মনাকাশে ধ্রুবতারা বেশে পর্ব-৩৭+৩৮

0
8

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৩৭.

অ্যাপোলো ডায়গনস্টিক সেন্টার
রাত ৩টা ।

স্বল্প আলোযুক্ত নীরব পরিবেশ আইসিইউ-র ভেতরটাই। জারার শরীরে স্যালাইন‚ হাতে নরম ব্যান্ডেজ‚ নাকের পাশে অক্সিজেন পাইপ। চোখদুটো বন্ধ করেও ভিডিয়োর দৃশ্যগুলো সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। বুকটা উঠছে-নামছে চাপা কান্নায়। মাঝে মাঝে ফেলছে একটা ভারী শ্বাস—মুখটাই ক্লান্তি‚ অপমান ও অদৃশ্য যন্ত্রণার মিশ্র ছাপ তার।

পাশেই দাঁড়িয়ে শারফান। অনেকক্ষণই দাঁড়িয়ে সে—আত্মা বিধ্বস্ত নিস্তব্ধতা নিয়ে। “চড়ুই”‚ ফিসফিসানির মতো হঠাৎ ডেকে উঠল জারাকে‚ “ওই ভিডিয়োতে তুই নেই‚ চড়ুই… ওটা তুই না। প্লিজ‚ ভুলে যা সব।”

ভাইয়ের মিথ্যা সান্ত্বনা জারা শুনল কি না‚ বোঝা গেল না। কোনো প্রতিক্রিয়ায় ফুটে উঠল না চেহারায়। কিন্তু তারপরই চোখের কোণ গড়িয়ে নেমে এল তার বিষাদ জল।

নিজের বিষাদ জলকে শাসাতে শাসাতে শারফান ক্লান্ত৷ জারার বিষাদটুকু মুছে দিতে গিয়ে এবার আর পারল না ঠেকাতে নিজের অবাধ্য অশ্রু। নিরবচ্ছিন্ন নির্ঘুম চোখজোড়া জবার মতো লাল—তা ভরে উঠে ওর ডান গালটা বেয়ে গড়িয়ে গেল জলটুকু। অর্থ‚ ক্ষমতার দাপট‚ গায়ের শক্তি‚ কোনো কিছু দিয়েই বোনের কষ্টটুকু নিঃশেষ করতে পারছে না সে! এই অক্ষমতার দহনে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে ওর ভেতরটা। “আমাকে চোখে দেখো না‚ খোদা?” ভীষণ অভিমানে বিড়বিড়িয়ে উঠল আচমকা‚ “আমি থাকতে কেন আমার বোন? আমার আগে কেন আমার বোনকে মারতে চাইলে তুমি?”

সকলের সব কিছু স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টাই গতকাল দুপুরটা পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। একবার যেহেতু আত্ম হ ত্যার চেষ্টা করেছে‚ কেউ আর তাই একা রাখেনি জারাকে৷ বিকাল হলে শারফান বাইরে বেরিয়েছিল হঠাৎ। মাথা গরম ছেলেটা যেন কিছু করে না বসে কোথাও‚ তাই সঙ্গে গিয়েছিল রিহানও। বাবা কারও সামনে আর মুখ দেখাতে পারবে না—এই ধারণা থেকে মেয়েকে বের করতে শাফিউল সাহেবও বেরিয়ে ছিলেন বাইরে। বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন জারাকে‚ তার মেয়ে কোনো অপরাধী নয়৷ তাই মুখ লুকিয়ে কেন ঘরে বসে থাকতে হবে?

লিভিংরুমে টিভি ছেড়ে বসে সবাই গল্প মেতে উঠেছিল‚ জারাকে স্বাভাবিক করতে৷ তখনই পুরোনো বাড়ির কিছু আত্মীয়-স্বজন এসে উপস্থিত হয় বাসায়৷ তাদের হঠাৎ আগমনে জেসমিন বেগম অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন বেশ। মনের এই হাল নিয়ে আতিথেয়তা করার মতো আগ্রহ না থাকলেও শ্বশুরবাড়ির মানুষদের খালি মুখে ফেরানো তো আর সম্ভব নয়। তাই মেয়েকে ছেড়ে রিহানের মাকে সঙ্গে করে চলে যান নাশতার আয়োজন করতে৷

জারা অস্বস্তি আর জড়তায় তখন ঘরে চলে যেতে চেয়েও পারেনি৷ তাকে ঘিরে শুরু হয় সবার হায়-আফসোস‚ কারও সান্ত্বনা‚ কারও প্রেরণা‚ জেসমিন বেগম ফিরলে হঠাৎ তাকে দোষারোপ করে ওঠে কেউ কেউ—কেন মেয়ের ঠিকঠাক খেয়াল রাখেননি তিনি? কেন জারার অপহরণের খবর তাদের জানানো হয়নি? তাদের কি পর ভাবা হয়? মেয়েকে তখন জেসমিন বেগম ঘরে পাঠিয়ে দেন বিশ্রাম নেওয়ার বাহানা তুলে ধরে৷ সঙ্গে পাঠান মিথি আর জোবেদাকে৷ আর জাং তো সকালের ঘটনার পর থেকে একদম লেজুড় হয়ে গেছে জারার। সবাই কোনো কারণবশত ওকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়লেও সে কোনোভাবেই আর একা ছাড়তে রাজি নয়৷ শাফিউল হক যতখানি দূরছাই করতেন‚ সকালের পর ইয়াজের এত চমৎকার প্রশিক্ষণের কারণে তিনি ইয়াজ আর জাং‚ দুজনের প্রতিই মুগ্ধ।

ঘরে যেতে যেতে জারার কানে হঠাৎ কিছু কথা পৌঁছায়—সম্পর্কে এক চাচি পরোক্ষভাবে নিজের ছেলের প্রস্তাব দিয়ে বসেছেন ওর জন্য৷ ছেলে তার পড়াশোনা শেষ করেছে ফরিদপুর কলেজ থেকে। মাস্টার্স পাশ করার পরই বাবার পাটের ব্যাবসার পাশাপাশি নিজের বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালসের বিরাট ব্যাবসা খুলে বসেছে।

ভদ্রমহিলা সান্ত্বনার ছলে বোঝান জেসমিন বেগমকে‚ জারার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেছে। এখন ভালো কোনো ছেলে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে ওর জন্য। আর যারা বিয়ে করতে চাইবে তারা নিশ্চয়ই ভালো অভিসন্ধি নিয়ে বিয়ে করতে চাইবে না! কেবল বাপ-ভাইয়ের ধনদৌলত দেখেই আসবে৷ কিন্তু বিয়ের পর মোটেও জারাকে ভালো আচরণ দেবে না৷ উঠতে‚ বসতে ওর আজকের দুর্ঘটনা নিয়ে কথা শোনাবে‚ আরও বিভিন্নভাবে কষ্ট দেবে। কেননা যে দুর্নাম ছড়িয়ে গেছে‚ তা দেখার পর আর জানার পর এমন দুর্নাম বহন করা মেয়েকে কেউ-ই ভালোভাবে গ্রহণ করে না। কিন্তু নিজের ছেলের বেলায় ভদ্রমহিলার যুক্তি আসে‚ তারা যেহেতু কাছের মানুষ আর জারা একই রক্তের মেয়ে। তাই জারাকে তাদের মতো খেয়াল করতে‚ ভালোবাসতে অন্য কেউ পারবে না। সবটা প্রথমে নীরবেই শুনে যান জেসমিন বেগম। কারণ‚ মহিলাটি শাফিউল সাহেবের আপন চাচাত ভাইয়ের বউ৷

কিন্তু জারার মনে মহিলার ঘুরানো-প্যাঁচানো প্রতিটি কথা বিঁধল তখন তিরের ফলার মতো। মায়ের জবাব শোনার কোনো আগ্রহ আর হলো না তাই৷

শাফিউল সাহেব ফোনে আত্মীয়দের আগমন বার্তা পেয়ে খুব বিরক্ত হন। কারণ‚ তাদের চিন্তাভাবনা আর কথাবার্তার ধরন সম্পর্কে পূর্ব অবগত তিনি৷ তবুও সৌজন্যপ্রদর্শনে বাজার করে পাঠান বাড়িতে। সন্ধ্যার পর রাতের খাবারের জোগাড়-গোছালে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বাড়ির সকলে৷ রাতের খাবার খেয়েই সবাই বিদায় নেবে।

এসবের মাঝে রাত বেজে যায় নটা৷ নানানজনের নানান মন্তব্য শুনতে শুনতে জারার হঠাৎ ইচ্ছা হয় নোংরা ভিডিয়োটা সম্পর্কে জানার৷ ভবিষ্যতে কোনো ভালো ছেলেই ওকে গ্রহণ করবে না বলছে সবাই৷ ঠিক কতটা নোংরা তাহলে ভিডিয়োটা?

মিথি নিজের ফোনটা ওর ঘরে রেখে নিচে গিয়েছিল। তার ফোনটা তখন হাতে তুলে নেয় ও৷ ওর কেন যেন মনে হয়‚ মিথি ভিডিয়োটা নিজের ফোনে ডাউনলোড করে রেখেছে। কারণ‚ মিথির সঙ্গে কখনোই ওর কাছের সম্পর্ক ছিল না। বরং সব সময় ওর পোশাক-পরিচ্ছদ‚ গহনাগাঁটি‚ সাজগোজের জিনিস নিয়ে হিংসা করত সে—সব কিছুর খুঁত ধরত শুধু। এসব কারণেই জারা তাকে পছন্দ করেনি কোনো সময়৷ একটা লোক দেখানো বোনের সম্পর্ক বজায় চলত দুজনে।

এবং ওর ধারণাটাই সত্যি হয়। ফোনের গ্যালারিতে সেই ভিডিয়োটার কয়েক মুহূর্ত দেখার পরই দমবন্ধ হয়ে আসা অনুভূতি হয় ওর—হিস্টেরিক রিঅ্যাকশন দেখা দেয়৷ জবান যেন বন্ধ হয়ে আসে‚ হাত-পা অবশ‚ নড়তে-চড়তেও পারে না আর৷ তারপরই চোখে অন্ধকার। কাউকে ডাকতে পারে না‚ কান্নাও করতে পারে না। আস্তে আস্তে বিছানায় গা এলিয়ে চোখদুটে বুুঁজে নেয় তাই।

রাত এগারোটায় শারফান বাড়ি ফিরে আত্মীয়দের কারও দেখা পায়নি। জেসমিন বেগমও তাই জানায়নি কিছুই। জারাকে এসে ঘুমন্ত পায় সে৷ কিন্তু না খেয়ে ঘুমিয়েছে শুনে মায়ের ওপর চোটপাট করে নিজেও না খেয়ে রাগ নিয়ে চলে আসে ঘরে৷ চোখদুটো ঘুমের আশ্রয় চাইলেও ক্ষুধা পেটে ঘুমাতে পারে না সে কখনোই। তাই সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে বিছানার সঙ্গে গা ঠেকিয়ে বসে পড়ে কার্পেটে। রিহানকে এবার নিজের ঘরে জায়গা দেয়নি সে৷ একা থাকার সুবাদে সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরিয়ে তোলে সারা ঘরটা।

মাথার মধ্যে গতকাল অবধি ছিল শুধু ফারনাজ আর তার ভাড়া করা অপরাধীগুলো। কিন্তু আজ থেকে নতুন করে সানা যুক্ত হওয়ায় সমস্ত ভাবনা কেবল তাকে ঘিরেই চলছিল শারফানের। সানার মামা বাড়ির সামনে চব্বিশ ঘন্টার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে দুজন বিশ্বস্ত মানুষকে৷ সুযোগ পেলেই খপ করে ধরে তাকে তুলে নেবে গাড়িতে। তারপর কোথায় নেওয়া হবে তাকে আর কী করা হবে তার সঙ্গে‚ সেসব চিন্তাতেই মশগুল শারফান।

রাত বারোটা বাজলে শরীরটা যখন একেবারেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে‚ তখন সে বিছানায় যায়৷ ঘুমিয়েও যায় অল্পক্ষণে।

কিন্তু জারার ঘুমটা ছেড়ে যায় সে সময়ই৷ গাঢ় ঘুম ঘুমাতে পারেনি সে। কিছু বিভৎস স্বপ্নে বারবার ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল। এখনো ঠিক তাই ঘটেছে। কে যেন ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শরীরের সর্বত্র ছুঁয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ও খুব করে চাইছে তাকে বাধা দিতে—পারছে না৷ এরপর আরও খারাপ কিছু স্বপ্নে দেখে সে৷ ঘুম ভাঙতেই বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে ওর। ভিডিয়োর সেই স্মৃতিটুকু মাথার ভেতর বারবার বিস্ফোরণের মতো ফিরে আসতে থাকে সহসা। বুকটা ভারী অনুভব হয় তখন। এবারও কাঁদতে পারে না—ছোট্ট‚ চিকন ঠোঁটজোড়া রক্তশূন্য। নিঃশ্বাস ক্রমেই ছোটো হয়ে আসতে শুরু করে আর সারা শরীরে কাঁপন আরম্ভ হয় ওর। উঠে বসে পড়ে হঠাৎ। এক হাত ওর বুকে যায়‚ আরেক হাতে থামাতে চায় শরীরের কাঁপুনি।

“আম্মু”‚ দুর্বল স্বরে কোনোরকমে ডেকে ওঠে শুধু একবার।

পাশেই মা ঘুমিয়ে আর মেঝেতে জাং। বুকটা ডলতে ডলতে আরেকবার ডাকে জারা মাকে৷ এবার নড়েচড়ে ওঠেন জেসমিন বেগম। গভীর ঘুমে হারাতে সাহস পাচ্ছেন না তিনিও। তাই সজাগ হতে সময় লাগে না। মেয়েকে হঠাৎ বসা অবস্থায় অমন অস্বাভাবিক ভঙ্গিমা করতে দেখে চমকে যান।

“কী হয়েছে?” আতঙ্কিত গলা তার। জড়িয়ে ধরেন মেয়েকে দ্রুত‚ “কী হয়েছে‚ মা? তৃষ্ণা লেগেছে? পানি খাবে?”

জারা নিষ্প্রাণ কণ্ঠটাই ফিসফিসিয়ে শুধু বলতে পারে‚ “বুকে ব্যথা লাগছে!”

জেসমিন বেগম বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে পানি এনে মেয়ের মুখে ধরেন৷ কিন্তু খেতে পারে না জারা৷ ক্রমশই ও ছটফট করতে থাকে। এ দৃশ্য দেখে তিনি এতটাই ভয় পান‚ যে কেঁদে উঠে আর্তস্বরে ডেকে ওঠেন‚ “শায়াফের আব্বু… তাড়াতাড়ি আসেন। আমার মেয়ে কেমন করছে! ও শায়াফ? শায়াফ রে… তাড়াতাড়ি আয়!”

তার চিৎকার শুনে ঘুম ছাড়ে সবার প্রথমে জাঙের। সে জারাকে জড়িয়ে ধরে তার কান্নাকাটি দেখে উচ্চস্বরে ঘেউঘেউ আরম্ভ করে৷ ওর ডাকেই তন্দ্রা ছুটে যায় সবার। কিন্তু ঘুমন্ত শাফিউল সাহেবের ঘুম ভাঙে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে। তিনি মনে করেই বসেন‚ এবারও বোধ হয় মেয়ে কিছু করে বসেছে—খারাপ কিছু হয়ে গেছে মেয়ের সঙ্গে।

যখন ছুটে আসেন মেয়ের ঘরে‚ তখন সবাই হাজির৷ কারও ডাকেই সাড়া দিচ্ছে না জারা৷ কারও কথায় ওর কানে পৌঁছাচ্ছে না। চোখদুটো স্থির‚ শুকনো ঠোঁটদুটো জড়িয়ে আছে নিজের ভেতরেই।

তারপর আর এক মুহূর্ত দেরি করা হয়নি ওকে হাসপাতাল নিতে৷ আইসিইউতে নেওয়ার পর ডাক্তার জানালেন‚ “ওর হার্টে একটা বিশেষ সমস্যা ধরা পড়েছে। জাপানিরা যেটাকে বলে তাকোৎসুবো কার্ডিওমায়োপ্যাথি। হঠাৎ বড়োসড়ো মানসিক আঘাতে হার্টে ঠিকমতো রক্ত পাম্প করতে পারেনি ওর। মানসিক ট্রমায় কারও কারও তো হার্ট কাজ করা বন্ধ করে দেয়। একে ব্রোকেন হার্ট সিনড্রোমও বলা হয়।”

অথচ জারার হৃদযন্ত্রে আগে কোনো সমস্যা ছিল না। কেবল তীব্র লজ্জা‚ অপমান আর আতঙ্ক—সব মিলে যেন হৃদয়টাই চুপসে গেছে ওর। মানসিক আঘাতের ধাক্কা এতটাই যন্ত্রণাদায়ক ছিল যে ওর শরীরটাও হাল ছেড়ে দিয়েছে।

আইসিইউ-র বাইরে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদেন জেসমিন‚ শাফিউল সাহেবকে লাগে অপ্রকৃতিস্থের মতো। আর শারফান চোখের পানিকে বাধা দিতে চোখদুটো শক্ত করে বুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। রাত তিনটায় কেবল একজন আইসিইউ-র ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পেলে সে-ই আগে প্রবেশ করে।

বর্তমানে ভাই-বোনের কান্না মুহূর্ত—যতবার বোনের চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকল অশ্রুজল‚ নীরবে মুছে দিতে থাকল শারফান ততবার। এর মাঝে দরজায় ধাক্কা পড়ল অকস্মাৎ।

নার্স ভেতরে এসেই ডাক্তার‚ শারফান‚ দুজনের উদ্দেশ্যেই জানাল‚ “রোগীর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ছে।”

উচ্চ রক্তচাপে ভোগা শাফিউল সাহেবের শারীরিক অবনতি মাঝে মাঝেই হয়ে থাকে৷ আর এই পরিস্থিতিতে অসুস্থ হয়ে পড়াটা মানে বিপজ্জনক কিছু। তা মনে হতেই নার্সের কথা শোনা মাত্র শারফান ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এল বাইরে৷

ওয়ার্ডের সোফায় বসেছিলেন শাফিউল সাহেব। মাথাটা বুকের সাথে মিশে ছিল তার। রিহান এ সময় ব্যস্ত ছিল জেসমিন বেগমকে সামলাতে। হঠাৎ স্বামীকে একপাশে ঢলে পড়তে দেখেন জেসমিন। তা দেখে ছুটে এসে তাকে আগলে ধরেন দু হাতে।

“আব্বু”‚ দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল শারফান৷ মুখটা ফ্যাকাশে শাফিউল সাহেবের, ঠোঁটের কোণ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে আসছে।

আতঙ্কে আত্মাটা বেরিয়ে যেতে চাইল জেসমিনের৷ স্বামীকে হারানোর শঙ্কায় ভেঙে পড়লেন মর্মবিদারী আর্তনাদে। শোকে পাথর হয়ে যাওয়া তার চোখে হাসপাতালের করিডরটাও যেন দুলে উঠল।

শাফিউল সাহেবকে দ্রুত নেওয়া হলো জরুরি বিভাগে। কিছুক্ষণ পর এক চিকিৎসক এসে সবার ভেতরে জমে থাকা ভয়টুকু সত্য করে দ্বিতীয় দুঃসংবাদ দিলেন‚ “কার্ডিওজেনিক শক। ওঁর হৃদপিণ্ড ঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে পারছে না। দ্রুত আইসিইউতে নিতে হবে। আমরা ইনট্রাভেনাস সাপোর্ট শুরু করেছি।” ঘরের বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠল সেই মুহূর্তে।

আইউসিইউতে নেওয়ার পর শাফিউল সাহেবকে অবলিম্বে অক্সিজেন মাস্ক পরানো হলো৷ শিরায় স্যালাইন দেওয়া তার। আর একপাশে মনিটরের টুঁটুঁ শব্দ।

“বিপি ক্রিটিক্যাল। ইনোট্রপ বাড়ান”‚ হঠাৎ বলে উঠলেন এক ডাক্তার‚ “হার্টরেট আপ-ডাউন করছে। আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে ভেন্টিলেটরের জন্যও।”

কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন জেসমিন বেগম৷ ডাক্তার তার শারীরিক‚ মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছেন।

জানালার কাচের ওপাশ থেকে বাবাকে দেখতে থাকল শারফান। যে মানুষটা সবসময় ছিলেন অবিচল। আপন-পর‚ কারও অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেওয়া‚ একটা হারাম পয়সা গ্রহণ না করা‚ সন্তানদের মঙ্গলের জন্য সর্বক্ষণ কঠিন খোলসে নিজেকে আবৃত রাখা সে মানুষটা আজ কী নিথর বেশে পড়ে আছে… করুণভাবে শ্বাস নিচ্ছে অক্সিজেনের দয়ায়!

গা ছেড়ে দেওয়ার মতো মন্থর পায়ে হেঁটে এসে বসল শারফান বাবার বসা জায়গাটিতে। রিহানও বসল ওর পাশে৷ সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা তো নেই তার‚ তাই কেবল মানসিক শক্তি সঞ্চয়ের তাগিদ দিতে থাকল।

সকাল হয়ে গেল এভাবেই। কিন্তু একচুল নড়েনি শারফান জায়গা থেকে৷ রিহানই বারবার উঠে গিয়ে তিনজনের খোঁজ নিচ্ছে। আলো ফুটতেই ফোন করে দিয়েছে সে শারফানের বন্ধুদেরকে। নিজের বাবাকেও কল করেছে মামাকে আইসিইউতে নেওয়ার পরই। এ সময়ে দৃঢ় মানসিকতাসম্পন্ন মানুষগুলোকে পাশে প্রয়োজন৷ এখন গেছে সে শারফান আর নিজের জন্য কফি আনতে।

একটু বেলা হলেই একে একে হাজির হলো অনি‚ রিপন‚ সাদ্দাম আর সোহানও৷ রিহানের বাবাও রওনা করেছেন। আর হাফসা বেগম চলে এলেন নাশতা নিয়ে। এসেই জানতে পারলেন শাফিউল সাহেবের খবর৷ বাড়িতে তাদের কাউকেই জানানো হয়েছিল না। কান্নাকাটি করে উঠে তিনি খবর জানালেন স্বামীকে। শাকিবুল সাহেব গতকালই চলে গেছেন ঢাকা। ব্যাবসার দেখাশোনা তো আর বন্ধ রাখা সম্ভব নয়৷ আবার আজই ছুটে আসাও সম্ভব নয় বলে মনে করলেন৷ তাই ফোনেই খোঁজ নিতে থাকলেন।

জোর করতে হলো না শারফানকে খাওয়ার জন্য৷ সব কিছু এক সঙ্গে সামলানোর জন্য সুস্থ আর শান্ত থাকার প্রয়োজন যে। বেলা বারোটায় চিন্তা মোটামুটি কমল সবার। অবস্থার উন্নতি হয়েছে দুজনেরই। কিন্তু দুজনকেই থাকতে হবে ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে। শারফান আর জেসমিন বেগমকে একটু বিশ্রামের জন্য বাড়ি পাঠানো হলো খুব মেহনত করে৷

গোসলটা নিয়ে গামছা হাতে উদাম শরীরে শারফান বসল এসে বিছানাতে৷ বড়ো বড়ো চুলগুলো ঠিকঠাক মোছা হয়নি এখনো। সবে মাথায় গামছাটা ওঠাল‚ ফোনটা বেজে উঠল তখনই। কিন্তু স্ক্রিনে ভেসে ওঠা অচেনা নাম্বারটা দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে রইল সে৷ রিসিভ করল তাই সময় নিয়েই৷ চুপ করে থাকল ওপাশ থেকে কথা আসার অপেক্ষায়।

“শারফান”‚ দ্বিধা-শঙ্কোচ আর জিজ্ঞাসার মিশেলে ভেসে এল ফারনাজের কণ্ঠ।

“ঘাপটি মেরে ফোনকল?” খুব শীতল কণ্ঠে বলে উঠল শারফান।

“আমি ইটের জবাবে পাটকেল মারা পুরুষ কেবল। ঘাপটি মেরে থাকা কাপুরুষ না—যতটা ভাবিস তুই।”

“হুঁ… তোর বীরপুরুষ থোবড়াটা আমার সামনে এনে বুলি ছাড়। তোর পাটকেলের জবাবে এবার বুলেট খাওয়ানোর পালা আমার। ঘাপটি মেরে থেকে বাঁচবি কত দিন?”

“দ্যাখ‚ আমি কোনো ঝগড়ার জন্য ফোন করিনি৷ ক্ষতি আমাদের দুজনেরই যা হয়েছে তা একপাশে রেখে আমার কথাগুলো একটু মাথা ঠান্ডা করে শোন৷”

“ঠান্ডা মাথা? আমি কতটা ঠান্ডা হয়ে থাকলে এখনো তুই ফোনের ওপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছিস!”

দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ এল ফোনের মধ্যে৷ ফারনাজ সরাসরি কথা পাড়ল‚ “আমি আমার সমস্ত ভুলের জন্য তোর বোন‚ তোর পরিবার‚ সবার কাছে মাথা নুইয়ে মাফ চাইতে রাজি। আমার ভুলের খেসারত আমাকেও দিতে হচ্ছে। ভদ্র সমাজের কেউ কখনো চায় না শত্রুকে দমন করতে গিয়ে নিজের স্ক্যান্ডাল বের করুক। আমিও চাইনি—ভুক্তভোগী আমিও৷ আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার তোকে ধ্বংস করতে হলো না আর। নিজের ভুলে তা নিজেই ধ্বংস করে ফেলেছি প্রায়৷ আমি সর্বস্বান্ত‚ শারফান৷ আমার পরিবার সম্পদ‚ সম্মান‚ সব হারিয়ে নিঃস্ব।” বলেই কলটা কেটে দিল সে।

ফোনটা হাতে নিয়েই কয়েক মুহূর্ত গুম হয়ে রইল শারফান। জানে‚ কল দিলে আর কলটা ঢুকবে না। তবুও চেষ্টা করল। এবং সত্যিই নাম্বারটা বন্ধ বলল।

“ওরে ভণ্ড”‚ ক্রোধান্বিত গলায় বলে উঠল শারফান “তুই চিনিসনি এখনো আমাকে? বিমা কোম্পানি আমি? তুই এসে হাতে-পায়ে ধরে তোর ভণ্ডামি দেখাবি আর তোর বিমা কোম্পানির মতো আমি সাজা থেকে মুক্তি দেব তোকে? শু** বাচ্চ‚ আমার যে ক্ষতি তুই করলি‚ তার কোনো পূরণ নেই। তোর জান যদি নিতে না পারি…!”

কথাটা শেষ হলো না ওর৷ দ্বিতীয়বার বেজে উঠল ফোনটা৷ কলারের নাম্বারটা দেখে রিসিভ করল দ্রুত৷ ওপাশ থেকে তখন জানাল ব্যক্তিটি‚ “যমুনা ফিউচার পার্কে আসছে‚ ভাই। সাথে আছে রিলেটিভস। রাইডে চড়তেছে তাদের সাথে৷ প্ল্যান এক্সিকিউট করব কি বের হওয়ার পরই?”

“সঙ্গে কতজন?”

“নয়জন।”

“রিস্কি৷ আজ তাহলে ছেড়ে দে।”

“ও.কে।”

“আমার বোন‚ আমার বাপ আইসিইউর বেডে”‚ ফোনটা রেখেই শারফান দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বলল সানার উদ্দেশ্যে‚ “আর তুমি দোল খাও রাইডে। চমৎকার!”

***

১৫ মার্চ
বিকাল ৪ টা ।

বৃষ্টিতে আজ স্নান করেছে প্রকৃতি৷ ঢাকার গরম হওয়ায় আজ আরামদায়ক শীতলতা। তাই তো আজ বোনেদের সঙ্গে বেরিয়েছে সানা। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনে ফুটপাতের দোকানে সে এখন খালাতো দুই বোনের সঙ্গে ব্যস্ত। প্রতি শুক্রবার এই জায়গাটাই মেলার মতো হয়। শাড়ি-থ্রিপিস‚ নানান পোশাকের অনেক দোকান বসে এখানে৷ প্রচুর ভিড় হয় প্রতিবারই—আজও তাই। ঢাকা আসার সুযোগ পেলেই সানার দুই খালাতো বোন পাখি আর মুক্তা চলে আসে এখানে। তাদের মুখে সাশ্রয়ী মূল্যের পোশাক পাওয়ার কথা শুনে দেখতে এসেছে সানাও৷ এবং আসার পর ওর পাগল হওয়ার দশা। এমন ভিড় সে প্রত্যাশা করেনি আসলে। বোন দুজন প্রতিটি দোকান ঘুরে দামদর করতে করতেই ঘন্টা একটা ইতোমধ্যে পার করে ফেলেছে। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পা চালাতে অক্ষম সানা—প্রচণ্ড হাঁটাহাঁটি করে তারা। তাই আর তাদের পিছু পিছু না ঘুরে একটা দোকানেই দাঁড়িয়ে দীর্ঘ গজের কিছু কাপড় দেখতে থাকল সে৷ সুন্দর সেলোয়ার-কামিজ বানানো যাবে ভেবেই কেনার সিদ্ধান্তও নিল৷ কিন্তু সবই ওর চোখে ভালো লাগছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবে এ নিয়ে যখন সে বিভ্রান্ত‚ তখন ছয়-সাত বছর বয়সী একটি বাচ্চা ছেলে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে এসে দাঁড়াল ওর পাশেই। শার্টের এক কোণা চেপে ধরে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে “আম্মু… আম্মু”‚ বলে কেঁদেই চলল।

সানা প্রথমে ভাবল বাচ্চাটার মা আছে হয়ত এখানেই৷ কিন্তু একটা পর্যায়ে ছেলেটা কান্না সুরে বলতে থাকল‚ “আমার আম্মু কোথায়? আম্মুকে খুঁজে পাচ্ছি না আমি।”

এমন মায়া মুখ‚ সেই মুখে ভয়ের ছাপ আর আশপাশের লোকের উদাসীনতা দেখে সানার মন কেমন করে উঠল—হারিয়ে গেছে বাচ্চাটা? তাকে জিজ্ঞেস করল‚ “তোমার আম্মু নেই এখানে‚ বাবু? কোথায় ছিল তোমার আম্মু?”

“ওইদিকে ছিল আম্মু”‚ চোখের পানি মুছে আঙুলের ইশারায় সামনের দিকে দেখাল ছেলেটা। “কথা বলছিল একটা আন্টির সাথে৷ তাই আমি একটু এদিকে আসছিলাম। কিন্তু ফিরে গিয়ে আর খুঁজে পাচ্ছি না৷ আম্মুকে একটু খুঁজে দাও না‚ আপু!” বলেই আবার কান্না শুরু করল।

খুব মায়া হলো সানার৷ বোনদের দেখল একবার৷ কয়েকটা দোকান পরেই তারা দাঁড়িয়ে শাড়ি হাতে দামদরে ব্যস্ত। তাই ভাবল‚ বাচ্চাটার মাকে এই ফাঁকে খুঁজে দেওয়া যাক৷ তারপরই ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে এগোল সামনে৷ ছেলেটি তাকে ফুটপাতের পাশের গলির দিকে নিয়ে এল। গলিটা ছোটো‚ লোকজন দেখা যাচ্ছে না আপাতত। গলির ভেতরে আরেকটু এগোতেই সানার কেমন অস্বস্তি অনুভব হলো হঠাৎ৷ তাই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। ছেলেটির হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াতেই মধ্যম স্বাস্থ্যের তরুণ দুই ছেলে ওর পথ আগলে ধরল। তাদের মুখটা কয়েক সেকেন্ড দেখার সুযোগ হলো শুধু৷ তারপরই একজন ক্ষিপ্র গতিতে ওর নাকের ওপর আচমকা রুমাল চেপে ধরল৷

চোখ ঝাপসা হয়ে এল সানার। এক ঝলকে দেখতে পেল গলির মুখে একটা সাদা গাড়ি। এরপর আর কিছু দেখার বা শোনার অবস্থাতে রইল না।

পূর্বাচলের শেষপ্রান্তে এক বিস্মৃতপ্রায় অঞ্চল—জায়গাটার নাম লোকমুখে ‘চরগাঁও’। কোনো সাইনবোর্ড নেই‚ নেই নির্ভরযোগ্য রাস্তার মানচিত্র। জঙ্গলের মতো গজিয়ে ওঠা গাছপালায় ঘেরা এই অংশটুকু দিনের আলোয়ও অনুজ্জ্বল‚ আর রাত নামলেই নিঃসাড় নিস্তব্ধ। এই জংলা পথে আধা কাঁচা রাস্তা বেয়ে ঢুকতে হয়। আশেপাশে কোনো লোকালয় নেই দুই-তিনশো গজের মধ্যে। এক পাশে পরিত্যক্ত ইটভাটা‚ অন্য দিকে শেওলা পড়া ছায়াময় জলধারা। সেই জলধারার পেছনে‚ কাদামাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটা একচালা টিনের ঘর। দেওয়ালে পুরনো দাগ আর ছাদের কোণাঘেঁষা ফাঁক দিয়ে বর্ষার জল টুপটাপ চুঁইয়ে পড়ে।

রাত সাড়ে সাতটা—গাড়িটা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে আগে নামল নাফিস আর পাভেল৷ তারপর নামল জাঙকে নিয়ে শারফান৷ সানাকে ধরে বসে থাকা মৌসুমি নামার পর নাফিস টর্চ জ্বালাল। রাস্তার আশেপাশে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে ইশারা করল সবাইকে‚ “কেউ নেই।”

পাভেল ভেতর থেকে সানাকে টেনে বের আনার মুহূর্তে কিছু একটা ভাবল শারফান। বারণ করল পাভেলকে। ওকে নির্দেশ দিল‚ “মৌসুমি আর জাঙকে নিয়ে তুই এগো। সামনে কেউ থাকলে বা কোনো অস্বাভাবিকতা থাকলে জাং তা টের পেয়ে এলার্ট করবে।”

পাভেল বিনা বাক্যে মেনে নিল ওর কথা৷

চেতনাশূন্য সানাকে এক পলক দেখে নিয়ে এবার নাফিসকে বলল শারফান ‚ “আমি নিচ্ছি ওকে। তুই পেছনে খেয়াল রাখবি।”

তারপর ভীষণ অনীহা আর অস্পৃশ্যতার সঙ্গে সানাকে কাঁধে তুলল সে। কোনো অসুবিধা ছাড়াই পৌঁছাল সবাই। কাঁচা বারান্দা পেরিয়ে ছোটো ঘরটাই ঢুকতেই সবার অনুভব হলো ভেতরের বাতাস ভারী আর সারা জায়গাটাই স্যাঁতসেঁতে। মাটির মেঝের ওপর কাঠের মচমচে একটা খাট। সেখানে ছেঁড়া একটা চট বিছানা পাতা। কোনায় পোকায় কাটা একটি পুরোনো ট্রাংক। কোনো জানালা নেই। দেওয়ালে এক টুকরো আয়না ঝুলছে। যেটার পেছনে কালচে দাগ—হয়তো আগুনের কালি‚ কিংবা দীর্ঘ সময় বয়ে চলার অজানা কোনো আঁচড়। এ ঘরের পাশেই আরেকটি ঘর আছে। সে ঘরে জানালা আছে ঠিকই। এবং সে ঘরটি তুলনামূলক বড়ো। তবে ভেতরের অবস্থা একই।

রাত হলে এখানে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দূরের কুকুরের হাহাকার ছাড়া কোনো শব্দ শোনা যায় না। চারপাশে কাঁটাঝোপ আর গুল্ম। দিনের আলোও যেন এখানে ঢুকতে ভয় পায়। ঘরটার পাশে ছোট্ট একটি পুকুর আছে৷ যা এক সময় আধা শুকনো আর কাদায় ভর্তি ছিল। কিন্তু আজকের বৃষ্টিটে পুকুরটা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সেদিকে পা দিলেই পা কাদায় আটকে যায়। ঘরের কাছেই গাছের ডালে একটানা ডাকে এক ঝাঁক কাক। যেন প্রহরীর দায়িত্বে নিয়জিত থাকে ওরা।

খাটের ওপর শুইয়ে দেওয়া হলো সানাকে। নাফিস আর পাভেলের দায়িত্ব আপাতত শেষ৷ শুরু মৌসুমির৷ মেয়েটা নাফিসের বোন হয় দূর সম্পর্কের। গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পর বাসা বাড়িতে কাজ করত। একদিন ফাঁকা বাসায় বাসার কর্তার কাছে করুণভাবে আহত হয়ে সম্ভ্রম হারিয়ে বসে। সেই মুহূর্তের ভিডিয়োও ধারণ করা হয়েছিল। আর সেই ভিডিয়োটা ‘ইন্টারনেটে ছেড়ে দেব’ বলে ভয় দেখিয়েই সুযোগ পেলে তাকে প্রতিনিয়তই বাধ্য করত লোকটি৷ এ থেকে মুক্তি পেতে মৌসুমি সাহায্য চেয়েছিল নাফিসের কাছে। আর নাফিস চেয়েছিল শারফানের কাছে৷ যেহেতু ক্ষমতাবান মানুষ শারফান৷ মৌসুমি নিপীড়িত হওয়ার এমনই একদিনে সে পুলিশ ফোর্স পাঠিয়ে দেয়। সেদিন হাতেনাতে ধরা হয় ধর্ষককে। এরপর অবশ্য নাফিসের দ্বিতীয় অনুরোধে মৌসুমিকে একটা কাজও জুটিয়ে দিয়েছিল সে—এক বন্ধুর বউয়ের একটি জামা-কাপড়ের দোকানে বিক্রেতা হিসেবে। সেদিন থেকেই মৌসুমি ঋণী আর কৃতজ্ঞ শারফানের প্রতি৷ এই ঋণ শোধের সুযোগ পেয়ে আর উপকারের দাম দিতে নাফিসের প্রস্তাবে রাজি হয়ে চলে এসেছে সে সানাকে পাহাড়া দিতে।

“তুমি পারবে তো?” জলদগম্ভীর গলায় বলল শারফান মৌসুমিকে‚ “অধিকাংশ সময়ই একা থাকতে হবে কিন্তু। অন্তত যতদিন না ওর স্থায়ী বন্দোবস্ত করছি। খাবার টাইম মতো নাও পেতে পারো৷ সময়‚ সুযোগ বুঝে আসতে হবে যেহেতু আমাদের। আর সব থেকে ইম্পর্ট্যান্ট হচ্ছে এই মেয়েকে চব্বিশ ঘন্টায় নজরে রাখতে হবে৷ মরা ঘুম ঘুমানো যাবে না।”

“আমারে সবই বুঝাইছে নাফিস ভাই। আফনে কুনো চিন্তা লইয়েন না‚ সার।”

নাফিস আর পাভেলের সঙ্গে তাকাতাকি করল তখন শারফান৷ নাফিস আশ্বস্ত করল‚ মৌসুমি হতাশ করবে না ওকে।

“ঠিক আছে‚ কাজেই দেখা যাবে। নিজের ঘরটা গিয়ে গুছিয়ে এসো”‚ বলে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা সানার দিকে তাকাল সে। বিড়বিড়িয়ে উঠল‚ “ও আর কোনোদিনও নিজের পরিবারে ফিরবে না৷ তোমার দায়িত্ব অনির্দিষ্ট কালের জন্য।”

“একটা কথা বলি‚ ভাই?” জিজ্ঞেস করল নাফিস।

শারফান হ্যাঁ‚ না কিছু বলল না। চেয়েই থাকল সানার পানে৷ ওর নীরবতাতে সম্মতি বুঝে নিয়ে বলল সে‚ “আমার মনে হয় বন্দি করে রাখার চাইতে একবারে খতম করে দেওয়ায় ভালো৷ নয়ত কোনো না কোনোদিন পুলিশ খোঁজ পাইয়ে যাবে। তা না হলিও কারও চোখে পড়েও যাইতে পারে।”

“যদি মন চায় তা-ই করব৷ কিন্তু তার আগে ওকে দুনিয়ার দোজখখানার সঙ্গে পরিচয় করাব আমি৷ তাছাড়া ওর প্রেমিক আর প্রেমিকের দলবল পলাতক। তাদের সব কটার হদিস না বের করা পর্যন্ত ওকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু মরার মতো।”

জারাকে দুটো সপ্তাহের মতো ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। এর মাঝে কোনো জটিলতা না দেখা দিলে ছেড়ে দেওয়া হবে৷ কিন্তু গত দুদিনে কোনো পরিবর্তনই দেখা যায়নি তার মাঝে। আর তার জন্য শাফিউল সাহেবও সুস্থ হতে পারছেন না৷ আটচল্লিশ ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে৷ এখনো তিনি ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে।

তাদের কথায় মনে করল শারফান সানাকে দেখতে দেখতে।

***

রাত ৮: ২০ মিনিট ।

কালো আঁধারে ডোবা চারপাশ৷ চোখদুটো মেলতেই সানার মনে হলো কোনো অদৃশ্য এক ঘোর থেকে জেগে উঠল সে। চোখের পাতা বেজায় ভারী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পিঠের নিচে খুব শক্ত মতোন অনুভব করল সে। বিছানা এত শক্ত হলো কী করে? ভাবতেই খেয়াল হলো ঘরটাই বা এত আঁধার কেন? তারপর কয়েক মুহূর্তের বিলম্ব। একে একে সমস্তটা মাথায় চলে এল ওর৷

আঁধার ঘরের চারদিকে তাকিয়ে ওর শ্বাস আটকে আসলো যেন—এই ঘর ওর নয়। চারপাশে জঙ্গলের গন্ধ‚ ঝিঁঝি পোকার ডাক—কোথায় সে? কারা ওকে ধরে নিয়ে এল?

আচমকা চোখজোড়া টলমল করে উঠল সানার। কিন্তু কান্নায় নয়‚ সেটা নিঃশব্দ আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি। সে ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করল। তখনই বুঝল‚ হাতদুটো বেঁধে রাখা হয়েছে। ভয় যেন মেরুদণ্ড বেয়ে সারা শরীরে কাঁপন ধরাল। গলা শুকিয়ে কাঠ‚ ঠোঁটদুটোও কাঁপছে। হঠাৎ কেউ বাইরে পা টেনে হেঁটে গেল। সে শব্দে বুকটা ধক্ করে উঠল সানার। মনে হলো‚ ওর প্রতিটা নিঃশ্বাস যেন মৃত্যুর এক ধাপ কাছে নিয়ে যাচ্ছে ওকে।

এরপরই দরজাটা খোলার শব্দ পেল সানা। দরজার ফাঁক থেকে বাইরের সীমানায় যতটুকু চোখ গেল‚ সবটাই ভূতূড়ে আঁধার৷ তবুও ও দেখতে পেল‚ চারপেয়ে কোনো বিরাট জন্তু সতর্ক পায়ে ঘরের ভেতরে ঢুকছে। ওটা কি মৃত্যুদূত? মৃত্যু ভয়ে সে চিৎকার করে উঠবে‚ ঠিক তখনই দরজা আটকানোর শব্দ পেল। খুট্ করে একটা আওয়াজ হলো এরপর। তারপরই আলোকিত হয়ে উঠল ঘরটা—এক চিলতে গ্যাস লাইটের আগুনে।

গত ক’দিনের অবহেলায় চুলগুলো আগের চেয়ে খানিকটা লম্বা হয়ে নেমে এসেছে চোখের নিচ অবধি। নরম, রেশমির মতো সেই চুলগুলো শারফান যতটা সম্ভব হাতে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। তবুও কয়েকটি আলগা বেণুর মতো অবাধ্যভাবে ঝুলে আছে চোখের ওপর। পরনে ধূসর ভি-গলা টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার‚ পায়ে কাদা মাড়িয়ে আসার উপযোগী হাইকিং বুট। কব্জিতে চকচকে রোলেক্স সাবমেরিনার। ঘড়ির স্টিল ব্রেসলেটের মতোই ওর চোখে জ্বলে উঠছে দাহ্য প্রতিহিংসার আগুন।

“আপনি! শায়াফ”‚ সানার বিস্ফারিত দৃষ্টি।

“হেই‚ শুগার ভেনম”‚ ঠোঁটের কোণে হালকা বিদ্রূপ টেনে বলল শারফান‚ “হ্যাঁ‚ আমিই। নট ইমপ্রেসড? ফারনাজ হলে মজা পেতে?”

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৩৮.

নও তুমি ক্ষমতাবান‚ মূল্যের বাইরে তোমার মান—সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কথাদুটো কতটা নিখাদ‚ তার জীবন্ত প্রমাণ মোস্তফা সাহেব৷

মেয়ে নিখোঁজের সংবাদ শোনার পর ভদ্রলোক দুঃসহ ভয়‚ অজানা আশঙ্কা আর নিদারুণ কষ্ট নিয়ে ঢাকা রওনা হন সেই বিকালেই। এরই মধ্যে সানার মামা মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের আশেপাশে প্রতিটি অলিগলি‚ অন্ধকার ঘুপচি চষে ফেলেছেন লোকবল নিয়ে। কারও ফোনে মেলে ধরা ওর ছবি‚ কারও মুখে প্রশ্ন‚ “এই মেয়েটিকে দেখেছেন?” কিন্তু না‚ কেউ কিছু জানে না‚ কেউ ওকে দেখেনি।

ঢাকায় পৌঁছেই মোস্তফা শ্যালকের হাত ধরে ছুটে যান থানায়। কিন্তু আইন সেখানে নিষ্ঠুর নিয়মে বাঁধা—চব্বিশ ঘন্টা না পেরোলে কোনো অভিযোগ গৃহীত হবে না। সেই সঙ্গে শুনতে হয় নানারকম কথা—সানা হয়ত তার প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছে! তাই যেন চাপ না নেন মোস্তফা।

চোখের কোণ তখন ভরে ওঠে তার অথই জলে। মেয়েটা কেমন—এ কথা অফিসারকে বোঝাতে পারেননি তিনি। রাত পোহাবে‚ আগামী বিকাল আসবে‚ তারপরই পুলিশ খোঁজে বের হবে। তাই ফিরে আসতে হয় তাকে অসহায় বেশে। আর নাজমা বেগম একা বাড়িতে জায়নামাজে বসে কেঁদে বুক ভাসান পরম সৃষ্টিকর্তার দরবারে।

এখন অবধি তারা কাউকে জানাননি সানার নিখোঁজ সংবাদ। যদি ফারনাজের মা-বোন জানতে পারে‚ নিজেদের এই সঙ্কটের মাঝেও তারা সানার কথা চারপাশে রটিয়ে দিতে দুবারও ভাববে না।

এদিকে‚ ফারনাজ ঘটিয়েছে আরেক বিস্ময়কর কাণ্ড। সন্ধ্যা সাতটার সময় সে নিজের অন্যায় কবুল করে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। বলা ভালো‚ জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসেছে পুলিশের কাছে।

ব্যাবসার প্রয়োজনে খারাপ-ভালো‚ সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গেই শারফান সীমাবদ্ধতার মাঝে সম্পর্ক তৈরি করে রেখেছে৷ দরকারে তাদের সঙ্গে ওঠা-বসাও চলে ওর। রাজনের মতো ঢাকায় সন্ত্রাসবাদ জীবন পরিচালনা করে আরও কজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। যাদের হাতও রাজনের থেকে কম লম্বা নয়। ফারনাজকে গুহা থেকে টেনে বের করার জন্য এমনই এক সন্ত্রাসী শারফানের টাকার কাছে গোলাম বনেছে৷ গত দুদিন ধরে তার পোষা বাহিনী ফরিদপুর ঢুকে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে আজ প্রায় ধরেই ফেলেছিল ফারনাজকে।

আত্মগোপন করেছিল ফারনাজ নিজের কারখানার এক কর্মীর বাসায়৷ সেই অবধি যখন পৌঁছে যায় সন্ত্রাস ছেলেগুলো‚ তার কয়েক মুহূর্তের মাঝে তাদের উদ্দেশ্য টের পেয়ে একরকম জান হাতে নিয়ে পালিয়ে আসে থানায়।

শারফান যে এবার ওর জীবনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে তা সে বুঝেছিল জারার আর শাফিউল সাহেবের অসুস্থতার খবর পেয়েই। তাই তো দেরি করেনি ফোন করে মাফ চাইতে। ভেবেছিল, সমাজের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন কিছু ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি আর দলের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে সঙ্গে নিয়ে শারফানের বাড়িতে যাবে—মাথা নত করে ক্ষমা চাইবে ওদের সকলের কাছে। ইতোমধ্যে একে একে সবার সঙ্গে কথা বলে নরমে-গরমে রাজি করানোর চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সুযোগটা আর দিল না শারফান।

ওর আত্মসমর্পণের খবরটা শারফানের কাছে পৌঁছেছে রাত আটটায়৷ কী কী জবানবন্দি দিয়েছে ফারনাজ‚ তাও শুনেছে৷ যেখানে রাজনের নাম গোপন করে গেছে সে৷ যদিও রাজনের জড়িত থাকার তথ্য শারফানের অজানা। কিন্তু ওর ভুল ধারণা মোতাবেক সানার নামটার সঙ্গে ফারনাজ হাসিবের নামটাও উল্লেখ করেনি বিধায় স্পষ্ট হয়েছে ওর কাছে‚ হাসিব তবে সত্যিই ওদের নিকটাত্মীয়।

এই আত্মসমর্পণে মোটেও খুশি হয়নি সে৷ কারণ‚ সে জানে‚ ফারনাজ খুব বেশিদিন জেলে থাকবে না—বড়োজোর বছরখানিক। সেটাও থাকবে কিনা সন্দেহ। রাজনীতির সুবাদে কম ক্ষমতাবান মানুষের সঙ্গে জড়ায়নি সে। খুব শীঘ্রই তাদের কারও মাধ্যমেই বেরিয়ে আসবে৷ তাই ঝোঁকের বশে বা কেবল ভীত হয়েই নয়‚ সব ভাবনাচিন্তা করেই ফারনাজ অপরাধ স্বীকার করেছে৷ আর এই অপরাধের কারণ দেখিয়েছে‚ নিজের জুট মিলের দুর্ঘটনার দায়ভার শারফানের ওপর দেখিয়ে৷

রোহান আর দিপুর খোঁজ নিয়েছিল ফারনাজ আগেই। তাদের ভারত পাড়ি দেওয়ার খবরও সে জানিয়েছে পুলিশকে। অর্থাৎ কোনো অপরাধীই শাস্তি পেল না ভেবেই রাগে-ক্ষোভে শারফান অন্ধ এখন। অথচ বিনা দোষে ওর বোন‚ বাবা অপূরণীয় ক্ষতির ভার বহন করছে হাসপাতালের বিছানাতে শুয়ে।

রাত ৮: ৪০ মিনিট ।
একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘরে ঢুকল মৌসুমি। সেটা কোথায় রাখবে‚ তা জানতেই জিজ্ঞাসু চোখে চাইল শারফানের দিকে৷ হাত বাড়িয়ে সে নিজের হাতেই নিল মোমবাতিটা।

ওদেরকে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে দেখছে সানা। এখনো কিছুই পরিষ্কার করেনি শারফান ওর কাছে। শুধু হেয়ালি করে গেছে আর যত নোংরা ইঙ্গিত করা যায়‚ তাই করে গেছে ফারনাজকে কেন্দ্র করে।

শারফান এগিয়ে এসে খাটের ওপর এক পা তুলে ঝুঁকে এল ওর দিকে। ওর চোখে-মুখে গভীর ভয় দেখতে পেয়ে ঠোঁটের কোণ বাঁকাল—সন্তুষ্ট সে ওকে ভীত হতে দেখে। ওর সারা মুখে চোখ বুলিয়ে হঠাৎ বলে উঠল‚ “ভালো দেখাচ্ছে তোমাকে। আগের থেকে অন্যরকম। কী চেইঞ্জ হলো এ কদিনে?” বলে সন্ধানী চোখে আরেকবার ওকে পর্যবেক্ষণ করল৷ তারপরই খুঁজে পেল বদলটা। “ও আচ্ছা… রিবোন্ডেড হেয়ার?” সহসাই হাত বাড়াল ওর চুলে। বলল ঠাট্টা করে‚ “মোর লাইক রিবোন্ডেড মাই হার্ট!”

একদম খেপে উঠল সানা। “খবরদার! গায়ে হাত দেবেন না”‚ শারফানের হাতটা ঝাড় দিয়ে সরিয়ে ঝাঁঝাল স্বরে বলল‚ “কোন সাহসে আমাকে তুলে এনেছেন? এত নোংরা আপনি!”

“দেন হোয়াট আর ইউ‚ ব্লাডি বিউটি?” বলেই ওর এক গোছা চুলের ডগা চার আঙুলে পেঁচিয়ে টান দিল নিষ্ঠুরভাবে।

চুলের গোড়া চেপে ধরে ব্যথায় ডুকরে উঠল সানা। তবু ছাড়ল না শারফান। “কীভাবে পারলে আমার বোনের সর্বনাশ করতে? তুমি নিজে না এক মেয়ে”‚ দাঁত চেপে শব্দগুলো ফুঁড়ে ফুঁড়ে বলল সে‚ “আমার বোনকে জানোয়ারদের হাতে তুলে দিয়ে তুমি আনন্দ-ফুর্তি করে বেড়াচ্ছ কী করে?”

“কী করেছি আপনার বোনকে?” বিস্ময়ের ভারে কণ্ঠটা কেঁপে উঠল সানার।

দরজায় দাঁড়ানো মৌসুমি তখন জিজ্ঞেস করল শারফানকে‚ “কুনো হেল্প লাগব‚ সার?”

“এখন না”‚ গমগমে গলায় বলল শারফান‚ “দরজাটা আটকে চলে যাও।”

চলে গেল মৌসুমি। সে যেতেই সানার ভয় জেঁকে ধরল আরও বেশি। যে ভয়ে ওকে যন্ত্রণা দিতে সাহায্য করা মেয়েটাকেই ডেকে উঠতে চাইল সে—সুযোগ পেল না। তার আগেই দ্বিতীয়বার শারফানের তোপের মুখে পড়ল৷ নিচু অথচ উগ্রকণ্ঠে বলল ওকে‚ “তোমার নাগর আমার হাতে পড়ার ভয়ে পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছে৷ খুব রাখঢাক বজায় রেখে দোষ স্বীকার করেছে৷ যেখানে তোমার নাম উল্লেখ নেই‚ হাসিব বাস্টার্ডসহ কিডন্যাপারের নাম উল্লেখ নেই। তাই তুমি কনফেস করো‚ আমি রেকর্ড করি। করলেই আমার জাং তোমার জান ছেড়ে দেবে। নয়ত…” থেমে চোখের ইশারায় দেখাল জার্মান শেফার্ডটিকে।

ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই যেন ঝড় তুলে রেখেছে জাং নিজের ভেতর। পেশিবহুল দেহটা টানটান করে দাঁড়িয়ে‚ পেছনের পা দুটো মাটি আঁকড়ে আর সামনের পা দুটো হালকা বাঁকানো—যেন লাফটা দিয়ে বসবে যে-কোনো মুহূর্তে। চোখ দুটো জ্বলছে এক নিঃশব্দ হিংস্র আলোয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সানাকে গেঁথে রেখেছে—যেন চোখ দিয়েই ছিঁড়ে ফেলবে ওর দেহটা। ঠোঁটের কোণায় জমে থাকা লালা‚ কাঁপতে থাকা গোঁফ‚ আর ঘন ঘন ওঠানামা করা বুক—সব কিছু মিলে সে যেন শুধু ‘আদেশ’ এর অপেক্ষায় এক অগ্নিপিণ্ড রূপে দাঁড়িয়ে আছে। মালিকের মতোই ওর গর্জন নয়‚ ওর নিস্তব্ধতা ভয়ংকর। কারণ‚ সে চুপ থাকলেই বোঝা যায় গর্জনের থেকেও বড়ো কিছু আসছে। ঠিক এখন যেমন।

সানার মনে হলো‚ ওটা সত্যিই ওর মৃত্যুদূত। আতঙ্কে চোখের কোণ ভাসিয়ে নিজের মধ্যেই সিঁটিয়ে গেল৷ “আমি কী অপরাধ করেছি বুঝতে পারছি না”‚ সরল গলায় বলল‚ “হাসিব—ও কী করেছে? পুলিশে ধরা দিয়েছে কে‚ বলুন?”

এক সময় যে কণ্ঠে শারফান বিমোহিত হত‚ আজ সেই কণ্ঠের কথাগুলো ওর কাছে ন্যাকামো আর নাটক মনে হলো। তাই মুহূর্তেই গলে যাওয়া মোমটুকু ওর বাহুতে ফেলল সে। এ যন্ত্রণা সহনশীল হলেও কেবল ভয়েই ফুঁপিয়ে উঠল সানা।

“লাস্টা চান্স‚ সানা”‚ অধৈর্য‚ উত্তেজিত হয়ে বলল শারফান‚ “আমি জানতে চাই প্রতিটি ব্যক্তির নাম‚ তাদের পরিচয়‚ ফারনাজের সম্পূর্ণ প্ল্যান৷ ওকে বাঁচানোর চেষ্টা যত করবে‚ তত তোমার জানের ওপর ঝড় যাবে।”

“আমি তো জানিই না আমি কী করেছি! কোথায় নিয়ে এসেছেন আমাকে? এক্ষুনি আমাকে আমার বাড়ি নিয়ে চলুন‚ বলছি! খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন।”

“বাড়াবাড়ি!” ধমকের স্বরে শব্দটা পুনরাবৃত্তি করল শারফান। ধৈর্য আর রাগের সীমা পেরিয়ে গেল ওর। চেহারাটাই হয়ে উঠল যেন বিকৃত৷ “এখনো ভয় লাগছে না আমাকে?” কণ্ঠে বজ্র হুঙ্কার আর চোখে আগুন নিয়ে বলল‚ “রক্তের শিরাতে শিরাতে ভয় ছড়াবে এখন।”

জাঙের গলায় কলারে বাঁধা ছয় ফুট লম্বা‚ শক্ত চামড়ার লিশটা তুলে নিল সে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে একপলক অপরাধী সানার দিকে তাকিয়ে হুকুম দিল‚ “ভয় কেমন‚ ওকে একটু বুঝিয়ে দে।”

সানা অবিশ্বাস চোখে চাইল শারফানের দিকে। পুরো পরিস্থিতিটুকুই লাগল অবিশ্বাস্য৷ কোন অপরাধের কারণে শারফানের এমন কদর্য রূপ দেখতে হচ্ছে ওকে? জাঙের হিংস্র অবয়বটা দেখেই ও চিৎকার করে উঠল ৷ তখনই এক লাফে খাটের ওপর উঠে এল জাং। চোখের পলকে ঝাঁপিয়ে ওকে পেড়ে ফেলল নিচে। কাঁদতে কাঁদতে কখনো মা-কে ডাকল‚ কখনো আল্লাহকে সানা। করুণ কাতর স্বরে প্রাণ ভিক্ষা চাইল শারফানের কাছে আর দু’হাতে নিজেকে রক্ষা করার ব্যর্থ চেষ্টা করল। জাঙের ধারাল নখের আঁচড়ে হাত-পায়ে চামড়া ফেটে রক্তের ধারা নেমে এল। প্রতিটি আঁচড় যেন একেকটা আগাম হুঁশিয়ারি‚ যে পরবর্তী আঘাত আরও ভয়ানক হবে। এবার কামড়ে তার শরীর থেকে মাংস ছিঁড়ে নেবে সে। ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ ওর গলায় বাঁধা লিশে প্রবল এক টান পড়ল। টান খেয়ে সে থমকে গিয়ে তাকাল মনিবের দিকে।

“এনাফ।” ঠান্ডা গলায় জাংকে আদেশ করল শারফান‚ “নেমে আয়।”

দ্বিতীয় লাফে নেমে এসে দাঁড়াল জাং ওর কাছে৷ তারপর পূর্বের আক্রোশ নিয়েই সানার দিকে তাকাল শারফান। ঘাড় বাঁকিয়ে সানাও তাকিয়ে। কিন্তু ভেজা‚ ভীত-সন্ত্রস্ত দৃষ্টিটা ওর হয়ে উঠল ঘোলাটে। চারপাশের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকও যেন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে এল কানে। হাপরের মতো উঠতে থাকা বুকটা থমকে গেল—তারপর নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল চোখদুটো‚ নীরবে ডান চেখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে গেল শেষ অশ্রুটুকু।

বুকের অস্থিরতার মাঝেই একটা বাড়ি দিয়ে উঠল যেন শারফানের। দ্রুত এগিয়ে এসে সানার নাকের কাছে আঙুল ধরল। এখনো শ্বাস চলছে দেখে শান্ত হলো ভেতরটা। “মৌসুমি?” উচ্চস্বরে ডেকে উঠল হঠাৎ।

দরজাটা খুলে গেল তারপরই৷ মৌসুমি ভেতরে আসতেই তাকে নির্দেশ দিল‚ “কিপ অ্যান আই অন হার।”

মৌসুমি বুঝল না কথাটা। তার কোনো জবাব না পেয়ে তার দিকে তাকাতেই বুঝল সমস্যাটা। তখন বলল‚ “নজর রেখো।”

“ও.কে‚ সার।” মুখে বললেও চেতনাশূন্য সানার মুখটা আর ওর রক্তাক্ত হাতদুটো দেখে মৌসুমির ভেতরে ভেতরে বেশ মায়া লাগল। কিন্তু তা গুরুত্ব দেওয়া চলবে না‚ সেটাও বোঝাল নিজেকে। মেয়েটা শারফানের বোনের যে ক্ষতি করেছে‚ তার কাছে এই নির্যাতনটুকু এখন অবধি তুচ্ছই।

“জাং থাকবে তোমার খেয়াল রাখতে”‚ বেজে উঠল শারফানের শুষ্ক গলাটা‚ “ও থাকতে ভয় নেই। আর সমস্যা লাগলে কল কোরো নাফিসকে।”

“আপনি কি এহন যাইবেন গা?”

“হুঁ।”

“সাবধানে যাইয়েন‚ সার৷ আমার কুনো ভয় নাই।”

জবাবে গম্ভীরই রইল শারফান। শেষবারের মতো আহত‚ জ্ঞানহীন সানার মুখটা দেখে জাংকে কিছু নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল দ্রুত। রাস্তায় উঠে গাড়িতে বসতেই দেহটা সিটে এলিয়ে দিল‚ যেন ক্লান্ত এক যোদ্ধা। গ্লানিতে ভরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখদুটো কিছুক্ষণের জন্য বুজল। ঠিক তখনই চোখের ভেতর ঝলক দিয়ে উঠল সানার কাতরানির চিত্রটা‚ তার আর্তিগুলো যেন কানে বাজতে থাকল। অদ্ভুত এক বিরক্তি চেপে ধরল তাতে। অপরাধীকে মারতে‚ শাস্তি দিতে সারাজীবন সে স্বস্তি পেত—কখনো কারও কান্না‚ চিৎকার বা করুণ আর্তি তাকে নাড়া দেয়নি এতটুকু। কিন্তু আজ… আজ কিছু একটা অন্যরকম ঘটছে ওর সঙ্গে। আজকের আগে কারও মরণ কান্না ভেতরটা এলোমেলো করেনি ওর।

জাং বসে ছিল বারান্দাতে। আর ঘরের ভেতরে বেশ দ্বিধা নিয়ে মৌসুমি তাকিয়ে দেখছিল সানাকে৷ ওর জ্ঞান ফেরাবে কি ফেরাবে না‚ রক্ত পরিষ্কার করবে কি-না—এসব ভাবনার মধ্যে কেটে গেছে দশটা মিনিট। কারণ‚ কেবল নজর রাখার কথা বলে গেছে শারফান৷ সেবা করবে কি-না‚ এ ব্যাপারে তাকে নির্দিষ্টভাবে প্রশ্ন করলে ভালো হত। তাই নিজেই সিদ্ধান্ত নিল‚ যেমন আছে তেমনই থাক—অপরাধীর প্রতি মায়া দেখানো একদম উচিত নয়।

দরজায় কড়া পড়ল এরপরই। ডেকে উঠল শারফান‚ “খোলো‚ মৌসুমি।”

চমকাল মৌসুমি—অপ্রত্যাশিত কিনা স্যারের আগমন! দ্রুত দরজাটা খুলতেই আচমকা তার সামনে ধরল একটা বাক্স। “ট্রিট হার”‚ ছোট্ট করে বলল শারফান।

ইংরেজি ভাষাজ্ঞান না থাকলেও দুই শব্দের অর্থ বুঝতে অসুবিধা হলো না মৌসুমির‚ ওষুধের বাক্স চিনতে পারায়। সেটা নিতেই আর দাঁড়াল না শারফান।

***

১৮ মার্চ
রাত ৮ টা

বাহাত্তর ঘন্টা পর আইসিইউ থেকে কেবিনে দেওয়া হয়েছিল শাফিউল সাহেবকে। আজ অনেকটাই ভালো বোধ করায় তিনি আর এখানে শুয়ে থাকতে রাজি নন। জারার কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে শুরু করলেন। কিন্তু জারার অবস্থা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ওকে এখনো আইসিইউতে মুখে অক্সিজেন মাস্ক অবস্থায় দেখলে যদি তা সহ্য করতে না পারেন তিনি‚ তাই রাজি হলো না শারফান৷ বলল কপট বিরক্তি নিয়ে‚ “ওকে বাসায় নিয়ে গেছি কবে! এখন কি তোমার জন্য হসপিটালে টেনে আনব?”

“কবে নিয়েছিস? বলিসনি কেন?” আবেগ আর আনন্দে কেঁপে উঠল শাফিউল সাহেবের কণ্ঠ‚ “ও পুরোপুরি সুস্থ আছে তো?”

“হুঁ”‚ দৃষ্টি লুকিয়ে জবাব দিল শারফান। “এখন খেয়েদেয়ে ঘুম দাও তো৷”

পাত্তা দিলেন না তিনি ছেলের কথা। আদেশ গলায় বললেন‚ “ডক্টরের সাথে কথা বলে রাখ তুই। আমিও বাড়ি যাব কালকেই।”

“কালকে যাবে না পরশু যাবে—তা তুমি ঠিক করবে?” ধমক লাগাল শারফান‚ “যার পেশেন্ট সে ডিসাইড করবে।”

“তুই আমার চোখের সামনে থেকে সর”‚ পালটা ধমকে বললেন শাফিউল‚ “ডক্টর পাঠা‚ যা। আমার কথা আমিই বলব।”

“তোমার চামড়া ঝুলে পড়া থোবড়া দেখার জন্য থাকছিও না আমি। চলে যাব রাতেই।”

“তোকে আসতে বলেছে কে? চৌদ্দবার ট্রিপ মারছিস কার গাড়ির তেল খরচ করে? আজকে যেয়ে আর ছয় মাসের ভেতর ফিরবি না।”

“পাগল-ছাগলের পয়দা”‚ বিদ্রুপের সুরে বিড়বিড় করে শারফান বেরিয়ে এল কেবিন থেকে।

আর তা শুনতে পেয়ে শাফিউল সাহেব চেতে উঠলেন‚ “এই‚ তুই কী বললি? আমার সামনে দাঁড়ায় বলে যা‚ হারামজাদা…”

নার্স দ্রুত তাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল—চিৎকার-চেঁচামেচি না করতে নির্দেশ দিতে থাকল বারবার৷ তখনই কেবিনে ঢুকলেন জেসমিন বেগম। মেয়ের কাছে গিয়েছিলেন তিনি। তাকে দেখেই ছেলের নামে নালিশ করলেন শাফিউল। ছেলেকে শিক্ষা দিতে পারেননি‚ মানুষ করতে পারেননি‚ এ অভিযোগও তুললেন বউয়ের ওপর। স্বামীর পরিস্থিতি আর স্থান বিবেচনা করে জেসমিন চুপচাপ শুনে গেলেন শুধু। তাছাড়া মনটা টানছেও কথা বলার জন্য৷ স্বামীর সামনে শক্তভাবে থাকেন আর আড়ালে বসে মেয়ের জন্য কাঁদেন। শরীরটা এ কদিনে একদম ভেঙে গেছে তার। তবুও খুব বেশি সময়ের জন্য নড়েন না হাসপাতাল থেকে।

এদিকে‚ শারফান এল জারার কাছে। তবে দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে পড়ল ডাক্তার আর নার্সের সঙ্গে জারার কথোপকথনে।

“আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে”‚ ভাঙা ভাঙা গলায় বলল জারা‚ “আমি ভালো নেই‚ না?”

“আমরা অক্সিজেন দিচ্ছি‚ হাই ফ্লো”‚ নার্স জানাল‚ “শরীর চাপ সামলাতে পারছে না বলে শ্বাসটা কষ্টকর লাগছে।”

আর ডাক্তার বললেন‚ “হৃদপিণ্ডের বাম দিকটা ঠিকঠাক রক্ত পাম্প করতে পারছে না তোমার। ফলে রক্ত পেছনের দিকে জমছে। এই জন্যই ফুসফুসে চাপ পড়ছে। এটা হার্ট ফেইলিউর।”

গলা ধরে এল জারার‚ “আমি… আমি কি মরে যাব?”

“আমরা সব করছি‚ সোনা”‚ ডাক্তার আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন‚ “অনেকেই সুস্থ হয়ে ওঠে। তোমাকে এখন কেবল লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। হৃদয়টা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্রাম‚ ওষুধ আর সময় দরকার। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো।”

বুকের গহিনে একটা শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ল জারার। শরীর ভরাট‚ তবু ভেতরটা ফাঁকা। মাথার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্স অক্সিজেন মাস্ক এগিয়ে দিল। ও বলল না কিছু। বুঝে গেল—শ্বাসটা এভাবে মেশিনের ভরসাতেই নিতে হবে।

নীরবে বোনের কাছে এসে দাঁড়াল শারফান। ভাইকে দেখে জারার চোখদুটো আরও টলমল করে উঠল—কী অসহায় চাউনিতে চেয়ে রইল! শারফানের পক্ষে সম্ভব হলো না অমন দৃষ্টিতে চোখ মেলানোর। দমবন্ধ লাগে ওর।

জারার আত্মীয়দের মতো সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি ভাবা হয় জারার পরিস্থিতি‚ তবে সত্যিই জীবনটা ওর শুরু হওয়ার আগেই অর্ধেক শেষ—যার ব্রোকেন হার্ট সিনড্রোম থেকে হার্ট ফেইলিউর হয়েছে। হাসপাতাল থেকে যেদিন মুক্তি পাবে‚ তারপর থেকে পুরো জীবনই নিজেকে সুস্থ রাখতে নিয়মিত চিকিৎসা ও যত্ন চালিয়ে যেতে হবে। শরীরে যাতে পানি না জমে‚ হৃদয়টা যেন শান্ত থাকে—এসবের জন্য দীর্ঘদিন চালিয়ে যেতে হবে ওষুধ। জীবনধারাও এখন থেকে নিয়ন্ত্রণে চালাতে হবে ওর। নয়ত মানসিক চাপ বাড়লেই দ্বিতীয়বার ব্রোকেন হার্টের শিকার হতে হবে। সামনের দিনগুলো ওর জন্য আর পাঁচটা অষ্টাদশী মেয়েদের মতো হবে না। চলাফেরাটাও দীর্ঘদিন করতে হবে হুইলচেয়ারের সাহায্যেই। শাফিউল সাহেব সম্পূর্ণ সুস্থ হলে শারফান আর এখানে রাখত না বোনকে। নিয়ে যেত সঙ্গে করে ঢাকাতে৷ বোনকে এভাবে বারবার ফেলে রেখে গিয়ে ব্যাবসাতে মনোনিবেশ করা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে ওর জন্য।

অন্যদিকে‚ মেয়ে নিখোঁজের পর থেকে মোস্তফা সাহেবের পরিবারটাও ভেঙে পড়েছে প্রায়। ঢাকার পুলিশ এখন অবধি সামান্য সূত্রও খুঁজে পায়নি সানাকে খুঁজে বের করার মতো। ভাইয়ের বাসাতেই আছেন নাজমা বেগমও৷ খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে রাত-দিন অবিরত কাঁদতে কাঁদতে তিনি অসুস্থ। জোরপূর্বক স্যালাইন দিয়ে বিশ্রামে রাখা হয়েছে তাকে৷

আর মোস্তফা সাহেব! দৌড়াদৌড়ির জন্য একটু শক্তি প্রয়োজন বলেই কোনোরকমে টিকে আছেন তিনি সুস্থ বেশে। মাত্র চারদিনেই সুঠাম চেহারার মানুষটির বয়স বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। মেয়েটা হারিয়ে গেছে পর্যন্ত রাতে ঘুমাতে পারেন না। এমন পরিস্থিতিতে যে-কোনো মুহূর্তে তিনিও বিছানাশয্যা হয়ে পড়বেন।

***

১৯ মার্চ
সন্ধ্যা ৬ টা ।

মচমচ করা খাটটা ভেঙে গেছে আজ দুদিন হলো। চটের বিছানা মাটিতে পেতে বসে আছে সানা—দেওয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে। সামনে দুর্গন্ধময় একটা রুটি আর পানির মতো পাতলা ডাল পড়ে আছে দুপুর থেকে৷ ডালটাও নষ্ট ছিল। এখন আরও নষ্ট হয়ে খাবারের দুর্গন্ধে ঘরটায় টেকা দায়৷ কিন্তু সানার যেন অভ্যাস হয়ে গেছে এ কদিনেই।

সুস্বাস্থ্য শরীরটা এখন শীর্ণকায় ওর। কত বছর ঘুমাতে না পারার মতো চোখজোড়া লাল‚ চোখের নিচে বিভৎস কালি‚ ঠোঁটদুটো ফ্যাকাশে আর চোয়ালজোড়া ভাঙা। গায়ের সাদা সেলোয়ার-কামিজটা ছেঁড়া-ফাটা—নোংরা ভরে সাদা রংটাই হারিয়ে গেছে।

প্রায় পাঁচদিনের অভুক্ত বলা চলে সানাকে। সারা দিনে এক বেলা খাবার দেয় মৌসুমি—শারফানেরই নির্দেশে। কোনোদিন পচাগলা পান্তা ভাত আর একটা পেঁয়াজ‚ কোনোদিন নষ্ট হওয়া বাসি রুটি আর নয়ত শুকনো মুড়ি আর পানি। প্রথম দুদিন কেবল পানি খেয়ে থাকলেও ক্ষুধার তাড়নায় পরের দুদিন যা দিয়েছে মৌসুমি‚ সেটাই খেতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু গলা দিয়ে নামার পরই পেট পাকিয়ে উঠে বমি করে ভাসিয়েছে নিজের শোবার জায়গাটুকু। গা কাঁপতে থাকা দুর্বল শরীরে তা পরিষ্কারও করতে হয়েছে নিজেকেই। এর মাঝে একটু ভালো হয়েছে যা‚ তা হলো ওর হাতে-পায়ের ক্ষততে নিয়ম করে চিকিৎসা দিয়েছে মৌসুমি৷ এও অবশ্য শারফানের অনুমতিতেই দিয়েছে‚ তা একটা সময় বুঝতে পেরেছে ও।

গতকালও মৌসুমির পা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে সানা—চেয়েছে মুক্তি। তার ফলেই আজ দুপুর পর্যন্ত হাত-পা বাঁধা অবস্থায় থাকতে হয়েছিল তাকে। নাফিস আর পাভেল যেহেতু নিয়মিত আসা-যাওয়া করছে‚ তাই গতরাতে এসে মৌসুমির কাছ থেকে সবটা শুনে শাস্তিস্বরূপ বেঁধে রেখে গিয়েছিল ওকে। দুপুরের খাবার দেওয়ার সময় ওর বাঁধনটা খুলে দিয়েছে মৌসুমি। দয়া দেখিয়ে দ্বিতীয়বার আর বাঁধেনি। বাঁধনমুক্ত হয়েই পুরনো প্রশ্নটা তাকে আবারও করেছিল সানা‚ “আপনি অন্তত বলুন‚ আপু‚ আমি কোন অপরাধের এই নিষ্ঠুর শাস্তি পাচ্ছি?”

“শোন রে ছেমরি‚ আমারে তোর লগে একখান টু শব্দও করবার নিষেধ করি দিছে‚ সার”‚ হুঁশিয়ার করতে জবাব দেয় মৌসুমি‚ “করলিই আমারে সরায় দিব কিন্তু। তহন থাকব কেডায় জানোস? ওই যে দুইডা ছেমরা আহে না? ওগো একজনে থাকব তোর পাহাড়ায়। এহন যেট্টুক নিরাপদ আছোস‚ তহন কইলাম তাও থাকবার পারবিনে”

সাবধানবাণীটা কাজ করেছিল। এরপর আর কোনো প্রশ্ন করেনি সানা। যদিও মৌসুমি যা বলেছিল‚ তা পুরোপুরি সত্য ছিল না। নাফিস আর পাভেল যতবার এসেছে‚ একবারের জন্যও সানাকে নিয়ে খারাপ কিছু ভাবেনি—ভাববেও না কখনো। তা শারফান জানে বলেই তাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছে সে।

তবে সানা জিজ্ঞেস করেছিল, শারফান কবে আসবে। সে উত্তরও পেয়েছে—পথিমধ্যে আছে শারফান‚ কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌঁছাবে। এই তথ্যের সঙ্গে সঙ্গে মৌসুমি ওকে মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত থাকতে বলেছে৷ কারণ‚ তার আগমন মানেই সেই দিনের মতো ভয়ঙ্কর কোনো শাস্তির পুনরাবৃত্তি। মৌসুমি তখন আরও কিছু বলেছিল‚ “নাফিস ভাইরতে যদ্দূর শুনসি সারের ব্যাফারে—এতুদিনের ভিত্রে তোর হালত তো এক্কেরেই চক্ষে দেহার মতো কতা না। বুনরে নাকি ম্যালা আদুর করে সার। সেই বুনের যে হালত করছোস! মরার মতো অবস্থা নাকি। মনে অয় তুই মাইয়া লোক কইয়াই ছাড় দিতাছে। খাওনের কষ্টটুক ছাড়া আর কী করতাছে? আমারেও কুনো অডার দেয় না তোরে মাইরধর করার লাইগা।”

এরপর থেকেই সানা অপেক্ষা করছে শারফানের জন্য। তবে শাস্তির ভয়ের চেয়েও বড়ো হয়ে উঠেছে ওর কৌতূহল—জারার কী হয়েছে? এবং সেখানে সে ও হাসিব কী করে জড়িত? ফারনাজের জন্যই কিছু একটা ঘটেছে। এবং তা গভীর কিছু—ইতোমধ্যে সেটা টের পেয়েছে সে।

মামার বাড়িতে বহুদিন বাদে ভাই-বোন সবাই এক সঙ্গে হওয়ায় সানা ফেসবুক থেকে দূরেই ছিল৷ তবে খালাত বোন পাখি এর মাঝে একদিন জানিয়েছিল ওকে‚ কোনো এক মেয়ের সঙ্গে ফারনাজের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিয়ো ফাঁস হয়েছে৷ ফারনাজের চরিত্র সম্পর্কে শারফানের থেকে যেহেতু আগে থেকেই সে অবগত ছিল‚ তাই সে ভেবেছিল তেমনই কিছু ফাঁস হয়েছে। এবং ফারনাজের প্রতি ওর তিক্ত অনুভূতি থেকেই আগ্রহবোধও করেনি ভিডিয়োটি দেখার৷ তাছাড়া বিষয়টি আপত্তিকর বিধায় নাজমা বেগম ফোনেও এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা করেননি মেয়েদের সঙ্গে। মূলতঃ ওরা মামার বাড়ি আনন্দে আছে ভেবেই সে মুহূর্তে এমন সংবেদনশীল বিষয় জানানোর প্রয়োজনবোধ করেননি বাবা-মা কেউ-ই। আর ফারনাজ বিষয়টিকে আত্মীয়দের কাছে ব্যাখ্যা করেছিল নিজেকে সরল রূপে—কোনো এক শত্রুপক্ষ তার আর শাকিবুল সাহেবের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি করতেই তাকে ফাঁসিয়েছে। এবং ভিডিয়োটি সম্পূর্ণ এডিটেড৷ যেখানে জারার সঙ্গে ছিল অন্য কেউ—সে নয়।

***

আকাশটা বিকেলের আলোর ভাঁজ থেকে হঠাৎ গাঢ় নীল-ধূসর হয়ে উঠেছে‚ পাখিরা হেঁটে হেঁটে গাছের ঘন পাতায় ঠাঁই নিচ্ছে। কারণ‚ তারা টের পেয়েছে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

ওদের আগাম ধারণাকে সত্য করে আচমকা বাতাস শুরু হলো—মাটি আর পাতার গন্ধ মেশানো বাতাস। তারপর হঠাৎ কোনো ঘোষণা ছাড়াই সায়ংকালের অসময়ের বৃষ্টি। মিহি ঝিরঝিরে নয়‚ টুপটাপ নয়‚ প্রথম ফোঁটাতেই ভারী ঝুম বৃষ্টি—যেন কেউ জলের পর্দা নামিয়ে দিয়েছে আকাশ থেকে গাছের মগডাল পর্যন্ত। পাতাগুলো তখন গাঢ় সবুজ হয়ে নুয়ে পড়ল জলের ভারে৷ বৃষ্টির মাঝেই সূর্য ডুবল নিঃশব্দে। তার শেষ আলো ফোঁটা ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ল গাছের কাণ্ডে। জঙ্গলের মধ্যে তখন আলো-আঁধারির খেলা আর বৃষ্টির অচেনা এক সংগীত—যা ভয় আর মুগ্ধতা একসঙ্গে জাগায়।

জঙ্গলের পাশের রাস্তাটাই তখন শারফানের গাড়িটা দাঁড়িয়ে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে থেকেই ভীষণ চুপচাপ হয়ে বসে ছিল সে ড্রাইভিং সিটে। পাশের সিটটি Rémy Martin VSOP-এর কালো রঙা বোতলটির দখলে৷ ইতোমধ্যে তিন পেগের মতো পেটে চালান করা শেষ ওর৷ অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা গিয়েছিল বারে। তারপর চলে এল চরগাঁও।

বৃষ্টির পরোয়া না করেই সে বোতলটা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এগোল কাঁচা রাস্তার জংলা পথে। শ্যাওলা পড়া জলধারাটা বৃষ্টির পানিতে ভরে উঠেছে। এদিকে থেমে গেছে পাখিদের কলরব। শুধু একটা-দুটো পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে দূরে‚ আর খুব কাছে কোথাও একটা পাতা-ভাঙা শব্দ—হয়ত কোনো শেয়াল ওকে দেখে পালাচ্ছে ভেজা মাটির ওপর দিয়ে।

ঘরটার বারান্দায় পৌঁছেই শারফান ডেকে উঠল এক ঘননাদময় বিরাজ গলায়‚ “জাং?”

বৃষ্টির জন্য মৌসুমি জাংকে নিজের ঘরে জায়গা দিয়েছে৷ ওর কণ্ঠ শুনতেই জাং ভেতর থেকে উত্তর নিল অবিলম্বে। দরজাটা দ্রুত খুলল মৌসুমি৷ ফোনের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে এল ওরা। সৌজন্যপ্রদর্শনে শারফানকে জিজ্ঞেস করল‚ “কেমন আছেন‚ সার? আফনের আব্বা আর বুনের শরীল ভালা এখন?”

অদ্ভুতভাবে কোনো জবাবই দিল না শারফান। শুধু বলল‚ “তালা খোলো।” মেঘরবের মতো শোনাল কণ্ঠটা। মেঘের মতোই গম্ভীর কিন্তু মোহনীয়৷

মৌসুমি অবশ্য মুগ্ধ হলেও ওর মোহতে ডোবার সাহস পেল না। তাছাড়া ভাবগতিক আজ আগের দিনের চেয়েও খারাপ‚ তা বুঝতে পেরে সানার জন্য ভয় পেল। “কী যে আছে আইজ ছেমরিডার কফালে”‚ মনে মনে বলতে বলতে দরজাটা খুলে দিল সে।

“লাগিয়ে দাও”‚ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আদেশ করল শারফান।

জাংকে যেহেতু ডাকল না‚ তাই জাং দাঁড়িয়েই রইল বাইরে৷ মৌসুমি চুপচাপ বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিল।

ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে‚ গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সানা৷ টিনের চালে ঝমঝমিয়ে পড়া বৃষ্টির শব্দে টের পায়নি বাইরের কোনো শব্দ। একটু ঘুমঘুমও অবস্থা যদিও৷ ফোনের ফ্লাশলাইটটা জ্বালাল শারফান৷ ওর ওপর আলো ফেলে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ।

এতদিন পর আজ আবার পরিচয় আড়াল করা কয়েকটি আইডি আর পেইজ ভিডিয়োটি আপলোড করেছে। ক্যাপশন পড়ে ধারণা করা গেছে ফারনাজকে যারা অপছন্দ করে‚ তারাই। ভিডিয়োটি আসলে ফারনাজের পরিচিতির কারণেই বেশি আলোড়ন ফেলেছে। সেটা ফেসবুক থেকে সরাতে বিটিআরসির সহযোগিতা নিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না৷

এতটা লজ্জা‚ অসম্মান আর মানুষের ধিক্কার কি প্রাপ্য ছিল জারার? যে এখন প্রায় মরতেই বসেছে! আজ সারাটা দিনে শারফান একটা দানা মুখে তুলতে পারেনি‚ কোনো কাজে ঠিকভাবে মনোযোগ দিতে পারেনি।

ফারনাজ এখন জেল হেফাজতে৷ তাকে রিমান্ডে নেওয়ার কথা শোনা গেছে। তবে তা কতটুকু সত্য‚ এ নিয়ে সন্দিহান শারফান৷ এবং ও নিশ্চিত‚ ফারনাজের বিচারের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা হতে হতে এক থেকে দুই বছর লেগে যাবে—এর মাঝে জামিনও মঞ্জুর করে ফেলবে সে। তাহলে ফলাফল কী দাঁড়াল? আইনের কাছে যথাযথ শাস্তি অপরাধীরা কেউ-ই পাবে না। কেবল পেতে পারে শুধু ওর কাছে—যদি আজ সানা মুখ খোলে।

সানার ঘুমভাব ইতোমধ্যে উবে গেছে। আলোর বিপরীতে শারফানের বিধ্বস্তপ্রায় রূপটা দেখতে পেয়েই ঝট করে উঠে বসল সে। বুকের মধ্যে ভয়ের তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। কাছে কিনারায় জাংকে খুঁজল‚ তাকে পেল না দেখে একটু নিশ্চিন্ত হতে চাইল। কিন্তু তারপরই আঁতকে উঠল আরেক আশঙ্কায়—ধপ করে শারফান ওর কাছ ঘেঁষে বসেছে দেখে।

দেওয়ালে হেলান দিয়ে পা দুটো টানটান করে বসল শারফান। গ্লাসের পানি হঠাৎ উপুড় করে ফেলে দিয়ে তার মধ্যে ঢালল কনিয়াক। রংটা ছিল যেন সোনায় ছোঁয়া মেহগনি—ফোনের আলোয় তা ঝিকমিক করছিল নিঃশব্দ আগুনের মতো। “এটা দারুণ! খাবে‚ সানা?” ঠান্ডা কাচের গ্লাসটার গায়ে আঙুল বুলাতে বুলাতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল হঠাৎ।

কিন্তু বিভ্রান্ত আর শঙ্কিত সানার উত্তর না পেয়ে নিজেই গ্লাসটা তুলে নিল। নাকের কাছে ধরে গন্ধটা টেনে নিয়ে চোখ বুজল—যেন এমন সুস্বাদু ঘ্রাণ তাকে হারিয়ে দিচ্ছে কল্পনার ক্যানভাসে। তারপর ধীরে চুমুক দিল। সবটুকু শেষ করে গ্লাসটা নামিয়ে সানার দিকে ফিরে বলল‚ “এটা শুধু ফলের গন্ধ না—পাকা আঙুরের ঘন রসের ভেতরে কড়া কফির পোড়া ঘ্রাণ মেশানো, সঙ্গে ভ্যানিলার মোলায়েম একটা সুইটনেস। খেতে অসাম।” যেন কোনো বোদ্ধার মতো মূল্যায়ন করল সে।

এভাবে শারফানকে মদ খেতে দেখে সানার যে কী অবস্থা হলো! যতটা সম্ভব তার থেকে দূরে সরে এসে বসল দ্রুত। সেদিন কেবল জান হারানোর ভয় থাকলেও আজ সম্ভ্রম হারানোর আতঙ্কও খামচি দিয়ে ধরল ওর অন্তস্তলে। আর তা বুঝতে পেরে শারফান তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে ঠোঁটের কোণ বাঁকাল‚ “ট্রাস্ট মি… ইউ আর নট দ্যাট ইরিজিস্টিবল। আমার ঘেন্না করে তোমার দিকে তাকাতেও।”

তবুও সানার ভয় দূর হলো না৷ একটা পর্যায়ে ঘরটাই নিঝুম নীরবতা নেমে এল। শারফানকে কতক্ষণ চুপচাপ মদ খেতে দেখে সানা সাহস জুগিয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “জারার কী হয়েছে?”

“আহারে নাটক!” বোতলে চুমুক দেওয়ার এক ফাঁকে ফিসফিসিয়ে উঠল শারফান।

তা শুনতে পেল সানা। “আমাকে প্লিজ বলুন”‚ অনুরোধ আর অনুনয় করে বলল সে‚ “আমি ঠিক কীভাবে ক্ষতি করেছি ওর‚ জানতে চাই। তাতে যদি সত্যিই অপরাধী প্রমাণ হই—তবে নির্দ্বিধায় শাস্তি মেনে নেব।”

“তুমি জানো‚ আমি আজ কেন নিজেকে মাতাল করতে চাইছি?” এরই মধ্যে কথা জড়িয়ে যেতে শুরু করেছে শারফানের। নেশা চড়ে যাচ্ছে তার৷ প্রশ্নটা করার পর জবাব নিজেই দিল‚ “যাতে সেদিনের মতো বুকটাই টান না লাগে… ভেতরটা এলোমেলো না হয়ে পড়ে আমার। যেন কঠিন থেকেও কঠিন কষ্ট দিতে পারি তোমাকে—কোনো ইমোশন ছাড়াই।”

সানার কান্না উঠে এল গলায়‚ “আমি কবুল করব সব কষ্ট। যদি জারার কোনো বিরাট ক্ষতি হয়ে থাকে আমার দ্বারা৷ কিন্তু শাস্তি দেওয়ার আগে অপরাধীকে তার অপরাধটা জানাবেন না?”

কী যেন ছিল সানার আকুতিতে। আশ্চর্যভাবে শারফানের বুকেও কান্নার ঢেউ তুলল—একই সাথে ক্ষোভও। মেসেঞ্জার থেকে আজকে পাওয়া একটা লিংকে প্রবেশ করল সে৷ ভিডিয়োটা চালু হতেই তুলে ধরল সানার চোখের সামনে৷ বলল কাঁপা গলায়‚ “দেখো‚ কতটা সুন্দর করে ক্ষতি করেছ আমার ডিম্পলসের। যার খেসারত দিচ্ছে ও আইসিইউর বেডে শুয়ে… তোমার মতো এত অনায়াসেই আর শ্বাসটাও নিতে পারছে না… অক্সিজেন ছাড়া ও মৃত। এখন বলো তো‚ কতখানি স্যাটিসফাইড তুমি? আচ্ছা‚ নিজের প্রেমিকের সঙ্গে অন্য মেয়েকে এমন মুহূর্তে দেখে কী করে সহ্য করলে? কেমন প্রেম তোমাদের মধ্যে?”

চলবে।