#ভাড়াটে_মরশুম – [০২]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ]
কিছুদিন যেতেই শরৎ নামের ভদ্রলোকের সম্পর্কে কিছু খবরাখবর কানে এলো। এক, ইনি চাকরিচ্যুত আর দুই, আগের বাড়ি থেকে ভাড়া না দেওয়ার জন্যে তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। টুকিটাকি যা ফার্ণিচার ছিল সেগুলো রেখেই। ওগুলা দিয়ে যদি বাড়িওয়ালার কিছু টাকা উঠত ঘর ভাড়ার, সেই আশাতে। শরৎ শুধু পরনের কটা কাপড়, ফ্যান, তোষক আর টুকটাক জরুরি জিনিসপত্রই আনতে পেরেছে। তাও বোধ হয় ফ্যান ব্যবহার করে না। প্রায়ই চলাফেরা করার সময় তার দখিনের জানালাটা খোলা দেখতে পাওয়া যায়। বড়ো জামরুল গাছের নিচে এই জানালা, যার ফলস্বরূপ হাওয়া-বাতাসের অভাব পড়ে না। আবার তীব্র গরমে বাতাস না থাকলেও রোদের তাপের থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আব্বা কিছু পাক কিংবা না পাক, একজন ভালো সঙ্গী পেয়েছে আলাপের জন্য। কিন্তু ভদ্রলোকের বেপরোয়া, দায়িত্বহীন স্বভাব আমাকে প্রতিনিয়ত কেমন হতাশ করে দিচ্ছে। সে যে কত মাসের ভাড়া আটকাবে সেটা তো প্রথম দিনেই বুঝেছিলাম। এখন নতুন করে এসব শোনার পর ভাবছি, উনি ভাড়া দিবেন এটা অতি আশ্চর্যের বিষয় হয়ে যাবে।
গতকাল বাড়িতে ফিরে দেখলাম অন্ধকারে আব্বা আর শরৎ সাহেব পাশাপাশি চেয়ারে বসে গল্প করছে। ওদের অবধি কেচিগেটের বাল্বের আলো যতটা পৌঁছায় আরকি! কেচিগেটের দিকে যেতে যেতে শুনলাম ওনার কণ্ঠস্বর। শরৎ বলছে,
–“চাকরিটা কোনো কালেই হাতের মোয়া ছিল না চাচা। এটা জীবনের মতোই অনিশ্চিত, কখনো আসে আবার কখনো হালকা ঝলক দেখিয়ে হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। এটা হচ্ছে চলতি ফিরতি স্ক্যাম।”
আব্বা সহমত জানালেন। বুঝলাম তাদের গল্পের আসর জমে উঠেছে। আমি তখন ক্লান্ত শরীরে ভেতরে চলে গিয়েছি। এত ধকল একসাথে নেওয়া যাচ্ছে না। এখন আমাদের ঘরের অঘোষিত একজন সদস্য হয়ে গিয়েছেন এই হুট করে উড়ে এসে জুড়ে বসা লোকটা, শরৎ। তার বাসায় চুলো জ্বলে না, কী খায় না খায় তার ঠিক ঠিকানা নেই। সারাদিন হয় ঘরে চিৎ হয়ে থাকবে নয়তো সারাদিনেও বাড়ি ফিরবে না। আব্বার আবার দয়ার শরীর, অল্পদিনেই এই ছেলে আব্বার মাথাটা পুরো ওয়াশ করে দিয়েছে। অথচ আমি মেয়ে হয়েও এখনো আব্বা আমার সাথে কথা বলেন না। বললেও হয়তো সারাদিন শরৎ শরৎ জপত।
ভদ্রলোকের সাথে আমার ঘড়ি ধরে ত্রিশ সেকেন্ডও কখনো কথা হয়নি। ওই এক দু’বার আব্বার নির্দেশে তার ঘরে খাবার দিতে গেছিলাম। একবার যে কী চরম অস্বস্তিতে পড়েছিলাম। দরজা খুলল এই লোক একদম খালি গায়ে, সামান্য একটা লুঙ্গি পরেই। সে কী চরম অস্বস্তিকর মুহূর্ত। সেদিন সেই লোকও কেমন অস্বস্তিতে কাবু হয়ে পড়ল। ধপ করে মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে মিনিটখানেকের মধ্যে আবার দরজা খুলল। এবার গায়ে একটা টি-শার্ট জড়িয়ে কিছুটা সভ্য সাজার ভং ধরেছিল। আমি এতকিছু না ভেবে শুধু খাবারটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, “আব্বা বললেন আপনি রাতের জন্য কিছু রাঁধেননি।”
ভদ্রলোক হ্যাঁ, না কিছু না বলে খাবারটা হাত বাড়িয়ে নেয়। উত্তরে বলেছিল, “আমি রাঁধতে পারি না। তবে আপনার খাবারের টেস্ট আছে।”
ভদ্রলোক মুখের ওপর প্রশংসা ছুঁড়ল নাকি ফ্লার্ট করল এ নিয়ে দারুণ দোটানায় পড়ে যাই। এর পরের দুবার মুখে কিছু না বলে খাবার দিয়েই চলে আসি।
ভদ্রলোক দেখতে মন্দ নয়। লম্বাটে, শ্যামবর্ণ, পেটানো শরীরের এক এলোমেলো পুরুষ। কিংবা সহজ ভাষায় বলতে গেলে একজন নারী ঘাতক, অথচ এই নারী ঘাতকের নারীদের প্রতি আগ্রহ নেই। কথা-বার্তা কখনো মধুর, কখনো আবার চরম তেঁতো। ইচ্ছে করবে সেখানেই তাকে পুঁতে দিতে। তবে সে প্রখর বুদ্ধিবান, তবে বুদ্ধি খরচ করার জায়গা নেই। তাই বুদ্ধিটা তার মাকড়শার জালের মতোই অবহেলিত। বয়স সম্ভবত ত্রিশ ছুঁইছুঁই। আব্বা বিয়ে-শাদির কথা বললেও হেসে কেমন উড়িয়ে দেয়। তাচ্ছিল্য করে বলে,
–“শূন্য পকেটের এই হিরোকে কে বিয়ে করবে?”
আব্বা তখন মুখ গোমড়া করেন। বলেন, “শূন্য পকেটে বিয়ের মতো দায়িত্ব নেওয়াও ঠিক না, ভালোই। বিয়ে করা লাগবে না তোমার!”
তখন শরৎ সাহেব হো হো করে হাসে। আব্বা ওনার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সেবারও তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে বলবে, “মা কবরে আর বাপ আছে বোধ হয় বেঁচে।”
বাবাকে নিয়ে তার কণ্ঠে চরম তাচ্ছিল্য, বুঝলাম তার বাবার সাথে সম্পর্ক ভালো নেই। তবে আব্বা ওনার মায়ের কথা শুনে ভীষণ আফসোস করে বলেন,
–“এজন্যই বোধ হয় তোমাকে গুছিয়ে দেবার মতো কেউ নেই।”
–“সমস্যা নেই তো চাচা। গুছিয়ে দিতে হয় স্কুলের বাচ্চাদের। আমি কী স্কুলের বাচ্চা নাকি? হাহাহা।”
–“সব বয়সী মানুষের জন্যই একজন গুছিয়ে দেবার মতো মানুষ থাকতে হয়। এলোমেলো হতে নির্দিষ্ট বয়সের প্রয়োজন হয় না।”
আজকাল এই ভদ্রলোক কেন যেন আমার বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে আছে। আমার কেন যেন বেকার ছেলেপেলে পছন্দ না। এরা চেষ্টা না করে শুধু শুয়ে থাকবে আর কথায় কথায় বেকার বেকার করবে। সত্যিকারের বেকার কারা? যারা চাকরির জন্য চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হয়। এখন সে চেষ্টা না করে, চাকরি না খুঁজে দিন-রাত বেকার বেকার করলে বুঝি লোকে চাকরি তার ঘরের দরজায় এসে দিয়ে যাবে? পৃথিবীর কোনোকিছুই চেষ্টা ছাড়া সম্ভব হয় না, এমনকি আজ অবধি যারা সফল তারা প্রত্যেকেই চেষ্টা, কঠিন অধ্যাবসায় এবং পরিশ্রমের পর সফল হয়েছে। শটকার্ট হয়তো থাকতে পারে বড়োলোকদের জন্য। কিন্তু আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের জন্য শুধু চেষ্টা, পরিশ্রমের দরজাই খোলা থাকে।
প্রতিদিনকার মতো অফিস যাওয়ার আগে আব্বাকে আজও জিজ্ঞেস করলাম, “আরেক কাপ চা করে আনব, আব্বা?”
–“প্রয়োজন নেই।” আব্বার কাঠকাঠ গলা।
প্রতিদিনের মতোই তীব্র হতাশা নিয়ে বাকি খাবারটুকু শেষ করলাম। তবে আজ খাবার টেবিল ছেড়ে উঠলাম না। আব্বা সেটা লক্ষ্য করলেও কিছু বললেন না। আমি থেমে বললাম,
–“টিউশনি দুটো ছেড়ে দিয়েছি আব্বা।”
আব্বা অবাকও হলেন না, কোনোপ্রকার অভিব্যক্তিও প্রকাশ করলেন না। আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে কোনোরকমে সব গুছিয়ে ছুটলাম অফিসের উদ্দেশে। উঠোন পার করার সময়েই মুখোমুখি হলাম শরৎ সাহেবের। উনি আমার তাড়াহুড়ো দেখে বললেন,
–“এত তাড়াহুড়ো করে কই যাচ্ছেন? জানেন না তাড়াহুড়ো শ*তানের কাজ?”
আমি ছোটো করে উত্তর দিলাম, “অফিস।”
–“তাহলে আস্তেধীরেই যান। সর্বোচ্চ দুটো বকা খাবেন, এত কাহিল হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং দেখবেন তাড়াহুড়ো করলে আরও দেরী হয়ে যাবে।”
–“তা কী করে?”
–“আমাদের জীবনের বেশিরভাগ ক্ষতিগুলো হয় তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই। শয়তানের কাজ তো আর ভালোর জন্য হবে না।” শেষের লাইনটা কৌতুক করে বললেন।
আমি সৌজন্যতার জন্য জিজ্ঞেস করলাম,
–“আপনি এই সকালে কোত্থেকে আসলেন?”
–“টিউশনি করিয়ে এসেছি। এখন আবার জিজ্ঞেস করিয়েন না ত্রিশ বছর বয়সী এই ব্যাটাকে কে টিউশনি দিল? হাহা।”
উনি থেমে আবারও বলল,
–“সকালের টিউশনির লাভ আছে জানেন? টিউশনি কপাল ভালো থাকলে স্টুডেন্টের বাসা থেকেই নাস্তা করে ফেলা যায়। এরপর আমার এক বেলার নাস্তার খরচও বেঁচে যাবে। কী বুদ্ধি ভাবেন ত একবার?”
আমি ওনার কথায় খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে দ্রুত বের হলাম। আজ সত্যিই দেরী হয়ে গিয়েছে, দাঁড়ানোর সময় নেই। কিন্তু দেখা গেল শরতের কথাই ফলে গেল। সত্যিই বিপদ হতে হতে বাঁচলাম, যার ফলস্বরূপ আমার দেরীর পরিমাণ বাড়ল আরেকটু। নিজের কপাল চাপড়ে আবার রওনা হলাম অফিসের উদ্দেশে। টিউশনি ছাড়ার কারণে বাড়ি ফিরলাম সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যেই। বহুদিন পর একা একা ঘুরেছি, নিজেকে সময় দিয়েছি আধ ঘণ্টার মতো। মনে হচ্ছিল যেন মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। নয়তো টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজের কথা, আব্বার কথা যেন ভুলেই বসেছিলাম। যাক, মাঝেমধ্যে এই ধরণের সিদ্ধান্ত তবে মন্দ নয়। বাড়ি ফিরে দেখলাম আব্বা কেচিগেটের বাইরে হাঁটাহাঁটি করছেন, সম্ভবত আমার ফেরার অপেক্ষা করছিলেন। আমাকে দেখে মুখ গম্ভীর করে ফেললেন। আদেশের সুরে বললেন,
–“ছাদে বুয়া কাপড় শুকিয়েছে। সেগুলা নিয়ে এসো।”
বলেই আব্বা ভেতরে চলে গেলেন। আমি মুচকি হাসলাম এই ভেবে, আব্বা আমারই অপেক্ষা করছিলেন। চাকরির পরপর আব্বা প্রায়ই এমন করতেন, তার উপর আজ শুনেছেন টিউশনি দুটোও ছেড়ে দিয়েছি। তাই তাড়াতাড়িই ফিরব। তবে মন বিষণ্ণ হয়ে উঠল আবার। আব্বা কথা বলেন না কতদিন আমার সঙ্গে, কেমন ভার হয়ে আছে বুকটা।
আমি কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে ছাদে উঠলাম। উঠোনে প্রায়ই জামা-কাপড় রশিতে দেই, কিন্তু এই এলাকায় কাপড় চুরির বিদঘুটে ঘটনা আছে। এজন্য একপ্রকার বাধ্য হয়েই এখন ছাদে কাপড় দিতে হয়। ছাদে উঠতেই সুন্দর বাতাস আমাকে ছুঁয়ে গেল, আমি চোখ বুজে তা অনুভব করলাম। আমার মোটেও নিচতলায় থাকতে ভালো লাগে না। আমার খুব শখ দোতলা বা তিনতলায় থাকার। আমার রুমের সাথে একটা বারান্দা থাকবে, আমি সেখানে ররং-বেরঙের ফুল গাছ লাগাব, একটা পাখি পুষব। আর বারান্দা বিলাস তো আছেই। মোটকথা, খোলা বাতাস আসবে। কিন্তু তা বুঝি আর ইহজীবনে পূর্ণ হবে?
দুই চাচা নিচতলা গছিয়ে দিয়েছে আমার বাবাকে। আর ওনারা দুই, তিন তলায় আয়েশ করে থাকছে। খোঁজও নেয় না। ওই মাঝেমধ্যে মেজো চাচী এটা সেটা রান্না করে পাঠান, এছাড়া খুব একটা সখ্যতা নেই। চাচারাও নিজেদের জীবনে ব্যস্ত, আব্বার সাথে সম্পর্ক আগের মতোই কিনা জানি না, তবে আব্বারও খুব একটা খোঁজ নেন না তাঁরা, যা আমাকে তীব্রভাবে হতাশ করে। ছাদে ভাই-বোনদের খেলাধুলা করতে দেখলাম। ওদের সাথে বসার সুযোগই হয় না আমার। তবে ওরা আমার ভীষণ প্রিয়। আরেকটা বোন আছে, মেজো চাচার মেয়ে। নাম কুসুম, এবার অনার্সে উঠেছে সম্ভবত। ভারী মিষ্টি মেয়ে, শুধু ঘরকুনো বিধায় ওর সাথে সেভাবে দেখা হয় না।
পরেরদিন দেখা গেল শরৎ এর দুই জামা চুরি হয়েছে। উঠোনের রশিতে রোদে দিয়েছিল। এ নিয়ে আব্বার সাথে তার আফসোসের শেষ নেই। শরৎ বলল,
–“চোর আমার শার্ট, লুঙ্গি নিছে মানলাম। তাই বলে আন্ডারওয়্যারটাকেও ছাড় দিবে না? আপনিই বলেন, এটা মানা যায়? এটারে অন্তত ছাড় দিবে ভাবছিলাম। লুইচ্চা চোর!”
চলবে~~
বিঃদ্রঃ হায় আল্লাহ, এই পর্বেও শেষ করতে পারলাম না। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর নজরে দেখবেন। সুন্দর সুন্দর মন্তব্যের অপেক্ষায়।