#নীল_প্রহর
আফরা নূর
৪.
তখন সবে সকাল হল। বাতাসে জানালার পর্দা গুলো উড়ছে। জানার ফাঁক গলে সূর্যের আলো এসে পড়ছে পিহুর চোখে মুখে। পিহু মুখ কুঁচকালো। আলোটা তাকে খুব বিরক্ত করছে। পিহু নড়েচড়ে উঠলো। তবে ঘুম ভাঙ্গল না তার।
অভ্র গোসল সেরে বেরিয়ে এসে পিহুর বিরক্তি মাখা মুখখানা দেখল। বুঝলো আলোতে অসুবিধা হচ্ছে। অভ্র জনালায় পর্দা টেনে দিল। গুষ্টি সুদ্ধ সবাই জানে পিহু কতটা কুম্ভকর্ণ। ঘুম তার জীবন মরনের সঙ্গী। নাওয়া খাওয়া ভুলে সে ঘুমায়। একটানা ষোল ঘন্টা ঘুমানোর রেকর্ডও আছে পিহুর।
অভ্র একেবারে রেডি হয়ে বের হলো। মা রান্নাঘরে নাস্তা তৈরি করছেন। বাবা সোফায় বসে পেপার পড়ছেন। অভ্র সবসময়ের মতন টেবিলে বসে নাস্তা চাইল।
-“পিহু কোথায়?”
নাস্তা টেবিলে দিতে দিতে জানতে চাইলেন মা।
-“ঘুমায়।”
-“ডাকলি না কেন?”
-“তোমার ভাগ্নি যেমনে কুম্ভকর্ণের মতন ঘুমায়। ডাকলে না আমাকে তুলে আছাড় মারে।”
-“ভালো করেছিস ডাকিস নি। কালকে তো কম কিছু গেল না মেয়েটার উপর দিয়ে।”
অভ্র তাকাল মায়ের দিকে। আদিখ্যেতা দেখলে গা জ্বলে যায়। কালকে তো তার উপর দিয়েও কম কিছু যায় নি। সেই কথা মনে নেই বুঝি?
-“তুই এমন রেডি শেডি হয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
-“অফিসে।”
খেতে খেতেই জবাব দিল অভ্র।
-“এ কী কথা? বিয়ের পরের দিন অফিস কে যায়?”
-“আমি যাই। যাদের জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় তারা যায়।”
-“কোথাও যেতে হবে না আজকে পিহুকে নিয়ে শপিংয়ে যাবি। ওর যা পছন্দ কিনে দিবি। মেয়েটাকে বিয়ের কিছু দেওয়া হয় নি।”
-“আমি পারব না। আমার একটা জরুরি মিটিং আছে।”
-“না বললে তো হবে না। আমি কোন না শুনতে চাই না।”
অভ্র বুঝলো মা শুনবে না।
-“ঠিক আছে। ও ঘুম থেকে উঠলে ওকে রেডি হয়ে থাকতে বলিও। আমি মিটিং শেষ করে ওকে নিয়ে যাব এসে।”
মা এবার থামলেন। ছেলে-মেয়ে দুটোকে এখন বেশি বেশি এক সাথে সময় কাটাতে দিতে হবে। তিনি তো জানেন বিয়ের আগে অভ্র-পিহুর সম্পর্ক কেমন ছিল। নিজপর বেয়াদব ছেলের সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে তার।
পিহুর ঘুম ভাঙ্গলো সকাল এগারোটায়। একেবারে গোসল দিয়ে বাইরে বের হল সে। গোসল না করলে ঘুম যাবে না। পরে দেখা যাবে বসে বসে ঘুমাচ্ছে সে।
পিহুর বের হয়ে এসে দেখল বড় খালা বসে আসেন খাটে। পিহুকে দেখে মিষ্টি হাসলেন। পিহু হাসলো না। মুখ গম্ভীর করে রাখল। বড় খাল ভাবলেন অভ্র ভাই কিছু করেছে হয়ত। এই ছেলেকে তিনি বিন্দু পরিমাণ বিশ্বাস করেন না।
পিহু বারান্দা থেকে রুমে এসে দেখল বড় খালা খাবার নিয়ে এসেছে। পিহু খাটে এসে বসল।
-“খেয়ে রেডি হয়ে নে। অভ্র তোকে নিয়ে একটু পর শপিংয়ে যাবে।”
পিহু এবারও কিছু বলল না। চুপচাপ খেতে থাকল। বড় খালা তোয়ালে নিয়ে পিহুর মাথা মুছতে লাগলেন।
-“রেগে আছিস পিহু?”
-“নাহ্।”
-“তাহলে কথা বলছিস না কেন, মা?”
পিহু নিরব।
-“এখন তোদের মনে হতে পারে আমরা যা করেছি তা ভুল বা অন্যায়। কিন্তু তোদের ভালোর জন্য এটা ছাড়া আর উপায় ছিল না কোন। দেখিস অভ্র তোর কিচ্ছু হতে দেবে না। তোকে সব বিপদ থেকে বাঁচাবে।”
পিহু কিছু বলল না। তার মাথায় অন্য চিন্তা। কালকে সে এত ভাবে নি। কিন্তু এখন ভাবছে। কিছু একটা হয়েছে যার জন্য সবাই এমন করে বিয়েটা দিয়েছে। কালকেও বলেছিল বাবা-মা ভয় পেয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছে। আর আজকে খালা বলছে অভ্র পিহুকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাবে। কী এমন বিপদ তার?
বড় খালা আরও অনেক কথা বললেন। পিহু সেসব শুনলো না কি বুঝা গেল না। সে আছে নিজের ভাবনায়। এখন নাকি আবার বিরক্তিকর লোকটার সাথে শপিংয়ে যেতে হবে। কী এক মুসিবত! পিহু কোনদিন নিজের শপিং করে নি। মা নয়ত ভাই তার সব কেনাকাটা করে। মাঝেমধ্যে বাবাও করে। বাড়ির সবার কথা মনে হতেই পিহুর মন খারাপ হল। ভাইয়া এখনও জানে না বিয়ের কথা। জানলে আর রক্ষা থাকবে না। সে বাড়িতে নেই। অফিশিয়াল কাজে দেশের বাইরে আছে। ভাই কাছে থাকলে পিহুকে ঠিল রক্ষা করত। আগলে রাখত। ভাইকে খুব মিস করছে পিহু। ফোনটা কাছে থাকলে কথা বলা যেত। কালকে তো রাগ করে ফোনটা সাথে আনা হয় নি।
পিহু নাস্তা করে রেডি হয়ে নিল। অভ্র ভাইও চলে এসেছে। পিহু বের হতেই বড় খালাকে বলে তারা বের হল।
অভ্র ড্রাইভ করছে। পাশে চুপচাপ বসে আছে পিহু। মুখে রা নেই। পরিবেশটা কেমন যেন পানসে।
-“কী কী কিনবি লিস্ট করেছিস?”
-“না।”
বিরক্ত হল অভ্র। এমনিতেই মেয়ে মানুষের শপিংয়ে সময় লাগে। তার উপর নাকি সে জানে না কী কিনবে। এই মেয়ে আসলেই কোন কাজের না।
প্রায় চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই তারা শপিং মলে পৌছাল। যেহেতু পিহু জানে না কী কিনবে তাই তার শপিংয়ের গুরু দায়িত্বটা অভ্র নিজ কাঁধে তুলে নিল স্বইচ্ছায়। এই মেয়ের আশায় থাকলে এখানেই ভোর হবে।
তারা প্রথমে গেল শাড়ির দোকানে। নতুন বউয়ের শাড়ি না হলে চলে? দোকানী বেশ কয়েকটা শাড়ি দেখালো। পিহুর একটাও পছন্দ সই হলো না যেন। সে শুধু উল্টে পাল্টে দেখছে।
-“তুই কী এই কজটাও পরিস না?”
অভ্রর কণ্ঠে বিরক্তির অভাস। ঠোঁট ফুলালো পিহু। নিচের ঠোঁটটা খানিক উল্টিয়ে বললো,
-“আমি আগে কখনো নিজের জন্য শপিং করি নি।”
হতাশ হলো অভ্র। এই মেয়ে আস্ত একটা ফার্মের মুরগী। ব্রয়লার মুরগীকে মালিক যেভাবে পালে পিহুকেও ছোট খালা ওইভাবেই পেলে বড় করেছে। সে নিজ হাতের ঠিকঠাক খেতে পারে না। এই মেয়ে হাতে পায়ে বড় হলেও বুদ্ধি সুদ্ধি হয় নি কিছু। অভ্র বুঝল তার ভবিষ্যতে আলোর থেকে অন্ধকার বেশি। এর সাথে পথ চলতে বেশ কষ্টই হবে তার। বাট হি লাভস এডভেঞ্চার! বিপরীত বৈশিষ্ট্যর মানুষ সর্বদাই আকর্ষণীয় হয়।
অভ্র নিজে পছন্দ করে পিহুকে তিনটা শাড়ি কিনে দিল। পিহু শাড়ি সামলাতে জানে না। সামলাতে জানলে হয়ত আরও দুয়েকটা নিয়ে নেওয়া যেত। তারা শাড়ির দোকান থেকে গেল থ্রি-পিসের দোকানে। পিহু বেশ করেকটা থ্রি-পিস কিনল। বলা বাহুল্য এগুলোও অভ্রই কিনেছে পছন্দ করে। পিহু শুরু ঘাড় নেড়েছে। এই মেয়ের মনে হয় ঘাড় নাড়ার রোগ আছে। ডাক্তার দেখিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হবে। অভ্র আহসানের বউয়ের ঘাড় নাড়ার রোগ থাকবে তা ভালো দেখায় না। অন্য রোগ থাকলেও মানা যেত। অভ্র পিহুকে কয়েকটা ওয়ান পিছও কিনে দিল। সাথে বরোটা মতন হিজাব। পিহু আবার ফুল হিজাবি কন্যা৷ ভন্ড হলেও হিজাব ছাড়া বাইরে বের হয় না।
জামা কাপড় কেনা শেষ হলে তারা গেল জুতা কিনতে। এবার পিহুকে কিছুটা আগ্রহী দেখাল। সে নিজ থেকেই জুতা দেখছে। কোন জুতা চোখে লাগলে অভ্র দিকে তাকাচ্ছে এপ্রুভালের জন্য। পিহু একে একে তিন জোড়া জুতা কিনল। নিজের পছন্দে। জুতার প্রতি তার একটা অবসেশন আছে। বাসায় তার দশ জোড়ার মতন জুতা রয়েছে। বাসা থেকে বের হলেই তার জুতা কিনতে মন চায়।
অভ্র পিহুকে নিয়ে এবার গেল জুয়েলারি দোকানে। পিহু যেতে চায়নি৷ অভ্র তাকে ধমকে নিয়ে গেছে। অভ্র পিহুকে একটা চিকন স্বর্ণের চেইন কিনে দিল। চেইনের নিচে ছোট্ট একটা লকেট। সাথে একটা ছোট নাকফুলও নিল অভ্র। মেয়ের যা অবস্থা এসব না পরে থাকলে কেউ বুঝবে না সে বিবাহিত। পড়ে অনার্সে আর দেখে মনে হয় স্কুলের গন্ডিও পেরোয়নি বুঝি।
সব কেনাকাটা শেষ করে পিহু আর অভ্র ফুড কোডে গেল। ঘুরে ঘুরে কেনা কাটা করে দুইজনই ক্ষুধার্ত। তারা একেবারে খেয়েদেয়ে সন্ধ্যা করে বাড়ি ফিরল। অভ্র পিহুকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আবার কোথায় যেন চলে গেল। বড় খালা নারাজ হল খুব। ভাবল ওই মেয়ের কাছে গিয়েছে। অভ্র অবশ্য কথা দিয়েছে ওই মেয়ের কাছে যাবে না আর। তবে পুরুষলোকের কী ভরসা?
চলবে…..