প্রেমের সমর ২য় পরিচ্ছেদ পর্ব-১১+১২+১৩

0
31

#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১১
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

স্বচ্ছর বুকে সে ছোট্ট প্রাণটা। নিথর শরীর। নড়চড় নেই এইটুকু বাচ্চাটার। চোখ বুঝে বাবার বুকে পড়ে আছে নিশ্চিন্তে। যেন ঘুমটা কত সুন্দর। স্বচ্ছ বহুক্ষন বুকে আগলে নিয়ে বসে থেকে ড্যাবড্যাব করে দেখল নিজের মেয়েকে। কি মায়াবী তার প্রাণটা। কি সুন্দর পুতুলের ন্যায়। এই পুতুলটা আর জীবিত নেই,তাদের ছেড়ে চলে গেছে এটা যেন স্বচ্ছ মানতেই পারল না। গলা রুদ্ধ হয়ে আসে। দীর্ঘশ্বাসে বুক ভার হয়ে আসে। রক্তিম চোখ জোড়া আরো রক্তিম হয়ে উঠে ভেতরে পুষে রাখা যন্ত্রনায়। স্বচ্ছ তাকিয়েই থাকে। অতঃপর ফুলটাকে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে এতোটা সময় পর সে মুখ খুলল,

“ কি এত রাগ হয়েছিল আম্মুজান? যে এইভাবে চলে গেলেন আমাদের রেখে? আব্বু কি বেশি পঁচা? আদর দিই নি? বল না আম্মু… ”

এইটুকু বলতে বলতেই স্বচ্ছর লাল রক্তিম চোখজোড়া আবারো জলে পরিপূর্ণ হয়ে আসে। ছোট্ট আদুরে মুখটাতে কয়েকবার চুমু দেয় পাগলের মতো। অতঃপর আবারএ পাগলের ন্যায় রুদ্ধ স্বরে জানায়

“ আম্মুজান? কেন এভাবে চলে গেলি আম্মু? তুই জানিস তুই আমার কতোটা জুড়ে ছিলি এই কয়েকটামাস? কতোটা স্বপ্ন বুনেছি তোকে নিয়ে? কেন এমনটা করলি আম্মুজান? কেন এমনটা হলো? এই আম্মু?একবার তাকা না আম্মু।”

এইটুকু বলতেই স্বচ্ছর মা কেঁদে উঠল। তার ছেলেটা কি পাগলামে করছে।কত ভালোবাসে তার বাচ্চাটাকে। আর বিধাতা কি করল? তার ছেলের সাথেই কেন করল এমনটা? এই যে তার ছেলেটা গত এক সপ্তাহ ঠিকমতো না খেয়ে, না ঘুমিয়ে শুধুমাত্র তার বউ আর সন্তানের চিন্তায় ভীত হয়ে থাকত বিধাতা কি চাইলে এই ছেলেটার প্রতি একটু মায়া দেখাতে পারত না? কেন করল এই নিষ্ঠুরতা? স্বচ্ছর মা ফুঁফিয়ে কাঁদে। স্বচ্ছর মাথায় হাত রাখতেই স্বচ্ছ অসহায়ের মতো করে তাকায়। আকুতি নিয়ে বলে উঠে,

“ আম্মু? আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দাও না আম্মু।ওকে বলো না একটাবার তাকাতে। একটাবার হাত পা নড়াচড়া করতে? আম্মু? দেখো না, আমার মেয়েটা কত মিষ্টি। একদম সুহাসিনীর মতোই। আম্মু…”

স্বচ্ছর মা কাঁদতেই থাকে ছেলের প্রলাপ শুনে। তবুও বহুকষ্টে বলে,

” আব্বু? ও আর নেই আব্বু। আমার নাতনিটা আর বেঁচে নেই। তুমি এমন পাগলামো করলে সুহাকে কি করে জানাব বিষয়টা বলো? কিভাবে সামলাব? মেয়েটাতো আরো দ্বিগুণ পাগলামি করবে। এদিকে জানানো ও প্রয়োজন। কারণ ও তো মা। ”

স্বচ্ছ হুট করেই গম্ভীর চাহনিতে তাকায় এবারে। সুহাসিনীকে কি করে জানাবে এই সত্যটা? মেয়েটা বড্ড খুশি ছিল যে। কি করে বলবে সত্যিটা? সবটা শুনে কিই বা করবে সুহা? এখনও তো পুরোপুরি সুস্থও নয়৷ স্বচ্ছ পারবে মানাতে মেয়েটাকে? স্বচ্ছ শুকনো ঢোক গিলে। হুট করেই নিজের সব কষ্ট ভেতরে চেপে রেখে তার প্রাণটাকে তার আম্মুর কোলে দেয়। অতঃপর যন্ত্রমানবের মতোই পা বাড়িয়ে চলতে লাগল সুহার উদ্দেশ্যে। অবশেষে গেল ও।গিয়েই বেশ মনোযোগ দিয়ে এক নজর তাকাল সুহাসিনীর পানে। বসে আছে একা একা জানালার দিকে মুখ করে। বোধহয় আকাশ দেখছে মেয়েটা। স্বচ্ছ যে কথাটা জানানোর জন্য এখানে এল তা যেন মুহুর্তেই নিরব বার্তায় পরিণত হলো। বলতে পারল না সে। এই মেয়েটাকে এই খবর কিছুতেই বলতে পারবে না সে। স্বচ্ছ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সুহা ততক্ষনে তার দিকে ফিরে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ সকাল থেকে আজ আপনাকে দেখা গেল না।কোথায় ছিলেন স্বচ্ছ? মেয়ের খোঁজ নিয়েছেন? আজ তো কোন নার্সও ওর ব্যাপারে কিছু জানাল না,বলল না, আনল না, কি ব্যাপার বলুন তো?দেখে এসেছেন ওকে?আমার মেয়েটা কি করছে এখন স্বচ্ছ? ও কখন পুরোপুরি সুস্খ হবে? ও সহ বাড়ি ফিরব স্বচ্ছ। ”

স্বচ্ছ শুনল ঠিক। তবে উত্তর করতে পারল না। ভারী হয়ে আসে বুক। অস্পষ্ট স্বরে বলে,

“ হু? ”

সুহা ভ্রু কুঁচকে তাকায় স্বচ্ছর দিকে। চোখজোড়া লাল। মুখচোখ এই কয়দিনে শুকিয়ে এইটুকু হয়েছে। মুখর দাঁড়িগুলো অব্দি বেড়েছে। চুলগুলো উষ্কুখুষ্কু ঠেকছে। স্বচ্ছ এই কয়দিনে কবেই বা বাড়ি গিয়ে ঠিকমতো গোসল করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে এসেছে সুহা জানে না। সর্বক্ষন তার কাছে নয়তো মেয়ের কাছে। সুহা মুহুর্তেই প্রশ্ন করে,

“ বাসায় গিয়েছেন স্বচ্ছ? তাই আজ আসেননি? ”

স্বচ্ছ কি করে বলবে সকাল থেকে মেয়েকে নিয়ে দৌাড়াদৌড়ি করেছে তাই আনতে পারেনি। কি করে বলবে তার এইটুকু পুতুলের ন্যায় মেয়েটা আর নেই? কি করে বলবে এসব? সুহা ফের বলে,

“ কিছু ভাবছেন স্বচ্ছ?আমার মেয়েটা ঠিক আছে তো? ”

স্বচ্ছ মুহুর্তেই চমকে গিয়ে উত্তর করল,

“ হু? নাহ, না তো, কিছু ভাবছি না। ”

সুহা ফের বলে উঠে,

“ আমার পিচ্চিটা সু্স্থ এখন স্বচ্ছ? ”

স্বচ্ছ এই মুহুর্তে টের পায়, সুহাকে এই কথাটা বলার মতো সাহস তার নেই। সত্যিই নেই। অস্ফুট স্বরে বলে,

“ হ্ হু? ”

সুহা ফের তাগড়া করে বলল,

“ স্বচ্ছ? আমার মেয়েটা ভালো আছে তো? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? ”

স্বচ্ছ অন্যমনস্ক । উত্তর যে দিতে সে আসলেই পারবে এমন ও নয়।সুহা ফের ডাকে,

“ স্বচ্ছ? ”

স্বচ্ছ এই মুহুর্তে উত্তর না দিয়েই উল্টো ঘুরে আবারো। বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ আমার একটু কাজ আছে সুহাসিনী। আসছি।”

অথচ স্বচ্ছর কাজ নেই। স্বচ্ছ সবসময়ই তার সুহাসিনীর জন্য ফ্রি হয়ে থেকেছে। সব কাজকে পেছনে রেখে গুরুত্ব দিয়েছে কেবল সুহাকে। আর আজ?আজ কাজের অযুহাত দিয়েই তাকে সরতে হলো কাপুরুষের ন্যায়। কারণ সত্যটা বলার সাহস যে তার নেই।

.

আবির গুণে গুণে আঠারোটা শাড়ি কিনেছে। তাও এই সন্ধ্যাবেলায়।অতঃপর শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে ছুটির জন্য চুড়ি, বেলিফুলের মালা সহ সবই কালেক্ট করল৷ ছুটিকে আজ সবটা বলা যাবে। অভিমান ভাঙ্গানে যাবে সময় নিয়ে৷ ছুটি কি ভেবেছে? সে এই অবহেলা মেনে নিবে? রাগ ভাঙ্গাবে না?বরং দূরত্ব বাড়াবেই? আবির চাইলে আগেই বলে দিতে পারত সবটা যখন এর আগেও ফোনে যোগাযোগ হয়েছিল। কিন্তু সে তো চেয়েছিল নিজ চোখে প্রেয়সীর অভিমান দেখতে। অভিমান ভাঙ্গিয়ে প্রেয়সীর তুলতুলে কান্নাময় মুখটা বুকে নিয়ে আদরময় চুমু দিতে ললাটে। একদম প্রত্যক্ষভাবে ভালোবাসা দিয়ে সবটুকু রাগ, অভিমান ভুলিয়ে দিতে। আবির মনে মনে এতদিন তাই ভেবে রাখল এত আরাম করে। অথচ আবির কি জানে সময়ের গুরুত্ব কতোটা? যে সময়টায় বসে সে এসব ভেবেছিল সে সময়টাতেই তার প্রেয়সী ভেবেছিল তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা, ভুলে যাওয়ার কথা৷ আবির যেটাকে উপযুক্ত সময় হিসেবে বিবেচনা করেছে সেটা যে আসলে সুযোগ হারানো তা আবির বুঝেই উঠল না। এমনকি এখনও বুঝে উঠছে ছেলেটা। নিজের মতো করে প্রেয়সীর জন্য কেনাকাটা করে সে গিয়ে উঠল শ্বশুড়বাড়িতে। শ্বশুর আব্বা হতে শ্বাশুড়ি আম্মু সবাইকে সালাম দিয়ে মুহুর্তেই শুধাল,

“ আপনাদের মেয়ে কি আমার সামনে আর দেখা দিবে না? না দিলে বলুক সে, আমি দরজা ভেঙ্গে হলেও তাকে দেখে আসি। ”

ছুটির বাবা গলা ঝাড়লেন। আবিরের দিকে তাকিয়ে হুট করে গম্ভীর স্বরে জানালেন,

“ আবির? তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার। ”

এই পর্যায়ে আবির সন্দেহী চোখে তাকায়। ভ্রু বাঁকিয়ে বলে,

“কথা তো পরেও বলা যাবে। কিন্তু বউ দেখা করাটা বেশি ইম্পোর্টেন্ট শ্বশুড় আব্বু। ”

এবার আবারও উনি বললেন,

” সে বিষয়েই কথা ছিল। ”

আবির ভ্রু বাঁকিয়ে মুহুর্তেই বলে,

“ আপনারা যে ধান্ধাবাজ আঙ্কেল। আগের বারের বিষয় কি ভুলে গিয়েছি নাকি আমি? হয়তো আপনারাই দিচ্ছেন না ওকে আমার সামনে আসতে। হতেই পারে।”

কথাগুলো বলেই সে গটগট পায়ে ছুটির রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজায় টোকা না দিয়ে ধমকের স্বরে বলে উঠে,

“ ছুটির বাচ্চা ছুটি? দরজা খুল নয়তে খুব খারাপ হবে। ”

যখন এই ধমক দেওয়ার পরও ভেতর থেকে কেন রেসপন্স এল না তখন আবিরের দ্বিগুণ মেজাজ খারাপ হয়। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে সে পুণরায় শুধায়,

“ এই ছুটি, দরজা খুলবি নাকি ভেঙ্গে ফেলব আমি? মেজাজ খারাপ হচ্ছে কিন্তু। ছুটি…. ”

এইটুকু বলেই দরজায় একটা লাথি বসাতে নিল সে। ঠিক সেই মুহুর্তেই দেখা গেল লাথির ধাক্কায় দরজাটা খুলে গেল। আবির অবাক হয়। তার মানে দরজা আটকানো ছিল না। আবির যখন চমকে গিয়ে রুমের ভেতরে গিয়ে তাকাল ঠিক তখনই দেখল রুম খালি। রুমে কারো উপস্থিতি না দেখেই আবির সরু চাহনিতে চাইল। মুহুর্তেই জিজ্ঞেস করল,

“ ছুটি কোথায়?”

“ ও নেই। ”

উত্তরটা পেয়েই আবির যেন বুঝে নিল অজানা আশংকা। এই মেয়েটাই সবই পারে। মিথ্যে মিথ্যে ভেবে প্রতিবারই তার থেকে দূরে মরে যেতে ওস্তাদ এই মেয়েটা। আবিরের কলিজায় মোচড় দেয়। পুণরায় গম্ভীর গলায় শুধায়,

“নেই মানে? ”

“ বাসাতে নেই। ”

“ কোথায় আছে এখন? ”

এই পর্যায়ে ছোটন এসে উত্তর দিল,

“ অন্য দেশে। ”

কথাটা বলেই ফের বলে,

“ আপু স্কলারশিপ পিয়ে অন্য একটা কান্ট্রিতে পড়তে গিয়েছে আবির ভাই। তোমার জন্য একটা চিঠি রেখে গিয়েছে আপু। বলেছে, যদি কখনো তুমি ফিরো তাহলে দিতে। ”

আবির ছোটনের কথাগুলে শুনে চুপ থাকে। এই ছোটনকে সে সত্যিই অনেকটুকু বিশ্বাস করেছিল। অনেকখানি ভালোবাসত। সে ছোটনই তাকে মিথ্যে বলেছে এতদিন বুঝতে পেরে বলল,

“ তুই ও ছোটন?বিশ্বাসঘাতক! তোরা সবকয়টাই বিশ্বাস ঘাতক। ”

কথাটুকু বলেই আবিরের হাত থেকে চিঠিটা নিল। চোয়াল শক্ত করে মেলে ধরল মুহুুর্তে,

আবির ভাই? আপনি যখন চিঠিটা পড়বেন তখন আমি আপনার থেকে অনেক দূরত্বে অবস্থানরত থাকব। সম্ভবত আপনিও এটাই চেয়েছিলেন। দূরত্ব!আমার মতে গুরুত্বহীন মানুষরা কাছে থাকলেও গুরুত্ব আর কোথায় বা পায় বলুন? এর চাইতে বরং দূরেই থাকলাম। আচ্ছা আবির ভাই?গুরুত্ব পেতে একটা মেয়েকে ঠিক কেমন হতে হয়? সুন্দরী হতে হয়?আচ্ছা? আর কতটুকু সুন্দরী হলর আপনি আমায় অবহেলা করবেন না আবির ভাই?আপনার লিজার মতো সুন্দরী? আবির ভাই,লিজাকে বউ বানানোর ইচ্ছে হলে বানাতেই পারেন, আমাকে ইনভাইট করতে ভুলবেন না। যদি অন্য কোন মেয়েকেও বউ বানাতে চান তাও অনুমতি দিয়ে রাখলাম। আর হ্যাঁ, যদি কখনো মনে হয় বিচ্ছেদ প্রয়োজন? ছোটনকে বলবেন। আমি অবশ্যই বিচ্ছেদের দিন হলেও আপনার মুখোমুখি দাঁড়াব। আর এমনিতে বোধহয় আমাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনাটা ক্ষীণ।যায় হোক, যেটুকু ভালোবাসা আমি আপনার দিক থেকে পেয়েছি সেইটুকু আমি আজীবন মনে রাখব। আজীবন সেই স্মৃতিটুকু আমি মাথায় নিয়ে ঘুরব। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে ঐটুকু ভালোবাসা দেওয়ার জন্য। যাক, তবুও সৌভাগ্য আমার। অবহেলার শহরে একটু হলেও ভালোবাসার দেখা মিলেছিল!

ইতি,
ছুটি

আবির পুরোটায় পড়ল। রাতে চোখমুখ লাল করে মুহুর্তে একটাই শব্দ কেবল উচ্চারণ করল,

“ স্টুপিড!”

#চলবে…

#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১২
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

সুহা খবরটা যখন থেকে পেয়েছে ঠিক তখন থেকেই মেয়েকে কোলে নিয়ে পাথরের মতো বসে আছে সে। কোন নড়চড় নেই। একপলকেই শুধু তাকিয়ে আছে তারই এক মাত্র বাচ্চা মেয়েটার দিকে।যার চোখ বুঝে আছে। হাত গুলো কেমন ঝুলে আছে। মুখটা নিষ্প্রাণ। সুহা কান্না করে না। বরং মুখে চুমু দিয়ে আওড়ায়,

“ আম্মুকে এভাবে বোকা বানাতে নেই আম্মু। চোখ খুল। ”

এই কথাটা সুহা কয়েকবারই বলেছে এই নিয়ে। প্রায় ঘন্টা সাতেক মেয়েকে নিয়ে এভাবে স্থির বসে আছে সে। এখন বাজে রাত একটা। সুহার ঘুম পায় না। কান্না পায় না। দুঃখ হয় না। হসপিটাল ছেড়ে বাড়ি ফিরেছে তিনজনই,অথচ তার মেয়েটা একটাবারও চোখ মেলে তাকাচ্ছে না। একটাবারও তার বাড়িঘর চোখ বুলিয়ে দেখছে না। সুহা থমকে থাকে। মেয়েকে বারবার ডাকে। বাদবাকি সবার কথা মিথ্যে প্রমাষ করতে মেয়েকে বহুবার অনুরোধ করে একটাবার চোখ মেলতে। কিন্তু মেয়ে কি শোনে তা?সুহা স্থির বসে থাকার পরই স্বচ্ছর মা আবারও এল সামনে। সুহার দিকে চেয়ে বহুকষ্টে কান্না আটকে রেখে শুধাল,

“ সুহা, দাফন কাজ করতে হবে তো সকালে। এভাবে বসে থাকলে কি করে হয় মা? বাস্তবটা বিশ্বাস করো, মেনে নাও মা। ”

সুহা ঘাড় কাত করে তাকাল এবারে। কোনভাবেই সে বিশ্বাস করতে পারল না যে তার মেয়ে মৃত। মানল না তার মেয়েটা আর বেঁচে নেই। সুহা চোখ বুঝে। এক পলক মেয়ের দিকে তাকিয়ে বুকে আগলে নেয় বেশ আদুরে স্পর্শে।স্বচ্ছর মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আম্মু? উনি কোথায়?দেখলাম না একবারও সে তখন থেকে। একবার উনাকে আসতে বলবেন আম্মু? উনি বললে বিশ্বাস করব আমি।মেনে নিব আপনাদের কথা। ”

সুহাকে খবরটা স্বচ্ছ বাদে বাদবাকি সবাই দিয়েছে। সবাই বুঝিয়েছে যে তার মেয়েটা আর নেই। রাহা, স্বচ্ছর মা, তার মা, সিয়া সবাই! অথচ স্বচ্ছ সেই যে কাজ আছে বলে বের হলো এরপর থেকে আর আসলই না তার সামনে। মূলত নিজের ভেতরে চাপা এক অপরাধবোধ থেকে স্বচ্ছ সুহার সামনে আসার সাহস করে উঠতে পারল না। বারবার একটাই কথাই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, সে তার মেয়েটাকে আগলে রাখতে পারেনি। স্বচ্ছ আড়াল থেকে সুহাকে ঠিকই দেখছিল এতক্ষন। বহুকষ্টে নিজেকে ঐ জায়গাটায় স্থির রেখেছে সে এতক্ষন। কিন্তু এতক্ষন পর যখন সুহা তার খোঁজ করল স্বচ্ছ আর সাহস নিয়ে দাঁড়াতে পারল না। মুহুর্তেই সরে দাঁড়াল সেখান থেকে। বিড়বিড় স্বরে নিজে নিজে বলল,

“ আমি এটা পারব না সুহাসিনী। কোনভাবেই পারব না। তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহসটাই নেই আমার। ”

কথাটা বলেই সে নিজেকে আড়াল করল আবারও। সুহার সামনে যাওয়ার যে সাহস নেই তার। অপর দিকে স্বচ্ছকে বুঝিয়েও যখন পাঠানো গেল না তখন সবাই মিলেই সুহাকে বুঝাতে লাগল। বাস্তবতা মেনে নিতে বলল। সুহা কাঁদে না। বরং মেয়ের শীতল,শুভ্র নিষ্প্রাণ মুখটায় বারংবার চুমু দিতে দিতে বলে উঠে,

“ ওরা মিথ্যে বলছে, তাই না আম্মু? তুই বেঁচে আছিস তাই না বল? ওরা কেন বলছে তুই নেই আর? আম্মু? শুনছিস আম্মু? ”

সুহা কোনভাবেই বিশ্বাস করতে চাইল না। সে নিষ্প্রাণ দেহটা নিয়েই সে আরো কয়েক ঘন্টা একইভাবেই বসে রইল। অপেক্ষায় থাকল, স্বচ্ছ আসবে। বলবে, তার মেয়েটা সত্যিই বেঁচে আছে। বাকি সবাই মিথ্যে বলছে। অথচ তাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে স্বচ্ছ এল না। বলল না একবার ও, তার মেয়েটা বেঁচে আছে। একটাবারও তাদের রক্ষা করতে আসল না স্বচ্ছ। বরং সবাই সকালের আলো ফুটে কিছুটা বেলা হতেই সুহার থেকে সুহার মেয়েটাকে কেড়ে নিয়ে গেল জোর করে। উদ্দেশ্য তার এইটুকু ছোট্ট মেয়েটাকে দাফন করা। সুহা বেশ শক্তপোক্ত ভাবেই মেয়েকে নিজের কাছে রাখার জন্য আক্রমন চালিয়েছিল। নিজের মায়ের মাথাতেই আঘাত করেছে কাঁচের গ্লাস দিয়ে, নিজ শ্বাশুড়ির কপালেই ছুড়ে মেরেছে ভারী ফুলদানি। তবুও তার ছোট্ট মেয়েটাকে নিজের কাছে রাখতে পারল না সে। সুহা যখন বুঝতে পারে তার মেয়েটাকে মাটি চাপা দিয়ে দিবে ঠিক তখনই সে আর্তনাদ করে উঠে। চিৎকার করে বারংবার স্বচ্ছকে ডাকে।আর ঠিক তার কয়েক মুহুর্ত পরেই সে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে ফ্লোরে। ফলস্বরূপ কপালের এককিনার খুব বিচ্ছিরি ভাবেই কেঁটে যায় তার।

.

সুহার যখন জ্ঞান ফিরে তখন মাথায় ব্যান্ডেজ। হাতে স্যালাইনের নল লাগানো। মাথাটা ভার ঠেকছে। সুহা প্রথমে যখন কিছু বোধগম্য ঠেকল না তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝল এখন রাত। পরমুহুর্তেই তার সব ঘটনা একের পর এক মনে পড়ে গেল স্পষ্টভাবে। চোখের সামনে স্বচ্ছকে দুশ্চিন্ত মুখ নিয়ে বসে থাকতে দেখে মুহুর্তেই শুধাল,

“ স্বচ্ছ? আমার মেয়েটা কোথায়? বেঁচে আছে? ওরা কি ওকে জোর করে মাটিতে পুতে দিয়েছে স্বচ্ছ? আমার ঐটুকু মেয়েটা নিঃশ্বাস নিবে কি করে স্বচ্ছ? ওদের বলুন না আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দিতে। বলুন না। ”

সুহা উত্তিজিত হয়েই বলল। মূলত এই কারণেই এতোটা সময় সুহাকে ঘুমের ঔষুধ দিয়ে নিশ্চুপ করে রাখা হয়েছিল। স্বচ্ছ সুহাকে সামলানোর জন্যই কিছুটা শান্ত স্বরে বলল,

“ সুহাসিনী, শান্ত হও,আমি বলছি। ”

সুহা শান্ত হয় না। দ্বিগুণ ছটফট করে বলে,

“ স্বচ্ছ, এনে দিন না আমার মেয়েটাকে। আমি তো ভালো করে ওকে কোলেও নিতে পারিনি স্বচ্ছ। প্লিজ। এনে দিন আমার পুতুলটাকে।”

স্বচ্ছ এবারে সুহাকে আগলে নেওয়ার ন্যায় জড়িয়ে নেয়। বলে,

“ আমার কথাটা শুনো”

সুহা নিশ্চিন্ত হতে না পেরে প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে স্বচ্ছর দিকে তাকায়। বলে,

“ স্বচ্ছ? মাটিতে পুতে দিয়েছে না ওরা আমার মেয়েকে এতক্ষনে? সত্যি করে বলুন। পুতে দিয়েছে তাইনা? ”

মুহুর্তেই সুহার কি হলো কিজানি। স্বচ্ছকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল সে। কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে মুখচোখ কুঁচকে নিয়ে শক্ত স্বরে বলে উঠে,

“ আপনি একটা কাপুরুষ স্বচ্ছ। নিজের স্ত্রী সন্তানকে রক্ষা করার ক্ষমতা টুকুও নেই আপনার। চলে যান আমার সামনে থেকে।এক্ষুনি চলে যান। ”

স্বচ্ছ ভঙ্গুর হৃদয়ে চায়। চাহনি ক্লান্ত। বহু কষ্টে শুধায়

“ সুহাসিনী? ”

সুহার ফের প্রতিবাদ,

“ আমাকে এই নামে আর ডাকবেন না স্বচ্ছ।একদমই ডাকবেন না। আপনি আমার মেয়েটাকে রক্ষা করলেন না। একটাবারও আমাদের কাছে আসলেন না স্বচ্ছ। আপনি বড় স্বার্থপর। ”

স্বচ্ছ আবারো আকুতি নিয়ে ডাকল,

“ সুহাসিনী

সুহা এই পর্যায়ে গলা উঁচিয়েই বলল,

“ কথা বলবেন না, বের হয়ে যান। এক্ষুনি বের হয়ে যান। আমার মেয়ের, আমার মেয়ের বাবা হওয়ার কোন যোগ্যতায় ছিল না আপনার। কাপুরুষ আপনি। ”

স্বচ্ছ যে কাছে আসতে নিল ঠিক তখনই সুহা পাশে রাখা কাঁচের জগটা নিয়ে ছুড়ে মারল স্বচ্ছর কপাল বরাবর। বলে উঠে,

“ সরে যান স্বচ্ছ, আমার আপনাকে সহ্য হচ্ছে না।চলে যান। ”

.

রাহা এইনিয়ে বোনের কাছে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে বহুবার। কিন্তু প্রতিবারই সুহা তাকে চিৎকার চেঁচামেচি করে বের করে দিয়েছে ঘর থেকে। অবশেষে যখন কান্নামুখে সে বসার ঘরে এসে বসল ঠিক তখনই তার পাশে বসল সাদ। সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেই কিছু বলতে যাবে তখনই সামনে এল রোহান। শার্টের হাতা গুঁটিয়ে একদম রাহার শরীর ঘেষিয়েই বসল সে। অতঃপর এক গ্লাস পানি বউয়ের দিকে এগিয়ে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“ সব ঠিক হয়ে যাবে নবনী, কান্না করবে না একদম। সুহা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। নাও, পানিটা শেষ করো। ”

সাদ তাকাল কি ভীষণ নরম দৃষ্টিতে। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুঝে নিল তার প্রেয়সী ভালো আছেে।যে পুরুষটির নামে তাকে লেখা হয়েছে সে পুরুষটি সত্যিই উত্তম। সাদ উঠে দাঁড়ায়। কয়েক পলক রাহার কান্নামুখো মুখটার দিকে তাকাতেই রোহান দ্রুত বলে,

“ আপনি বরং অন্য কাউকে সান্ত্বনা দিন সাদ। নবনীকে সামলানোর জন্য আমি আছি। আই থিংক, আমি ওকে সামলাতে পারব। আপনার প্রয়োজন হবে না। ”

সাদ থমথমে মুখ নিয়ে অপমানিত বোধ করল। মাথা নাড়িয়ে দ্রুতই পা চালাল সে। বুক চিনচিন করছে। বা পাশটা কেমন যেন ব্যাথা ধরেছে। যন্ত্রনার ব্যাথা। সাদ ছাদে যায়। পকেট থেকে একটা সিগারেট জ্বালিয় মুখে পুরতেই পেছন থেকে সিয়া বলে উঠে,

“ কষ্ট হচ্ছে সাদ ভাইয়া? ”

#চলবে….

#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১৩
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

প্রায় মাস তিনেক পেরিয়ে গেল চোখের পলকেই। আবির ছুটির খোঁজ পেল না। কেউ বললই না তাকে। ছোটনকে এত করে বুঝিয়ে শুনিয়েও লাভ হয়নি। উত্তর দেয় নি তাকে। বরং ছোটনটাও আজ তিনমাস হলো লাপাত্তা বোধহয়। একবার শুনেছে সে নাকি বন্ধুদের সাথে ট্যুরে ঘোরাঘুরি করছে। আবির বিশ্বাস করে না। তিন মাস যাবৎ কে ঘোরাঘুরি করে হুহ? হয়তো ছোটনই ওর সামনে পড়ে না ইচ্ছে করে। লুকিয়ে থাকে হয়তো জিজ্ঞেস করবে বলে। আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাতের আঁধারেই বসে থাকে ছাদের এককোণায়। আবিরের চুলগুলো এলোমেলো কিছুটা। বড় হয়ে কপালে ঠেকেছে। হাতের আঙ্গুলে গুঁজে রাখা সিগারেটের ধূসর ধোঁয়া মধ্যরাতের যন্ত্রনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে বোধহয়। আবির যখন ছাদে দাঁড়িয়ে আনমনে সিগারেট ফুঁকছে আর ছুটির কথা ভাবছে ঠিক তখনই দেখা গেল ছুটিদের ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে ছোটনের মতোই একটা ছায়া। আবির ভ্রু কুঁচকায়। ছোটন তো বাইরে। তাহলে? ভার গলায় জিজ্ঞেস করল,

“ ছোটন নাকি? ”

ছোটন এগিয়ে এল।সে যে বাসাতেই আছে, কোথাও যায়নি এটা মূলত আর লুকানোর প্রয়োজন বোধ করল না। কারণ আবির যে হারে প্রতিটা রাতে ছাদে এসে নির্ঘুম কাঁটিয়ে সিগারেট ফুকছে এই তথ্য ছুটিকে দেওয়ার পর ছুটি রেগে আগুন হয়ে আছে। আবিরের উপরই। ছোটনকে বারবার করে বলে পাঠিয়েছে এই লোক আবার সিগারেট ধরলে সোজা ছাদ থেকে ফেলে দিতে। ছোটস অবশ্য গত এক সপ্তাহ যাবৎ এই দুঃসাহসী কাজ সম্পাদন করার চেষ্টা চালিয়েও পারে নি।এই যেমন এখনও ছুটি ফোনকলে আছে। ছোটন ফোনটা হাতে নিয়েই ছাদে এসেছে। বোনকে দেখিয়েছেও আবিরের কার্যকলাপ। এই পর্যায়ে রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে হেসে বলল,

“ প্রতিদিন রাত বারোটা থেকে চারটা অব্দি এত সিগারেট টেনে কি বুঝাতে চান ভাই? আমার বোনের কথা ভেবে নিজের শরীরের বারোটা নিজেই বাজাচ্ছেন এটা? ”

আবির ঘাড় কাঁত করে তাকায়। তখনও সিগারেটে সুখটান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ায় ব্যস্ত সে। বলে,

“তোর আপু তো ছেড়ে চলেই গেছে, একপ্রকার ছাড়াছাড়ির মতোই তো আছি বল? তো শরীরের বারোটা বাজাই অথবা তেরোটাই তোর আপুর কোন ক্ষতি হবে না এতে। ”

কথাটা শোনামাত্রই ফোনকলে ঘাপটি মেরে থাকা ছুটি ফুঁসে উঠে। রাগে নাক ফুলায় সে। ইচ্ছে হয় আবিরকে কিছু বলে বসতে। কিন্তু উপায় নেই। ফলস্বরূপ কলই রেখে দিল সে। এবার ছোটনই বলল,

“ ছাড়াছাড়ির মতো থাকা আর ছাড়াছাড়ি একই কথা না।নিজের এভাবে অযত্ন না করলেও তো হয়।”

আবির সিগারেট ফেলল। জ্বলন্ত সিগারেটের অংশটাকে পা দিয়ে ফিষে ফেলতে ফেলতে তাচ্ছিল্য করে বলে উঠে,

“ বাদ দে, তুই তো তোর আপুর সাথে আর কথা বলিয়ে দিবি না তাই না? ”

ছোটন জানায়,

“আপুই আপনার সাথে কথা বলবে না। ”

আবির হাসে। কত উন্নতি না ছুটিটার? যে ছুটি তার সাথে কথা বলতে মরিয়া হয়ে থাকত, সে ছুটি আজকাল তাকে এড়িয়ে চলে। তার সাথে কথা হোক এটা ছুটি চায়ই না আজকাল। সময় কত অদ্ভুত!সময় সত্যিই মানুষকে পরিবর্তন করে, সঙ্গে মানুষের অনুভূতিকেও। আবির তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসে। এক লাফে ছুটিদের ছাদটায় পৌঁছে ছোটন ঘাড়ে হাত রাখল। বলে,

“ ভালো তো, তোর আপুকে বলিস আমি মরে গেলে একবার দেখে যেতে। নাকি মরে গেলে ও দাম দেখাবে এমন? ”

ছোটন ঘাড় কাঁত করে তাকায়। মুহুর্তেই উত্তর করে,

“ আপু এতোটা স্বার্থপর নয়। ”

আবির মুখ ভেঙ্গিয়ে বলে,

“ তা তো দেখতে পাচ্ছি।নিজের দাম দেখাতে আমাকে উনি ভুলে যেতেও দুবার ভাবেননি। সেলফিশ। ”

কথাগুলো বলেই অন্যদিকে ফিরে চাইল সে। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে কিছু ভাবল। অতঃপর ছোটনের দিকে চেয়ে ক্রুর হাসে সে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ডাকে,

“ ছোটন? ”

ছোটন জবাব দেয়। আবির প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘাড় ঝুুকিয়ে হেসে বলে,

“ তোকে কিডন্যাপ করে নিলে দোষ দিবি না তো আমায়? কিংবা জোরজবরদস্তি করলে?”

ছোটন বুঝে উঠে না। বোকার মতো জিজ্ঞেস করে,
” মানে?”

আবির আরো শক্ত করে ঝেকে ধরে ছোটনাকে। একদম ঝেকে ধরে কাঁধে হাত রেখেছে যেন৷ বলে,

“ তোর ফোনে নিশ্চয় ছুটির সাথে কন্ট্যাক্ট করার কোন ওয়ে থাকবে?তুই তো ওর সাথে যোগাযোগ রাখছিসই নিয়মিত তাই না?”

“ হু আব…”

কথাটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আবির ছোটনকে ছাদ থেকে ঠেলে ধরে কিছুটা।যেন আরেকটু ধাক্কা দিলেই ছোটন সোজা বিল্ডিংয়ের নিচে পড়বে। ছোটন ভয় পায়। কোনভাবে বলে,

“ আপনি আবির ভাই?”

আবির হেসে বলে,

“ তোর আপুকে কল করে কথা বলতে বল। নয়তো সোজা নিচে ফেলে দিব ছোটন। তুই কি নিচে যেতে চাস?”

ছোটন শুকনো ঢোক গিলে। ততক্ষনে কোনরকমে মাথা নাড়ায় সে। আবির তাড়া দেখিয়ে বলে,

“ এবার তাড়াতাড়ি ছুটিকে কল দে। নাহলে সোজা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব ছোটন ”

উত্তর আসে,

“ দিচ্ছি আবির ভাই।”

অতঃপর ছোটন করে সোজা হয়ে দাঁড় করায় আবির। অপেক্ষায় থাকে ছুটি কখন কল তুলবে। অবশেষে ছুটি যখন কল তুলল ভিডিও কলের ফোন স্ক্রিনে সে চেয়ে থাকে।
ছুটির চোখে চশমা। কাঁধ অব্দি চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া৷ ছুটি কি চুল কেঁটেছে?ছোট করেছে? কোন প্রয়োজনে? আবির তাকিয়ে দেখে। নাকে নাকফুলটা জ্বলজ্বল করছে৷ দেখতে সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। আবিরকে অবশ্য দেখা যাচ্ছে না।ফলস্বরূপ ছুটি রেগেমেগেই বলে ফেলল,

“ বলেছিস ঐ বেয়াদব লোককে সিগারেট আর না ফুঁকতে? এভাবে রাত জেগে সিগারেট ফুঁকে শরীরের বারোটা বাজাচ্ছে কেন? কোন প্রয়োজনে? আবার বলছে তোর বোনের কিছু হবে না? এই লোক পেয়েছে কি আসলে হুহ?”

আবির শুনে। লুকিয়ে লুকিয়ে তাহলে এখন তাকে পর্যবেক্ষণ করা হয় এখন? যেটা সে এতকাল ফলো করত সেটাই তার উপরে এপ্লাই করা হচ্ছে? বাহ! ভালো তো। সে হাসে। আড়ালে খবর রাখলেও ধরা যে পড়ে গেছে এইটা আবিরের ভালো লাগছে। এতকালের সমস্ত রাগ তার এক মুহুর্তেই হাসিতে পরিণত হয়েছেে।ছুটি আবারও বলল,

“ কি হলো কথা বলিস না কেন? তোরে যে দেশে রেখে আসছি? কোন কারণে? সঠিত কাজই যদি না করতে পারিস তাহলে তুই কিসের ভাই আমার? ঐ লোক এখন কোথায়? কি করছেন উনি? আবারও সিগারেট ফুঁকছে? ফুঁকছে কিনা বল… ”

ছোটন উত্তর করে না। একবার ঘাড় ফিরে শুধু আবিরের দিকে চায়। আবার ফোনের স্ক্রিনে তাকায়। আবির হাসে শুধু। ছুটি ফের বলে,

” যদো সিগারেটই ফুঁকে থাকে তাহলে প্লিজ সিগারেটের জ্বলন্ত দিকটা চেপে ধর উনার ঠোঁটে। বেয়াদব পুরুষ মানুষ কোথাকার। আমি এই পুরুষমানুষ জীবনেও চাই না। ”

আবির হাসে এবারেও। বিনিময়ে ছোটনের হাত থেকে ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকায়। বাচ্চামতো চেহারার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে উত্তর করে সে,

” কিন্তু আপনাকে না চাইলেও এই পুরুষমানুষকেই চাইতে হবে ম্যাম। আপনার জন্য এই পৃথিবীতে শুধু এই পুরুষমানুষটিই বরাদ্ধকৃত আছে। বুঝলেন? ”

#চলবে….