#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১৪
লেখনীতেঃঅলকানন্দা ঐন্দ্রি
সুহা নিরবে বসে আছে ছাদের এককোণে৷ হাতে তার বেলিফুলের একটা মালা জড়ানো। যা কিছুটা সময় আগে স্বচ্ছই যত্নসমেত পরিয়ে দিয়েছে তার হাতে। স্বচ্ছ মিনিট দুয়েকের জন্য বাসায় গেল ঠিক তবে তার একটু পরই আবার হাতে দুই মগ কফি নিয়ে ফিরে এল ছাদে। সুহাকে একইভাবে নিরব হয়ে বসে থাকতে দেখে সে পা বাড়িয়ে সুহার কাছে গেল। গলা ঝাড়ল কিঞ্চিৎ যাতে সুহা তার দিকে তাকায়। অথচ সুহা তাকাল না। স্বচ্ছ দীর্ঘশ্বাস ফেলেই তার পাশে বসল। একটা কফির মগ তার হাতে রেখে অন্যটা সুহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“ কফি সুহাসিনী। ”
সুহা পাশ ফিরে চাইল এবারে। এক হাতে স্বচ্ছর হাত থেকে কফি মগটা নিয়ে নিরবে চুমুক বসাল। এমনভাবে নিল যেন স্বচ্ছর হাতের সাথে তার হাতের এইটুকুও স্পর্শ না ঘটে। এমনকি স্বচ্ছর সাথে একটা বাক্যও ব্যয় করল না সে। স্বচ্ছ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কন্ঠ রোধ হয়ে আসে তার।একপলকে তাকিয়ে থাকে নিজের সামনে বসে থাকা নারীটির দিকে। চুলগুলো এলোমেলো, মুখচোখে ফুলো ভাব। এক দৃষ্টিতে অনেকটা সময় তাকিয়ে থেকেই সে রুদ্ধ স্বরে বলে,
“ আমার শাস্তির মেয়াদকাল কি কখনোই শেষ হবে না সুহাসিনী? আর পারছি না এই দীর্ঘসময়ে শাস্তি মেনে নিতে।আর যে অপেক্ষা করা যায় না। আর সত্যিই সহ্য হয় না এই নিরব সুহাসিনীতকে। ”
সুহা কিঞ্চিৎ ভ্রু বাঁকায়। স্বচ্ছর দিকে ফিরে চেয়ে পুণরায় কফির মগে চুমুক বসানোয় মনোযোগ দেয় সে। শান্ত স্বরে বলে,
“সহ্য না হলে মুক্তি দিয়ে দিন। গুড সল্যুশন।”
স্বচ্ছ মুহুর্তেই উত্তর করে,
“ সেটা সম্ভব নয় । ”
সুহা এবারে কাটকাট স্বরে উত্তর দেয়,
“ তাহলে আমার মেয়েকে এনে দিন। ”
স্বচ্ছ এই কয়েকমাসে এই একটা কথাই বারবার বুঝিয়ে আসছে। অথচ সুহ্ মানলে তো? বলল,
“ আমাদের মেয়ে আর পৃথিবীতে নেই সুহাসিনী। ”
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই সুহা টলমল করা চোখ নিয়ে তাকায়। বলে,
“ কি করে থাকবো? আপনি তো সেদিন আসলেন না তাকে বাঁচাতে। চেষ্টা করলেন না তো একটাবারও৷”
স্বচ্ছ চোখ বুঝে। বুকের ভেতর চিনচিনে এক ব্যাথা জাগে। বলে,
“সুহাসিনী? ”
সুহার চোখ বেয়ে ততক্ষনে পানি গড়িয়ে পড়ে। শুধায়,
“ উহ, আমার বুকে যন্ত্রনা হচ্ছে স্বচ্ছ। কি ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ”
স্বচ্ছ এগিয়ে বসে। সুহার দিকে যেই হাক বাড়িয়ে আগলে নিবে মেয়েটাকে ঠিক সেই মুহুর্তেই সুহা ছিটকে দূরে সরে যায়। শুধায়,
“ উহ, না না! আমায় ধরবেন না স্বচ্ছ। ধরবেন না। আমি চলে যাচ্ছি। চলে যাচ্ছি..”
এইটুকু বলতে বলতেই কাঁদকে কাঁদতে মেয়েটা দ্রুত উঠে বসে। মুহুর্তেই এক দৌড়ে ছুটে যেতে লাগে ছাদ ছেড়ে। স্বচ্ছ সেদিক পানে তাকিয়ে চোখ বুঝে ফেলে। এক হাতে কফির মগটা ছুড়ে ফেলে অদূরে। অতঃপর আকাশের পানে তাকিয়ে তীব্র হতাশা আর আপসোস নিয়ে বলে উঠে,
” আমি তার চোখে এতোটা নিস্পৃহতা, এতোটা ঘৃণা কখনোই দেখতে চাইনি বিধাতা। তবুও কেন? কেন আমার ক্ষেত্রেই তার চোখে এত নিস্পৃহতা দেখতে হচ্ছে? এত ঘৃণা দেখতে হচ্ছে কেন বিধাতা? ”
.
ছুটির পাশে ভিডিও কলে আরো দুইজন যুবতী এবং একজন যুবক উৎসুক হয়ে আবিরকে দেখছিল। আবির তা দেখে ভ্রু কুঁচকায়।ঠিক তখনই ছুটির পাশে থাকা যুবকটি বেশ গদগদ স্বরে বলে উঠে,
” হেই ব্রো? আ’ম আলভি। ছুটি’স বয়ফ্রেন্ড।”
ছুটি আকস্মিক কথাটা শুনে একবার আলভীর দিকে তাকায়।পরমুহুর্তেই সেও বেশ হেসে হেসে উত্তর করে উঠে,
“ আবির ভাই? মিট মাই বি এফ। আলভি। ”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছুটির সাথের সোই পুরুষালি মুখটা আবির ভালো করে পরখ করে দেখে। ছেলেটা সাদা ধবধবে। চুল আর চোখ দেখে আন্দাজ করতে পারে ছেলেটা সে দেশের বাসিন্দা। আবির সুচালো চাহনিতেই তাকিয়ে পরখ করল। পরমুহুর্তেই চাপা হেসে বলল,
“ আমি জেলাস ফিল করছি না ছুটি। তারপর বলুন, ভ্যাকেশনে ট্যাকেশনে দেশে ফিরবেন তো নাকি? আর কবে আপনার দর্শন পেতে পারি? ”
ছুটি মুহুর্তেই উত্তর করল,
“ আপনার কেন মনে হলো আপনাকে জ্বেলাস ফিল করাতে আমি তাকে বি এফ পরিচয় দিচ্ছি? আমরা সত্যিই রিলেশনে আছি মাস তিনেক হলো। বিশ্বাস নাহলে
তার গলায় লাভ বাইট দেখুন? ”
আবির তাকায়। ছেলেটার গলায় সত্যিই লালচে দাগ। পরমুহুর্তেি ছুটির গলায় তাকায় সে। না। ছুটির গলায় তো তেমন কোন দাগ নেই। আবির বিপরীতে বেশ কনফিডেন্স নিয়েই উত্তর করে,
“ একজনের সাথে প্রেমে জড়িয়েছিস অথচ আগ্রহ এখনও আমাতেই? আমি সিগারেট টানছি কেন এই নিয়ে রাগের সীমা নেই ওদিকে বয়ফ্রেন্ডের গলায় লাভবাইট ও? বোকা পেয়েছিস আমায়?”
“ এটাই সত্যি। ”
আবির পাত্তা না দিয়ে বলল,
“ আমি তোর মতো বোকা নই যে যা ইচ্ছে তা ভেবে নিয়ে দূরে সরে যাব৷ ভুল বুঝে নিব এক সেকেন্ডেই ছুটি। ”
ছুটি ত্যাড়াস্বরে জবাব দিল,
“ হু, আমি তো বোকা। তাই বলেই আপনার মতো নির্দয়, স্বার্থপর একটা মানুষকে ভালোবেসেছিলাম। ”
আবির মুখ গোল করে শ্বাস ফেলে এবারে। বলে,
“ আমাকে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগটা দেওয়া হলো কখন?যদি শুধু নিজে নিজেই সব ভেবে নিয়ে চলে যাওয়া হয় এইক্ষেত্রে আমার কিছু করার ছিল?তবুও তো আমি ফোনে বুঝাতে চেয়েছিলাম এলিজা আমার কেউ না। তুই বিশ্বাস করেছিলি?এই জন্য ভেবেছিলাম সরাসরি সবটা বলল, সরাসরি সব মিটিয়ে নিব। কিন্তু হলো কি? এসে দেখলাম আপনি তার আগেই চলে গেছেন।”
“ আবির ভাই? আমি আর আপনার সম্মুখীন হতে চাই না। আপনি কেন আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছেন বলুন? আমাকে কি একটুও ভালো থাকতে দিবেন না?”
আবির কিয়ৎক্ষন থম মেরে থাকে। কপালের রগ ফুলে উঠে ছেলেটার। বলে,
“ ভেবে বলছিস এসব? ”
“ হু।”
“ আমি ম’রে গেলে অবশ্য তোকে আর আমার সম্মুখীন হতে হতেও না। কেন যে ম’র’লাম না এখনো বল তো। ম’র’লে তো তোর বড্ড সুবিধা হতো।”
ছুটি তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল,
“ ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছেন আবির ভাই?”
আবির হেসে বলে,
” মোটেই না। তোর পাশের জনকে দে, বেচারা গলায় লাভ বাইট নিয়ে অনেকক্ষন যাবৎ তাকিয়ে আছে। ”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আলভি বলে,
“হেই ব্রাদার। কেমন আছেন?”
আবির হাসে। বলে,
“ প্রথমে যে হারে সালাম দিলেন মনে হচ্ছে ভদ্র ঘরের ছেলে। কিন্তু অন্যের বউরে প্রেমিকা হিসেবে চাইতে লজ্জ্বা করে নাই? ”
ছেলেটা বলতে চেষ্টা করল,
“ ব্রো, আপনি বোধহয়..”
পুরো কথাটা বলা হলো না। তার আগেই আবির ঠোঁট বাকিয়ে বলল,
“ মিথ্যে বলল নাকি ছুটি? আপনি ওর বয়ফ্রন্ড নন?অবশ্য আপনাকে দেখেই এতোটা ভদ্র মনে হচ্ছে যে আমি নিশ্চিত আপনি কোন ছেলের ওয়াইফকে গার্লফ্রেন্ড হিসেবে মেনে নিবেন। তাই না ব্রো? ”
কথাটা বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছুটি উত্তর করল,
“ আপনি যদি বিবাহিত অবস্থায় অন্য একটা মেয়েকে নিজের রুমে থাকার অনুমতি দিতে পারেন সে কেন একটা বিবাহিত মেয়েকে গার্লফ্রেন্ড হিসেবে গ্রহন করতে পারবে না? বলুন।
আবির দাঁতে দাঁত চাপে। এই মেয়েটাকে এত বলেও বুঝানো যায় না। যা নিজে ভেবে নেয় তাই। আবির দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“ অবশ্যই পারবে,কিন্তু আবিরের বউকে পারবে না। বুঝলি?”
.
আবিরের হাতে তখন জ্বলন্ত সিগারেট। দৃষ্টি শূণ্যে। আকাশ তখন অন্ধকার। আবির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বুকের ভেতর ভার লাগেে তার। যন্ত্রনা হয়। শূণ্য লাগে। আবির নিকোটিনের ধুসর ধোঁয়া গুলো মুখ দিয়ে উড়িয়ে বলে,
“তোর বোন তাহলে প্রেম ভালোবাসাও চিনতে শিখেছে? ভেরি গুড। ”
ছোটন মনোযোগ দিয়ে দেখছিল আবিরকে। এতক্ষন যাবৎ একটাক ন দেখে যাচ্ছ। অতঃপর বলে,
“আবির ভাই? আপুর সাথে যোগাযোগ করেননি কেন অতো গুলো মাস? আমার তো মনে হয় আপনি সত্যিই আপুকে অনেকটা ভালোবাসেন। তাহলে এত অবহেলা ছিল কেন আবির ভাই? ”
আবির শান্তি দৃষ্টিতে তাকায়। শান্তস্বরে ছোটনের দিকে চেয়ে উত্তর করে,
“হসপিটালাইজড ছিলাম ছোটন। কোমায় ছিলাম। তোর আপুর সাথে যোগাযোগ করতাম কি করে বল? নিজের সে এবিলিটি ছিল তখন? ”
ছোটন বিস্ময় নিয়ে তখন বলে,
“হসপিটালাইজড? ”
আবির হেসে বলে,
“বিশ্বাস হচ্ছে না না? এর জন্যই সব রিপোর্ট হতে সব কাগজপত্র সবই সাথে এনেছিলাম যাতে তোর আপুর সামনে সব হাজির করতে পারি। ”
“আপু তোমায় যথেষ্ট বিশ্বাস করে আবির ভাই। তুমি বলেই দেখতে একবার। ”
#চলবে….
#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১৫
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
“ বিয়ের তো বেশ কয়মাস পার হলো। তা বাচ্চা টাচ্চার বিষয়ে ভেবেছো? ”
রাহা তখন সোফায় বসা। কথাটা এক প্রতিবেশিই বলল। রাহা তখন মুখ কাঁচামাচু করে কোন একটা উত্তর দিয়ে এল কেবল। আসলেইসে বাচ্চা খুব ভালোবাসে। যদি এতদিনের স্বামীর ভালোবাসা পাওয়া হতো তবে সে নিশ্চয় বাচ্চাকাচ্চার প্ল্যান করে ফেলত। বাচ্চা ভীষণ ভালোবাসে যে সে। এই যেমন আজ দুপুরেও রাস্তায়একটা ছেলেকে সে প্রচুর আদর করেছে, খেলেছে।
রোহান বসে আছে বেলকনিতে।আজ অফিস থেকে ফেরার পথেই সাদের সাথে দেখা হয়েছিল। সম্ভবত টিউশন করে ফিরছে সাদ। রাহার কথাও জিজ্ঞেস করল বেশ কৌতুহল নিয়ে। আর এই জিজ্ঞেস করাটাই রোহান নিতে পারে না। একমনে এক ধ্যানে কি যেন ভেবে চেলেছে সে এই নিয়ে। রাহা বাচ্চার কথা ভাবতে ভাবতে রোহানকে মনোযোগ দিয়েই এতক্ষন যাবৎ দেখে চলছিল। কিন্তু আচমকাই রোহান ফিরে তাকাতে সে নজর সরাল। রোহান ভ্রু উুঁচিয়ে শুধায়,
“ এভাবে ড্যাবড্যাব করে পর্যবেক্ষন করার কারণ? ”
রাহা এবারে এগিয়ে আসে। মৃদু হেসে জবাব দেয়,
“ ভাবছি একটা বাচ্চা নিব। ”
রোহান কেঁশে উঠে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। বলে,
“ ক্ কি?”
রাহা ফের বলে,
“ আজ রাস্তায় একটা বাচ্চা দেখেছি। দেখতে ভীষণ মিষ্টি সে। ওরকম একটা বাচ্চা আমার থাকলে জীবনে আর কোন দুঃখ থাকত না। ”
রোহান শান্তস্বরে বলে,
“ তো বাচ্চা দত্তক নিবে এখন? ”
রাহা তা না মেনে না নিয়ে বলল,
“ মেয়ে হয়েছি। মা হওয়ার ক্ষমতা কি আমার নেই যে দত্তক নিব? ”
রোহান হাসে কিঞ্চিৎ। মেয়েটা কি ছোট? বলে,
” মা হওয়ার ক্ষমতা থাকলেই মা হতে পারবে নাকি? ”
রাহা হাসে দাঁত কেলিয়ে। বলে,
“ অবশ্যই পারব। আপনি আছেন না? ”
রোহান এই পর্যায়ে আবারও কেঁশে উঠে। চোখমুখ লাল হয়ে উঠে কেমন। শুধায়
“ কি? ”
রোহা কোমড়ে হাত রেখে বলে,
“ মানুষ কার বাচ্চা গর্ভে ধারণ করে? ”
রোহানও প্রশ্ন ছুড়ে,
“ কার?”
“ বরের। ”
রোহান দাঁতে দাঁত চাপে। শুধায়,
” এটা কি আমি জানি না?”
“ আমার বরটা কে মিঃ রোহান ফারাবী?আপনি নিশ্চয়? ”
“ হু। ”
রাহা আবারও ব্যাখ্যা স্বরূপ বলে,
“ তাহলে আমি আপনার বাচ্চাই তো গর্ভে ধারণ করব তাই না? আর আপনি এটা অস্বীকার করবেন না যে আপনিও নিশ্চয় বাচ্চা চান হুহ?”
রোহান চুপ থাকে। আসলেই যে সে বাচ্চা অপছন্দ করে এমন নয়৷ সেও চায় কার একটা সংসার হোক, ফুটফুটে সন্তান থাক।রোহান উত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাতে দ্রুত বলে,
“ হুট করে বাচ্চার ভূত মাথায় চাপল কেন নবনী? তোমার প্রাক্তন প্রেমিক কি বাচ্চা নিয়ে কিছু বলেছে নাকি আজ? ”
রাহার সুন্দর আলোচনায়এমন একটা কথা পছন্দ হলো না। দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,
“ আমার কোন প্রাক্তন প্রেমিক নেই। যে ছিল সে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। আর আপনার কথানুযায়ী সে যদি কিছু বলেও থাকে তবে তার কথামতে নিশ্চয় আমি বাচ্চা নিতে পাগল হবো না? ”
রোহান এই পর্যায়ে আড়ালে হাসে রাহার কথা শুনে। বিড়বিড় করে শুধায়,
“ হু, এখনও কিছুই হয়ে উঠল না, আর উনি একেবারে বাচ্চা নিয়ে নিচ্ছেন। ”
কথাগুলো বিড়বিড় করেই বলল রোহান। রাহা শুনল না। তবে হঠাৎই রাহা প্রশ্ন ছুড়ল,
“ আপুকে খুব ভালোবাসেন তাই না মিঃ রোহান ফারাবী? ”
রোহান ফিরে তাকায়। উত্তর দেয়,
“ এর উত্তরটা তো অজানা নয়। হঠাৎ জিজ্ঞেস করার কারণ কি নবনী? ”
রাহা বেশ মনোযোগী হয়ে আবার বলে,
“ অন্য কাউকে কখনো ভালোবাসতে পারবেন কি? ”
“ হ্ হু?”
রাহা এবার কথা ঘুরাতে বলে,
“ কিছু নয়। এতক্ষন আকাশপানে তাকিয়ে কি ভাবছিলেন? ”
রোহান এবারে হাসে। মেয়েটা যে একটু হলেও তার প্রতি দুর্বল এটুকু সে মাস কয়েকে বুঝতে পেরেছে ঠিকই। তাই তো হেসে বলে,
“ ভাবছি অন্যের বউয়ের পিছনে ঘুরে ঘুরে তাকে জ্বালানোর মাশুল এখন আমিও পাচ্ছি। আমার বউয়ের পিছনেও কেউ ঘুরে এইটা আমি মানতে পারছি না সহজ সরল ভাবে এখনও।”
এই প্রথম এভাবে আমার বউ সম্বোধনটা পেয়ে রাহা মাথা নিচু করে। ফর্সা মুখটা বোধহয় লজ্জ্বায় লাল হয়ে আসল। দৃষ্টি অবনত হলো দ্রুত।
.
সুহার হাতে তখন ধারালো চুরি। একহাত এগিয়ে ধরে সে একাধারে চিন্তা করে যাচ্ছে তার একরত্তি মেয়েটাকে। অতঃপর আকাশপানে চেয়ে হুট করেই কেঁদে উঠে সে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,
“ আম্মু? তোর ওখানে অনেক কষ্ট হয় না? একা থাকতে পারিস আম্মু? ওখানে তো তোর কেউ নেই আম্মু। আম্মুও তো নেই। তোর খুব কষ্ট হয় তাই না? ”
সুহা নিরবেই কাঁদে। দরজা বন্ধ করতে চেষ্টা করেছিল। তবে পারে না সে। স্বচ্ছ মাস কয়েক হলো দরজার লক হতে ছিটকিনি সব নষ্ট করেছে। সুহাকে সর্বক্ষণ চোখে চোখে রেখেছেে।যত্ন নিয়েছে। মাস কয়েকে মধ্যে সুহা বহুবার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। বহুবার মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আবোলতাবোল কান্ডকারখানা চালিয়েছে নিজের উপর। যার ফলস্বরূপ এখনও কিছু কাঁটা দাগ সুহার হাতে ভাসে। এখনও কপালের কোণাটায় কাঁটা দাগ স্পষ্ট যা তার নিজেরই নিজেকে আঘাত করার স্পষ্ট প্রমাণ।অবশ্য এই এক মাসে সুহা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। এই একমাসে স্বচ্ছ অনেকটাই সুহাকে একা ছাড়ে। কিন্তু আজ একমাস পর আবারও সুহার মাথায় একই ভূত চাপবে কে জানত। সুহা নিরবে বসেই বার কয়েক চুরি দিয়ে নিজের হাতে দাগ বসাল। কাঁটা দাগ। যা দিয়ে মুহুর্তেই বেরিয়ে এল লালাভ রক্ত। অতঃপর মুখে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে সে বলল,
“ সোনা? আম্মু তোমার কাছে আসব। খুব আদর করব আম্মু। মিলিয়ে নিও। আম্মু তোমায় খুব ভালোবাসব আম্মু। ”
.
ছুটির নিজের একটা বন্ধুমহল হয়েছে এখানে। সে বন্ধুমহলে সে ব্যাতীত দুইজন যুবতী এবং একজন যুবক। যুবকটির নাম আলভি, এবং বাকি দুইজন যুবতী এলিনা এবং উইলি। আলভির গার্লফ্রেন্ড হলো উইলি। এদের মাঝের কেমিস্ট্রিটা তারা বাকি দুইজন সবসময়ই দেখে, সবসময়ই সম্মুখে অবলোকন করে তাদের প্রেম। সেদিন আলভির গলায় যে লাভবাইটের চিহ্ণ ছিল তাও উইলির দেওয়াই ছিল। ছুটি তো কেবল একটু আবিরকে জ্বালাতে আলভিকে বয়ফ্রেন্ড হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল। ছুটি কিঞ্চিৎ হাসে আনমনেই। আবার পরক্ষণেই মন খারাপ হয়। সে আবির ভাইকে কষ্ট দিতে চায়নি কোনকালেই। কখনোই চায়নি আবির ভাই কষ্ট পাক। কখনো চায়নি আবির ভাই রাত জেগে নিকোটিনে আসক্ত হোক। কিন্তু আবির ভাই কেন তাকে অবহেলা করল? কেন তার সাথে এতগুলো মাস কথা বলল না?কেন অন্য একটা মেয়ে আবির ভাইয়ের রুমে থাকবে? এই এত এত প্রশ্ন যখন তার মাথায় ঘুরপাক খায় তখন এমনিতেই জেদ চাপে। ইচ্ছে হয় আবিরকেও সেইম একই যন্ত্রনায় দেখতে। ইচ্ছে হয় আবিরের কাছে নিজের মূল্যটা হারে হারে প্রমাণ করতে। ছুটি যখন কফি হাতে এসবই ভাবছিল ঠিক তখনই উইলি,এলিনা এবং আলভি আসল। কিঞ্চিৎ হেসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় উইলি বলল,
“ ব্রো এ’র ক’থা ভাব’ছো? ”
যদিও আলভি আর এলিনা দুইজনেরই মা বাংলাদেশি হওয়াতে তারা সুন্দর বাংলা বলতে পারে। তবে উইলি এই দেশের হওয়াতে বাংলাটা খুব একটা পারে না। তবুও আলভীর থেকে এই কয়েক মাসে শিখে ফেলেছে বেশ অনেকটাই। বলতে গেলে অনেকটা ভালোই পারে সে বাংলা বলতে তবে হালকা ভাঙ্গা ভাঙ্গা এবং উচ্চারণ গুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাস্যকর। ছুটি হাসে। বলে,
“ তোমাদের ব্রো এখন দিনরাত উদাসীনতায় কাঁটায়। নতুন নেশা হিসেবে নিকোটিনে আসক্ত হয়েছে। তার কথা আর কি ভাবব বলো? ”
এলিনা এবারে বলল,
“ সে তোমায় অনেক লাভ করে ছুটি। তবুও মিথ্যে বললে কেন? ”
ছুটি উত্তর করে,
“ একটু জ্বালাচ্ছি। আগে তো আড়ালে আমার সাথে যোগাযোগ রাখত না। আমিও এবার একটু তার দেখানো পথে হাঁটছি। সরাসরি যোগাযোগ না করে আড়াল হতে খোঁজ খবর রাখছি এই আরকি। আর অলভিকে বয়ফ্রেন্ড হিসেবে পরিচয় দিয়েছি উনার লিজার কারণে। যে একবার তার হয়ে কল তুলেছিল এবং সে মুহুর্তে তার রুমেই অবস্থান করছিল। আমি লিজাকে খুব খারাপ হিসেবে নিচ্ছি না, আবার খুব ভালো হিসেবেও নিচ্ছি না কারণ লিজা নিজেই বলেছে সে আবির ভাইকে পছন্দ করে। তাহলে? একটা মেয়ে পছন্দ করে জেনেও সে কেন তার রুমে মেয়েটাকে এলাও করল এটাই আমি আজ অব্দি মানতে পারছি না। মূল কথা তার পাশে কোন মেয়েকেই আমি সহ্য করতে পারি না এলিনা। এর আগেও রাহাকে নিয়ে আমি অনেকটা কষ্ট পেয়েছিলাম।”
আলভী এই মুহুর্তে বলে উঠল,
“ এমনও তো হতে পারে সে কোন সমস্যায় ছিল? ”
“ তার সাথে তো আমার চলে আসার আগে দিয়ে কয়েকবার ফোনে যোগাযোগ হলো আলভী। বলল না তো সে সমস্যায় ছিল। বলতে পারত তো বলো? ”
ছুটি উত্তরটা দিয়ে শেষ করে ঠিক তখনই তার ফোনে কল আসে। ছোটনের কল। ছুটি কল তুলে। ওপাশ থেকে ছোটন বলে,
“আপু? আবির ভাইয়া তো চলে যাবে আবার। এবার অন্য কান্ট্রিতে যাবে। ভিসার জন্য গেছে আজ। ভালোই ভালোই ভিসা হয়ে গেলে মাস এক দুয়েকের মধ্যে চলে যাবে আবির ভাই। আর শুনলাম,এবারে গেলে উনি নাকি আর দেশে ফিরবেন না কোনদিন।”
আচমকা এই খবরটা ছুটি বিশ্বাস করতে পারে না। ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
“ ফিরবেন না মানে?”
ছোটন বলে,
“ফেরার ইচ্ছে নেই নাকি উনার। চিরচেনা সব কিছু থেকেই নাকি হারিয়ে যাবেন। এইজন্যই নাকি অন্য কান্ট্রিতে যেতে চাইছেন এবার। ”
ছুটি রেগে উঠল এবারে। চলে যাবেন মানে? নিষ্ঠুর! নির্দয় লোক! প্রতিবার ছুটিকে অবহেলায় ছুড়ে ফেলতে একটাবারও মায়া হয় না এইলোকের? ছুটি মুহুর্তেই বলল,
“ ফেরার ইচ্ছে নেই বললেই হলো? হারিয়ে যাবেন বললেই হলো? উনার মামাবড়ির আবদার নাকি? ”
“ সেটা তো জানি না আপু। ”
ছুটি ফের বলল,
“ সিগারেট টেনে টেনে এসব ভাবে এখন?আজ সকাল থেকে সিগারেট ছুঁয়েছে কয়বার হু? ”
ছোটন বলে,
” দুয়েকবার বোধহয় ছুঁয়েছে। ”
ছুটি বাহবা দিয়ে বলে,
“ বাহ! কেউ কিছু বলে না এই খারাপ লোককে? পরিবারে এতগুলা লোক কিছুই বলে না? ”
ছোটন শুধায়,
” জানি না,তবে ফিহার কাছেও শুনেছি আবির ভাই এবারে গেলে আর ফিরবে না। ”
ছুটির এবারে কান্না পেয়ে যায়। ফিরবে না মানে? ছুটি কি একটু বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে আবির ভাইকে? ছুটি যদি পরবর্তীতে আর খুঁজে না পায় এই লোককে? ছুটি কেঁদে ফেলে সামনের বাকি তিনজন মানুষের সামনেই৷ বলে,
“ খবদ্দার ছোটন, উনাকে একেবারের জন্য যেতে দিলে দেশে ফিরে আমি তোর চুল একটাও রাখব না। দরকার হলে কিডন্যাপ করে হলেও তার যাওয়া আটকাবি।মাইন্ড ইট ছোটন। ”
এপাশে ছোটনের পাশে বসেই আবির সবকথা শুনছিল। এবারে ছুটিকে কাঁদতে কাঁদতে এসব বলতে দেখে হালকা হাসে সে। ছোটনের থেকে ফোনটা নিয়ে কল রাখে সে। ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
“ তোর বোন জ্বলে উঠল নাকি ছোটন? ”
ছোটন বোনের কান্না শুনে আপসোস করে। বলে,
“ একটু তো জ্বলবেই। সেই কবে থেকে আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসে৷ ”
আবির উত্তর দেয়,
“ অথচ তোর বোন নিজেও জানে না যে তোর বোনকে আমি কতোটা পাগলের মতো ভালোবাসি।তোর বোন একটা বোকা। সাধে কি বোকাপাখি বলি? আমি যে তার কাছে যাওয়ারই প্রস্তুতি চালাচ্ছি এটা তার মাথায় একবারও আসবে না দেখিস। আসবে দুনিয়ার হাবিজাবি চিন্তা।দেখবি যেদিন ওর সামনে গিয়ে হাজির হবো সেদিন আবারও নিশ্চয় কাঁদবে বোকাপাখিটা।”
#চলবে…
#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১৬
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
সুহার হাতে ব্যান্ডেজ। চোখজোড়া বুঝে শুয়ে আছে। স্বচ্ছ দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবারে। একহাতে সুহার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে স্বচ্ছ নিরব চেয়ে থাকে ওর মুখপানে। তারপর অনেকটা সময় পর সে মাথা নুইয়ে চুমু বসাল সুহার কপালে। পরপরই সুহার গালে চুমু বসাল। স্বচ্ছ একজন পুরুষ মানুষ। লোকসম্মুখে কান্না বারণ তার। তবে স্বচ্ছ সে নিয়ম মনে না করে সুহাকে চুমু দিতে দিতেই চোখ লাল টকটকে হয়ে উঠে। যেন চোখের পানি পড়বে এক্ষুনিই। স্বচ্ছ কিছুট্ সময় স্থির তাকিয়ে থেকে আক্ষেপ নিয়ে ভেজা স্বরে বলে,
“ আমি জানি না বিধাতা আমায় কিসের শাস্তি দিচ্ছে সুহাসিনী। কেন বিধাতা কাউকে আমার শত্রু তৈরি করে পাঠালেন। আমি চাইনি কেউ আমাকে শত্রু হিসেবে দেখুক সুহাসিনী, কেউ আমার ভালোব্সার জিনিসগুলোর প্রতি নজর দিক আমি চাইনি। তবুও নজর দিয়েছে। বারংবার আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে সুহাসিনী। প্রথমে তোমার আর আমার এক্সিডেন্ট করানোর চেষ্টা চালাল। ভাবল আমরা মরে যাব সেই এক্সিডেন্ট। অথচ আমরা বেঁচে ফিরলাম। তারপরও আসল কাল্প্রিটকে খুুজে বের করতে আমার কম সময় যায় নি। আমি যখন খুঁজে বের করলাম, আমার সাথে সাথে তোমাকে হ’ত্যা করার চেষ্টা কিংবা আমার প্রিয় মানুষটার লাইফও রিস্কে ফেলার কারণে তাকে দিনের পর দিন আমি শারিরীক যন্ত্রনা দিয়েছি সুহাসিনী। জানে মারতে পারিনি, কারণ যতই হোক সে আমার চাচা। রক্তের সম্পর্ক! তিহানকে যে খুব ভালোবাসতাম সুহাসিনী। ওর আব্বুকে নিজ হাতে কিভাবেই বা মেরে দিই বলো? কিন্তু ওটাই পাপ হলো। ঐ খু’নী পালিয়ে গেল একদিন। আমি তখন ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম যদি তোমার উপর আক্রমন হয়?তার উপর তখন তুমি দুয়েকমাসের প্রেগন্যান্ট সুহাসিনী!”
এটুকু বলেই স্বচ্ছ ঢোক গিলে। সুহার সুস্থ হাতটা এবার হাতের মধ্যে আগলে নিয়ে বলল,
“ সিদ্ধান্ত নিলাম এদেশেই থাকব। ফিরব না আর। এর জন্য যা যা কিছু করতে হতো তার জন্য একবার দেশের বাইরে যেতে হয়েছিল আমার। এবং তার ফল কি হলো জানো সুহাসিনী? ঐ জা’নোয়ারটা এবার আবারও ওখানে আমার উপর হামলা চালানোর চেষ্টা করল। আবির আর আমি একটা গাড়িতেই ছিলাম সেবার। মাঝপথে আমি কি একটা কারণে নেমে পড়াতে গাড়িতে কেবল আবিরই ছিল। এবং ফলাফল কি হয়েছিল জানো সুহাসিনী? ঐ পাষন্ড লোকটা আমায় হ’ত্যার উদ্দেশ্যে নিজেই গাড়ি চালিয়ে আক্রমন চালাল। আর তারপরই শোনা গেল ঐ এক্সিডেন্ট দুই গাড়ির এক চালক মারা যায় এবং অপরজন হসপিটালে ভর্তি। সেবার আবিরের জন্য কলিজা লাফিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল যেন। বহু খোঁজ করে যখন আবিরকে পেলাম তখন শুনলাম আবির কোমায়। এবং যে লোকটা মারা গিয়েছিল সে আমারই আপন চাচা। এরপর আমি ভেবেছিলাম যে আর কোন শত্রু বোধহয় আমার সত্যিই নেই। আমি তার লা’শ নিয়ে দেশে ফিরলাম , আবিরের খোজ নিতে মাঝেমাঝে যেতাম। কিন্তু আমার একবারও মনে হয় নি সে শত্রুর শত্রুতার রেশ আমার সন্তানকেও দিতে হবে সুহাসিনী। আমি জানি, আমি জানি তুমি আমায় কেন ঘৃণা করো সুহাসিনী। কেন আমাদের মেয়ের মৃত্যুর জন্য আমাকেয় দায়ী মনে করো। ”
স্বচ্ছ ফের ফ্যাঁসফ্যাঁস করে বলে,
“ আমি একজনকে হারিয়েছি সুহাসিনী। একজনকে আমি না চাইতেও হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তোমাকে হারাতে চাই না। তোমাকে কিছুতেই হারাতে পারব না সুহাসিনী। এত ভয় আমি আর সামলাতে পারি না। কেন এমন করো সুহাসিনী? কেন? আমি তো এমন চাইনি। সত্যিই চাইনি এমনটা। ”
এইটুকু বলতে বলতেই স্বচ্ছ কান্না পেল। ঢোক গিলে সে। সুহা ততক্ষনে ক্লান্ত চাহনিতে তাকায় স্বচ্ছর দিকে। এতক্ষন সব শুনেছে কিনা স্বচ্ছ বুঝে উঠে না। তবে স্বচ্ছকে অমন করে রক্তিম চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে হালকা হেসে বলে সে,
“ চিন্তা করছিলেন নাকি? কিন্তু বেঁচে গেলাম তো এবারও স্বচ্ছ। ”
কথাটায় কি ছিল যেন জানা নেই তবে স্বচ্ছ একমুহুর্তও দেরি করল না সুহাকে জড়িয়ে নিতে। বলে উঠল অস্থিরভাবে,
“ বাঁচতেই হবে তোমাকে সুহাসিনী। তুমি ছাড়া আমি শূণ্য। ”
সুহা নিশ্চুপ থাকে। আত্মহত্যা মহাপাপ। সুহার এটা অজানা নয়। কিন্তু তবুও সুহা আজকাল বাঁচতে পারে না। নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না। যখন থেকে জানতে পারল সেদিন ছাদে তিহান ছিল। তিহানই তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলল এবং কারণটা হলো স্বচ্ছর সাথে শত্রুতা। কারণ স্বচ্ছ তার বাবাকে অনেকদিন আটক রেখেছিল এর কারণে সে তার বাবার মৃত্যুর জন্য স্বচ্ছকেই দায়ী করে। সুহা মাঝেমাঝে একদম স্বাভাবিক আচরণই করে যেন পুরোপুরি সুস্থ সে আবার মাঝেমাঝেই তার মাথা ঠিক থাকে না। পাগলামো শুরু হয়। সুহা স্বচ্ছর পিঠে হাত রাখে আলতো করে। বলে,
“ আমাদের মেয়েটাকে ছাড়া ও কি আপনি পূর্ণ আছেন স্বচ্ছ? ”
স্বচ্ছ ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠে এবারে। বলে,
“ আমি চেয়েছিলাম তাকেও। বিধাতা রাখেননি। বোধহয় আমার কারণেই রাখেননি”
সুহা নিরব চেয়ে থাকে। গড়িয়ে পড়ে চোখ বেয়ে পানি। বলে,
“ বিধাতা রাখেননি? নাকি তাকে রাখতে দেওয়া হয়নি স্বচ্ছ? বলুন.. ”
স্বচ্ছ মুখ তুলে তাকায়। সুহার দিকে চেয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকে। তারপর বহু কষ্টে বলার চেষ্টা করে,
“ সুহাসিনী.. ”
সুহা এবারে অস্বাভাবিক ভাবে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। নিজের চুলগুলো নিজেই টেনে ধরে পাগলের ন্যায়। দাঁতে দাোত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“ ওকে মেরে ফেলা হয়েছে স্বচ্ছ। ওকে সত্যিই মেরে ফেলা হয়েছে। আমি মা হয়ে মেনে নিব এটা? আর আপনি? আপনি তো সবটা জেনেও শুরু থেকে চুপ আছেন স্বচ্ছ। আপনাকে ঘৃণা করব না? করাটা কি অনুচিত বলুন? আপনি এখনও আমার মেয়েটার খুনীর কোন শাস্তি নিশ্চিত করেননি। করেননি। ”
ফের আবার বলতে লাগে,
“ আমি তো জানতাম না আমার বাচ্চাটার এত শত্রু আছে। তাও তার বাবার কারণেই সে পৃথিবীতে জম্মানোর আগেই অনেকে তাকে শত্রু হিসেবে ভেবে এসেছে।তার বাবা তো জানত তার গুঁটিকয়েক শত্রু থাকতে পারে তাই না?তবুও কেন আমার বাচ্চাটাকে আগাম সতর্কতা নিয়ে রক্ষা করল না? কেন বাঁচিয়ে রাখল না? ”
সুহা কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে মেয়েটার। সবশেষে ক্লান্ত স্বরে স্বচ্ছর কাছে কাঁদতে কাঁদতেই আকুতি নিয়ে বলে,
“ আমাকে একটা বাচ্চা এনে দিন স্বচ্ছ। আমি তাকে নিয়ে থাকব। নয়তো আমাকে আমার মেয়ের কাছে যেতে দিন। বিশ্বাস করুন, আমি ঘুমাতে পারি না আমার মেয়েটার কান্নায়।”
এভাবে বলতে বলতেই সুহা জ্ঞান হারাল। চোখ বুঝে পড়ে রইল। স্বচ্ছ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাস টেনে ভারী আওয়াজে বলে,
“ আমি একবার বেবি নিয়ে তোমাকে হারানোর ভয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছি সুহাসিনী।ডক্টর যখন থেকে বলেছিল ঝুুকি ছিল তখন থেকেই। আর এখনও রোজ ভয় পাই তুমি কি না কি করে ফেলবে এই ভেবে। আমি তোমাকে হারাতে চাই না সুহাসিনী। ”
.
স্বচ্ছ ডক্টরের সামনে বসা৷ কপালে চিন্তার রেখা তার। ডক্টর এবারে ছোটশ্বাস টেনে স্বচ্ছকে শুধালেন,
“সম্ভবত একটা বেবিই পারে ওর ভেতরের এই যন্ত্রনাটা মুঁছে দিতে স্বচ্ছ। আর, সুহা কিন্তু তোমার প্রতি রাগ জেদ যায় দেখাক তোমাকে এখনো ভালোবাসে স্বচ্ছ। তার মাঝে এখনও তোমার জন্য একটা সফট কর্নার আছেে।তুমি কৌশলে তা কাজে লাগিয়ে তাকে সুস্থ করতে পারো। ”
স্বচ্ছ স্থির তাকায়। বলে,
“ ও বোধহয় আমায় সত্যি সত্যিই ঘৃণা করে ডক্টর। কারণ আমার মেয়েটা আমার অসতর্কতার কারণেই মারা গিয়েছিল ডক্টর।”
ডক্টর শান্তস্বরে বোঝালেন,
“ আমি সবটা জানি স্বচ্ছ। কিন্তু তুমি তো ইচ্ছে করে করোনি। নিজেকে দোষ দিও না স্বচ্ছ। তোমার শত্রু থাকতেই পারে। এর জন্য তোমার সন্তান মারা গেলে এটা তোমার দোষ নয়। ”
“ আমার আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল ডক্টর। ছাদ থেকে ধাক্কা দেওয়াটা যে তিহান করতে পারে এটা আমার মাথাতে কাজই করেনি। পরবর্তীতে যখন জানলাম তখন থেকে তিহান নিরুদ্দেশ।আমি এখনও আমার বাচ্চাটার জন্য কিছুই করতে পারিনি ডক্টর। ”
ডক্টর স্বচ্ছর হাতের উপর হাত রাখলেন। বললেন,
“ আপনার তো করার কিছু নেইও স্বচ্ছ। সে অপরাধ করেছে, এর শাস্তি আইন তাকে দিবে। আপনি যদি আগের বারেও আপনার চাচাকে আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করতেন তাহলে বোধহয় সমস্যাটা এতটুকু বাড়ত না স্বচ্ছ।”
.
আবির ছাদে বসা।পাশে বসে আছে ছোটন। প্রতিদিনের মতো সিগারেট ফুঁকছে না সে। বরং নিরব চেয়ে আছে আকাশের পানে। আবির পাশে বসা ছোটনের দিকে চেয়ে হালকা হাসে। বলে,
“ তোর বোন এখন কি করছে বলতো?একটু কথা বলিয়ে দিবি তোর বোনের সাথে? ”
আবার ফের ছোটনের দিকে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“ আমার সাথে যে রাতদুপুরে এসে বসে আছিস তোর বোন কিছু বলবে না? ”
ছোটন তাকায়। হালকা হেসে বলে,
“ তুমি আপুকে অনেক ভালোবাসো তাই না আবির ভাই? ”
আবির উত্তর দেয়,
“ একটুআধটু।
ফের প্রশ্ন আসে,
“ ভালোবাসা ঠিক কেমন তোমার কাছে?”
“ আমার কাছে ভালোবাসা মানে তোর বোন।তোর বোনের পাগলামো। আমি ভালোবাসা বুঝতে পেরেছি সর্বপ্রথম তোর বোনকে দিয়েই। ”
ছোটন উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে এবারে বলে,
“ আপু তোমার প্রথম প্রেম? ”
আবির উত্তর করে,
“ ঠিক প্রেম নয়। তবে প্রথম অনুভূতি ওই।গোপন অনুভূতি, যে অনুভূতির কথা তোর বোনকে অব্দি জানতে দিইনি। ”
ছোটন হেসে উঠে। ফোন নিয়ে ছুটিকে ভিডিও কল দিতে দিতে হেসে বলে,
“ আপুর সাথে কথা বলবে না? ”
আবির মুহুর্তেই উত্তর দিল,
“বলি একটু। বোকাপাখির কন্ঠ শোনার বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে। ”
ছোটন কল দিয়েই ফোনটা আবিরের হাতে দিল। আবির অপেক্ষায় থাকল কবে কল রিসিভড হবে । বুক ঢিপঢিপ করে তার কেমন। ঠিক তখনই কর তোলা হলো। ওপাশ থেকে ভেসে এল ছুটির স্নিগ্ধ চাহনি। আবির মুখটার দিকে তাকিয়েই বুকের বা পাশে হাত রাখে। বলে,
“ বহু তো লুকোচুরি হলো। লাভ কি হলো শুনি? ধরা তো পড়লিই বোকাপাখি। ”
ছুটি মনোযোগ নিয়ে তাকায়। আবিরকে ফোনের স্ক্রিনে দেখে ভ্রু কুঁচকায় সে। বলে,
“ আপনি? আপনি কেন ছোটনের ফোনে? ”
আবির হেসে বলে,
“ মনে হলো তোকে বহুদিন জ্বালাই না। ”
ছুটি বিরক্ত যেন। উত্তরে বলে,
“ এরপরও যে সবসময় জ্বালাবেন এমন তো নয়৷ দুদিন জ্বালিয়ে আবারও হয়তো নিরুদ্দেশ হয়ে যাবেন। তখন তো আমার মানাতে কষ্ট হবে। এর চাইতে ভালো যোগাযোগ না হোক।”
আবির খোচা দিয়ে বলল,
“ তোর তো বয়ফ্রেন্ড আছে। কষ্ট কেন হবে? আমাকে তো আর এখন ভালোবাসিস না। ”
ছুটি জ্বলন্ত চাহনিতে তাকায়। উত্তরে বলে,
“ একদম। আমার ভুল হয়েছে জীবনে আপনার মতো কাউকে ভালোবাসা। আমার সত্যিই নিজের উপর রাগ হয় এই ভেবে যে আমি আপনাকে কেন ভালোবাসলাম।কোন দুঃখে!আমার আর জীবনে কিচ্ছু বাকি থাকল না। ”
আবির হেসে উঠে। ঠোঁট বাকিয়ে বলে উঠে,
“ কি করবি এখন আর? ভালোবেসে সব তো দিয়েই দিয়েছিস বল? এখন নতুন করে ভেবে আর লাভ নেই।”
#চলবে…