#ভাড়াটে_মরশুম – [শেষ]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
বিয়ের কনে সেজে পানের স্টলে এসেছি। পাশেই দাঁড়ানো আমার সদ্য বিয়ে করা স্বামী, শরৎ। তার জ্বরে চোখ-মুখের বিধ্বস্ত অবস্থা। এই রাত দশটায় পানের দোকানে বউ সাজে আমি আর শেরওয়ানি পরা শরতকে এলিয়েনের মতোই অনুভূতি দিচ্ছে। আশেপাশের মানুষজন চোখ পাকিয়ে আমাদের দুজনকে দেখছে। আমি আশেপাশে নজর বুলিয়ে শরতের দিকে রাগী চোখে তাকালাম। চাপা গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লাম,
–“এগুলো কী ধরণের আবদার? দেখছেন সবাই কেমন করে দেখছে? বাড়ি চলুন ত!”
–“লোকের ধর্মই হচ্ছে দেখা, প্রিয়াঞ্জনা। আপনি তাদের এভাবে বঞ্চিত করতে পারেন না। গরম পান খাবেন আসুন।”
–“শরৎ সাহেব, আপনার সবেতেই বাড়াবাড়ি!”
–“বাড়াবাড়ি না করতে শিখলে যে আজ আপনাকে মিসেস শরৎ ভুঁইয়া রূপে দেখতাম না, প্রিয়াঞ্জনা।”
চুপসে গেলাম, মুখ থেকে আর কোনো কথা বের হলো না। শরতের ক্লান্ত ঠোঁটে যে হাসি ফুটেছে, তা আমার চোখ ফাঁকি দিতে পারল না। লাজে অন্যদিকে ফিরে গেলাম। শরৎ তখন পান অর্ডার দিল।
শরৎ এবার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
–“আজ বৃষ্টি হলে মন্দ হয় না মিসেস।”
অন্তর কেঁপে উঠল আমার। আমরা আগেও এই পানের দোকানে এসেছিলাম। তবে আচমকা ঝপঝপিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি নামায় সেদিন পানের স্টল খোলা পাইনি। অগত্যা, আমাদের সেদিনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। সেই বৃষ্টিতে আমরা কোনো এক দোকানের ছাউনিতে দাঁড়িয়েছিলাম, বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছিলাম। শরৎ তখন বলেছিল,
–“আমি কখনো বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করি না প্রিয়াঞ্জনা। হয় ভিজি, নয়তো উপভোগ করি। বিয়ের অনুমতি থাকলে আপনাকে সঙ্গে করে ভিজতাম। তাই আপাতত বৃষ্টির চাইতে আপনার অপেক্ষা করতে হচ্ছে বেশি।”
আমাদের বিয়েটা হলো শরতের দ্বিতীয় বেতনের পরেরদিনই। শরৎ আচমকাই জ্বরে কাবু হয়ে পড়েছিল, তার উপর আব্বার নতুন করে পাত্র দেখার কার্যক্রম শুরু হয়ে গিয়েছিল। শরৎ সাহেব জ্বরের মধ্যে এমন খবর সইতে পারেনি। উনি জ্বর নিয়ে আচমকাই রাত সাড়ে আটটা নাগাদ আমাদের ঘরে আসে। আমি তখন ওনার জ্বরের কথা শুনে গরম গরম তরকারি রাঁধছিলাম, রাতের খাবারে দিয়ে আসব বলে। আব্বা শরতের উত্তেজনা, অস্থিরতা দেখে তাকে বসতে বলেন। উনি বসে সঙ্গে সঙ্গেই আমার আব্বাকে বলল,
–“আঙ্কেল, আপনি জানেন আমি ধানাই পানাই পছন্দ করি না। যা মনে আসে, তাই বলে দেই। আমার মা নেই, বাবাও তার আরেক সংসারে ব্যস্ত। তাই বলতে পারেন, এই এতিমের অভিভাবক নেই। একটা অল্প বেতনের চাকরি আছে, পুষে যাবে। আপনি কী আমার রবিন আঙ্কেল থেকে শ্বশুর আব্বা হবেন? আপনার মূল্যবান মেয়েকে কী আমাকে দিবেন আঙ্কেল? কথা দিচ্ছি আপনার অমূল্য রত্নকে খুব যত্নে আগলে রাখব।”
জ্বরের ঘোরে শরৎ-কে পাগল পাগল লাগছিল। সে আব্বার মুখ থেকে হ্যাঁ না শুনে উঠবেই না। আব্বা পড়লেন মুসিবতে, ভাবনারও সময় পেলেন না। আমি ত রান্নাঘরে থম মেরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এত বড়ো লোক আজ এমন বাচ্চা হলো কেমন করে? প্রেমের বুঝি বয়স বাড়ে না? অবশেষে আব্বা রাজি হলেন। শরৎ সাহেব তৎক্ষণাৎ ঘরে গিয়ে একটা সুন্দর লাল শাড়ি আর শেরওয়ানি আনলেন। শরৎ এক্ষুণি বিয়ে করবে। আব্বা কিছু বললে শরৎ বলেছিল,
–“কিছু মনে নিবেন না আঙ্কেল, তবে জ্বর হওয়ার থেকে কেন যেন মনে হচ্ছে আমি প্রিয়াঞ্জনাকে হারিয়ে ফেলব। আমি এক্ষুণি ওকে বিয়ে করতে চাই আঙ্কেল।”
আব্বা ততক্ষণে কাজী এবং আমার চাচাদের ডাক পাঠালেন। আমার তখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না। সব এতই দ্রুত হচ্ছিল যে মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়েছিল। শরৎ আমার হাতে লাল টুকটুকে শাড়িটা দিয়ে বলল,
–“আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন না বেতন পেলেই মানুষ কতকিছু করে? গতকাল বেতন পেয়েই আপনার জন্য শাড়ি এবং এই শেরওয়ানিটা ভাড়ায় এনেছি। দ্বিতীয় বেতনেই আমাদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে— শুনছ প্রিয়াঞ্জনা?”
————————-
পান মুখে দিতেই ঝালে পেয়ে বসল আমায়। যেহেতু অনেক ঝালেও আমি অভ্যস্ত তাই বেশি সমস্যা হলো না। শরৎ তখন পান চিবুতে চিবুতে লাল দাঁত বের করে হাসছে। এটা তার সুখের হাসি। পান খেয়ে দাঁত লাল করা অবস্থাতেও শরতকে কী দারুণ লাগছে। লোকটা কী আসলেই সুন্দর নাকি ভালোবাসে বিধায় তার চোখে এত সুন্দর লাগে?
পান খেয়ে দুজন হাতে হাত ধরে রাস্তার ফুটপাত ধরে বাড়ি ফিরছে। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলো নব বঁধু এবং বরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে, সঙ্গে হালকা বাতাস ত আছেই। এই প্রথম শরৎ আমার হাত ধরেছে, পূর্ণ অধিকার নিয়ে। তবে লোকটার গায়ে এখনো জ্বর অনুভব হচ্ছে। আমি মলিন গলায় বললাম,
–“আপনার এখনো খুব জ্বর, শরৎ। কেন পাগলামি করছেন?”
শরৎ তখন মুচকি হাসল। আমাকে আচমকা তার বুকে আগলে নিয়ে হাঁটতে লাগল, আমার সমস্ত শরীর তখন কাঁপন দিয়ে উঠল। সেই কম্পন বুঝি শরৎ সাহেবও টের পেল। শরৎ আকাশের পানে চেয়ে গুণগুণ করে বলল,
–“তোমাকে অসাধারণ বউ লাগছে, প্রিয়াঞ্জনা। এত সুন্দর, যত্ন করা বউ পাওয়ার ভাগ্য আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, কৃতজ্ঞায় যে মাথা নুইয়ে আসছে। আর তুমি ভাবছ জ্বরের কথা। বিশ্বাস করো, জ্বরের চাইতেও আমার আনন্দ বেশি।এখন আমার হাতে হাত ধরে শুধু রাতটা উপভোগ করো প্রিয়াঞ্জনা।”
শরৎ সাহেবের মুখে এই প্রথম “তুমি” সম্বোধন। মুহূর্তেই মনে হচ্ছে আমি মানুষটার কত আপন, কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি তার জীবনের অংশ। লাজে চোখ নামিয়ে ফেললাম। শরৎ আমাকে সেভাবেই বুকে আগলে নিয়ে গুণগুণ করে গান ধরল,
“এই রাত, তোমার আমার
এই চাঁদ, তোমার আমার।
শুধু দুজনের
এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণ এ দুটি প্রাণের।”
যখন বাড়ি ফিরলাম, আমাকে আব্বার কাছে দিয়ে শরৎ নিজের ঘরে চলে যায়। তার ভাষ্যমতে সে এমন ঘরে আমাকে স্বাগতম করবে না। সে একটা নতুন বাসা দেখেছে, আমাদের এলাকাতেই। সেখানেই আগামীকাল নিয়ে যাবে। যাওয়ার আগে শরৎ সাহেব বলে যায়,
–“আঙ্কেল, মন থেকে বিয়েটা মেনেছেন ত?”
আব্বা তখন হেসে দিয়ে বলেছিলেন,
–“অমত থেকে একমাত্র মেয়ের বিয়ে কী করে দেওয়া যায় পাগল?”
–“যাক আঙ্কেল, আজ রাতে বোধ হয় স্বস্তির সাথে ঘুমাতে পারব। আসি আঙ্কেল, আপনার মেয়ের যত্ন নিবেন।”
অগত্যা, বিবাহিত আমি শরতহীন প্রথম রাত কাটালাম। সকালে উঠেই দেখলাম আব্বা দুই কাপ চা নিয়ে অপেক্ষায়। অবাকই হলাম, আব্বা অনেকদিন পর চা করলেন। আব্বা অন্য রান্না না পারলেও মোটামুটি চা বানাতেই পারেন। আব্বা বহুদিন পর অভিমান ভেঙে মিটমাটের হাত বাড়িয়ে দিলেন হাসি-মুখে। কিন্তু আমার আচমকাই মুখ পাংশুটে হয়ে এলো, বুক ভার হয়ে এলো। আজ যে আমার আব্বাকে ছেড়ে অন্যের ঘরে চলে যেতে হবে। কী করে থাকব আব্বাকে ছাড়া? আব্বা আমায় ছাড়া কীভাবে থাকবেন, কীভাবে ঘুমাবেন? বুকে পাহাড়সম দুঃখ নিয়ে আব্বার পাশে বসে চায়ে চুমুক দিলাম। আব্বা তখন চা কেমন হয়েছে তা জানার অপেক্ষায়।
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম,
–“দারুণ হয়েছে আব্বা।”
আব্বা হাসলেন। পরপর নিজেও চায়ে চুমুক দিলেন। মুখে তৃপ্তির শব্দ তুলে বললেন,
–“গোছগাছ শেষ?”
আমি আলতো করে মাথা নাড়াই। আব্বা কিছুটা সময় নিয়ে বললেন,
–“শরৎ ছেলেটা ভালো, ওকে আমি যতটুকু কাছ থেকে দেখেছি.. ততই মনে হয়েছে ছেলেটা ভীষণ সরল, নরম। ওর বাড়ির দিকেও খোঁজ-খবর নিয়েছি, সব শুনে বুঝলাম ছেলেটা ছোটো থেকেই অবহেলায় বড়ো হয়েছে। আপন মানুষ কী তা কখনো চিনতে পারেনি। কিন্তু তবুও কখনো বখে যায়নি।”
–“খোঁজ নিয়েছ?” আমার অবাক গলা।
আব্বা হালকা হেসে বললেন,
–“মেয়েকে বুঝি অল্প চেনা ছেলের হাতে তুলে দিব? এতটা বোকা কোনো বাবা নয়, প্রিয়াঞ্জনা। শরতের কখনো খোঁজ না নেওয়া বাবার সাথে বসেও কথা বলেছি। লোকটা তাঁর ছেলের প্রতি সেভাবে আগ্রহ দেখাননি, তাই আমিও আর কথা বাড়াইনি।”
–“তবুও রাজি হলে?”
–“শরৎ এতদিন অবধি যতটা এসেছে.. সে নিজের একার পরিশ্রম, চেষ্টায় এসেছে। বিয়ে আমি শরতের সাথে তোমায় দিয়েছি, ওর বাবা যদি সন্তানের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন ওটা তাঁর ব্যর্থতা, মা।”
আব্বা থামলেন, আমিও চুপ করে চায়ে চুমুক দিলাম। আব্বার দিকে তাকালাম না। দুজনের নীরবতার মধ্যেই কীভাবে যেন দুঃখ ভীড় জমালো। আব্বা আচমকাই অস্বাভাবিক নরম গলায় বললেন,
–“কখনো ভুল করে থাকলে মাফ করে দিস মা। আল্লাহ তোকে আমার ভাগের সুখগুলাও দিক। তুই সুখে থাকলেই আমার সুখ। তুই ছাড়া আমার আর কে আছে মা?”
দুপুর বারোটা নাগাদ আমরা নতুন ফ্ল্যাটে পৌঁছালাম। দু’রুমের ছোটো একটা বাসা। দুটো বেড রুম, একটা লিভিংরুম, একটা বাথরুম, একটা কিচেন আর সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার এক রুমের সাথে সুন্দর এক বারান্দা। বারান্দা দেখেই আমার খুশির অন্ত রইলো না। এ যেন আমার মনে সাজানো ছোট্ট ঘরের ছোট্ট সংসারের রূপান্তর। শরৎ ঠিকই আমার পছন্দের সবদিক খেয়াল রেখেছে। যদিও ফার্ণিচার বলতে শুধু একটা খাট আর আরএফএলের একটা ওয়ারড্রব। শরৎ সাহেব পেছন থেকে লাগেজ টেনে একপাশে রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার কপালের পাশে চুমু দিয়ে বলল,
–“এই ছোটো ঘর পছন্দ হয়েছে প্রিয়াঞ্জনা? দুঃখিত, তোমার স্বামীর পনেরো, বিশ হাজারের বাসা ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আপাতত এই আট হাজার টাকার ফ্ল্যাটেই নিজেকে সামলে নাও।”
–“সামর্থ্যে কিছু যায় না সাহেব, সামর্থ্য থেকেও সুখ প্রয়োজন। আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের তা আছে। যার ঘরে সুখ আছে সে অখুশি থাকতেই পারে না।”
ধীরে ধীরে দুজনে হাতে হাতে নিজেদের ছোট্ট সংসারটা গুছিয়ে নিলাম। আমি এবং শরৎ দুজনেই চাকরিরত। আমি চাকরি ছাড়িনি, শরৎ সাহেবের থেকেও কোনো প্রকার নিষেধাজ্ঞা নেই। তিনি সবসময়, সব পরিস্থিতেই আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করেন, সাপোর্ট দেন। আবার কখনো ভুল করলে বুকে আগলে নিয়ে শুধরে দেন। আমাদের কত যে অভিমানের ঝগড়া হয়। ঝগড়া হলেও সেই একই বিছানায় দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে সমস্ত রাগ মিটিয়ে ফেলি। ছুটির দিনে বিকেলে বারান্দায় একসাথে বসে চায়ের আড্ডা কিংবা রাতে দুজনে হাতে হাত রেখে ফুটপাত ধরে হাঁটা। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি বিলাস কিংবা বৃষ্টিতে গা ভেজানো, আবার কখনো কখনো শরৎ ফুল আনে ফেরার পথে। এই বিবাহিত জীবনে আহামরি চাওয়া-পাওয়া নেই, তবে এই সম্পর্কের আনাচে কানাচে ভরে আছে ছোটো ছোটো সুখের গল্প। সব মিলিয়ে জীবন সুন্দর। ফুলের মতো সুবাস ছড়ানো সুন্দর।
বিয়ের প্রায় সাত মাস। আব্বার সাথে রোজই কথা হয়। ছুটিতে কিংবা সুযোগ পেলেই আব্বার সাথে দেখা করে আসি। ছুটির দিনে আমি আর শরৎ মিলে চলে যাই আব্বার কাছে বাজার নিয়ে। অতঃপর আমি সেখানে রাঁধি আর শরৎ আব্বার সাথে বসে আড্ডা দেন। তাদের কতরকমের গল্পের আসর যে জমে। আমি তখন রাঁধতে রাঁধতে তাদের গল্প উপভোগ করি।
এমন সময়ে দুটো সুখবর আসে। এক শরৎ তার বাবার এক জমি পায় উত্তরাধিকার সূত্রে। এটা তার বাবার পক্ষ থেকে শরতের বিয়ের উপহার। শরৎ সেই জমি বিক্রি করে টাকাটা ব্যাংকে তুলল। জায়গার চড়া দাম ছিল বিধায় শরৎ হাতছাড়া করেনি। তবে বাবার প্রতি তার রাগ এখনো কাটেনি, এটা তার অধিকার ছিল বিধায় সে না করেনি। আরেকটা সুখবর হচ্ছে আমাদের ছোট্ট সংসারে এক ছোট্ট ফুল আসতে চলেছে। আমি প্রেগন্যান্ট, তিন মাস চলছে। এই খবর শুনে আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম। শরৎ ত খুশিতে পারছে না আমার সাথেই সারাদিন লেপ্টে থাকতে। বেপরোয়া সেই ছেলেটা এখন দায়িত্বশীল স্বামীর পাশাপাশি, বাবাও হতে যাচ্ছে। আমি শুধু তার পাগলামোতে হাসি।
চাকরি ছাড়ার পর সারাদিন বাড়িতেই থাকা হয়। এতদিন চাকরি করে যতটুকু জমিয়েছি, আব্বা আরও কয়েকমাস চলতে পারবেন। আজকাল শরীর ভীষণ দূর্বল লাগে, তাই চেয়েও কিছু করা যায় না। আব্বা আসেন প্রায়ই দেখা করতে, তিনিও নানা হবেন শুনে ভীষণ খুশি। আব্বার মুখের হাসিটা দেখে এত প্রশান্তি অনুভব হয়। আব্বা এখন একাই থাকেন। খাওয়া-দাওয়া চাচাদের সাথেই হয়। আমি আসার আগে চাচাদের কাছে শেষ বায়না করেছিলাম যেন আব্বার খেয়াল রাখে.. সে যেন কখনো একা অনুভব না করে। অবাকের ব্যাপার হচ্ছে চাচারা আমার কথা রাখলেন। ভাইদের মধ্যকার দূরত্ব কেটে গেল।
একদিন শুক্রবারে। শরৎ সাহেব বাজারে গিয়েছিল, আমি তার অপেক্ষায় ছিলাম। বারান্দায় নতুন ফুল গাছটা ঠিক করছিলাম, গতকালই শরৎ এনে দিয়েছিলেন। আমার ইচ্ছেনুযায়ী একজোড়া লাভ বার্ডও আছে আমার। ওদের সাথেই আমার বেশিরভাগ সময় কাটে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শরৎ হন্তদন্ত হয়ে ফিরল। হাতে তার বাজার নেই। চার মাসের অন্তসত্ত্বা আমি শরতের এমন ব্যবহারের মানে বুঝলাম না। খালি হাতে ফিরেছে কেন? আমি প্রশ্ন করার আগেই শরৎ বিষাদ গলায় বলল,
–“তৈরি হও।”
আমি অবাকই হলাম। প্রশ্ন ছুঁড়লাম,
–“কেন?”
শরৎ বলল না কিছু। নিজ হাতেই আমার গায়ে বোরকা, ওড়না জড়িয়ে দিয়ে বের হলো। দুজনে রিকশা করে যখন যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম আমাদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছি। কেন যেন আচমকা আমার বুকে কু ডেকে উঠল। জুম্মার আযানের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। এমন সময়ই মসজিদের মাইকে শোক সংবাদ শোনা গেল,
–“মরহুম আলী-মোশাররফ হোসেনের বড়ো ছেলে “রবিন মালেক” ইন্তেকাল করিয়াছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মরহুমের জানাজার নামাজ..”
আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো তীব্র রোদেও আমার চোখে অন্ধকার জড়িয়ে এসেছে। শক্তি হারিয়ে একটুর জন্য চলন্ত রিকশা থেকে পড়তে নিলে শরৎ তৎক্ষণাৎ আমাকে ধরে ফেলল। শক্ত করে বুকে আগলে নিল। বাড়ি ফিরে দেখলাম লোকবিহীন বাড়িটায় আজ নানান মানুষের ভীড়। বাড়ির জুড়ে মানুষের মধ্যে চাপা কান্নার সুর। শরৎ শোকে পাথর আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল। আমাকে কান্নারত মেজো চাচীর কাছে দিয়ে শরৎ চলে গেল আব্বার গোসলের ব্যবস্থা করতে। আজ কুসুমও এসেছে। সবাই আমাকে ধরে কাঁদছে আমার চোখে ভাসছে আব্বার সুন্দর হাসিতে ভরপুর মুখটা। এখনো আব্বার আবদার, অভিমান সব কানে ভাসছে। আশেপাশে তাকালে চারপাশে আব্বাকেই যেন দেখতে পাচ্ছি। চাচী আমাকে বারবার কাঁদতে বলছে, কিন্তু আমার ত কান্না পাচ্ছে না। কেন কান্না পাবে? আমার আব্বা কী এত দ্রুত আমাকে ছেড়ে যেতে পারে?
বেশি শোক সইতে না পেরে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। যখন জ্ঞান ফিরল দেখলাম আমি শরতের বুকে। শরৎ-এর চোখ-মুখ তখন লাল হয়ে আছে। শরৎ তখন আমাকে আগলে নিয়ে বলল,
–“শক্ত হও প্রিয়াঞ্জনা। এভাবে ভেঙে পড়বে না। ভুলে যেয়ো না তোমার মধ্যে আরেকজন আছে, তার কথা অন্তত ভাবো।”
আমাকে আব্বার খাটিয়ার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। আব্বাকে কাফনে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। কী যে সুন্দর লাগছিল আব্বাকে, একদম যেন চোখ ফেরানো দায়। আম্মাকেও শেষ বিদায়ে এতটাই সুন্দর লাগছিল। আমার হঠাৎ কী হলো কে জানে, আমি গলা ফাটানো চিৎকার দিয়ে আব্বার নিথর, সুগন্ধী দেহ জড়িয়ে ধরলাম। কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করলাম,
–“আব্বা, আব্বা গো! এমনে আমারে ছেড়ে যাইয়ো না আব্বা। তুমি ছাড়া আমার কেউ নাই। কেমনে পারলে আমাকে এভাবে এতিম করে চলে যেতে? যেও না আব্বা, আব্বা গো! তুমি ছাড়া কে আমার কাছে আবদার করবে? কে আমাকে নতুন নতুন পদ রেঁধে দিতে বলবে? কাকে আমি ওষুধ ঠিক মতো না খাওয়ার জন্য বকা দিব? ও আব্বা, চোখ খুলো, যাইও না। আব্বায়া!”
শরৎ বহু কষ্টে আমাকে উঠিয়ে আনল, আশেপাশে কারো দিকে খেয়াল নেই আমার। আমি বারবার আব্বার কাছে ছুটে যেতে চাইছি কিন্তু শরৎ বারবার আমাকে আটকে দিচ্ছে। আব্বাকে এত মিনুতি করলাম, অনুরোধ করলাম, আমার আব্বা চোখ তুলে চাইলো না, উঠল না। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল না, “আমি কোথাও যাব না আমার মাকে ছেড়ে।”
আমার চোখের সামনে দিয়ে শরৎসহ বাকিরা আব্বাকে কাঁধে করে নিয়ে গেলেন। আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ওদের থামতে বললাম,
–“না, না। আমার আব্বাকে নিয়ে যাইও না। আমার থেকে এভাবে দূর করে দিয়ো না। আব্বা, যাইও না আমাকে এতিম করে রেখে! আব্বা।”
চারপাশে সবাই কাঁদছে, আমার শরীর আবারও নিস্তেজ হয়ে গেল। আমি মেজো চাচীর কাঁধে পড়ে গেলাম।
পরিশিষ্ট–
আমার এক মাসের ছেলে রায়ামিনকে নিয়ে আব্বার কবর জিয়ারত করতে এসেছি। আল্লাহ আমার আব্বাকে নিয়ে গেলেও আমার কোল আলো করে আরেক আব্বাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যার মাঝে আমি আমার আব্বার অনুভূতি পাই, আব্বার মতোই হাসি তার। দূরে দাঁড়িয়ে আব্বার কবর আর শরতের কবর জিয়ারত দেখছি। আব্বা আচমকাই হার্ট অ্যাটাক করে মারা গিয়েছেন, কেউ টেরও পায়নি। এভাবে পুরো রাত, সকাল নটা পর্যন্ত ওভাবে নিঃশেষ হয়ে সোফার ঘরে পড়েছিলেন। সকালে যখন মেজো চাচা খোঁজ করতে এসে দেখলেন আব্বা কিছুতেই দরজা খুলছে না। তখন দরজা ভেঙে দেখলেন মানুষটা পড়ে আছে, জান কবজ হয়ে গিয়েছে আগেই।
আমি রায়ামিনকে কোলে নিয়ে আব্বার কবরের দিকে তাকিয়ে আনমনে দেখলাম,
–“আব্বা দেখো, তোমার নাতি তোমার মতো করেই হাসে। তোমার মতোই নানান বায়না ধরে। তুমি চলে গিয়েও যেন ফিরে এসেছ। দোয়ায় রেখো আব্বা, যেন তোমার নাতিটাকে মানুষের মতো মানুষ করতে পারি। আল্লাহ তোমাকে জান্নাত দান করুক আব্বা, তুমি জান্নাতে গিয়েও হাসবে খুব, আমিন।”
শরৎ ফিরে এলো আমার কাছে। রায়ামিন তার বাবাকে পিটপিট করে দেখছে। শরৎ আলতো হাতে রায়ামিনকে আমার থেকে নিজের হাতে তুলে নিল। বাবাকে বেশ চিনে ছেলেটা। শরৎ আমার কপালে চুমু দিয়ে বলল,
–“চলো প্রিয়াঞ্জনা, সন্ধ্যা হয়ে আসছে।”
আরেকবার ব্যাকুল চোখে আব্বার কবরের দিকে তাকালাম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো আব্বা ওখানে বসে আমাদের প্রাণ ভরে দেখছেন। তার মুখে লেপ্টে আছে তৃপ্তির হাসি। আব্বা যে সবসময় আমাকে এমনই পরিপূর্ণ দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর দোয়া বুঝি আল্লাহ কবুল করলেন।
সমাপ্ত।
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন,