#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_২১
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
আবিরের এ্যাপার্টমেন্টটা সাধারণই।এ্যপার্টমেন্টে দুই দুটো রুম৷এখানে এলিনা, উইলি ওদের বাইরেও তার এক পরিচিত বন্ধুও আছে।যার সাথে তার পরিচিতি কয়েক বছে আগেরই। এবং তার সাথে কথা বলেই আগে থেকে সব গুঁছিয়ে নিতে আবিরের সহজই হলো বেশ। আবির মূলত ছুটিকে তৈরি হতে বলেছিল নিজের এ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই।এমনকি এখন এসেছিল ও সে জন্য। কিন্তু ছুটি তখনও তৈরি হয়নি। আবির যে রূপে নিজের প্রিয়তমা নারীকে নিজের করে নিবে ভেবেছিল সে রূপে মেয়েটা মোটেও তৈরি হয়নি। উল্টো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কেঁদে যাচ্ছে। আবির এক পর্যায়ে ছোটশ্বাস ফেলেই বলে,
“ তৈরি হবি নাকি হবি না? এভাবেই ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থেকে কান্না করবি? আর কতক্ষন ছুটি? ”
ছুটি তখনও ফ্যালফ্যাল করে তাকায়৷ অস্ফুট কন্ঠে বলে,
” আমার অনেক কান্না পাচ্ছে আবির ভা…”
আবির চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাল যেন। মুহুর্তেই গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,
“ ভাই বলবি না। থা’পড়ে দাঁত ফেলে দিব এখন।”
ছুটি ফের ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।আবির ভাই বলাটা তো তার অভ্যাস। বিয়ের পরও যার ফলে সে এই অভ্যাসটা বদলাতে পারেনি। এমনকি এখনও তার মুখে আবির ভাই সম্বোধনটাই আসে বারবার।ছুটি উত্তর দেয়,
“ আপনাকে কি কিছুটা সময় জড়িয়ে ধরতে পারি? আপনাকে অনুভব করতে পারি কিছুটা সময়? ”
আবির সরু দৃষ্টিতে তাকায়। ভ্রুজোড়া শিথিল হয়ে আসে। মনে মনে অনুরোধটা শুনে প্রশান্তি মিললেও উপরে তাকে দেখাল বেশ গম্ভীর, কঠিন। শুধাল,
“পারবি না বললে কি তুই এমনভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবি? ”
ছুটি ওভাবেই জড়িয়ে ধরে মানুষটাকে। দুই হাত দিয়ে আবিরের পিঠ আঁকড়ে ধরে। মাথাটা রাখে আবিরের বুকে। হৃদস্পন্দন শুনে পুরুষটার। অনুভব হয় এই পুরুষটা তার! কেবল তার ! ছুটি সেভাবে হৃদস্পন্দন শুনতে মনোযোগী হয়েই উত্তর দিল,
“ আপনাকে বহুদিন আমি জড়িয়ে ধরিনি। বহুদিন আপনার বুকে মাথা রাখিনি। আপনি না বললেও আমি এখন আপনার নিষেধ মানতে ইচ্ছুক নই। ”
“ বাহ! এভাবে জড়িয়ে ধরে আমায় পাগল করতে চাইছিস নাকি? ”
ছুটি মুখ তুলে তাকায়। কিছুক্ষন চুপ থেকে শান্তস্বরে শুধায়,
“ আপনি নিজেও জানেন না আপনি আমার কতোটা মানসিক শান্তির কারণ। আপনি যেমন আমার মানসিক শার্তি বিনষ্ট করতে পারেন ঠিক তেমন ভাবেই মানসিক শান্তি অর্জনেও আপনিই একমাত্র অবলম্বন আমার। ”
আবির এবারে কিঞ্চিৎ হাসল। মাথা নোয়াল কিছুটা। ছুটির চুলে একটা আলতে চুমু দিয়ে বলে,
“ বোকাপাখি? আমি তোর মানসিক শান্তি কখনোই বিনষ্ট করতে চাইনি। কখনোই না। আমি চেয়েছিলাম তুই সবসময়ই উচ্ছল, হাসিখুশি থাক। ”
.
রাহা পাঁচ মিনিট তো দূর। পুরো আদঘন্টারও বেশি সময় যাবৎ সে বৃষ্টিতেই স্থির দাঁড়িয়ে ভিজছে। দুই হাত বাড়িয়ে রাখা মেয়েটার। রোহান অতি বিরক্তি নিয়েই নিচে এল। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ এই মেয়ের আসার নাম নেই? এই ভেবেই সে নিচে নামল। অথচ নেমেও যখন রাহাকে বৃষ্টিতেই ভিজতে দেখতে পেল তখন সে ছোটশ্বাস ফেলে। আচমকায় দুই পা বাড়িয়ে এই বৃষ্টির মধ্যে গিয়েই দাঁড়াল রাহার সামনে। ভারী আওয়াজে বলে উঠল,
“ পাঁচ মিনিট শেষ হয়েছে নবনী। ”
রাহা হুট করেই চোশ খুলে তাকায়। এতক্ষন চোখ বুঝেই হাত বাড়িয়ে দাঁড়ানো ছিল সে। সে সামনের পুরুষটার দিকে তাকায়। আবছা অন্ধকারে পুরুষটার অবয়ব চিনতে পেরে সে ভ্রু কুঁচকায়। পাঁচ মিনিট? পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে কেউ বৃষ্টিতে ভিজে? বলে সে,
“ তো? ”
রোহান গম্ভীর মুখ করে তাকায়। এই মেয়েটা তাকে অবহেলা করছে? নাকি একটু বেশিই এটিটিউড দেখাচ্ছে? গম্ভীর স্বরে বলে সে,
“পাঁচ মিনিট কি বৃষ্টিতে ভেজার জন্য যথেষ্ট নয়?”
রাহা মুহুর্তেই ছটফট স্বরে উত্তর করে,
“ মোটেই নয়। পাঁচ মিনিট কোন সময়ই নয় মিঃ রোহান ফারাবী। ”
রোহানের চোয়াল অল্প শক্ত হয়ে এল যেন। বুকে দুই হাত গুঁজে কঠিন কন্ঠে বলে,
“ তাহলে কি সারারাত ভিজবে নবনী? ”
রাহা মুহুর্তেই হেসে উত্তর করল,
“ সারারাত? খারাপ হয় না তো সারারাত ভিজলে। ”
রোহান দাঁতে দাঁত চাপে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে তার। বলে উঠে,
“ নবনী..”
রাহা তাকায়। রোহানের দৃষ্টিতে যেন অদৃশ্য রাগ। রাহা শুরু থেকে খেয়াল করছেে।এই লোক শুধু শুধুই তার উপর রাগ ঝাড়তেছে।শুধু শুধুই রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। অথচ রাহা কিছু করেনি। রাহারও রাগ জমে যেন। মুহুর্তেই শুধাল,
“কি হয়েছে? ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? ”
রোহান পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,
“ যাবে কিনা এখনি?”
“ যাব না এখনি। কি করবেন? ”
রোহানের রাগ এবার দৃঢ় হয় যেন। যে রোহান তাকে আনতে অতটুকু গেল, বৃষ্টিতে ভিজে তাকে নিতে আসল রাহার কি উচিত না তার সাথে যাওয়া? অথচ এই মেয়ে ত্যাড়ামো দেখাচ্ছেে।যাবে না বলছে। রোহান ফোঁসফোঁস করতে চায় যেন।শক্তস্বরে বলে,
“ নিয়ে যাব।”
“ কিভাবে?”
রাহার প্রশ্নটা করতে দেরি হলো কিন্তু রোহানের রাহাকে কোলে তুলতে দেরি হলো না।অতঃপর পা বাড়ায় সে নিজ গন্তব্যে। এক বৃষ্টিময় অন্ধকারে এমন এক অপ্রত্যাশিত ঘটনায় রাহার কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত?
.
সিয়ার চোখে পানি। আজও বৃষ্টি বাইরে। আজও মুষলধারে বর্ষণ! সিয়া জানালার ধারে বসে থাকে। আজ টানা কয়েক মাস সে তার প্রিয় পুরুষটির দর্শন পায় নি। আজ কয়েকটা মাস হলো পুরুষটি তাকে ক্রমশ বুঝাচ্ছে তার ভুলে যাওয়া উচিত ঐ পুরুষটিকে। অথচ সিয়া ভুলতে পারে না। সিয়া ভুলতে চায় ও না। সিয়ার বুক ভারী হয়ে আসে। দীর্ঘশ্বাসরা বুকে জমা হয়ে আসে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে মেয়েটার। সিয়া হাতে কলম নেয়। ডায়েরীটা হাতে তুলে লিখতে লাগে,
আজ ভীষণ বর্ষণ সাদ ভাই। আষাঢ়ের বৃষ্টিমুখর রাত। আমি ও কিন্তু আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম কোন এক আষাঢ়ে সাদ ভাই। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। পরণে একটা কালো রং এর ফতুয়া টাইপ শার্ট আর কালো প্যান্ট। বৃষ্টিতে ভিজে চিপচিপে অবস্থায় আপনার তখন নাজেহাল অবস্থা যেন।তবুও চোখের দৃষ্টিতে যেন কতকালের অপেক্ষা! সেদিন বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ো থাকার মাঝেই হুট করেই পাশ দিয়ে চলে গেল একটা গাড়ি। আপনার গায়ে তখন কাঁদার আস্তরণ! ইশশ! কি চুপসানো মুখটা আপনার।একটুও বিরক্তি নেই সেই মুখটায়। গাড়িটার প্রতি একটু বিরূপ মনোভব ও দেখতে পেলাম না। অথচ কি খারাপ অবস্থা। আমার সেই প্রথমই মনে হলো এই ছেলেটা পৃথিবীর সবচাইতে নিষ্পাপ ছেলে। এই ছেলেটা সত্যিই পৃথিবীতে থাকা এক শুদ্ধ মনের মানুষ। আপনি রোজ আসতেন, রোজ দাঁড়াতেন আমাদের বাসার সামনে। তাকিয়ে কি দেখতেন তা আমি জানতাম না।তবে আমার আপনাকে দেখতে ভালো লাগত।আপনার যেমন রোজ রোজ এসে দাঁড়িয়ে থাকাটা অভ্যাস ছিল? তেমনই আপনাকে আড়াল থেকে অবলোকন করা, আড়াল থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাটা আমার অভ্যাসে পরিণত হচ্ছিল ক্রমশ। আমি ক্রমশ আপনার সরলতায় ডুব দিচ্ছিলাম। হারিয়ে যাচ্ছিলাম আপনার মায়ার গভীরতায়। আপনি বোধহয় বুঝতেও পারেননি আপনাকে আড়াল থেকে একটা মেয়ে কতোটা চোখে চোখে রাখত। কতোটা কষ্ট হতো তার যখন চুপচাপ সব মেনে নিতেন আপনি নিরীহ চাহনিতে। কতোটা খুশি হতো সে যখন আপনার মুখে হাসি ফুটত। সাদ ভাই? পড়ানোর উদ্দেশ্যে হলেও যখন আমি আপনার সান্নিধ্য পেলাম আমি তখন আমি আড়াল থেকে পর্যবেক্ষণ করাটা বাদ দিলাম। অনুভূতির সজীবতায় নিজেকে একটু সাহসী ভেবে এবার শুরু করলাম সামনাসামনিই অবলোকন করা৷ সম্ভবত আপনি বিষয়টা বুঝে ফেলেছেন তখনই। আচ্ছা? আমার কি খুব বেশিই অন্যায় হয়েছে আপনার মায়াতে গা ভাসানো? খুব বেশি অন্যায় করেছি আপনাকে ভালোবেসে? কেন এত অবহেলা সাদ ভাই? আমি তো বিনিময়ে ভালোবাসা চাই নি। আমি চাই নি তো আপনার কাছে অনুভূতির মূল্য। তবুও কেন এতোটা এড়িয়ে চলেন? আমার যে কষ্ট হয়৷ কী ভীষণ যন্ত্রনায় আমি ছটফট করি! দম বন্ধ হয়ে আসে ।অথচ শ্বাসরুদ্ধকর সে কষ্টের মুহুর্তে ও আমি প্রত্যাশা রাখি পরমুহুর্তে যদি আপনার দেখা পাই একটাবার,যদি একটাবার আপনার কন্ঠস্বর শুনতে পাই!
#চলবে…
#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_২২
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
রাহার শরীরটা ভিজে চুপসে গেছে। শরীরের ভাজ স্পষ্ট ঠেকে জামার উপরেই৷ এতক্ষন আঁধারে তা সুস্পষ্ট বুঝা না গেলেও যখনই বাসার আলোতে রাহার শরীরে চোখ পড়ল তখনই এক মুহুর্তে রোহান কোল ছেড়ে নামাল রাহাকে। অতঃপর দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেল নিজ রুমে। রাহা এই আচরণের আগা-মাথা কিছুই বুঝে উঠল না। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে সর্বপ্রথম গেল রোহানের মায়ের কাছে। সে ভেজা শরীরেই! বেশ কিছুটা সময় গল্পগুজব করে ফিরে এল রুমে। আজ এক মাস পর এই রুমটাতে এসেই সে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। রুমে এককোণায় পড়ে থাকা সোফাটা নেই শুধু। বাকিসব ঠিক আছে। রাহা ভ্রু কুঁচকে যখনই জিজ্ঞেস করবে ঠিক তখনই রোহানকে চোখে পড়ল খালি শরীরে। পরনে কেবল একটা তোয়ালে। বুঝা যাচ্ছে মাত্রই শাওয়ার নিয়েছে। পুরুষটার লোমবিহীন বক্ষে ফোঁটাফোঁটা পানি।ভেজা চুলগুলো যখন নুঁইয়ে কপালে পড়েছে তখন এই ছেলেটার প্রতি আকর্ষণ বহুগুণ বাড়ে যেন আরো। রাহা মুহুর্তেই উঁশখুঁশ করতে করতে নজর সরাল। কি বলবে আর মাথাতেই এল না। রোহান ততক্ষনে টিশার্ট জড়িয়ে নিয়েছে শরীরে। হাতে টাউজার নিতে নিতে রাহাকে উদ্দেশ্য করে গমগমে স্বরে বলে উঠল,
“ এতক্ষন ভেজা শরীরে কি করছিলে? পরে জ্বর বাঁধালে? ”
রাহা ফ্যালফ্যাল আবারও তাকায় রোহানের দিকে। মনে মনে বলে উঠে, সুন্দর দেখাচ্ছে পুরুষটাকে।পরমুহুর্তেই উচ্ছাস নিয়ে হাসে। বলে উঠে,
“ আম্মুকে বলছিলাম কাল সকালে আবার চলে যাব। কয়েকমাস থেকে আবার আসব আপনাদের বাড়িতে। অবশ্য মাঝে মধ্যে একদিন একদিন এসে আম্মুকে দেখে চলে যাব, কি বলুন? আজকে আমার বাচ্চাটাকে রেখে চলে এসেছি আপনার জন্য। কত্ত মন খারাপ করবে আমার বাচ্চাটা। ”
রোহানের মেজাজ খারাপ লাগে। কয়েক মাস থেকে যাবে বলাতেউ তো এই মেয়েকে সে ধরেবেঁধে নিয়ে আসল। রোজ রোজ জ্বালাতন করে নিজেকে রোহানের অভ্যাসে পরিণত করল আর এখন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াবে? রোহানের যে অস্থিরতা কাজ করে তা কাকে বুঝাবে? রোহান ছোট শ্বাস টানে। ভ্রু উঁচু করে শুধায়,
“ তোমার বাচ্চা? ”
রাহা উত্তর করল,
“ মানে বায়োলজিক্যালি নয়। বায়োলজিক্যালি মা হতে তো আপনি মত দিলেন না মিঃ রোহান ফারাবী। তবে বায়োলজিক্যলি না হলেও মন থেকে স্নিগ্ধ আমার বাচ্চাই। কি কিউট!। ”
রোহানের মাথা ডুকল সর্বপ্রথম এই কথাটাই যে সে রাহাকে মা হতে সাহায্য করেনি বলেই, বা বাচ্চা পায়নি বলেই এখন হয়তো একটা বাচ্চাকে আদর করার জন্য ঐ বাড়িতে থাকতে চাইছে। রোহান শুধাল,
“ তুমি বাচ্চার জন্য ও বাড়িতে পড়ে আছো?”
পড়ে আছে? পড়ে থাকবে কেন সে? রাহা মুহুর্তেই বলে উঠল,
“ কি আশ্চর্য! আপনি বিষয়টাকে এভাবে দেখছেন কেন। পড়ে থাকব কেন আমি।আমি তো এর আগেও ও বিল্ডিংয়েই থাকতাম আপুর সাথে। ”
“ জানি আমি। ”
“ তো? ”
“ কিছু নয়। ”
রাহা এই পর্যায়ে চুপ থেকে যায়। রোহানও আর উত্তর করে না। তারপর একটা সময় পর রাহার হঠাৎই মনে পড়ে যে সোফাটার বিষয়ে তো জিজ্ঞেস করা হয়নি। রাহা আর প্রশ্নটা দমিয়ে রাখতে পারল না। মুহুর্তে বলে উঠল,
“সোফাটা নেই কেন? কি করেছেন ওটাকে?”
রোহান জবাব দেয় গম্ভীর গলায়,
“ফেলে দিয়েছি।”
“ কেন?”
এবারেও গম্ভীর স্বরে উত্তর আসে,
“ প্রয়োজন দেখছি না ওটার। ”
রাহা এই কথাটা মানতে পারল না। মুহুর্তেই বলে উঠল,
” প্রয়োজন দেখছেন না মানে কি? ওটা কতোটা প্রয়োজনীয় ধারণা আছে আপনার?বিশেষ করে আপনার জন্য। একটা মেয়ের সাথে তো আপনি একই খাটে মানাতে পারবেন না। কি আশ্চর্য! ”
“ সেটা আমি বুঝে নিব। ”
“ তার মানে আপনার এখন একই খাটে ঘুমাতে অসুবিধা হবে না?”
রোহানের মুখ তখনও গম্ভীর! এই মেয়ে এত প্রশ্ন করে কেন? কেন? সে সেভাবে গম্ভীর থেকেই বলল,
“ হওয়ার তো কথা নয়। ”
রাহা মুহুর্তেই প্রতিবাদ স্বরূপ বলে উঠল,
“ কেন কথা নয়? আপনি আপুকে ভালোবাসেন। আমি এটা মানব না। কোনকালেই না৷”
“ না মানলে কিছু করার নেই। ”
রাহা এই পর্যায়েও প্রতিবাদ স্বরূপ জানাল,
“ আপনার কথা যে আমি মেনে নিই? আর আমার বেলায় না মানলে কিছু করার নেই?এসব কি ধরণের অন্যায়? আশ্চর্য! বিয়ের রাতে কত বড়বড় কথা৷ বিয়ের আগে এত শক্তপোক্ত চুক্তি!সব এখন কোথায় হুহ? ”
রোহানের এই পর্যায়ে এই বাচাল মেয়েটির মুখ আঠা দিয়ে বন্ধ করে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু পারল না।গম্ভীর মুখেই বলল,
“ বোধহয় মিসিং। খুঁজে পাচ্ছি না কোথায় চুক্তিগুলো। ”
গম্ভীর মুখে এমনভাবে কথাগুলো বলল যেন কোন সিরিয়াস কথা সে বলে ফেলেছে৷ রাহা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে,
“ মশকারা করছেন? ”
রোহান এবারেও হাসে না। মুখ গম্ভীর রেখে আগের মতোই বলে,
“ একদম নয়। মশকারা করে আমার লাভ কি ? ”
রাহা এই পর্যায়ে ছোটশ্বাস ফেলে। চকচকে চাহনিতে তাকিয়ে বলে,
“ আপনি কি কোন ভাবে সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন মিঃ রোহান ফারাবী? অবশ্য এমন হলে আমি সত্যিই চুক্তি ভেঙ্গে দেখতে পারি। ”
রোহান এই পর্যায়ে বিরক্তি নিয়ে তাকাল। কে বলেছিল তাকে শর্ত স্থির করে বিয়ে করতে? এই মেয়ে যে এভাবে সারাজীবন চুক্তি চুক্তি করবে না তার কি নিশ্চায়তা? রোহান বিরক্ত নিয়েই বলল,
“ সবসময় চুক্তি চুক্তি করো কেন? চুক্তিতে তো এটাও ছিল না তুমি মা হতে চাও। তোমার বাচ্চা লাগবে। বাচ্চার জন্য তুমি অন্যের বাড়িতে মাসের পর মাস থাকবে। তাই না? ”
“ স্নিগ্ধকে আমার মায়া লাগে। তাই থাকব। সমস্যা কি?”
“ আমারও লেগেছিল, তাই বলে কি আমি থেকে গেছি ওখানে মাস কয়েক? ”
রাহা উত্তর দেয়,
“ মাস কয়েক তো থাকিনি। শুধু একমাস। ”
রোহান আচমকাই প্রশ্ন ছুড়ল,
“ একটা বাচ্চা থাকলে তো আর যাবে না তাই না? ”
“ জ্বী ? ”
নিজের মুখ দিয়ে এই প্রশ্নটা যে এভাবে বেরিয়ে যাবে তা বোধহয় রোহান নিজেই বুঝে উঠে নি। রোহান এবার নিজেই প্রসঙ্গ বদলাতে বলর উঠল,
“ নাথিং! ফ্রেশ হয়ে কাপড় বদলে এসো। ”
.
স্বচ্ছর কোলে তার ছোট্ট বাচ্চাটা। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে তার দিকে। কিছুটা সময় আগেই সুহার কাছে ছিল। তারপর সিয়ার কোলে! এবং অবশেষে স্বচ্ছর কোলে এসে সে একদম শান্ত বাচ্চার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। স্বচ্ছ হাসে ছেলের এমন চাহনি দেখে। শ্যামলা মুখটা কি মায়াবী! স্বচ্ছ মুখটা নামিয়ে স্নিগ্ধর মুখে চুমু খায়। ফিসফিস স্বরে বলে,
“ তোর আম্মু কি রান্না করছে আব্বু? চল একটু জ্বালিয়ে আসি। ”
স্নিগ্ধ আগের মতোই গম্ভীর গম্ভীর ভাব ধরে তাকিয়ে থাকল বাবার দিকে। অতঃপর হুট করে একহাতে মুঠো করতে চাইল স্বচ্ছর মুখের দাঁড়িগুলো। আলতো আদুরে হাতে যখন মুঠো করতে পারল না তা তখন দুই আঙ্গুলে চিমটির ন্যায় তা ধরতে চাইল। অতঃপর চিমটি বসালও। স্বচ্ছ তখন ছেলের দিকে তাকায় হতাশ চোখে। শুধায়,
“ বললাম তোর মাকে জ্বালাব, আর তুই আমার দাঁড়ি ধরে টানছিস বাপ? মাকে না জ্বালানোর জন্য? একদম মা ভক্ত না? ”
স্নিগ্ধ সেবারেও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ঝাপটে বাবার ঘাড় জড়িয়ে ধরে। নরম তুলতুলে হাতজোড়া যখন ঘাড় অব্দি গেল এবং ছোট্ট শরীরটা যখন বুক ঝাপটে বসে থাকে স্বচ্ছ তখন প্রশান্তির শ্বাস ফেলে। হয়তো বিধাতা তার জন্য তার মেয়েকে রাখেননি, তবে এই যে তার ছেলে? একদম শান্ত, গম্ভীর একটা বাচ্চা! তাকে পেলেই তার হৃদয় শান্ত হয়ে যায়। আদুরে অনুভূতিতে মন প্রাণ ভরে উঠে। স্বচ্ছ তা ভেবে হাসে। ছেলেকে সেভাবে কোলে তুলেই হাঁটা ধরে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যর। অতঃপর সেখানে এসেই দেখা মিলে সুহার। চুলায় চা বসিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছে যেন। স্বচ্ছ পরখ করে। কিছুটা সময় যাওয়ার পর ডাকে হঠাৎ,
“ সুহাসিনী? কিছু ভাবছো? ”
সুহার ধ্যান ভাঙ্গে যেন। হুট করে সতর্ক হয়ে চুলার আগুন নেভায়। বলে,
“ তেমন কিছু নয় স্বচ্ছ।”
স্বচ্ছ তবুও বলে,
” ভাবছিলে। ”
সুহা তাকাল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানাল,
“ ভয় হয় স্বচ্ছ। তিহান যদি আবারও কিছু করে আড়াল থেকে? আমার স্নিগ্ধটা আমার খুব আদরের স্বচ্ছ! ”
স্বচ্ছ এবারে হাসে। ছেলেকে নিয়ে সেভাবে এগিয়ে এসেই সুহাকে জড়িয়ে ধরে। বলে,
” আমি আছি তো সুহাসিনী। এটুকু ভরসা কি আমার উপর করা যায় না ? ”
” কে বলল করিনি? ”
“ আমার থেকে আর দূরে সরো না সুহাসিনী।”
সুহা টলমল চোখে তাকায়। এই পুরুষটার প্রতি কতোটা অবহেলা সে দেখিয়েছিল। এই পুরুষটাকে সর্বদা দূরে দূরে রাখত। কতোটা কষ্ট সে দিয়েছিল এই পুরুষটাকে। অথচ এই পুরুষটা তার থেকে এইটুকুও দূরে সরে নি। এইটুকুও অবহেলা করেনি কোনদিন। সুহা শুধায়,
“ দূরে সরার সুযোগ তো মিলে নি। আপনি তো দূরে সরতে দেননি স্বচ্ছ। ”
সুহা কথাটা বলতে দেরি হলো কিন্তু স্নিগ্ধর ছটফট করে স্বচ্ছর বুকে নিজের অতি গুরুত্বপূর্ণ কার্যটা সম্পন্ন করতে। স্বচ্ছ বুক পেটে তরল এবং উষ্ণ কিছু অনুভব করেই তাকায় ফ্যালফ্যাল করে৷ মুহুর্তেই নিজের টিশার্ট টাউজার ভেজা দেখে বুঝে উঠতে পারে কি হয়ে গেল৷ সে একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে পরমুহুর্তেই সুহার দিকে চেয়ে বলে উঠল,
“ স্নিগ্ধ এই প্রথম আমার কোলে থেকে আমার জামা কাপড় ভিজিয়ে দিয়েছে সুহাসিনী। ”
সুহা বুঝে উঠে না প্রথমে। পরমুহুর্তেই প্রশ্ন ছুড়ে,
“ ভিজিয়ে দিয়েছে মানে? ”
স্বচ্ছ দেখিয়ে বলে উঠে,
“ দেখে নাও। ”
কথাটা বলেই আবার স্নিগ্ধর দিকে তাকাল। দুই হাত বাড়িয়ে ধরে সে। কপালে কপাল মিলায়। অতঃপর বলে,
“ ভেরি গুড আব্বু। তুমি এতকাল আব্বুকে তেমন জ্বালাওনি।কিন্তু তাই বলে আজ আব্বুকে হি’সু করার জায়গা মনে করে বসবে?এমনটা করতে পারলি বাপ? ”
সুহা ততক্ষনে হেসে ফেলেছে খিলখিল করে। হাসতে হাসতে যেন পেট ফেটে যাবে এমন ভাবেই সে বলে উঠল,
“ যাক! একবার হলেও এই কার্যটা সে সম্পন্ন করল। ”
স্বচ্ছ তখন মুগ্ধ চোখে নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে। আজ কতকাল পর সুহা এভাবে প্রাণ খুলে হাসছে? আজ কতকাল পর সে তার বউকে এভাবে খিলখিলিয়ে হাসতে দেখেছে সে নিজেও জানে না বোধহয়। সব রং তো প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল তার জীবন থেকে। এই স্নিগ্ধটা! এই স্নিগ্ধটা না থাকলে সে তার জীবনের রং ফিরেই পেত না হয়তো!
.
সিয়া সকাল সকাল বের হয়েছে অজানা গন্তব্যে৷ অতঃপর পা চালিয়ে হাঁটতে লাগল নিজের মতো করেই। আজকাল কিছুই ভালো লাগে না তার। কিছুই না। ছটফট লাগে। অস্থির লাগে। তীব্র এক অস্থিরতা তার মনে ঘুরে বেড়ায় সর্বক্ষণ। সিয়ার কান্না পায় মাঝেমাঝে। এমনটা তার সাথেই কেন হলো? এমন এক পুরুষকে সে মন দিয়ে ফেলেছে যে হয়তো তাকে নিয়ে কোনদিনও ভাববে না। সিয়া জানে সাদ কি অসম্ভব রকম ভালোবাসে রাহাকে। সে ভালোবাসার আংশিকও যে তার কপালে জুটবে না তা বেধহয় সিয়া নিশ্চিত৷ তাইতো ভালোবাসা পাবার আশা সে কোনকালেই রাখে নি। কোনকালেই সাদের থেকে পাল্টা অনুভূতি পেতে সে চায়নি। শুধু একটু দেখা, একটু কথন চেয়েছিল। খুব বেশি তো নয়৷ এই পুরুষটার সাথে কথা না বললে যে তার কি অসম্ভব রকম ছটফট ছটফপ লাগে তা যদি সে একটিবার বুঝত। সিয়া ছোটশ্বাস ফেলে। আধঘন্টা যাবৎ পথে পথে হাঁটতে হাঁটতে হুট করে সিদ্ধান্ত নিল সাদের কাছে যাবে। সাদ একমাস হলো একটা ব্যাচেলর বাসায় উঠেছে নতুন করে। তাও সিয়াদের এখন থেকে বেশ কিছুটা দূরেই বলতে গেলে। এদিকের সব টিউশনি গুলোও ছেড়ে দিয়েছে। চাইলেও আজকাল সাদের দেখা পাওয়া দুর্লভ। সিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রিক্সা খুঁজে ঠিকানা বলল। অতঃপর রিক্সা চলতে লাগল সে গন্তব্যে। সিয়া মূর্তির ন্যায় বসে থাকে পুরোটা সময়। কেমন যেন গম্ভীর এক ভাবসাব তার মুখেচোখে। রিক্সা যখন গন্তব্যে এসে পৌঁছাল তখন সে নেমে ভাড়া মিটাল। অতঃপর সাদের যে ঠিকানাটা সে সুহাে থেকে পেয়েছিল সে ঠিকানা অনুযায়ী ঐ বিল্ডিংটায় গেল। পা বাড়িয়ে দোতালায় গিয়ে কোন দরজায় কড়া নাড়বে বুঝ উঠে না। তিন তিনটা বাসা৷ এখানে ব্যাচেলরটা কোনটাতে থাকে সে তে জানে না। অনেকক্ষন ভেবে সে বাম দিকে দরজাটাতেই সর্বপ্রথম টোকা দেয়। অতঃপর দরজা খুলে এক হ্যাংলাপাতলা যুবক।গলায় এখনও তোয়ালে ঝুলছে। মুখে এখন ব্রাশ। বোধহয় গোসলে যাচ্ছিল। সিয়া ছোটছোট চোখে তাকিয়ে বলল,
“ এটা ব্যাচেলরদের বাসাটা? ”
ছেলেটা সাতসকালে সুন্দরী যুবতী মেয়ে দেখে উৎসুক হয়ে তাকাল। উচ্ছাস নিয়ে বলল,
“ হ্যাঁ, হ্যাঁ। কেন?”
সিয়া ছেলেটার উৎসাহে আগ্রহ দেখাল না। গম্ভীর গলায় বলল,
“ আপনার রুমমেট কোথায় ভাইয়া? ”
ছেলেটা হতাশ হলো। দাঁতে ব্রাশ চালাতে চালাতে বলল,
“ সোজা ভাইয়া?”
সিয়া যা জানতে চাইল তার উত্তর না দেওয়াতে অসন্তোষ নিয়ে চাইল সে। বলল,
“ আপনার রুমমেইট কি বাসায় আছে? থাকলে একটু ডেকে দিন। ”
ছেলেটা কপাল কুঁচকেই তাকাল। মেয়েটা বড্ড বেরসিক। একটা সুন্দর ছেলে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটু হাসতে টাসতে পারে নাকি?কিন্তু কেমন যেন গম্ভীর গম্ভীর জবাব। ছেলেটা এবার বলল,
“কার কথা বলছো মেয়ে? ”
অপরিচিত একটা মেয়েকে তুমি বলাতে যদি সিয়া একটু বিরক্তই হলো তবুও শুধাল,
“ সাদ ভাই। চিনেন? ”
ছেলেটা গদগদ হয়ে উত্তর করল,
“ হু। কিন্তু ও তো এই সময় বাসায় থাকে না। তুমি বরং রুমে এসে বসো। ”
“ এই সময়ে কোথায় থাকে? ”
“ সে তো আমি জানি না। থাকে কোথাও। বলে তো যায় না। তুমি এসো, বসতে পারো কিছুটা সময়। ”
সিয়া কপাল কুঁচকে তাকায়। একা একটা ব্যাচেলর বাসায় বসাটা কতোটা অযৌক্তিক তা সে জানে। ছেলেটা কি জানে না? শক্তস্বরে বলে,
“ না। ”
ছেলেটা হাসে। সিয়ার দিকে যেন কেমন করে তাকায়। ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলে,
“ আচ্ছা। তোমার চোখজোড়া কিন্তু খুব মায়াবী। তোমার নামটা কি জানা যাবে? ”
সিয়ার বিরক্ত লাগে এবার এই ছেলেটা। দৃষ্টিও ভালো লাগে না। শক্ত গলায় বলে,
“ না। ”
ছেলেটা এবারেও হেসে বলে,
“ যায়হোক তোমার নামটাও নিশ্চয় তোমার মতোই সুন্দর হবে। ”
সিয়া চলে যাওয়ার জন্য বলে,
“ আসছি আজ। ”
“ এই না, কিছুক্ষণ থেকে যাও না। সাদ চলে আসবে হয়তো এক্ষুনি। ”
“ আপনাদের বাসার নিচে অপেক্ষা করব, আসলে দেখা হয়ে যাবে ওখানে। ”
এটুকু বলে যখন চলে যাওয়ার জন্য পিছু ঘুরতে নিবে ঠিক তখনই এক পুরুষালি কন্ঠ কানে এল,
“সিয়া? তুমি এখানে? ”
সাদ এসেছে আরেকটু আগেই। এতক্ষন তার রুমম্যাট আর সিয়ার কথোপকোতন শুনছিল। সাথে ছেলেটার চোখের দৃষ্টি। সাদের মেজাজ খারাপ লাগে। কে বলেছিল মেয়েটাকে এখানে আসতে? জানে না ব্যাচেলর বাসায় ছেলেপুলে থাকবে? সিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়৷ সাদকে দেখেই নিরব চাহনি ফেলে। অতঃপর শুধায়,
“ হ্যাঁ, আপনার সাথে দেখা করতে এলাম। কেমন আছেন সাদ ভাই? ”
সাদ উত্তর দিল। শুধু মুখ টানটান করে তাকায় সিয়ার দিকে। ততক্ষনে সাদের রুমম্যাটটা এসে দাঁড়াল তার পাশে। একটা হাসি দিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে সাদকে ইশারা দিয়ে বলল,
“ কে মামা? গার্লফ্রেন্ড নাকি? দেখতে কিন্তু মিষ্টি! ”
সাদ এই কথাটার উত্তর করল না। তাকাল ও না ছেলেটার দিকে। শুধু টানটান স্বরে সিয়াকে বলে,
“তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি। বাসায় যাবে এক্ষুনি। ”
সিয়ার যেতে ইচ্ছে হয় না। প্রিয় পুরুষটাকে বহুদিন পর দেখার সুযোগ মিলেছেে।বহুদিন পর!এত তাড়াতাড়ি যেতে ইচ্ছে হয়?বলে,
“আরেকটু থাকি? আপনাকে দেখি না বহুদিন।”
সাদ এই পর্যায়েও রুক্ষ্ম স্বরে জবাব দেয়,
“আমাকে দেখাটা গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় নয়।”
সিয়ার চোখ টলমল করে এবারে। সাদের দিকে অভিমানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই তাকায়। বলে,
“ সাদ ভাই? ”
সাদ চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাল যেন। ধমক স্বরূপ বলে,
“ বললাম না বাসায় যেতে? কথা কি কানে নাও না তুমি? ”
সিয়ার সত্যিই এবার যেন কান্না পেয়ে যাবেে।কিন্তু নিজেকে স্থির করে বলল,
“ যাচ্ছি। ”
এটুকু বলে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামল সে। মনে মনে শুধু শুধাল, “নিষ্ঠুর! আপনি বড্ড নিষ্ঠুর সাদ ভাই।”
#চলবে…
#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_২৩
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
সাদ যখন গম্ভীর মুখে সেভাবেই সিয়ার চলে যাওয়া দেখছিল তখনই তার রুমম্যাটটা একদম তার পাশে এসে দাঁড়াল। মুখে একগাধা রসিকতা। দৃষ্টিও বুঝাচ্ছে খুব একটা সুবিধার লোক সে নয়। ছেলেটা সাদকে হাতের কনুই দিয়ে ইঙ্গিত করল। ভ্রু নাচিয়ে বড্ড রসিকতা নিয়ে বলল,
“ কে মামা? বললে না তো। ”
সাদের এমনিতেই এই ছেলেটার উপর র্গ জমেছে সিয়ার প্রতি এই ছেলের তখনকার দৃষ্টি দেখে। ফের প্রশ্ন করাতে ইচ্ছে হলো দুই গালে দুটো থাপ্পড় দিক। কিন্তু ভদ্রতা জ্ঞানে পারল না। শুধু শক্তস্বরে উত্তর করল,
“ স্টুডেন্ট। ”
ছেলেটা যেন বিশ্বাস করল না। পুণরায় শুধাল,
“ শুধু স্টুডেন্ট? কই? স্যার ট্যার তো কিছু বলল না। ”
এবারে সাদ ছোটশ্বাস ফেলে। জানায়,
“ বন্ধুর ননদ ও হয়, এই কারণে সাদ ভাই ডাকে।”
ছেলেটা এবার হাসল কেমন করে। বলল,
“ আর কিছুই নয়? ”
“ না। ”
ছেলেটা বড্ড আগ্রহ নিয়ে এবারে বলে উঠল,
“ তাহলে আমার সাথে কিছু করে দাও না। সুন্দর তো দেখতে মেয়েটা। আর কতকাল একা থাকব বলো? ”
সাদের সত্যিই এই পর্যায়ে রাগে নাক মুখ লাল হয়ে আসে। ছেলেটার প্রতি রাগ দেখাতে না পেরে সব জমা হয় সিয়ার প্রতি। ওকে কে বলেছিল একা একা একটা ব্যাচেলর বাসায় চলে আসতে? কে বলেছিল? বেশি বড় হয়ে গিয়েছে সে?সে গম্ভীর গলায় উত্তর করল,
“ আমি একটু আসছি। ”
অতঃপর পা বাড়াল। ধুপধাপ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। তারপর পা চালিয়ে গেইট পেরুতেই দেখা মিলল সিয়ার। দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো রিক্সার জন্যই। সাদও গিয়ে দাঁড়াল তার পিছনেই। সিয়া হয়তো খেয়াল করল না। তবে অনেকটা সময় পর যখন একটার রিক্সার দেখা মিলল তখনই সে গলা উঁচিয়ে বলল,
“ এই মামা? যাবেন? ”
রিক্সাটা সাদের ইশারা পেয়ে সামনে এসে দাঁড়াল৷ সিয়া ততক্ষনে কন্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকিয়েছে। চোখের দৃষ্টিতে অভিমান তার। সাদ সেসব পরোয়া করল না যেন। গম্ভীর গলায় জানাল,
“ উঠো। ”
সিয়া উঠল না। তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। একটু আগেই তাড়িয়ে দিয়েছে। আর এখন ভদ্রতা দেখাচ্ছে? সিয়া যখন নিশ্চুপ তখন সাদ আবারও বলল,
“ কি হলো? উঠো রিক্সায়। ”
সিয়া শান্ত গলায় জানাল,
“ উঠব না। ”
“ কি করবে তাহলে? ”
“ এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব। এই রাস্তা তো আর আপনার বাসার আওতায় পড়ে না তাই না?তাই এখান থেকে তাড়ানোর অধিকার ও আপনার নেই। ”
সাদ এই পর্যায়ে রক্তিম চোখজোড়া নিয়ে তাকাল সিয়ার দিকে। এমনিতেই রাগ হচ্ছে তার। অযথাই রাগ হচ্ছে। সিয়া কি বুঝতে পারছে না? তবুও রাগ বাড়াচ্ছে কেন? সাদ গলা শক্ত করে বলল,
“ রিক্সায় উঠে বাসায় গিয়ে কল করে জানাবে। আর যদি না উঠো তবে তোমার সাথে আজকের পর আমার আর কোন যোগাযোগ হবে না সিয়া। ”
সিয়ার চোখ টলমল করল কেমন। তবে নিজেকে সামলে নিতে পারল সে। বলল,
“ আপনি আমার দুর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছেন?”
“ লাগালাম। ”
সিয়ার অভিমান তখন আরো গাঢ় হয়। ধীরগতিতে রিক্সায় উঠে বসল সে। জানাল,
“ আপনি খব নিষ্ঠুর সাদ ভাই! খুব নিষ্ঠুর! ”
সাদ বিনিময়ে শুধায়,
“ আর কখনো এখানে আসবে না। কথাটা মনে থাকে যেন হুহ?”
সিয়া উত্তর করে না। অভিমান জমে জমে পাহাড়সম অভিমান তার মনেতে জমা হয়েছে।সাদ কি তা জানে?বুঝে? কতোটা কষ্ট এই মেয়েটা বুকে আগলে রেখেছে?
.
রোহানের হাতে এক প্ল্যাট খাবার। রাহা ততক্ষনে গোসল সেরে এসেছে।চুলগুলো ভেজা তার। পরনে একটা সুতির গোল জামা। রোহান সেদিক পানে তাকিয়েই রাহার স্নিগ্ধ মুখখানক দুয়েক সেকেন্ড পরখ করে। অতঃপর খাবারের প্ল্যাটটারেখে বলে,
“ খেয়ে নাও। আম্মু পাঠিয়েছে।”
রাহা তাকাল। হুট করেই মাথা ধরেছে তার। চোখ জ্বালা করছে। শরীরটাও উষ্ণ অনুভব হচ্ছে। বুঝে উঠে না জ্বর নেমেছে কিনা। তবুও এগিয়ে এল। বলল,
“ আপনি? ”
“ খেয়ে নিয়েছি। ”
এরপর আর কথা হলো না। রাহা খাবার প্ল্যাট নিতে নিতেই রোহান বিছানার এককোণ দখল করে শুঁয়ে পড়েছে। রাহা তা দেখে। খাওয়ার চেষ্টা করে। অথচ তেমন একটা খেতে সে পারল না। বুঝতে পারল বৃষ্টিতে ভেজার ফল ইতোমধ্যেই শরীরে দেখা দিয়েছে। সে সরু শ্বাস টেনে বিছানার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। প্রায় অর্ধেকটা রোহানের দখলে। বাকি অর্ধেকটা রাহার জন্য রাখা হয়েছে৷ কিন্তু তবুও রাহার সংকোচ হয়ে৷ যদি গড়িয়ে ঐ পুরুষের উপর গিয়ে পড়ে? কিংবা হাত পা তুলে দেয়? রাহা উশখুঁশ করে৷ রোহান ততক্ষনে সরু চোখে তাকিয়েছে৷ রাহাকে এমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
“ কি সমস্যা? এমন করছো কেন? ”
রাহা ছটফট বলল,
” আপনি আরও ওপাশে যান। ঘুমাব। ”
রোহান বাকি অর্ধেকটা খালি জায়গা পরখ করল। বলা যায় তার চাইতেও বেশি জায়গা। বলল,
“ এটুকু কি যথেষ্ট নয়? ”
রাহা উত্তর করল,
”না, যথেষ্ট নয়। দেখা গেল ঘুমের মধ্যে আমি আপনার শরীরে হাত পা তুলে দিলাম। তখন আপনি ও বিরক্ত হবেন। ”
রোহানের হাসি পায় এবারে। তবুও হাসে না। শুধায়,
“ যদি বিরক্ত না হই?”
“ তবুও আমার অস্বস্তি হবে।আপনি আরো ওদিক চেপে যান। ”
রোহান ছোটশ্বাস টানে। অতঃপর আরো এদিকে চেপে আসে। বলে,
“ এবার হবে? ঘুমাও। অনেক রাত হয়েছে। ”
রাহা মাথা নাড়ায়। একপাশে শুঁয়ে চোখ বুঝে। আর রোহান সেই চোখ বুঝার মুহুর্তটাই পরখ করে। বাচ্চা বাচ্চা দেখাচ্ছে। মনে মনে আওড়ায়, মেয়েটা আসলেই খুব একটা খারাপ হবে না বউ হিসেবে। এই যে অল্প সময়েই তার মনে অনুভূতি জাগিয়ে দিল এটাই তো তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হয়ে ঠেকছে এখন।
.
আধঘন্টা যাবৎ ছুটিরা আবিরের অ্যাপার্টম্যান্টটায় পৌঁছেছে। আবির পকেটে হাত রেখে সে কখন থেকেই তাকিয়ে আছে ছুটির দিকে। ছুটির ধ্যান জ্ঞান তখন তার রুমের দিকে। এপাশ ওপাশ তাকাতে তাকাতে সে বলল,
“ কবে আসলেন এখানে?”
আবির এতোটা সময় পর এমন একটা প্রশ্ন পেয়ে অসন্তোষ দৃষ্টিতে তাকায়৷ মুখে উত্তর দেয়,
” অবশ্যই আজ।”
ছুটি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
” এরমধ্যে সব ঠিকঠাক? ”
” এর আগেই সব ঠিকঠাক। তোর বন্ধুবান্ধব, আমার পরিচিত এক বন্ধু। সব মিলিয়ে আমার অসুবিধা হয়নি কিছুতেই। ”
ছুটি এতক্ষন একটা রুমেই অবস্থান করেছে। অপর রুমটা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে সে রুমটা লক করা৷ ছুটি শুধায়,
“ ওই রুমটা দেখব? ”
আবির মুহুর্তেই সতর্ক হয়ে শুধায়,
” না। ”
” কেন? ”
আবির এবারে মশকারা করেই শুধায়,
“ ওই রুমে আমার আরেকটা বউ রাখব তাই।”
ছুটি এই পর্যায়ে চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন ছুড়ে,
” আরেকটা বিয়ে করেছেন? ”
বোকা ছুটি! আবির যেটা বলে সেটাই বিশ্বাস করতে হবে কেন এই মেয়ের? আবির ভ্রু নাচিয়ে বলে,
” সে কি! তুই জানিস না? দাওয়াত পাস নি?”
“ আবির ভ…”
আবির এই পর্যায়ে দাঁতে দাঁত চাপে। বউয়ের মুখে আর একবারও ভাই ডাক শুনতে ইচ্ছুক নয় সে৷ দ্রুত বলে,
“ এ্যাঁই! ভাই বলবি তো এখন আস্ত থাকবি না। ”
ছুটি ছোট করে বলে,
” ঠিকাছে বলব না। ”
আবির শ্বাস ফেলে। ছুটিকে গিফ্ট করা সেই শাড়ি, সাঁজের অংশ হিসেবে সব কিছুই ছুটির হাতে তুলে দিয়ে বলে,
“ এগুলো নে, সোজা তৈরি হয়ে বসে থাকবি।আমি আর অপেক্ষা করতে চাইছি না। বহুকাল তোকে শাড়িতে দেখি না বোকাপাখি। ”
“ এখন এতরাতে শাড়ি পরব ? এর চেয়ে কাল সকালে পরি? এখন আপনার বাসাটা ঘুরে দেখি। ”
আবির মুহুর্তেই জানাল,
“ জ্বী না, বাসা ঘুরে দেখার কোন প্রয়োজনীয়তা আমি দেখছি না। আপাতত আপনাকে পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখছি। এখন বলুন, আপনি কি এতকাল পর আমার হতে রাজি? আমার আকুল আকাঙ্খা পূরণে সাধ দিবেন? ”
ছুটির কান গরম হয়ে উঠে এবারে। লজ্জায় গাল উষ্ণ লাগে। আবির আবারো বলে,
“ আমাকে কি এভাবেই অপেক্ষা করাবি আজীবন? নাকি বুঝে গিয়েছিস যে এতকালের অপেক্ষার শাস্তি দৃঢ় হবে? তাই ভয় পেয়ে এসব করে বেড়াচ্ছিস? ”
ছুটির গলা কাঁপে এতকাল পর নির্দিষ্ট পুরুষটির আকাঙ্খা পেয়ে। বলে,
“ জ্বী? ”
আবির ভ্রু বাঁকায়। বুকে হাত গুঁজে সেভাবেই বলে,
“ বুঝিস নি? সোজাসুজি বাসায় বললে,তুই কি আমায় আমার জীবনে দ্বিতীয় বাসর উপভোগ করতে দিবি? প্লিজ না বলিস না বোকাপাখি… আমি জানি তুই নিজেও অপেক্ষায় আছিস। ”
ছুটি এবারেও উত্তর করে না। আবির তা দেখে শুধায়,
“এভাবে চুপচাপ থাকলে থাকতে পারিস। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক৷ আমি চেষ্টা করতেই পারি শাড়ি পরানোর। ”
এই বলেই আবির শাড়িটা হাতে নিল৷ ছুটির হাতে দিল ব্লাউজ এবং পেটিকোড।ছুটিকে নিরব চেয়ে থাকতে দেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“ তুই কি চাইছিস এখন এসবও তোকে আমি পরিয়ে দিব? ছিঃ ছুটি! ”
ছুটি এবারে কোনরকমে মুখ খুলে। রুদ্ধ হয়ে আসা স্বরটায় কোনরকমে বলে উঠে,
” শাড়িটা দিন। আমি পরে নিতে পারব। ”
আবির মুহুর্তেই না জানিয়ে বলল,
“ পরে নিতে পারলে এতক্ষন পরিসনি কেন? এখন আমি পরাব বলেছি যেহেতু আমিই পরাব। জলদি এসব চেঞ্জ করে আসবি। সময় দুই মিনিট । ”
ছুটি ফের বলতে নিল,
“ আমি সত্যিই পা…”
আবির শুনল না। সেভাবেই স্থির তাকিয়ে বলে উঠল,
“ শুনতে ইন্টারেস্টেড নই। আপাতত নিজের বউকে নিজে সাজানোর ইচ্ছা হয়েছে। তাই পূরণ করব। গো ফার্স্ট। ”
#চলবে….