#বিভাবরী
#তৃতীয়_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা
সন্দীপ আর কোয়েল মুখোমুখি বসে আছে। দুজনেই চুপ। একটু আগেই সন্দীপ, তিনতলা থেকে কোয়েলের হাত ধরে টেনে দোতলায় নিয়ে এসেছে নিজের রুমে।
সন্দীপ আর কোনো কথা না বলে দরজাটা বন্ধ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
কোয়েল তখনও চুপচাপ বসে আছে। কী চলছে এইসব? ওই ঘরে তো কেউ ছিল না। তাহলে যে সবাই বলে ওই ঘরে সন্দীপের দাদা আছে। কিন্তু কোয়েল ভালো করে দেখেছিল প্রতিটি রুম বন্ধ করা ছিল বাইরে থেকে। শুধু একটা রুম খোলা ছিল, যেখানে কেউই ছিল না। আর কোয়েলের ছবি ওইঘরে কেন?
সন্দীপ রে গে আছে হয়তো। এখন ওর সাথে কথা বলা ঠিক হবে না। সন্দীপের পাশে শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতেই কোয়েলের ঘুম নেমে এলো চোখে। ঠিক ঘুমের ঘোরে মনে হলো কেউ যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সাথে ঘুমটা ভে ঙে যেতেই কোয়েল বসে পড়লো। সন্দীপেরও ঘুম ভে ঙে গেল। কোয়েলকে ভ য় পেয়ে যেতে দেখে, জলের বোতলটা কোয়েলের সামনে এগিয়ে দিল। কোয়েল ঢকঢক করে জল খেয়ে বোতলটা আবার সন্দীপকে দিয়ে দিল।
সন্দীপ বোতলটা রেখে কোয়েলকে শুইয়ে দিয়ে, মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো,
দাদা আর আমি তখন অনেক ছোট। আমার নেশা ছিল ব্যাটবল, দাদার ভালো লাগতো পুতুল নিয়ে খেলতে। একটু একটু করে আবিষ্কার করলাম, দাদা মেয়েদের মতো সাজতে ভালোবাসে। প্রথম প্রথম বাড়ির সবাই বারণ করতো। কেউ দাদাকে বুঝতে পারতো না। দাদাকে স্কুলে বন্ধুরা রা’গাতো। আমার খুব খা’রাপ লাগতো। আমি রে গে গিয়ে দাদার বন্ধুদের মা’রতাম।
আমার দাদা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আমাকে একবার বলেছিল, আমাকে দাদা না বলে দিদি বলে ডাকবি ভাই?
আমি তাই বলে ডাকতাম। দাদা লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে ভাইফোঁটা দিত তিনতলার ঘরে, সেদিন মায়ের একটা শাড়ি পরতো।
আমি সবসময় সব কিছু থেকে দাদাকে আড়াল করে রাখতাম। কারণ এই সমাজ দাদাকে বুঝতো না। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাই হাসাহাসি করতো। আমার ক ষ্ট হতো দাদার জন্য।
একসময় বাড়ির সকলেও বুঝলো। তারা দাদাকে আর কোনো কিছুতে বাধা দিত না।
ঠাকুমা পুরোনো দিনের মানুষ, একটা সময় পর ঠাকুমাও বুঝলেন। আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম, দাদা যেভাবে চাইবে, সেইভাবেই নিজের জীবন বেছে নেবে। দাদা নাচ ভীষণ ভালোবাসতো। তাই একজন নাচের টিচার রাখা হলো। উনি বাড়িতে এসে নাচ শেখাতেন। আমি দেখতাম, দাদা যখন পায়ে ঘুঙুর গুলো বাঁধতো, কি যে খুশি হতো! আমার ভীষণ ভালো লাগতো দাদাকে দেখে। পড়াশোনার জন্য বাইরে যেতে হতো ঠিকই। কিন্তু দাদার কোনো বন্ধু ছিল না। আমিই ছিলাম দাদার বন্ধু। তবে আরও একজন ছিল দাদার প্রিয় সাথী৷ তার নাম অরুন্ধতী।
আচ্ছা কোয়েল এই পৃথিবীতে তো সবার বাঁ’চার অধিকার আছে, তাই না?
কোয়েল দেখলো, সন্দীপের চোখে জল।
কোয়েল চোখের জলটা মুছিয়ে দিয়ে বললো, আমাকে এইসব আগে বললে কী হতো?
সন্দীপ বললো, তুমি যদি না বুঝতে? বা তোমার পরিবার যদি এইসব শুনে আমাদের বিয়ের জন্য রাজি না হতো?
কোয়েল বললো, এই চিনলে আমাদের? আর এইসব কতদিন চাপা দিয়ে রাখবে? কতদিন উনিই বা নিজেকে বন্দী করে রাখবেন?
সন্দীপ বললো, তুমি এখন বাড়িতে কারোর সাথে এই বিষয়ে কথা বলবে না। আমি তোমাকে কোনো কিছু লুকিয়ে রাখতে চাই নি। শুধু মনে হয়েছিল এই সত্যিটা জানার পর যদি তোমাকে হারাতে হয়, সেই ভ য়েই….
কোয়েল সন্দীপকে থামিয়ে বললো,
… আচ্ছা সন্দীপ, ওই ঘরে তো কেউ ছিল না, তাহলে উনি কোথায়?
… মনে হয় ছাদে। সারাদিন বাড়িতে বন্দী থাকে। তাই রাতে ছাদে যায়।
… দাদা ছাদে প্রায় নাচ করে, আমি পায়ের নূপুরের আওয়াজ পেয়েছিলাম আগে।
… হ্যাঁ। এই বাড়িতে তুমি আছো বলে দিনের বেলা নাচ করে না এখন। নাচই তো দাদার ভালোবাসা। এছাড়া আর কিছু নেই দাদার কাছে ভালোলাগার মতো। আমি শহরে গেলে, দাদার জন্য সাজের জিনিস এনে দিই। খুব খুশি হয় দেখে।
… আমার কাছে এমন গোপনীয়তা কেন?
… দাদা মনে করে দাদার নজর খা’রাপ। ওর নজরে নাকি তোমার ক্ষ তি হতে পারে। তাই ও তোমার সামনে আসে না। আমি অনেকবার ওকে বুঝিয়েছি। তোমার একটা ছবি যেদিন দেখিয়ে ছিলাম, আমাকে বলেছিল, এই মেয়ের সামনে কখনো যেতে পারবো কিনা জানি না, এই ছবিটা বড়ো করে বাঁধিয়ে দিতে পারবি?
… হ্যাঁ, ছবিটা তো আমি ওই রুমে দেখলাম। কিন্তু এইসবের মাঝে নজর খা’রাপ কথাটার মানে কী?
… সে অনেক কথা। বলতে পারো দাদার এক কাহিনী লুকিয়ে আছে এর পিছনে। সেইসব কথা বলতে এখন আর ভালো লাগছে না। পরে কোনো দিন বলবো।
সন্দীপ সব কথা কোয়েলের কাছে বলতে পেরে, নিজেকে অনেকটা হালকা মনে করছিল। কোয়েল বললো, আমার প্রতি ভরসা আছে তোমার?
সন্দীপ বললো, আছে বলেই তো, সব কিছু বললাম।
কোয়েল বললো, তাহলে এবার আমি যা করবো, তুমি আমাকে বাধা দেবে না। বিভাসদার আর আমার মাঝে তুমি আসবে না।
সন্দীপ বললো, যা করবে ভেবেচিন্তে করবে, এইসবের মাঝে ও যেন ক ষ্ট না পায়। ও ছোট থেকে অনেক ক ষ্ট পেয়েছে। মন আর শরীরের মধ্যে মিল পায় নি। অনেক ল’ড়াই করেছে নিজের সাথে, অনেক কিছু হারিয়েছে। শেষে এই জীবন বেছে নিয়েছে।
কোয়েল বললো, এবার ঘুমিয়ে যাও। অনেক রাত হলো।
কোয়েল মনে মনে ভাবলো, আর বিভাসদাকে ক ষ্ট পেতে হবে না। ওকে এই বন্দী জীবন থেকে বাইরে বেরোতে হবে। ও যেমন তেমন ভাবেই নিজেকে মেনে নিতে হবে। সমাজের ভ য় পেলে চলবে না।
কোয়েল মনে মনে ভীষণ খুশি হলো, বিভাসদা নাচ ভালোবাসে, কোয়েলও যে নাচ ভীষণ ভালোবাসে।
সকালের জলখাবার কোয়েল আজ নিজে হাতে তৈরি করলো। বিভাসদার খাবার একটা প্লেটে দিয়ে শাশুড়ি মায়ের হাতে দিয়ে বললো, বলবেন, তাঁর ভাইয়ের বৌ আজ জলখাবার বানিয়েছে। কেমন হয়েছে জানাতে…
শাশুড়ি মা অবাক হলেন। কোয়েল আজ সংসারের সব কাজ নিজে হাতে সামলাচ্ছে। দুপুরের খাবারও নিজে হাতে বানালো।
সন্ধ্যের দিকে বাগানের দিকে গেল। যেখান থেকে দাঁড়িয়ে তিনতলার বিভাসদার ঘরের জানালা দেখতে পাওয়া যায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও কিছু দেখতে পেল না। ঘর অন্ধকার। কোয়েলের মনের ভিতর চঞ্চলতা বাড়লো। মনে মনে ভাবলো, যে ভাবেই হোক বিভাসদার সাথে দেখা করতেই হবে।
কেউ না থাকায়, সুযোগ পেয়ে, সুজয়দাকে ফোন করে সবটা জানাল।
সুজয়দা অবাক হয়ে বললো, এই সাধারণ একটা বিষয় এইভাবে লুকিয়ে রাখার কারণ কী?
কোয়েল বললো, সঠিক ভাবে তো জানি না। তবে এর পিছনে অন্য এক কাহিনী আছে, যা আমি বিভাসদার কাছেই জানবো।
সুজয় বললো, তুমি কীভাবে এই কাজটা করবে?
কোয়েল নিজের প্ল্যানের কথা সব জানালো সুজয়দাকে।
সুজয়দা সব শুনে বললো, বাড়ির কেউ কিছু জানতে পারবে না?
কোয়েল বললো, জানলেও আমি আর পিছু হটবো না। ভেবে দেখো সুজয় দা একটা মানুষ এত গুলো বছর ধরে নিজেকে বন্দী করে রেখেছে। তাকে বের করতেই হবে।
সুজয় বললো, তোমার আর তোমার দিদির জন্য আমার খুব গর্ব হয়। নয়নাও সব বাধা-বিপত্তি পার করে গ্রামে স্কুল বানালো। এখন তুমিও একটা ভালো কাজ করতে চলেছো। তোমার যদি কোনো সাহায্য লাগে আমাকে অবশ্যই জানাবে।
রাত হলো…
সবাই প্রায় ঘুমিয়ে গেছে।
সন্দীপ বললো, এই কোয়েল তুমি এত রাতে শাড়ি পরে, পায়ে ঘুঙুর পরে কী করবে?
কোয়েল বললো, তোমাকে কাল রাতেই বলেছি, তুমি আমাদের মাঝে আসবে না। আমি যা করছি করতে দাও। এই রুম থেকে বেরোবে না…
আজ অনেকদিন পর কোয়েল নাচবে। তাও শুধু বিভাসদার জন্য। মোবাইলে গান চালিয়ে দোতলার বারান্দায় নাচ শুরু করলো। যাতে বিভাস দা দোতলায় নেমে আসে। সন্দীপ নিজের রুম থেকে আড়ালে দেখছে। কোয়েল কী পারবে বিভাসকে নিয়ে আসতে?
একের পর এক নাচ করতে করতে কোয়েলের মনে হলো, কেউ যেন সিঁড়িতে লুকিয়ে আছে। কোয়েল এবার গান বন্ধ করে বললো, পারবে আমার সাথে নাচ করতে? নাকি ভ য় হয় হেরে যাবার?
কেউ কথা বললো না। কিন্তু কোয়েল তার উপস্থিতি অনুভব করেছে। সে ওখানেই লুকিয়ে আছে।
কোয়েল আবারও বললো, জানি জানি আমাকে নাচে হারানো মুসকিল। তাই আমার সামনে আসতে ভ য় হচ্ছে। তাই না বিভাবরী?
কোয়েল শুনতে পেল কেউ নূপুর পরে নিচে নেমে আসছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার থেকে এগিয়ে আসছে কোয়েলের দিকে।
মনে মনে একটা ভ য় আর কৌতূহল নিয়ে কোয়েলও এগিয়ে গেল কিছুটা।
দুজনে সামনাসামনি হলো। একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো। অবশেষে কোয়েল পেরেছে তাকে সামনে আনতে।
কোয়েল নরম সুরে বললো, আমার সাথে কেন এমন লুকোচুরি বিভাবরী?
নামটা শুনেই বিভাস বললো, এই নাম তুমি আমাকে দিলে?
কোয়েল বললো, হ্যাঁ। বিভাবরী মানে রাত। তুমি তো রাত ভালোবাসো। তাই তুমি বিভাবরী। এই নামেই আমি তোমাকে ডাকবো।
বিভাবরী বললো, তাহলে কোয়েল থেকে আমিও কুহু নামে তোমায় ডাকবো।
সন্দীপ লুকিয়ে ওদের কথা শুনছে। আর মনে মনে ভাবছে কোয়েল সত্যিই পারবে তো, ওকে বাইরে নিয়ে আসতে? সন্দীপও চায় ও বাইরে বেরিয়ে আসুক। সবার সামনে আসুক।
বাড়ির তিনটি মানুষ কিছু টের পেলেন না। এর মাঝে সখ্যতা বাড়লো বিভাবরী আর কুহুর। এখন দিনের বেলাতেও তারা দুজনে দেখা করে। কোয়েল সুযোগ পেলেই চলে যায় বিভাবরীর কাছে।
একদিন বিকেলে কোয়েল বললো, দাও তো তোমার চুলটা বেঁধে দিই। কোয়েল চুল বাঁধছে এমন সময় তার শাশুড়ি মা এসে উপস্থিত হলেন। হাত থেকে থালাটা পড়ে গেল কোয়েলকে এই ঘরে দেখে। বিভাবরী বললো, মা তুমি কুহুকে কিছু বলো না। আমিই ওকে এখানে নিয়ে এসেছি। একদিন আমিই তোমাদের বলেছিলাম, এই তিনতলায় যেন ও না আসে। আর আজ আমিই বলছি ওকে আমার কাছে আসতে বাধা দিয়ো না। ভাইও জানে।
কোয়েল বললো, কতদিন আমার থেকে সব কিছু আড়াল করে রাখবেন? আমিও তো এই বাড়িরই একজন।
শাশুড়ি মা বললেন, আমি আড়াল করতে চাই নি, এই বাড়ির কেউই আড়াল করতে চায় নি কোনো কিছু। বিভাস কারোর সামনে আসতে চায় না। আমরা অনেকবার ওকে বুঝিয়েছি।
কোয়েল বললো, আসবে, বিভাবরী এবার সবার সামনে আসবে।
বিভাবরী বললো, না কুহু। তোরাই আমার পৃথিবী। আর আমার কিছু চাই না। আমি এইভাবেই থাকতে চাই।
বিভাবরী এখন নিচে নেমে আসে। সবার সাথে বসে খাবার খায়। মন খুলে কথা বলে। হাসিখুশি থাকে। কোয়েলের সাথে ওর বন্ধুত্ব দেখে বাড়ির সকলে খুশি। দুজনে একসাথে নাচ করে। সন্দীপ দুজনের জন্য নাচের সাজ-পোশাক এনে দেয়। সবাই ভীষণ খুশি।
এর মাঝে ঠাকুমা একদিন কোয়েলকে ডেকে বলেছিলেন, একটা পর্দা তুমি সরিয়ে ফেলেছো। এবার বিভাসকে বাইরে নিয়ে আসতে পারবে তুমি?
কোয়েল কথা দিয়েছে, সে পারবে।
একদিন দুপুরে কোয়েল আর বিভাবরী দুজনে বসে গল্প করছে। কোয়েল বললো,
… তুমি বাইরে বেরোতে চাও না কেন বিভাবরী?
… আমার সাথে শরীরের মিল নেই। মানুষ হাসাহাসি করবে। তাছাড়া আমার নজর খা’রাপ।
… কে বলেছে এইসব কথা? তোমার শরীরে স্বয়ং কৃষ্ণ আর রাধার বাস। তুমি যেমন তুমি তেমনই থাকো।
… সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমি বেরোলেই যে অরুন্ধতীর সামনাসামনি হতে হবে।
… কে অরুন্ধতী? তোমার ভাই বলছিল, এই নামে তোমার একজন বান্ধবী আছে।
… আমি যে ওর জীবনে নজর দিয়েছি।
… কী সব বলছো বিভাবরী? এইসব কী কথা?
বিভাবরী ফুঁপিয়ে কেঁ দে উঠলো।
ভুল ত্রুটি মার্জনীয় 🙏