ভাড়াটে মরশুম পর্ব-৪+৫

0
1

#ভাড়াটে_মরশুম – [০৪+০৫]
লাবিবা ওয়াহিদ

[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

পরেরদিনই কুসুমের বিয়ে। বিয়ের আয়োজন নিজস্ব এলাকারই এক কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজন করা হয়েছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে নিয়ে কোনো প্রকার কার্পণ্য করেননি কুসুমের বাবা অর্থাৎ আমার মেজো চাচা। ধুমধাম করেই মেয়েকে তুলে দিচ্ছেন। আমি সেন্টারে পৌঁছেছি কিছুক্ষণ আগে। কুসুম বউ সেজে সঙের মতো স্টেজে বসা। কী যে মিষ্টি লাগছে মেয়েটাকে, বউরূপে। খুদা পাওয়ায় অন্যান্য আত্নীয়দের সাথে খেতে বসে পড়ি। আব্বা চাচাদের সাথে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত। কোত্থেকে হঠাৎ শরৎ তার পাশের চেয়ারটা দখল করে নিল। আমি চমকে তাকালাম পাশে।

শরৎ আজ আর কুঁচকানো পাঞ্জাবি পরেনি। একদম আয়রন করা নীল পাঞ্জাবি পরেছে। পাঞ্জাবির কলারে কিছু কারুকাজ করা আছে। আজ যেন বেকার বেকার ভাব আসছেই না শরতের থেকে। লোকটা সবসময় সাদা-মাটা থাকলেও আজ স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি ওনার ফ্যাশন সেন্স ভালো। শরৎ সাহেব একবার স্টেজ ত একবার খাবার দিচ্ছে কিনা তা দেখছে। সেসব দেখা শেষে সর্বশেষ আমার দিকে তাকাল।
–“প্রিয়াঞ্জনা লক্ষ্য করেছেন? আমাদের পোশাকের রং কাকতালীয়ভাবে এক হয়ে গিয়েছে।”

আমি চমকে নিজের দিকে তাকালাম। শরৎ সাহেবকে দেখার চক্করে নিজের পরিহিত নীল শাড়িটার কথা তো ভুলেই গিয়েছি। এটা আমার মায়ের জর্জেট শাড়ি, চাচী অনুরোধ করলেন যেন এটাই পরি আজ। এটাতে নাকি আমাকে আম্মার মতো লাগবে। তাই বহুদিন পর যত্ন করে রাখা বাকি শাড়িদের থেকে একে নামিয়েছি। চাচী আর আম্মার মধ্যে মোটামুটি ভালোই সখ্যতা ছিল। আম্মা ওনাকে ছোটো বোনের মতো আগলে রাখতেন। ছোটো চাচী আবার সবসময় ছিলেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। খুব একটা আম্মাদের কাছ ঘেঁষতেন না। তিনি একাই থাকতে পছন্দ করেন বেশি, তাই সখ্যতাও সেভাবে আম্মার সাথে হয়নি। এখন আম্মা নেই, তবে বছরের পর বছর যেতে যেতে মেজো চাচী আর ছোটো চাচীর মধ্যে ভালো একটা সম্পর্ক হলো। কিন্তু ছোটো চাচীর একা থাকার স্বভাব আজও বদলায়নি। আমাদের কথা-বার্তা ওই কুশল বিনিময় অবধিই।

–“আপনার শাড়ি থেকে নাইন্টিনস ভাইব আসছে। যেন যত্ন করে আগলে রেখেছেন। শাড়িটা কী আপনার মায়ের?”

শরতের এই একটা অভ্যেস। সে চট করেই আবেগপূর্ণ প্রসঙ্গে আটকে যান, তাও খুব কোমল ভাবে। এইযে এখন; শরতের কোমল, নরম প্রশ্নটা কেমন বুকে বিঁধে দিল। নিজের আহ্লাদী ভাবখানা বহু কষ্টে সামলে নিলাম, ধাতস্থ হলাম। শাড়ির আঁচলটা মুঠোবন্দি করে বললাম,
–“হুঁ, আমার মায়ের।”

–“মায়ের স্মৃতিগুলো সবসময় আদুরে আর যত্নেরই হয়, প্রিয়াঞ্জনা। আমিও মায়ের কয়েকটা শাড়িসহ আরও কিছু জিনিস যত্ন করে রেখে দিয়েছি। মাকে মনে পড়লেই সেখান থেকে একটা শাড়ি নিয়ে মায়ের গন্ধ নিই। এত আরাম দেয়।”

শরৎ বুঝতে পারল যেন আমি ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি। এজন্য সে চট করে প্রসঙ্গ বদলে বলল,
–“আমার একটা হিডেন ট্যালেন্ট আছে জানেন, পুরাতন জিনিসকে ঝকঝকে রাখতে পারি। এইযে দেখুন আমার এই পাঞ্জাবি। কোথা থেকে বোঝা যায় এটা পাঁচ বছর পুরানো? শুধু আয়রন করতে পনেরো টাকার মতো লেগেছে। দেখুন, পনেরো টাকাতেই ব্র‍্যান্ডেড পাঞ্জাবি হাহাহা।”

শরৎ থেমে আবার বললেন,
–“অবশ্য, এটাতে ফিট হবার জন্য কসরত করতে হয়। আমার তো আবার জিমে যাবারও টাকা নেই, ওটা জীবনে বিলাসিতা বই কিছু নয়।”
–“তাহলে ফিট থাকেন কী করে?”

–“টেকনিক জানলে সবই সম্ভব।”

খাবার চলে আসে। শরৎ সাহেব নিজ হাতে খাবার বেড়ে দিলেন। এমনকি পুরো খাবারের টেবিলে আমায় কোনো চামচ ধরতেই দেননি। যা যা প্রয়োজন সব নিজ হাতে পাতে তুলে দিয়েছেন। শরৎ বলল,
–“আপনি আমার জন্যে কষ্ট করে রান্না করেন। এটুকু খেদমত তো করতেই পারি, বারণ করবেন না প্লিজ।”

আমি দেখলাম আত্নীয়রা কেমন অন্য চোখে দেখছে ব্যাপারটা। স্টেজে বসা কুসুমের চোখেও দুঃখের ছায়া। সে বোধ হয় মানতে পারছে না তার বিয়েতে শরৎ সাহেবের এত উচ্ছ্বাস। এ সমস্ত ব্যাপারে আমার নিজেরই গলায় খাবার আটকে রইলো, আর নামতে চাইলো না। শরতের এতদিকে খেয়াল নেই, সে নিজ খেয়ালে বাঁচতে বেশি পছন্দ করে। আমি পাশ ফিরে লোকটার দিকে চাইলাম, খোঁটা দেওয়া গলায় বললাম,
–“আপনার জন্য ভালো মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আর আপনি গোগ্রাসে গিলছেন? মেয়েটার অনুভূতি বুঝলেন না?”

শরৎ খেতে খেতে দায় সারা গলায় বলল,
–“অনুভূতি দিয়ে পেট ভরে না প্রিয়াঞ্জনা। আপনি উলটো আমাকে ধন্যবাদ দিন আপনার বোনের এত বড়ো উপকার করে দিয়েছি। কোথায় বেকার শরৎ সাইমন আর কোথায় সরকারী চাকরিজিবী পাত্র। আপনার বোনের পেট ভরাতে না পারলে আপনার বোনই কপাল ঠুকত দেয়ালে এই ভেবে যে সে কোথায় এসে পড়েছে। ভালোবাসা যাক গোল্লায়।”

–“তো আপনি কী আশা করেন একটা মেয়ে চাকরি ছাড়াই আপনার ঘাড়ে এসে বসবে? আপনি আপনার দায়িত্ব পালন না করে ঘরে পড়ে থাকবেন?”

–“এজন্যই ত আমি বিয়ে করতে রাজি না। যেখানে নিজের চাকরির খোঁজ নেই সেখানে নতুন করে দায়িত্বের ভার.. কী দরকার? আমি এমনিই ছন্নছাড়া আছি ভালো।”

–“চাকরির জন্য চেষ্টা করতে হয়। আপনি কতখানি করেন তা জানা আছে, শুধু পারেন বেকার বেকার বলে ঘুরে বেড়াতে।” বহুদিনের জমে থাকা রাগ সুযোগ বুঝে ঝেড়ে দিলাম আমি।

–“আপনার কী মনে হয় আমি চেষ্টা করছি না?”

–“চেষ্টা করছেন কিন্তু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নয়। আত্মবিশ্বাস না থাকলে চাকরিও কখনো আপনাকে ধরা দিবে না।”

শরৎ গুরুত্ব দিল না খুব একটা। বলল,
–“সে যাইহোক, এখন আপনার বোনের বিয়েটা খেতে দিন। পরেরটা পরে ভাবা যাবে। ইশ, গোরুটা রান্না হয়নি ভালো মতো। ধ্যাত, তৃপ্তি পাচ্ছি না। অথচ প্লেট ভরে নিলাম। শুধু শুধু খাবার অপচয়।”

আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে কুসুমের দিকে তাকালাম। কুসুম সবার সাথে ছবি তোলার পাশাপাশি সুযোগ বুঝে শরতের দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটা সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে তাকে। ভালোবাসা বুঝি এত পরিমাপ, ভালো-মন্দ দেখে হয়? আমি আনমনে বললাম শরৎ-কে,
–“আপনি প্রেমে না পড়লে বুঝবেন না কুসুমের অনুভূতি। প্রেমের অনুভূতি এমন এক অনুভূতি, জীবনটাই কেমন হয়ে যায়। আমি চাই আপনি জীবনে একবার প্রেমে পড়ুন। অনুভব করুন এই প্রেমের তাণ্ডব।”

শরৎ খাওয়া ছেড়ে আমার দিকে তাকাল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
–“বদদোয়া দিলেন?”
–“কাউকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য অন্তত করবেন না প্রেমে পড়লে। তাই আপনার প্রেমে পড়া উচিত।”

শরৎ আমার দিকে তাকাল, আপাদমস্তক দেখল৷ এরপর আবার খেতে মনোযোগ দেয়।

বরপক্ষ আসল কিছুক্ষণের মধ্যেই। শরৎ বেশিক্ষণ থাকেনি, খেয়ে-দেয়ে টাকা জমা দিয়েই চলে গেল। চোখ-মুখে কেমন তার ঘুম লেপ্টে ছিল, যেন বাড়ি গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চাদর ছাড়া তোষকটায় গা এলিয়ে দিবে।

কুসুমের বিয়ের পর শরৎ সাহেবের সাথে আমার আর মিনিট ধরে কথা হয়নি, ওই যেতে-আসতে যতটুকু দেখা হয় আর কি। মেজো চাচী কুসুমকে ছাড়া কেমন একা হয়ে গেছেন। এজন্য প্রায়ই আমাদের ঘর থেকে ঘুরে যান, আমার সাথে কিছুটা সময় কাটান। আমি বুঝতে পারি ওনার নিঃসঙ্গতা। তবে তিনি শরৎ-কে একদমই দেখতে পারেন না। আমিও যে খুব দেখতে পারি এমনও না। হ্যাঁ লোকটা ভালো, তবে দায়িত্ব-জ্ঞানহীন। তার কোনো ভালো কাজই আমার চোখে লাগে না। আমি কেন যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই নেতিবাচক স্বভাবই বের করি।

এর মাঝে দুই মাস কেটে গেল। দুই মাসের বাসা ভাড়া শরৎ সাহেব আটকে রাখলেন। আব্বাকে এতে মোটেও বিচলিত হতে দেখা যায়নি। তবে তার যত সমস্যা আমার বিয়েতে ‘না’ করা নিয়ে। এই মাস দুয়েকে কয়েকটা সম্বন্ধ এসেছে। এই সম্বন্ধে হয় বিয়ে কোনো না কোনো কারণে ভাঙছে আর নয়তো আমি ভেঙে দিচ্ছি। এ নিয়ে লোকমুখে আমাকে গুঞ্জন আরও বেড়েছে। আব্বাও কেমন এ বিষয় নিয়ে দিনকে দিন বিরক্ত হচ্ছেন। কিন্তু সবকিছু বাদেও যদি মনের মিল খুঁজতে যাই, আমি তা পাই না খুঁজে। মনের মিল না পেলে কী করে একটা জীবন পার করব? এভাবে করতে করতে বোধ হয় আমার বয়স পঁচিশ থেকে ছাব্বিশে পদধুলি দিবে।

|পর্ব ০৫|

আব্বা আজ অফিসে থাকাকালীন কল দিলেন আমায়। আদেশ করলেন যেন তাড়াতাড়ি ফিরি, পাত্রপক্ষ আসবে। অগত্যা, তাড়াতাড়িই ফিরতে হলো। এলাকায় আসতেই কিছু কেনাকাটার জন্য মুদি দোকানে ঢুকলাম। মেহমানদের আপ্যায়ন করার জন্য চানাচুর, নাটি বিস্কুটসহ অন্যান্য জিনিস নিয়ে নিলাম। মুদির দোকানের পাশের দোকানটাই কাশুর টং, সেখানে বসে আয়েশ করে চা খাচ্ছিল শরৎ। তিনি আমাকে দেখে বললেন,
–“আরে প্রিয়াঞ্জনা যে, আসুন। বসে চায়ের আড্ডা দেই।”

আমি বারণ করলাম।
–“সম্ভব না, আমি ব্যস্ত।”

–“ব্যস্ততা সবার জীবনেই আছে। ধরে নিন এটা আপনার ব্যস্ত দিনের ‘চায়ের ব্রেক’। আসুন, প্রিয়াঞ্জনা।”

একপ্রকার বাধ্য হয়েই তার থেকে দূরত্ব রেখে বসলাম। কাশু চাচা চা বানিয়ে দিলেন। দুজন হাতে তুলে ধরতেই শরৎ বললেন,
–“জীবনে এই চা-কেই আমি এফোর্ট করতে পারি।”

আমি নীরব। ফুঁ দিয়ে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। শরৎ সাহেব আমাকে অনুসরণ করল। বলল,
–“আজকের ব্যস্ততা কী পাত্রপক্ষকে ঘিরে?”

–“বুঝলেন কী করে?”
–“কারণ প্রত্যেকবার পাত্রপক্ষের কথা শুনলেই আপনার মুখ থেকে উজ্জ্বলতা হারিয়ে যায়, প্রিয়াঞ্জনা। অথচ বিয়ের ক্ষেত্রে নারীদের মুখে সুখ ভর করার কথা।”

আমি নীরব। শরৎ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
–“এবারও বিয়েটা ভেঙে যাবে, চিন্তা করবেন না।”

–“কী করে?”
–“আমি ভেঙে দিব, আজ আর পাত্রপক্ষ আপনার ঘর অবধি পৌঁছাবে না।”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম শরতের দিকে।
–“আপনি কেন ভাঙবেন? এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।”
–“হয়তো ব্যক্তিগত। তবে আপনার এই দুঃখী মুখ আমার বড্ড অপছন্দের, প্রিয়াঞ্জনা। তাই এটা আমারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে ঢুকে গেছে।”

–“ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে সোজা কথা বলুন, আমি আঠারো বছর বয়সী রঙিন তরুণী নই যে এসব কথায় গলে যাব।”

শরৎ এবার আমার চোখের দিকে তাকাল। ওনার চোখ জুড়ে অদ্ভুত এক তেজ ছিল, যা আমি বেশিক্ষণ সইতে পারলাম না। দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেললাম। আমার এই অপ্রস্তুত মনোভাব দেখে শরৎ গা দুলিয়ে হাসলেন।

–“দেখলেন প্রিয়াঞ্জনা? আপনি আমার সামান্য চাহনিতেই ভড়কে গিয়েছেন। সোজা কথা কী করে সইবেন? সেই সৎ সাহস আপনার নেই।”

আমি অজুহাত খুঁজলাম। তবে চায়ের কাপে এখনো অর্ধেক চা জমে আছে। আমি গরম গরম চা খেতে পারি না। তাই চেয়েও পুরোটা শেষ করতে পারলাম না। কিন্তু আমার যে পালাতে হবে। আমি কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
–“আসছি।”
–পালাচ্ছেন?”
–“না।”
–“তবে চা শেষ করুন। এত তাড়ার কিছু নেই।”

আমি না চাইতেও আবার বসলাম। দেখালাম আমি খুব সাহসী, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি বড্ড এলোমেলো এবং নাজুক হয়ে গিয়েছি। যেই লোকটাকে আমি তীব্র মনে অপছন্দ করি তাকে ঘিরে এই ধরণের আজেবাজে চিন্তা কেন মাথায় আসছে? কেনই বা এমন ভড়কে যাচ্ছি বুঝে আসছে না। শরৎ আরেক কাপ চায়ে ঠোঁট ডুবিয়ে বললেন,
–“আপনার বদদোয়া কাজে লেগে গিয়েছে প্রিয়াঞ্জনা। আমি এখন সইতে পারব না অন্য কেউ পাত্রপক্ষ রূপে আপনাকে এসে দেখবে।”

আমার আত্মা কেঁপে উঠল শরতের এহেম স্বীকারোক্তিতে। হৃদপিণ্ডের ওঠানামা ভীষণ বেসামাল, অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি শক্ত হয়ে বসে রইলাম। ভালোবাসি না বলেও বুঝি ভালোবাসা অনুভব করানো যায়? কী করে? এই লোকটা এত তীব্রভাবে কী করে আমাকে অনুভব করালো? আমি গলায় কম্পন তুলে বললাম,

–“বিয়ে ভাঙবেন না।”
–“ভাঙব। আপনার কথা শুনতে গেলে আমার খালি পেটে থাকতে হবে।”

–“আবেগী হচ্ছেন বেশি বেশি।”
–“এটা আপনার বদদোয়ার ফল। আপনাকে নিয়েই ভুগব।”

বুঝলাম শরৎ সাহেব ধীরে ধীরে নিজের সিরিয়াসনেস হারিয়ে ফেলছেন। তিক্ত কথা বলে তাকে জাগিয়ে দেওয়া জরুরি। তাতে অন্তত যদি সে পিছু ছাড়ে।

–“আপনার হাতে চাকরি-বাকরি নেই। আমি কেন আপনাকে গুরুত্ব দেব?”

কথাটা বোধ হয় কাজে লাগল। শরতের মুখের রং আচমকাই কেমন পরিবর্তন হয়ে গেল। সে চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,
–“চ্যালেঞ্জ করছেন আমায়?”
–“আপনার জীবন, আমি কেন চ্যালেঞ্জ করতে যাব? আমি আপনার কিছুই হই না।”

–“হবেন। তার আগে চ্যালেঞ্জটা পূরণ করে নিই।”

আমি আর পারলাম এই লোকের চোখের সামনে বসে থাকতে। চা শেষের পথে। এবার আমি সত্যিই অজুহাত খুঁজলাম,
–“আসছি।”
–“কথায় না পারলে সবাই আপনার মতো অজুহাত খুঁজে। যাক, ব্যাপার না। বিল নিয়ে ভাবতে হবে না আপনার, আপনি বাড়ি যান। আর অপেক্ষা করুন শুনতে যে— পাত্রপক্ষ আসছে না।”

সত্যি সত্যিই সেদিন আর পাত্রপক্ষ আসল না। শুধু তাই নয়, আব্বা নিজে আসতে না করেছেন। কেন কে জানেন, তবে বুঝলাম এতে শরতের হাত আছে। কিন্তু আমি এ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। লোকটার মাথায় আবার কোন ভূত চেপে বসল?

আমি সন্ধ্যার পরপর ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। এত এত দুশ্চিন্তা, ভারের মাঝে এ যেন আমার একমাত্র শান্তি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শরৎ সাহেব কোত্থেকে ছাদে আসলেন। এলাকায় কারেন্ট নেই, তাই অতি গরমে ছাদে আসাটা অস্বাভাবিক নয়। বাড়ির বাকিরাও কারেন্ট না থাকলে ছাদে আসে। তবে আজ কেন যেন কেউই আসল না। আসবেই বা কেন? তাদের খোলা বারান্দা, বড়ো জানালা আছে। সেখান দিয়েই হুড়মুড়িয়ে বাতাস ঢোকে, তাদের ছাদে না আসলেও চলে। আমি শরৎ-এর দিকে না তাকিয়েই বললাম,
–“আপনার মনে হচ্ছে না আপনি একটু বেশি বেশি পিছু নিচ্ছেন আমার?”

–“চাকরি পেয়ে গেলে ভালো হয়ে যাব। ততদিন অবধি থাকি নাহয় একটু বেপরোয়া, ছন্নছাড়া। চিন্তা করবেন না, শরতের ব্যক্তিত্বের সাথে এমনিতেও ছ্যাঁচড়ামি যায় না। তাই সে ছ্যাঁচড়ামি করবে না আপনার সঙ্গে!”

আমি চুপ রইলাম, এটা সত্যি। শরৎ তার অনুভূতি প্রকাশের পর কিংবা আগে কখনোই ছ্যাঁচড়ামি করেনি। তার বয়স অনুযায়ী তার মন-মানসিকতা, চলাফেরা কিংবা ভাবনার ধরণ সবকিছু আলাদা ব্যক্তিত্ব ধারণ করে। আর বরাবরই শরৎ আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে। প্রেমে কী করে পড়ল কে জানে? তার এই বয়সটা মোটেও ঠাট্টার নয় যে সে আমার সাথে এসে ঠাট্টা করবে।

–“আব্বাকে কী করে রাজি করালেন পাত্রপক্ষকে না বলতে?”
–“পাত্র বুড়ো ছিল, ডিভোর্সী। সেটা গোপন করেই আপনাকে দেখতে আসতে চাচ্ছিল।”
–“এত খবর কোথায় পান?”
–“বাতাসই যথেষ্ট কান অবধি খবর পৌঁছানোর জন্য।”
–“ভুল করছেন আপনি।”
–“মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়, করলাম নাহয় একটি সুখের ভুল।”
–“আব্বা জানলে দুঃখ পাবে।”
–“উহু, খুশি হবে।”
–“দুই মাসের ভাড়া আটকে রেখে কোন মুখে বলছেন খুশি হবে?”
–“আপনার বাড়ি ছেড়ে তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না। টাকা হাতে আসলেই দিয়ে দিব।”
–“প্রথম মাসে তো সুন্দর ভাবেই দিলেন, আবার এই দুই মাস হাত ফাঁকা কেন?”

শরৎ এ বিষয়ে কিছু বলল না। আমি থেমে বেশ শক্ত গলায় বললাম,
–“প্রমাণ করুন যে আপনি আমার দায়িত্ব নিতে পারবেন। নয়তো এসব ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।”
–“এর মানে আপনি ইতিবাচক ইঙ্গিত দিলেন?”

আমি চমকে উঠলাম,
–“না তো।”
–“নজর লুকাবেন না প্রিয়াঞ্জনা। আমিও কথা দিচ্ছি, আমাকে দুই মাস সময় দিন। সব হয়ে যাবে।”
–“এত কনফিডেন্ট?”

–“শরৎ সাইমনের জন্য কনফিডেন্টই তার সম্পদ। আর আপনি আমার শক্তি। এতদিন এই শক্তির অভাবেই শুকিয়ে যাচ্ছিলাম।”

অদ্ভুতভাবে আমার চারপাশে শরৎ সাহেবের উপস্থিতি বদলে গেল। সে ইনিয়ে-বিনিয়ে আমাকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেন। এইযে সেদিন, ছুটির দিন ছিল। ভীষণ মাথা ব্যথা করছিল। রান্না করা প্রায় অসম্ভব। আব্বাকে বলতেও পারছিলাম না এ বিষয়ে। উঠোনে কী যেন করছিলাম, হঠাৎ শরৎ এসে বললেন,
–“আপনি ঠিক আছেন প্রিয়াঞ্জনা?”

আমার তখনো কপালের ভাঁজ কাটেনি। বিরক্ত গলায় বলেছিলাম, “হ্যাঁ। আমার আবার কী হবে?”

দেখা গেল জ্বরও উঠে গেল ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। শরৎ সাহেব ততক্ষণে আব্বাকে ঘোষণা দিলেন তার পক্ষ থেকে আজকে বিরিয়ানির ট্রিট। নামাজের আগে আগে তিন প্যাকেট বিরিয়ানি আর সেভেনআপ কিনে দিয়ে গেলেন, আব্বাও ভীষণ খুশি হলেন এতে। যার ফলস্বরূপ সে বেলা আমার উপর আর রান্নার চাপটা পড়ল না। এই সূক্ষ্ম ব্যাপারটা আব্বাও খেয়াল করেননি।

বিকালে ছাদের শুকনো কাপড় ঘরে দিয়ে গেল। যা প্রায়ই করে থাকে সে। আমি অফিস থেকে ফিরতে দেরী করলে হয় মেজো চাচী নয়তো শরৎ কাপড় এনে রাখে। আমি তাকে এ সমস্ত কাণ্ড করতে না করলে তিনি আমার কথা শুনে না। উলটো ত্যাড়া উত্তর দিবে,
–“পুরুষরা বউয়ের কথায় উঠে বসে, আপনি ত আমার বউ নন। তবে কেন শুনব আপনার বারণ?”

আমি উপলব্ধি করলাম, শরৎ আগের থেকে এফোর্ট বাড়িয়ে দিয়েছে চাকরি খোঁজা নিয়ে। যেখানে সেখানে ছুটছেন চাকরির খোঁজে। কিন্তু চাকরি দেখতে গেলে কিছু না কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছেই, হয় না করে দিচ্ছে নয়তো মোটা অংকের ঘুষ চাচ্ছে। শরৎ তখন তাদের বিচ্ছিরি বকা দিয়ে ফিরে আসে। সে সব সইতে পারে, অসৎ রোজগারের কথা একদমই শুনতে পারে না।

বাবার সাথে প্রায়ই বলে,
–“ভাবছি বিয়েটা করে ফেলব। যৌতুকও নেওয়াও তো একটা চাকরি, তাই না? যৌতুকের টাকা দিয়েই পরে নাহয় বউ পালব।”

আব্বা তখন খুব হাসেন। কিন্তু আমি ত বুঝতে পারি তার চোখের হতাশা। সে এখন আর আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসে না আমার সাথে। দূর থেকে যতটা সম্ভব ততটা করে যায় আমার জন্য। লোকটার কর্মকাণ্ডে এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, লোকটা সত্যি আমাকে ভালোবাসে— সত্যিই। সে এত হতাশার মাঝেও হাল ছাড়েনি, সঙ্গে আর কোনো পাত্রপক্ষও আসতে দেয়নি আমার বাড়িতে। এক দিক থেকে আমার এটাই আমার স্বস্তি। সে ঠিকই বলেছিল, আমি তার শক্তি।

আব্বা আমার সাথে মান-অভিমান কিছুটা ভাঙিয়ে নিয়েছে। তবে অভিমান যে পুরোপুরি আমার বিয়ের মাধ্যমে ভাঙবে তা আমার বুঝতে বাকি নেই। আমিও বোধ হয় কোথাও না কোথাও অপেক্ষা করছি, শরতের পক্ষ থেকে কোনো সুসংবাদ।

সেদিনও শরৎ বলছিল,
–“ভাবছি কাশু চাচার মতো একটা টং খুলে বসে পড়ব। অন্তত প্রতিদিন চা বেঁচেও হাজার করে উঠবে। দেশের চাকরির বাজারের যা করুণ অবস্থা।”

আমি নীরব থাকি তখন। শরৎ থেমে আবার বলেছিল,
–“আপনার আব্বাকে বলুন যৌতুক প্রস্তুত করতে। সেই যৌতুকের টাকা দিয়েই আমি টং খুলে বসব। ইনকাম সোর্স ভালো।”

আমি তখন হাসি আটকে রাখতে না পেরে হেসে দিই। বলেছিলাম, “পাগলামি ছাড়ুন।”
–“পাগলামি করে যদি আপনার ভার মুখে হাসি ফুটানো যায় তবে তা ছাড়ার কী দরকার?”

——————————-
অফিসে দুপুরের খাবারের ব্রেক চলছিল আমার। সবে ভাতের লোকমা মুখে পুরেছি, ওমনি একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসল। আমি ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। জরুরি ভেবে খেতে খেতে কল রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে শরতের গলা শুনে আমি অসাড় হয়ে গেলাম। উনি আমার নাম্বার পেল কোথা থেকে?

শরৎ সাহেবের গলা থেকে যেন উচ্ছ্বাস ঝড়ছে। সে অত্যন্ত খুশি হয়ে বিখ্যাত সেই লাইনটা নাটকীয় গলায় বলল,
–“প্রিয়াঞ্জনা শুনছ, চাকরিটা আমার হয়ে গিয়েছে।”

®লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে~~