নীল প্রহর পর্ব-০৯

0
47

#নীল_প্রহর
আফরা নূর

৯.
মাঝখানে চলে গেল অনেকগুলো দিন। বাবা-মায়ের সাথে এখনও কথা বলে না পিহু। বাবা-মা কয়েকবার এসে দেখে গেছে তাকে। সে কথা বলে নি তাদের সাথে। অপরদিকে পিহু আর অভ্রর সম্পর্কটাও আগের মতই শীতল। কোন উন্নতি নেই। তবে উনিশ থেকে বিশ হলেই একজন আরেক জনের থেকে প্রতিশোধ খুব ভালো নেয়। মাঝেমধ্যে পিহু ব্যর্থ হলেও অভ্র হয় না। সব কাজে পারফেক্ট কিনা! পিহুর পরীক্ষা শেষ হয়েছে বেশ কয়েক দিন হয়েছে। একটা পরীক্ষাও তার ভালো হয় নি। পাশ করবে কী না তা নিয়ে মেয়েটা যথেষ্ট সন্দিহান। পড়ালেখা না করলে যা হয়। পিহু ঠিক করেছে এই সেমিস্টার থেকে সে মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। আর কোন ফাঁকিবাজি নয়। সিরিয়াস হবে সে। ক’দিন যাবত নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ছে সে। আল্লাহ্ তায়ালা একটা মিরাক্কেল করে যদি পাশ করিয়ে দেয়। পিহুর এমন ভক্তি দেখে অভ্র উঠতে বসতে তাকে তাচ্ছিল্য করে৷ মিটিমিটি হাসে। পরীক্ষার খাতায় কিছু না লিখলে মিরাক্কেলটা হবে কোথায়? পিহু অবশ্য এসব গায়ে মাখে না। চিন্তায় চিন্তায় তার নাজেহাল অবস্থা। ফেইল করলে অভ্র তার মান সম্মান রাখবে না কিছু। নিজের মান-সম্মান অক্ষত রাখতে পাশের বিকল্প নেই।
আজকে সকালবেলাও অভ্র পিহুকে খুঁচিয়ে অফিস গেছে। পিহু লোকটার উপর যথেষ্ট বিরক্ত। নিজে টপার ছিল বলে ব্যকবেঞ্চার পিহুকে সে গোনায় ধরে না। পিহু অভ্রকে শিক্ষা দেওয়ার পায়তারা করল। এভাবে চলা যায় না। পিহু ওয়াশরুমে গেল। তার আর অভ্রর জিনিসপত্র আলাদা আলাদা সাজানো। অভ্র নিজের জিনিস পিহুর জিনিসের সাথে রাখে না। এমন ভাব করে পিহুর ছোঁয়াছে রোগ আছে কোন। পিহু মুখ ব্যাঁকাল। ব্যাটা বেয়াদব লোক একটা। পিহু অভ্রর তোয়ালেতে কালো রঙ মিশিয়ে দিল। তারপর তোয়ালেটা উল্টে রাখল। এবার বুঝবে মজা। পিহুর সাথে লাগতে আসে।
নিজের কাজ শেষ করে পিহু বাইরে গেল। মাথা ধরেছে ভীষণ। এক কাপ চা হলে মন্দ হবে না। পিহু রান্নাঘরে যাওয়ার আগে বড় খালার ঘরে উঁকি দিল। এখনও আসে নি তারা। বড় খালা আর খালু গেছেন খালুর বোনের বাড়িতে। উনার শ্বাশুড়ি অসুস্থ তাই।
একা একা ভালো লাগছে না পিহুর। করার মতন কিছু নেই। পিহু ফোন বের করে তার বান্ধবী প্রিয়াকে ফোন করল। জানতে পারল রেজাল্ট দিয়েছে আজকে। একটু আগেই দিল। ফোন কেটে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল সে। রেজাল্ট ফোল্ডার ওপেন করতে মন চাইছে না তার। বুকটা দুরুদুরু করে কাঁপছে । পিহু অনেক সাহস জুগিয়ে রেজাল্ট ফোল্ডার ওপেন করল। সাথে সাথেই চেচিয়ে উঠলো,
-“ইন্না-লিল্লাহ।”
অভ্র তখন রুমেই আসছিল। পিহুর কণ্ঠ শুনে বিচলিত হল সে। তড়িঘড়ি করে রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছে পিহু? ফুফুর শ্বাশুড়ির কিছু হয়ে গেছে? মরে গেছে?”

পিহু মাথা নাড়িয়ে না বুঝাল।
-“তাহলে এভাবে চিল্লাছিস কেন তুই? কে মরেছে? তোর প্রেমিক? তোর বিরহে সুইসাইড করেছে?”

পিহু ছলছল নয়নে একবার অভ্রর দিকে আরেকবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। অভ্র কিছুই বুঝল না। সে পিহুর ফোনটা হাতে নিল। ফোনের স্ক্রিনে রেজাল্ট শীট ঝলঝল করছে। অভ্র পিহুর নাম খুঁজে বের করল। স্পষ্ট দেখতে পেল ফারাবিয়া হাসান পিহু চার সাবজেক্টে ফেইল। অভ্র পিহুর দিকে তাকাল।
-“কয় সাবজেক্ট পরীক্ষা দিয়েছিলি রে?”

-“ছয়।”
আলতো স্বরে বলল পিহু।

-“আলহামদুলিল্লাহ। দুইটায় পাশ করেছিস। তোকে নিয়ে আমার গর্ব হচ্ছে রে পিহু। আমি তো ভেবেছিলাম অল সাবজেক্টে ফেইল করবি। আমি ভাবতে পারি নি তুই এভাবে আমাকে ভুল প্রমান করবি।”
পিহু অভ্রর খোঁচা স্পষ্ট টের পেল। সে মুখ লুকানোর জায়গা পেল না। অভ্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পিহুর রেজাল্ট শীট দেখছে। কেমিস্ট্রিতে পেয়েছে তিরিশ! একশোতে একটা মানুষ তিরিশ কেমনে পায় অভ্র বুঝল না। তাও একটা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট! অভ্র হতাশ হলো।
-“শোন, তোর রিটেকের টাকা তোর বাপকে দিতে বলবি। কোন ফেলুর পিছনে আমি টাকা নষ্ট করতে পারব না। এগুলো আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কামাই করছি আমি।”
অভ্র একটু থামল। তারপর আবার জানতে চাইল,
-“আচ্ছা এই পর্যন্ত তোর সর্বোচ্চ সিজি কত রে?”

-” থ্রি পয়েন্ট।”
মিনমিন করে বলল পিহু

-“তোর সর্বোচ্চ সিজি আমার সর্বনিম্ন সিজির আশেপাশেও নেই। হাহ্, এই ছিল আমার।কপালে?”
আবারো অপমান। এত অপমান নেওয়া যায়? পিহুর ইচ্ছে করছে অভ্রর গলা চেপে ধরতে। পিহুর চোখ দুটো তখনও ছলছল করছে। অভিমানে মনটা ভরে উঠছে। বাবা-মাকে বলতে ইচ্ছে করছে, জোর করে যখন বিয়ে দিয়েছিলে একটা রিক্সাওয়ালার কাছে দিতে পারলে না? তখন অন্তত এমন উঠতে বসতে অপমানিত হতে হতো না।
অভ্র হয়ত পিহুর অবস্থাটা বুঝল। তাই আর বেশি কিছু বলল না। সে চলে গেল ফ্রেশ হতে। যাওয়ার আগে বিটকেল মার্কা হাসি দিতে ভুলল না যেন।
অভ্র ওয়াশরুমে গেলে পিহু শয়তানি হাসি দিল। এবার বুঝবে চান্দু মজা। পিহু হাসিমুখে অভ্রর জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। মিনিট বিশেক পর অভ্র হেলেদুলে বেসুরো গলায় গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে আসল। না তার কিছুই হয় নি। তার চেহারা আগের মতই ধবধবে ফর্সা রয়ে গেছে। তার মানে অভ্র অন্য তোয়ালে ব্যবহার করেছে। পিহুর মনটা আবারো বিষিয়ে উঠল। ভাগ্য তাকে এখনেও ছোবল দিয়ে দিল! আজকে তার দিনটাই খারাপ।

সন্ধ্যায় খালা আর খালু ফিরে আসলেন। পিহুকে ডাকলেও পিহু বের হয় নি। এই মুখ কিভাবে দেখাবে সে? সবাই কী বলবে? নতুন বউ ছয় বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে সাফল্যের সাথে চার বিষয়ে ফেইল করেছে? পিহু সারাক্ষণ রুমেই থাকল। রুমে থেকেও শান্তি নেই। একটু পর পর অভ্র রুমে আসছে আর তাকে দেখে হাসছে।

-“পিহু, খেতে আায়। খাবার দিয়েছি।”
ডাকলেন বড় খালা। এখন বের না হয়ে উপায় নেই। গর্ত থেকে তাকে বের হতেই হবে এখন। কিচ্ছু করার নেই। পিহু চোখে মুখে পানি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বের হল। টেবিলে অভ্র ভাই আর খালু বসা। খালা খাবার বাড়ছে। পিহু একটা চেয়ার টেনে বসল। খালু আর অভ্র ভাই ব্যবসায়ীক কয়েকটা আলাপ করল। পিহু একটু স্বস্তি পেল অভ্র এসব কথা কাউকে বলে নি। কিন্তু তার সেই স্বস্তি বেশিক্ষণ টিকল না।
-“পিহু মা, তোমার নতুন সেমিস্টার কবে থেকে শুরু? রেজাল্ট দেয় নি এখনও?”
পিহু অভ্রর দিকে তাকাল। অভ্রও পিহুর দিকে তাকাল। তারপর কুটিল হেঁসে বলল,
-“মাশাল্লাহ, আমাদের পিহুরাণী ছয় বিষয় পরীক্ষা দিয়ে চার বিষয়ে ফেইল করেছে।”

বড় খালা আর খালু দু’জনেই পিহুর দিকে তাকালেন। পিহু মাথা নিচু করে বসে আছে। উনারা বুঝতে পারলেন পিহু মন খারাপ করেছে।
-“পাশ ফেইল কোন বিষয় না বুঝলে। ফেইল আছে বলেই পাশের এত দাম। যারা পাশ করে তাদের উচিত ফেইল করাদের ট্রিট দেওয়া। তারা না থাকলে পাশের কদর থাকত না।”
বললেন বড় খালু। অভ্র মুখ ব্যাঁকাল। এমন আদিখ্যেতা দেখলে গা জ্বলে যায় তার।

-“পিহু, মন খারাপ করিস না তো। আমিও জীবনে কত ফেইল করেছি। এগুলো নিচের নাতি-নাতনীদের গল্প শুনানোর জন্য রেখেছি। তুইও শুনাতে পারবি। আরে নিজের নাতি-নাতনীদের শুনানোর জন্য রোমাঞ্চকর গল্প না থাকলে হয় নাকি?”
সবাই পরিবেশটা স্বাভাবিক করতে চাইলেন। বিষটা এমন নয় পিহু এই প্রথম ফেইল করেছে। ফেইল সে দুইদিন একদিন পর পরেই করে। সে এটাতে অভ্যস্ত। সে তো অভ্রর অপমানের জন্য মুখ ফুলিয়েছে। এই কথা অভ্র ব্যাটা বুঝলে হয়! পিহুর মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয় অভ্র প্রেম কেমনে করেছে? এই লোক মেয়ে মানুষের মন বুঝে না। আর না বুঝে মান-অভিমান। আলিজার মতন মেয়ে অভ্রকে দুই বছর সহ্য করেছে ভাবতেই গা গুলায় পিহুর। আলিজাকে পিহু দেখতে পারে না। আলিজার সাথে পিহুর সিরিয়াস ঝামেলা হয়েছে দুয়েকবার। আর সেটা অবশ্যই অভ্রকে নিয়ে!

রাতটা এভাবেই পার হল। অভ্র পিহুকে একটু পর পর জ্বালিয়েছে। থেকে থেকে নিজের ভার্সিটি লাইফের সকল এচিভমেন্ট বলে উঠছে। পিহু এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে কানে তুলা গুজল। অভ্র বিশ্ব জয়ের হাসি দিয়ে ঘুমাতে গেল। বুঝাই যাচ্ছে আজকে তার ঘুমটা বেশ ভালো হবে।

****
পরদিন সকাল এগারোটা। পিসিতে চোখ রেখে তুমুল বেগে কিবোর্ডে আঙ্গুল চালাচ্ছে অভ্র। অন্য কোন দিকে তার মন নেই। এমন সময় দরজা ঠেলে প্রবেশ করল একজন নারী। সোজা এসে দাঁড়াল অভ্রর সামনে। অভ্র তুলে একবার তাকাল। তারপর চোখ বন্ধ করে ঢোক গিলল একটা।
-“আলিজা…!

চলবে….