#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৪৩.
রাত ৮: ২০ মিনিট।
পায়ের চারপাশে বাঁধা ব্যান্ডেজটা খুলে ধীরে ধীরে টি-টেবিলের ওপর পা’টা তুলে রাখল শারফান। টাখনুর ওপরে জায়গাটায় এখনো লালচে দগদগে—দুপুরের সেই পোড়া ক্ষত। ভেতরের জ্বালা কমার বদলে বেড়েই চলেছে।
দুপুরে সেই কেরোসিন ঢালা আগুনের পাত্রে ডান পা প্রায় ডুবিয়েই ফেলছিল সে। শেষ মুহূর্তে পা সরাতে গিয়ে পাত্রের কোণায় ঠোক্কর খায়—তাতেই সেটি উলটে পড়ে যায়। আগুন তখন প্যান্টের নিচে ঢুকে পড়েছিল‚ দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল ঠিক টাখনুর একটু ওপরে। ভাগ্যক্রমে বুটজোড়া ছিল শক্ত—তা না হলে ক্ষতটা হয়ত পায়ের মাংস পেরিয়েই পৌঁছে যেত হাড়ে। পানির বোতল কাছেই ছিল বলে পাভেল আর নাফিস দৌড়ে এসে যেভাবে পানি ঢেলে আগুন নিভিয়েছিল, সেটা মনে করে শারফান যেন এখনো হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ফোনের ওপাশে থাকা রায়হান তখন ওদের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনছিল। জ্বালায় মুখটাই তখন বীভৎস ভাঁজ পড়েছিল শারফানের। তাই বাধ্য হয়ে আর কথা না বাড়িয়ে কলটা কেটে দিয়েছিল সে।
রিহান ঘরে ঘুমাচ্ছে‚ আর সে বসে আছে লিভিংরুমের সোফায়—দুই অতিথির অপেক্ষায়। তবে মেজাজটা ওর বড্ড তেতো। প্রথমত, রায়হানের কাছ থেকে তখন পুরো কথাটা শোনা হয়নি। আগে থেকেই তো সানা দখল করে বসে ছিল ওর মন-মস্তিষ্ক। রায়হানের অসমাপ্ত কথাই এখন যেন মেয়েটা মাথায় চড়ে নাচছে।
দ্বিতীয়ত‚ সানার মাঝে বুঁদ হয়ে থাকা মনটাতেই চলছে আবার দিপুর বলা তথ্য। তার মুখ থেকে রাজনের ব্যাপারে জানার পর এখন রাজনের মতো লোককে ধরার কোনো স্পষ্ট উপায়ই মাথায় আসছে না ওর। সম্ভবত শেষমেশ বাবলুর সাহায্য নিতে হতে পারে, যেটা ও আদতে চাচ্ছিল না।
তৃতীয়ত, আজ রান্নার দায়িত্বে থাকা লোকটা ছুটিতে। অথচ অতিথিদের জন্য নাশতার ব্যবস্থা তো করতেই হবে। কফিমেশিনে কফি বানানো ছাড়া আর কিছুই করার মতো হাতযশ না আছে ওর‚ না রিহানের।
উঠে দাঁড়াল শারফান। যেটুকু সম্ভব, সেটুকুই না হয় বানিয়ে দেবে। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই কলিংবেলটা বেজে উঠল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করল—ওর অতিথিরা এসে গেছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই প্রথমে চোখে পড়ল জিসানের চিন্তিত মুখটা।
“কীরে, তুই তো দেখি দাঁড়াতে পারছিস!” অবাক গলায় বলল জিসান। রায়হানের কাছ থেকে খবর পেয়েই সে কল করেছিল শারফানকে। ফোনটা ধরেছিল রিহান‚ আর তার মুখ থেকে ঘটনাটা শুনে ভেবেছিল, শারফানের পায়ের অবস্থা অনেক ভয়াবহ।
“বিছানায় পড়ে যাওয়ার মতো কিছু হয়নি”‚ বলতে বলতেই রায়হানের দিকে তাকাল শারফান। আন্তরিক ভঙ্গিতে তাকে বলল, “ভেতরে আসুন‚ ভাই। কষ্ট করে আমার বাসায় আসতে হলো আপনাকে।”
“আরে, কোনো ব্যাপার না”‚ হালকা হাসল রায়হান‚ “ব্যথাটা যে আমার কারণেই, তাই এটুকু করতেই হত। আমার সঙ্গে কথা বলার সময়ই তো বেখেয়ালি হয়ে পড়েছিলে।”
“মোটেও নিজের ঘাড়ে দোষ নেবেন না”‚ যেন সাবধান করল শারফান।
ওরা ভেতরে এসে বসলে শারফান ওর মেঘনাদের মতো গলাটা ছেড়ে ডেকে উঠল রিহানকে। সেই কণ্ঠ ওপর তলায় পৌঁছে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকা রিহানকে অনায়াসেই জাগিয়ে তুলল। ততক্ষণে গল্পগুজব আরম্ভ করে দিল ওরা তিনজন।
সানার ব্যাপারে কথাগুলো সরাসরি শোনার জন্য এই পা নিয়েই শারফান আজ রাতের বেলা রায়হানের চেম্বারে গিয়ে হাজির হতে চেয়েছিল। জিসান তা রায়হানের থেকে জেনে ওকে মানা করে দিয়ে জানিয়েছিল‚ সে-ই রায়হানকে নিয়ে ওর বাসায় চলে আসবে। এজন্যই আসা রায়হানের।
ওদের কথাবার্তার মাঝে রিহান এসে উপস্থিত হলো৷ রায়হানের সঙ্গে আলাপচারিতা শেষ করে সে রান্নাঘরে গেল। কফি আর ফ্রিজে থাকা কিছু ফল এনে পরিবেশন করল অতিথিদের। তারপর বসল শারফানের পাশে৷ তখন জিসান তাকে বলল‚ “তোমার কথা শুনে তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম। আমি ভেবেছি ওর পুরো পা-ই পুড়ে গেছে। এসে দেখি বান্দা সটান দাঁড়ানো।”
“পুরো পা না পুড়লেও ঘা’র অবস্থা দেখেন। দেখে বলেন‚ আপনি হলে বিছানায় পড়ে থাকতেন না-কি ওর মতো ঘোড়া হয়ে দৌড়াদৌড়ি করতেন।”
প্যান্ট পরা বারণ বিধায় পরনে আজ শারফানের খয়েরী রঙা পছন্দসই বাটিক লুঙ্গি৷ খুব বেশি গরম না পড়লে তেমন একটা লুঙ্গি পরতে দেখা যায় না ওকে। রিহানের কথা শুনে জিসান নিজেই এগিয়ে এসে পায়ের কাছ থেকে লুঙ্গিটা উঁচু করল। শারফান কি চুপচাপ বসে থাকার মানুষ? বাধা দিতে চেষ্টা করল কবার‚ কিন্তু শুনল না জিসান ওর বাধা-নিষেধ। রায়হানও এগিয়ে এসে দেখল পায়ের অবস্থা—অনেকটা জায়গা জুড়ে পোড়া ক্ষত৷ সে জিজ্ঞেস করল‚ “এভাবে আলগা রেখেছ কেন? জীবাণু লেগে ইনফেকশন হয়ে যাবে না?”
“ছিল ব্যান্ডেজ৷ মাত্রই খুলেছি। ভেতরে চুলকাচ্ছিল খুব।”
“চুলকাক। ভুলেও হাত দেবে না ওখানে‚ আর এখনই ব্যান্ডেজ করতে হবে। লুঙ্গির ঘষা খেয়ে তো ব্যথা আরও লাগবে।”
রিহান তিরিক্ষি মেজাজে একবার শারফানকে দেখে নিয়ে চলে গেল শোবার ঘরে—ফাস্টএইড বক্সটা আনতে।
শারফান অবশ্য কারও কোনো কথা বা প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব দিল না৷ কফির মগ দুজনের হাতে তুলে দিয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসল৷ জিজ্ঞেস করল তারপর রায়হানকে‚ “সানার ব্যাপারে বাকি কথা কি এখন বলা যাবে‚ ভাই?”
হাসল রায়হান‚ “ব্যক্তিটা তুমি না হলে যাবে না বলতাম।”
কথাটা শুনে হেসে ফেলল জিসান। শারফান কোন পর্যায়ের মানুষ‚ এ ধারণা সে-ই দিয়েছিল রায়হানকে৷ তখনই সে প্রস্তুত ছিল শারফানকে তোয়াজ করে চলতে৷ শারফান অবশ্য কোনো ক্ষমতা জাহির করেনি তার কাছে৷ বরং সানাকে নিয়ে ওর চিন্তা‚ ওর উতলা ভাব দেখে রায়হান বুঝে গিয়েছিল‚ কেবল অপরাধবোধ থেকেই নয়—অধিকন্তু সানা মেয়েটি খুবই বিশেষ শারফানের জন্য। তাছাড়া জিসানের চাচাত ভাই হওয়ার ফলে তাকে বড়ো ভাইয়ের মতোই সম্মান প্রদর্শন করে কথা বলেছে সে‚ ভাই ডেকে এবং বিশ্বাস করে এমনভাবে নিজের অপরাধের ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা দিয়েছে তাকে‚ যেন মনে হচ্ছিল আপন বড়ো ভাইয়ের কাছেই সে নিজের ভুল আর অনুশোচনার স্বীকারোক্তি দিয়ে সমাধান চাইছে৷ শারফানের প্রতি ভীষণ মায়া হয় রায়হানের তখন থেকেই‚ ওর প্রতি আন্তরিকও হয়ে ওঠে খুব তাড়াতাড়িই।
কোনো উত্তর দিল না শারফান‚ রায়হানের কথাতে। চুপচাপ‚ গাম্ভীর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করতে থাকল সানার ব্যাপারে সমস্তটা জানার জন্য।
কথা শুরু করার পর আস্তে আস্তে রায়হানও গম্ভীর হয়ে উঠল৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলল‚ “শারফান‚ একটা কথা মনে রাখতে হবে তোমাকে‚ মানসিক আঘাত সব সময় চোখে দেখা যায় না। কিন্তু সেটা শরীরের ক্ষতের মতোই বাস্তব। সানা এখন পোস্ট-ট্রমাটিক স্টেট–এ রয়েছে সেটা তো বলেছিই। ওর মস্তিষ্ক এখনো হুমকির অনুভূতি থেকে পুরোপুরি বের হতে পারেনি। ওর সঙ্গে যা ঘটেছে—তা ওকে শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত করেছে। এটা শুধু ভয় না, এটা ট্রমা-ইনডিউস্ড গিল্ট‚ ট্রাস্ট রাপচার (trauma-induced guilt, trust rupture)‚ আর নিজের প্রতি সন্দেহের এক বিষাক্ত মিশ্রণ। ও মনে করে, ও হয়ত কোনোভাবে তোমার বোনের ক্ষতির জন্য সত্যিই দায়ী। যদিও ওর কোনো ইচ্ছা বা নিয়ন্ত্রণ ছিল না তোমার বোনের দুর্ঘটনাতে। সেই সঙ্গে ওর প্রতি তোমার প্রতিক্রিয়া—অত্যাচার‚ বঞ্চনা‚ ভয়—এই অনুভূতিগুলো মিশে গিয়ে ওর ভেতরে গভীর এক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে গভীর আঘাতটা এসেছে এই জায়গায়—সে তোমাকে মনের অজান্তেই বিশ্বাস করত‚ তোমাকে গুরুত্ব দিত। কিন্তু সেই মানুষটার থেকেই যখন কষ্ট পেয়েছে, তখন ওর ভেতরে দুটো সত্তা যুদ্ধ করছে। একটা চায় তোমাকে ঘৃণা করতে। আরেকটা তোমাকে আজও…” একটু থামার পর বলল‚ “মাফ করে দিতে চায়।”
শারফানের মনে হলো বুকের গভীরে কোথাও হিমালয়ের বরফ ধসে পড়ার মত শব্দ হচ্ছে যেন। নিজের অজান্তেই হাতটা উঠে এল বুকের বাঁ দিকে। কালো টি শার্টটার সেখানে খামচে ধরল সে। মনটা ওর কী যেন ফিসফিস করছে কানের কাছে। যতবার শুনছে ‘সানা ভালোবাসে তোমাকে’‚ ততবার কেমন এক ব্যথা অনুভব হচ্ছে বুকটাই৷ কত ব্যথায় তো আজ অবধি সয়েছে ওর দেহটা৷ কিন্তু এ ব্যথার সঙ্গে পরিচিত নয় সে।
পরিচয়ের শুরু থেকেই সানার প্রতি ওর না বোঝা‚ না জানা অন্যরকম টান—যাকে সে কখনো অল্পক্ষণের মোহ আর আবেশ ভাবত‚ কখনোবা ভাবত রাগ‚ প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ। এখন সেসব অনুভূতিগুলো স্রেফ ভুল প্রমাণিত হওয়ায় খুব করে সঠিক অনুভূতির হদিস চাচ্ছে ওর সেই মনটা। কেমন অস্থিরতা নিয়ে সোজা হয়ে বসল সে৷ ওর হাঁসফাঁস করাটা চোখে পড়ল সবারই৷ তারা কিছু বলার আগেই শারফান বিড়বিড় করে উঠল‚ “ও এখনো আমাকে মাফ করতে চায়?” প্রশ্নটা সে নিজেকেই করল মনে হলো।
আর ওর এ প্রশ্নটার ভেতরেই ছড়িয়ে ছিল অনুশোচনা আর বিস্ময়—তা টের পেল উপস্থিত সকলেই।
শারফান ভাবেনি সানার ভেতর এতটা কোমলতা বেঁচে থাকবে। ভাবেনি সেই মেয়েটাকে—যাকে দিনের পর দিন অন্ধভাবে শাস্তি দিয়েছে‚ সে-ই এখনো ওর জন্য কিছু অনুভব করতে পারে।
“তুমি ঠিক আছ‚ শারফান?” জিজ্ঞেস করল রায়হান।
“না”‚ চকিতেই উত্তর দিল শারফান৷ কেমন অশান্ত‚ অধৈর্যের সুরে বলল সে‚ “কীভাবে ঠিক থাকব আমি? বলুন‚ ভাই। ও আমাকে ঘেন্না করবে‚ আমার শাস্তি চাইবে‚ মৃত্যু চাইবে—আপনি যদি এগুলো শোনাতেন‚ তাহলে আমি ঠিক থাকতে পারতাম। কারণ‚ সেটাই হত এক্সপেকটেড রিয়্যাকশন। কিন্তু আপনি যেটা শোনাচ্ছেন সেটা আমাকে কীভাবে হিট করছে… না ঠিক হিট না… আমার যে কেমন লাগছে…” থেমে গেল সে। ভগ্নদশা স্পষ্ট হলো ওর মাঝে৷ মাথাটা সোফার গায়ে ধপ করে ফেলল আবার। “আমি বোঝাতে পারছি না আমার অবস্থাটা… আমি নিজেই যেন কোনো অন্ধকার কূপের ভেতর হারিয়ে আছি। কীভাবে বোঝাব তাহলে আপনাদের?”
রিহানের চেহারায় ফুটল তাচ্ছিল্যপূর্ণ অভিব্যক্তি। কিন্তু অবাক হচ্ছে জিসান। সেই ছাত্র জীবন থেকে সানার ঘটনার আগ পর্যন্ত তার চিরচেনা শারফানকে আজ লাগছে একদম অচেনা—যাকে লাগছে ভীষণ দুর্বল আত্মার‚ যে নিজ স্বার্থে কাউকে আঘাত করে এই প্রথমবার ভুগছে এতটা আত্মগ্লানিতে। অথচ এমন পরিণতি হওযার কথা তো ছিল না। বরং মেয়েটার সঙ্গে যা হয়েছে‚ তা একদম ঠিক হয়েছে—ওর মতো খেপা‚ রগচটা‚ প্রতিশোধপরায়ণ মানুষের এমনটাই তো ভাবার কথা। কারণ‚ মেয়েটা কোনো না কোনোভাবে তো জড়িত ছিলই জারার ক্ষতিতে৷ সন্দিগ্ধ চোখে ওকে দেখতে দেখতে ফট করে সে বলে উঠল‚ “শায়াফ‚ মেয়েটাকে ভালো টালো বাসতি না-কি?”
“ইস… আপনি বুঝে গেলেন‚ ভাই?” শারফানকে তিরস্কারপূর্ণ তির বিদ্ধ করে রিহান সহসাই বলে উঠল। “তবে বাসতি না—বলেন বাসিস। এই কথা আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি আরও বহু আগে৷ সে বোঝা তো দূর—আরও আমাকে গালাগাল করে নিজেকে বিশাল মাপের বুঝনেওয়ালা দেখিয়েছে‚ যে ওর ফিলিংস ওর চেয়ে ভালো কি আমি বুঝব? দুনিয়াতে ওর মতো এমন কোনো গাধা আছে বলেন‚ ভাই‚ যে নিজের ভালোবাসার অনুভূতি নিজে টের পাবে না? আমি ওকে সাবধান করেছিলাম‚ মেয়েটার সঙ্গে কোনো বাড়াবাড়ি না করতে। নয়ত পরে নিজেই পস্তাবি। কেবল আফসোস হচ্ছে যে‚ আমার কথা ঠিক হলো ঠিকই‚ কিন্তু প্রচণ্ড খারাপ সিচুয়েশন তৈরি হয়ে ঠিক হলো৷”
আহাম্মকের মতো চেহারা বানিয়ে জিসান তাকিয়ে দেখতে লাগল ওদের দুই ভাইকে৷ মাত্র অনুমানের ভিত্তিতে বলা মুখের কথাটা যে আসলেই সত্যি—তা সে বিশ্বাসই করতে পারছে না এখনো৷
আর শারফান—ওকে দেখাল এলোমেলো‚ টালমাটাল‚ কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত। এবার কেন যেন রিহানের কথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস হলো না ওর৷ দোলাচালে ভুগতে থাকা ওর মনটা এমন এক যন্ত্রণায় আছে‚ যে চাইছে কেউ ওকে এই অসহ্যরকম দ্বিধা থেকে বের করে আনুক৷ চেয়ে রইল রিহানের দিকে কেমন অসহায়‚ কাতর চাউনিতে৷ কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে ওকে দেখে কেউ হয়ত ভাববে‚ এ মুহূর্তে পোড়া ক্ষততে যে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে‚ সে কষ্টেই কাতরতায় ফুটে উঠেছে ওর চেহারাতে। অথচ সানার এই সত্যটা ওকে এমনভাবে গ্রাস করে নিয়েছে যে‚ ওর ক্ষত স্থানের স্নায়ু মস্তিষ্কে সিগনাল পাঠালেও তা ও অনুভবই করতে পারছে না।
“কীরে শায়াফ”‚ বিস্ময় কণ্ঠে বলল জিসান‚ “কী বলে রে ও? এর জন্যই তাহলে এই অবস্থা তোর?”
বোবার মতো কয়েক পল জিসানের দিকে চেয়ে থেকে শারফান ফিরল রায়হানের দিকে। অস্ফুটস্বরে কেবল বলল তাকে‚ “ওই মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে আমি সব সময় কেমন অস্থিরতায় ভুগেছি‚ অশান্তিতে থেকেছি। খুব খারাপ করতে চেয়েছিলাম ওর সঙ্গে—পারিনি‚ ভাই। বিবেকে‚ না-কি আমার মনুষ্যত্বে বাধা দিত‚ বলুন তো?”
রায়হান জবাব দেওয়ার আগেই রিহান বলে উঠল‚ “আপনি ওর সানার সঙ্গে করা সমস্ত কাজকর্মেরই একটা ব্যাখ্যা দিন‚ ভাইয়া। নয়ত আপনি ওকে এক বাক্যে বিশ্বাস করাতে পারবেন না‚ হি হ্যাজ ফিলিংস ফর সানা।”
“ঠিক আছে”‚ বলে শারফানকে জিজ্ঞেস করল রায়হান‚ “বলো তো‚ শারফান‚ সানাকে নিয়ে তোমার চিন্তাভাবনাগুলো?”
কিন্তু শারফান কোনো কথাই বলল না। মুখে যেন কুলুপ এঁটেছে সে৷ ওর একদম ভালো লাগছে না কথা বলতে৷ ভেতর থেকে লম্বা এক ক্লান্তি অনুভব করছে সে—যে ক্লান্তি দূর হবে কেবল একটিবার সানার মুখোমুখি হতে পারলে… ওকে দেখতে পেলে… ওর মুখ থেকে রায়হানের জানানো ‘ভালোবাসার’ স্বীকারোক্তিটা শুনতে পেলে।
ওর মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরে রিহান বলল রায়হানকে‚ “আমি যা যা জানি‚ সেটাই আপনাকে বলি…”
রায়হান চুপচাপ শুনতে লাগল রিহানের গল্পগুলো৷ জিসানও শুনে গেল আকাশ অবধি বিস্ময় নিয়ে। শারফানের কাণ্ডকারখানার কথা শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে তারা না হেসে পারল না৷ শোনা শেষ হলে জিসান উঠে এসে শারফানের পাশে বসল৷ ওর থাইয়ে শব্দ করে একটা চাপড় বসিয়ে বলল‚ “কত্ত বড়ো খাটাশ তুই‚ হ্যাঁ? তোর মতো একখান চিজ আর যেন কেউ পয়দা না করে। মেয়েটার জীবনটাকে একদম তামাক পাতার মতো বানিয়ে দিয়েছিস‚ খচ্চর!”
কোনো প্রতিক্রিয়ায় দেখাল না শারফান‚ যেন কোনো ধ্যানে নিমজ্জিত সে। ওর এই অচঞ্চল‚ অন্যমনস্ক অভিব্যক্তি দেখে রায়হান ডাকল ওকে‚ “শারফান?”
চোখ তুলে তার দিকে শারফান তাকালে মুচকি হাসল সে। বলল‚ “তুমি মানুষটা কেমন‚ তা কিন্তু আমি জানি। ভাগ্যিস তোমার ব্যাপারে জ্ঞান আমাকে আগেই দিয়েছিল জিসান। তাই এখন সহজেই ধরতে পারলাম তোমার ভাবনাগুলো ঠিক কেমন। তুমি প্রেমকে দুর্বলতা আর নারীদের প্রতি টানকে সময়ের অপচয় বলে ভাবতে‚ রাইট?”
শারফান এবারেও নিশ্চুপ৷ তবে ওর নীরবতাতেই সম্মতি—তা বুঝল সবাই-ই। রায়হান জিজ্ঞেস করল তারপর‚ “ভাবতে‚ নারীর প্রতি টান পুরুষের লক্ষ্য থেকে তাকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু নিজেকে কখনো জিজ্ঞেস করেছ‚ এই ধারণাটা আদৌ সত্যি কি-না?”
“আমার কাছে বাস্তব মানে ছিল কেবল লাভ-ক্ষতির হিসাব”‚ নির্বিকার স্বরে উত্তরটা দিল শারফান।
তারপর হঠাৎ উদাসী কণ্ঠে স্বগতোক্তির মত বলতে আরম্ভ করল‚ “ওর কণ্ঠটা প্রথম শুনেই কোথায় যেন আটকে গিয়েছিলাম আমি। কিছু ছিল তাতে—যা বোঝানো যায় না‚ ছুঁয়ে দেখা যায় না… কিন্তু অনুভবে আসে। আর ওর সরলতা? প্রথমে মনে হত‚ কী বিরক্তিকর একটা জিনিস! এত ন্যাকা ও! কিন্তু সেই সরলতায় একসময় আমাকে আগ্রহী করল ওর প্রতি… মে বি আই গট অ্যাট্রাক্টেড। ওকে হঠাৎ সুন্দর লাগতেও শুরু করল আমার কাছে। ওর সেই কণ্ঠটা‚ সেই সহজপনা—যেটাকে সহ্য করতে পারতাম না শুরুতে‚ পরবর্তীতে সেটাই আমার পছন্দ হয়ে গেল। আমি এখন সব বুঝতে পারছি—আমি যত ঠেলেছি‚ ও ততই প্রবেশ করেছে আমার মনে। আমার জীবনের সেই ফাঁকা জায়গায়—যেটা আমি কখনো খালি ভাবিনি।”
“এটা ঠিক যে তুমি পরিকল্পনা করে প্রেমে পড়োনি”‚ রায়হান বলল”‚ “বরং তুমি এমন এক অনুভূতির শিকার হয়েছ‚ যেটা তোমার প্রথাগত আত্ম-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এই বিরোধই তোমার আচরণে ছায়া ফেলেছে। কারণ‚ তোমাকে ওর প্রতি দুর্বল হতে দেখা তোমার পক্ষে সহজ ছিল না। তাই নিজের ভেতরের অস্থিরতা ঢাকতে গিয়ে তুমি ওর ওপর সব সময় নিয়ন্ত্রণ রাখতে চেয়েছ—ভেবেছিলে‚ ওকে ধরে রাখার এটাই একমাত্র উপায়।”
নিজেকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করল শারফান। নিঃশব্দে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল‚ “আমি কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিলাম ওর ওপর, আবার আমিই থামিয়েছিলাম—এটা কি আমার স্রেফ পাগলামি? না-কি আমি নিজেও জানতাম না‚ আমি ওকে আঘাত দিতে চাই না-কি বাঁচিয়ে রাখতে চাই?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে রায়হান জবাব দিল‚ “না‚ এটা পাগলামি নয়। এটা সেই সংকেত—যেটাকে আমরা বলি অ্যাম্বিভেলেন্ট ইমপাল্স (ambivalent impulse)। তুমি তখন ওকে আঘাত দিতে চেয়েছিলে। কারণ‚ তোমার মনে হচ্ছিল সে তোমার বোনের ক্ষতির কারণ। তোমার প্রতিশোধ ছিল বিচারহীন। কেবল আবেগ থেকে উঠে আসা। কিন্তু তুমি শেষ মুহূর্তে নিজেই কুকুরটাকে থামিয়ে দিয়েছিলে—এটাই আসল সত্য। কারণ‚ ভেতরে ভেতরে তুমি জানতে‚ ওর প্রতি তোমার রাগ যতটা তীব্র‚ তার নিচে লুকানো আছে একরকম আকর্ষণ‚ একরকম বিশ্বাস… যেটা তুমি নিজেও বোঝোনি তখন। তুমি চেয়েছিলে ওকে শাস্তি দিতে। আবার ঠিক সেই সময়েই ওর নিরাপত্তার দায়িত্বও নিতে চেয়েছিলে। এই যে দ্বন্দ্ব—মানে আঘাতের ইচ্ছা আর সুরক্ষার তাড়না‚ এই দুই বিপরীত অনুভূতি একসঙ্গেই তোমার ভেতরে কাজ করছিল। এটা দুর্বলতা নয়। বরং এটা প্রমাণ করে‚ তোমার আবেগ ছিল গভীর‚ শুধু তার প্রকাশটা ছিল অসম্ভবভাবে বিপথে চালিত।”
“আমি ওকে সত্যিই তবে ভালোবাসি?” ফিসফিসিয়ে শারফান জিজ্ঞেস করল যেন নিজেকেই।
একটু ঝুঁকে এল রায়হান‚ “তুমি ভালোবাসো‚ কিন্তু সেটা প্রকাশের যে ভাষা বা উপায় অন্যরা বোঝে—সেভাবে নয়। তোমার ভালোবাসা ছিল একদম ভেতর থেকে আসা—কিন্তু কাচা আর অপরিচিত। যেন শুকিয়ে থাকা একটা মরুভূমিতে হঠাৎ প্রথমবার বৃষ্টি নামে—ভূমিটা কাঁপে‚ গন্ধ বের হয়‚ কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না ঠিক কী হচ্ছে। তোমার ভালোবাসাও ছিল ঠিক তেমন। একটা অচেনা অনুভব—যেটা তুমি বুঝতে পারোনি‚ নিয়ন্ত্রণও করতে পারোনি।”
আরও কিছু বলে থামল রায়হান৷ চুপটি করে সেসব শুনল শারফান।
রায়হানের কথাগুলো শুনতে শুনতে শারফানের প্রতি রিহানের রাগ হঠাৎই ঝরে গেল। সেও বুঝতে পারল‚ চালাকচতুর ছেলেটা ভালোবাসার কাছে কতটা হেরেছে! কিন্তু তা সহজেই বুঝতে পারার মতো ক্ষমতা ওকে দেননি সৃষ্টিকর্তা। যার পরিণতি আজ জঘন্যভাবে ভোগ করতে হচ্ছে ওকেও‚ আর সানাকেও৷ মায়া হলো রিহানের ওদের দুজনের জন্যই৷
এমন মুহূর্তে আসলে কার কী বলা উচিত‚ তা জিসানও বুঝল না‚ রিহানও না। সান্ত্বনা ছাড়া কিছুই খুঁজে পেল না জিসান। সেটাই বলতে মুখটা সবে খুলল‚ শারফান আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল তখনই। “আই ডিপলি অ্যাপোলোজাইজ”‚ বলে উঠল‚ “আমি একটু আসছি ঘর থেকে৷ তোরা ততক্ষণে আড্ডা জমা।”
রিহান ভ্রু কুঁচকে কিছু বলতে গেলে রায়হান ইশারায় বারণ করল৷ শারফান আর দাঁড়াল না৷ পায়ের ব্যথা ভুলে বড়ো বড়ো কদম ফেলে সে চলে গেল ওপরে।
“ও এখন আমার কথাগুলো ভাববে‚ সানাকে নিয়ে ভাববে”‚ বলল রায়হান‚ “একা থাকতে চাইবে তাই৷ থাকতে দেওয়া উচিত এ মুহূর্তে।”
ঘরে ফিরে লাইট জ্বালাল না শারফান। বারান্দার দরজা খুলে দিল নিঃশব্দে। সোফার পাশের টেবিল থেকে একটা সিগারেট তুলে নিল সে। কিন্তু ধরাল না। হাতের ভাঁজে কেবল ঘোরাতে লাগল—যেন ঠিক কী করা উচিত‚ বুঝতে পারছে না। রায়হানের শেষ কথাগুলো এখনো কানে বাজছে‚ “তুমি প্রেমে পড়োনি‚ তুমি ধাক্কা খেয়েছিলে। এটা ছিল না কোনো পরিকল্পিত বা বোঝা ভালোবাসা। বরং যেন হঠাৎ কোনো অচেনা আলো এসে তোমার ভেতরে প্রবেশ করেছিল—তোমার আগের জানা জগৎটাকে এক মুহূর্তে বদলে দিয়েছিল। তুমি বুঝে উঠতে পারোনি সেটা প্রেম‚ না নিজের ভেতর থেকে কিছু ভেঙে পড়ার শুরু। সে আলো তোমাকে কাবু করেছিল। কারণ‚ তুমি সেই অনুভূতির জন্য প্রস্তুত ছিলে না। এটাই তো হয়… যখন কেউ না চাইতেই তোমার মনটা ছুঁয়ে ফেলে‚ তখন সে তোমাকে বদলে দেয়‚ তোমার ভেতরটা এলোমেলো করে দেয়।”
মাথাটা সোফার গায়ে এলিয়ে চোখটা বন্ধ করে নিল শারফান। সানার মুখটা মনে করার চেষ্টা করল—সেই মুখ‚ টলমল চোখে চেয়ে যে নীরবে সহ্য করে গিয়েছিল ওর সমস্ত অন্যায় নির্যাতন।
আচ্ছা‚ ও কি চেয়েছিল একটা ক্ষত হয়ে সানার চোখে নিজের উপস্থিতিটা রেখে যেতে‚ যে ক্ষত কোনোদিন শুকায় না? না কি চেয়েছিল‚ ওর প্রতি রাগ আর অভিমান যেন সানার চোখে চিরদিন গেঁথে থাকে কাঁটার মতো? যাতে সে কখনোই ওকে ভুলতে না পারে? নয়ত কেন এমন নিকৃষ্ট পন্থা বেছে নিয়েছিল তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য?
প্রলম্বিত শ্বাসটা ফেলে সোজা হয়ে বসল শারফান। সিগারেটটা টেবিলে রেখে দিয়ে তুলে নিল ট্যাব। তারপর হঠাৎ নোটবুকে প্রবেশ করল। যেখানে একসময় ব্যবসায়িক নানানরকম পরিকল্পনা সাজাত, ডিলসের খসড়া বানাত। আজ সেখানে প্রথমবার নিজের নামের নিচে লিখল‚ “সানা…”
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৪৩. (শেষ অংশ)
“সানা… সানা ফারহিন—এক অদ্ভুত অনুভব আমার জীবনে। একটা উপস্থিতি—এমন এক উপস্থিতি‚ যাকে ছুঁয়ে দেখা যায় না‚ অথচ কাঁপিয়ে দেয় আমার ভেতরটা। নিজের অজান্তে যে নাড়িয়ে দিয়েছে আমার দুনিয়াকে… আমার শান্তিকে। বদলে আমি করেছি রক্তাক্ত তার দেহকে‚ তার মনকে। তাও সে আমায় ক্ষমা করতে চায়! কিন্তু সে জানে না না-কি বোঝে না‚ আমি যা করেছি তা ক্ষমাপ্রাপ্য অপরাধ নয়?”
শারফানের আঙুলটা কয়েক মুহূর্তের জন্য থামল এরপর। এক লাইন ফাঁকা রেখে লিখল আবার‚ “Hey Sana‚ did you love me so deeply‚ যে এখনো ঘৃণা তোমার মনটাকে পুরো দখলে নিতে পারছে না? But you must grant me only your hate—no mercy, no love to spare. নয়ত শাস্তিটা আমি কঠিন করে নিতে পারব না যে! অথবা তোমার জন্য হয়ত আবারও হয়ে উঠব অভিশপ্ত—কেবল ভিন্ন কোনো ভাবে।”
কতক মুহূর্ত লেখাগুলোতে স্থিরভাবে চেয়ে থেকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল সে। বুকে চাপা প্রবল অস্থিরতা আর গভীর মনস্তাপ—কী করলে এ থেকে পরিত্রাণ পাবে‚ তা ভাবতে ভাবতে পায়চারি আরম্ভ করল ঘর জুড়ে। ছটফটিয়ে ওঠা মন-মস্তিষ্কের অজান্তেই সানার নম্বরটা স্ক্রিনে তুলে কল করে বসল সে‚ কিন্তু বন্ধ৷ তারপরই মনে পড়ল‚ ওকে তুলে নিয়ে আসার পর সিমসমেত ফোনটা সে-ই নষ্ট করে ফেলেছিল৷ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ট্যাবটা সোফাতে ছুড়ে রাখল। তখনই নিচতলা থেকে ডাক এল রিহানের৷
দুজন অতিথিকে বসিয়ে রেখেছে সে‚ তা খেয়াল হতে নিচে নেমে এল দ্রুত। সরাসরি রায়হানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে চঞ্চল গলায় বলল‚ “আমাকে নিয়ে হওয়া সানার মানসিক যে দ্বন্দ‚ তা থেকে কি ওকে কোনোভাবে মুক্তি দিতে পারি আমি? আমি জানি‚ ওর ওপর আমার করা নির্যাতনগুলো ভয়াবহ ছিল। কিন্তু আমি এখন একটা জিনিস বুঝতে চাই‚ আমার পক্ষে কি সম্ভব ওকে সুস্থ হয়ে উঠতে হেল্প করা? ও কখনোই জানবে না‚ ও কীভাবে আমার ভেতরে ঠাঁই করে নিয়েছিল—আমি চাইনি‚ তবু হয়েছিল। এখন ও যে তীব্র দ্বন্দে‚ আমায় ঘৃণা করবে‚ না আমাকে ক্ষমা করবে… এই বোঝা‚ এই অস্থিরতা অন্তত একটু হলেও যেন হালকা হয় ওর জন্য—এমন কিছু কি করতে পারি না আমি?”
“শারফান”‚ শান্ত গলায় ডেকে রায়হান বলল‚ “তুমি ওর জায়গায় দাঁড়িয়ে ওর কষ্ট মুছে দিতে পারবে না‚ ভাই। এমনকি ওর হয়ে কোনো সিদ্ধান্তও নিতে পারবে না। সেটা ওর ভেতরের যুদ্ধ—একান্তই ওর। কিন্তু তুমি ওর পাশে দাঁড়াতে পারো এমন একজন মানুষ হয়ে‚ যে নিজের ভুল স্বীকার করে কিছু পাওয়ার আশায় নয়। যে সত্যিই পাশে থাকতে চায়‚ সে কিছু দাবি করে না। সে শুধু নিঃশব্দে পাশে থাকে। এতটা সময়‚ যতক্ষণ না কেউ নিজেই অনুভব করে‚ সে পাশে ছিল সবসময়। এটাই সহানুভূতি। এটাই আসল সাপোর্ট‚ শারফান। ভালোবাসা কখনো চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তবে পাশে থাকাটাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে গভীর ভাষা।”
“আমি তবে সত্যি ওর সামনে দাঁড়াতে পারব?” ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল শারফান‚ “কিছু বলতে পারব?”
“হ্যাঁ‚ অবশ্যই”‚ রায়হান হাসল শারফানের ভেতরের অস্থিরতা টের পেয়ে। “তুমি ওর সামনে দাঁড়াতে পারো‚ ওর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে পারো। কিন্তু শর্ত হলো—তোমাকে নিজের দায় মেনে নিয়ে দাঁড়াতে হবে। ক্ষমা চেয়ে কিছু পাবে এই আশায় নয়‚ বা ওর মন গলবে এই ভরসাতেও নয়। তুমি দাঁড়াবে শুধু এ কথা জানানোর জন্য‚ ‘আমি ভুল করেছি‚ আমি অনুতপ্ত। তুমি আমাকে যা ভাবো‚ সেটাই মেনে নেব।’ সানা যেন বোঝে‚ তুমি পালাচ্ছ না‚ লুকাচ্ছ না। নিজের কৃতকর্মের দায়িত্ব নিচ্ছ। কিন্তু লক্ষ রাখবে‚ তোমার কথা ওর মনের জন্য যেন চাপ না হয়। ও যদি একদিন তোমাকে ক্ষমা করে‚ তা ওর নিজের পথ থেকে আসবে। আর যদি না-ও করে‚ সেটাও ওর অধিকার।”
চুপচাপ কথাগুলো শুনতে শুনতে শারফান টের পেল‚ আর এক মুহূর্ত পারবে না সে সানাকে না দেখে থাকতে।
***
৩০ মার্চ
মালিবাগ‚ চৌধুরীপাড়া
ঘড়ির কাঁটা রাত দুটো ছুঁয়েছে। আকাশজুড়ে অন্ধকারের ভার‚ শহর জুড়ে বৃষ্টির রেশ। বাতাসে যেন অদ্ভুত এক অস্থিরতা—অট্টালিকার গায়ে গায়ে ছড়িয়ে পড়ছে ভারী বৃষ্টির শব্দ। যেন আকাশ তার ভেতরকার ভারি কান্না নামিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর গায়ে। আর এমন বৃষ্টিস্নাত গভীর রাতে নিশাচর এক পুরুষ নির্জন গলিটাতে বসে আছে এক কালো বিএমডব্লিউ সেভেন সিরিজের এক্সিকিউটিভ সেডানে। হেডলাইট নিভিয়ে রাখা‚ কিন্তু ভেতরে আলো জ্বলছে ক্ষীণ। ভেজা কাচের বাইরে রাস্তার বাতিগুলো একেকটা ছায়া তৈরি করেছে। গাছের পাতায় ঝরে পড়ছে জমে থাকা পানি।
স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে অনড় দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে শারফান। জানালার কাচে জমা জলের রেখা সরিয়ে সে চেয়ে আছে দোতলার ব্যালকনিতে। ঠিক জানা নেই ওর‚ ওখানে সানার উপস্থিতি পাওয়া যাবে কি-না। গত তিন দিনের মতোই আজও ছুটে এসেছে সে—কোনো জবাব খুঁজতে নয়‚ বরং শুধুই একবার দেখতে… তাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে প্রতিবারই ফিরে গেছে—আজও নিঃসঙ্গভাবে করছে সেই একই অপেক্ষা। না‚ ঠিক পুরোপুরি নিঃসঙ্গ বলা চলে না। সঙ্গ দিচ্ছে ওর প্রিয় শিল্পী তাহসানের গলায় একের পর এক গান—
“পেছনে ফিরে দেখো তুমি,
অপ্রত্যাশিত কোন অতিথি
চোখ ফেরালে বলো কেন,
ভয় পেয়েছ কি, নাকি আরতি?
জানি প্রতিটা স্বপ্নে তুমি দেখেছ আমায়
নিরন্তর ছিলে আমারই ছায়ায়
তবে চোখ মেলাতে কি বিরোধ?
ভুল করে একটাবার প্রাচীরটা ভেঙ্গে দেখো
জমে আছে কত কথা ভুল করে বলে দিয়ো
জন্মান্তর যদি মিথ্যে হয়, এই হবে শেষ দেখা
ভালোবাসি কেন যে তোমায়,
হবে না আর কখনো বোঝা।”
ঠিক এর মাঝে দোতলার ব্যালকনির সাদা গ্রিলের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল একটি ছায়া। সানা!
আজও ঘুম এল না তার কিছুতেই। বুকের ভেতরটা এত ভারী লাগছিল যে‚ যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার প্রতি নিঃশ্বাসে। রাত নামলেই ভেতরটা খুব বেশিই এলোমেলো হয়ে পড়ে। কেমন আর্তনাদ করে ওঠে তখন আত্মাটা। কোনো কিছু বুঝিয়েই তাকে শান্ত করতে পারে না সে। যেন আগুনের শিখায় প্রতিনিয়ত পুড়ে পুড়ে কাঁদে। বৃষ্টির ঝাপটায় গা ছুঁইয়ে সেই কান্না একটু ঠান্ডা করতে চাইল সে। নির্ঘুম চোখ দুটো ক্লান্ত‚ মুখটা অবসন্ন।
লোহার গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়াল সানা। গলিটাকে কতখানি ভেজাতে পারল বৃষ্টি‚ তাই দেখতে দেখতে হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল নিচে—কালো গাড়িটার ওপরে। কয়েক পল…তারপর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল একটা মুখ—শারফান। ক্ষীণ আলোয় বসে থাকা সে‚ ভেজা কাঁচে ঢাকা ওর অবয়ব‚ তবু ওর চোখদুটো এত স্পষ্ট! যেন কেবল তাকিয়েই থাকতে চায়… কিছু বলার নেই।
প্রথমে মনে হলো বুঝি স্বপ্ন দেখছে সে। কিন্তু হৃদয়ের গতি বদলে গেল তার সঙ্গে সঙ্গে। নিজের কানে যেন শুনতে পেল সে নিজের বুকের ‘ধুপ ধুপ’ শব্দটা। সানা কাঁপল না‚ প্রতিবারের মতো দৌড়ে পালালও না। শুধু তাকিয়ে রইল। কতটা সময় পেরোল কে জানে! হয়ত ঠিক তখনই হৃদয়ের এক কিনারে জমে থাকা শূন্যতা শব্দহীন হাওয়ার মতো সরে গেল।
অবিশ্রান্ত বৃষ্টিধারা শব্দ তুলছে জমিনে। অথচ দুজনের মাঝখানে একখণ্ড নীরবতা। তবুও যেন বহু শব্দ ছুটে আসছে একে অপরের দিকে। যা অব্যক্ত কথা।
চোখ নামাল না শারফান। মনটা এবার কানে কানে বলল যেন‚ “যদি এমন করেই চেয়ে থাকে ও—তাহলে এখনো কিছু বাকি আছে‚ শায়াফ। ক্ষমা নয়‚ হয়ত ভালোবাসাও নয়। হয়ত কিছু বোঝাপড়া।”
শারফানের চোখে এখন নেই প্রতিশোধ‚ নেই তীব্র ক্ষোভ। সেখানে কেবলই অনুশোচনা‚ আর দুর্বার আকাঙ্ক্ষা। “আর একবার… কেবল আর একবার যদি কাছে পেতাম”‚ অনিমেষ চেয়ে ফিসফিস করে উঠল সে আচমকা‚ “না‚ ছুঁতাম না। শুধু ওর অস্তিত্বটা নিঃশ্বাসে টেনে নিতাম।”
সেদিনের মতোই আজও মুখটা অভিব্যক্তিশূন্য সানার‚ যেন এক জীবন্ত মূর্তি কেবল দাঁড়িয়ে। কিন্তু ভেতরটাই যে হাহাকার বয়ে চলেছে তার‚ তা কেউ টেরটাও পাবে না দেখে। নিঃশব্দে চেয়ে রইল শারফানের চোখে৷ এই পুরুষটিকে সে সেদিনও ভয় পেত‚ তার কাছে নিজের মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল বলেও ভাবত৷ একটু কাছে এলেই তাই আতঙ্কিত হয়ে পালাতে চাইত। অথচ সেদিনগুলোর আগে ওর কণ্ঠটা শুনলে‚ ওর অস্তিত্ব অনুভব করলে অবচেতন মনটা তার অজানা এক অনুভূতির জোয়ারে ভাসত। ওর দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি তাকে বিষণ্ণ করে তুলত… তখন মনে পড়ত ফোনের ওপাশে থেকেই কেমন অনাধিকার চর্চা করে অধিকার ফলাত মানুষটা তার ওপর—সারাটা রাত কথা বলে যেত আর তাকে বলিয়েও ছাড়ত জোর খাটিয়ে। এই যে তার অনুভবগুলো—এ নাকি তার এক আত্মিক টান মানুষটার প্রতি। যা হয়ত এক শব্দে ‘ভালোবাসা’। কথাটা ভাবতেই সানার চোখের সামনে সিনেমার দৃশ্যপট বদলানোর মতো একেক করে ভাসতে থাকল শারফানের নির্মম রূপগুলো—যা ছিল শুরুতে ওর কাছে ভীষণ অবিশ্বাস্য৷
“আপনি জানেন না‚ শায়াফ‚ আমি প্রতিদিন ঘুমানোর আগে নিজেকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করি—আপনি এক দুঃস্বপ্ন ছিলেন শুধু”‚ ঠোঁটটা কামড়ে কান্না বাধা দিতে চাইল তারপর। সফল হতেই আবার বিড়বিড়াল‚ “কিন্তু আজ আপনাকে দেখে আমার সেই চেষ্টাটুকু আর টিকবে না। কেন যে এলেন! কী-ই বা দেখতে এলেন?”
তবু ঝাপসা চোখে শারফানকে দেখতে থাকল সানা ৷ নীরবে গাল বেয়ে একটা টানা জলরেখা নেমে গেল তার। সে জানে না‚ সে কাঁদছে কেন। ঘৃণায়? না-কি অপূর্ণ ভালোবাসা? নয়ত মিশ্র এক বেদনায়‚ যেটা ভাষায় ধরা যায় না। ভেজা কাচের ওপার থেকে ওর মুখটা স্পষ্ট দেখা যায় না বলে ভাবনায় প্রশ্ন রাখল শারফানের কাছে‚ “আপনার চোখের দৃষ্টি কি এখনো নির্মম আমার জন্য?”
ঠিক সে মুহূর্তেই গাড়ির দরজাটা খুলে নেমে দাঁড়াল শারফান৷ চোখটা তখন সরিয়ে নিল সানা। কিন্তু শারফান পাগলের মতো হয়ে চেয়েই থাকল। মাথার ওপর কোনো ছাতা নেই। বাঁকা হয়ে আসা বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে একাকার হয়ে উঠল সারা শরীর। সাদা সুতি কাপড়ের পাতলা শার্টটা ভিজে শরীরের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠল ওর। কয়েক পা এগিয়ে গেল ব্যালকনির কাছে—সানাকে খু্ব কাছ থেকে দেখার জন্য। বোকার মতো তারপর হাতটা বাড়াল ওপর দিকে‚ যেন ছুঁয়ে ফেলতে পারবে আলো-আঁধারিতে দেখতে পাওয়া সরল‚ বিষণ্ণ সুন্দর মুখখানি।
সানাকে দেখে ভেতরে ওর জ্বলছে এক আগুন‚ যা শুধু অনুশোচনার নয়। তা ভালোবাসা পূর্ণতা না পাওয়ার যন্ত্রণা। সেই অপ্রতিরোধ্য ভালোবাসা‚ যেটা কখনো প্রকাশই পায়নি‚ আর হয়ত পাবেও না।
“সানা”‚ অদমনীয় আবেগে অস্ফুটে ডেকে উঠল শারফান।
ঠোঁটদুটোর নড়ে ওঠা দেখতে পেল সানা স্পষ্ট। নিজের নামটা উচ্চারিত হয়েছে সেখানে—তাও বুঝল সে৷ কিন্তু প্রতিক্রিয়া জানানোর পূর্বেই শারফান বিস্ময়কর এক কাণ্ড ঘটাল৷ রাস্তা থেকে ইটের ছোটো এক টুকরো কুড়িয়ে নিল‚ তারপরই পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দ্রুত সেটা টুকরোটাই মুড়িয়ে দিয়ে ছুড়ে মারল গ্রিলের ফাঁকে৷
ঘরের দরজায় গিয়ে পড়ল টুকরোটা। সেদিকে একবার বিস্মিত চোখে চেয়ে সানা আরেকবার চাইল শারফানের দিকে—এমন একটা কাজ করেও যে নির্ভার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে চেয়েই।
টুকরোটা তুলল সানা৷ ল্যাম্পোস্টের সরু আলোটা ব্যালকনির যেদিকে এসে পড়েছে‚ সেদিকে এগিয়ে কাগজটা মেলল সে। ছোটো-ছোটো অক্ষরে পরিচ্ছন্ন লেখায় কটা লাইন—
“তোমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলার মতো সুযোগ বানিয়ে নিতে পারলেও এই চিঠির সাহায্যই নিলাম। কারণ‚ তুমি আর কোনোদিনও হয়ত আমার মুখোমুখি হতে চাইবে না। শোনো সানা‚ কথাগুলো খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় তোমার জন্য৷ চাইলে তাই একদম শেষ লাইনটা দেখতে পারো শুধু।”
সানা‚
আমার মন আমার কাছে একটা অচেনা ভূখণ্ডের মতো ছিল৷ যেখানে তুমি পা রেখেছিলে নিঃশব্দে‚ নিঃস্বার্থে। তারপরই বদলে দিয়েছিলে আমার ভূখণ্ডের প্রকৃতিকে। অথচ আমি বুঝিনি তখন। তোমার কণ্ঠ শুনে প্রথমবার থেমেছিলাম আমি। হয়ত সেদিনই আমার অনুভবে কিছু একটা ঘটে গিয়েছিল৷ তারপর আমি যা করেছি‚ তা মাফযোগ্য না—আমি জানি। আমি চাইনি তোমাকে এতটা ভাঙতে‚ তবু ভেঙেছি… অসহ্য কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু তুমি চুপ ছিলে। তোমার সরলতা‚ তোমার চুপচাপ সহ্য করে যাওয়া—সবকিছু এখন আমার বুকের ভার। তুমি যদি কোনোদিন কিছু রাখতে চাও আমার জন্য—তবে কেবল ঘৃণায় রেখো। অন্য কিছু নয়। তোমার ঘৃণা আমি মেনে নেব‚ কিন্তু তোমার কষ্টটুকু আর বাড়াব না। আমি শুধু চাই তুমি সুস্থ হও।
আর তুমি চেয়েছিলে‚ আমার অন্যায়ের বিচার যেন আমিই করি। আমিই করব‚ সানা৷ আমি একদম যোগ্য বিচারক হব—দেখে নিয়ো। খুব বেশিদিন তোমাকে অপেক্ষা করাব না‚ তা দেখার জন্য৷
– শারফান শায়াফ
চিঠি সম্পূর্ণটুকুই পড়ল সানা। তারপর চঞ্চল চোখে নিচে চাইতেই শারফান হঠাৎ বুকের বাঁ পাশে হাতটা চেপে ধরে মাথাটা একবার নুয়াল। যেন সে সানার আজ্ঞাবহ কোনো সেনা‚ আর সানা এক রাজকুমারী। তাকে বোঝাল‚ নিজের দেওয়া এই কথা সে অবশ্যই রাখবে৷
চলবে।