার্নিশ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। উজানকে এভাবে দেখে কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে তার। কিভাবে স্বামীর এই শোক কমাবে সে? যারা দুনিয়া ছেড়ে চলে যায় তারা যে আর ফেরে না। যদি সাধ্য থাকতো সাঁঝ দিন দুনিয়া এক করে ফেলতো স্বামীর কষ্ট কমানোর জন্য। কিন্তু সেতো সাধারণ মানুষ। তার কোন ক্ষমতা নাই। কিভাবে সে স্বামীর কষ্ট কমাবে? কি করলে উজান একটু হালকা হবে? ছেলেটা সারাদিন অফিসে কাজ করেছে। খেয়েছে সেই দুপুরে। কতক্ষণ অবধি না খাওয়া। সাঁঝ এর মাথায় কিছুই আসছে না। সাঁঝ একটু উপর দিকে উঠে উজানের মুখ বরাবর ঝুঁকলো। শার্টের আরও দুইটা বোতাম খুলে দিলো। উজানের মুখে হাত ছুঁয়ে দিলো। কপালে গভীরভাবে একটা ভেজা হামি দিলো। উজান কিছুটা কেপেঁ উঠে। নরম গলায় সাঁঝ বলে
” উজান আমি বউ তোমাকে খুব ভালোবাসি। তুমি আর একা নও। তোমার আমি আছি জান। আমার তোমার সবকিছুর উপর হক আছে। তোমার সুখের উপরব,আদরের উপর, তোমার মন খারাপের সময়ের উপর। তোমার শোক তাপের উপরেও আমার সমান অধিকার আছে। আমিও তোমার সাথে এগুলো ভাগ করে নিতে চাই। আমাকেতো আপন ভাবতে পারো। কি পারো না”?
উজান চোখ মেলে তাকায়। এক নববধু লাল শাড়ি পড়ে মোহনীয় আবেশে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই নারী তার একমাত্র ভরসা। এই নারীকে নিয়েই তার এখন দিন রাত সংসার সাজাতে হবে। তার সাথেই বাকি জীবন পাড়ি দেওয়াতে মনোনিবেশ করতে হবে। এই নারী তাকে খুব টানে। এই নারীকে দেখলেই বুকের ভেতর ক্ষতগুলোতে যেন ওষুধ পড়ে জ্বলুনি কমে যায়। বুকের ব্যাথা উপশম হয়। উজান হাতের মৃদু ধাক্কাতে সাঁঝকে নিজের উপর থেকে সড়িয়ে নিজেই সাঁঝের উপর ঝুঁকে আসে। সাঁঝ চমকায় না ভরকে যায় না। স্থির হয়ে উজানকে দেখে। উজান বলে
” আমি পারবো না উপোস থাকতে। আমার তোমাকে চাই, কাছে আরও গভীরে ঠিক যেমন রক্ত শরীরের সাথে মিশে থাকে তেমন করে তোমাকে চাই। আমার সবকিছুতে নিগূঢ় স্পর্শে আমার আদরে আহ্লাদে তোমাকে এখন চাই”।
সাঁঝ বলে
” আমি চাইও না তুমি উপোস থাকো। আমি তোমার শুধুই তোমার। যেভাবে চাও যা মন চায় করো “।
উজান এর এখন শুধু সাঁঝকে প্রয়োজন। একমাত্র তার বউ এখন তার কষ্ট কমাতে পারে। উজান নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে নির্দ্বিধায় সাঁঝের বুকে আশ্রয় নিলো। বাহিরে তুমুল অশান্ত বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু উজান এর বুকের ভেতরটা ক্রমশ ঠান্ডা আর শান্ত হয়ে আসছে।
চলবে………….