আমার বধু পর্ব-১৬

0
4

#আমার_বধু!
#আফসানা_ইমরোজ_নুহা
#পর্ব_১৬

বড় ফুপি আর রোজিনা তন্নীদের বাড়িতে এসেছেন এগারোটার সময়। মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকদের আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখা হলো না। তারপর বড় ঘরের মাঝখানে বসা হলো। মইনুল ইসলাম আর কাউকে ডাকেন নি। ছোটখাটো বিষয়। এসব নিয়ে ঝামেলা করলেই ঝামেলা। মেয়ের বদনাম। তন্নী দাঁড়িয়েছে একপাশে। ওর পড়নে হালকা খয়েরী রঙের একটা শাড়ি। ঘোমটা টেনেছে সুন্দর করে। গ্রামের বধু। চোখেমুখেই স্পষ্ট ফুটেছে‌। হাতে একজোড়া সোনালী চিকন চুড়ি, কানে স্বর্ণের দুল, গলায় চিকন চেইন। মেয়ের সাজপোশাক জানান দিচ্ছে বড় ঘরের বউ সে। সাধারনের মধ্যেও অসাধারণ। মুখের চমক, জ্যোতি প্রমান, মেয়েটা স্বামীর আদুরে বধু! সে মুখে আঁচল চেপে দাঁড়িয়েছে। বড় ফুপি মুখ খুললেন,

“ মেয়ে এসেছে, ভাইজান। আমাদের সাথে দিয়ে দিন। আরেকবার আসবে না হয়। ”

মইনুল ইসলাম কিছু বলার আগেই তিনি এগিয়ে গেলেন তন্নীর কাছে। হাত দুটো আঁকড়ে ধরলেন,

“ তুই কি পাগল, বউ? কি না কি বলে ফেলেছি। এসব মনে রাখতে আছে? চল আমাদের সাথে। ”

তন্নী কথা বললো না। নুরজাহান বললেন,

“ আমাদের সামর্থ্য আছে। মাইয়ারে সব দিয়া পরে পাঠামু। ”

রোজিনা ওনার পাশে বসলেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন,

“ এসব কথা মনে রাখতে নেই, আম্মা। বিয়ে হলে টুকটাক কথা হয়। আপনি তো সংসার করেছেন। কিছু হলেও জানেন। ”

মইনুল ইসলাম তন্নী কে জিজ্ঞেস করলেন,

“ তুমি এখন যাবে, আম্মা? ”

তন্নী সরাসরি বললো,

“ নাহ। ”

বড় ফুপি ওর হাতটা ফের ধরলেন। বললেন,

“ শোনো মেয়ের কথা। চল মা। এই যে এখানে দাঁড়িয়ে বললাম, ফুপি আর কখনো তোকে কিছু বলবো না। শুধু আমি না, কেউ তোকে কখনো কিছু বলবে না। বললে আমি প্রতিবাদ করবো। ”

তন্নী মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। জুতো মেরে গরুদান করতে এসেছে। আস্ত খান্নাস। মইনুল ইসলাম বললেন,

“ আচ্ছা, বেয়াইন। রাগ গোস্বা যেভাবেই এসেছে। কয়েকটা দিন থাকুক….. ”

ওনার কথা শেষ হলো না। ফুপি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,

“ না না। পরে এসে থাকবে। তন্নী, তুই যা মা। জামাকাপড় গুছিয়ে আন। শাড়ি পাল্টাতে হবে না। গাড়ি নিয়ে এসেছি। আচ্ছা, তোমার যেতে হবে না। তোমার বোন কোথায়? ” মোহনা কে দেখতে পেয়ে তিনি ডাক দিলেন, “ যাও তো, মা। তোমার বোনের জামাকাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে এসো। ”

তিনি তন্নীকে চেপে ধরেছেন নিজের সাথে। ওনার এমন আদর দেখে তন্নী অবাক হচ্ছে। কি আশ্চর্য! তৃনয়ও বোধহয় ওকে এভাবে জড়িয়ে ধরে না। কথাবার্তা বেশ হয়েছে। বেঁকে বসেছিলেন নুরজাহান। নাতনীর অসম্মান হয়েছে। উনি কি এতই মিসকিন নাকি? প্রয়োজন পড়লে নিজের গয়না বিক্রি করে নাতনীর শ্বশুর বাড়িতে জিনিসপত্র পাঠাবেন। দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তিনি। মইনুল, আসমা অবাক হলেন বেশ। কেননা, গত সন্ধ্যায় তিনি তন্নীকে বকাঝকা করেছেন। তন্নী কয়েক দফা কেঁদেছে। কে জানে কেনো? হয়তো, পরিচিত ঘরটার জন্য। নয়তো মাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য। কয়েকটা দিন থেকে যাওয়ার ইচ্ছে তারও হয়েছিল। কেবল ঝগড়া করে এসেছে বলেই মুখ ফুটে সেটা বলেনি সে। তৃনয়কে আরেকবার বলবে, কয়েকটা দিন থাকার কথা।
ওদের কে শেষমেষ বিদেয় দেওয়া হলো বিকেলের দিকে। তন্নী সিদ্দিকী বাড়িতে পা রাখলো ভয়ে ভয়ে। জুঁই, জবা এসে জড়িয়ে ধরলো তাঁকে। তন্নী ফিসফিস করে বলল,

“ তোমার ভাইয়া কোথায়, জুঁই? ”

জুঁই একটু হেসে বললো,

“ বিকেলে এসেছে। ঘুমুচ্ছে বোধহয়। তুমি ভয় পাচ্ছো নাকি? বাপরে! কালকে এদিকে ঘুর্নিঝড় বয়ে গেছে। ফুপির উপর কড়া হুঁশিয়ারি জারি হয়েছিল। আজকে তোমাকে আনতেই হবে। ”

তন্নীর বড় চাচী শাশুড়ি বললেন,

“ কেমন যাওয়া গেলি, বউ। একদিনও থাকতে পারলি না। ”

তন্নী জবাব দিল না। এই প্রথম শ্বশুর বাড়িতে ওর অস্বস্তি হচ্ছে। কাল যে তৃনয়কে বড় মুখে বললো, আর আসবে না। এখন জবাব কি দেবে? ধ্যাত! সে প্রথমে জুঁইয়ের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো।
তারপর বেশ ভয়ে ভয়ে ঘরের ভেতর এলো। পা টিপে টিপে। তৃণয় তখন ঘুমুচ্ছে। একটা হাত বুকের উপর‌। অপরহাতটা বালিশের উপর, মাথার নিচে। ঘুমানোর ভাবভঙ্গি দারুন। তন্নী বিছানায় উঠে বসলো। নাকের উপর, চোখের সামনে হাত রেখে বুঝলো লোকটা ঘুমিয়ে গেছে। তারপর শান্ত শ্বাস ছাড়লো সে। নিজেও মাথাটা বালিশে রেখে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো গম্ভীর আর ভীষণ রাগী মুখটায়। এখন একটুও বোঝা যাচ্ছে না। জুঁই জবার ভাষায় তাদের ভাইয়া মারাত্মক রাগী‌। যেটা এখন পর্যন্ত তন্নী দেখে নি। ওকে দেখায় না কখনো। সবসময় বেশ আদরে আদরে রাখে বলেই তন্নী টের পায় না। কিন্তু তৃনয়ের গম্ভীর মুখ জানান দেয় সে কতটা রাগী। আজ পর্যন্ত কখনো মন খুলে হাসতে দেখে নি লোকটাকে। তন্নী বিড়বিড় করে, রোবট। তারপর স্বামীর সুদর্শন মুখটা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে। আগেরদিন সারারাত তার ঘুম হয় নি একবিন্দুও।
ঘুমের ঘোরে তৃনয় টের পেল একটা সাপ ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। ভীষণ গভীর আলিঙ্গন। শরীরের চেনা ঘ্রানে ঘরের সাপটাকে চিনতে তৃনয়ের ভুল হয় না। সে তন্নীর হাতটা ছাড়িয়ে উঠে বসলো। তারপর শরীরে কাঁথা টেনে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে যায়। আলগোছে অবশ্য একটু হাসেও। যেই হাসি কেউ দেখে না।

***
তৃনয় ঘর থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে বসলো। রোজিনা ওকে দেখে এগিয়ে এলেন। পাশে বসে শান্ত মতো বললেন,

“ বউকে কিছু বলিস না, বাবা। ”

তৃনয় প্রশ্ন করলো, “ তোমার ননদ কোথায়? ”

“ তোর চাচ্চুর বাড়িতে গেছে। ” উনি পুনরায় বললেন, “ কিছু বলিস না বউকে। ছোট না? ”

তৃনয় বললো,

“ কিছু বলবো না, মা। ওকে কখন, কিভাবে, কি বলতে হবে তা আমি খুব ভালো করে জানি। একটা মেয়ে নিজের সব ছেড়েছুড়ে আমার কাছে এসেছে‌। কেবল মাত্র আমার আশায়‌। আমি ওর একমাত্র আশা, ভরসা এবং বিশ্বস্ত কাঁধ। আমার কাছে এলেই সে যেনো নিজেকে নিরাপদ ভাবে তা বোঝানোর দায়িত্ব আমার। আমি ওকে কিছু বলবো না। তোমাদের কাছে অনুরোধ, তোমরাও কিছু বলো না। ”

একটু থেমে সে পুনরায় শুরু করলো,

“ নতুন বউ নবজাতক শিশুর মতো, মা। যখন একটা মুসলিম ঘরে এবং একটা হিন্দু ঘরে একই সাথে দুটি বাচ্চা জন্ম নেয় তখন তারা জানেনা তাঁদের ধর্ম কি? তারা দুজনই নিষ্পাপ। তারপর যখন একে একে শিশুগুলো নিজেদের পরিবার কে পুজো করতে দেখে, তখন তাঁরাও সেটা অনুসরণ করে। একটা মুসলিম শিশু নামাজ শেখে। অর্থাৎ তাকে যা শেখানো হবে সে তাই শিখবে। ঘরের নববধু ঠিক এরকমই, মা। ওরা প্রথম প্রথম এসেই ঝগড়া, বিবাদে জড়ায় না। প্রত্যেকটা মেয়ের শখ থাকে, শ্বশুর বাড়ির লোকদের সাথে মিলেমিশে থাকার। পরবর্তীতে ওদের সাথে তুমি যেরুপ আচরণ করবে , সে সেরুপ আচরণ শিখবে। ঘরের নিয়ম বুঝবে। তুমি একবারের জায়গায় তিনবার ভুল ধরলে সে আর কাজটা করতেই চাইবে না। তুমি ওকে আগলে নিলে সে নিজেও তোমাকে আগলে নেবে, নেওয়ার চেষ্টা করবে। মা হওয়া যায় না, কিন্তু চেষ্টা করতে হয়‌। ”

তৃনয় আর কিছু বললো না। সংসার যতটা সহজ দেখা যায় ঠিক ততোটা সহজ না। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ হলো, সংসার টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। বিপরীত ধর্মী দু’জনকে মেনে নেওয়ার, মানিয়ে নেওয়ার যুদ্ধ। যার সাথে তাবত দুনিয়ার কোনো কিছুর তুলনা হয় না।

***
তন্নীর যখন ঘুম ভাঙলো তখন অনেক রাত। চারপাশে ঝি ঝি পোকার অবাধ আলোড়ন। একঝাঁক জোৎস্না নেমেছে বাইরে। কাঁঠাল পোকার শব্দে আশপাশ ঝুমঝুম করছে। তন্নী অভ্যাসবশত পাশে হাত বুলালো। খালি পেয়ে ঘুমের ঘোরে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসলো। চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে পাশে তাকালো। ঘরে আলো নেই। তৃনয় বসেছে ল্যাপটপের সামনে। কেবল ততটুকু আলোই ঘরটা জুড়ে। আনাচে কানাচে ভুতুরে ভাব। শাড়ির আঁচলটাও সে ঠিক করে নিল। একবার ভাবলো পেছন থেকেই কেটে পড়বে। এখানে থাকলে নিশ্চিত তৃনয় ওকে মেরে ফেলবে। অন্তত কয়েকটা চর থাপ্পড় হলেও অবধারিত হয়েছে তার জন্য। তন্নী তাই বিছানার অপর পাশ দিয়ে নামলো। এক পা এগুনোর আগেই অপরপাশের লোকটা বলে উঠলো,

“ কে জানি চলে গিয়েছিল! ”

তন্নী আরেকটা ঢোক গিললো। খাটের মাথায় মাথাটা ঠুকে দিতে ইচ্ছে করছে। সে ভেবে পায় না, এত ভয় আসে কোথা থেকে? নিজের বরকে কেউ এভাবে ভয় পায়? তন্নী আস্তে করে বললো,

“ নিজের ঘরে ফিরে আসবে না নাকি? ”

“ নিজের ঘর হলে গিয়েছিল কেনো? ”

কেমন ভরাট গম্ভীর স্বর। হাতের আঙ্গুল গুলো তখনো কি বোর্ডে চলছে অবিরাম। তন্নী বললো,

“ যা বলার সরাসরি বলো। ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলছো কেনো? ”

তৃনয় চেয়ার ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালো। তন্নীর আপাদমস্তক কাপে। তার ঠোঁট দুটো নিজের প্রতি বিতৃষ্ণায় উল্টে আসে। কাল একটু বেশি অবাধ্যতা করেছে। সে জানে, তৃনয় নিজে গাড়িতে তুলে দিলেও ভেতরে ভেতরে রেগে ছিল। বাইরের হালকা হলুদাভ আলোটা চোখে লাগছে। তৃনয় একটা বাঁশের চিকন কঞ্চি নিল হাতে। ওটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো‌। সেখানে তাকিয়ে থেকেই বললো,

“ কত শয়তান মানুষ করলাম। এখন নিজের ঘরের দুশমন পাত্তাই দিচ্ছে না। ”

তন্নী অপরপাশ থেকে অনুনয় করলো,

“ পাত্তা দিচ্ছি তো‌। তুমি অতো বড়বড় ছেলেমেয়ের শরীরে হাত তোলো? ”

তৃনয় ভ্রু উচু করলো। বললো,

“ এদিকে এসো। ”

তন্নী নাক টেনে বললো, “ তুমি আমাকে মারবে। ”

“ কাছে আসতে বলেছি। ”

“ আর কখনো তোমার কথার অবাধ্য হবো না। প্রমিস। ” নিজের গলাটা দেখালো সে, “ এই দেখো। কসম। সবসময় তোমার কথা শুনবো। ”

তৃনয় উঠে এলো। তন্নী কয়েকপা পিছিয়ে গেল। লোকটা বিছানার পাশ দিয়েই ওর কাছে এলো। আরেকটু এগুতে গেলেই তন্নী দৌড় শুরু করলো। ঘরময় ছুটোছুটি করলো দুজনে। বেশ অনেকক্ষণ। তারপর তার হাতটা তৃনয় খপ করে ধরে ফেললো। তন্নী অসহায় চোখে তাকায়। তৃনয় হাতের লাঠিটা ফেলে দিয়ে ওকে কোলের উপর বসিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলো। তন্নীর মাথার খোঁপা খুলে গেছে সেই কখন। দুজনেই অবশ্য হাপাচ্ছে। শরীর ঘেমেছে কিছুটা। তৃনয় কিছু বললো না। ঘর্মাক্ত হলদে মুখখানি দেখে বা হাতে বাম পাশের চুলগুলো সরিয়ে দিল আলতো করে। তারপর তন্নী কে চেপে ধরে মুখ ডুবিয়ে দিল গলায়। দাঁতের আঘাত বাড়তেই পেছনের চুলগুলো খামচে ধরলো তন্নী। তার সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে। শরীর জোড়ায় জোড়ায় খুলে যাচ্ছে আস্তেধীরে। দাড়ির ঘষায় মরন দশা। তৃনয় সেভাবেই শুয়ে পড়লো। মুখটা গলাতে রেখেই প্রশ্ন করলো,

“ কেনো এলে? ”

তন্নী সয়ে নিয়েছে ততক্ষণে। বললো,

“ তোমার ফুপু গিয়ে তেল মালিশ করলো। ”

“ আচ্ছা? কোথায়? ”

তন্নী থতমত খায়, “ কোথায় আবার। উনি তো আমার বড়। মাথায় একটু তেল দিয়েছিলেন। ”

তৃনয় আরেকটু গম্ভীর গলায় ফিসফিস করলো,

“ আর কখনো যাবে না। ”

তন্নীর কান্না পেল খুব। সে কাঁদল না। স্বামীর মাথাটা বুকের উপর নিয়ে বললো,

“ আর যাবো না। ”

“ মনে থাকবে? ”

“ আগে তুমি বলো, আমার সাথে আর কখনো কেউ বাজে ব্যবহার করবে না। ”

তৃনয় বুক থেকে মাথা তুললো। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,

“ কাঁদছো কেনো? ”

তন্নী নাক টেনে জবাব দিল, “ ঘুম না হলে আমার খুব কান্না পায়। ”

“ এতক্ষণ তো ঘুমুচ্ছিলে। ”

“ কাল রাতে আমি একটুও ঘুমোতে পারি নি। তোমাকে ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি না। ”

“ আচ্ছা, কাঁদে না। ” বলতে বলতে তৃনয় উঠে বসলো। বসেছে তন্নী নিজেও। সে নিজের গলার ডান পাশটায় হাত বুলিয়ে দেখলো। অনাগ্রহী গলায় বললো,

“ ডান পাশে দিয়েছো? এটা ঢাকবো কিভাবে? কেউ দেখে ফেললে? ”

তৃনয়ের দ্বায়সারা জবাব, “ দেখুক। ”

তন্নী এগিয়ে গিয়ে ওর বাহুটা জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করলো,

“ তোমার রাগ কমেছে? ”

“ আমি কারো উপর রাগ করি নি। ”

তন্নী হাতটা ঝটকায় সরিয়ে দিলো। তারপর মুখ ঘুরিয়ে কাঁদতে লাগলো শব্দ করে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। সব দোষ শুধু ওর। ওদের গাঁয়ে মেয়েরা রাগ করলে বর এসে নিয়ে যায়। কিন্তু তৃনয় তো গেল না? ওর কি এখানে অপরাধ হয় নি? রাগ করার অধিকার তো তারও আছে। পেছন থেকে তৃনয় পুনরায় জানতে চায়,

“ আবার কাঁদছো কেনো? ”

তন্নী খাটের কোনায় হাত রাখলো। রাগে দুঃখে জর্জরিত কন্ঠে বললো, “ সবসময় তুমি রাগ করো। আমাদের এখানে জানো কি হয়? মেয়েরা রাগ করে বাপের বাড়ি চলে এলে বর গিয়ে রাগ ভাঙায়। নিয়ে যেতে আসে। কিন্তু আমার বেলায় তুমি গেলে না। একটা ফোন দিয়েও খবর নিলে না। তুমি কি আদোতে আমায় ভালোবাসো? ”

তৃনয় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে থুতনি রেখে বললো,

“ তোমার মান আমি যেকোনো সময় ভাঙতে পারব। আমি চাইলেই আজ ওখানে যেতে পারতাম। কিন্তু আমার সাথে ফিরে এলে তোমার মধ্যে একটা অনুশোচনা বোধ থাকতো। তুমি ঠিকমতো ফুপির সামনে, আম্মুর সামনে দাঁড়াতে পারতে না। আমার স্ত্রী কোনোরকম অস্বস্তিতে পড়ুক তা আমি চাই না। ফুপু নিজে গিয়ে এনেছে তোমায়। তোমার সম্মান টা বুঝতে পারছো তুমি? আফরোজা, তুমি বোকা না। ”

তন্নী সবটা বুঝলো। নাক টেনে জানতে চাইলো, “ তাহলে বলো, তুমি আমার উপর রেগে নেই। ”

“ সত্যি রেগে নেই। ঘুমাবে? ”

“ মাত্রই তো ঘুমালাম। এ্যাই শোনো? ”

“ বলো! ”

“ আজকে চাঁদ দেখতে যাবে? কত সুন্দর চাঁদ উঠেছে। ”

তৃনয় বললো, “ আচ্ছা চলো। কোথায় যাবে? ”

ওরা দুজন প্রথমবারের মতো হাঁটতে বের হলো। ভীষণ গভীর রাত তখন। গলিটা পাড় হতে গিয়ে তন্নী দেখলো সত্যি সত্যিই কতগুলো জোনাকি পোকা। কি সুন্দর সবুজ আলো চারপাশে। অনেক গুলো লাইট নিভে গেছে ততক্ষনে। আঁধার গলি কেবল চাঁদের রুপোলি আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। ওরা প্রথমে শোলাকিয়া মাঠ পেড়োলো। তারপর এলো গুরু দয়ালের সামনে। তন্নীর আবদার মুক্ত মঞ্চে যাবে। কলেজের আশেপাশেও সব নিরব। নরসুন্ধার জলের উপর কচুরিপানা ভেসেছে। সাদা ব্রিজ গুলো দেখতে ভয়ানক। তন্নী গিয়ে লোহার শিক আঁকড়ে সেখানে দাঁড়াল। এত সুন্দর আশপাশ দেখে পুনরায় তাঁর কান্না পাচ্ছে। তৃনয় দাঁড়ালো ওকে আগলে ধরে। সম্পুর্ন গোলাকার জায়গাটা খালি। পাশের রাস্তায় কতগুলো কুকুর রাস্তার ধুলোবালিতে গড়াগড়ি খেয়ে ঘুমাচ্ছে। কয়েকটা আবার জেগে আছে। তার মধ্যে দু একটা কুকুর হঠাৎ করে ডেকে উঠছে। তন্নীর হাতটা শক্ত হাতের বাঁধনে বাঁধা পড়েছে। ভীষন গভীর বাঁধনে। কুকুরের নিদারুণ আর্ত চিৎকার কানে এলে সে আরেকটু ঘেঁষে আসে নিজের স্বামীর দিকে। তারপর একধ্যানে তাকিয়ে থাকে গোলাকার চাঁদটার দিকে। তৃনয় তাকিয়ে ওর দিকে। তন্নী চাঁদ দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে,

“ কি দেখছো? ”

“ আমার চাঁদ কে। ”

হঠাৎ করে বাতাস শুরু হয়। গায়ের আঁচল টা বিছিয়ে পড়ে রেলিং এর উপর। তন্নী আলতো হেসে বুকে কিল বসায় , “ এসব পুরোনো ডায়লগ। নতুন কিছু বলো। কি দেখছো? ”

তন্নী ভীষণ আগ্রহ নিয়ে লোকটার দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়ে দুজনের। হাতের বাঁধনটা আরেকটু শক্ত হলে হুট করে ওর ওষ্ঠের উপর শব্দ করে চুমু খায় তৃনয়। তন্নী চমকে উঠলো। নড়েচড়ে উঠলো‌। তার নড়বড়ে দেহটা তৃনয় আরেকটু আগলে ধরলো। গভীর স্বরে বললো,

“ আমার বউ কে দেখি। আমার জীবন সঙ্গীনীকে! ”

তারপরের এলোমেলো বাতাসের তোপ তন্নীর মনে প্রাণে আলোড়ন তোলে। গোটা শরীর শিরশির করে। লজ্জায় কপোলে একগুচ্ছ কৃষ্ণচূড়া নামে হরবর করে। সে একান্ত ভাবে চাঁদ টাকে জিজ্ঞেস করে,

“ ওর মুখে বউ ডাক এতো আদুরে কেনো? কেনো সে ডাক শুনলে জীবনে বাঁচতে চাওয়ার ইচ্ছে দ্বিগুণ হয়ে যায়? কেবল স্বামী স্ত্রী বলেই? নাকি অপ্রকাশিত, না বলা এবং হতে না পারা প্রেমিক প্রেমিকা বলে? ”

চলবে….!