প্রেমের সমর পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
32

#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৩৭
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

মাঝখানে সময় অতিবাহিত হয়েছে প্রায় সাত সাতটা বছর! সিয়া এই সাত বছরে তার প্রিয় পুরুষটির একটি বারও দেখা পায়নি আর। কোন খোঁজ অব্দি পায়নি সে পুরুষটির। এই সাধারণ জীবনে তার আজকাল আক্ষেপ লাগে সাদের জন্য। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের গহীনে জমা হয়ে থাকে। সিয়া একটা কলেজে টিচার হয়ে জয়েন করেছে এই মাসখানেক হলো। এখন পরনের পোশাক হিসেবে প্রতিদিনই জায়গা নিয়েছে কিছু সাদামাটা শাড়ি। সিয়া আজও শাড়ি জড়াল শরীরে। মুখে তেমন সাজগোজ নেই। চোখে চশমা এঁটে যখন কর্মজীবনের জন্য রওনা হলো? রিক্সা নিয়ে পথ এগোল? ঠিক তখনই অস্পষ্ট ভাবে অপর একটি রিক্সায় অনাকাঙ্খিত একটা মুখ ভেসে উঠল! সাদ! সিয়ার চিরচেনা পুরুষ! সিয়া চাহনি সরু করেই কতক্ষন তাকিয়ে থাকল। হ্যাঁ, সাদই! শুধু যে সাদ তেমন নয়, পাশে আছে খুব রূপবতী এক নারীও। সিয়া মনে মনে হাসে। এত বছর পর দেখা মিলেছে ঠিক, তবে সে পুরুষটি যে এখনও অবিবাহিতই আছে এমনটা ভাবা হাস্যকর। সিয়ার হাসি এল।অনুভূতিরা ঝং ধরে এল যেন হঠাৎ ই। হুট করেই সিয়া আবিষ্কার করল যে কোন নারীর মন থেকে কোন পুরুষের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার জন্য সে পুরুষের জীবনে অন্য এক নারীর উপস্থিতিই যথেষ্ট। সিয়া আর যায় হোক অতোটক বেহায়া না, অতোটা ব্যাক্তিত্বহীন নয় সে। অতোটা সে ভালোবাসতে পারে নি যতটুকু ভালোবাসলে সে পুরুষটি অন্য এক নারীর জেনেও সে পাগলামো করবে। এতটা নিচু তো সিয়া নয়। সিয়া এটুকু ভেবেই মৃদু হাসল। মনে মনে আওড়াল,

“ ভালো থাকুন, দোয়া করি পৃথিবীর সবটুকু ভালো থাকা আপনার হোক সাদ। আমার কষ্ট নেই, সত্যিই কষ্ট হচ্ছে না। আপনি অন্য কারোর সাথে ভালো থাকলেও জীবনে খুব খুব ভালো থাকুন এটাই আমার সর্বোত্তম চাওয়া! ”

.

রাহার কোলে আড়াই বছর এর একটা ছটফটে বাচ্চা মেয়ে। দেখতে একদমই রাহার মতো। চোখ হতে, মুখ হতে অবিকল রাহার চেহারা। রাহা কিছুক্ষন তাকাল বাচ্চা মেয়েটার দিকে। একটু আগেই সে অনেক কষ্টে মেয়েটাকে খাইয়েছে। বলতে গেলে প্রায় ঘন্টা দুয়েক চেষ্টা করে সে এক ছোটবাটি সমান খিঁচুড়ি খাওয়াতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু তার গুণধর মেয়ে একটু আগেই তার শরীরে গলগল করে বমি করে তার সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়েছে বলেই রাহা মনে করে। রাহা ফোঁসফাঁস করে। অপর পাশে রোহানকে বসে হাসতে দেখে তৎক্ষনাৎ চ্যাৎ করে উঠে। বলে উঠল,

“ এই মেয়ে জীবনেও আমার হতে পারে না, দেখতে হয়েছে অবিকল আমার মতো অথচ সারাক্ষন বাপ বাপ করে। কি পল্টি’বাজ মেয়ে। ”

রোহান হাসল একটু। এগিয়ে এসে মেয়েকে বমিভর্তি শরীরে ওভাবেই কোলে তুলে নিল। মেয়েটা তার ভীতু প্রকৃতির। যার দরুণ বমি করে ভাসিয়েই চোখ টলমল করছে। ঠোঁট কাঁপছে। এক্ষুনিই হয়তো রুম কাঁপিয়ে কেঁদে উঠবে, কিন্তু মায়ের চিৎকারে ভয়ে বোধহয় তাও করতে পারছে না। রোহান মেয়েকে আদরে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

“ দুনিয়ার সব বাচ্চাকে দেখলেই তোমার আদর আদর পায় নবনী, অথচ আমার বাচ্চাটার বেলাতেই তোমার যত অনাদর। আমার মেয়েটা এমনিতেই ভীতু। ”

রাহা আবার ফোঁস করে উঠে। চোখ রাঙ্গিয়ে বলে উঠে,

“ ও মোটেই ভীতু না। ভীতু হলে ও এভাবে জ্বালাত আমায়? ”

রোহান মেয়ের দিকে তাকাল। যেন বহু কষ্টে কান্নাটা আটকে রেখেছে। শান্তস্বরে মেয়েকে শুধাল,

” আম্মু? জ্বালাবে না আর এই মেয়েকে। এবার থেকে আব্বুর সাথে সাথে থাকবে হু? আব্বুর সাথে সাথে অফিস নিয়ে চলে যাব আব্বু তোমাকে। কেউ বকবে না তোমায়। ”

রাহা মুহুর্তেই চোখে মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে তুলল। কপাল কুঁচকে বলল,

“ বকতে পারব না আমি আমার মেয়েকে? ”

রোহান তাকায়। বলে বসল,

“ একটা বাচ্চা সামলিয়েই এমন বকাবকি করলে বাকি বাচ্চাকাচ্চার কি হবে নবনী?তোমার তো আবার বাচ্চাকাচ্চার শখ বেশি।”

“ রোহান…”

রোহান হাসে এবারে। মেয়েকে নিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ ওকে পরিষ্কার করাতে নিয়ে যাই? তোমার প্রেম পরে গ্রহণ করছি কেমন? ”

বলে রোহান ওয়াশরুমে প্রবেশ করার আগেই জামাকাপড় নিয়ে প্রবেশ করল রাহা। রোহান তা দেখে দ্রুত শুধাল,

” মা মেয়ে দুইজনকেই পরিষ্কার করে দিতে হবে নাকি? আমার অবশ্য সমস্যা নেই, পরিষ্কার হলে হতে পারো আমার সামনে।”

রাহা কেমন করে যেন চাইল। বলল,

“ মোটেই না। ওকে আমায় দিন, গোসল করিয়ে পাঠাচ্ছি আপনার কাছে।”

রোহান হতাশ হয়ে বলে,

“ তোমাকে তো জ্বালাচ্ছে বললে..”

রাহা দ্রুত মেয়েকে নিজের কাছে টেনে নিল। রেগে রোহানকে শুধাল,

“ তো? জ্বালালে বলব না আমি? মেয়ে কি আমার না? নাকি আপনার অন্য কোন বউ এর? সরুন! ”

এটুকু বলেই বেচারা রোহানের মুখের উপরেই দরজাটা লাগাল রাহা। রোহান ছোটশ্বাস টেনে ফের বিছানায় গিয়ে বসে। তার ঠিক কিছুক্ষন পরই তার মেয়ের দেখা মিলল।পরনে ছোট শুভ্র রং এর ফ্রক আর ছোট প্যান্ট। চুলগুলো ভিজে আছে একটু একটু এখনো। ভেতর থেকে রাহা ততক্ষনে চেঁচিয়ে বলল,

“ ওর চুলগুলো আরেকটু মুঁছে দেন। ভেজা আছে একটু একটু। ”

রোহান তাই করল। মেয়েকে কোলে নিয়ে চুমু আঁকল কপালে। পরপরই ভালো করে মাথা মুঁছে দিল। তারপর বিছানার একপ্রান্তে বাপ মেয়ে দুইজনে সময় কাঁটাতে কাঁটাতে কবেই যে মেয়েটা তার কোলে ঘুমিয়ে গেল রোহান বুঝলই না। রোহান হাসে। তার মিষ্টি মেয়েটাকে আরো একটা চুমু উপহার দিয়ে শুঁইয়ে দিল বিছানায়। আশপাশে সুন্দর করে বালিশ দিয়ে দিল। কোলবালিশটা টেনে রাখল মেয়ের হাতের নিচেই। রাহা গোসল করে, কাপঁড় ধুয়ে বের হলো তার একটু খানি পরই। মেয়েকে ঘুমিয়ে পরতে দেখে জিজ্ঞেম করল,

“ ঘুমিয়ে গেল?”

উত্তরে রোহান বলে,

“ বাচ্চার আম্মু এতক্ষন যাবৎ গোসল করলে বাচ্চা তো ঘুমিয়ে যাবেই, তবে বাচ্চার আব্বু কিন্তু ঘুমায়নি। বাচ্চার আম্মুর প্রেম গ্রহণ করার জন্য অপেক্ষা করছিল… ”

রাহা হেসে ফেলল এবারে। বালতি ভর্তি কাপড় গুলো নিতে নিতে বলে উঠল,

“ বাচ্চার আম্মু আপনাকে প্রেম নিবেদনের জন্য বসে নেই! ”

রোহান বড্ড আপসোসের সাথে ফের বলল,
”বাচ্চার আব্বু প্রেম নিবেদন করলে গ্রহণ করবেন? না মানে, বাচ্চার আম্মুকে আজকাল খুব ব্যস্ত লাগে! বাচ্চার আম্মুকে তো আজকাল পাওয়াই যায় না। ”

.

ড্রয়িং রুমের এককোণে বসে আছে স্নিগ্ধ।হাতে একটা কিউব। দেখে মনে হচ্ছে সে খুব করে কিউবটা মিল করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ হচ্ছে না। অন্যদিকে সোফার এককোণে বসে সাদাফ এবং নিধির দুই জমজ ছেলে সাদিদ এবং আবিদ। দুইজনই খুবই উৎসুক ছুটির আর আবিরের বেবি নিয়ে। তারা জানে তাদের জন্য একটা নতুন ডল আসবে। তাদের সাথে খেলা করার জন্য একটা ডল আসবে। এটুকু শোনার পর থেকে তাদের দুটোর শান্তি নেই আজ অনেক দিন। শুধু অপেক্ষা করছে কবে ডল আসবে। এই যে তারা স্নিগ্ধদের বাসায় বেড়াতে এল? এখানে এসেও ছুটিকে তারা ভিডিও কল করেছে। জানতে চেয়েছে ডল কেমন আছে? কি করছে? সাদাফ আর নিধি অবশ্য হাসে এসব দেখে। আজও ব্যাতিক্রম হলো না। সাদাফ সোফায় বসামাত্রই সাদিদ বাবার গলা জড়িয়ে ধরল। দ্রুত বলল,

“ পাপা? ছুটি আন্টির কি ডল বেবি আসবে?”

সাদাফ হাসে। ছেলে যে এমন প্রশ্ন করবে বা করতে পারে তা তার জানা। হেসে বলে,

“ হ্যাঁ, আব্বু। ডল বেবি আসবে।”

সাদিদ বেশ আগ্রহ নিয়ে শুধাল,

“ ডলের মতো চুল থাকবে ওর পাপা? ”

সাদাফ হেসে বলে,

“ অবশ্যই থাকবে। ”

এবারে আবিদ তাকাল আগ্রহ আগ্রহ দৃষ্টিতে। জানতে চাইল,

“ ও কি পুতুলের মতো মিষ্টি হবে? ”

সাদাফ উত্তর করে,

“ হ্যাঁ আব্বু। ”

সাদিদ দ্রুতই বলল,

“ পাপা? ও আমার সাথে খেলবে? ”

সাদাফ ছোটশ্বাস টেনে বলল,

“ তোমাদের সবার সাথেই খেলবে আব্বু। ”

সাদিদ মানল না। দ্রুতই প্রতিবাদ করে বলে উঠল,

“ না আব্বু, ও আমার সাথে খেলবে। আবিদ পঁচা। ”

আবিদও বলল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই

“ আব্বু, সাদিদ পঁচা।ওর সাথে ডল খেলবে না। ”

এই নিয়েই লেগে গেল দুইজনের মধ্যে ঝগড়া! সাড়ে ছয় বছরের দুই বাচ্চার এমন ঝগড়া প্রায়সই সাদাফ দেখে। তাই আজও পাত্তা দিল না। চুপ করে উঠে গেল। অন্যদিাে স্নিগ্ধ এই দুইজনের প্যা প্যা শুনে মুখ তুলে চায়। এতক্ষন সব শুনলেও সে কথা বলেনি। উত্তর করেনি। তবে এখন করবে বলে এগোল সে। বলল,

“সাদিদ? আবিদ?ছোটরা কি খেলতে পারে নাকি? ঝগড়া করিস কেন তোরা? ”

আবিদ মুহুর্তেই স্নিগ্ধির দিকে চেয়ে বলল,

“ পারে না? ”

স্নিগ্ধ বড়দের মতো উত্তর দিল,

“ না! ”

আবিদ ফের বলল,

“ তুই খেলবি না ডলের সাথে? ”

“ নাহ! ”

সাদিদ তখন কিঞ্চিৎ রেগে বলল,

“ ভালো, আমার ডল। আমার সাথেই খেলবে। ”

.

ছুটি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে।মাত্রই সাদিদ আর আবিদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলেছে সে।এত মিষ্টি এই বাচ্চাগুলো। দেখা হয়েছে প্রায় সপ্তাহখানেক হচ্ছে। ছুটি একবার হাসে। নয়মাসের ভরা পেটের জন্য কিছুটা উঁচু দেখাচ্ছে তার পেট। মুখটা আগের থেকে গোলাগাল হয়েছে। আবির তা দেখে। এই গোলগাল চেহারার মিষ্টিমতন মেয়েটাকে দেখে হাসল সে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে থুতনি রাখল মেয়েটাে কাঁধে। হাত জোড়া বড্ড আদুরে ভাবে ছুঁয়ে গেল ছুটির উঁচু হওয়া পেটে। ছুটি প্রিয় পুরুষের উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত শুধাল,

”যদি আরো আগে কনসিভ করতাম এতদিনে আমার সাদিদ আবিদের সমান একটা বাচ্চা থাকত। কিন্তু আপনি, আপনি মানুষটা তা হতে দিলেন না। ”

আবির হাসল। জানতে চাইল,

“ তো এখন কে হতে দিয়েছে? আমি না?”

ছুটি ছোটশ্বাস টেনে শুধায়,

“ আগে তো রাজি হননি। ”

আবির নিজের দিকে ফেরাল ছুটিকে। মুখটা দুইহাতে আগলে নিয়ে শান্তভঙ্গিতে শুধাল,

“ আগে ওদেশে যেমন তোর জন্য ডিফিকাল্ট হতো,তেমনই আমার বেবির জন্যও কঠিন হতো। তার চেয়ে এখানে সবার মাঝে এসে এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া ভালো হলো না? ওখানে আমরা সামলাতে পারতাম না। তুই জানিস ছুটি? আমার এখনও স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। আমি এখনও একটু একটু নার্ভাস ফিল করি নতুন বাবা হচ্ছি ভেবে। আমি এখনও ভাবি প্রথমবার আমি আমার মিষ্টি পুতুলটাকে কি করে কোলে তুলব? হাত কাঁপবে না আমার? ”

“মোটেই না। হাত কেন কাঁপবে। আপনি খুশি হবেন না ওকে দেখে?”

আবির হাসল৷ উত্তরে বলে,

“আমার খুশির পরিমাণ অত্যাধিক হবে বলেই আমি নার্ভাস ফিল করছি মাঝেমাঝে।”

ছুটি ছোটছোট চোখে তাকায়। বোকার মতে জিজ্ঞেস করে,

“নার্ভাস ফিল করলে কোলে নিবেন না ওকে?”

আবির নিঃশব্দে হাসে। মেয়েটার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে শুধায়,

“ বোকাপাখি! তুই বোকাই থাকলি সবসময়।”

“আর অল্পকয়টা দিন। আর কয়টা দিন পর ও আমাদের কোলে চলে আসবে তাই না বলুন? আপনি কিন্তু ওকে অনেক ভালোবাসবেন।”

এটুকু বলতেই ছুটির চোখ বেয়ে গড়াল পানি। আবির ভ্রু কুঁচকে শুধায়,

“ কাঁদছিস কেন? ”

ছুটি জড়িয়ে ধরল প্রিয় পুরুষকে। বলল

“ আমার একটা আদর, একটা মিষ্টি, আস্ত একটা পৃথিবী ও জানেন? যদি আমার কিছু হয়ও, ওকে কখনো অনাদর করবেন না প্লিজ। ”

আবির ভ্রু কুঁচকে জানতে চায়,

” কি হবে তোর? ”

ছুটি ইতস্থত বোধ করে বলে,

” হয়না কিছুক্ষেত্রে… ”

এই পর্যায়ে আবির হঠাৎই দৃঢ় স্বরে বলে উঠল,

“ মন থেকে নেগেটিভিটি সরা ছুটি। নয়তো রেগে যাব আমি। তোর কিচ্ছু হলে আমি কিন্তু তোর বাচ্চাকে মোটেও কোলে তুলব না। একবারও না। বলে রাখলাম। ”

ছুটি ফ্যালফ্যাল করে। আবির রেগে গেছে? ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই শুধাল,

“ মানে? আমার কিছু হলে ও মাও পাবে না, বাবাও পাবে না? ”

“ হ্যাঁ, পাবে না। ”

“ এমন হলে আমি রাগ করব। এখন কত আদর দেখাচ্ছেন ওর প্রতি।”

আবিরের ছুটির বাচ্চা বাচ্চা কথায় হাসি পায় যেন। তবুও দৃঢ় স্বরে বলে,

” দুইজনকেই তো আদর দেখাচ্ছি, তাহলে একজন আসলে অন্যজন আসবে না এমন ভাবনা ভাববে কেন? ”

” আসব না তা বলিনি, যদি এমনটা হয় তাই বললাম….”

ফের কঠিন গলায় আবির বলল

” হবে না, যদি হয় তবে তোকে আমি ম’রে গেলেও ছাড়ব না,প্রমিজ!”

#চলবে….

#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৩৮
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

সিয়া আজ ইচ্ছে করেই কলেজ গেল না। ছুটি নিল। মাঝেমাঝে সে একা একাই ঘুরতে বের হয়। একা একাই রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিংবা কফিশপে গিয়ে কফিতে চুমুক রাখে। অনেকটা নিজের সাথে নিজে ঘোরাফেরা, নিজেকে ভালোবাসা, নিজেকে সময় দেওয়া বলা চলে। আজও তাই করল। পরনে লাল এর মধ্যে কালো পাড়ের একটা শাড়ি জড়িয়ে চোখে গাঢ় কাজল আঁকল। চুলগুলো খোলা রাখল। অতঃপর এই সিম্পল সাঁজ নিয়েই কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে বের হলো সে এক দূরবর্তী নদীর উদ্দেশ্যে। যেখানে সে একা একাই যায়, একা একাই বসে থেকে নিরব সময় কাঁটায়, আবার একা একাই ফিরে আসে। সময় হলে ওখানকার টং দোকানে মাঝেমধ্যে দুয়েক কাপ চা মুখে তুলে। আজ টং দোকানে সে গেল না। সকাল থেকে দুপুর অব্দি সে নদীর পাড়টায় বসে থেকে সে ফের ফিরে এল দুপুর আড়াইটার দিকে। অতঃপর দুপুরের ক্ষিধেটা মেটাতে গেল একটা রেস্টুরেন্টে। খেয়ে আবার কিছুটা সময় নিজে নিজে ঘুরব। ফুরফুরে মন! মাঝেমাঝে জীবনের বিষন্নতার মাঝখানে নিজেকে এমন কিছু ফুরফুরে সময় এনে দেওয়া উচিত। আনন্দ দেওয়া উচিত। এত দুঃখ পুষে জীবনে লাভ আছে? জীবনকে একা একাও উপভোগ করা যায় খুব করে। সিয়া তা ভেবেই হেসে রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দিচ্ছিল। অর্ডার দিয়ে একা একা বসে থেকে যখন অপেক্ষা করছিল তখন দেখা হলো এক ভার্সিটি ফ্রেন্ডের সাথে। সম্ভবত বন্ধুদের সাথে এসেছে সে। সিয়া আড়চোখে একবার একটা টেবিলে ছেলেটার পুরো বন্ধুমহলকে দেখে হালকা কথা বলল। তারপর যখন ছেলেটা চলে গেল ঠিক তখনই আরো একটা স্বর এসে বাঁধল তার কানে। সিয়া চমকায়। ঠিক শুনল সে? তাকে নিশ্চিত করতে আবারও সে স্বরটা বলে উঠল,

“ সিয়া? ”

সিয়া তাকায়। এই স্বরটা তার চেনা। আসলেই চেনা। সিয়া মুহুর্তেই সে মানুষটিকে কাছ থেকে আবিষ্কার করে কিছুটা চমকাল। সাথে সাথেই সেই বিস্ময় চেপে গিয়ে হাসল মৃদু। বলল,

“ হ্যাঁ, সাদ ভাই? কেমন আছেন? অনেকদিন পর দেখা আপনার সাথে। ”

সাদ হালকা হাসল।পরনে তার ফর্মাল ড্রেস আপ। এক হাতে সম্ভবত একটা কোট ঝুলছে। সাদ আচমকায় সিয়ার সামনের চেয়ারটা দখল করে বসল। তাকাল সিয়ার দিকে। আগের সিয়া আর এই সিয়ার মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। এই সিয়াকে দেখতে ম্যাচিউরড,গম্ভীর রমণী লাগছে। মুখচাহনিও গম্ভীর। কথাগুলোও কি সুন্দর ম্যাচিউরড পার্সনদের মতো। সাদ অল্প হাসল। বলল,

“ রেস্টুরেন্টে কার সাথে এলে? বরের সাথে?”

সিয়া হাসে অল্প। তার আবার বর? কে? সিয়া তো একটা সময় মনে মনে ধরেই নিয়েছিল সামনের পুরুষটি তার বর হবে। সামনের পুরুষটিই তার জীবনের পথচলার সঙ্গী হবে। কিন্তু হলো কই? সিয়া হেসে শুধাল,

“ বরের সাথেই যে রেস্টুরেন্টে আসতে হবে তা কোথাও লিখা আছে সাদ ভাই? বর ছাড়া আসা যায় না? ”

” অবশ্যই যায়, তবে আমি সম্ভবত এই টেবিলটায় কিছুক্ষন আগে একজন পুরুষকেও দেখেছিলাম সিয়া। তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”

সিয়া হাসে এবারে। বলল,

“ অনেকক্ষন থেকে খেয়াল করছিলেন নাকি আমায়? সাথে বউকে আনেননি? অন্য মেয়েকে খেয়াল করছেন দেখলে তো এতক্ষনে কপালে শনি থাকত আপনার। ”

আগের সিয়া কখনো এই কথাগুলো এভাবে হাসি হাসি মুখে বলতে পারত বলে সাদের মনে হয় না। তবে এখনকার সিয়া ভিন্ন। একদম ভিন্ন। সাদের যেন অদ্ভুত হাঁসফাঁস লাগল আগের সিয়াকে হারিয়ে। জানতে মন চাইল তার প্রতি কি এই মেয়েটার এখনো একটু হলেও অনুভূতি আছে? সাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই কথাটা ভেবেই। কেন থাকবে অনুভূতি? সেই সাড়ে ছয় বছর আগেই তো সে শুনেছিল সিয়ার বিয়ের খবর। সুহা নিজে তাকে ইনভাইট করেছিল সিয়ার বিয়েতে। শহর ছাড়ার ছয় মাস পর! সাদ সেবারে কি ভীষণ রাগ জেদ নিয়ে নিজের বন্ধুমহলও ত্যাগ করল। কন্ট্যাক্ট নাম্বার ও চেঞ্জ করল। সিয়া সিয়ার মতো ভালো থাকুক এমন একটা প্রতিজ্ঞা বুকে পুষে নিয়ে সে সর্বোচ্চ দূরে সরে গিয়েছিল।সাদ ম্লান হাসে। জবাবে বলে,

“ তোমার বর কেমন আছে? আমি খুবই দুঃখিত তোমার বিয়েতে আসতে পারিনি বলে সিয়া।”

সিয়া তাকায়। বিয়ের একটা নাটক সে করেছিল প্রায় ছয় বছর আগে। তাও সাদের জন্যই৷সুহাকে দিয়ে সে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ইনভাইট করেছিল। ভেবেছিল সাদকে একবার আনতে পারবে তার বিয়ের ইনভাইট করে। অথচ সাদ বরাবরের মতো নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে হাজির হলো না। উল্টে সাদের সাথে যোগাযোগ করার যে সিঙ্গেল ওয়ে ছিল সেগুলো অব্দি বন্ধ করে দিল। কি নিষ্ঠুর এই পুরুষ ! সিয়া হাসল। সত্যিই তো নিষ্ঠুর। নয়তো অন্য এক নারীকে বিয়ে করতে পারত? পারত না তো। মানল সে, সাদের জীবনে প্রথম নারী রাহা। কিন্তু রাহার পরবর্তীতে যে নারীকে জায়গা দিল সে নারী কী সিয়া হতে পারত না? সিয়ার বিয়েটা অবশ্য পরে সিয়া ভেঙ্গেই দিয়েছিল। সাদের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে মাস দুয়েক ঘর বন্দিও ছিল। তারপর আস্তে আস্তে সুহা,স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ, নিজের মা বাবার সবার প্রচেষ্টায় সে এখন অনেকটা হাসিখুশি! অনেকটাই প্রাণবন্ত। সিয়া হেসে শুধাল,

“ আমার বিয়ে? সেই সাড়ে ছয়বছর আগে?”

সাদের স্পষ্ট সময়টা মনে আছে। স্পষ্টই মনে পড়ে তার এখনো৷ তবে সে মুখে বলল,

” সময়টা তেমনই হবে বোধহয়।”

সিয়া এবারে বলল,

“ আপনি তো এমনভাবে লেজ গুঁটিয়ে পালালেন, বোধহয় ভাবলেন আমার সুইসাইডের দায়টা আপনার উপন গিয়ে পড়বে, সেই জন্যই এভাবে হাওয়া হয়ে গেলেন হুহ?”

সাদ গম্ভীর হয়ে তাকায়৷ বলল,

“ আমাকে কি কাপুরুষ মনে হয়? ”

“ না তো। ”

সাদ ফের কিছু বলতে নিবে তখনই ফের সিয়ার সে ভার্সিটির ফ্রেন্ডটা এসে বসল। একটা টিস্যু পেপারের মতো কিছু সিয়ার দিকে এগিয়ে দ্রুত বলল,

“ সিয়া, সিয়া? তোর জন্য একটা চিরকুট! জ্বালিয়ে মারছে ওরা এটা তোকর দেওয়ার জন্য, তুই প্লিজ মাইন্ড করিস। দরকার হলে পড়েই ফেলে দিস। ”

সাদ ভ্র কুঁচকে তাকাল। ছেলেটার দিকে তাকাতেই ছেলেটা সাদকে ইশারা করেই সিয়াকে শুধাল,

“ ব্রো কি আমাদের হবু দুলাভাই?ব্রো আবার জ্বেলাস হবে না তো? ”

সিয়া এবারে টিস্যুটা এগিয়ে ধরল। ছেলেটা আবারও হেসে কিছু বলতে নিতেই সিয়া হেসে বলল,

“ ব্রো এর অলরেডি একখানা বউ আছে ভাই। ব্রো তোদের হবু দুলাভাই হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। ”

সাদ ভ্রু কুঁচকায়। হবু দুলাভাই সম্বোধনটা মস্তিষ্কে ঘুরপাক খায়। অতঃপর জিজ্ঞেস করেই ফেলল,

“ তোমার বিয়েটা কি হয়নি এখনো সিয়া?”

সিয়াকে বলতে না দিয়ে মাঝপথেই সিয়ার সে বন্ধু সিয়ামই উত্তর দিয়ে বসল,

“ কিভাবে হবে, আমাদের সিয়া তো নিজেই বিয়েতে রাজি হয় না। আমাদের বন্ধুমহলের দুয়েকটা ছেলেও তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে পাঠিয়ে দিনরাত ম’রে যাচ্ছে। এখনও…..।কিন্তু উনি রাজি নন। ”

সাদকে বিভ্রান্ত দেখাল। বিভ্রান্তি নিয়েই সে বলল,

” আমি যে শুনেছিলাম ওর বিয়েটা রাজশাহীতে হয়েছিল।প্রায় ছয় বছর আগে.. ”

সিয়াম এবারেও ফট করে বলে বসল,

“ আপনি বোধহয় ভুল করছেন,সিয়ার সেই নাটক নাটক বিয়েটা তো শেষ পর্যন্ত হয়নি৷ সিয়া ভেঙ্গে দিয়েছিল বিয়েটা৷ ”

সিয়া বিরক্ত। প্রচুর বিরক্ত এই ছেলের প্রতি। ওকে এভাবে গড়গড় করে সব বলে দিতে কে বলেছে? রাগ হচ্ছে সিয়ার। অনেকটা দাঁতে দাঁত চেপেই বলে উঠল এবারে সিয়া,

“ সিয়াম! যাবি এখান থেকে? ”

সিয়াম সিয়র চোখ রাঙ্গানো দেখে উঠে গেল। জলদি যেতে যেতে বলল,

“ যাচ্ছি, যাচ্ছি! ”

সিয়াম যেতেই খাবার এল। সিয়া ফের সাদের জন্য কিছু অর্ডার দেওয়ার কথা বলতেই সে জানাল সে খেয়ে নিয়েছে। খেতে খেতেই একা বসে থাকা সিয়াকে তার চোখে পড়েছিল। সিয়া হাসে৷ সাদ ফের কৌতুহল দেখিয়ে শুধাল,

“কেন হলো না তোমার বিয়েটা?বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছিলে কেন সিয়া? ”

সিয়া খাবার মুখে তুলল। হেসে বলল,

“ এমনিই! বিয়ে তো মানুষের লাইফে অতো ইম্পোর্টেন্ট না। আপনার কথা বলুন, বিয়ে কবে করেছেন? বউ বাচ্চাসহ হ্যাপি তো? ”

“ হু? ”

“ সেদিন রিক্সায় আপনার পাশে একটা মেয়ে দেখেছিলাম। সম্ভবত আপনার ওয়াইফ। তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”

“ কোনদিন? ”

সিয়া হেসে তাকায়। বলে,

“ প্রতিদিনই বের হোন আপনারা? ”

সাদ জানাল,

“ আমি এখানে এসেছি কয়েকদিন হলো সিয়া। তোমাদের এলাকাতেই বাসা নিয়েছি তাই দেখা হয়ে যাচ্ছে বোধহয় বারবার।যদিও আমি তোমার দেখা আজই পেলাম। ”

সিয়া হাসল। বলল,

“ ওহ, একদিন আপনার ওয়াইফকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবেন।”

“ অবশ্যই। ”

সিয়া উঠল। খাবারের এইটুকু অংশও যেন তার গলা দিয়ে নামছে। তবুও চেষ্টা করছিল সে খাওয়ার। অবশেষে না পেরে উঠে গেল। সাদকে বলল,

“ আজ আসি তাহলে, তাড়া আছে একটু। ”

সিয়া মিথ্যে বলছে। মোটেই তার তাড়া নেই। তবুও যাওয়ার জন্য বিদাল নিল। বিল মেটাতে গিয়ে হুট করে শুনল তার বিল পে করা হয়েছে। সিয়া ভ্রু কুঁচকায়। পরমুহুর্তে জানতে পারল সাদই দিয়েছে। সিয়া ফের ঘাড় ফেরাতে গিয়ে দেখল সাদ তার পেছনেই দাঁড়িয়ে। শুধাল,

“ সিয়া? সুহার কন্ট্যাক্ট নাম্বারটা দেওয়া যাবে? দয়া করে.. ”

সিয়া ভ্রু কুঁচকে শুধায়,

“ যোগাযোগ হয়নি আর সুহা আপুর সাথে? ”

সাদ মুখ গম্ভীর করে এবারে বলল,

“ যোগাযোগ করার পথ রাখিনি আসলে আমি নিজেই। ওদের কারোর সাথেই যোগাযোগ করিনি।দেওয়া যাবে ওর নাম্বারটা? ”

সিয়া হেসে বলল,

“ অবশ্যই। ”

এটুকু বলেই সে নাম্বার দিল। পরমুহুর্তেই এগিয়ে পা বাড়াল। আর সাদ সে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল,

“সিয়া? তুমি কি এখনো আমার প্রতি অনুভূতি পুষে আছো? নাকি মুঁছে নিয়েছো সবটুকু অনুভূতি? ”

.

সুহার হাতে একটা প্র্যাগনেন্সি রিপোর্ট।যা স্পষ্ট বুঝাচ্ছে প্রেগন্যান্সি রেজাল্ট পজিটিভ। আজ সকালেই সে হসপিটালে গিয়েছিল।সুহার চোখ টলমল করে যেন। স্বচ্ছকে এই খবরটা কখন দিবে তার জন্য অপেক্ষা করে। অতঃপর স্বচ্ছ যখন এল তখন সুহা কি বলবে বুঝে পেল না। অনেকক্ষন যাবৎ ভেবেচিন্তে সে স্বচ্ছর পিছুপিছু ঘুরঘুর করে বিষয়টা যখন জানাল তখন আচমকাই স্বচ্ছর মুখচোখ কঠিন দেখাল। সুহার দিকে তাকিয়ে শুধাল,

“ এটা কি খুব বেশি প্রয়োজনীয় ছিল সুহাসিনী? স্নিগ্ধ কি এনাফ ছিল না তোমার জন্য? ”

সুহার মুখের খুশিখুশি ভাব মুহুর্তেই নিভে গেল৷ স্নিগ্ধ তার জীবনে সর্বোত্তম সুখ। এটা সে অস্বীকার করতে পারে না। স্বচ্ছ কেন এই খানে স্নিগ্ধকে টানল? সে কি স্নিগ্ধাে ভালোবাসে না? সুহা শুধাল,

“ স্নিগ্ধর তুলনা আমি কখনো কারোর সাথেই করতে পারব না স্বচ্ছ। আমার স্নিগ্ধ আমার প্রাণের চাইতেও বেশি। তাই বলে আমি অন্য কারোর মা হতে পারব না এমনটা কি কোথাও উল্লেখ আছে? ”

স্বচ্ছ আচমকায় ঝাপটে ধরল মেয়েটাকে। শুধাল,

“ আমি তোমায় হারাতে পারব না সুহাসিনী। একবারে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, আমার জীবনের উপর কি গিয়েছিল সেবার।”

সুহা শান্ত স্বরে বলে,

“ খারাপটাই কেন ভাবছেন? ”

“ কারণ আমি খারাপটারই সম্মুখীন হয়েছিলাম। খুব বাজেভাবে। ”

“ আচ্ছা? তিহানকে কি এখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি? ”

স্বচ্ছ দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল এবারে,

“ ম’রে গেছে ও। ”

সুহা মুহুর্তেই তাকায়। বলে,

“ হু? ”

“ জানি না। বাদ দাও। ”

সুহা বাদ দিল। কিয়ৎক্ষন স্বচ্ছর বুকের হৃদস্পন্দন শুনে বলল,

“ এবারে আমি সত্যিই সাবধানে থাকব স্বচ্ছ৷ খুশি হবেন না আপনি?খুশি হওয়া উচিত নয় কি আপনার? ”

স্বচ্ছ ছোটশ্বাস টেনে শুধায়,

“ ভয় হচ্ছে আমার সুহাসিনী। আবারও একই রিস্ক…আমি এবারে সত্যিই সামলাতে পারব না কিছু হলে। ”

সুহা আশ্বাস দিয়ে জানায়,

“ কিছু হবে না। আমি সত্যিই সাবধানে চলাফেরা করব।তাছাড়া আমার স্নিগ্ধ আছে তো আমার সাথে এবার। ”

#চলবে…

#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৩৯
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

তখন রাত! রাহা মেয়েকে বুকে নিয়ে ঘুমোচ্ছে বেঘোরে। ঘুমানোর আগেই রাহা রোহানের সাথে অল্প কি কথা নিয়ে যেন কথা কাঁটাকাটি করে মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সতর্কতা দিয়েছে তাদের মা মেয়ের দিকে যেন একটু না চাপে সে। নির্দিষ্টি জায়গার মধ্যেই যেন ঘুমিয়ে পড়ে। অথচ তার ঘুম এল না। রাহাকে জড়িয়ে না ধরে আজকাল তার খুব একটা ঘুম আসেও না। রোহান হতাশ হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকায় মা মেয়ের দিকে। অবিকল এক যেন দুইজনই। দুইজনের ঘুম যাওয়ার দৃশ্যটাও এক। মায়াবী মুখটা ফুলোফুলো হয়ে পুতুলের ন্যায় লাগে। রোহান তাকায়।যতোটা সময় সে জেগে আছে ততক্ষনই তাকিয়ে থাকে। কি এক মুগ্ধতা যেন। রোহান মুচকি হাসল। মুখ নামিয়ে সর্বপ্রথম তার আর রাহার মাঝখানে থাকা তাদের মিষ্টি মেয়েটাকে চুমু দিল। কপালে, গালে দুটো চুমু এঁকে ফিসফিসিয়ে শুধায়,

” আম্মু? তুমি আমার লাইফে সত্যিই একটা চমৎকার।তুমি জানো? আমি এখনোও একদম নতুন আনন্দময় একটা অনুভূতি টের পাই নিজের হৃদয়ে যখন ভাবি আমার একটা মেয়ে আছে। একদম তোমার আম্মুর মতোই হুবুহু একটা মেয়ে!”

রোহান কথাগুলো বলেই ফের চুমু দিল মেয়ের ফুলো গালে। এত আদুরে কেন তার মেয়েটা? এত মায়া! রোহান যখন চুমু দিল তখনই নড়চড় করে উঠল তার মেয়েটা। রোহান হাসে। এক ফাঁকে রাহার থেকে নিজের মেয়েকে টেনে নিজের বুকে রাখে।অতঃপর হেসে শুধায়,

“ আব্বুর কাছেই ঘুমাও। আব্বু বরং তোমার আম্মুকেই দেখি। ”

তার ঠিক কিছুটা সময় পরই চোখ ফিটফিট করে তাকাল রাহা। ঘুমের মধ্যে হাতড়ে যখন নিজের মেয়েকে পেল না তখনই মস্তিষ্কের আগাম বার্তায় ঘুম ভাঙ্গতে বাধ্য তার। রাহা ফ্যালফ্যাল করে তাকাতেই যখন নিজের আদরের মেয়েকে বাবার বুকে ঘুমোতে দেখল এবং মেয়ের বাপকে নিজের দিকে ফিরে তাকিয়ে থাকতে দেখল তখন ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,

“ ওকে বিছানা থেকে নিয়ে এভাবে আপনার বুকে রাখার কি কারণ? আর ওভাবে চেয়ে চেয়ে কি দেখছিলেন? ”

রোহান হাসল। উত্তরে হেসে বলল,

“ বিয়ের এতবছরে যে মেয়েটাকে দেখি তাকেই দেখছিলাম।একদম আমার মেয়েটার মতোই মিষ্টি।”

রাহা হাসবে কিনা বুঝল না। তবে হাত বাড়িয়ে শুধাল,

“ আমার কাছে দিন ওকে। ”

“ থাকুক না। ”

“ ওভাবে ঘুমিয়ে শরীর ব্যাথা হবে মেয়েটার৷ ”

রোহান ছোটশ্বাস ফেলে মেয়েকে আগের ন্যায় শুঁইয়ে দিল। শান্তস্বরে বলল,

“ ঠিকাছে, ঘুমাক। ”

রাহা ফের মেয়েকে জড়িয়ে চোখ বুঝল। রোহানের উদ্দেশ্যে বলল,

“ ঘুমিয়ে পড়ুন। এদ রাত জাগা তো ভালো অভ্যাস নয়। ঘুমান। ”

রোহান তাকায়। পরপরই আলো নিভাল। তার ঠিক দুই সেকেন্ড পরই এপাশ থেকে অবস্থান পাল্টে উঠে গেল। এর ঠিক দুই সেকেন্ডই পরই নিঃশব্দে হেঁটে গিয়ে অবস্থান নিল রাহার পেছনে। অতঃপর রাহার পেট আঁকড়ে জড়িয়ে ধরে মুখ ঘেষল রাহার কাঁধে। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে সেভাবেই মুখ ঘেষে বলে উঠল,

“ আমার আসলে ঘুম আসছে না তুমি ছাড়া নবনী। এতোটা অভ্যেস খারাপ করেছো আমার, আমি তোমাকে না জড়িয়ে ঘুমোতেও পারছি না। কি যন্ত্রনা! ”

রাহা নড়চড় করে না।উত্তর ও করে না। তবে প্রিয় পুরুষের এমন বাক্যে ঠোঁট চওড়া হয় তার। নিঃশব্দে হাসে। কোথাও যেন সুখ সুখ অনুভূতিরা এসে বলে যায় সে সত্যিই সুখী। সত্যিই!

.

খু্ব অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই গত দুদিন যাবৎ সিয়ার কাছে কয়েকটা চিঠি আসছে। চিঠিগুলোর মাধ্যম কি তাও সিয়ার অজানা। তবে সকাল সকাল যখন বের হয়? ঠিক তখনই দরজার সামনে চিঠি গুলো মিলে। এই নিয়ে তিনটে হলো। সিয়া ভ্রু কুঁচকায়। আজকের চিঠিটা মেলে ধরতেই ভেসে উঠে,

” সম্ভবত তুমি আমায় ভুলে বসেছো সেই কবেই। অথচ আমার মস্তিষ্কে খুব ক্ষুদ্র জায়গা নিয়েও তুমি কি প্রগাঢ় হয়ে থেকে গেলর সিয়া। আমি সত্যিই কখনো তোমাতে ডুবতে চাইনি, তবুও যখন আমি বুঝতে পারলাম তুমি কখনোই আর আমার হবে না তখনই আমার যন্ত্রনার সূচনা ঘটল। আমি দিনরাত এত তীব্র বেদনায় মূর্ছা যাওয়ার মতো ডু্বে থাকতাম।নেহাৎই তোমার সামনে এসে দাঁড়ানোর আমার সাহস ছিল না, নয়তো তোমাকে ফিরতি ভালোবাসা দেওয়ার কমতি বোধহয় আমার হৃদয় ও রাখে নি। ঠিক যতটুকু ভালোবাসা তুমি আমায় দিলে? আমিও ততখানি ভালোবাসা নিরবে নিভৃতে সিয়া নামক রমণীটির নামে লিখে দিলাম। অথচ ততদিনে জানতাম রমণীটি অন্য কারো নিজস্ব নারী। সাহস হলো না তোমার সামনে দাঁড়ানোর। কি করেই বা দাঁড়াতাম? যেখানে নিজেরই ঠাঁই নেই, সেখানে কি করে তোমায় আগলে নিতাম বলো? তোমার মতো রাজকন্যাকে তখনকার আমি মোটেই আগলে নিতে পারতাম না। তবুও জানতে ইচ্ছে হয়, আমায় একটিবার তোমায় আগলানোর সুযোগ দিবে? আর একটিবার আমায় তোমার দুর্বলতা দেখাবে? আর একটিবার আমার প্রতি অনুভূতব পোষণ করবে লক্ষীটি?

ইতি,
বরাবরের মতো সম্বোধনটা আজও ঠিক মাথায় আসছে না

সিয়া হতবিহ্বল দৃষ্টিতর চেয়ে থাকে। কে লিখল এই চিঠি? কেই বা লিখে? বুঝে উঠে না। কৌতুহলটাকে চেপে রেখে চিঠিটা ব্যাগে পুরে যখন বের হবে ঠিক তখনই সেখানে এল সুহা। সুহার চোখেমুখে খুশির আভাস দেখে সিয়া ও হাসে৷ কাঁধে ব্যাগ তুলতে তুলতে বলে,

“ আমাদের স্নিগ্ধর ভাইবোন আসা ব্যাতীত অন্য কোন শুভ খবর ও কি আছে আপু? এত খুশি খুশি দেখাচ্ছে তোমায়? কিন্তু কি কারণে?”

সুহাও মিষ্টি করে হাসল। সিয়াকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে বলল,

“ আজ না গেলে কি হয়? ”

সিয়া হেসে শুধাল,

“ ছুটি একদিন নিয়ে নিয়েছি তো৷ কিন্তু কেন? আজ কি বিশেষ কিছু আপু?কিন্তু কি?”

সুহা হাসল মিষ্টি করে। উত্তরে বলল,

“ আজ বিশেষ কিছু, তবে বিশেষ কি তা সিক্রেট। ”

সিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,

“ সিক্রেট কেন? ”

“সারপ্রাইজ। ”

সিয়া ভাবল। ওর জম্মদিন কি? কিন্তু তেমন কিছু তো নেই আজ। বলল,

“ আজকে তো কিছু নেই আপু। ”

“ নেই তো কি হয়েছে, সারপ্রাইজ থাকতে পারে না? ”

সিয়া এই পর্যায়ে হাসল। বলল,

“ অবশ্যই পারে। আমি অপেক্ষায় থাকলাম সেই সারপ্রাইজের। ”

“ জলদি ফিরো। ”

যেতে যেতে সিয়া বলল,

“ অবশ্যই। ”

.

তখন বিকাল।আশপাশে সুন্দর আবহাওয়া। বসার ঘরে সাদ সহ সাদের পরিবারের লোকজন তখনও অপেক্ষা করছিল সিয়ার আসার জন্য। উদ্দেশ্য সিয়া পর্যন্ত বিয়ের প্রস্তাব রাখা। সুহা, স্বচ্ছ, স্বচ্ছর পরিবারের সকলেই জানে সিয়া কার জন্য এতগুলো দিন অপেক্ষা করেছে। কার জন্য সব বিয়ে ভেঙ্গেছে। কত করে তার পরিবার বুঝিয়েছিল এই ছেলেটাকে ভুলে যেতে অথচ সিয়া নিজের সিদ্ধান্তেই অটুট ছিল৷ আজ যখন সে ছেলেটা নিজের বিয়ের প্রস্তাব রেখেছে তখন তার পরিবারের সবাই না রাজি হয়ে কি করবে? মেয়ের একমাত্র ভালোবাসা!সিয়া মুখে না বললেও এই কারণটা জেনেছিল বহু আগেই তারা। স্বচ্ছকেও আজ খুশি দেখাল। সুহা, স্বচ্ছ সকলেই উপস্থিত।স্বচ্ছ বার কয়েক কল করে সিয়াকে জানালও তাড়াতাড়ি ফিরতে। অতঃপর নিজেই আনতে যাবে কিনা তাও জিজ্ঞেস করল। কিন্তু সিয়া নিষেধ করাতে আর গেল না। সাদ শুধু ঘড়িতে সময় দেখছিল। কোন এক অজানা কারণেই তার বুক ঢিপঢিপ করছে। সিয়া কি আজ রাজি হবে? নাকি নাকোচ করবে বিয়ের প্রস্তাবটা? আচ্ছা, সিয়া কি এখনো তার প্রতি অনুভূতি রেখেছে? নাকি ভুলে বসেছে এই পুরুষটিকে। এই এত এতসব প্রশ্ন যখন মাথায় খেলা করছিল ঠিক তখনই সিয়ার নাম্বারে স্বচ্ছ কল দিল আবারও। অথচ এবারে সিয়া কল তুলল না। তুলল অপরিচিত এক ব্যাক্তি। আর কল তুলেই জলদি জানাল,

“ আপনি মহিলাটির কে হন? মহিলাটার খুবই জঘন্যভাবে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে….”

#চলবে….