আমার বধু পর্ব-১৯

0
181

#আমার_বধু!
#আফসানা_ইমরোজ_নুহা
#পর্ব_১৯

আগস্ট মাস, ২০১৬।
সিদ্দিকী বাড়িটা দোতলা এখনো। বাড়ির সামনের গেটের নকশা পাল্টেছে। পাল্টেছে বাড়ির কমলা রঙটা। সেসব সেকেলে বর্ণ। দেয়ালজুড়ে এখন অফ হোয়াইট রঙের ছড়াছড়ি। বড় নেম প্লেটে খচিত নাম, “ নিয়াজ মোর্শেদ ভবন। ” দেয়ালজুড়ে অপরাজিতার লতাপাতা পেঁচিয়ে উঠেছে। সাদা কাগজে আঁকা শিল্পীর চিত্রের ন্যায়। বাগানের ফুল গাছগুলোতে কোনো ফুল নেই। কেবল পাতা, আর পাতা। বাগান বিলাসের বিশাল গাছটা সদরগেটের উপর বিস্তৃতি লাভ করেছে। গোলাপী ফুলের থোকা সেখানে জমাট বাঁধা। হাওয়ায় দোল খাচ্ছে ফুলের পাতলা পাপড়িগুলো। দুর থেকে দেখলে মনে হয়, একখন্ড আকাশ বুঝি নেমেছে সেথায়। সেই রাজকীয় বাড়ির দোতলার শেষ কোণে একটা বিশাল ঘর আছে। বাড়ির একমাত্র নেতাজীর ঘর। যার ভেতরের নকশা বড্ড সুনিপুণ হাতে সাজিয়েছে এক গৃহিণী। অগোছালো, এলোমেলো এক গৃহবধূর বাস সেখানে। যে স্বামীর কাছে দীর্ঘ বছর আগে একখানা সংসার চেয়েছিল। একটা সোনায় মোড়ানো সোনালী ঘর চেয়েছিল। উহু! ধনসম্পদ মোটেই না। গৃহবধূর চাওয়া পাওয়ায় কভু ধনসম্পদ ছিল না। সে চেয়েছিল স্বামীর বিরামহীন যত্ন, এক আকাশ ভালোবাসা, আর মুঠো মুঠো সুখ।
জানালার সামনে পর্দা ঝুলছে। পাশের সোফাটা খালি তখন। খোলা ব্যালকনি দিয়ে হুড়মুড় করে গরম বাতাসের আনাগোনা চলছে। আয়নার সামনে কতগুলো চুড়ি, পারফিউম, তেলের বোতল, ছোটদের লোশনের বোতল উঁকি দিচ্ছে। তন্নী তখন বিছানায় বসে খাচ্ছে। ছোটদের জিনিস। ডেইরি মিল্ক চকলেট। তৃনয় মেয়ের জন্য কিছু আনলে দু’টো করে আনে সব। মেয়ের মায়ের স্বভাব ওর জানা আছে। মেয়েটা যে কোথায় আছে? বোধহয় দাদীর কাছে। তন্নীর খেয়াল নেই। দরজার পর্দা তখন একটু একটু করে সরে গেল। ছোট ছোট হাতে পর্দাটা সরিয়ে ভেতরে এলো একটা জীবন্ত পুতুল। পুতুলের মতোই দেখতে গোলগাল একটা মুখ। সম্পুর্ন বাবার আদল পেয়েছে। মাথায় গরুর শিংয়ের মতো দুটি ঝুটি। ছোট ফুপি করে দিয়েছেন। তন্নী সেদিকে তাকালো। সকাল তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। মায়ের হাতের জিনিসটা বুঝতে পেরেই ওর ঠোঁট ভেঙ্গে এলো। তারপর হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো মাটিতে। গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলো,

“ ওতা আমাল। টুমি কেয়েচো কিনুওওও? ”

তন্নী হতভম্ব হলো। হাতের চকলেট দেখিয়ে মেয়েকে মুখ ভেংচি কাটলো,

“ এটা আমার। তোরটা তুই রাতে খেয়ে ফেলেছিস! ”

সকালের কান্না থামে না। তন্নী সেখান থেকে এগিয়ে আসার আগেই শব্দ করে ওয়াশ রুমের দরজাটা খুলে গেল। তৃনয় দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল মেয়ের দিকে। শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছে। শরীর ভেজা। টাওয়ালটা কোমড়ে কোনোমতে জড়িয়েছে বোধহয়। বুকের উপর পশমগুলো চিকচিক করছে রোদের টুকটাক আলোতে। তন্নী বেহায়ার মতো ঢোক গিললো। তারপর অন্যদিকে তাকালো। মনে কেবল দুষ্টু চিন্তা উঁকি দেয়। দিনদিন প্রেম বাড়ছে। আহারে! তার হ্যান্ডসাম জামাইটাও বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। ইশশ! তৃনয় সকালকে কোলে তুললো ভেজা গায়েই। মেয়েটা তখনো কাঁদছে কেমন। তন্নীর খারাপ লাগে। কিন্তু মেয়ে কাঁদবে সে জানত? একটা চকলেটই তো। ওর বাপের বেশ সামর্থ্য আছে কিনে দেওয়ার।
মেয়েকে কোলে নিয়ে সোফায় বসলো সে। জিজ্ঞেস করলো,

“ কাঁদো কেনো, আম্মু? ”

সকাল ফুঁপিয়ে উঠে জবাব দিল,

“ টুমার বউ আমার চলকেত খেয়েচে। ”

তৃনয়ের হাসি পেল। সে হাসলে মেয়ে আরো কাঁদবে। তাই তন্নীকে চোখ রাঙালো‌। বললো,

“ আব্বু আবার এনে দেবো। কাঁদে না, মা। তুমিও কেমন বলো তো? ”

তন্নী দায়সারা বললো, “ তোমার মেয়ের জিনিস ছুঁয়েও দেখি না। এগুলো আমার। নিজেরটা রাতেই খেয়ে ফেলেছে। এখন মনে নেই। ছোচা কোথাকার। ”

তৃনয় না পারতে ধমকালো,

“ আফরোজা! ”

বাবার বুক থেকে সকাল নিজেও ধমক দিল,

“ আলফুচা! ”

তৃনয় বহু কষ্টে দানবীয় হাসিটা গিলে নিল। তন্নী এগিয়ে গেল দু কদম,

“ একদম নাম ধরে ডাকবি না। মেরে ভর্তা বানিয়ে ফেলবো। ”

মেয়ে বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে নিল। মায়ের ধমকে ফের কেঁদে দিল। কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় ডাকলো,

“ আব্বা আআ! ”

মায়ের থেকে শিখেছে দুটি ডাক। বেশি কাঁদলেই আব্বা আর আম্মা। সুর মিলিয়ে ডাকে। তৃনয়ের বুকটা ঠান্ডা হয়ে যায়। সে উত্তর দেয়,

“ হ্যাঁ, আম্মু? ”

“ টুমি…টুমি আম…. আম্মুকে কেনোও বিয়ে কললে? ”

ফুপানোর তোড়ে ঠিকঠাক বলতে পারছে না সে। তৃনয় হেসেই ফেললো এবারে,

“ তোমার আম্মু কে বিয়ে না করলে কি তোমাকে পেতাম, বলো! কাঁদে না। হুশশ! ”

তন্নী নাক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কতবড় সাহস মেয়ের। বলে কিনা, আম্মুকে কেনো বিয়ে করলে? ওকে বিয়ে না করলে সে কোথা থেকে হতো? তন্নী জিজ্ঞেস করলো,

“ আমাকে বিয়ে করেছে তাতে তোর কি? ”

“ টুমি আমার মজা খাও, মালো আমাকে। ”

তৃনয় বললো, “ এমন করো কেনো বলো তো? ও তোমার মেয়ে না? ”

তন্নী একবাক্যে বিরোধিতা করলো,

“ না। তোমার একার। পেটে ধরলাম আমি, জন্ম দিলাম আমি, গু মুত পরিষ্কার করলাম আমি। এখন বলছে, আম্মু কে কেনো বিয়ে করলে? সব তোমার। তুমিই তার সব। থাকো ওকে নিয়েই। আমি চললাম। ”

“ কোথায় যাবে? ”

সেই কয়েকবছর আগের প্রশ্ন। তন্নী পাল্টা প্রশ্ন করলো,

“ আমার কি বাড়িঘর নেই? ”

তৃনয় গভীর গলায় ফের জানতে চাইলো,

“ তোমার বাড়িঘর আমি না? ”

তন্নী আর জবাব জানে না। মুখে মুখে তর্ক ভালো লাগে না। মাঝেমধ্যে টুকটাক খুনসুটি গুলো হয় বুকে গেঁথে যাওয়ার মতো। সকাল বোধহয় বাবার বুকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তন্নী এসে পাশে বসলো।

“ চাচীমা এসেছিল। ”

“ কি বললো? ”

“ আমি যেনো আজ সন্ধ্যা থেকেই ও বাড়িতে চলে যাই। ”

তৃনয় মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে বললো,

“ দরকার নেই। বাড়ি তো বেশি দুরে না। মেয়ে আমার এতো হট্টগোলে থাকতে পারবে না। জুঁই কখন আসবে? ”

“ দুপুরে বোধহয়। তোমাকে বলেছে বাজারে যেতে। ”

“ আচ্ছা, যাচ্ছি। ওকে বিছানায় নাও। ”

তন্নী মেয়েকে কোলে তুলে সেখানেই বসে রইলো। বুকটার সাথে মিলিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মাথায় চুমু খেল শব্দের সহীত। তৃনয়ের চাচাতো বোনের বিয়ে কাল। আজ গাঁয়ে হলুদ। বেশ বড় করে অনুষ্ঠান হবে। ওদের সম্পুর্ন গোষ্ঠীর সবার দাওয়াত। জুঁই আসবে স্বামী নিয়ে। ওর বিয়ে হয়েছিল ২০১৩ তে। এখন বাচ্চা হবে‌। সবে পাঁচ মাস। জবার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে কয়েকদিন হলো। বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। তৃনয়ের শখ থাকলেও ওদের বাবা আর পড়াতে চাইছেন না। বিয়ের পর পড়ুক। মেয়েদের সময় থাকতে বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। এটা ওনার ধারনা। তৃনয় রেডি হয়ে বের হওয়ার আগে মা মেয়ের কপালে চুমু খেল। তারপর হাত নাড়িয়ে চলে গেল। তন্নী মেয়েকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও সাথে শুয়ে পড়লো। পেট ব্যথা করছে একটু একটু।

***
হলুদে এখান থেকে সবাই যাবে। তন্নী যেহেতু বাড়ির বউ তাই সে শাড়ি পড়ে মাথায় ঘোমটা টানলো। মেয়েকেও পড়ালো একটা হালকা হলুদ সবুজের মিশেল শাড়ি। পায়ে, হাতে আলতা দিয়ে দিল। কি সুন্দর লাগছে দেখতে! তন্নী আয়নার সামনে মেয়েকে বসিয়ে দিয়ে নিজে তৈরি হলো। বাইরে বের হলো সকালকে কোলে নিয়ে। জবা ওকে টেনে নিল। গালে আদর করলো,

“ আমাদের মিষ্টিকে একদম রসগোল্লার মতো লাগছে। তাই না, আম্মু। ”

রোজিনা বললেন, “ নজর দিস না। ”

সকাল বোধহয় বিরক্ত হলো। গালে চুমু খাওয়া তার পছন্দ না‌। বাপের মতো একরোখা কিনা? সে গালটা ঘষে ঘষে বললো,

“ লচগোল্লা বলে টুমি আমাকে কাবে নাকি? ”

“ ওমা! তোকে কখন খেলাম আমি? মানুষ খাওয়া যায়? ”

“ সুপ! ইদিয়ত! ”

সবাই একযোগে হেসে ফেললো। বাপের কমন ডায়লগ। চুপ, ইডিয়ট! তন্নী পিঠে মৃদু থাপ্পড় দিল। সবাই একে একে বিয়ে বাড়ির দিকে এগুলো। তৃনয় আগে থেকেই সেখানে আছে।
বাড়িটা লোক সমাগমের কারনে ঝুমঝুম করছে। এদিকে সেদিকে সব জায়গায় মানুষের ছড়াছড়ি। তৃনয়কে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তন্নী সেখানে গিয়ে বোকা বনে গেল। মেয়েকে নিয়ে একদম একা হয়ে গেল। সবাই গেছে কোথায়?
তৃনয়কে এক কোনে পাওয়া গেল। ঘামে ভেজা শরীর। পড়নের পাঞ্জাবি টা ভেজা। এভাবে একবার তাকে ছোটাছুটি করতে দেখা গিয়েছিল জুঁইয়ের বিয়ের সময়। একা হাতে সব সামলেছে। গরমের কারনে টেবিল ফ্যান দেওয়া হয়েছে। তার সামনেই এখন দাঁড়িয়ে আছে। তন্নী মেয়েকে কোলে নিয়ে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে ওর পাঞ্জাবি টেনে ধরলো। তৃনয় পিছু ফিরলো টান লাগায়। তন্নী সেজেছে আজ। টুকটাক, হালকা পাতলা সাজ। ওর বোধ হয় দিনদিন সৌন্দর্য্য বাড়ে‌। যার গভীরতা তৃনয় আজও খুঁজে পায় নি। এতো বছরেও মেয়েটার প্রতি তার মুগ্ধতা একবিন্দুও কমে না। সেই প্রথম দিনের মতো আজও ওকে দেখলে তার বুক ধুকপুক শুরু হয়। চেপে ধরে কেবল চুমু খেতে মন চায়। তৃনয় নিজের ভাবনায় জল ঢেলে জিজ্ঞেস করলো,

“ সবাই কোথায়? ”

“ আরে এখানে বাইরের মানুষ সবাই। তোমার মেয়ে তোমাকে খুঁজছে। ”

তৃনয় ওকে কোলে তুললো। অন্যদিকে ফিরে গেল তারপর। তন্নী সামনে তাকিয়ে আছে। মহল্লার মহিলাদের কারনে ড্রয়িং রুমের সব জায়গা ব্লক। আত্মীয়রা বেশি নেই। তন্নী মাথার ঘোমটা ফেলে দিয়ে দাড়াল ঠিকঠাক। একটা বয়স্কা নারী ওর দিকে এগিয়ে এলো। তন্নী ভ্রু কুঁচকে তাকায়। উনি এসে পেছনের তৃনয়কে দেখলেন। অন্যদিকে ফিরে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

“ তুমি একা? ”

তন্নী মানা করলো, “ না না আন্টি। ” তারপর পেছনে ইঙ্গিত দিয়ে বোঝালো সাথে মানুষ আছে। মহিলা বললেন,

“ কে হয়? ”

তন্নী একপলক তৃনয়ের পিঠটা দেখলো। লাজুক হেঁসে জবাব দিল,

“ আমরা স্বামী-স্ত্রী আন্টি! ”

মহিলা কয়েক মিনিট সময় নিলেন পুরোটা বুঝতে। স্বামী-স্ত্রী? আহা! কত সুন্দর সম্পর্ক। তিনি বললেন,

“ আজীবন সুখে থাকো‌। দেখি বাবা…. ”

তৃনয়কে ডাকলেন তিনি। শব্দ পেয়ে তৃনয় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তারপর সোজাসুজি তন্নীর সাথে দাঁড়ালো। ভদ্রমহিলা দু কদম পিছিয়ে গেলেন। কি সুখী চিত্র খানা। স্বামী-স্ত্রী একসাথে দাঁড়িয়ে। কি মিষ্টি দেখাচ্ছে। তন্নী টেনেটুনে তৃনয়ের কাঁধ পর্যন্ত। মেয়েটাও দারুন দেখতে। উনি তৃনয়ের বাহুতে হাত বুলিয়ে দিলেন,

“ একটা বউ পাইছো, মাশাআল্লাহ। আমি আরো বলি, মেয়ের বোধহয় বিয়েই হয় নি। একদম রাজ-যোটক। তোমাদের মেয়ে? ” তন্নী হেঁসে মাথা নাড়লো। উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “ কি নাম? ”

“ তাজরীন সিদ্দিকা সকাল। ”

মহিলাটা হাসলেন। বেশ মানিয়েছে। উনি দু হাত উপরে তুলে দোয়া দিলেন,

“ সারাজীবন মিলেমিশে থাকো। আল্লাহ এমন জুটি সবসময় বানিয়ে রাখুন। আমিন। ”

তারপর তিনি চলে গেলেন। তৃনয় তন্নী একে অপরের দিকে তাকালো। একটু হাসলো। স্বামী স্ত্রীর চোখাচোখি হওয়াটা ভীষণ সুন্দর! তাই না?

***
বাড়ির সামনের গলিটা সাজানো হয়েছে‌। লাল, সবুজ লাইট উপরে, দুই পাশে ঝলমল করছে। গায়ে হলুদের উচ্ছাস কমে এসেছে। টুকটাক গান বাজছে বক্সে। জুঁইয়ের শরীর খারাপের ফলে বাকীরা আরো আগেই চলে গেছে। মহল্লার মহিলারা বাড়ি গেছে নিজেদের। ভীষণ রাত হয়েছে। প্রত্যেকটা দালানের লাইট বন্ধ হয়ে গেছে বহুক্ষণ হলো। তৃনয় বের হলো তখন। একটা হাতে সে শক্ত করে ধরেছে তন্নীর হাত। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চিন্তে। বাবার কাঁধে তাহার মুখটা হেলে পড়ে আছে। তৃনয় পিঠে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। পাছে মেয়েটার ঘুম নষ্ট হয়? তন্নী উপরে তাকালো মুখ উঁচু করে। হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যেনো হারিয়ে গেল সে। রঙিন বিন্দু গুলো কে ওর কাছে জোনাকি মনে হলো। মসৃন, মলিন হাতটা খসখসে, শক্ত একটা হাতের কবলে পড়েছে। ঠিক এভাবেই পড়েছিল আরো ছ’বছর আগে। তখন তন্নীর বুক কেঁপেছিল ভয়ে। আজ কাঁপছে সুখে। এই নিস্তব্ধ, নিস্তেজ রাতে ওর হারিয়ে যেতে মন চাইছে বহু দুরে, অজানায়।
মাত্র সতেরো বছর বয়সে নববধু হিসেবে বাড়িতে পা রাখা মেয়েটা আজও স্বামীর সোহাগী। আজও স্বামীর প্রিয়তমা হিসেবে সে ছুটে বেড়ায় বাড়িটার আনাচে কানাচে। ভীষণ বুঝদার হওয়া সত্ত্বেও সে আজও বোকা কেমন। একটা ঘরকন্যা হিসেবে গড়ে উঠেছিল তন্নী। অপরিচিত একটা ঘর তার বড্ড পরিচিত হয়েছে আজ। মুঠোবন্দী ভালোবাসা আজ তার আঁচলের নিচে। তাঁকে ছোট থেকে নিজ হাতে গড়েছিল তৃনয়। বুকে আগলে ভালোবেসেছে, সময় অনুযায়ী শাসন করেছে, কখনো সখনো বাঁচিয়েছে অসম্মানের হাত থেকেও। স্বামীই তো মেয়েদের অভিভাবক। তৃনয় হয়েছিল সেই অভিভাবক। নিজ হাতে মাটির পুতুলের ন্যায় তন্নী কে গড়েছিল বলেই সে কখনো তার অবাধ্য হয় নি। অবাধ্য হওয়া শিখে নি। বোঝে নি।
তন্নী বহুকষ্টেও বাস্তবে ফিরতে পারে না। তার মনে হয়, হাঁটতে হাঁটতে সময়টাকে থামিয়ে দিলে মন্দ হতো না। একটা আদর্শ স্বামী, একটা বাউন্ডুলে বধু, আরেকটা পুতুল মেয়ের গল্পটা এ পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়ালে অবশ্য মন্দ হয় না। পায়ের নিচের জমিনটা থেমে গেলে জীবনটা কষ্টের হয় না।
ভালোবাসা এমন হয়। এমনই হয়। তৃনয় হাতে চাপ দিল। তন্নী তাকায়। আবছা আলো আঁধারের অদ্ভুত খেলায় সে চোখজোড়া তার কাছে বড্ড বেশি রহস্যজনক মনে হয়। মনে হয়, কত জনমের ক্ষুধার্ত দুটি চোখ। ওকে দেখার ক্ষুদা। ওকে দেখে দেখে জীবন পার করে দেওয়ার ক্ষুদা। ওকে ভালোবাসার, ভালোবাসতে চাওয়ার আকুতি সেখানে। তন্নী তাকিয়ে থাকে। সময়, ধ্যানজ্ঞান সব ভুলে তাকিয়ে থাকে। বিয়ে বাড়ির অল্প সামান্য আওয়াজে হাসন রাজার গানটা হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে আসে নিস্তব্ধ তাদের কাছে। জানিয়ে যায় দুটি মনের এক অমোঘ সত্য,

“ নেশা লাগিল রে
নেশা লাগিল রে।
বাঁকা দু নয়নে নেশা লাগিল রে। ”

চলবে…!