#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_২০
#লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
বাইরে ঠান্ডা বাতাস। চারপাশে শীতল এক বৃষ্টিময় সুভাস। যেন একটু পরই বৃষ্টি নামবে৷ রাহা চুপচাপ বসে থেকে একটু পরপর আড়চোখে রোহানকে দেখছে।গাড়ি চলছে তার নিজ গতিতে।রোহান চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। মুখটা টানটান দেখাচ্ছে যেন কোন কারণে সে রেগে আছে। রাহা বুঝে উঠে না এই সুপ্ত রাগের কারণ। তবে মাঝেমধ্যেই আড়দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরখ করছে সে এই পুরুষটাকে। কিছুক্ষন পর হুট করে প্রশ্ন ছুড়ল,
“ এভাবে নিয়ে আসার মানে কি?এখন কি আমরা আপনার বাড়ি যাচ্ছি? ”
রোহান ভ্রু কুঁচকাল। আগের মতোই গাড়ি চালানোতে মনোযোগ তার। রাহার দিকে একবারও না ফিরে সে গম্ভীর স্বরে বলল,
“ ওটা কি শুধুই আমার বাড়ি? ”
রাহা মুহুর্তেই উত্তর করল,
“ তা নয়,কিন্তু হুট করে এমন জরুরী তলব পড়ল কেন?মানে আমাকে বললে আমি তো কাল সকালেই চলে যেতাম। ”
রোহান টানটান স্বরে জবাব করল এবারে,
“ বাড়ি যাওয়ার জন্য তোমাকে বলতে হবে কেন ? ”
“ না বললে জানব কি করে আমাকে যেতে হবে কি হবে না। ”
রোহান এবারে আচমকায় গাড়ি থামাল রাস্তার এক পাশে। ঘাড় ফিরিয়ে রাহার দিকে তাকাল শক্ত চাহনিতে। পরমুহুর্তেই টানটান গলায় ভ্রু উুঁচিয়ে বলল,
“ তোমাকে কি বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল নবনী? বের করে দিয়ে বলেছিলাম আমি বললে তারপর বাসায় আসবে নয়তো না ? ”
রাহা আচমকা রোহানের রাগ রাগ স্বর দেখে থম মেরে গেল। উত্তরে চুপসানো স্বরে বলে,
“ তেমন নয়। ”
ভ্রু নাচিয়ে শুধায় রোহান,
“ তাহলে? ”
রাহা ছোটশ্বাস ফেলে। যুক্তি সাঁজিয়ে বলে,
“ আমরা আলাদা থাকলে তো একদিক দিয়ে আমাদেরই সুবিধা বলুন? আপনারও অন্য কারোর সাথে কষ্ট করে রুম শেয়ার করতে হচ্ছে না,কষ্ট করে সোফায় ঘুমোতে হচ্ছে না। আমি ও এখানে দিব্যি স্নিগ্ধকে নিয়ে ভালো ছিলাম। স্নিগ্ধ-কে যে ছেড়ে এসেছি এই জন্য এখনই আমার মন খারাপ লাগছে বুঝলেন? আমার আদুরে বাচ্চাটা। শুনুন? আমি কিন্তু কাল আবার চলে যাব৷ আমার কাপড়, জিনিস, এমনকি ফোনটাও তো আনা হলো না। আর এমনিতেও আমি চলে গেলে আপনারই সুবিধা… ”
বাকি টুকু বলার আগেই রোহান শক্ত স্বরে বলে উঠল,
“ সুবিধা অসুবিধার কথা ভাবলে আমি বিয়েটা করতাম না নবনী। আমি কি ছোট বাচ্চা? জানতাম না বিয়েটা হলে মানিয়ে ঘুমোতে হবে, অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে রুম শেয়ার করতে হবে? জেনেশুনে যখন বিয়ে করেছি তখন আমার অসুবিধা হওয়ার তো কথা নয়। নাকি তোমার অসুবিধা হচ্ছে আমার সাথে রুম শেয়ার করতে? ”
রোহানের কন্ঠস্বরে স্পষ্টই টের পাওয়া গেল কোন এক অস্পষ্ট রাগের। রাহা তা বুঝে উঠতে পারল কিনা জানা নেই তবে উত্তরে সঙ্গে সঙ্গেই বলল,
“ মোটেই না। আমার কোন অসুবিধা হয়নি। হলে কি এই কয়েক মাস আমি আপনার সঙ্গে থাকতাম? ”
রোহান ফের পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে,
“ এখন থাকছো না কেন তাহলে? ”
রাহা ফ্যালফ্যাল করে তাকায় এবারে। রোহান এমনভাবে বলছে যেন থাকাটা বাধ্যতামূলক। যেন সত্যিই সত্যিই তাদের মাঝে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক বিদ্যমান। সে স্মিত হেসে বলে,
“ আমার বাচ্চাটার জন্য। স্নিগ্ধ! ওকে আমি অনেক আদর করি। ওর সাথে থাকতে ভালো লাগে আমার। তাছাড়া আমরা তো বিয়ের সময় বলেছিলামই একজন আরেকজনের লাইফে নাক গলাব না।তাই আপনারও এই বিষয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”
রোহান স্বীকার করে না তার সমস্যার কথা, রাগের কথা।এই এক মাস যে সে এই মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করে করে দিন কাঁটিয়েছে তাও বলা হয়ে উঠে না। রোহান মিস করেছে, এই এক মাসে এই মেয়েটাকে সত্যিই সে মিস করেছে খুব করে। কারণ এই মেয়েটাই নিজেকে কয়েকমাসে তার অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছেে।রোহান ছোটশ্বাস ফেলে৷। নিজের সমস্ত অভিযোগ লুকিয় বলে উঠে,
“ আমি বলেছি আমার সমস্যা হচ্ছে? ”
রাহা প্রশ্ন ছুড়ে এবারে,
“ তাহলে নিয়ে যাচ্ছেন কেন আমায়? ”
রোহান আচমকায় নিজের দিকটা আড়াল করতে গিয়ে একটা মিথ্যে বলে ফেলল ,
” আম্মু বলেছে তোমায় নিয়ে যেতে তাই। ”
রাহা সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকায়। একটু আগেই তো কথা হলো রোহানের মায়ের সাথে তার। কিছু তো বলল না। তাহলে? রাহা ভ্রু কুঁচকে নিয়ে বলল,
“ আম্মু বলেছে? ”
রোহান ভ্রু বাঁকিয়ে বলে,
” তো আমি নিজে তোমায় কেন নিয়ে যেতে আসব তাহলে? ”
রাহা তবুও যেন বিশ্বাস করে না। বলে,
“ আম্মুর সাথে তো আমার একটু আগেও কথা হলো। কিছু বলল না কেন? ”
রোহান নিজের দিকটা স্বীকার করল না তখনও। উল্টো নিজের দিক থেকে বেশ কনফিডেন্স দেখাল তাকে। বলল,
“ আমি কি করে জানব? ”
কথাটা বলেই রোহান গাড়ি স্টার্ট দেয়। রাহা তখন বিড়বিড় করে বলে,
“ তাও ঠিক। ”
এরপর রাহা আর রোহানের মাঝে আর কোন কথা হলো না। যতটুকু পথ গাড়ি চলল দুইজনই চুপ থাকল। তারপর রোহান যখন গাড়ি থামাল তখন বাইরে ঝুম ধারার বৃষ্টি।আচমকায় ভারী বর্ষণের আগমণ। রাহা বৃষ্টি দেখে কাঁচ নামাল। বৃষ্টিতে হাত বাড়ায় গাড়িতে বসেই। উচ্ছাসিত স্বরে রোহানকে শুধায়,
“ আপনি কি বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করেন জনাব রোহান ফারাবী? ”
রোহান ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। এই মেয়ে হঠাৎ জনাব জনাব করছে কেন হু?বুঝে উঠে না সে ।তবে পরমুহুর্তেই রাহার আগ্রহতে এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে বলে উঠে,
“ বৃষ্টিতে ভেজা কেবল মেয়েদেরই পছন্দ হতে পারে নবনী।ছেলেদের কাছে এসব বৃষ্টিতে ভেজা টেজা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় এবং বিরক্তিকর।”
রাহা মুহুর্তেই নাক ফুলিয়ে তাকায়। এমন একটা মানুষকে বৃষ্টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাটাই তার ভুল হয়েছে৷ শুধু শুধু বৃষ্টিকে অপমান করল। রাহা নাক ফুলিয়ে উত্তর করে,
“ যে সে মানুষ তো আর বৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারবে না।মূর্খরা তো আরো নয়। ”
রোহান মুহুর্তেই প্রশ্ন ছুড়ল,
“আমি মূর্খ? ”
রাহা সুন্দর করেই উত্তর দিল,
“ অবশ্যই! নয়তো এমন সুন্দর একটা প্রশ্নের এমন বিচ্ছিরি উত্তর আপনি দিতে পারতেন না। আমি আপনাকে সুন্দরভাবে জিজ্ঞেস করেছি, আপনার উচিত ছিল সুন্দর ভাবে উত্তর দেওয়া৷ নয়তো শুধু হ্যাঁ অথবা না বলা। তা নয়, আপনি বৃষ্টিকে অতি তুচ্ছ হিসেবে উপস্থাপন করলেন। ”
রোহান তাকায়। শান্তস্বরে বলে,
“ একেকজনের মত একেক রকম থাকতেই পারে। তোমার কাছে যা মূল্যবান আমার কাছে তা মূল্যহীন হতেই পারে। সবার কাছে তো একটা বস্তু মূল্যবান হতে পারে না। ”
রাহা নাক মুখ ফুলিয়ো তাকায়। উত্তর দেয়,
“ আমার কাছে যেহেতু মূল্যবান আমি এখন বৃষ্টিতে ভিজব, আপনি এখন যান। ”
রোহানের গম্ভীর গলায় উত্তর আসে,
“ মোটেই না, তুমিও এখন আমার সাথেই যাবে। কোন প্রয়োজন নেই বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধানোর। ”
রাহা দৃষ্টি ধারাল করে যেন। বলে উঠে,
“ শর্ত ভাঙ্গছেন। আমার বিষয়ে নাক গলাচ্ছেন আপনি।আমি কিন্তু আপনার বিষয়ে নাক গলাই নি। ”
রোহান এবারে হার মানে। চাইলেই সে জোর করে এখন রাহাকে নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু এতে নিজের দুর্বলতা কিছুটা হলেও প্রকাশ পেয়ে যাবে ভেবে সে বলে,
“ওকে ফাইন। পাঁচ মিনিট পরই ফিরবে। ”
.
সিয়া বহুবার বিছানায় গড়াগড়ি করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। অথচ ঘুম নামে না চোখে। ছটফট করে মেয়েটা৷ যে পুরুষটির জন্য তার এই অস্থিরতা সেই পুরুষটির সাথে কথা বলার ইচ্ছায় সে নিজেকে আর হার মানাতে পারল না। উঠে বসে। জানালার ধারে বসে মোবাইলের স্ক্রিনে সে কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটা খুঁজে নিয়েই সে কল দিল সে ব্যাক্তিকে। মুহুর্তেই কল রিসিভড হয়। সিয়া বুকের ভেতর মুহুর্তেই যেন দ্রিমদ্রিম আওয়াজ উঠে। হৃদস্পন্দন বাড়ে। সিয়ার শ্বাস রোধ হয়ে আসে প্রিয় পুরুষটির কন্ঠস্বর শোনার আগ্রহে। বহু কষ্টে শুধায়,
“ সাদ ভাই? আমি আজ অনেকদিন ঘুমাতে পারি না৷ আজ অনেক দিন আমার মনে শান্তি নেই। অনেকদিন হলো আপনার সাথে আমার দেখা হয় না। একটা বার দেখা দিবেন সাদ ভাইয়া? একটাবার কথা পাঠাবোন? ”
সাদ তখন সিগারেট হাতে বসা। দৃষ্টি অন্ধকার আকাশে। সিয়ার রোধ হওয়া কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বরে কথাগুলো শুনে সে দীর্ঘশ্বাস টানে। বলে,
“ যার প্রতি মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই তার প্রতি মায়া না বাড়ানোই শ্রেয় সিয়া৷ আমার মনে হয় তোমার আমার দেখা না হওয়াটাই ভালো। ”
সিয়ার কান্না আসে এবারে। দম আটাে আসে যেন। যে মানুষ অস্তিত্বে মিশে গেছে তার প্রতি বুঝি মায়া বাড়াবে না সে? মায়া কি তার নিজের হাতে আবদ্ধ নাকি? সিয়া শান্তস্বরে শুধায়,
“ যদি মায়াটা খুব গাঢ় রূপেই জম্মে থাকে? যদি মায়াটা মুঁছতে পারার মতো না হয়ে থাকে?”
উত্তর আসে,
“ তবুও মুুঁছতে হবে। ”
“ সম্ভব নয় সাদ ভাইয়া। ”
সাদ হাসে। আসলেই তো। সম্ভব হয় না তো। যে মায়া নিজে নিজেই জম্মে, এবং অতি গাঢ়তে রূপান্তরিত হয় সেই মায়া তো হাজারো চেয়েও মুঁছে ফেলা যায় না। এই যেমন সাদ। সে কি পেরেছে? পেরেছে রাহার প্রতি অনুভূতি মুঁছে ফেলতে? পেরেছে ঐ রমণীকে ভুলে যেতে? সাদ হাসে। সিয়াকে ভুলানোর চেষ্টা করতে বলল,
“ তুমি জানো আমি একজনকে ভালোবাসি। তোমার এসব পাগলামো সিয়া। ”
সিয়ার চোখ টলমল করে। আরেকটু হলেই কান্না আসবে যেন মেয়েটার। সিয়া চেষ্টা করে কান্না আটকানোর। রোধ হওয়া কন্ঠে বলে,
” আমি তো ভালোবাসা চাইনি সাদ ভাই। একপাক্ষিক ভালোবাসায় চাওয়া-পাওয়া থাকে না।আমারও আপনার প্রতি কোন চাওয়া নেই। শুধু আপনাকে দেখার তৃষ্ণা মেটাতে একটাবার দেখতে চেয়েছি।বেশিকিছু চেয়েছি কি? ভয় নেই, দেখা দিলেও প্রাপ্তির আশা রাখব না আমি। ”
সাদ অন্ধকার আকাশে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়ায়। অতঃপর কিছুটা সময় চুপ থেকে সিয়াকে বুঝানোর ন্যায় বলল,
“ তুমি খুব ভালো মেয়ে সিয়া৷ সব দিক দিয়ে পার্ফেক্ট। আমি আশা রাখি আমার চেয়েও পার্ফেক্ট ছেলেকে তুমি জীবনে পাবে। শুধু শুধু আমার জন্য জীবনের মূল্যবান সময়ের অপচয় করো না। ”
এটুকু বলেই সাদ কল রাখল। এর পরমুহুর্তেই মোবাইলটা বন্ধ করে অবহেলায় ফেলে রাখল। আর সিয়া কেবল ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“ নিষ্ঠুর! আপনি বড্ড নিষ্ঠুে পুরুষ সাদ ভাই।”
#চলবে….