আমার বধু পর্ব-০৭

0
1

#আমার_বধু!
#আফসানা_ইমরোজ_নুহা
#পর্ব_০৭

দিনরাত প্রকৃতির নিয়ম। নিয়ম কে সামনে রেখেই দিন কাটলে রাত হবে‌, আবার রাতের পর দিন হবে। এতটুকু অবশ্যই স্বাভাবিক। তবুও এই সামান্য স্বাভাবিকতা হঠাৎ হঠাৎ কারো জীবনে অস্বাভাবিকতার বন্যা নিয়ে আসে। আজকে কারো খাতায় তন্নীর নাম। মোটেই আজকের রাতটা তার জন্য স্বাভাবিক না। কিছুটা অসামান্য বটে! তন্নী সেই বিকেল থেকে কাঁপছে ঠকঠক করে। সবাই চলে যাওয়ার পর থেকে। নুরজাহান আরো হাজার খানেক কথা বলে গেছেন। মেয়েটা একপ্রকার অস্বস্তি, লজ্জায়, আর ভয়ে মিশে যাচ্ছে। এখানে সে একা। কেবল একা। রাত বোধহয় তখন দশটার উপরে। জানালাটা খোলা ঘরের। তন্নী চুপচাপ বিছানার মাঝখানে বসে আছে। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভুতি। সবকিছু নিরব, খা খা করছে। বাড়ির পেছনে, তৃনয়ের ব্যালকনির থেকে একটু দুরে একটা ডোবা। ময়লা পানি‌। বিশাল বড়বড় কচুরিপানার গাছ, কচু গাছ, হেলেঞ্চার ঝোপ। তন্নী বিকেলে দেখেছিল। সেখান থেকে ঝি ঝি পোকার আওয়াজ আসছে। তাছাড়া বাকী সব নিস্তব্ধ, পাতাল পুরীর ন্যায়। তখন দরজার দিকে মৃদু শব্দ হলো। সেই আওয়াজে ঘোমটার নিচে তন্নী আরেকবার কেঁপে উঠলো। খটখট শব্দ তুলে এগিয়ে এলো তৃনয়। বুক সমান ঘোমটা টেনে বসেছে‌। মেয়েটার গরম লাগে না? তৃনয় বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো,

“ গরম লাগছে না? ”

তন্নী মাথা দোলালো। অর্থাৎ গরম লাগছে। তৃনয় আবারও বললো,

“ তাহলে ঘোমটা দিয়েছো কেনো? তাও এতো বড় করে? ”

তন্নী পড়েছে মহা মুশকিলে। সে জবাব দিল না অনেকক্ষন। তারপর আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,

“ তোমাকে আমি তুমি করে ডাকি? ”

প্রশ্ন শুনে তৃনয় ভ্রু কুঁচকায়। আসলেই এটা পাগল। সে বিছানায় হেলেদুলে বসলো। খাটটা নড়ে উঠলো একটু। তন্নী আরেকটু গুটিয়ে গেল।

“ ডাকবে। সমস্যা কি? তুমি অলরেডি আমাকে তুমি বলেই ডেকেছো। ”

তন্নী কতক্ষন মনে করার চেষ্টা করলো। তারপর বিফল হলো। বললো,

“ কখন? ”

“ গাড়িতে। ”

সে আরেকটু সময় চুপচাপ থাকলো। হঠাৎ করেই তৃনয়কে দেখতে মন চাইছে। লোকটা এখনো তার ঘোমটা সরাচ্ছে না কেনো? কথা খুঁজে না পেয়ে সে আবার বললো,

“ শিলা বলেছিল আপনি ডাকে সম্মান বেশি? ”

তৃনয় ওকে সময় নিয়ে বোঝায়,

“ সম্মান ডাকে থাকে না। সম্মান বোঝা যায় আচারে আচরণে। তুমি আমাকে তুমি বলছো মানে অসম্মান করছো না। এটা তোমার কমফোর্টেবল ম্যাটার। এসব নিয়ে কখনো ভাববে না। সম্মান মন থেকে আসে। কাছের মানুষকেই সহজে তুমি বলা যায়। বুঝেছো? ”

তন্নী ভীষণ খুশি হলো। তার বর বুঝদার আছে‌। খুব সুন্দর কয়েকটা কথায় ওর সমস্ত অস্বস্তি শুষে নিল কেমন! কিন্তু কথা বললো না। আঁচলের তলায় তার মুখের প্রতিক্রিয়া তৃনয় বুঝলো না। সে একটা বালিশ পিঠের পেছনে ঠেকিয়ে বিছানার হেড বোর্ডে হেলান দিল। তন্নী কে আদেশ করলো,

“ ঘোমটা তোলো! ”

তন্নী বোকা বনে গেল। বউয়ের ঘোমটা তো স্বামী তুলবে। জানে না নাকি? ও বললো,

“ জুঁই বললো, আমার ঘোমটা নাকি তুমি তুলবে! ”

তৃনয় সোজা হলো সাথে সাথে, “ ওহ আমাকে তুলতে হবে? ওকে! ”

তারপর আরেকটু এগিয়ে গিয়ে হাঁটুতে ভর করে দুহাতে শাড়ি ধরে উপরে তুললো। তন্নীর ফর্সা মুখটা উন্মুক্ত হলো। সে তাকালো দুটো চোখে। মুগ্ধতায় লেপ্টে এলো দুজনের চোখমুখ। তৃনয় একটা ভ্রু উচু করলো, “ তারপর? ”

তন্নী লজ্জা পেয়ে মুখটা নামিয়ে নিতে চাইলো। এর আগেই দুটো শক্ত হাতের অঞ্জলিপুটে ভর্তি হলো তার গাল দুটো। তৃনয় আঁকড়ে ধরেছে। ঠোঁট দুটো গোল হয়েছে। তন্নী চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে। তাকে আরেকটু কাঁপিয়ে দেওয়ার তাগিদে তৃনয়ের মুখটা এগিয়ে এলো। উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় এসে বসলো তার মসৃন, টানটান, লাবন্যময় কপালখানায়। ভীষন সময় নিয়ে। তন্নীর চোখদুটো আবেশে বন্ধ হয়ে আসে। হাতগুলো বিছানার চাদর খামচে ধরে। সেখানেই তৃনয় আরেকটা চুমু দিল শব্দহীন। তন্নী শব্দ করে কেঁদে উঠলো। তৃনয় সরে এলো। কিন্তু হাতটা সরালো না। বদ্ধ চোখের পাতায় তাকিয়ে রইলো কতক্ষন। শুভ্র গাল বেয়ে আরো খানিক সময় ঝর্নার মতো অশ্রু ঝড়লো। তারপর সে জিজ্ঞেস করলো,

“ বউ কাঁদে কেনো? ”

তন্নী চোখ মেললো। ওমন ফোলা চোখ নিয়েই ভেজা গালে আবদার করলো,

“ তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি! ”

তৃনয় নিজেই টেনে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। তন্নী পিঠের পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরে চুপ হয়ে গেল। আর কাঁদল না। নিজেকে কেমন বাচ্চা বাচ্চা মনে হচ্ছে লোকটার বাহুবন্ধনী তে। কি সুন্দর ঘ্রান! চওড়া বুক, পিঠ। তারপর কতক্ষন সে চুপচাপ মাথা এলিয়ে রাখলো। তৃনয় ওর মাথায় থুতনি রেখেছে, “ এবার বলো। কাঁদলে কেনো? ”

তন্নী আস্তে আস্তে ঠোঁট উল্টে বললো,

“ বাড়ির কথা মনে পড়ছিল। আমার এখানে দমবন্ধ লাগছে। ”

তৃনয় জিজ্ঞেস করলো,

“ বাইরে যাবে? ”

তন্নী মাথা নাড়লো, “ না। এতক্ষণ খারাপ লাগছিল। তুমি আসার পর থেকে ভালো লাগছে। দাদু বলেছে, স্বামীর মতো আপন কেউ নেই। ”

তৃনয় একটু শব্দহীন হাসলো। মাথা থেকে থুতনি সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো পুনরায়,

“ এভাবেই থাকবে? ”

তন্নী প্রথম প্রথম লজ্জা পেল। নিজেকে হাতের বেষ্টনী তে আবিষ্কার করে আরেকটু গুটিয়ে গেল। ভুলেই গিয়েছিল। সে সরে এলো। তৃনয় বিছানার বোর্ডে হেলান দিয়ে একটা বালিশ রাখলো কোলের উপর। দেখলো, তন্নী মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। একটু একটু হাসছেও‌। এই হাসিকেই কি তবে মেয়েদের লজ্জা বলে? এত অপরূপ দেখতে। মেয়েদের লজ্জা পাওয়ার দৃশ্যের থেকে আবেদনময়ী চিত্র বোধহয় ভু খন্ডে নেই! অপার্থিব মনোমুগ্ধকর। অথচ পুরুষ তাকায় শুধু দেহে। তৃনয় সেসব ভাবনা বাদ দিয়ে বললো,

“ সোজা, ঠিকঠাক হয়ে বসো। ”

তন্নী নড়েচড়ে বসল। কথা বললো না। লাইটটা নিভে গেছে কতক্ষন হলো। ঘরে সবুজ রঙের ড্রিম লাইট জ্বলছে মিটিমিটি। তৃনয় জিজ্ঞেস করলো,

“ তোমার কোনো শখ নেই? ”

তন্নী প্রথমে বুঝলো না। তারপর জবাব দিল, “ আছে! ”

“ কি? ”

তন্নী এদিকে তাকালো হেসে হেসে,

“ বাগান করা! ”

তৃনয় কিছুটা বোকা বনে গেল,

“ হোয়াট? এটা একটা শখ হলো? ”

তন্নী অনাগ্রহী ভীষণ। কথায় কথায় ইংরেজি বলে। সাহেব কোথাকার! সে উত্তর দিল,

“ আরে ধুর! কিসের শখ? ছোট থেকেই এটা লিখেছি, তাই এটাই বললাম! ”

“ লিখেছো বলতে? ”

“ তুমি তো দেখি কিছুই বোঝো না। স্কুলে আমরা প্যারাগ্রাফ লিখতাম। ইউর ফেবারিট হবি। তখন লিখতাম, মাই ফেবারিট হবি ইজ গার্ডিনিং। আমার পড়ার ঘরের সামনে একটা বাগান আছে, সেখানে আমি ফুল গাছ লাগিয়েছি। প্রতিদিন সেখানে কাজ করি। আবার কয়েকটা শাকসবজির গাছও আছে। আম্মু সেগুলো দিয়ে সুস্বাদু খাবার বানায়.. ” তন্নী কথার মধ্যেই হেঁসে উঠলো, “ আদতে আমার কোনো পড়ার ঘরই নেই। বাগান তো দুর। বাপ জীবনে একটা গাছ লাগালেই মরে ভুত হয়ে যেত। ”

তৃনয় বুকে হাত ভাঁজ করে রেখেছে। চোখমুখ তার অসহায় ভীষণ। মেয়েটা কি বোকা! ও জিজ্ঞেস করলো,

“ তোমাকে আমি রচনা জিজ্ঞেস করেছি? ”

তন্নীর হাসি হাসি মুখটা বদলে গেল, “ শুনেছিলাম তুমি শিক্ষক। তাই ভাবলাম…. ”

“ তাই ভাবলে আমি তোমাকে এখানে পড়ালেখা জিজ্ঞেস করছি? ”

“ তাহলে? ”

“ ঘুম পাচ্ছে? ”

“ না। তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগছে! ”

তৃনয় একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লো‌। তন্নীর পেছনেও একটা বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে দিল। তারপর আস্তেধীরে বললো,

“ শখ মানে ইচ্ছে, মনোবাসনা। মেয়েদের বিয়ের পর অনেক শখ থাকে। ইচ্ছে থাকে। বিয়ে ছাড়াও থাকে যেগুলো সে পুরন করতে পারে না। যেমন, ঘুরা ঘুরি, পড়ালেখা, সংসার আরো অনেক কিছু আছে। তোমার তেমন কোনো অপুর্ন শখ আছে? থাকলে আমাকে বলো‌। আমি পুরন করার চেষ্টা করবো! ”

তন্নী আশ্চর্য হচ্ছে। বাসর ঘরে কেউ এসব জিজ্ঞেস করে? ওকে আরো জনে জনে গোপনীয় কথা বলে গেছে। উনি এমন অদ্ভুত কেনো? বিয়ে হয়েছে। সংসার করবে। এখানে শখ জিনিসটা এলো কোথা থেকে? সে উত্তর দিল,

“ কোনো শখ নেই। আমি শখ বুঝি না! ”

“ যখন বুঝবে তখন বলে দিও! ”

তন্নী মাথা নাড়ে, “ আচ্ছা। ”

তৃনয় আরেকবার প্রশ্ন করলো,

“ বাসর রাত নিয়েও নাকি মেয়েদের অনেক ইচ্ছে থাকে? আজকে তো চাঁদ নেই। কাঁধে মাথা রেখে আকাশ দেখবে? ছাদে যাবে? নাকি হাঁটতে? ”

তন্নীর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। বাসর রাতে বর বউ বাইরে থাকবে কেনো? সে বোকা কন্ঠে শুধালো,

“ বিয়ের বছর জ্বিন ভুত বেশি থাকে। বাইরে যেতে হবে না। লোকে দেখলে কি বলবে? ”

তৃনয় কিছু বললো না। কিছু কিছু দুর্লভ মুহুর্তের আনন্দ এমনিতে বোঝা যায় না। স্বচক্ষে দেখতে হয়। সে বললো,

“ আমার ঘরে তো চাঁদ আছে। বাইরে যেদিন পুর্নিমা উঠবে সেদিন তোমাকে নিয়ে চাঁদ দেখবো। ”

তন্নী নিজের দিকে আঙ্গুল তাক করে,

“ আমি চাঁদ? ”

“ আমার চাঁদ! ”

“ চাঁদের গায়ে যে অতগুলো দাগ? ”

“ তোমার গায়ে লাগতে দেব না! ”

তন্নী ভীষণ খুশি হয়ে চুপচাপ বসে পড়লো। তৃনয়কে ডিঙিয়ে পেছনে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো একধ্যানে। বড়রা যা বলেছে সব ভুল। ওরা তন্নী কে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। তার বর তো ভীষণ ভালো। সে কথা বললো না। তৃনয়ও আর কিছু বললো না। সামনে তন্নী বসে আছে। তার শরীরটা ঘেমে যাচ্ছে হঠাৎ। হালকা আলোয় মুখটা স্পষ্ট দৃশ্যমান। সে চোখ বুজে নিল। আরেকবার তাকালে দৃষ্টি গিয়ে আছড়ে পড়লো মেয়েটার রাঙা ঠোঁটে। তৃনয় আর ভাবলো না‌। এগিয়ে গেল। তন্নী হুট করে তাকালো। তৃনয় পিঠের বালিশটা একহাতে ঠিক করে সেই হাতটা তন্নীর মাথার পেছনে রেখে হাতের তালুতেই ওকে শুইয়ে দিল। তারপর ধীরে ধীরে পুরুষ শরীরটা তন্নীর উপর নেমে আসতে দেখেই সে কেঁপে উঠলো। হাত পা থরথর করছে‌। অজানা লাবুডুবু বুকের আনাচে কানাচে। দুই মিনিট লোকটার উষ্ণ নিঃশ্বাস ওর মুখের উপর আছড়ে পড়লো। তন্নী মুখটার দিকে তাকিয়ে একটু স্বাভাবিক হলো‌। তবে, ওর স্বাভাবিকতা টিকলো না বেশিক্ষণ। তৃনয় আরেকটু ঝুঁকে এসে গালে হাত রেখে বুলিয়ে দিল, এবং সাথে সাথে নিজের ঠোঁট ওর ঠোঁটে চেপে ধরলো। প্রথমবারের মতো এত ঘনিষ্ঠ ছোঁয়ায় আর ঠোঁটের স্পর্শে তন্নী নিজের শাড়ি দুহাতে খামচে ধরলো। চোখগুলো ঠাটিয়ে বন্ধ করে নিল। দম আটকে রাখলো। আর কিছুক্ষণ এভাবে চললে ওর নিঃশ্বাস আটকে মরে যাবে। তৃনয় ঠোঁটটা ঠোঁট থেকে সরিয়ে গলার খাঁজে গেঁথে দিল। মাথার পেছনের হাতটা পিঠের নিচে দিয়ে অপর হাতটা কোমড়ে রাখলো। তন্নীর শরীর তখনো থরথর করছে। ঠোঁট মুক্তি পাওয়াতে সে শ্বাস ছাড়লো। তৃনয় বুঝতে পেরে হাসলো,

“ এভাবে কাঁপে না। ভয় পেও না। করবো না কিছু। ”

তন্নী জিজ্ঞেস করলো,

“ তুমি এভাবে শ্বাস ফেলছো কেনো? ”

“ এমনি। তুমি একটু তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাও। ”

কথা বলার সময় দাড়ির সংস্পর্শে ওর দম আটকানো অনুভুতি হলো। তৃনয় বোধহয় ঘুমিয়েছে। তন্নী দিশেহারা হয়ে নিজের হাতটাতেই দাঁত বসিয়ে দিল। ভালোও লাগছে, আবার ছুটে যেতেও মন চাইছে। ভীষণ জ্বালা তো!

***
ফজরের আজান পড়ছে চারদিকে। তন্নীর ঘুম ছুটে গেছে। দাদী বলেছে, সকাল সকাল গোসল করবি। কিন্তু সে গোসল করবে কেনো? গোসলের মতো কিছু হয় নি তো! তন্নী আধো আধো চোখ খুললো। তৃনয়ের হাত দুটো ওকে জড়িয়ে রেখেছে। একটা পা ওর শরীরের উপর। তন্নী মনে করতে পারে না। রাতে ঘুমানোর সময় তৃনয় ওর বুকের উপর ছিল। এভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরলো কখন? তন্নী নড়েচড়ে উঠলো। তৃনয় বিরক্ত হচ্ছে। তন্নী কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

“ ছাড়ো! এ্যাই? ”

তৃনয় সেভাবেই চোখ কুঁচকে ওর দিকে তাকালো। ঘুমঘুম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

“ এত সকালে কোথায় যাবে? ”

তন্নী চমকে উঠলো। মারাত্মক কন্ঠস্বর‌। সে কথা খুঁজে পেল না। কিভাবে জিজ্ঞেস করবে? আচ্ছা থাক। নিজের বরকে জিজ্ঞেস করলে তো ক্ষতি নেই। সে মিনমিন করে বললো,

“ দাদু বলেছিল সকাল সকাল উঠে গোসল করবি। এখন যাই? ”

তৃনয়ের কপালে ভাঁজ অনেকগুলো। তন্নী লক্ষ্য করলো‌। প্রথম দিনের মতো হাজারটা বিরক্তি। নিজের রুপে ফিরে আসছে‌। তৃনয় আরেকটু চেপে ধরলো ওকে,

“ কেনো গোসল করতে হয় সেটা বলে নি? ”

তন্নী চুপ হয়ে গেল। হাতের চাপে দম আটকে যাচ্ছে। মনে মনে হাজারটা কথা আসছে। জিভ নিসপিস করছে ভীষণ। ও চুপচাপ থাকতে পারে না। তৃনয় তাকে ছেড়ে দিল। তন্নী শাড়ি ঠিক করে উঠে বসলো। দিনের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। ঘরটা একটু একটু করে আলোকিত হচ্ছে। সেই আলোকিত আলোয় গালে হাত দিয়ে তন্নী তৃনয়কে দেখলো। কত সুন্দর ঘুমানোর ভঙ্গিমা। কি সুন্দর স্নিগ্ধ চেহারা! তন্নীর মাথায় ভুত চাপলো। বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে সে তৃনয়ের দিকে ঝুঁকে পড়লো। খোঁচা খোঁচা দাড়িযুক্ত গালে পরপর শব্দ করে একটা চুমু খেল। ভেবেছিল তৃনয় জেগে উঠবে আর ও দৌড়ে পালাবে। তৃনয় উঠলো না। সে মনমরা হয়ে পিছু ফিরে গেল। তৃনয় বুঝতে পেরে চোখ বন্ধ রেখেই হাসলো একটু। মনে মনে ঘোষণা করলো, এত সুন্দর, অপার্থিব একটা সকালের জন্য হলেও ছেলেদের বিয়ে করা উচিত।
তন্নী সময় নিয়ে গোসল করলো‌। দু তিনদিন ধরে শান্তি মতো গোসল করা যাচ্ছে না। কি মহা মুশকিল কান্ড। তারপর কোনোরকম শাড়ি পড়লো দু ঘন্টা লাগিয়ে। সকাল হয়ে গেছে। বাইরে বোধহয় সবাই জেগে উঠেছে। তৃনয় ঘুমুচ্ছে নাকি সজাগ সে বুঝতে পারলো না। তন্নী গিয়ে দরজা খুললো। পেছন থেকে ওকে কেউ জিজ্ঞেস করলো,

“ কোথায় যাচ্ছো? ”

তন্নী হকচকিয়ে উঠলো। বোধগম্য হতেই শান্ত হয়ে উত্তর দিল,

“ বাইরে। বাড়ির বাইরে না। রান্নাঘরে। ”

তৃনয় বালিশে মুখ গুজে দিল। ওকে আদেশ করলো,

“ মাথায় কাপড় দিয়ে যাও। ”

তন্নী মেনে নিল। তারপর চুপচাপ এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসছে। তন্নী শব্দ অনুসরণ করে সেদিকে গেল। রোজিনা রান্নাবান্নার আয়োজন করছেন। তন্নী কি করবে, কি বলবে কিছু খুঁজে পেল না। তাঁকে দেখতে পেয়ে রোজিনা নিজেই বললেন,

“ উঠেছো তুমি? বাইরে এলে কেনো? ঘরে যাও। ”

তন্নী আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,

“ আমিও তোমাকে সাহায্য করি? ”

“ রান্নাবান্না পারো? ”

“ একটু একটু! ”

রোজিনা হেসে দিলেন। ওনার হাসি দেখে তন্নী বুঝলো তার শ্বাশুড়ি আম্মা ভীষণ ভালো বোধহয়। তিনি বললেন,

“ তাহলে আটা মাখো। এরা সবাই সকালে পরোটা খায়। ”

তন্নী চুপচাপ কাজ করতে লাগলো। মনটা খুচখুচ করছে তার। সে শেষমেষ জিজ্ঞেস করলো,

“ আম্মা, আজকে আমাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা না? ”

রোজিনা জিজ্ঞেস করলেন,

“ বাড়ির কথা মনে পড়ছে? বোকা মেয়ে। যাবেই তো। আজকে তোমাদের নাইওর তো। ”

তন্নী আর কথা বললো না। সে মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছে। একে একে সবাই হাজির হলো ডাইনিং টেবিলে। রোজিনা তন্নী কে বললেন,

“ তৃনয়কে ডাক দাও গিয়ে। উঠুক। খাবে না? ”

তন্নী মেনে নিল। এখানে তার ভালো লাগছে না। ঘরে যেতে মন টানছে। জুঁই, জবা, রোজিনা ওর শ্বশুর কারো প্রতিই তেমন টান আসছে না যতটুকু তৃনয়ের প্রতি এসেছে‌। নুরজাহান বলেছিলেন, “ একটা রাত গেলেই বুঝবি। ” তন্নী বুঝেছে। ওদের সবার সাথে কথা বলতে কিছুটা অস্বস্তি এখন হচ্ছে। সময় হলে অবশ্য কেটে যাবে সেটা। সে চুপচাপ ঘরে এলো। তারপর ঝাড়া দিয়ে মাথার ঘোমটা ফেলে দিল। কি গরম পড়েছে। এত গরমে কেউ মাথায় কাপড় দেয়? অসহ্য! পরপর সে বিছানায় তাকালো। তৃনয় তখনো ঘুমুচ্ছে। তন্নী আশ্চর্য হলো। এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায়? উনি না শিক্ষক? সময়ানুবর্তিতা নেই। তন্নী এগিয়ে গেল। কি বলে ডাক দেবে? সে ইতস্তত করলো,

“ শুনছো? এ্যাই? ”

তৃনয় বালিশ থেকে মুখ তুললো, “ সমস্যা কি তোমার? ঘুমোতে দিচ্ছো না! ”

“ সকাল হয়ে গেছে। ”

তৃনয় কপালের ভাঁজ সমেত উঠে বসলো। তন্নী একপাশে দাঁড়ালো জায়গা দিয়ে। তৃনয় বসলো পা ঝুলিয়ে। তন্নী তখন বিছানায় তাকিয়ে আছে। ফোনটা ওর মনোযোগ কেড়েছে। স্মার্টফোন সে দেখেছে। কিন্তু ব্যবহার পদ্ধতি জানে না। তৃনয় ওকে দেখলো। তারপর ফোনটা হাতে নিল। তন্নী হকচকিয়ে গেল। বুঝে ফেলেছে। তৃনয় ফোনটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“ বিয়ের ছবি দেখবে? ”

তন্নী খুশি হয়ে গেল। ফোনটা লক খোলার আগে পর্যন্ত উঁকি দিয়ে দেখলো। তৃনয় গ্যালারি ওপেন করেছে। সে তাকালো পাশে। তারপর বললো,

“ বসো এখানে। ”

হাত দিয়ে নিজের পাশটা দেখালো সে। তন্নী গুটিয়ে-শুটিয়ে বসলো। খুবই সামান্য দুরত্ব রেখে। ব্লাউজ পেটিকোটের ফাঁকে বাম কোমড়ের কিছুটা জায়গা উন্মুক্ত। সেকেন্ডের ব্যবধানে তন্নী টের পেল একটা হাত সেখানে স্পর্শ করেছে। তৃনয় ওকে টেনে নিজের কাছাকাছি নিয়ে গেল। নরম ত্বকে খরখরে হাতের ছোঁয়ায় তন্নী জমে গেল। পায়ের পাতা শিরশির করে উঠলো তখন, যখন সেখানে রাখা হাতের আঙ্গুল গুলো নড়াচড়া শুরু করলো!

চলবে…!