প্রেমের সমর ২য় পরিচ্ছেদ পর্ব-০৭

0
2

#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_০৭
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

সিয়ার চিৎকার শুনেই স্বচ্ছ যখন ছুটে উপরে এল ঠিক তখনই তার কলিজা শূণ্য এল সুহাকে এভাবে ব্যাথায় কাঁতরাতে দেখেে।স্বচ্ছ ছুটে যায় মেয়েটার কাছে। বুকে আগলে নিয়ে রোধ হয়ে আসা গলাতেই কোনরকমে বলল,

“ সুহাসিনী? কিচ্ছু হবে না।তোমার কিংবা তার কিচ্ছু হবে না। ”

সুহার মনমস্তিষ্ক তখন এসবে মনোযোগ নেই বোধহয়। ব্যাথায় কাঁতরায় সে। অসহ্যরকমের যন্ত্রনায় মূর্ছা যায় যেন। স্বচ্ছর পাগল পাগল লাগে এমতাবস্থায়। অস্থিরতার চরম সীমায় পৌঁছিয়েই আকস্মাৎ সুহাকে কোলে তুলে নেয় সে। এই প্রথম সুহাকে কোলে তুলে সে অনুভব করে তার সামনে এগোতে কষ্ট হচ্ছে। নিঃশ্বাস রোধ হয়ে আসছে। অজানা আশংকায় পুরুষ মানুষ হয়েও তার কান্না পাচ্ছে এই মুহুর্তে। চোখ লাল হয়ে উঠছে ক্রমশ তার। স্বচ্ছ সুহাকে কোলে তুলে নিয়েই কোনরকমে সিয়াকে বলল,

” আমার পিছু পিছু একটু দ্রুত আয় সিয়া। গাড়িতে নিতে হবে। ”

কথাটুকু বলেই দ্রুত পা চালাল সে। অতঃপর দ্রুত পা বাড়িয়ে সিঁড়িগুলো মাড়িয়ে নিচে এল। আসার পথে যোগ দিল তার আম্মুও। সাথে একগাধা কান্নাকাটি। বংশের প্রথম নাতনি আসছিল বলে কথা, অথচ মাঝপথেই এমনটা হবে কে জানত? স্বচ্ছ অবশ্য এসব কান্নকাটিতে সময় নষ্ট করল না। যত দ্রুত সম্ভব সে গাড়িতে সুহাকে নিয়ে রাখল। কেন জানি না সুহার দিকে তাকানোর সাহস তার হলো না। বুক কাঁপছে।হাত পা কাঁপছে! হৃদকম্পন অতিদ্রুত চলছে পুরুষটার। স্বচ্ছ এই পর্যায়ে কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে দাঁতে দাঁত চাপল।নিজে ড্রাইভ না করে ড্রাইভারকে ড্রাইভ করতে বলে স্বচ্ছ সুহাকে আগলে নেয়। সুহার মাথায় মুখ ঠেকিয়ে এবার হুট করেই সে কেঁদে ফেলে। ভেজা চোখে রুদ্ধ হওয়া স্বরেই কোনরকমে বলে উঠল,

“ কেন এমনটা হলো সুহাসিনী? আমি তো বিধাতাকে এত করে বললাম তোমাদের সুস্থ রাখতে, তোমাকে, আম্মুজানকে সুন্দরভাবে আমার কাছে রাখার জন্য এত আকুল আবেদন ছিল আমার তার প্রতি! তবু শুনল না সে? কেন এমনটা করল সুহাসিনী? কেন আমার বাচ্চাটাকে বিনা কারণে কষ্ট পেতে হচ্ছে, কেন তোমাকে এই যন্ত্রনায় দেখতে হচ্ছে সুহাসিনী? আমি তো তার প্রার্থনা কিছু কম করিনি এইকয়েকমাসে সুহাসিনী। ”

সুহা বোধহয় এবার সত্যিই নিজের কপালে উষ্ণ পানির স্পর্শ টের পায়। ব্যাথায়, যন্ত্রনায় নিজের বিভৎস মুহুর্তের মধ্যেও সে অবাক হয়ে তাকাল স্বচ্ছর দিকে। স্বচ্ছ এবারও সুহার কপালে মুখ ঠেকিয়ে পাগলের মতো চুমু দিতে দিতে কেঁদে বলে উঠে,

“ সুহাসিনী? আমার ভালোবাসাকে মিথ্যে করে দিও না সুহাসিনী। আমি, আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারব না সুহাসিনী। প্লিজ! প্লিজ সুহাসিনী। আমার তোমাকে ছাড়া কিচ্ছু লাগবে না। কিচ্ছুই না। তুমি হলেই চলবে সুহাসিনী। প্লিজ থেকে যাও। থেকে যাও সুহাসিনী। ”

.

রোহান আজ দুপুর বেলাতেই বাসায় ফিরল। ফিরল মূলত একটা কাজেই।রাহা তা দেখেই আড়চোখে তাকায়। ক্লান্তমুখ চাহনি নিয়ে বসে থাকা ছেলেটার দিকে দূর থেকে মিনিট কয়েক তাকিয়ে থাকে রাহা দীর্ঘশ্বাস টানে। অতঃপর নিজ মনেই বলে,

” শুধু যে দাদাজান বলেছে বলেই আমি আপনাকে বিয়ে করেছি এই কথাটা আসলে ভুল রোহান ফারাবী। কোথাও না কোথাও আমি সত্যিই আপনাতে আটকে গিয়েছিলাম, কোথাও না কোথাও আপনাকে সত্যিই আমার মনে ধরেছিল। তাই তো আপনার মন পাব না জেনেও বিয়ে করেছি। আপনি আমারই বোনকে ভালোবাসেন জেনেন বেহায়ার মতো আমি আপনারই বউ হয়েছি। আচ্ছা?কখনো আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা-টাসা জম্মানোর চান্স আছে মিঃ রোহান ফারাবী? বোধহয় নেই। ”

কথাটুকু বলেই রাহা রুমের সোফায় শরীর এলিয়ে দিল। তারা সোফা এবং খাট ভাগাভাগি করেই ঘুমায় দুজনে।রোহান খাটে হলে অপরজন সোফায়। রাহা সোফায় ঘুমানোর চেষ্টা করল। চোখ বুঝল। কখনো আড়চোখে তাকিয়ে খেয়াল করল রোহানের কার্যকলাপ।

রোহান যখন কাজে ব্যস্ত ঠিক তখনই ফোনে ম্যাসেজের আওয়াজ পাওয়া গেল। রোহান ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই দেখতে পেল ওটা রাহার ফোন। স্ক্রিনে ভেসে আছে,

” ভালো আছো নিশ্চয়?বহুদিন তোমার মুখখানা দেখা হয় প্রিয়তমা। দেখা হয় না তোমার মায়াময় আঁখি,তোমার ঠোঁটের নিচে সেই তিল। আপসোস! আজকাল আমি বেলকনির গ্রিলে সেই মেয়েটির প্রতিচ্ছবি পাই না। পাই না এক গাধা স্নিগ্ধ অনুভূতিকে। এই যেমন আজ? আজও ফিরে যাচ্ছি তোমার বোলকনির মুখ থেকে, তোমাকে না দেখেই। ভালো থেকো। ”

রোহান ভ্রু কুঁচকায়। হুট করেই এক পুরুষালি অধিকার মেজাজ খিটখিটব করে তুলল। তার বউকেই অন্য কেউ এমন প্রেম নিয়ে লিখবো কেন? ভালো বাসুক, অথবা না বাসুক, তারই তো বউ। সে বউকেও কেউ ওই নজরে দেখবে কেন? রোহানের দাঁত চিড়চিড় করে। দ্রুতই দরকারি কাজ ফেলে বেলকনিতে গেল। দুপুরের রাস্তায় বহুজনের দেখা মিললেও ওপাশে এক যুবককে দেখা গেল সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বেখেয়ালিভাবে হেঁটে যেতে। রোহান ভ্রু কুঁচকায়। কিয়ৎক্ষন সে যুবককে সন্দেহ করে রুমে ফিরে আসে। অতঃপর সোফায় ঝুঁকে
রোহান বেশ অনেকটা সময় যাবৎ রাহার মুখটা দেখল। বোধহয় এই প্রথমই সে রাহাকে খেয়াল করছে। এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে। কারণ একটু আগেই রাহার ফোনে একটা ম্যাসেজ এসেছে। ম্যাসেজটি যে পাঠিয়েছে সে আগুন্তক যেভাবে রাহার মুখের মায়া সম্পর্কে লিখেছে তা পড়েই রাহার মুখটা দেখতে সে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু বেচারা শান্তিমতো খেয়াল করে উঠতে পারল না। তার আগেই রাহা চোখ মেলে চাইল। রোহানকে এভাবে তাকাতে দেখে দ্রুত বলল,

” কি দেখছেন এভাবে? ”

রোহান হুট করেই সোজা হয়ে দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

“ তোমার ঠোঁটের নিচে তিল কেন থাকবে নবনী?”

রাহা হতবিহ্বল নজরে তাকায়। তার ঠোঁটের নিচে তিল এটা কি তার দোষ? আশ্চর্য। বলল,

“ এটা কেমন প্রশ্ন? ”

রোহান ফের টানটান মুখ করে বলল,

“সত্যি করে বলো তো, তোমায় কে ভালোবাসত নবনী?”

রাহা উঠে বসে বলল,

“ দেখা হয়নি যেখানে সেখানে চিনব কি করে আমি?কিন্তু আপনার কিউরিসিটি কেন ভাই?”

রোহান ফের বলল,

“ চেনো তুমি নবনী। বলো,আমি তার সাথে দেখা করতে চাই। ”

রাহজ বিরক্ত হয়েই বলল এবারে,

“ আজব তো৷ চিনি না বললাম তো। চিনলে তো আমি নিজেই ওই ছেলেকে বিয়ে করে নিতাম জোর করে।

রোহান ভ্রু উঁচু করে তাকায়,

“ তার মানে তাকেই বিয়ে করার স্বপ্ন ছিল তোমার? ”

“ কিন্তু ছেলেটা তো ভালো ছিল। আমায় ভালোবাসত খুব। এবং আমি আশাবাদী যে সে আমায় খুবই ভালো রাখত। এভাবে সোফায় ঘুমোতে দিয়ে কষ্ট দিত না অন্তত।”

ব্যস। রোহান একটু ঝুঁকেই রাহাকে কোলে তুলল যেন। অতঃপর দ্রুত বিছানার সামনে গিয়ে ছুড়ে ফেলল অবহেলায়। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,

”আজ থেকে খাটে ঘুমাবে, যা চাইবে তাই পাবে। কিন্তু কখনো যেন না শুনি রোহান ফারাবীর বউ অন্য কোন পুরুষকে চাইছে। এতোটা নিচু লেভেলের মেয়ে আমার বউ হওয়ার যোগ্যতা রাখে না নবনী। ”

কথাগুলো কাটকাট স্বরে বলেই পা বাড়াল রোহান। রাহা টলমল চোখে চেয়ে থাকল এবারে৷ সে যথেষ্ট শক্ত মেয়ে। তবুও কান্না পাচ্ছে আজ তার। কেন ওভাবে ছুড়ে ফেলল? দোষ কি তার? ওভাবে নিচু বলে ইঙ্গিতই বা করল কেন হু?

.

হসপিটালের করিডোরে টানা পায়চারি করতেই দেখা গেল স্বচ্ছকে।কেবল পারছে না ডক্টরের রুলস ব্রেক করে সে অপরেশন কেবিনে ডুকে পড়তে। স্বচ্ছ ছটফট করে। মিনিট পাঁচেক এভাবে কাঁটানোর পরই হুট করে তার মনে হলো সে সব হারাচ্ছে।ডক্টর বলেছে প্র্যাগনেন্সিতে এমনিতেই সুহাে হাজারটা জটিলতা, তার উপর ডেলিভারি টাইসে প্রবলেম হতে পারে বলা হয়েছিল। এর জন্যই এতকাল সে এত ভয়ে ভয়ে থাকত, এত সচেতন হয়ে চলত আর এখন?এখন তো আরো বিপদ। সুহার কতোটা যন্ত্রনা হচ্ছে? তার বাচ্চাটা? বাঁচবে তো ঐটুকুনি মেয়েটা তার? সুহা? ফিরবে তো তার কাছে আবার? স্বচ্ছ আর ভাবতে পারে না যেন। কান্না আসে তার। তবে কাঁদে না। চোখ লাল টকটকে হয়ে উঠে তার। চেহারায় বড্ড অবসাদ ফুটে উঠে স্পষ্ট।স্বচ্ছ নিজেকে সামলাতে পারে না। বুক চিনচিনে ব্যাথা হয়। ধরে আসে কেমন ব্যাথাটা। এক হাতে সে বুকের বা পাশটা চেপেও ধরে। কিন্তু অতিরিক্ত চিন্তা, অতিরিক্ত ভয় এসবকে সামলে উঠতে না পেরে পুরুষটা মিনি হার্ট এ্যাটাকের ব্যাথা নিয়ে ঘামতে থাকে। অতঃপর হেলে পড়ে হসপিটালের করিডোরেই। দূর হতে সিয়া এবং তার মা তা দেখেই দ্রুত ছুটে আসে মুহুর্তে।

.

ছুটির ব্যাগ গোছানো কম্প্লিট। ছোটনকে সব বলে রাখা আছে যাতে সে কাউকে না বলে। ফিহাকে বলেছে গ্রামের বাড়ি যাবে তারা। এটুকু বলে বেঁচে গেলেও আবির বোধহয় তা বিশ্বাস করল না।তা জানার পরপরই দ্রুত ছুটিকে কল দিল। ছুটি এবারেও সঙ্গে সঙ্গে কল তুলে না। দুই তিনবার কল আসার পর যখন কল তুলে ঠিক তখনই আবির বলে উঠে,

” অবহেলা শিখাচ্ছিস আমাকে? অবহেলা করলে কেমন লাগে তা বুঝাতে চাইছিস কল না তুলে বারংবার? এত সাহস হয় কি করে তোর? ”

ছুটি মৃদু হাসে। বাহ!সে পুরুষ সাহস দেখালে কিচ্ছু হয় না?অথচ ছুটির বেলাতে দোষ? ছুটি ভালোবাসে বলে সাহস দেখাতে পারবে না? ছুটি তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে,

” আপনার থেকেই একটুআধটু শিখলাম আরকি আবিরভাই। সাহস করতে তো দোষ নেই বলুন? ”

“ পুরোপুরি নিজেকে ফিট করে যখন দেশে ফিরব তখন তোর সাহস ঘুচাব আমি ছুটি।তখন পালানোর চেষ্টা চালাস না আবার। ”

পালানোর চেষ্টা তখন কি চালাবে? সে তো এখনই পালাচ্ছে। কালই! ছুটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“ অপেক্ষায় থাকলাম।”

” সত্যি করে বল, তোর মাথায় কোন কুবুদ্ধি চলছে ছুটি? আবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করার চেষ্টা চালালে কিন্তু আমার চাইকে খারাপ কেউই হবে না। ”

ছুটি তাচ্ছিল্য করে হাসে। এই যে এতকাল যে অবহেলা, অনাদর, যোগাযোগ ছিন্ন রেখে তাকে ছটফট করাতে করাতে মেরে ফেলে নিজের যে খারাপ সত্ত্বার পরিচয় দিয়েছে এর চাইতেও খারাপ আর কি হবে? ছুটি বলে,

” যতোটা খারাপ ইতোমধ্যেই হয়েছেন এরচাইতে বেশি খারাপ আর কি হবেন আবির ভাই? আর কিভাবে আমায় মারার প্ল্যান করবেন? ”

আবির ওপাশ থেকে শুধাল,

” যেভাবে প্ল্যান করলে তুই শুধুই আমার থাকবি বোকাপাখি। ”

#চলবে…