#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ২২
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
“তোদের সবার কাছে যা কিছু আছে সব দিয়ে দে নাইলে কাউকে জীবিত ছাড়বোনা “।
এই হুমকিতে বাসে থাকা সব যাত্রী আতঙ্কিত হয়ে গেলো। সময় রাত বারোটা ছুঁইছুঁই। উজানদের নিয়ে যে বাস নওগাঁ যাচ্ছিলো সেটা ছিনতাই এর কবলে পড়েছে। বগুড়া শেরপুর ফুড ভিলেজ হাইওয়ে রেষ্টুরেন্ট এ পচিঁশ মিনিটের যাত্রা বিরতি ছিলো। যাত্রা বিরতি শেষ হওয়ার পর নিয়মমাফিক আবারও বাস চলতে শুরু করার দশ মিনিট পর গাড়িটি ছিনতাই এর কবলে পড়ে। বেশ নাটকীয় কায়দায় কিছু স্থানীয় অসাধু মানুষ এই ঘটনাটা সাজায়। প্রথমে পাঁচজন মানুষ সাহায্যের নাম করে গাড়ি আটকায়। তাদের একজন খুব অসুস্থ এবং দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে এরকম অনুনয় বিনয় করতে থাকে। যেহেতু কোচ বাস তাই নিয়ম আছে সিট খালি থাকলেও মাঝরাস্তায় অতিরিক্ত টাকা পয়সার মোহে না পড়ে কোন যাত্রী না উঠাতে। এখানেই তাই হলো। বাস ড্রাইভার এবং সুপারভাইজার কিছুতেই রাজি না অজ্ঞাতদের গাড়িতে উঠাতে। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা খুবই সহজ সরল এবং দয়ার শরীর। অসহায় মানুষদের দুঃখ কষ্ট দেখলেই তার মন কাঁদে। বাসে বিদ্যমান কিছু মুরুব্বি বললো যেহেতু সামনেই সদর উপজেলা অন্তত সেই অবধি নিয়ে যেতে। তারপর তারা গাড়ির ব্যবস্থা করে নিজেরাই চলে যাবে। মিনিট পাচেঁক বাকবিতন্ডা হওয়ার পর সেই পাচঁজন ব্যক্তিদের গাড়িতে উঠানো হয় এবং তারা গাড়িতে খুব ধীর স্থির ভাবেই উঠে। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলে কিছুটা নির্জন জায়গায় যেখানে জনবসতি কম এবং আশেপাশে গ্রাম এলাকা শুধু মাঠের পর মাঠ আবাদি জমি এমন জায়গায় এসে সেই পাচঁজন মানুষ হঠাৎ করে বিকট চিৎকার দিয়ে পেছন এর সিট থেকে একজনকে জিম্মি করে বের করে নিয়ে আসে। উপস্থিত সবাই আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকে। অজ্ঞাত দূর্বত্তরা আবার প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে ধমক দিয়ে উঠে। তাদের একজন বাস ড্রাইভার এর দিকে এগিয়ে যায় এবং তার গলায় ছু*রি ধরে বলে
” চুপচাপ গাড়ি চালাবি। যতক্ষণ না আমরা কাজ শেষ করবো গাড়ি যেন না থামে। একটু চালাকি করবিতো একজন যাত্রীও বাঁচবেনা”।
অজ্ঞাত দূর্বৃত্তদের ধমক খেয়ে সবাই প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছে। চিন্তায় অস্থিরতায় একেকজনের প্রান যায় যায় অবস্থা। একজন সামনে আরেকজন বাসের একদম পেছেনে দাঁড়িয়ে থেকে সবার উপর নজর রাখছে যাতে কেউ পুলিশে খবর দিতে না পারে আর বাকি তিনজন লুটপাট করতে ব্যস্ত। সবাই প্রাণ বাচাঁতে যার কাছে যা আছে দিয়ে দিচ্ছে। উজানরা বসে ছিলো গাড়ির মাঝ বরাবর। সবার কাছ থেকে জিনিসপত্র নেওয়ার পর উজানদের এর সিট এর কাছে দুজন পুরুষ মানুষ এসে দাঁড়ায়। উজান তাদের দেখে চমকে উঠে কিন্তু ভড়কে যায় না। অস্থির হয় না অশান্ত হয়ে তাদের সাথে বাকবিতন্ডাতেও জড়ায় না কারণ সে জানে তারা অনেক খারাপ ধরনের কাজ করে। তাদের মনুষ্যত্ব বলতে কিছু থাকে না। উজানের ভয়টা আরও বেশি কারণ সাথে সাঁঝ আছে। সাঁঝ ভয়ে কাঁপছে। উজানের শার্ট ডান হাত দিয়ে খামচে ধরে আছে। যেহেতু বোরকা পড়ে আছে সে তাই তাকে খুব ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। উজানের কাছে এসে একজন পুরুষ মানুষ বললো
” তোর কাপড় চোপড় দেখেতো মনে হচ্ছে বেশ ভালো অবস্থা তোর। মালদার মানুষ তুই। অনেক টাকা পয়সা সাথে করে নিয়ে আসছিস। চুপচাপ যা আছে বের কর। একটা কথা বলবিতো এখানেই তোর কাহিনী শেষ করে ফেলবো”।
উজান কোন রকম কথা না বলে নিজের কাছে যা আছে বের করলো। তার কাছে নগদ প্রায় পাচঁ হাজার টাকা ব্যাংকের কার্ড সহ মোবাইল ফোন ছিলো। উজানের কাছ থেকে জিনিসপত্র নেওয়া হয়ে গেলে এবার তাদের চোখ যায় সাঁঝের দিকে। ভীত দুই চোখে সাঁঝ ভয়ে আড়ষ্ট তটস্থ হয়ে আছে। তাদের একজন বললো
” বউ এর সোনাদানা যা আছে তা দিয়ে দে। নয়তো কান গলা ছিড়ে টেনে সেগুলো নিয়ে নিবো”।
উজানের রক্ত গরম হয়ে যায় এই কথা শুনে। তারই সামনে তার বউ এর গায়ে হাত দেওয়ার কথা বলছে। ইচ্ছে করতেছে তাদের হাতে থাকা সেটা দিয়েই মুন্ডু নিপাত করতে কিন্তু এগুলো করলে হীতে বিপরীত হবে তাই চুপচাপ উজান নিজেই গয়না গুলো খুলে নিয়ে দেয়। তাদের কাছ থেকে জিনিসপত্র আদায় শেষ হলে বলে
” তুই ব্যাডা বুদ্ধিমান মানুষ। ঝামেলা হবে দেখে আগে পিছে কোন কথাই বললি না। চুপচাপ সব কথা শুনলি। তোরে ভালো লাগছে”।
এই বলে হেরো গলায় হাসতে শুরু করে। অন্য সিটের মানুষ এর কাছে যেতেই গাড়ি থেমে যায়। গাড়ি থামতেই সামনে থাকা তাদের একজন চিৎকার করে উঠে
” এই ড্রাইভার গাড়ি থামাইলি ক্যান। তোরে না বলছি চুপচাপ গাড়ি চালায় নিয়ে যাইতে। বাংলা কথা বুঝিস নাই”?
ড্রাইভার চটপট উত্তর করলো
” পুলিশ আমাদের গাড়ি আটকাইছে। সামনে দেখেন পুলিশ অফিসার দাড়াঁয় আছে কতগুলা”।
পাচঁজন অজ্ঞাত দূর্বৃত্ত এবং অসাধু পুরুষ তখন হতবিহ্বল হয়ে যায়। এইটা তাদের পরিকল্পনা ছিলো না। এটা তারা ভাবেনি। কারণ চলন্ত গাড়িতে চুপচাপ এসব করলে দূর থেকে কারো সন্দেহ হওয়ার কথা না। মাঝিড়া ক্যান্টনমেন্ট এবং শাহজাহানপুর থানা এখান থেকে আরও সামনে আছে। তাদের মধ্য এবার ভয়ে সব তালগোল পাকিয়ে যায়। এদিকে পুলিশ এসে গাড়ির দরজা জোরে জোরে ধাক্কাতে থাকে। এদের মধ্যেই একজন বলে
” ওস্তাদ শুধু পুলিশ না দুই গাড়ি আর্মিও আছে সাথে”।
আর্মি আছে শুনেই তারা আরও বেশি অশান্ত হয়ে যায়। এরই মধ্য বাসের সুপারভাইজার গিয়ে বাসের দরজার লক খুলে দেয়। সাথে সাথে পুলিশ বাসের মধ্য ঢোকে। ছিনতাইকারীরা সাথে সাথে হাত উঠিয়ে নেয়। বুঝা যাচ্ছে এই লাইনে নতুনসবাই। তারা অনভিজ্ঞ। অভিজ্ঞরা বুঝে এই সময়ে পরিস্থিতি কিভাবে একটু হলেও আরও ভীতকর বানানো যায়। পুলিশ অফিসার গুলো তাদের সাথে থাকা জিনিসপত্র নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেয় এবং সাথে সাথে যাত্রীদের কাছ থেকে যা কিছু নিয়েছে সব দিয়ে দিতে বলে। তারা সেটাই করে কারন পালানোর পথ আর নাই। ধরা পরেই গেছে। তারপর তাদের বাস থেকে লাইন করে নামানো হয় হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে। আশেপাশে তখন অনেক মানুষের ভীড় জমে গেছে। কৌতুহল জনতা অনেকেই এসে নানা ভাবে এই দৃশ্য দেখছে। কেউ ভিডিও করছে। বাসটি পুলিশ থামিয়েছে একটা বাজারের কাছে। তাই সব মানুষ এসে ভীড় করেছে। লুটপাট করা টাকা পয়সা এবং মহিলাদের জিনিসপত্র সবারটা সবাইকে আর্মি সদস্যরা বুঝিয়ে দিলো। তারপর একজন সেনা সদস্য জিজ্ঞেস করলো
” ৯৯৯ এ কল করেছিলেন কে আপনাদের মধ্য? উনি প্লিজ এগিয়ে আসবেন সামনে”?
উজান বুক টান টান করে সস্ত্রীক সামনে এগিয়ে যায়। সাঁঝ প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলো। এখনো বুক কাঁপছে তার। অনেক আজেবাজে চিন্তা মাথায় এসেছিলো। উজান আইন শৃঙ্খলা সদস্যদের বলে
” আমি ফোন করেছিলাম আপনাদের কাছে। ফুড ভিলেজে যখন গাড়ি থামায় বাস থেকে নামার সময় আমি এই পাঁচজনকে অন্য একটা লোকাল বাস থেকে নামতে দেখেছিলাম। তাদের চেহারা দেখেই সন্দেহ হয়েছিলো এরা অসাধু কাজের সাথে জড়িত। তারা যখন আমাদের বাসে উঠে তখন তাদের গা থেকে খুব বিশ্রী একটা গন্ধ আসছিলো যেমনটা মনে হয় কেউ নেশা করলে হয়। তাদের চোখ মুখের ভঙ্গিও সাধারণ নিরীহ মানুষের মতো না। আর তাছাড়া এখান থেকে যেকোনো হসপিটাল কাছেই। কেন তারা মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে হসপিটাল যাওয়ার জন্য বলবে। তাদের যখন গাড়িতে উঠানোর কথা হচ্ছিলো তখনই আমি ৯৯৯ এ কল করে থানায় যোগাযোগ করি। তখন আমাকে বলা হয় ভীত না হয়ে বাসকে বাজারের কাছে নিয়ে আসতে যাতে তারা তাদের হাতেনাতে ধরতে পারে এবং চেষ্টা করতে যাতে যাত্রীরা প্যানিক না করে। এজন্য আমি তাদের সাথে কোনো রকম তর্কে জড়ায়নি”।
উজানের এই বুদ্ধির প্রয়োগ এবং সাহসিকতা দেখে সবাই অনেক খুশি হয়। তাকে বাহবা দেয়। আর্মি এবং পুলিশ সদস্যরা সকল নিয়ম পালন করে অসাধুদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। বাস প্রায় এক ঘন্টার মতো দেরি করে সকল কাজকর্ম শেষ করতে তারপর আবার নওগাঁর উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করে। বাসে থাকা সকল যাত্রীদের জন্য এই দিনটি ভয়ানক এক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে সেই সাথে শিক্ষনীয়। সব জায়গায় দরদ এবং মায়া দেখানো ঠিক নয়। একের লাঠি দশের বোঝা হয়ে যায়। সাঁঝ এখনো ট্রমার মধ্য আছে। সে উজানের শার্ট খামচে ধরেই আছে। বুকের কাঁপুনি এখনো কমেনি। ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদেই যাচ্ছে। তারা রাত আটটার বাসে রওনা দিয়েছিলো নওগাঁ যাবে বলে। রানীনগর উপজেলার বেলবাড়ি গ্রামে উজানের মামাবাড়ি। নতুন বউকে নিয়ে উজান সেখানেই যাচ্ছে। এইতো আরও ঘন্টাদুয়েক লাগবে। এই অরাজকতা না হলে এতোক্ষনে পৌছেঁ যেতো তারা। সাঁঝ এর এই অবস্থা দেখে উজান নিজেও কেমন অস্থির হয়ে গেলো। ভয়তো সেও পেয়েছিলো।এসব মানুষের মধ্য মানবিকতা লজ্জা এবং মনুষ্যত্ব বলে কিছু থাকে না। যদি সাঁঝের গায়ে তারা হাত দিতো? যদি অসম্মান করার চেষ্টা করতো? আর ভাবতে পারে না সে। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তার। উজান সাঁঝের হাত শক্ত করে ধরলো। এক হাত দিয়ে সাঁঝের কাধঁ জড়িয়ে নিলো বুকের মধ্য। তারপর বললো
” আর ভয় নেই বউ। উপরওয়ালা বিপদ থেকে বের করেছেন। আমি আছি ভয় পেয়ো না জান”।
সাঁঝের কপালটা স্কার্ফ দিয়ে ঢাকা। তার উপরেই পরম আদরে উজান একটা চুমু দিলো। আশ্চর্য বিষয় কিভাবে যেন সাঁঝের বুকের কাঁপুনি উধাও হয়ে গেছে।
চলবে………….
#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ২৩
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
” তোমার আগের বউতো এই বউ এর চেয়ে বেশি সুন্দর ছিলো। গায়ের রং আরও ধবধবে ফর্সা ছিলো। এই বউটাও দেখি সুন্দরই পাইছো তবে আগেরটার মতো গায়ের রঙ মেলানো না। পুরুষ মানুষ এর টাকা পয়সা থাকলে যে বউ পাইতে কিছু লাগে না তুমি তার প্রমাণ নাইলে দেখো যে ব্যাডা মানুষ পোলাপান জন্ম দিতে পারবে না তার কপালেই সুন্দর বউ জোটে। আর আমরা কপাল করে ছেলের বউ পাইছি। আমাদের ছেলেরা বলে শক্তিতে চেহারায় রাজপুত্রের চেয়ে কোন অংশে কম না কিন্তু একেকটা বিয়ে করে নিয়ে আসছে সব ছোটলোকের মেয়েরে। না আছে ঢক না আছে কামের ছিরি। ঘরে বউ আসতে না আসতেই সংসারে ভাঙন ধরায় আলাদা হয়ে গেছে। মা-বাপে বাঁচলো কি নাই হয়ে গেলো সেই খোঁজটাও নেয় না। বউতো তাবিজ জাদু করে আমার ছেলেদের হাত করে রাখছে মা-বাপের কাছে আসবে কেমনে”?
বিদ্রুপের ভাষায় কথাগুলো বলে বিলাপ করছেন উজানের ছোট মামীর মা। বসার ঘরে একগাদা মেহমানদের সামনে এই তীর্যক কথা শুনে উজানের মনে হচ্ছে কানে কেউ যেন গরম শিশা ঢেলে দিলো। লজ্জায় তার দম আটকে আসছে। সাঁঝের দিকে একপলক তাকালো সে। এতোগুলো নতুন মানুষ তার সামনে তার উপর নতুন জায়গা স্বামীর আত্নীয় স্বজন সবাই। প্রথম দিনেই এতো বাজে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে এটা হয়তো সে কস্মিনকালেও ভাবে নাই। উজানের মনে হচ্ছে বউকে নিয়ে এখনই এক ছুটে দরজা দিয়ে বের হয়ে যেতে। মহিলার লাগামহীন কথায় রাগে ক্ষোভে চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো উপস্থিত সবার। এমনিতেই গতরাতে আসার পথে এরকম লোমহর্ষক ঘটনার রেশ তাদের মাথা থেকে যায়নি তার উপর আবার এরকম বাজে কথা ওদের তিক্ত বিরক্ত না করে দেয়। অনেক বছর পর তাদের বোনের ছেলে মামার বাড়ি এসেছে। উজানের ছোট মামা তার স্ত্রীকে ধীর গলায় ফিসফিস করে বললেন
” রাজিয়া তোমার মাকে এই মুহুর্তে এখান থেকে অন্য ঘরে নিয়ে যাও। এতো বয়স হয়ে গেছে তবুও কোথায় কি বলতে হবে সেই জ্ঞান নাই। থাকবে কেমনে? বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়ে গেলে এগুলো জ্ঞান থাকে না। উজান এমনিতেই এই বাড়ি আসে না আজ কত বছর। যাও বা দরকারে আসলো শুরুতেই তোমার মা এরকম একটা কান্ড করে বসলো। আমি গাড়ি রেডি করে দিতে বলতেছি। তোমার মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও। মাসের পর মাস মেয়ের শ্বশুর বাড়ি এসে পড়ে থাকবে আবার সেই বাড়ির ছেলেমেয়েদের বদনাম করবে। নিজের ছেলেমেয়েদেরও অন্যদের কাছে ছোট করে। এই জন্যই তোমার ভাইরা আলাদা হয়ে গেছে। তোমার মা তৈরী হয়ে থাকতে বলো। গাড়ি আসলে বিনা তামশা করে আপাতত বিদায় নেয়। ম-রা বোনের ছেলেটা এতো বছর পর মামার বাড়ি আসলো এসেই এই তামশা হলো”।
স্বামীর কড়া কথা শুনে উজানের ছোট মামীর খুব খারাপ লাগলো। তার মায়ের আসলেই দিন দিন জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে। কোথায় কি বলতে হবে কাকে বলতে হবে সেসব ভুলে যাচ্ছে। মেয়ের সংসারে এসে তারই স্বামীর এর ভাগনেকে কথা শোনাচ্ছে। এইটা কোন মেয়ের স্বামী ভালো চোখে দেখবে? মায়ের এই ব্যবহারের জন্যই ভাইরা সব বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে যে যার মতো। এখন মেয়ের বাড়ি এসে অধিকাংশ সময় থাকে। কিছু বললেই ছ্যাতঁ করে উঠে। আজকে এই কান্ড দেখে তার নিজেরই লজ্জা লাগছে। নতুব বউ এর সামনে কি এক বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটে গেলো। দাতেঁ দাতঁ চেপে রাজিয়া তার মাকে বললো
” মা তোমার সাথে একটা জরুরি আলাপ আছে ঘরে চলোতো”।
রাজিয়ার মা বললো
” কি এমন জরুরী আলাপ যে ঘরে যেতে হবে? এখানেই বল শুনি। বাড়িতে নতুন বউ আসছে তার সাথে একটু আলাপ পরিচয় হই। তার কথাবার্তা শুনি। ঘরদোড় বংশ কেমন? বাপে কি করে এগুলো শুনি। তোর আবার আমার সাথে কি আলাপ?
রাজিয়ার রাগ যেন সাত আসমানে উঠে গেলো। মাথা দপদপ করে উঠলো তার মায়ের কথা শুনে। এরকম কান্ড করার পর আবার নতুন বউ এর বংশ নিয়ে পরেছে। সে তার মায়ের হাত ধরে টানতে টানতে বললো
” জরুরি আলাপ যেহেতু বলেছি তার মানে সেটা আছে বলেই বলেছি। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ চলো আমার সাথে”।
রাজিয়া তার মাকে এক প্রকার টেনেই ঘরের মধ্য নিয়ে গেলো। এতোক্ষণ যেন সবাই শ্বাস টেনে নিয়ে ছিলো বুকের মধ্য। মহিলা ঘরের মধ্য যেতেই সবাই শ্বাস ছাড়লো। বড় মামা উজান আর তার বউকে সহজ করতে বললেন
” বুড়ো মানুষ কি বলতে কি বলে ফেলে ঠিক নাই। তোমরা তার কথায় কিছু মনে করোনা। অনেক বেলা হয়ে গেছে আগে নাস্তা সেড়ে নাও। কাল থেকে ঠিকমতো খাওয়া নেই তোমাদের। আগে পেট ভরাতে হবে তারপর বাকি কথা হবে”।
শহরের মতো গ্রামগুলোতে এখন চেয়ার টেবিলে বসে খাওয়ার চল বেড়ে গেলেও কিছু কিছু পরিবারে মাটিতে পাটি বিছিয়ে সবার একসাথে খাওয়ার অভ্যাস এখনো আছে। বিশেষ করে যেসব পরিবার এখনো একান্নবর্তী পরিবার হয়ে আছে। উজানের দুই মামা তাদের ছেলে মেয়ে নিয়ে এখনো একান্নবর্তী পরিবারের মতোই থাকে তবে তাদের হেসেঁল আলাদা। বাড়িতে মেহমান আসলেই শুধু তারা এক উনুনে হাড়ি চড়ায়। এটা তারা করে যাতে মেহমানদের আলাদা করে এ বাড়ি ও বাড়ি দিন রাত ভাগ করতে না হয়। উজান সাঁঝের হাতটা শক্ত করে বললো
” বয়স্ক মানুষ কত কথাই বলে কিছু মনে করো না। আমরা আজ আছি দুই দিন পর চলে যাবো। কথা ধরে কাজ নেই। চলো ক্ষুধা লাগছে খুব। নাস্তা করে নেই আগে”।
সাঁঝ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায় স্বামীর কথায়। কিছুটা কষ্ট সে পেয়েছে অবশ্য। তার স্বামীর আগের বউ তার থেকে সুন্দরী ছিলো এই কথা তার ভালো লাগেনি। নারীর সহজাত প্রবৃত্তিই এমন। স্বামীর সাথে অন্য নারীকে টেনে কথা বললে খুব কষ্ট হয়। সাঁঝ এসব নিয়ে ভাবতে চায়না এখন। তার সাথে উজান থাকলেই যথেষ্ট। তারা নাস্তা করতে বসে পড়লো। বড় মামীর হাতের কয়েক পদের পিঠা আছে। চালের রুটির সাথে দেশী হাঁসের ঝাল ভুনা, দুধ পিঠা, সেমাই, খিচুড়ি ডিম ভাজা সবই করেছে। একসাথে এতো পদ দেখে উজান আর সাঁঝ কেউ ভড়কায় না।তারা জানে গ্রামের আতিথিয়েতা এরকমই হয়। সবার সাথে নাস্তা সেড়ে উজান আর সাঁঝ নিজেদের ঘরে চলে গেলো। তারা রাত দুটোর দিকে বাড়ি এসে পৌছেঁছে। ভয়ের রেশ এখনো যায়নি সেই সাথে ক্লান্তিতো আছে। ঘুম পুরো হয়নি। তাই আবার ঘুম পাচ্ছে উজানের। সাঁঝেরও ক্লান্ত লাগছে কিন্তু ঘুমালে যদি কেউ আবার বলে
“নতুন বউয়ের লজ্জা নাই। দিনে দুপুরে দরজায় খিল দিয়ে স্বামীর সাথে থাকে “।
সাঁঝকে বসে থাকতে দেখে উজান তাকে হঠাৎ করে টেনে বিছানায় ফেলে দেয়। উজান সাঁঝ এর উপর ঝুঁকে আছে এক দৃষ্টিতে। কেউ কিছুই বলছে না শুধু একে অপরের দিকে চেয়েই আছে। এভাবে পাঁচ মিনিট চলে যাওয়ার পর সাঁঝ উজানকে বলে
” আপনার আগের বউ আমার থেকে বেশি সুন্দরী ছিলো তাই না? আপনি তাকে খুব ভালোবাসতেন? অনেক বেশি আদর করতেন? আচ্ছা আমাকে যেভাবে আদর করেন তার চেয়েও গভীরে গিয়ে আদর করতেন? সেও আপনাকে অনেক আদর করতো? আমার চেয়েও বেশি? আমার ভালোবাসাতে কি কমতি পান আপনি? আমার আদরে কি কোন ত্রুটি আছে? যদি থাকে তাহলে বলেন আমি আরও চেষ্টা করবো। আমি আপনাকে ভালোবাসতে বা আদর যত্ন করতে কোন ত্রুটি রাখতে চাইনা। আমার স্বামীকে আমি আরও বেশি ভালোবাসবো যাতে কেউ কোন কথা না বলতে পারে”।
উজান এখন বুঝতে পারে সাঁঝের মন খারাপ এর জায়গাটা ঠিক কোথায় হয়েছে? তারই সামনে তার স্বামীর প্রাক্তন বউকে নিয়ে কথা বলেছে তার চেহারার রুপের প্রশংসা করেছে সেটা ভালো লাগেনি সাঁঝের। এইটা একদম স্বাভাবিক। যে কারো এমন প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা। উজান নিজের স্ত্রীর ছলছল হয়ে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে আছে যেনো একটু টোকা দিলেই ডুকরে কেঁদে উঠবে। না! কোনভাবেই থাকে কাদাঁনো যাবে না। তাহলে কি করা যাবে? সেটাই করতে হবে যেটা বউ একটু আগে বললো তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হবে তবে উত্তর মুখে দেওয়ার চেয়ে করে বুঝিয়ে দেওয়া বেশি ভালো। উজান আরেকটু ঝুঁকে যায় সাঁঝের মুখের উপর। তারপর বলে
“উত্তর কি একসাথে সব বুঝিয়ে দিতে হবে নাকি একটা একটা করে উত্তর চাও?
সাঁঝ বললো
” একসাথেই সব উত্তর চাই। আমিও জানতে চাই আমার কোথায় ত্রুটি বিচ্যুতি হচ্ছে আপনাকে বুঝতে”।
উজান আর কিছু বলতে চাইলো না। সাঁঝের পুরো মুখে হাত ছুইঁয়ে দিল। এলোপাথাড়ি এলোমেলো আদর আছড়ে পড়ছে সাঁঝের পুরো মুখ আর গলা জুড়ে। অধরের গভীরে ভেজা আদর পেয়ে সাঁঝ উজানকে শার্ট খামচে জড়িয়ে ধরে আছে। সাঁঝ নিজের ত্রুটি জানতে উজানকে আরও বেশি সুযোগ করে দিলো। শাড়ির আচঁল উন্মুক্ত করে দিলো তা দেখে উজান ক্ষীন গলায় বললো
” তুমি কি ধাতু দিয়ে গড়া সাঁঝ? আমাকে বারে বারে নিজের দিকে ধেয়ে নিয়ে যাও। ভাসিয়ে দাও। আমি তোমার অতলে ডুবে যাচ্ছিতো যাচ্ছিই।তুমি একজনই সাঁঝ। তোমার ভালোবাসাতে কোনো কমতি নাই আর না তোমার আদরে কোনো বিচ্যুতি আছে। এসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে নিজেকে কষ্ট দিবে না বলে রাখলাম”।
এইদিকে উজানের ছোটমামী রাজিয়া রাগে গজগজ করতে করতে তার মায়ের কাপড়ের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বললো
” আমার মান সম্মান এর কোন চিন্তা তোমার নাই মা? সবার সামনে আমাকে ছোট করে ফেললা। তোমার জামাই গাড়ি ডেকেছে। তৈরী হয়ে নাও। আপাতত ছয় মাস আমার এখানে আসবেনা আর তুমি। তুমিতো জানো তোমার জামাই এক কথার মানুষ তাই কথা বাড়িও না।
চলবে…………
#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ২৪
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
” তুই আমেনার ছাওয়ালের বউ। চান্দের লাহান চেহারা তোর। স্বামীর আদর সোহাগ পাইয়া চোখ মুখ ঝলমল করতাছে। স্বামী ভালোই সুখে রাখছে তোরে। এইডাতো হইবোই তোর স্বামীর বাপও ম্যালা ভালো মানুষ আছিলো।তারিতো রক্ত বইতাছে তোর স্বামীর গায়ে। বাপ ভালো হইলে পোলাতো ভালো হইবোই। বিধির বিধান কি খন্ডানো যায়রে মা। ছাওয়ালের আগের বিয়েডা টিকলো না। এইডারে তোর স্বামীর দোষ ধরবিনা। এইডাও একটা রহমত আল্লাহর তরফ থাইক্যা। সবসময় মনে রাখবি ওই সাত আসমানে যিনি বইয়্যা রইছেন হেই ভালো জানে তার বান্দার জন্য কোনটা ভালো কোনটা মন্দ। সেই বিয়া টিকবোনা দেইখাই টিকে নাই। তোর সাথে জোড়া বান্ধা আছে এইজন্যই আগেরটা টিকে নাই। সামনের রমজান মাস আইতে আইতে তুই জোড়া ছাওয়ালের মা হইয়া যাইবি মিলায় নেস। তোর কোল খালি থাকবো না। তিন চারটা ছাওয়ালপাওয়াল দিয়ে তোর ঘর আলো দিয়ে ভইরা যাইবো। স্বামী বউ গভীর রাতে আল্লাহর কাছে হাত তুইলা চাইবি। কাইন্দা কাইন্দা চাইবি। হেই সবকিছুর মালিক মানুষ এর কি ক্ষমতা সে যদি তোরে দিতে চায়। স্বামীর লগে লগে থাকপি। স্বামীরে বেশি বেশি আদর সোহাগ করবি। তার কাছ থেকেও আদায় করবি তাইলেই ফুল আসবো তাড়াতাড়ি। আমেনার ছাওয়াল আগে যখন ছোট আছিলো প্রায়ই আইতো গ্রামে। বড় হওয়ার পর তেমন আইতোনা। ওর মায়ের সেই যে একটা অঘটন হইলো তারপর আর পোলা মাইয়া হইলো না। এক ছাওয়াল নিয়েই বাইচ্যাঁ আছিলো”।
এতোক্ষন ধরে জহুরীর চোখে সাঁঝকে পরোখ করে কথা বলছিলেন আশি বছর বয়সী এক প্রবীন বৃদ্ধা। বয়সের ভারে তেমন একটা হাঁটাচলা করতে পারেন না এখন। তার জীবনে অনেক মানুষ দেখেছেন তিনি। অনেক ভালো- মন্দ, বিপর্যয়, খারাপ সময় সেই সাথে নানা ধরনের মানুষ তিনি তার এই দীর্ঘ জীবনে তিনি দেখেছেন। তাই মানুষ দেখার সাথে সাথেই বলে দিতে পারে। যদিও সে শুধু আন্দাজা করতে পারে। উপরওয়ালা যাকে যা দিবেন তাই নিয়েই থাকতে হবে। সাঁঝ মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনে যাচ্ছে। উজানের মামাতো ভাই সেলিম এর সাথে তারা গ্রাম দেখতে বেড়িয়েছে। নিজেদের জমি পুকুর পুষ্কর ফল বাগান কোথায় কি হয় সেগুলোই ঘুরে ঘুরে দেখছিলো তারা। ঘুরতে ঘুরতে এক জমির পাশে বৃদ্ধার বাড়ি পরে যায়। উজান আগে থেকেই চিনতো বৃদ্ধাকে তাই নিজেই এসে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে। বৃদ্ধা উজানকে দেখেই আবেগ আপ্লুত হয়ে যান। উজানের মা যখন মা-রা যায় তারপর উজান একবার এসেছিলো মায়ের জন্য মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসার বাচ্চাদের থেকে দোয়া পড়িয়ে নেওয়ার জন্য। বৃদ্ধা তার মায়ের জন্য কেঁদেছিলেন। অনেক আফসোস করেছিলেন তিনি উজানের বিয়ে ভেঙে যাওয়ায়। এখন তিনি বেশ খুশি হয়েছেন নতুন বউ দেখে। সাঁঝ কিছুটা কৌতুহল নিয়ে বললো
” কি অঘটন হয়েছিলো আম্মার সাথে বুড়ি মা?
বৃদ্ধা লম্বা শ্বাস টেনে বললো
” তোর স্বামীর মা তখন ছয় মাসের পোয়াতি আছিলো। ভরা পেট গা ভারি অবস্থা তখন। সেই সময়তো আর এখনকার মতোন ট্যাপ কল আছিলো না পুকুর আর চাপকল ছিলো বাড়ি বাড়ি। তোর শ্বাশুড়ি পুকুরে গোসল করতে গেছিলো। গোসল করে ঘাটে উঠতেই পা পিছলে পড়ে গেছিলো। বাচাঁরই কথা আছিলো না। উপরওয়ালা হায়াত দিছিলো তাই ফিরছিলো কিন্তু বাচ্চা হওয়ার ক্ষমতা হারাইলো। তোর স্বামীর বয়স তখন কত হইবো পাচঁ কি ছয় বছর। ছাওয়ালের বাপ অনেক কষ্ট পাইছিলো। কিন্তু বউরে ভালোবাসতো তাই কোনোদিনও কোন অভিযোগ করে নাই”।
উজান জানে এসব কথা। তার বয়স যখন সবে ছয়ে পরেছে তখন তার মা আবার গর্ভবতী হয়। উজান মায়ের উচুঁ পেট দেখে বলতো মা এখানে আমার ছোট বোন আছে। উজানের বোনের খুব শখ ছিলো। তার বোনই হয়েছিলো কিন্তু তাকে সে আর কোলে নিতে পারেনি দেখতেও পারেনি। এই ঘটনার পর থেকেই উজানের প্রতি তার মা আরও বেশি স্পর্শকাতর হয়ে যায়। মন মানসিকতা চিন্তায় পরিবর্তন আসে। তার বাবাকেও সে দেখেছে বিনা অভিযোগে মায়ের রাগ অভিমান অশান্তি অস্থিরতা সুন্দরভাবে সামলে নিতে। তার মা ভুল হলেও উজানের বাবা কখনো উচুঁ গলায় কথা বলেনি। সুন্দর করে বুঝানোর চেষ্টা করেছে সবসময়। এজন্য উজানও কখনো মায়ের কথার অবাধ্য হতে পারেনি।উজান উঠানে বসে তাদের সব কথাই শুনছিলো। লাঠিতে ভর করে সাঁঝের সাথে বাইরে বেড়িয়ে আসলো বৃদ্ধা। উজানকে দেখেই মুখে হাসি নিয়ে বললো
” বউতো পাইছিস চান্দের লাহান ফকফক্যা। তোরে রাইন্ধ্যা খাওয়াইতে পারে? তোর মাতো খুব ভালো রান্না করতে পারতো। বউ আর শ্বাশুড়ির রান্না এক হইবো না কিন্তু শিখতে পারলে কাছাকাছি যাইবো। বউ অনেক সোহাগী পাইছিস। বউ তোরে আদর সোহাগ করে নাকি মায়ের মতো খ্যাচ খ্যাচ করে? তোর বাপটা অনেক ভালো মানুষ আছিলো। ভালো মানুষদের আল্লাহ তাড়াতাড়ি নিজের কাছে লইয়্যা যায়। তোর মাও অনেক ভালো ছিলো কিন্তু একটু রাগ বেশি আছিলো এই যা। শোন ছাওয়াল বউরে অনেক ভালোবাসবি। বউরে বেশি বেশি আদর যত্ন করবি। এই বউরে দিয়েই তুই তোর বংশের সলতে পাবি। বউরে কষ্ট দিবিনা একদম। বউ যা বলে তাই শুনবি”।
বৃদ্ধার কথা শুনে উজান চমকে উঠলো। সাঁঝের মুখ পানে চাইলো। তাকে অনেক খুশি দেখাচ্ছে। তাদের বাচ্চা হবে কিন্তু কিভাবে? ডাক্তারতো বলেছিলো তার বাবা হওয়ার সম্ভাবনা পাচঁ শতাংশেরও কম মাত্রায় আছে। গ্রামের মানুষ অনেক অভিজ্ঞ হয়।অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো বলেছে। উজানকে চিন্তা মুখ করে থাকতে দেখে বৃদ্ধা বললো
” এই ছাওয়াল এতো চিন্তা করিস না। আমি বাইচ্যা থাকলে তোগো ছাওয়াল দেইখা যামু দেখিস। উপরওয়ালার কাছে বেশি বেশি চাইবি। কাইন্দা কাইন্দা দুই হাত তুলে দুজন চাইবি।মন থেকে চাইলে সে দিবো। নিজেরে ছোট মনে করবি না কখনো। বউডা খুব ভালো তোর। তোরে খুব ভালোবাসে। স্বামী পাগল বউ তোর তবে তেজ একটু বেশি। বউ মানুষের তেজ থাহা ভালো। সংসারে করে খাইতে গেলে তেজ সাহসেরও দরকার আছে”।
উজান আর সাঁঝ অনেক লজ্জা পেয়ে যায় বৃদ্ধার কথা শুনে। সাঁঝ লজ্জায় আচঁল দিয়ে মুখ ঢাকে। উজান স্মিত হাসে। তার মামাতো ভাই সেলিমকে ডাক দেয়। সেলিমের হাতে দুই হাজার টাকার নোট দিয়ে বলে বাজার থেকে মিষ্টি আর কিছু ভালো বাজার সদাই করে বৃদ্ধাকে পৌছেঁ দিতে যদিও তার ভরা সংসার। উজান খুশি হয়েই করে এই কাজটা। উজান আর সাঁঝ বৃদ্ধার কাছ থেকে বিদায় নিতে নিতে বলে
” বুড়ি মা আমাদের জন্য দোয়া করো যাতে তোমার কাছে আবার খুশির খবর নিয়ে আসতে পারি”।
বৃদ্ধা দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। প্রান ভরে দোয়া করে দুজনকে। ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে বেলা অনেক গড়িয়েছে।তাদের বাড়ি ফেরা দরকার। এইদিকে বাড়িতে আরেক লংকাকান্ড হয়ে গেছে। রাজিয়ার মা যাওয়ার আগে এমন এমন সব কথা বলে গেছে যা শুনে উজানের ছোট মামার রাগ সাত আসমানে উঠে গেছে। ভালো কথাতো বলে যায়নি মেয়ের কানে বিষ ঢেলে গেছে। আর এই বিষ ঢালার সময় উজানের ছোট মামা আবার সব শুনে ফেলেছে। তার শ্বাশুড়ির ভাষ্য ছিলো
” বোন ম-রে কবরে গেছে তার আবার সম্পত্তি বুঝায় দেওয়ার জন্য ঘটা করে বোনের ছেলেকে দাওয়াত করে আনতে হবে কেন? কিছু টাকা দিয়ে বিষয়টা মিটাই নিলেই হয়। তোর শ্বশুরে কি বিঘা বিঘা সম্পত্তি রেখে গেছে তার ছেলেদের জন্য।স্বামীরে বুঝাতে পারিস না তোদের এতোগুলো ছেলে মেয়ে আছে তাদের ভবিষ্যত আছে। তাও যদি হইতো সেই ছেলের কোন বাচ্চাকাচ্চা আছে। আধকুঁড়ে ব্যাডা মানুষ তার মধ্য বউ একটা চলে গেছে আবার কি শখ করে আরেকটা বিয়ে করে আনছে। আমি যেমন বোকা তেমনি আমার পেট থেকেও ভেদি জন্ম নিছে। সংসার গোছাইতে পারে না”
রাজিয়া বলে
” মা তুমি চুপ করবা? আমাদের কি কম আছে যে মানুষের হক থেকে টান দিতে হবে? মায়ের সম্পত্তি ছেলে পাবে বুঝায় নিতে আসছে। যার হক সে বুঝে নিবে। আমাদের কপালে যেটুকু আছে তাই আমরা পাবো”।
রাজিয়ার মা তীব্র আক্রোশ নিয়ে বললো
” সেইতো দেখাই যাইতেছে। যে তোর সম্পত্তি তার জন্য দাড়াঁয় আছে শ খানেক মানুষ। দেখিস তোর পোলাপান তোরেই দুষবো যে কেন এতো কম সম্পত্তি”।
এতোক্ষন এই কথাগুলো দরজার আড়াল থেকে শুনছিলেন উজানের ছোট মামা। ধৈর্য ধরে এতোক্ষন রাগ সংবরন করে থাকলেও আর পারলেন না তিনি। গুরুজন তার উপর শ্বাশুড়ি এজন্য তাকে কখনো বেশি কিছু বলেননি কিন্তু না বলেই ভুল হয়েছে। লাই পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠেছে। তিনি বললেন
“আমার ছেলেমেয়েরা জানে তাদের বাবার কি আছে না আছে। এজন্য বোনের সম্পত্তি নয় ছয় করে তাদের দিতে হবে না। যার যা প্রাপ্য তাকে তাই বুঝিয়ে দেওয়া হবে। আপনার এই হিংসুটে মনের জন্য আপনার ছেলেরা আপনার সাথে থাকে না। মন সাফ নাই আপনার। মেয়ের বাড়িতে এসে থাকেন আবার তার কানেই বিষ ঢালতেছেন। মেয়েকে যে এই বাড়িতে সংসার করে খেতে হবে ভুলে যান কেন?
রাজিয়ার মা রেগে গিয়ে বললো
” আমি হিংসুটে? জামাই তুমি আমাকে এতোগুলো কথা বলতে পারলে”? আমিতো তোমাদের ভালোর জন্যই বলছিলাম”।
উজানের ছোট মামা বললো
” আপনি এই বাড়িতে আর না আসলে ভালো হয় মা। যেদিন মন সাফ করে আসতে পারবেন সেদিন মেয়ের কাছে আসবেন”।
চলবে…………..