নীল প্রহর পর্ব-১০

0
47

#নীল_প্রহর
আফরা নূর

১০.
আলিজাকে দেখে অভ্রর ভেতরের অসহায়ত্ব বাড়ল যেন। অনুশোচনা বাড়ল কয়েকগুণ। সামনের মিষ্টি মেয়েটাকে সে ঠকিয়েছে ভাবতেই পৃথিবীটা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে অভ্রর। এই মেয়েটা এগুলো ডিজার্ভ করে না। শী ডিজার্ভ অল দ্যা হ্যাপিনেস!
-“আলিজা…
অভ্র ভাঙ্গা গলায় ডাকল। আলিজা তাকিয়ে আছে অভ্রর দিকে। দাঁড়ি গুলো আগের তুলনায় বড় হয়েছে বেশ। ছাঁটে না মনে হয় অনেকদিন। তবে তাতে যেন ছেলেটার সৌন্দর্য কমল না এক ফোঁটাও। বাড়ল কয়েকগুণ। আলিজা বুঝে পায় না একটা ছেলেকে এত সুন্দর কেন হতে হবে। আলিজা যেন অভ্রে অপলকে দেখে চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।

-“আমার ফোন তুলছিলে না কেন অভ্র? ইজ এভ্রিথিং অলরাইট? তুমি ঠিক আছো?”
জানতে চাইল আলিজা।

-“দেশে কবে এসেছো?”

-“কালকে রাতে।”

-“তুমি বসো। আমি তোমাকে চা দিচ্ছি।”
আলিজা বসল। অভ্রর হাতের চা তার ভীষণ প্রিয়। এত ভালো চা বানায় ছেলেটা। মনে হয় তার হাতের চা খেয়েই জীবন পার করে দেওয়া যাবে। কিয়ৎক্ষণ পরেই অভ্র চা দিল আলিজাকে। চায়ে একটা চুমুক দিতেই আলিজার মনটা ভালো হয়ে গেল। অভ্রর হাতে বোধহয় জাদু আছে। এই যে এক চুমুকেই তার সকল ক্লান্তি, সকল অবসাদ কর্পূরের মতন উবে গেল। আলিজা চায়ে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে আর অভ্রকে দেখছে। অভ্র মাথা নিচু করে রেখেছে। আজকের অভ্রকে অচেনা লাগছে তার কাছে। আগের অভ্র সবসময় তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলত। আজকে ছেলেটা তার দিকে তাকাচ্ছে অবদি না। কী হয়েছে তার?
-“অভ্র..!”

-“হুম”
আনমনে জবাব দিল অভ্র। সে এখনো ভালো করে তাকায় নি আলিজার দিকে। ভেতর থেকে কিছু একটা তাকে বাঁধা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আলিজার দিকে তাকানেটাও তার জন্য পাপ।

-“আমার দিকে তাকাচ্ছো না কেন অভ্র? অভিমান করেছ? কিন্তু কেন? কী করেছি আমি?”

অভিমান? অভ্র হাসল। সে অভিমান করে নি। সে তো পাপ করেছে। একজনের ভালোবাসা পায়ে ঠেলে আরেকজনে বিয়ে করে ঘর বেঁধেছে।
-“আলিজা তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।”

-“বল না অভ্র। কতদিন আমি তোমার কথা শুনি না।”
মেয়েটার তৃষ্ণা টের পেল অভ্র।

-“আমি তোমায় ঠকিয়েছি আলিজা।”
কোন ধরনের ভনিতা ছাড়াই বলল অভ্র। আলিজা শব্দ করে হাসল। তার অভ্র তাকে ঠকাবে? এটা বিশ্বাস করার মতন কথা? অভ্রটা সবসময় মজা করে।

-“এত দিন পর দেখা হয়েছে তুমি কোথায় ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করবে। তা না করে ঠাট্টা করছো। তুমি শুধরালে না অভ্র।”

আলিজা হেসে চায়ে মন দিল।

-“আমি বিয়ে করেছি।”
আলিজা এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল অভ্রর দিকে। অভ্রর মাথা তখনও নিচু। যেন সে মস্ত বড় অপরাধ করেছে। এবার আর আলিজার মনে হল না অভ্র মজা করছে।

-“তুমি মজা করছো?”

-“না। আ’ম সিরিয়াস।”

আলিজা এবার শব্দ করে টেবিলে কাপখানা রাখল। উঠে দাঁড়াল ত্বরিতে। তার শরীর কাঁপছে। রাগে হয়ত।

-“তোমার মা এসব করেছে তাই না? তুমি তোমার মায়ের কথায় আমাকে ধোঁকা দিয়েছ?”
কথা বলতে বলতে আলিজার কাঁপুনি বাড়ল যেন। অপরদিকে অভ্র তাকিয়ে আছে আলিজার দিকে। ও কিভাবে জানে মা কী করেছে না করেছে? দেখা হয়েছে বা কথা হয়েছে মায়ের সাথে? কই মা তো তাকে কিছু বলে নি।

-“তুমি আমার সাথে এমন করতে পার না অভ্র। তুমি আমাকে ঠকাতে পার না। তুমি শুধু আমার। তুমি আর কারো হতে পার না। তুমি এটা করতে পার না।”
আলিজা পাগলের মতন আচরণ করছে। এক পর্যায়ে আলিজা জ্ঞান হারিয়ে চেয়ারে ঢলে পড়ল। অভ্র আলিজাকে ধরতে গিয়েও ধরল না। পিহুর মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। পিহু! তার বিয়ে করা বউ। সে হয়ত পিহুকে ভালোবাসে না। কিন্তু তার অধিকার নেই পিহু ছাড়া পরনারীকে স্পর্শ করার। যে চায় না আরও একটা মেয়েকে ঠাকতে।
অভ্র দুজন লেডি স্টাফকে ডেকে অনল। তারা ধরাধরি করে আলিজাকে অফিসের মেডিক্যাল রুমে নিয়ে গেল। অভ্র আসিফকে ফোন করেছে। আসিফ আসছে।

অভ্রর কেবিনে বসে আছে আসিফ আর অভ্র। আসিফ আলিজাকে ঔষধ দিয়েছে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে তার।
অভ্র মাথা নিচু করে বসে আছে। আসিফ অভ্রকে সত্যিটা বলে দিতে চাইল। পরক্ষণেই মনে পড়ল তার কাছে প্রমাণ নেই। প্রমাণ ছাড়া অভ্র এতকিছু বিশ্বাস করবে না। প্রমান দেখলেও যে কতটা বিশ্বাস করবে তাও বলা যাচ্ছে না।
অভ্র কিছুক্ষণ এভাবেই বসে থাকল। তারপর উঠে দাঁড়াল।
-“কোথায় যাচ্ছিস?”

-“দেখি আলিজার জ্ঞান ফিরল নাকি।”

আসিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
-“চল।”
এমন সময় অভ্রর কল আসল। মা কল দিয়েছেন। তারাতাড়ি বাসায় যেতে বলেছেন। পিহুর ভাই পিয়াল এসে ঝামেলা করছে অনেক।
অভ্র আর আলিজার কাছে গেলো না। পা ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে। আসিফ খুশি হল বটে। আসিফও আর গেল না। জ্ঞান ফিরলে বাড়ি চলে যাবে ক্ষন। আসিফ মুখ ব্যাঁকাল।
***
অভ্র বাড়ি এসে দেখল সবকিছু স্বাভাবিক।কোথাও কোন হইচই নেই। পিয়াল সোফায় বসে বাবার সাথে খোশগল্প করছেন। পাশে ছোট খালুও আছেন।
-“অভ্র, এসেছিস?”

অভ্র মায়ের দিকে তাকাল।
-“এই না বললে ঝামেলা হচ্ছে। কোথায় ঝামেলা? এখানে দেখি কমেডি শো চলছে।”

-“এত কুটনা কেন রে তুই? শান্তি পছন্দ হয় না?”

-“কথা না ঘুরিয়ে বল মিথ্যা কেন বললে?”

-“মিথ্যা কখন বললাম? তখন পিয়াল আসলেই চেচামেচি করেছিল অনেক। ওকে শান্ত করা যাচ্ছিল না। তাই তোকে ফোন দিয়েছিলাম।”

-“এখন শান্ত হল কিভাবে?”

-“তোর বাবা আর খালু মিলে কান পড়া দিয়েছে।”
অভ্র বুঝল না তারা কী এমন কান পড়া দিয়েছে যে ষাড়টা শান্ত হয়ে গেছে? পিয়ালকে অভ্রর কাছে ষাড় ছাড়া কিছু মনে হয় না। আচরণ ষাড়ের মতই।

-“এসেছিস যখন তাহলে লাঞ্চটা করে যাস সবার সাথে।”
অভ্র মাথা নেড়ে ঘরে গেল। পিহু ঘরে নেই। বারান্দা থেকে গুনগুন শব্দ আসছে। অভ্র বারান্দায় উঁকি দিল। পিহু গান গাইছে বসে বসে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে ফ্লোরে। মনে হয় আজকে প্রেমিকটাকে একটু বেশি মনে পড়ছে। আহারে বেচারি পিহু! আহারে বেচারা অভ্র!
***
কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসে আলিজার। এখানে আর কেউ নেই। সে একাই। আলিজা তাচ্ছিল্য করে হাসল। বিয়ে করেই বউ পাগল হয়ে গেছে অভ্র! তার কাছে দুদণ্ড বসার ফুরসত তার নেই। আলিজা আশা করেছিল অভ্র তার পাশে বসে থাকবে। যতক্ষণ না তার জ্ঞান ফিরে। কিন্তু তা হল কই? চলে গেছে বউয়ের কাছে। আলিজা এটা মানতে পারছে না সে ছাড়া কোন মেয়ে অভ্রকে স্পর্শ করবে। তাদের এতদিনের সম্পর্কে অভ্র শুধু তার হাত ধরেছে। তাদের মধ্যে কোন অন্তরঙ্গ মূহুর্ত তৈরি হয় নি। অভ্র সবসময় তাদের মাঝখানে এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে রাখত।
আলিজার মনটা আরো বিষিয়ে উঠল যেন। তার মাথায় রক্ত চড়ে বসেছে। সে দেরি করল না। নিজের ব্যাগটা খুঁজল। পেয়েও গেল টেবিলের উপর। মেডিক্যাল রুম থেকে বেরিয়ে অভ্রর খোঁজ করে জানতে পারল সে বাড়ি চলে গেছে। আলিজা রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করল। একে তো তাকে ঠকিয়েছে। তারপর তাকে এমন অবস্থায় ফেলে চলে গেছে। এর প্রতিদান অভ্র আহসানকে দিতে হবে। অভ্র আহসানের সাথে সাথে তার বউকেও এর মূল্য দিতে হবে। এত সহজে ওরা ছাড় পাবে না।

**
দুপুর আড়াইটার দিকে তকলে খেতে বসেছে। খেতে খেতে সকলের মধ্যে বিভিন্ন কথা হল। এর মধ্যে পিয়ালের সাথে অভ্রর আলদা করেও কথা হল। এই দুই ভাই বোন অভ্রর দু’চোখের বিষ। দেখলেই চোখ জ্বলে তার। লাঞ্চ করে অভ্র আবার বেরিয়ে গেল। সবাই একটু মনঃক্ষুণ্ন হল যেন। নতুন বিয়ে করেছিস ঘরে বউ নিয়ে দোর দিয়ে থাকবি তা না করে টোটো কোম্পানির ম্যানেজার হয়ে ঘুরে বেড়াস! ঘুরে যখন বেড়াস বউকে নিয়ে যেতে পারিস না? না বউকে কেন নেবে সে? সে তো নেবে আসিফকে! ভাবখানা এমন পিহু নয় আসিফই যেন তার বউ।

চলবে….