নীল সাঁঝের উজান পর্ব-৪২ এবং শেষ পর্ব

0
31

#নীল_সাঁঝের_উজান
#অন্তিম_পর্ব
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

“সাঁঝ শুনছো? কথা বলো সাঁঝ। হঠাৎ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে কি করে? শরীর খারাপ লাগছে কখন থেকে? বুঝতে পারোনি? আমার কথা শুনতে পাচ্ছো তুমি? কতক্ষন ধরে এভাবে জ্ঞান হারিয়ে পরে আছো? চোখ খুলো সাঁঝ”?

উজান অফিস থেকে এসেছে বিশ মিনিট এর মতো হলো। সাধারণত একবার ডোরবেল দিলেই দরজা খুলে দেয় সাঁঝ। এমনও হয় অনেকদিন ওর ডোরবেল এর সুইচও টিপতে হয় না।তার আগেই দরজা খুলে যায়। সাঁঝ তাদের ঘরের লাগোয়া বারান্দা থেকে দেখতে পায় উজান বাড়িতে ঢুকছে। কিন্তু আজকে তার ব্যতিক্রম হয়েছে। উজান এসে ডোরবেল দেওয়ার পরেও যখন সাঁঝ দরজা খুলছিলো না তখন উজান চিন্তায় পড়ে যায়। এমনটা হয় না। যদিও উজান এর কাছে বাড়িতে ঢোকার স্পেয়ার কি থাকে তবে এটা তার দরকার পড়ে না। সাঁঝ দরজা না খোলাতে আজকে উজান কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুললো। দরজা খোলার পরে এক অদ্ভুত নিরবতা তার গা ছুয়েঁ গেলো। কেমন যেন ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেলো সে। একটা অচেনা ভয় অচেনা আশংকা তার সাথে এক অদ্ভুত শিহরণ। এটার সাথে সে পরিচিত নয়। সাঁঝকে আশেপাশে কোথাও দেখতে না পেয়ে ডাকতে ডাকতে নিজেদের ঘরে গেলো। গিয়ে যা দেখলো তাতে তার ভয় আরও ঘনীভূত হয়ে গেলো। সাঁঝ বিছানায় আলুথালু হয়ে পড়ে আছে। জ্ঞান নেই। দ্রুত বেগে উজান সাঁঝের কাছে যায়। সাঁঝের মাথাটা নিজের কোলের উপর নিয়ে বুঝতে পারে অজ্ঞান হয়ে আছে। কতক্ষন ধরে আছে বুঝলো না সে। বেড সাইডের পাশে রাখা পানির জগ থেকে সাঁঝের চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলো সে। মিনিট দুয়েক পর পিটপিট করে চোখ খুললো সাঁঝ। শরীরটা বেশ দূর্বল লাগছে। মাথাটা ঝিম মেরে আছে। সে বুঝতে পারলো উজানের কোলের মধ্য সে আছে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে উজান। উজানকে দেখে কোন রকমে মাথাটা উচুঁ করে তার বুকের মধ্য মুখ ডুবিয়ে দেয় সে। এক হাত দিয়ে উজানের বুকের কাছের শার্ট খামচে ধরে থাকে। উজান একটু আরাম করে বউকে জড়িয়ে ধরে বসলো। চুলের ভাজে হাত বুলাতে বুলাতে উজান বললো

” শরীর খারাপ লাগছে কখন থেকে? বলোনি কেন? অফিস থেকে আরও আগে আসার চেষ্টা করতাম। ডাক্তারের কাছে যাই চলো। নয়তো ডাক্তারকেই বাসায় ডাকি”?

সাঁঝ কিছু বলছে না। বলার মতো শরীরে শক্তি বা ইচ্ছা কোনটাই তার হচ্ছে না। চোখ জ্বলছে। মাথা টলছে। কিছুই ভালো লাগছে না। ইদানীং তার একটুতেই হাঁফ ধরে যায়। এই মাসের পিরিয়ডের ডেইট পার হয়ে গেছে আরও সাতদিন আগে। মনে মনে মন কলা খাচ্ছে সে। সত্যি কি কিছু মিরাকল ঘটতে যাচ্ছে? সৃষ্টিকর্তা কি তাদের প্রার্থনা কবুল করলো তবে? কতক্ষন সে জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় পড়েছিলো । হবে হয়তো মিনিট দশেক। সে তাদের উমরাহ্ হজ্জের ছবি দেখছিলো। এক অদ্ভুত প্রশান্তির দিনগুলো কাটিয়েছিলো তারা। আল্লাহর ঘর দেখার সাথে সাথেই দুজনে দোয়া করেছিলো জীবনের একটাই স্বপ্ন, আশা ভরসার জন্য। আল্লাহ যেন তাদের কোল ভরে একটা নেককার সন্তান ভিক্ষা দেন। কাবাঘর তাওয়াফ করার সময় অঝোরে কেদেঁছিলো দুজন। মোনাজাতে চোখের পানি ফেলে শুধু একটা চাওয়াই চেয়ে গেছে। কাবা ঘরের পাশে মসজিদের ছাদে তাহাজ্জুদ নামাযে কুরআন পড়ে কেদেঁ ভাসিয়ে দুহাত তুলে দোয়া করেছে। ওই সময়টা উজানের জন্য অনেক বেশি কষ্টকর ছিলো। সেখানে গিয়ে উজান আরও বেশি নরম হয়ে গিয়েছিলো। হুটহাট সাঁঝকে জড়িয়ে কান্না করে দিতো সে। সাঁঝও স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কাদঁতো। এই পৃথীবিতে উজানের সাঁঝ ছাড়া আপন বলতে কেউ নেই। দুই সপ্তাহের মতো ছিলো তারা সৌদি আরবে সব মিলিয়ে। সেখান থেকে আসার পর অদ্ভুত এক শান্তি কাজ করে দুজনের। আবার ছুটে যেতে মন চায় সেখানে। তাই ফোনের গ্যালারিতে বসে ছবিগুলো দেখছিলো। উজান আসার সময় হয়ে গেছে বলে ভাত রান্না করার জন্য কিচেনে যেতে নিলেই হঠাৎ করে মাথা গা দুলে উঠে সাঁঝের। একটু পা বাড়াতেই মাথা ঘুরে বিছানায় পড়ে যায়। তারপর আর কিছু মনে নেই। বউকে চুপ করে থাকতে দেখে উজান বললো

” কথা বলো বউ। জান ভয় লাগেতো আমার। তুমি জানো কত ভয়ে পেয়ে গিয়েছিলাম আমি? এসে দেখি তুমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছো। আচ্ছা আমি বাড়িতেই ডাক্তারকে ডাকছি। এসে দেখে যাক “।

উজান তার পরিচিত একজন মহিলা ডাক্তারকে ফোন করে আসতে বললো। পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। গাইনী ডাক্তার। জরুরী প্রয়োজনে তাকে পাওয়া যায়। মিনিট দশেক পর ডাক্তার আসলো। উজান পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সাঁঝ উজানের হাত শক্ত করে ধরে আছে। উজান বাহিরে দাড়াঁতে চেয়েছিলো। ডাক্তার যাতে ভালো মতো তাকে দেখতে পারে কিন্তু সাঁঝ যেতে দেয়নি। হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ডাক্তার বললো

” সমস্যা নেই। আপনি থাকুন উনার কাছে। উনি হয়তো কিছু নিয়ে চিন্তা করছেন”।

ডাক্তারের কথায় থেকে গেলো উজান। ডাক্তার পরীক্ষা করলো সাঁঝকে। প্রাথমিকভাবে চোখ, পালস, শ্বাস প্রশ্বাসের গতি সবকিছু। উনি কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন কি হয়েছে। তিনি সাঁঝকে বললেন

“আপনার লাষ্ট পিরিয়ড কবে হয়েছিলো?

সাঁঝ সময়টা বলে। এটাও বলে সেই তারিখ পার হয়ে সাতদিন হয়ে গেছে। ডাক্তার এবার নিশ্চিত হলো। সে যা আন্দাজ করেছিলো ঠিক তাই। ডাক্তারকে চুপ করে থাকতে দেখে উজান বললো

” কি হয়েছে ডাক্তার আমার স্ত্রীর? কোনো সমস্যা মনে করছেন? হসপিটালে নিয়ে যাবো”?

ডাক্তার উজানের দিকে তাকায়। তারপর চোখে মুখে আনন্দের আভা নিয়ে এসে বলে

” আপনি বাবা হতে চলেছেন উজান সাহেব। মিষ্টি নিয়ে আসুন। আপনার স্ত্রী মা হতে চলেছে। ঘরে নতুন সদস্য আসছে “।

উজান যেন ভালো মতো শুনতে পায়নি ডাক্তার কি বললো। সে তব্দা খেয়ে আছে। মনে হচ্ছে নিশ্চল পাথর হয়ে গেছে সে। সাঁঝ দুহাতে মুখ লুকিয়ে ফুপিঁয়ে কাদঁছে। সৃষ্টিকর্তা শুনেছেন তাদের প্রার্থনা। তাদের হাহাকার আর আর্তনাদ শুনেছেন। মিরাকল হয়েছে। উজান নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে তাকে। তাকে দিশেহারা হতে দেখে ডাক্তার আবারও বললো

” উজান সাহেব শুনছেন? আপনারা বাবা-মা হতে যাচ্ছেন। এই সময় সাঁঝকে অনেক সাবধানে থাকতে হবে। ভারী জিনিস তোলা যাবে না। সিড়ি বেয়ে উঠা নামা করা যাবে না। ভালো ভালো পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে”।

উজান এর গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে এক প্রকার। আবার সে শুনলো বাবা হতে যাচ্ছে সে। সাঁঝ মা হতে যাচ্ছে। উজান এর চোখে পানি। উজান বললো

” এটা কি সত্যি ডাক্তার নাকি স্বপ্ন দেখছি? কিছুক্ষণ পর ভেঙে যাবে”?

ডাক্তার বললো

“এটা সত্যি। এতোদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। আগামীকাল সকালে প্রেগ্ন্যাসি কীট দিয়ে টেস্ট করাতে পারেন সাথে আরও বেশি নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটা ইউ এস জি করিয়ে নিতে পারেন”। আমি আসছি উজান সাহেব। আপনাদের দুজনের এখন একান্ত সময় প্রয়োজন। আমি বুঝতে পারছি আপনাদের মনে কি চলছে। পরে কথা হবে আবার। সাবধানে থাকতে হবে এখন। ভালো থাকবেন। আবারও অনেক অভিনন্দন আপনাদের “।

ডাক্তার চলে যেতেই দেখলো ইতিমধ্যে সাঁঝের বাবা-মা আর রায়হান এসেছে। উজানই তাদের ফোন করে সাঁঝের অসুস্থতার খবর জানিয়েছে। তারা শুনেছে ডাক্তার কি বলেছেন। তারাও এতো বেশি আনন্দে বিমোহিত হয়ে গেছে যে তারাও কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। রায়হান এসে জড়িয়ে ধরে উজানকে। সাঁঝের বাবা-মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সাঁঝও আকুল হয়ে কাঁদছে। রায়হান বললো

” আর কান্নাকাটি করো না। আনন্দের সংবাদে কেউ এভাবে কাঁদে? এতো বড় একটা খুশির সংবাদ। কতদিনের একটা চাওয়া সৃষ্টিকর্তা কবুল করেছেন। দুজনে সবার আগে দু রাকাত নফল নামায পড়ে শুকরিয়া আদায় করো। যে আসতে চলেছে দুনিয়াতে সে যেন সহীহ সালামতে আসে এটাই প্রার্থনা এখন। বাবা-মা চলুন। আমরা মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা করি। ওরা নিজেরা একটু কথা বলুক “।

সাঁঝের বাবা-মা আর রায়হান চলে গেলো বাহানা দিয়ে। ঘরে শুধু তারা এখন দুজন। উজান যেন এই অপেক্ষাটাই অনেকক্ষন ধরে করছিলো কখন তারা একা হবে। ঘর খালি হতেই সাঁঝের বুকের মাঝে এক প্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ে উজান। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বউকে। অজস্র চুমু খায় সাঁঝের পুরো মুখ জুড়ে। কত দিনের হাহাকার আর তৃষ্ণার্ত ছিলো সে এই দিনটার জন্য। উন্মাদ এর মতো আদর করছে উজান সাঁঝকে। সাঁঝও যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। সেওতো একই পথের পথিক। স্বামীকে বুকের মধ্য নিয়ে আদর করলো কিছুক্ষণ। উজান কাঁদছে। সেই কান্নার পানি সাঁঝের বুক স্পর্শ করছে। উজান নিজের ডান হাত দিয়ে সাঁঝের পেটের কাছে শাড়ির কাপড়টা সরায়। পেটে হালকা করে হাত বুলায়। এখানে তার বাচ্চা আছে। তার রক্ত। তার ঔরসজাত অংশ। তাকে বাবা হওয়ার সুখ দিলো। তাকে পরিপূর্ণ করলো। আবেশে পেটের কাছে মুখ নিয়ে অনেকগুলো চুমু দিলো সে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না সত্যিই সে বাবা হতে চলেছে। উজান কতক্ষন যে সাঁঝেকে বুকের মধ্য জড়িয়ে নিয়ে একভাবে বসে থাকলো তারা দুজনের কেউ জানে না। থাকুক তারা আজকে এমন। সময়টা এভাবে থমকে গেলে হয়তো আরও ভালো হতো।

অন্যদিকে রায়হান এই বাড়ি এসে মিলিকে ফোন দিলো। মিলি যেন তার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলো। একবার রিং হতেই ধরে ফেলে মিলি। রায়হান ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। বললো

” ফোন হাতে নিয়েই ছিলে নাকি? মনে হলো তুমি আমার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলে”?

লজ্জায় চোখ মুখ নত হয়ে আসে মিলির। গলা ধরে আসে তার। ভাগ্য ভালো রায়হান সেটা দেখতে পাচ্ছে না। কোনরকমে আমতা আমতা করে বললো

” ফোন হাতেই ছিলো। ফেসবুক ঘাটঁছিলাম। তখনই ফোন এসেছে আপনার”।

রায়হান কোন বাড়তি কথা না বলে সোজা খুশির সংবাদ দিতে চাইলো। সে বললো

” সাঁঝ আর উজান বাবা-মা হতে যাচ্ছে মিলি। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবার প্রার্থনা কবুল করেছেন। তাদের হাহাকার আর্তনাদ আর চোখের পানি বৃথা যায়নি। তাদের এই চাওয়া কবুল করেছেন মহান সৃষ্টিকর্তা”।

মিলি চূড়ান্ত পর্যায়ের অবাক হয়ে গেলো। ভিমড়ি খেয়ে উঠলো রায়হানের কথায়। এতো বড় একটা খুশির সংবাদ। তার প্রিয় বান্ধবী মা হতে চলেছে। উজান ভাইয়ের বাবা হওয়ার ইচ্ছা পূরন হতে যাচ্ছে। এতো বড় একটা খুশির সংবাদ দিলো রায়হান। মিলি বললো

” সত্যি বলছেন”?

রায়হান বললো

“ডাক্তার চেক আপ করে জানিয়েছেন। আরও বেশি নিশ্চিত হতে কাল হসপিটালে গিয়ে টেষ্ট করাতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে সাঁঝের প্রেগন্যান্সিপজিটিভ “।

মিলি খুশিতে আত্নহারা হয়ে গেলো। সে কি বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রায়হান নরম গলায় মিলিকে ডাকলো

” মিলি”?

মিলি শিউরে উঠে রায়হানের এই ডাকে। এইভাবে ডাকাটা তার কাছে খুব ভালো লাগে। শুধু এই ডাক কেন গোটা আস্ত রায়হানকেই তার ভালো লাগে। তার অস্তিত্বকেই মিলির ভালো লাগে। শুধু কি ভালো লাগে? এটা কি শুধুই ভালোলাগা? মিলির মনে পড়লো সেই দিনের কথা যেদিন রায়হান রাস্তা পার হতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করলো। না সেদিন রায়হানের তেমন কোনো বড় কিছু ঘটেনি। সময়মতো গাড়ি ব্রেক কষেছিলো তবে টাল সামলাতে না পেরে রায়হান পরে যায়। রাস্তায় ঘেষা লাগে হাত ছড়ে যায় অনেকখানি আর কপালে খানিকটা কে’টে যায়। মিলি উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসে রায়হানের দিকে। রায়হান জ্ঞান হারায়নি। রায়হানের মাথাটা কোলের উপর নিয়ে কাঁদতে কাদঁতে খেই হারায় ফেলে আর বলে

“আমার সাথে থাকলে কারো ভালো কিছু হবে না। সবার শুধু ক্ষতি হয়। আমি ভালো না। অলুক্ষনে অপয়া। ওর যেন কিছু না হয়। প্লিজ প্লিজ” আল্লাহ “।

রায়হান কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলে

” আমার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। কেদোঁনা দেখো ঠিক আছি “।

সেদিন মিলির এরকম আচরণে রায়হান যেন আরও বেশি মায়ায় পড়লো তার। নীল শাড়িতে কালো কাজলে একটা মেয়ে ক্রমাগত তার দরজায় কড়া নাড়ছে। দুটো ভেঙে পড়া মানুষ যেন একই রাস্তায় হাটঁছে। সেদিনের পর থেকে তাদের কথা বেড়ে গেছে। কারনে অকারণে তারা কথা বলে। দেখা করে। কখনো গাছ কেনার বাহানায়। কখনো ডাক্তার দেখানোর বাহানায়। অনেকক্ষন চুপ থাকার পর রায়হান বললো

” মিলি আছো? চুপ করে আছো যে”?

রায়হানের ডাকে মিলির ধ্যান ভাঙে। মিলি বলে

” নাতো কোথায় চুপ করে আছি। বাচ্চারা কেমন আছে”?

রায়হান বললো

“ভালো আছে বাচ্চারা। মিলি তোমার সবগুলো ফুল গাছে ফুল এসেছে? বেলী ফুল গাছটায়”?

মিলি বারান্দায় গেলো। সবগুলো গাছ দেখলো। হ্যা সবগুলো গাছেই ফুল এসেছে। মিলি বললো

” হ্যা সবগুলো গাছেই ফুল এসেছে। বেলী ফুল গাছটাতেও”।

রায়হান বললো

” একটা কথা বলবো মিলি?

মিলি কিছুটা ভড়কে যায়। কি বলতে চায় সে? অনেকটা দ্বিধা নিয়ে বললো

“জি বলুন ”

রায়হান ইতস্তত করে বললো

” সোমা আমার জীবনে এক অপূরনীয় অধ্যায়। তাকে শুরুতে আমি যেমন ভালোবেসেছিলাম আজও ভালোবাসি। সে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী। তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় আর সেটার প্রয়োজনও নেই। ভেবেছিলাম এক জীবন এইভাবেই পারি দিবো বাচ্চাদের নিয়ে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি আমার কাছে হেরে যাচ্ছি। একজনের মায়ায় পড়ছি দিনের পর দিন। আচ্ছা তাকে যদি প্রিয়জন এবং প্রয়োজন এর জন্য নিজের মনে আরেকটা অধ্যায় জুড়ে জায়গা দেই তাহলে কি খুব ক্ষতি হবে মিলি”?

মিলির বুকটা ধক করে উঠে রায়হানের কথায়। অন্য কাউকে জায়গা দিবে মানে? রায়হান কি অন্য কাউকে ভালোবাসে? কে সে? বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে তার। তবুও নিজেকে সংযত করে বললো

“কে সে?

রায়হান কোন ভনিতা ছাড়াই উত্তর দিলো

” এক বৃষ্টির দিনে নীল শাড়ি পড়া এক মায়াবতী আমার জন্য কেদেঁ চোখের কাজল লেপ্টে ফেলেছিলো । সে আর কেউ না আমি যার সাথে এখন কথা বলছি সে। তার নাম মিলি “।

এপাশ থেকে আর কোন কথা আসলো না। রায়হান কিছুর জবাব পেলো না। শুধু ফুপিয়ে কান্নার শব্দ পেলো। মিলি কাদঁছে। রায়হান বুঝলো না এটা হ্যা নাকি না।

দুই মাস পর,

সন্ধ্যায় রায়হান আর মিলির বিয়ে পড়ানো শেষ হলো। বিয়েটা হয়েছে সাঁঝদের বাড়ি থেকেই। সাঁঝের বাবা-মা পুরো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন এমনকি তারা রায়হান মিলিকে এই বাড়িতেই থাকতে বলেছে। যদিও রায়হান আপত্তি করেছিলো। কিন্তু সাঁঝের মা বলেছে সোমা বেচেঁ নেই কিন্তু এক মেয়ের পরিবর্তে আরেকটা মেয়েকে তারা পাবে। রায়হানের পরিবার থেকে কেউ আসেনি। তাদের জানানো হলে মুখের উপর না করে দিয়েছে। কিছু মানুষের স্বভাব কখনো পরিবর্তন হয়না। রায়হানের পরিবারও তেমন। এই নিয়ে রায়হানের কোন মাথাব্যথা নেই। রায়হান বারান্দায় গেলো।আকাশে তাকিয়ে রইলো। সোমার এই তারাগুলোর মধ্য একটা হয়তো। রায়হান আকাশে তাকিয়ে বললো

” তুমি ছিলে তুমি আছো তুমিই সবসময় আমার জীবনের প্রথম অধ্যায় জুড়ে জায়গা নিয়েই থাকবে। আমার নিহিন আর নিহার মা তুমি। আমার শেকড় তুমি। তোমার ভালোবাসা তোমার জন্যই বরাদ্দ। রাগ করোনা বউ। মিলিকে তোমার চেয়ে কম ভালোবাসবো সত্যি বলছি”।

হঠাৎ রায়হানের গা ছুঁয়ে একটা হালকা শীতল বাতাস বয়ে গেলো। মনে হলো সোমা ছুঁয়ে গেলো তাকে। মিলি বারান্দায় আসলো। মিলিকে দেখে রায়হান হাতটা বাড়ালো। মিলি হাতটা ধরে রায়হানের বুকের মধ্য এসে মুখ লুকালো। মিলি বললো

” সোমা আপুকে যাতে ভুলতে না পারেন সেই ব্যবস্থা আমি নিজেই করবো। আপুর জায়গা আমি নিবোনা। সেই যোগ্যতা আমার নেই শুধু কম করে হলেও আমাকে একটু ভালোবাসবেন। ঠিক যেমন বউয়ের এক আলাদা অধ্যায় থাকে তেমন করে “।

রায়হান মিলির কপালে গভীরভাবে স্পর্শ করে চুমু খেলো। দুটো মানুষের জীবনে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়।

দেখতে দেখতে নয়মাস পেরিয়ে এসে গেলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। লেবার পেইন উঠায় সাঁঝকে হসপিটালে নিতে হয়েছে। প্রথমে ডাক্তার ভেবেছিলো সি-সেকশন করাতে হবে কিন্তু সাঁঝের অবস্থা সেটা জানান দিচ্ছে না। নরমালেই বেবি ডেলিভারি সম্ভব।ডাক্তার দ্রুত অটিতে নিয়ে গেল সাঁঝকে। কিছুক্ষণ পর বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেলো সবাই। নার্স বের হয়ে সাদা তোয়ালে মোড়ানো এক নবজাতককে উজানের কোলে দিয়ে বললো

” রাজপুত্রের মতো ছেলে হয়েছে আপনার। এই নেন কোলে নিয়ে আজান দেন বাচ্চার কানে”।

বাচ্চাকে কোলে নিতেই হুহু করে কেদেঁ ফেললো উজান। বললো

” আমার স্ত্রী কেমন আছে”?

ডাক্তার এর মধ্য বের হয়ে বললো

“উনি ভালো আছে। কেবিনে শিফট করলে দেখতে পারবেন “।

ছেলেকে কোলে নিয়ে সাঁঝের কাছে গেলো উজান। সাঁঝকে অনেক ক্লান্ত লাগছে। এই মেয়েটা গত নয়টা মাস যা সহ্য করেছে তার জন্য উজান চির কৃতজ্ঞ। বউয়ের কপালে আর মুখ জুড়ে উষ্ণ আদরে ভরিয়ে দিলো সে। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো

“আমার জীবনের এক বুক হাহাকার আর আক্ষেপ এর হিসেব মেলাতে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর উপহার হয়ে আসলি তুই। তোর মা আমাকে নতুন করে ভালোবাসা বুঝিয়েছে আর তুই বুঝাতে শেখালি বাবা হওয়ার সুখ কতটা তীব্র আনন্দের হয়। তোর বাবা তোকে সারাজীবন বুকে আগলে রাখবে যতদিন তার প্রাণ আছে”।

সমাপ্ত।