নীল সাঁঝের উজান পর্ব-৪০+৪১

0
32

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ৪০
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

” আপনার প্রাক্তন স্ত্রী মিলিকে দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে মাঝ রাস্তায় জনসম্মুখে হেনস্তা করা, অশালীন কথা বলা, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা এবং জীবন সংকটে ফেলার অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। আপনাকে আমাদের সাথে এই মুহুর্তে থানায় যেতে হবে। বাকি কথা সেখানেই হবে। অযথা আমাদের সময় নষ্ট করবেন না”।

কিছুক্ষণ আগে,

গোসল সেরে এসে মাত্র খাবার টেবিলে বসেছে আজাদ। টিশার্ট পরলেও গলায় এখনো ভেজা গামছা ঝুলানো। চুলটাও ভালো মতো মোছেনি সে। আগে খাওয়া প্রয়োজন। ক্ষুধা লেগেছে তার। যবে থেকে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে বাহিরে থাকছে সেদিন থেকে নাওয়া খাওয়ার ঠিক নেই। হোটেলে খেতে খেতে মুখে অরুচি আর গ্যাস্ট্রিক এর সমস্যা বাড়িয়ে ফেলেছে। আজাদের মা ছেলের পছন্দের খাবার রান্না করেছেন আজকে। খাবারের গন্ধে ঘর ভরে গেছে। আজাদ আর দেরি না করে দ্রুত খেতে বসে পরে। ছেলে অনেকদিন পর তার সামনে বসে খাচ্ছে এই দৃশ্য দেখে আজাদের মায়ের চোখে পানি এসে গেলো। একটা সুস্থ সংসার অবুঝের মতো নষ্ট করে ফেললো তার ছেলে। ঘরের ছেলে এখন ঘরে ফিরতে পারে না। ঘর ছাড়া হয়ে যাযাবরের মতো এখানে সেখানে থাকে সে। নিজের স্বামীর উপর রাগ হয় তার। ছেলে না একটা ভুল করেই ফেলেছে তার জন্য ছেলেকে বাড়ি ছাড়া করতে হবে কেন? পরের বাড়ির মেয়ের জন্য নিজের ছেলেকে পর করে দিতে হবে কেন? মন মানেনি সংসার টিকেনি। তাই বলে এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে হবে কেন? সেই মেয়েতো ঠিকই আরেকজনের সাথে ফুর্তিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজাদের মা ফোস করে লম্বা শ্বাস টেনে বললেন

” মিলি আরেকজনকে জুটিয়েছে তুই এটা এতো নিশ্চিত করে কিভাবে বলছিস? তার কোন আত্নীয় মানুষও হতে পারে। মেয়েটার কত বড় সাহস তোকে রাস্তায় জুতা খুলে মে’রেছে আবার সেই লোকটাও গায়ে হাত তুলেছে। আহারে আমার ছেলেটার চেহারার কি অবস্থাটা করেছে “।

আজাদ মাত্র এক লোকমা ভাত মুখে তুলেছে। মায়ের কথায় সেও কিছুটা ভড়কে যায়। আসলে সেদিন সে নিজেই বাড়াবাড়ি করেছে। তিন বছরের সংসারে মিলি এমন কিছু করেনি যে তাকে এসব কথা বলা যায়। তবুও পুরুষের আচরণ ধরে রাখতে হবে। মেয়ে মানুষ এর কাছে নিজের দাম্ভিকতা খোয়াবে কেন সে। এজন্য সেদিন যা মুখে এসেছে তাই বলেছে। আজাদ বললো

” আত্নীয় হলে কি আমি চিনতাম না? তিন বছরের সংসারে কখনোতো সেই লোককে দেখিনি। কোন অনুষ্ঠানে বা দাওয়াতে কখনো চোখ পড়েনি। এসব মেয়ে মানুষ এর ঠিক আছে মা? একটা ছাড়লে আরেকটা পাবে”।

ছেলের এই কথার সাথে আজাদের মা একমত হতে পারলেন না। আর যাই হোক মিলির মধ্য এমন কোন স্বভাব ছিলো না। বউ হিসেবে যথেষ্ট ভালো ছিলো সে। সব দায়িত্ব পালন করতো। কোনোদিন কাজকর্ম নিয়ে দুটো বাড়তি কথা বলতে হয়নি। বরং তিনিই খ্যাচ খ্যাচ করতেন। আজাদের মা বললো

” আর যাই বল বাবা মিলির এমন কোন স্বভাব ছিলো না। পারিবারিক শিক্ষা ছিলো মেয়ের। তোর সব কথা শুনলেও এটাতে আমার আপত্তি আছে। যার জন্য নিজের ঘর সংসার নষ্ট করলি সেই বা তোরে ছাড়লো কেন? সেতো তোর সবচেয়ে কঠিন সময়ে তোর হাত ছেড়ে দিয়েছে”।

আজাদ এর হাত থেমে যায়। মায়ের দিকে তাকায় সে। আসলেই তার মা ভুল কিছু বলেনি। যার মোহে পরে নিজের সংসার নষ্ট করলো সে কোথায়? সেতো ঠিকই লেজ গুটিয়ে তাকে ফেলে চলে গেছে। আর যা ক্ষতি হওয়ার তার হয়েছে। আজ সে বাড়ি ছাড়া এবং চাকরি হারা হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। আজাদ আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেলো না। চুপচাপ খাবার শেষ করে বেসিনে গেলো হাত ধুতে। এরই মধ্য কলিং বেল বেজে উঠলো। আজাদ চমকে উঠে তার মায়ের দিকে তাকায়। কে এসেছে তার বাবা? মা যে বললো বাবার ফিরতে আজকে রাত হবে। এখন কি করবে সে? বাবাতো তাকে সহ্যই করতে পারে না। কি যে হবে এখন। তার মা তাকে ইশারায় চুপ করে নিজের ঘরে যেতে বললো। সে ব্যাপারটা সামলাবে। আজাদ নিজের ঘরের দরজার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়। আজাদের মা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে তিনজন পুলিশ অফিসার আইডি কার্ড দেখিয়ে ঘরে ঢুকলো। একজন এস আই এবং সাথে দুজন কনস্টেবল। আজাদের মা পুলিশ দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো। উনি বললেন

” আপনারা এখানে কেন অফিসার? কে ডেকেছে? আমরাতো ডাকিনি। এখানে কিছু হয়ও নি”।

এস আই এর নেইমপ্লেটে নাম দেখা যাচ্ছে আনন্দ লিখা। ঘরের আশেপাশে ভালো করে চোখ বুলালেন তিনি। জহুরী চোখে দেখলেন পর্দা কাঁপছে আর একটা ছায়া সেখানে আছে। যা বুঝার বুঝে গেলেন তিনি। একজন কনস্টেবলকে ইশারায় বাড়ির বাহিরে নজর রাখতে বললো। আজাদের মাকে বাজিয়ে দেখার জন্য বললো

” আপনার ছেলে কোথায়? কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন তাকে? তার নামে গুরুতর অভিযোগ আছে। যেখানেই থাকুক তাকে আসতে বলেন “।

অভিযোগ এর কথা শুনে আজাদের মা আতঁকে উঠলেন। আবার অভিযোগ ছেলের নামে? আবার থানা, পুলিশ, আদালত আবার সেই হাজত। এই কোন শনির দশা লাগলো তার ছেলের কপালে। বিপদ যেন পিছু ছাড়ছেই না। কিসের কি এক মেয়েকে নিয়ে পালায় গেলো তারপর থেকে তার সুখের ঘরে অশান্তি শুরু হয়ে গেলো। ঘর ভেঙে তছনছ হয়ে গেলো। বাবা ছেলের মুখ দেখতে চায়না। কি শুরু হলো তার সংসারে। তিনি বললেন

” আমার ছেলেকে তার বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। সে এখানে থাকে না। কোথায় থাকে তাও জানিনা। কি অভিযোগ আছে তার নামে”?

এস এই আনন্দ গলা চড়িয়ে বললেন

” আজাদ সাহেব দরজার আড়াল থেকে কথা না শুনে বাহিরে আসেন। জনে জনে বলার চেয়ে মা ছেলেকে একসাথে বলি। অযথা সময় নষ্ট করে লাভ নেই”।

আজাদ উপায়ন্তর না দেখে ঘর থেকে বেড় হয়ে আসে। পুলিশকে দেখে ভড়কে যায়। সে সন্দেহ করে গতকাল রাস্তায় মিলিকে অপমান করার জন্য আবার মিলি থানায় অভিযোগ করেছে নাকি? করতেই পারে। যে তেজ বেড়ে গেছে এই মেয়ের। আগের চেয়ে সাহস আর কথার ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। পুলিশকে দেখে ভড়কে গেলেও চেহারায় তা দেখালো না আজাদ। বিনা জড়তায় সে পুলিশ অফিসারকে বললো

” কি অভিযোগ আছে আমার নামে। কে করেছে এই অভিযোগ “?

এস আই আনন্দ হাতে রাখা খাম থেকে একটা কাগজ বের করলেন। তারপর উপরের কথাগুলো পড়ে শোনালেন। আবার বললেন

” আপনার নামে এরেষ্ট ওয়ারেন্ট আছে। আপনাকে এখনই এই মুহুর্তে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। এবারে আর কোন আপোষের সুযোগ নাই। এবার যা হবে আদালতে সরাসরি মুখোমুখি হয়ে বিচার হবে “।

আজাদ এর মা চিৎকার করে উঠলেন। ডুকরে কেদেঁ বললেন

” আমার ছেলে নির্দোষ। সে কিছুই করেনি বরং ওরা দুজন মিলে আমার ছেলেকে মে’রে’ছে। আমার ছেলের চোখ মুখ দেখুন অফিসার এখনো দাগ হয়ে আছে”।

এস আই আজাদের মায়ের মুখোমুখি হয়ে উত্তর দিলো

” আপনার ছেলে ভরা রাস্তায় একজন মেয়েকে অকথ্য ভাষায় তার চরিত্র তুলে কথা বলবে তার সাথে অন্য কারো নাম জড়িয়ে যা তা ইংগিত দিবে আবার হুমকি দিবে এতোকিছুর পরেও আপনি বলবেন আপনার ছেলে নির্দোষ? আপনার ছেলের জন্য একটা মেয়ের জীবন সংকটে পড়েছে। মিস মিলি মেজর হার্ট এট্যাক করে চব্বিশ ঘন্টা অচেতন থাকার পর জ্ঞান ফিরেছে তার। হসপিটালে আছে সে। এখনো বিপদ টলেনি। উনার এই অবস্থার জন্য আপনার ছেলে একনাত্র দায়ী। ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন কি করেছে সে যার জন্য একটা মেয়েকে হসপিটালে জীবনের সাথে বাচাঁর জন্য লড়াই করতে হচ্ছে”?

আজাদের মা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকায়। আজাদ মাথা নিচু করে আছে। উনি যা বুঝার বুঝে গেলেন। ছেলের কাছে গিয়ে বললেন

“তুই মিলিকে মাঝ রাস্তায় অপমান করেছিস? তাকে হুমকি দিয়েছিস? উত্তর দে”।

আজাদ চুপ করে আছে। একটু মাথা তুলে বললো

” মাথার ঠিক ছিলো না। মিলিকে অন্য কারো সাথে দেখে মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাই মনে যা এসেছে তাই বলেছি। আমি ভাবিনি যে ও এইটা নিতে পারবে না আর অসুস্থ হয়ে যাবে “।

ছেলের বাম গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিলেন তিনি। রাগে দুঃখে হাত পা কাপঁছে তার। স্বামী বাড়ি নেই। ছেলের এই অবস্থা। কোথায় যাবে কার কাছে যাবে কিছুই ভেবে পেলেন না তিনি। এমনিতেই মান সম্মান শেষ তাদের। যেটুকু আছে সেটাও আর থাকবে না। পুলিশ অফিসার কন্সটেবলকে তাড়া দিলেন আজাদকে গাড়িতে উঠানোর জন্য। আজাদের মা চিৎকার করে কাঁদছে। এস আই আজাদকে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নিচে চলে গেলো। পাশের বাসার ফ্ল্যাটের লোকজন সবাই তাকিয়ে আছে। আজাদের মা বিধ্বস্ত শুন্য চোখে ছেলেকে নিয়ে যাওয়া দেখলো। কোনরকমে ঘরে এসে স্বামীকে ফোন দিলো। ফোন ধরতেই আজাদের মা ডুকরে উঠে বললেন

” আমার ছেলেকে বাচাঁও আজাদের বাবা। আজাদকে পুলিশ আবার ধরে নিয়ে গেছে। তোমার ছেলে আবার মিলির সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে এই অভিযোগে মেয়েটা থানায় মামলা করেছে। আমার ছেলেকে এবারের মতো বাচাঁও”।

অন্যদিকে উজান অফিসে বসে কাজ করছিলো। উজানও অনেক কিছু নিয়ে চিন্তায় আছে। মিলির সাথে এসব হওয়ার পর সাঁঝও অনেক দুশ্চিন্তায় আছে। তার মন খারাপ। সবসময় একটা আতঙ্কের মধ্য থাকে এখন সে। গতকাল মিলিকে দেখে আসার পর রাতে তাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। তার কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে যা হয় হয়ে যাক কখনো তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা যেন চিন্তাও না করে। সারারাত একটুও ঘুমায়নি। ফজরের নামাজের পর একটু ঘুমিয়েছে। কাজের মধ্যই হঠাৎ করে ফোন আসে উজানের কাছে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে বউ কল করেছে। কল ধরতেই সাঁঝ দূর্বল গলায় বললো

” আমার কিছু ভালো লাগছে না। শরীর খারাপ লাগছে। তোমাকে দেখতে মন চাচ্ছে। তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় আসো”।

উজান সময় ব্যয় না করে উত্তর করলো

” এখনই আসছি”।

চলবে………….

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ৪১
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

“তুমি আমার সাথে এভাবে বিশ্বাস ঘাতকতা করবে জানলে তোমাকে আমি কখনো ভালোবাসতাম না। তোমাকে এতো ভালোবাসি তার উপহার হিসেবে তুমি আমায় কি উপহার দিলে সতিন? এই তোমার ভালোবাসার নমুনা? এই তোমার দেওয়া ওয়াদা? তুমিতো আমাকে কাল রাতেই কথা দিয়েছিলে যা হয় হয়ে যাক আমাকে একা ছাড়বেনা। আমাকে আগলে রাখবে সারাজীবন। এভাবেই ভালোবেসে যাবে? আজ সব এক নিমিষেই ভুলে গেলে? তোমার একটুও দয়া মায়া হলো না আমার উপর? উজান এখন এরকম রোবট এর মতো সাইলেন্ট মোডে আছো কেনো? আমার কথার উত্তর দাও তুমি। তুমি আমার সাথে ছল ছাতুরি করেছো। আমি তোমাকে ভালো মানুষ ভেবে ভালোবেসেছি আর তুমি? তুমি আমাকে মোটেও ভালোবাসো না। বল ভালোবাসো”?

অফিসে কাজ করার সময় সাঁঝের ফোন পাওয়া মাত্রই আর দেরি না করে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দেয় উজান। সে ধরেই নিয়েছে আজকে তার কপালে অরাজকতা মূলক কিছু আছে। বউয়ের কথা বলার ধরন দেখেই বুঝেছে কিছু একটা নিয়ে তার মন মেজাজ চটে আছে। ইদানীং একটু বেশিই মুড সুইং হয় সাঁঝের। যখন এটা হয় তখন উজানের আর রক্ষা নাই। কোন কথার ছুতো ধরে কোথায় কোথায় কথা জোড়া লাগায় তার কোন আগা মাথা খুঁজে পায়না উজান। তার বউ এই হাসে আবার এই তার উপর প্রচন্ড অভিমান করে বসে। অভিমানে নাকের জল চোখের জল এক করে কাঁদে। তখন উজানের মনে হয় ব্যাচেলর লাইফের মতো কোন জীবন হয় না। এক মুহুর্তের জন্য মনে হয় ছয়টা বছর সে একা ছিলো ভালো ছিলো। এসব নারী মনের প্যাচ ছিলো না তার জীবনে। এখন এমন গিট্টু লাগছে যে এই প্যাচ খোলার সাধ্য তার আর নেই। দিন যাচ্ছে আরও গিঁট শক্ত হচ্ছে। উজান চুপ করে বিছানার কোণায় দাড়িয়ে আছে। বসার কোন জায়গা ঠিক নেই। পুরো ঘর ওলট পালট। উজানকে চুপ করে থাকতে দেখে সাঁঝ বললো

” এরকম চুপ করে আছো কেনো? এই তুমি আমাকে ভালোবাসো? সত্যি করে বলোতো কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে কোথাও চক্কর চালাচ্ছো নাকি? আমাকে ঠকাচ্ছো তুমি? যদি এমন করে থাকো তোমার সামনে কিন্তু নিজেকে শেষ করে দিবো বলে রাখলাম “।

উজান তব্দা খেয়ে যায় এসব শুনে। হয়েছেটা কি এই মেয়ের? এমন পাগলামো করছে কেনো? সে কবে বিশ্বাসঘাতকতা করলো? সতীন উপহার দিলাম কখন? আর আমি বউকে ঠকাচ্ছি? মানে কি? উজান এর মাথা ঘুরছে। একসাথে এতো সব অভিযোগ শুনে ওর মাথা পুরাই বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। তবুও বললো

” কবে বিশ্বাস ঘাতকতা করলাম? আর সতীন কোথায় আনলাম তোমার? কিসের চক্কর চালাবো? আর কার সাথে চালাবো? এই বয়সে এসব করা মানায়? ঘরে সুন্দরী বউ রেখে এসব শোভা পায় নাকি? আমি অফিস থেকে বাড়ি আসি আবার বাড়ি থেকে অফিসে যাই। কাজ করে হুশ মেলে না এগুলো আজাইরা চিন্তা ভাবনা কখন করবো”?

সাঁঝ কপট রাগ নিয়ে উজানের দিকে তাকায়। উজানের কাজকেই সে সতীন বলেছে। গত কয়েকদিন ধরে অফিসের কাজের চাপে এতো ব্যস্ত হয়ে গেছে যে তার কোন হুশ মেলে না। সাঁঝ একটু একটু করে উজানের দিকে আগায়। পুরো ঘর এলোমেলো হয়ে আছে। পায়ের সাথে শাড়ি বাধঁলো। পা ঘুরে মুখ থুবরে পরে যেতে নিলেই উজান দুহাত জড়িয়ে আগলে নেয় তাকে। বুকের মধ্য তীব্র বেগে হৃদস্পন্দন হচ্ছে সাঁঝের। উজান তা শুনছে স্পষ্ট। এতো জোরে সাঁঝ শ্বাস ফেলছে যে উজান বাহির থেকেই গুনতে পারবে এমন অবস্থা। উজান শক্ত করে বউকে জড়িয়ে ধরে আছে। সাঁঝও জড়িয়ে ধরে আছে উজানকে। সাঁঝ বেমালুম ভুলেই গেলো এতোক্ষণ সে উজানের সাথে অর্থহীন রাগ দেখাচ্ছিলো। আজকাল কি যে হয়েছে তার। এতো বেশি মুড সুইং হচ্ছে। আর মিলির ঘটনার পর উজানকে চোখে হারাচ্ছে সাঁঝ। কেমন যেন একটা চাপা ভয় কাজ করে তার। যদিও সে জানে উজান মানুষটাই অন্যরকম তবুও এতো কিছু দেখে তার ভয় হয় খুব। উজান জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই বললো

” এখনো সময় হয়নি। সাতদিন বাকি আছে পিরিয়ড এর। এরকম মুড সুইং কেন হচ্ছে? কষ্ট হচ্ছে? অসুস্থ লাগছে শরীর? ডাক্তারের কাছে যাবে? সিরিয়াল নিবো”?

সাঁঝ এই কথা শুনে লজ্জায় মুখ লুকায় উজানের বুকে। এই লোক তার এসবের দিনও মনে রাখে। অবশ্য উজান তার কাছে খোলা বইয়ের মতো। যার কোন গোপনীয়তা নেই। অনায়াসে গভীরে চলে গিয়ে পড়ে ফেলা যায় আর সাঁঝ সে নিজেকে স্বচ্ছ কাঁচের মতো মেলে ধরেছে উজানের কাছে। উজান যেন তার বউকে সবসময় এমন স্বচ্ছ রুপেই পায় এজন্য সে প্রতিনিয়ত নিজেকে বুঝার চেষ্টা করে, শোধরানোর চেষ্টা করে সেই সাথে সহজ হওয়ার চেষ্টা করে। সাঁঝ উজানের বুক থেকে মাথা তুলে তাকায় উজানের মুখের দিকে। জিজ্ঞাসু চোখে সন্দিহান হিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মানুষটাকে দেখে বড্ড মায়া হচ্ছে সাঁঝের এখন। হুদায় চিল্লাচিল্লি করে মানুষটাকে নাস্তানাবুদ করেছে সে। কি করা যায় এখন? কি করলে এই উজানের এই ক্লান্তি কমবে? হঠাৎ করে সাঁঝের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাড়া দেয়। অনেকদিন ধরে সাঁঝ উজানের সাথে নিজে থেকে দুষ্টমি করে ঘনিষ্ঠ হয় না। হওয়ার দরকারও হয়না। উজান নিজেই তার কাছে এসে তাকে এলোমেলো করে দিয়ে নিজেরটা বুঝে নেয়। আজকে সে এমন কিছু করবে। সাঁঝ হঠাৎ করে দুই পায়ে ভর দিয়ে উচুঁ হওয়ার চেষ্টা করে। উজান অনেকটা লম্বা তাই একটু কষ্টই হয় তার। উজানের মুখটা দুই হাতের আজলায় নিয়ে একটু ঝুঁকে আসে। পা টলে যায় সাঁঝের। উজান বলে

” কি হয়েছে? কিছু বলতে চাও”?

সাঁঝ বলে

“উম হু বলতে না করতে চাই”।

উজান বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচঁকে তাকায় বউয়ের দিকে। আবারও কি করতে চায় সে? এতোক্ষনতো অনেক কিছুই করলো সে। উজান বলে

” কি করতে চাও”?

সাঁঝ নিজেকে সামলে নায়। পায়ের অবস্থান বেশ শক্ত করে আকড়ে ধরে। উজানের মুখটাকে আরেকটু ঝুকেঁ নিয়ে আসে নিজের কাছে। তার ঠোঁট কাপঁছে। হার্টবিট তীব্র হচ্ছে। সাঁঝ উজানের অধরের সাথে নিজের অধর মিশিয়ে ফেলে। অতর্কিত আক্রমণ পেয়ে উজান বেশ অবাক হয়। অবাক হতে দেরি হলেও এখন তার আয়ত্বে আর কিছু নেই। সাঁঝ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গভীরে চলে গেছে। ঠোঁটের স্পর্শ গভীর থেকে গভীরে যাচ্ছে। পুরো দমে সাঁঝ আকঁড়ে ধরেছে উজানকে। উজান আর কি করবে? বউ নিজে থেকেই কাছে আসলে সেতো সাধু সন্ন্যাসী না চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। সেও বউয়ের আদরে ডুবতে চাইছে। অনেকটা সময় এভাবে চলে গেলো। একটা গভীর গাঢ় চুম্বনের পর সাঁঝ যেন আরও বেসামাল হলো। উজানকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দেয়। শাড়ির আচঁল বিনা জড়তায় সরিয়ে নেয় গা থেকে। শাড়িটাই সে আর রাখলো না গায়ে। উজান সবই দেখছে। আর ভাবছে এই মানবী কিছুক্ষণ আগে তাকে অর্থহীনভাবে ভৎসনা করলো আর এখন স্বর্বস্ব উজার করে দিচ্ছে। সাঁঝ উজানের মুখের দিকে ঝুকেঁ আসে। স্বামীর কপালে ভেজা চুমু দেয়। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে উজান। সাঁঝ শার্টের বোতাম একটা একটা করে খুলতে শুরু করে। গলায় অধর ছোয়াঁয়। উজান বউয়ের কান্ড দেখে যাচ্ছে। বউ তাকে এতো ভালোবাসছে, প্রতিটা স্পর্শ প্রতিটা আদর যেন তাকে আরও সাঁঝের দিকে ধেয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উজান সাঁঝের কোমড় পেচিঁয়ে উল্টো ঘুরিয়ে নিজের নিচে ফেলে দেয়। উজান বলে

” কিছুক্ষণ আগে এতো অভিযোগ করলে আর এখন আদর করে বেসামাল করে দিচ্ছো? কি চাও বলোতো?

সাঁঝ অকপটে বললো

” শুধু তোমাকে “।

উজান পলকহীনভাবে বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা নিশ্চুপ কামড়ায় দুজন মানুষ একে অপরের দিকে চেয়ে থেকেই দিব্যি সময় পার করে দিতে পারে। ছোয়াঁর প্রয়োজন পড়ছে না। অনেকক্ষন পর সাঁঝের গালে ভেজা মতো কিছু পরলো মনে হলো। সাঁঝ যতক্ষনে বুঝবে তার আগেই উজান তাকে বুকের মধ্য জড়িয়ে আষ্টেপৃষ্টে মিশিয়ে নিয়ে আছে। মুখ ফুটে কিছু বলতে নিবে তার আগেই অজস্র নিয়ন্ত্রণহীন স্পর্শ এলোপাথাড়িভাবে ছুতেঁ লাগলো তাকে। তারপর আর বলার কিছু চেষ্টা করেনি সে। আর কিছু বলার প্রয়োজনও নেই। একটা রাতের একাংশ এভাবেই পার করলো দুজন নর নারী। তারা ক্লান্ত কিন্তু আবেশে আচ্ছন্ন। সাঁঝ উজানের বুকে ঠোঁট স্পর্শ করে কাঁদছে। উজান বাধাঁ দিচ্ছে না। কাদুঁক সে। কাঁদলে মন ভালো হয় কারন কাদঁছে সে নিজেও এখন। বউয়ের চুলের ভাজে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবছে জীবনের নানা না মেলা অংক।

_____________________

সেদিনের পর পেরিয়ে গেছে সাতদিন। মিলির শরীরের অবস্থা এখন ভালো। ডাক্তার তাকে মানসিক চাপ নিতে বারণ করেছে। তবুও তার বারবার অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। রায়হান মিলিকে অনেকগুলো ভালো ভালো বই কিনে দিয়েছে। বেশ কয়েক জাতের ফুলের গাছ কিনে দিয়েছে যাতে সে ব্যস্ত থাকতে পারে। দুজনের কথা হয় নিয়মিত। মাঝে মিলির মনে হয়েছিলো সে অযাচিত ভাবে রায়হানের কাছ থেকে সাহায্য নিচ্ছে। এমনটা ঠিক নয়। উচিত নয়। মিলির মনে হয়েছে সে তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। যদি রায়হান তাকে খারাপ মেয়ে মনে করে? যদি গায়ে পড়া মেয়ে মনে করে? এজন্য যোগাযোগ করে নি দু তিনদিন। রায়হান নিজে থেকেই মিলিকে ফোন করে বকা দিয়েছে। কেন সে তাকে এড়িয়ে যায় কি কারন? মিলি বলে না বরং দূরত্ব রেখে সংযত করে নিজেকে। রায়হান হয়তো বুঝে গেছে কিছু একটা হচ্ছে। মিলিকে আবার চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। এর মধ্য ঘটে গেছে আরেকটা ঘটনা। আজাদের বাবা মিলির কাছে এসেছিলো মাফ চাইতে। মিলিকে হাতজোড় করে বলেছিলো এবারের মতো আজাদকে মাফ করে দিতে। মিলির মন সায় দেয়নি। সে বিহীত চায় আপোষ নয়। আইন অনুযায়ী ফৌজদারী কার্যবিধি ১০৭ ধারা অনুযায়ী আজাদকে মুচলেকা দিতে হয়েছে। এই মুচলেকার মেয়াদ ছয় মাস। এর মধ্য যদি আজাদ আবার মিলিকে বিরক্ত বা হুম’কি দেওয়ার চেষ্টা করে তার শান্তি ভঙ্গ করে তাহলে পরবর্তীতে আর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। মুচলেকা দেওয়ার পরেই আজাদের বাবা তাকে আর দেশে রাখতে চায়নি। শেষ খবর পাওয়া অবধি আজাদকে তার ছোট চাচার কাছে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা। এখানে থাকলে কেউ শান্তিতে থাকতে পারবে না। এক বিকেলে হঠাৎ রায়হানের কল আসে মিলির কাছে। মিলি তখন হুমায়ুন আহমেদ এর অপেক্ষা বইটা পড়ছিলো। ফোনটা ধরেই মিলিকে রায়হান বললো

“একটু বের হতে পারবে? নার্সারীতে নতুন কিছু ফুলগাছ এসেছে। দেখতে যেতাম “।

মিলি না বলে না। দ্বিধা সংশয় নিয়েই একটা নীল শাড়ি পড়ে বের হয়। তখন আকাশে মেঘ জমেছে।গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। রাস্তার ওপাড়ে রায়হান আর এপারে মিলি। রায়হান এপারে আসতে নিলে অসাবধানতায় হঠাৎ একটা গাড়ি এসে রায়হানকে ধাক্কা দিলো। জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। সবটাই দেখলো মিলি। ঠিক পাথরের মতো। সন্দিহান হতবিহ্বল হয়ে শুধু দেখছে লোক জড়ো হচ্ছে। হঠাৎ করে একজনের ধাক্কায় হুশে আসে সে। তীব্র গগণবিদারী চিৎকার করে ডেকে উঠে

” রায়হান ”

চলবে………..