#আমার_বধু!
#আফসানা_ইমরোজ_নুহা
#পর্ব_১৫
তন্নীর ঘরের মাঝখানে ওদের সবার আসর জমেছে। সবাই জেনেছে তন্নী ঝগড়া করে এসেছে। নইলে এমন হুটহাট আগমন কেনো? চোখমুখ দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে? আসমা, মইনুল আর নুরজাহান খাটে বসে আছেন। তন্নী বসেছে পড়ার টেবিলের সামনে। মোহনা ফ্লোরে বসে আছে। নুরজাহান জিজ্ঞেস করলেন,
“ জামাইয়ের সাথে লেগেছিস? ”
তন্নী চোখমুখ উল্টে ফেললো,
“ তোমাদের জামাই নিজে আমাকে গাড়িতে তুলে দিয়েছে। ”
আসমা ওর কাছে এগিয়ে এলেন। ঘরটা শুনশান, নিরব। তিনি পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন,
“ তাহলে কে বলেছে তোকে আজেবাজে কথা? ”
তন্নীর আবার কান্না পাচ্ছে। ও যে কেনো আরেকটু স্ট্রং হলো না? সে গলায় দলা পাকানো কান্না গিলে নিল। সংসার করলে কতকিছু সহ্য করতে হয়।
“ আমার ফুপু শাশুড়ি। আমাকে আব্বা ফার্নিচার, আসবাবপত্র দিলো না কেনো? তাই। ”
মইনুল ইসলাম বিব্রত হলেন না। যদিও বিষয়টা ভীষণ লজ্জাজনক। তিনি বললেন,
“ জামাইকে চেনা আছে আমার। ওর ফুপির এতো সাহস কোথা থেকে এলো আল্লাহ জানে। বেশ করেছিস চলে এসে। তোর মা, বাপ এখনো জীবিত আছে। এখানে থাক কয়েকদিন। আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকুক। ”
কেউ কিছু না বললেও নুরজাহান বললেন রেগে গিয়ে,
“ আরে মা*গী? হাইনের ঘর করলে কত কথা শুনতে হয়। আমরা কথা শুনেই ঘর করেছি। তোরে তোর জামাই কিছু বলে নাই! তবুও তুমি সোহাগী সাজো? কত মাইর খাইছি তোর দাদার হাতে। ”
“ মিথ্যা বলবে না বুড়ি। ও নিজেই তো আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আটকালো না পর্যন্ত। ”
তন্নী এ পর্যায়ে কেঁদে উঠলো শব্দ করে। সে ভেবেছিল তৃনয় ওকে আটকাবে। অথচ নিজে এসে এগিয়ে দিয়ে গেছে। মইনুল ইসলাম উঠে দাঁড়ালেন। তন্নীর মাথায় হাত বুলিয়ে নিঃশব্দে হাসলেন,
“ কাঁদে না, মা। জামাই যা করেছে ভেবেচিন্তেই করেছে। ওর বুঝ তোমার থেকে বেশি। তুমি এসেছো, যতদিন মন চায় থাকবে। ”
উনি চলে গেলেন। নুরজাহান হতাশ চিত্তে আওড়ালেন,
“ এমনে ম্যা ম্যা ডাইক্কাই আশকারা দিছো। একটু মুখ বন্ধ করে থাকলেই হয়, সহ্য করলেই হয়। ”
আসমা আর চুপ থাকলেন না, “ না, আম্মা। এসে পড়েছে ভালো হয়েছে। ওখানে থেকে ঝগড়া করলে ঝগড়া বাড়তো। ওদের মুখও লাগামছাড়া হতো, আমার মেয়ের টাও। বিয়ে যখন হয়েছে এতো সহজে কি ছেড়ে দেবে নাকি? ওকে বকবেন না। ”
নুরজাহান আর কিছু বললেন না। ওনারও মনটা খারাপ হচ্ছে। তন্নী আশকারা পেয়ে যাবে বলেই এসব বলছেন। তিনি তন্নীকে টেনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। মাথার তালুতে কতখানি তেল-জল মিশেল করে মালিশ করলেন। তবুও তন্নী ঘুমোতে পারলো না। নুরজাহান ওকে একধ্যানে দেখে গেলেন। সেদিনের মেয়েটা। বিয়ের দু’দিন আগেও ‘ বিয়ে করবো না, বিয়ে করবো না ‘ বলে চেঁচামেচি করা মেয়েটা কি সুন্দর সংসার করছে। দুরে বসে থেকেও স্বামীর জন্য মন খারাপ করছে , দুশ্চিন্তা করছে। ভাত পর্যন্ত খাচ্ছে না ঠিকমতো। তন্নী কত অবুঝ ছিল। সবাই বলাবলি করতো, এ মেয়ে সংসার করবে কিভাবে? অথচ কয়েকটা মাসে সে পাক্কা গৃহিণী হয়ে উঠেছে। স্বামীর সোহাগী হয়েছে। সব বুঝি বিয়ের জোর? নাকি একজন আদর্শ স্বামী পাওয়ার সুফল?
***
এদিকে সিদ্দিকী পরিবারে আগুন লেগে গেছে। তৃনয়ের বাকী দুই চাচার পরিবারসহ পুরো মহল্লা জেনেছে বাড়ির বউ চলে গেছে। রাগ করে বাপের বাড়ি গেছে। তৃনয় ঝগড়া করার মতো ছেলে না। সামান্য কিংবা ভীষণ গুরুতর কিছু হলেও সে বউয়ের সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করবে না যার জন্য বউয়ের বাড়ি ছাড়ার মতো অবস্থা হয়। গুঞ্জন শোনা গেল, তৃনয়ের বড় ফুপি এসেছেন। সবাই নিশ্চিত উনিই কিছু বলেছেন। ওনার মুখ কিছুটা লাগামহীন তা প্রায় সবাই জানে। কিন্তু বউ চলে যাওয়ার ঘটনা বেশ বিরল। সিদ্দিক পরিবারের বউরা স্বামীর অনুমতি ব্যতীত ঘর থেকে বের হয় না। মেয়ের এতো সাহস? কি এমন বলেছে? যে একদম বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হবে? তৃনয়ের বাকী দুই চাচার একজনের তিনজন ছেলে। আরেকজনের দুইজন। সবার বউ আছে। ওরাও তো শুনেছে ফুপির কটু কথা। কেউ তো কখনো বাড়ি ছাড়ে নি। চুপচাপ শুনেছে, নয়তো তর্ক করেছে। বাড়িতে এসে রাতে সবাই জড়ো হলো। তন্নীর বাকী পাঁচ জা, ভাসুর। ননদেরা, চাচী শাশুড়িরা। বাড়ি সবার পাশে পাশেই। তৃনয়ের বাবা বকাঝকা করছেন,
“ বাড়ির নতুন বৌ। ঠিকমতো তো একবছরও হয় নি বিয়ে হলো। এর মধ্যে বউকে কথা শোনালি কেন তুই? আমার মানসম্মান কিছু থাকবে? হ্যাঁ? ”
ওনার গর্জনে ফুপি তটস্থ হয়ে আছেন। এমন কোনো বউ নেই যে ওনার কথা শোনে নি। পরিস্থিতি এভাবে বিগড়ে যাবে তা ভাবনার বাইরে ছিল। জুঁই নিজের বড় ভাবীকে বললো,
“ আমি আর আম্মু জানো, কিচ্ছু বলি না ভাবীকে। আমাদের ভাবীও খুব মিশুক। একসাথে শাড়ি পড়া, সাজগোজ করা, গল্প করা। ফুপি নিশ্চয়ই বড় কিছু বলেছে…. ”
বড় ভাবী নিজেও ফিসফিস করলেন,
“ আমাদের কি কম কথা বলতো? কতবার চলে যেতে চেয়েছি জানো? তোমার ভাইয়া দেয় নি। কতভাবে আটকে রাখতো। বলতো, স্বামীর সংসার করলে একটু আধটু সহ্য করতে হয়। আমি পাশে আছি না? ”
জুঁই মাথা দোলালো, “ ঠিক এর জন্যই ফুপি আরো সাহস পেত। তোমরা কেউ যদি আগেই চলে যেতে তাহলে সুযোগ পেত না। আজকে এমন কান্ডও ঘটতো না। এই মহল্লায় আজ প্রথম বাড়ির বউ বাড়ি ছেড়েছে। ”
জুঁইয়ের চাচাতো ভাই তাওসীফ জিজ্ঞেস করলো,
“ তৃনয় বাড়িতে ছিল না? ”
“ শুনেছি কথা কাটাকাটির সময় ছিল। ভাবী গেছে ভাইয়া বের হওয়ার পর। জানে না বোধহয়। এলেই তুলকালাম ঘটবে। ”
ছোট চাচার ছেলের বউ এসে সেখানে শামিল হলো,
“ ভাইয়াকে রেখেও তন্নী চলে যাওয়ার সাহস করলো। তৃনয় ভাইকে তো চেনা আছে। উনি চাইলেই আটকাতে পারতো। তাই না? ”
মোর্শেদ দাঁড়িয়ে ছিল পাশে। সে চুপচাপ শুনছে। শেষমেষ হেসে ফেললো,
“ তোরা সবকটা বলদ। তৃনয় নিজে ওকে গাড়িতে তুলে দিয়েছে। আমি সদরের সামনে ছিলাম। ভেবেছি বোধহয় বেড়াতে যাচ্ছে। এসে শুনলাম এই কাহিনী। ”
সবগুলো বউয়ের মাথায় হাত পড়লো। ভীষণ জোরে বজ্রপাত হলো বোধহয়। তৃনয় নিজে এগিয়ে দিয়েছে? আর সেটা কেউ জানল না? সবাই বলাবলি করলো,
“ দেখলে? ফুপিকে শায়েস্তা করার জন্যই ইচ্ছে করে পাঠিয়েছে। ” তারপর নিজেদের স্বামীদের বললো,
“ শেখো কিছু। জীবন পাড় করে ফেললাম কথা শুনতে শুনতে। চলে যেতে চাইলে আটকাতে। তোমাদের ফুপিরও তাই সাহস হয়েছে। ”
জুঁই মুখ ভেংচি কাটলো, “ আর তোমাদেরও মুখ বেড়েছে। আমার ভাইয়ার বুদ্ধি ভালো। এখানে থাকতে থাকতে ভাবীও জবাব দেওয়া শুরু করতো। বেটার সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। ”
সেখানে একগাদা প্রশংসার বৃষ্টি হলো তৃনয়কে নিয়ে। সবাই চুপ হলো তখন, যখন সদর দরজা দিয়ে একটা লম্বা মতোন পুরুষ দেহ ভেতরে এলো। হাঁটা-চলার দারুন ভঙিতে সে নিঃসন্দেহে এক সুপুরুষ। দৃঢ় চোয়াল, ঘন ভ্রুয়ের নিচে ইস্পাত কঠিন দুটি চোখ জানান দিল, সে এক অভিজাত বংশের পুরুষ। তৃনয় এসে মাঝঘরে দাঁড়ালো। গোষ্ঠীর সবাইকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
“ কি হয়েছে? সবাই এখানে কেনো? আফরোজা? আফরোজা? ”
বড়রা সবাই আতঙ্কিত হলেও কাজিন মহলের সবাই ঠোঁট চেপে হাসলো। তৃনয়ের বাবা গমগমে গলায় বললেন,
“ তোমার বউ চলে গেছে। ”
তৃনয় আশ্চর্য হওয়ার অভিনয় করলো। তাঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে সব জানে। সে জিজ্ঞেস করলো,
“ চলে গেছে মানে? কোথায় গেছে? ”
উনি বোনের প্রতি দাঁত কটমট করলেন,
“ কোথায় যাবে? বাপের বাড়ি গেছে। তোমার ফুপি ওকে যা নয় তা বলেছে! ”
তৃনয় সোজা, সটান দাড়িয়ে। সে কঠিন স্বরে বললো,
“ সামান্য এই কারনে চলে যেতে হবে? ওকে আমি অনুমতি দিয়েছি? ”
দাবার গুটি এক লহমায় পাল্টে গেল। ওরা সবাই আশ্চর্য হলো। তৃনয় এভাবে বলছে কেনো? বড় ফুপি সাহস পেলেন। তিনি বলতে চাইলেন,
“ হ্যাঁ, বাবা। সেটাই তো….. ”
তৃনয় আটকে দিল হাত উঁচু করে,
“ আমার ঘরের বউকে আপনারা নিজেদের মতো চালানোর ক্ষমতা পেয়ে গেছেন? ওর সাহস কতটুকু বাড়িয়ে দিয়েছেন ভাবতে পারছেন? ও আমার সাথে ঝগড়া করে নি। আমি কোনো বাহানা, অজুহাত শুনতে চাই না। কেবল ঘরের বউ ঘরে চাই। তার জন্য ওর পা ধরতে হয় কিংবা হাত, তা আমি জানি না। ”
এই তো বাজিমাত! প্রথমের অভিনয় টুকু বেশ দারুন হয়েছে। একবাক্যেই তন্নীর সাইডে চলে গেলে সবাই সন্দেহ করতো। তৃনয় সেখান থেকে চলে গেল। যেতে যেতে বললো,
“ খাবার দাও, মা। ”
একটা ফয়সালা করতে হবে। ফুপি যা বলেছে তাও সবার কাছে স্পষ্ট। তৃনয়ের বাবা কঠিন স্বরে আদেশ দিলেন,
“ তুমি কালকে রোজিনা কে নিয়ে ওকে আনতে যাবে। যদি না দেয় তারপর পুরুষরা যাবে। সবাই যার যার আশ্রয়ে যাও। ”
সবাই সরে দাঁড়াল। বড় ফুপির অবস্থা করুণ। মইনুল ইসলামকে মানানোর দায়িত্ব ওনার কাঁধে। বাকী বউরা আড়ালে খুশি হলো। একেই বলে, “ চোরের দশদিন, গৃহস্থের একদিন। ”
এই শিক্ষা থেকে যদি পাড়ার মহিলা গুলো কিছু শেখে। তৃনয় তো বেশ চতুর! জুঁইয়ের একটা চাচাতো বোন প্রশংসা করলো,
“ ভাবীর দেখছি রাজকপাল। আমাদের যে কবে এমন একটা জামাই হবে। ”
শেষটুকু আফসোসের স্বরে বললো সে। জুঁই জবাব দিল না। চুপচাপ তৃনয়কে খাবার দিতে এগিয়ে গেল। ভাবী ছাড়া সব কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সব থেকেও যেনো কি একটা নেই!
***
তন্নী কে ঘরে রেখে বাইরে আসার পর তৃনয় কল দিল। নুরজাহান রিসিভ করলেন চোখ কুঁচকে,
“ কি কবি ক, গোলাম। ”
তৃনয় জিজ্ঞেস করলো,
“ আফরোজা কোথায়? ”
“ ঘরে। ”
“ ঘুমায়? ”
নুরজাহান হতাশ চিত্তে মাথা নাড়লেন,
“ নারে, জামাই। নাতী আমার ঘুমায় না। কি জাদু করলি রে। ”
তৃনয় স্বাভাবিক স্বরে বললো, “ পিরিতের জাদু। কালা জাদু। খেয়েছে কিছু? ”
“ খায় না। জোর করে খাওয়াইলাম। ওর কাছে দেই? ”
তৃনয় দ্রুত বললো,
“ না না। দিতে হবে না। ও যেনো না জানে আমি কল দিয়েছিলাম। ”
নুরজাহান টিপ্পনী কাটলেন,
“ ক্যান? লুকাইয়া লুকাইয়া পিরিত দেহাও? ”
তৃনয় হুঁশিয়ারি দিল যেনো,
“ শোনো, সুন্দরী। ওর খেয়াল রাখবা। ওর কিছু হলে সব তোমার দোষ। ”
“ আচ্ছা বুঝলাম। খেয়াল রাখলে আমারে কি দিবি? ”
তৃনয় ফোন সামনে এনে জানতে চাইলো,
“ নতুন জামাই লাগবে? ”
নুরজাহান কে রাগানোর একমাত্র পন্থা। তিনি ফুঁসে উঠে বললেন,
“ রাখ রাখ। মোবাইল রাখ। মাঙ্গের নাতী খালি আমার মরা জামাইয়ের কাছে যায়! বা*লডা। ”
তৃনয় অল্প হেঁসে কল কেটে দিল। তারপর খালি ঘরটা দেখে তার হাসিটা গায়েব হয়ে গেল। মনে হচ্ছে, ঘরজুরে নুপুরের শব্দ বাজছে। ওই তো, ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে বেনী গাঁথছে তন্নী। শব্দ করে হাসছে। গালে হাত দিয়ে কখনো সখনো ভাবুক হয়ে যাচ্ছে। আবার তৃনয়ের বুকে মাথা রেখে, সামনে বসে হাজারটা বকবক করছে। কি আশ্চর্য! তৃনয় এর আগেও কতো থেকেছে একা ঘরে। আজকের মতো এমন ফাঁকা তো লাগে নি? একেই বুঝি ঘর বলে? একেই বুঝি সংসার বলে? গৃহিণী বাদে সব অচল, অকেজো। তৃনয় খুব করে তন্নীর বকবক গুলো মিস করলো।
খুব দ্রুত তন্নী ফিরে আসুক। কাল গিয়ে ফুপি না আনলে পরেরদিন তৃনয় যাবে। বিবাহিত পুরুষ সে। বউ ছাড়া থাকা যায় নাকি? আঠাশ বছর তো থেকেছে। আর কত? বিছানাটা কেমন খালি খালি। ইশশ!
চলবে…!