নীল প্রহর পর্ব-০২

0
35

#নীল_প্রহর
আফরা নূর

২.

পিহুদের বসার ঘরে দুই পক্ষের বৈঠক বসেছে। আলোচনার বিষয় পিহুর শ্বশুরবাড়ি যাওয়া আর না যাওয়া। এক পক্ষ বলছে এখন নয়। অপর পক্ষ বলছে এখনই। এই নিয়ে দফায় দফায় চলছে তর্ক-বিতর্ক। পিহুর বাবা এখন মেয়ে দিতে রাজি নন। অপর দিকে পিহুর বড় খালা পিহুকে না নিয়ে যাবেন না কিছুতেই। ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে তবেই তিনি বাড়ি ফিরবেন। বড় খালার জেদ দেখে বাবা অসন্তুষ্ট হলেন যেন। তার চোখে মুখে তা স্পষ্টই প্রতীয়মাণ।
-“দেখুন আপা আপনার জেদ আর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে আমি তখন রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু আমি এখন পিহুকে ওই বাড়িতে পাঠাতে চাচ্ছি না।”

-“এসব কি কথা পারভেজ? মেয়ে বিয়ে দিয়ে এখন মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠাতে যাচ্ছো না। এটা তো কোন কথা হলো না। একটু তো ভেবে কথা বলো আর সিদ্ধান্ত নাও।”

-“আমি ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপা। তখন আপনার জেদে আমাকে বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছে৷ কিন্তু এখন আমি যথেষ্ট সন্দিহান যে অভ্র পিহুকে কখনো মেনে নিতে পারবে কি না। ওই মেয়ের কাছে অভ্র যাবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই। এটা আমার মেয়ের পুরো জীবনের ব্যপার।”

-“অভ্রর কাছে পিহুকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। আর অভ্র চাইলেও ওই মেয়ের কাছে যেতে পারবে না তা তুমি খুব ভালো করেই জানো পারভেজ। এসব নিয়ে শুধু শুধু অশান্তি করছো এখন।”

-“আমি শুধু শুধু অশান্তি করছি না। আপনার চাপে পড়ে হয়তো অভ্র এখন পিহুকে মেনে নেবে কিন্তু অভ্র কি কখনো পিহুকে মন থেকে মেনে নিতে পারবে? ভবিষ্যতে অভ্র সুযোগ পেলে ওই মেয়ের কাছে যাবে না তার কি ভরাা আছে? হায়াত-মউতের কথা বলা যায় না। আপনারা, আমরা আজ আছি কাল নেই। আমাদের অনুপস্থিতে অভ্র পিহুকে ঠকাবেনা তার কি নিশ্চয়তা আছে?”

অভ্র পুরোটা সময় চুপ ছিলো। কোন কথা সে বলে নি। নিরবে দুই পক্ষের তর্ক-বিতর্ক দেখে গেছে। এখন রীতিমতো ভদ্রলোক তার চরিত্র নিয়ে কথা বলছে। এতটা খারাপ সময় কবে আসলো লোকে অভ্রর চরিত্র নিয়ে কথা বলছে? অভ্রকে আকারে ইঙ্গিতে চরিত্রহীন প্রমাণের চেষ্টা করছে? তাকে ঠগ উপাধি দিচ্ছে? অভ্র আশ্চর্য না হয়ে পারলো না যেন।
-“আপনি যখন এতই আপনার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান তাহলে মায়ের অন্যায় জেদের কাছে কেন পরাস্ত হলেন খালু? এতই যখন আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানেন তাহলে কেন রাজি হলেন মেয়েকে আমার সাথে বেঁধে দিতে? আপনি এতই যখন জানেন আমি চরিত্রহীন, আমার চরিত্রের ঠিক নেই তাহলে মেয়েকে বেঁধে না দিলেই পারতেন আমার সাথে। তখন মনে ছিলো না এসব? তখন মনে হয় নি আমি সুযোগ পেলেই অপনার মেয়েকে ছেড়ে অন্য একটা মেয়ের কাছে চলে যাব?”

অভ্রর গলার স্বর ঠান্ডা, শীতল। অভ্রর কথা বলার ধরন বলে দিচ্ছে এই মূহুর্তে অভ্র ঠিক কতটা রেগে আছে। অতিরিক্ত রাগে অভ্র কখনোই চিৎকার চেচামেচি করে না। তার গলার স্বর শীতল হয়ে যায়।

-“অভ্র! আমরা কথা বলছি তো। তোকে কে বলেছে মাঝখান দিয়ে কথা বলতে?”
বাবা ধমকে উঠলেন অভ্রকে। অভ্র মাথা নিচু করে লম্বা করে গভীর নিঃস্বাস ছাড়লো দুটো। এটা অভ্রর রাগ নিয়ন্ত্রণে কৌশল।

-“আমি তাখন থেকে তোমাদের কথা শুনেই যাচ্ছি বাবা। কিন্তু এখন আর নিতে পারছি না এসব ড্রামা। অনেক হয়েছে। এবার একটু রেহাই দাও।”

-“আমরা যা করছি তোমার ভালোর জন্যই করছি। ওই মেয়ে তোমার উপযুক্ত নয়। কেন বুঝতে পারছো না ওই মেয়ে ভালো নয়। তুমি ওই মেয়ের সাথে সুখী হবে না কখনও।”

-“তুমি কিভাবে এতটা নিশ্চিত হলে যে পিহুর সাথে সুখী হবো? আচ্ছা তা বাদ দিলাম। একবার ভাবো পিহু আমার সাথে সুখী হবে মা? এত স্বার্থপর কিভাবে হলে? পিহুর দিকটা ভেবে দেখলে না?”

ছেলের কথায় চুপ রইলেন আয়শা আহসান। আসলেই তো তিনি পিহুর দিকটা ভেবে দেখেন নি। স্বার্থপরের মতন শুধু ছেলের কথা ভেবেছেন। শুধু ছেলেকে কাছে রাখার চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা করেছেন ছেলে যাতে ওই ধড়িবাজ মেয়ের কাছে যেতে না পারে। তিনি জানেন পিহু অভ্রকে সুখে রাখবে। কিন্তু পিহু কি পারবে সুখে থাকতে? অভ্র দেবে পিহুকে সুখে থাকতে? এই ছেলের তো রাগের শেষ নেই। আর পিহু এই ছেলের রাগটাই সহ্য করতে পারে না। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এখন এসব ভাবার সময় নয়। যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে।

-“তুমি কি করতে চাচ্ছো এখন?”

-“পিহুকে সময় দাও। এমনিতেই একটা সম্পর্ক ওর উপর চাপিয়ে দিয়েছো। সম্পর্কটাকে মেনে নেওয়ার সময়টাও দাও এখন।”
মায়ের প্রশ্নে অভ্রের সোজা জবাব।

-“বেশ তাহলে পিহু এখানেই থাক। কিন্তু তোমাকে তো আমার বিশ্বাস হয় না।”
ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে শেষের কথাটা বললেন আয়শা আহসান।
মায়ের কথায় অভ্র মায়ের দিকে তাকালো। চোখে চোখ রাখলে। সেই দৃষ্টিতে নেই কোন জড়তা। নেই কোন চতুরতা।
-“চিন্তা করো না। তোমার কন্ট্রাক্ট ভাংবো না। এত পয়সা-কড়ি নেই আমার।”

ছেলের পাল্টা জবাবে চোখ নামালেন আয়শা আহসান। ছেলে এখন তাকে ভুল বুঝলেও তার বিশ্বাস একটা সময় ছেলে বুঝতে পারবে তাকে। বুঝতে পারবে তিনি ছেলের খারাপ চেয়ে কাজটা করেন নি। তিনি ছেলেকে সমসময় সুখী দেখতে চান।

বৈঠক শেষ হলো। পিহুর মনের অবস্থা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো পিহু কয়েকদিন এখানেই থাকবে। কিন্তু অভ্র এখানে আসবে মাঝেমধ্যে। আয়শা আহসান ছেলেকে বিশ্বাস করেন না। বউয়ের চেহারা দেখতে থাকলে মনে থাকবে সে বিবাহিত। ঘরে বউ আছে তার। শুধু অভ্র এবাড়িতে আসবে এমন নয়। পিহুও মাঝে মধ্যে যাবে শ্বশুর বাড়িতে।

রাতের খাওয়া দুই পরিবার একসাথে শেষ করলো। সবাই উপস্থিত থাকলেও পিহু থাকেনি। কয়েকবার ডাকলেও সে আসে নি। পিহুর জ্ঞান ফেরার পর পাশের মসজিদের হুজুর এনে তাদের শরিয়ত মাফিক বিয়ে পড়ানো হয়েছিলো। তার পর যে মেয়ে রুমে গিয়ে খিল দিয়েছে আর বের হয় নি। স্পষ্ট বলে দিয়েছে সে একা থাকতে চায়। কেউ যেন বিরক্ত না করে। তাই তাকে কেউ বেশি ঘাটায় নি। পিহু এমনিতেও ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। ক্ষিধে পেলে সে নিজ থেকেই আসবে।

রাতের খাবার পর্ব চুকিয়ে অভ্ররা যাওয়ার জন্য উদ্ধত হলো। এমন সময় দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো পিহু। হাতে তার সুটকেস। সোজা হেঁটে আসলো সদর দরজার সামনে। তার হাঁটার ভঙ্গি দেখেই বুঝা যাচ্ছে সুটকেসটা যথেষ্ট ভারি। পিহু ঠিকভাবে টানতেও পারছে না এটা।
পারভেজ সাহেব অবাক হয়ে শুধায়,
-“পিহু মা, কি করছো এসব? টানছো কেন সুটকেস? কি আছে এতে?”

-“আমার সব দরকারি জিনিসপত্র।”
পিহুর কাটকাট জবাব।

-“দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”

-“শ্বশুর বাড়ি।”
পিহুর উত্তরে অবাক হলো সবাই। বড় খালা আয়শা আহসান অবাক হলেও পিহুর উত্তরে খুশি হলেন মনে মনে।

-“শ্বশুর বাড়ি মানে?”

-“শ্বশুর বাড়ি মানে শ্বশুর বাড়ি। বিয়ে দিয়েছো শ্বশুর বাড়ি যাবো না?”

-“যাবে তো। কিন্তু এখন নয় কয়েকদিন যাক তারপর যেও।”

-“বিয়ে যেহেতু এখন দিয়েছো শ্বশুর বাড়ি আমি এখনই যাব। আরেকটা কথা আমি এই বাড়ির বাইরে পা রাখার সাথে সাথে তোমাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না। মনে করবে তোমাদের কোন মেয়ে নেই। ছিলো না কোনদিন।”

পিহুর কথায় পারভেজ সাহেব আশাহত হলেন। মেয়েটার তার সবসময়ই বড্ড অভিমানী। এখনের কথাগুলোও যে মেয়েটা অভিমানে বলছে তা তিনি জানেন। তিনি অসহায় চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তিনি তাকে চোখের ইশারায় আশ্বস্থ করলেন। তার চিন্তা কমলো না। পারভেজ সাহেব অনুভব করলেন তিনি প্রচন্ড ঘামছেন। কোনমতে সোফায় বসলেন। পিহু বাবার দিকে তাকালো। তার মন চাইলো বাবাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কান্না করতে। বাবার গলা ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আমাকে তোমার একটু ভালোবাসা দরকার ছিল, বাবা। এত কম ভালোবাসলে কেন?’ কিন্তু সে নিজেকে আটকে রাখল। তার অভিমান তাকে তা করতে দিল না।
পিহুর মা এগিয়ে আসলেন মেয়ের কাছে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-“পারলে আমাদের ক্ষমা করে দিস। আমাদের তখন আর কিছু করার ছিলো না। আমরা তোকে হারাতে চাই না। আমরা তোকে খুব ভালোবাসি পিহু।”

বলেই তিনি আঁচলে মুখ ঢাকলেন। মায়ের কান্না দেখে পিহুরও অনেক কাঁদতে ইচ্ছে করছে অনেক। কিন্তু সে কাঁদবে না। কেন কাঁদবে সে? কাদের জন্য কাঁদবে? পিহুর মনটা আবারো অভিমানে ভরে উঠলো। পিহুর মনে হলো, যেন সে একটা পুতুল। যার চাওয়ার কোনো মূল্য নেই। যার জীবনের সিদ্ধান্ত অন্যরা নিয়ে ফেলেছে। তার বাবার কাছে সে নিজের প্রতি একটুখানি ভালোবাসার আশা করেছিল। কিন্তু বাবাও তাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে এতটাই তাড়াহুড়ো করেছে। যেখানে বাবা তাকে ভালোবাসতে পারল না যেখানে সে আর কিছু আশা করে না।

চলবে…..