#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৪৪.
৪ এপ্রিল
দুপুর ১: ০৫ মিনিট ।
ল্যাপটপের কি-বোর্ডে ঝরের বেগে আঙুল চালিয়ে কিসের কাজ যেন প্রস্তুত করছে শারফান৷ টেবিলের এপাশে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে তা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছে শাফিউল সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী এহসান খন্দকার। বয়স পঁয়ত্রিশ‚ কিন্তু দেখতে লাগে পয়তাল্লিশ। লাল টকটকে ফরসা‚ লম্বা-চওড়া শরীরটা স্থূল‚ সারা মাথায় কেবল চাঁদিতে টাক—অনেকটা শাফিউল সাহেবের টাকের মতোই‚ আর ক্লিন শেভ মুখে শুধু একটা মোটা গোঁফ। তবে ভুঁড়িটা তেমন উঁচু না। এর প্রধান কারণ সম্ভবত তার সারাদিনের দৌড়াদৌড়ি। সে শাফিউল সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী হলেও তাকে অধিকাংশ সময় দৌড়ের ওপর রাখে শারফান। সেজন্য লোকটি অনেকবার অনুরোধ করেছিল শাফিউল সাহেবকে‚ যেন শারফানের জন্য একজন সহকারী নিয়োগ দেন তিনি৷
কিন্তু শারফান তাতে রাজি হয়নি কখনো। বরঞ্চ এহসানকেই সে দাবি করে বসে বাপের কাছে। ছেলের দাবি বাপ মানতে চাইলেও এহসান কোনোভাবেই রাজি হয়নি শারফানের অধীনে স্থায়ীভাবে কাজ করতে। বসের একরকম হাতে-পায়ে পড়ে কান্নাকাটি করে আটকিয়েছিল নিজের বদলিটা। তার সেই অবস্থা দেখে শাফিউল সাহেবের মায়াও লেগেছিল‚ আবার হাসিও পেয়েছিল বেশ। এহসান লোকটি কাজে ভয় পায় না ঠিক—সে ভয় পায় শারফানের জ্বালাতন। কাজের বাহানায় ঠিকঠাক দশটা মিনিটও তাকে চেয়ারের গদিতে পশ্চাৎদেশ ছোঁয়ানোর সুযোগ দেয় না শারফান। তার অভিযোগ‚ তার মোটা শরীরটার ওপর নাকি ওর বেজায় কুনজর৷ ওই শরীরটাকে শুকনো কঞ্চির মতো করাটাই নাকি ওর বহুদিনের উদ্দেশ্য। এ কথা জানার পর থেকে ছেলে আর তার মাঝের কাণ্ডকারখানায় শাফিউল সাহেব কেবল মনে মনে মজা পান আর হাসেন।
কি-বোর্ড থেকে আঙুল সরিয়ে শারফান এবার ট্যাবটা হাতে তুলে নিল। সেখানেও গভীর মনোযোগ চেয়ে টাইপ আরম্ভ করল৷ কী যে করছে সে‚ তা ধরতে না পেরে অধৈর্য এহসান আন্দাজের ওপর ঢিল ছুড়ল‚ “স্যার কি বার্থডে প্ল্যান রেডি করছেন?”
“কী?” ভ্রু বাঁকিয়ে চোখ তুলল শারফান।
চেহারার ভাবটা দেখে এহসান টের পেল ভুল আন্দাজ করেছে সে৷ জলদি মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে ‘কিছু না’ বুঝিয়ে চুপ করে গেল। শারফান তখন আবার টাইপ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আন্দাজ অবশ্য একেবারেও ভুল করেনি এহসান। আজ শারফানের জন্মদিন। সকাল থেকে অফিসের প্রতিটি মেয়ে স্টাফ পরিকল্পনা বানাচ্ছে‚ অফিস শেষে কেক কেটে ওকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে সবাই একযোগে। তার আয়োজনও চলছে চুপিচুপি। তাছাড়া এই দিনে বিগত বছরগুলোতে শারফানকে দেখা যেত বন্ধু-বান্ধব আর তথাকথিত প্রেমিকাদের সঙ্গে নিয়ে দিনভর ব্যস্ত সময় পার করতে৷ কেবল এবারের চিত্রটাই একেবারে আলাদা। তাই বেশ অবাকই হচ্ছে এহসান—শারফান যে নিজের জন্মদিনের কথা ভুলে গেছে‚ তা ভেবেই।
ট্যাবের কাজটা শেষ করে হাত ঘড়িতে সময় দেখল শারফান। তারপর যে কাজে ডেকেছিল এহসানকে‚ সে কাজ বুঝিয়ে দিল তাকে। গুছিয়ে রাখা কিছু ফাইল আর ট্যাবটা তার হাতে তুলে দিয়ে বলল‚ “আগামীকাল ঠিক সকালে আব্বুর কাছে এগুলো পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন—অন্য কারও কাছে না। আগামীকাল সকাল মানে আগামীকাল সকালই৷ এর আগেও নয়‚ পরেও নয়। মনে থাকবে?”
মাথা নাড়াল এহসান‚ “হ্যাঁ‚ হ্যাঁ… কোনো ভুল হবে না৷”
“গুড”‚ বলে সে উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে। টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে সাদা রঙা টুইল প্যান্টের পকেটে পুরতে পুরতে এগোল সোফার দিকে। এহসানের উপস্থিতিকে এড়িয়েই গায়ের টি শার্টটা খুলে সোফায় রাখা সুতির স্যামন গোলাপি শার্টটা চড়িয়ে নিল।
“স্যার কি বেরিয়ে পড়বেন এখনই?” গলায় হালকা কৌতূহল এহসানের। দুপুরের খাবারের খাওয়ার সময় এখন শারফানের৷ তারপরই যায় সে এসএস কোম্পানিতে। সন্ধ্যায় আবার ফিরে আসে এখানে৷
“হ্যাঁ‚ ফিরব না আর৷”
মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল এহসান৷ মেকি আন্তরিকতা দেখাতে শারফান বলার আগেই সে সোফা থেকে টিশার্টটা তুলে নিয়ে বলল‚ “ওয়াশ করতে পাঠিয়ে দিচ্ছি এখনই।”
“না করলেও চলবে”‚ শার্টের বোতাম লাগাতে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল শারফান—যেন কোনো গুরুত্ব নেই এ নিয়ে।
এবার অনেকটা অবাক হলো এহসান৷ পোশাকের ব্যাপারে তো বেশ সচেতন শারফান৷ এরকম কতবার কত জামা-কাপড় অর্ধেক বেলা পরে রেখে গেছে তার দায়িত্বে! ধুয়ে‚ আয়রন করে তা ওর বাসায় পৌঁছে দিতে হয় তাকে সব সময়। আর আজ কিনা সে-ই ছেলে বলছে ‘না করলেও চলবে’! অদ্ভুতদর্শনের মতো এহসান ওকে দেখতে লাগল। এতক্ষণে খেয়াল করল‚ আজ অস্বাভাবিক চুপচাপ হয়ে আছে শারফান। মনে হচ্ছে এতদিনের সকল বাঁদরামি‚ ত্যাঁদড়ামি ছেড়ে-ছুড়ে একদম ভালো মানুষটি হয়ে গেছে সে‚ একটা পরিণত‚ ভারিক্কি ভাব চলে এসেছে যেন রাতারাতিই।
গতকাল ফরিদপুর গিয়েছিল শারফান—বাসার সবার খোঁজ-খবর নিতে৷ ফিরে আসার পরই এমন পরিবর্তন! এই অসম্ভব ঘটল কী করে? তা নিয়ে গভীর চিন্তাতে ডুবে গেল এহসান৷ এর মাঝেই শারফান বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অফিস থেকে।
***
ডা. রায়হান আহমেদ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও ট্রমা থেরাপিস্ট
রুম নম্বর: ৫০৬‚ ৫ম তলা
ইনার হিল সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড মাইন্ডকেয়ার ইনস্টিটিউট‚ ধানমন্ডি শাখা।
দুপুর ৩: ৩০ মিনিট ।
রায়হানের চেম্বারটা অন্য ডাক্তারি চেম্বারের মতো নয়। এখানে ঢুকতেই একটা অদ্ভুত প্রশান্তি টের পাওয়া যায়। দেওয়ালের রং হালকা অফ-হোয়াইট‚ যার ওপর নরম হলুদ আলো ছড়ানো ফ্লোর ল্যাম্প। এক পাশে ছায়াময় বারান্দা ঘেরা জানালা৷ যেখানে মাঝেমধ্যে নরম বাতাস ঢোকে‚ আর ধানমন্ডির গাছগাছালি ভরা সড়ক দেখা যায়‚ মাঝে মাঝে গাড়ির হালকা শব্দ এলেও সেটা ভেতরে ঢোকে না।
দেওয়ালের এক পাশে একাডেমিক সার্টিফিকেট আর ছোটো ছোটো আর্টপ্রিন্ট। ছোটো একটা ইনডোর প্ল্যান্ট সাজানো আছে ডেস্কের কোণে। কাঠের বুকশেলফে সাজানো বই। বেশিরভাগই মাইন্ডফুলনেস‚ ট্রমা থেরাপি‚ কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি নিয়ে।
ডেস্কের সামনের দুটো সোফা। একটা বাদামি‚ আরেকটা নীল রঙের—বেশ নরম। সানার জন্য বরাদ্দ থাকে বারান্দার দিকে রাখা নীল সোফাটা। যাতে বসে বাইরেটা দেখা যায়। পাশে ছোটো কাঠের টেবিলে টিস্যু‚ জলভর্তি গ্লাস‚ আর একটা সাদা মোমবাতি—যেটা সব সময় জ্বলে না। তবে মাঝে মাঝে আলো কমিয়ে দিলে তা আলো ছড়িয়ে দেয়।
ঘরের কোণে রাখা ডিফিউজার থেকে ভেসে আসছে হালকা ল্যাভেন্ডার সুবাস। সেই সাথে ঘরের ভেতরে বাজছে স্নিগ্ধ পিয়ানো মিউজিক। সোফায় বসে আছে সানা—চুপচাপ। চোখের নিচে হালকা ফোলা। ভেতরের ক্লান্তি আর চঞ্চলতা মিশে চেহারায় তৈরি করেছে এক ঘোলাটে বিষণ্ণতা। হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে একটা ভাঁজ করা কাগজ—গত চারদিন আগে পাওয়া সেই চিঠি। এই চারদিনের মাঝে ওকে জোর করেও রায়হানের কাছে আনতে পারেনি কেউ। কিন্তু আজ হঠাৎ করে কেন যেন নিজেই আগ্রহ দেখিয়েছে থেরাপি নিতে। এ ব্যাপারটা নিয়ে কোনো কথা আপাতত তুলল না রায়হান। জিজ্ঞেস করল‚ “তুমি চিঠিটা সঙ্গে এনেছ?”
সানা হালকা মাথা নাড়ল। চুপচাপ কাগজটা সামনে রাখল। চোখদুটো নামিয়ে রইল অনেকক্ষণ। একসময় বলল‚ “ভেবেছিলাম ছিঁড়ে ফেলব। পারলাম না। আমি জানি না চিঠিটা পড়ে আমি কেঁদেছি কি ওনার চিঠির জন্য? না-কি সেই কষ্টগুলোর জন্য‚ যেগুলো এখনো আমাকে ভেতর থেকে পোড়ায়? আমি জানি না ওনার চোখে সত্যি কী ছিল সেদিন। কিন্তু‚ আমার শরীর মনে রেখেছে ওনার দেওয়া কষ্টগুলো।”
“সানা‚ তোমার ভেতরে এখনো দুইটা সত্ত্বা কথা বলছে”‚ রায়হান বলল ধীর কণ্ঠে‚ “একটা বলছে‚ ও তোমায় কষ্ট দিয়েছে। তাই ওর প্রতি কোনো সহানুভূতি নেই। আর অন্যটা জোরে জোরে বলছে—ও কষ্ট পেয়েছে‚ ও বদলেছে… ওর চোখে কোনো প্রতিহিংসা ছিল না। ছিল শুধু আফসোস। কিন্তু তুমি ওকে দেখে মৃত্যুভয় পেয়েছিলে। অথচ সেই মানুষটাই এখন তোমার সামনে দাঁড়াচ্ছে অনুশোচনার ভঙ্গিতে। মনে হচ্ছে‚ দুটো সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ?
“হ্যাঁ”‚ নরম গলায় বলল সানা‚ “সেদিন ওনার চোখের ভেতর যেটা ছিল‚ সেটা কোনো রাগ-ক্ষোভ না‚ কোনো ভয় না। কিন্তু কী—তাও বুঝতে পারিনি। কেমন যেন একধরনের বোবা কান্না মনে হচ্ছিল।”
একটু থামল সে। তারপর আবার বলল‚ “ওনার চিঠির প্রতিটা শব্দ পড়ার পর মনে হচ্ছিল‚ আমি ভুল করে ওনার কিছু ভালো জিনিস মুছে ফেলেছি শুধু খারাপটা মনে রেখে। কিন্তু আমি তো ভালো থাকার সুযোগ পাইনি। ওনার হাতে থেকে আমি যতবার একটু করে রক্ষা পেয়েছি‚ প্রতিবারই সেটা এসেছে ওনার অপরাধবোধ থেকে। কিন্তু আমি কি আসলে কখনো রক্ষা পেয়েছিলাম?”
কথা শোনার ফাঁকে ফাঁকে রায়হান তার থেরাপিস্ট নোটে লিখল‚ “রোগী আজও ভীষণ সংবেদনশীল এবং দোটানায় ভোগার লক্ষণ এখনো স্পষ্ট। চিঠিতে প্রকাশিত অনুশোচনা এবং দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছা—তাকে একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছে।”
সানার কথা শেষ হলে সে জিজ্ঞেস করল‚ “কী অনুভব করেছিলে‚ যখন ও বলল—তোমার কষ্ট আর বাড়াবে না?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সানা। মৃদুস্বরে বলল তারপর‚ “মন চাইল বিশ্বাস করি। কিন্তু মাথা বারবার বলছিল—এটা সেই লোক‚ যে আমায় দিনের পর দিন অভুক্ত রেখে বন্দি করে রেখেছিল‚ নির্দয়ের মতো কষ্ট দিয়েছিল‚ আমি ভাবতাম এভাবেই আমি মরে যাব। কিন্তু ওনার চিঠির শেষ কয়েকটি লাইন বারবার মাথায় বাজছে। যেমন‚ ‘তুমি যদি ঘৃণা দাও‚ আমি তা মেনে নেব। কিন্তু তোমার কষ্টটা আর বাড়াতে চাই না।’ এই কথাটা পড়ার পর আমার কষ্টটা হালকা হয়ে যায়নি। কিন্তু আগের মতো ভারও লাগছে না।”
“তুমি ভয়, মায়া আর ভেতরে কোথাও হয়ত চাপা পড়ে থাকা ঘৃণার মতো আবেগের মাঝে একটা ভারসাম্য খুঁজে নিচ্ছ—এটাকেই বলে ইমোশনাল প্রসেসিং।” রায়হান বলল শান্ত গলায়‚ “তুমি এখন আর কেবল ভিকটিম না‚ তুমি একজন পর্যবেক্ষকও—তোমার অনুভবের। এটা হিলিঙের (healing) একটা পরিণত ধাপ। এখন তুমি কি ভাবছ? ওকে ক্ষমা করে দিতে পারবে?”
একটু ভাবুক দেখাল সানার মুখটা। “না‚ এখনো না”‚ এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল‚ “কিন্তু প্রতিশোধ বা ঘৃণার কথাও মাথায় আসছে না। শুধু চাচ্ছি‚ আমি যেন ওর কথা ভাবলে নিজের ওপর রাগ না হই। আমি নিজেকে দোষ না দিই। আমি যেন নিজেকে আবার একটু একটু করে ভালোবাসতে শিখি।”
রায়হান মাথা নাড়াল‚ “এটাই সঠিক পথ‚ সানা। ক্ষমা চাইলে দেবে কি-না—তা তোমার ব্যাপার। নিজের কষ্টটা বোঝা‚ সেই কষ্টকে গুরুত্ব দেওয়া‚ আর নিজের ওপর দোষ না চাপানো—এই তিনটাই আসলে সবচেয়ে সঠিক বিচার। আর সেই বিচার শুধু তুমিই নিজেকে দিতে পারো‚ অন্য কেউ নয়।”
সানা একদৃষ্টে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। বাতাসে দোল খেয়ে গাছের পাতা নড়ছে ধীরে ধীরে—ঠিক যেমনভাবে ওর মনে কিছু অনুভূতি আসছে‚ আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। “আমি ভাবি”‚ বলল সে মন্থর সুরে‚ “ও যদি সত্যিই বদলায়‚ তাহলে কি আমার সেই পুরনো ভালোবাসার অনুভূতিগুলো আবার ফিরে আসবে? অথচ আমি জানি‚ আমি এমন কাউকে ভালোবাসতে পারি না‚ যে আমার মনটা করুণভাবে ভেঙে দিয়েছে।”
“তার প্রতি সহানুভূতি থাকা মানে তাকে আবার ভালোবাসা নয়। আর ভালোবাসা থাকলেও সেটা তোমার সিদ্ধান্ত কেড়ে নিতে পারে না। তুমি স্বাধীন। ভালোবাসা‚ সহানুভূতি‚ কিংবা বিচ্ছিন্নতা—সব অনুভূতিরই অধিকার তোমার আছে।”
সানা কাঁধ ঝাঁকাল হালকা করে‚ “আচ্ছা ডাক্তার‚ আমি কি নিজেকে ফিরে পাবো?”
রায়হান হাসল মৃদু‚ “তোমার ভেতরের ‘নিজেকে’ তুমি হারাওনি‚ সানা। তুমি শুধু অনেকদিন তাকে চুপ করিয়ে রেখেছিলে। এখন সে আবার কথা বলতে চাইছে। আজ যেভাবে তুমি নিজের পায়ে হেঁটে এখানে এসেছ—এটাই তার প্রমাণ। এখন আমাদের কাজ হলো তাকে পুরোপুরি শুনতে দেওয়া। সে যেন আর কারও কণ্ঠে হারিয়ে না যায়।”
সানা চোখ বুঁজল। যেন মনে মনে খুঁজছে সেই পুরনো নিজেকে—যে ভালোবাসতে চেয়েছিল অবচেতনভাবেই। কিন্তু ভুল মানুষকে।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সে আবার বলল‚ “আমার আসলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় এই ভেবে যে‚ আমি নিজেকে বিশ্বাস করিনি। ভাবতাম‚ নিশ্চয়ই আমারই কোনো দোষ আছে—তাই এমনটা হচ্ছে। আমি নিজেকেই ঘৃণা করতে শিখেছিলাম। ওনার থেকে যখন আঘাত পেতাম তখন আমি নিজেকেই দোষারোপ করতাম—ওনাকে না।”
রায়হান একটু সামনে ঝুঁকল‚ “এই অনুভূতিটাই ট্রমার গভীরতম জায়গা। যখন একজন মানুষ তার কষ্টদাতা থেকে নয়‚ নিজের থেকে রক্ষা চায়‚ তখন তার আত্মপরিচয় ভেঙে যায়। কিন্তু তুমি এখন প্রশ্ন তুলছ‚ মানে সেই ভাঙনের ভেতর থেকেও তুমি বের হতে চাইছ। এটা অনেক বড়ো অগ্রগতি।”
“চিঠির আরেকটা লাইনও বারবার মাথায় বাজছে‚ ‘আমি একদম যোগ্য বিচারক হব—দেখে নিয়ো।’ এই কথাটা কি ভয় পাওয়ার মতো? না স্বস্তির মতো? আমি বুঝতে পারছি না।”
রায়হান তাকিয়ে রইল স্থিরভাবে। পালটা জিজ্ঞেস করল‚ “তুমি কী মনে করো?”
“আমি ভয় পাচ্ছি। আমি ওনাকে চিনি। ওনার বিচার মানে ওনার নিজের নিয়মে কিছু একটা করা। আমি চাই না‚ আবার সে আমার জীবনে প্রবেশ করুক কোনো উপায়ে। অথচ সেই সাথে মনের একটা ছোটো অংশে বলে‚ উনি সত্যিই অনুশোচনায় ভুগছেন। বিচার মানে হয়ত নিজেকে দুঃখ দিয়ে শোধ করবেন‚ হয়ত সরে যাবেন।”
রায়হান হালকা মাথা নোয়াল‚ “তোমার ভয়ও সত্যি‚ মায়াও সত্যি। তুমি এখন নিজেকে রক্ষা করতে চাও। কিন্তু তোমার মানবিক অনুভবও তোমার সত্ত্বার অংশ। তুমি এই দুইয়ের টানাপোড়েনে আছ বলেই তুমি মানুষ। এবং তুমি সারতে পারো।”
তার থেরাপিস্ট নোট—
“রোগী আজ তার ট্রমার মূল অনুভূতিগুলোর মুখোমুখি হয়েছে। আত্মদ্বন্দ্ব‚ অপরাধবোধ‚ পরস্পরবিরোধী আবেগ‚ সহানুভূতি এবং নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়।
চিঠিতে ‘বিচারক হব’ লাইন তাকে অস্থির করেছে‚ যা নির্দেশ করে PTSD-এর সঙ্গে cognitive dissonance এখনো সক্রিয়।
রোগী নিজের ‘self-trust’ ফিরে পেতে চাইছে। এবং ‘self-blame’-এর চক্র ভাঙার চেষ্টা করছে।
এখন থেকে থেরাপির লক্ষ্য হবে self-worth পুনর্গঠন‚ emotional boundary তৈরি। এবং trauma narrative-কে নতুন করে রচনার সুযোগ তৈরি করা।”
লেখা শেষ হতেই টেবিলের ওপর রাখা তার ফোনটা কাঁপতে শুরু করল—কল এসেছে সহকর্মী ছেলেটার। চুপচাপ রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে বলা তার কথাগুলো শুনে রায়হানের চেহারায় অবাক আর বিভ্রান্তি দুই-ই ফুটে উঠল৷ নিঃশব্দে কলটা কেটে সানাকে বলল স্বাভাবিক গলায়‚ “একটু বারান্দা থেকে ঘুরে আসতে পারো‚ সানা৷ ভালো লাগবে। ততক্ষণে আমি ছোট্ট একটা কল অ্যাটেন্ড করি? খুবই এমার্জেন্সি আসলে।”
“কোনো ব্যাপার না”‚ হালকা হেসে বলল সানা। “আমি বরং বেরিয়ে পড়ি? আজকের মতো থেরাপি সেশন তো শেষ বোধ হয়।”
“হ্যাঁ‚ তা শেষ। কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে এখনো৷ আরেকটু পর বের হও।”
“ঠিক আছে”‚ বলে সানা চলে গেল বারান্দাতে।
তারপরই দ্রুত কল করল শারফানকে। তৈরিই ছিল যেন শারফান। তাই প্রথমবার রিং হতেই রিসিভ করল সে। রায়হান বলল‚ “কী ব্যাপার বলো তো‚ শারফান? ঠিক আছ তো তুমি? হঠাৎ সরাসরি চেম্বারে কেন?”
“সানা আছে নিশ্চয়ই?” ফোনের ওপাশ থেকে শান্ত স্বরে প্রশ্নটা এল।
“হ্যাঁ‚ মাত্রই ওর থেরাপি শেষ করলাম।”
“আমি জাস্ট ফাইভ মিনিটস চাই‚ ভাইয়া”‚ এবার গলাতে আকুতি প্রকাশ পেল শারফানের‚ “ওর সামনে আসতে চাইছি। সেটা আপনার চেম্বারে না হোক‚ কিন্তু রাস্তার মধ্যেও না৷ আপনি কাইন্ডলি একটা ব্যবস্থা করে দিন প্লিজ।”
“শারফান‚ কুল। আমি তোমার কন্ডিশন বুঝতে পারছি৷ কিন্তু তুমি যেটা চাইছ তাতে আমার প্রফেশনালিজম একেবারেই বজায় থাকে না।”
“বাট আই নো‚ ভাইয়া‚ ইউ উইল ম্যানেজ দিজ—ওয়ান ওয়ে অর অ্যানাদার। আই অ্যাম আস্কিং ইউ উইথ অল মাই হার্ট।”
“শারফান‚ প্লিজ… এমন কোনো রিকুয়েস্ট কোরো না‚ ভাই‚ যেটা…” কথা আর শেষ করা হলো না রায়হানের।
শারফান চেম্বারের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল৷ কেবল ভদ্রতা প্রদর্শনে রায়হানের সহকর্মীর মাধ্যমে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ৷ কিন্তু রায়হানের আপত্তিতে ভদ্রতাটুকু আর টিকিয়ে রাখল না। ফোনের লাইনটা খটাস করে কেটে দিয়ে দরজা ঠেলে হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল৷
সহকর্মী ছেলেটা একটু অমনোযোগী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল‚ তাই ঠেকানোর সুযোগটুকুও পেল না সে৷ “এই‚ ভাই‚ এই…” করতে করতে চেম্বারের ভেতর সেও ঢুকল৷ রায়হান তখন হাতের ইশারায় তাকে চলে যেতে বলল৷ শারফান তার মুখোমুখি তিন সেকেন্ডের জন্য থামল‚ “সরি‚ ব্রাদার। আমার সিচুয়েশন আপনাকে বোঝানোর মতো সময় এখন নেই হাতে।” বলেই জিজ্ঞেস করল‚ “সানা কই?”
মুখটা থমথমে দেখাল রায়হানের৷ জবাব দেওয়ার আগেই শারফান নিজেই খুঁজে পেয়ে গেল সানাকে৷ রায়হানের নারাজি দেখে পাঁচ আঙুলের ইশারায় তাকে আবারও ‘ফাইভ মিনিটস’ বুঝিয়ে এগিয়ে গেল সানার দিকে।
উদাসীনের মতো আকাশের পানে দৃষ্টি তুলে দাঁড়িয়ে আছে সানা। তাই তো কানে পৌঁছায়নি শারফানের গলা৷ শারফান এসে দাঁড়াল ওর থেকে মাত্র এক হাত দূরত্বে—সেটাও টের পেল না।
সাদা আর লাল রঙা সেলোয়ার-কামিজে সানা৷ পিঠজুড়ে ছড়ানো লম্বা চুলগুলো—কেবল ছোট্ট একটা ক্ল-ক্লিপ আটকে রেখেছে গুটি কয়েক চুল। নিঃশব্দে‚ নিষ্পলক ওকে দেখতে দেখতে হৃৎপিণ্ডের গতি কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল শারফানের। সেদিন বৃষ্টি ঝরা রাতের পর আজ দ্বিতীয়বারের মতো এ অনুভবের শিকার হলো সে৷
“হেই‚ সানা…” সানাকে ডাকার চিরাচরিত স্বভাবেই আকস্মিক ডেকে উঠল। মুখটা শুকনো‚ চোখজোড়া লাল‚ কিন্তু স্বর শান্ত তার।
চমকাল সানা। ভূত দেখার মতো তাকিয়ে রইল তার দিকে‚ তারপরই তাকাল একবার রায়হানের দিকে৷ ওর অভিব্যক্তি লক্ষ করে শারফান মিনতিপূর্ণ গলায় স্বীকারোক্তি দিল‚ “রায়হান ভাই আমার এক বড়ো ভাইয়ের কাজিন। সে হিসেবেই চেনাজানা। এজন্যই অনধিকার প্রয়োগ করে ঢুকে পড়েছি। সেট্ল ডাউন‚ প্লিজ। আমি এক্ষুণি চলে যাব। শুধু…” বলতে বলতে কণ্ঠ হঠাৎ থেমে গেল শারফানের—সানার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে উঠতে দেখে৷
এর মাঝে রায়হানের দিকে আরেকবার তাকাল সানা। রায়হান ততক্ষণে উঠে এসেছে৷ “শারফান”‚ ওকে বলল সে‚ “তোমার কাজটা ঠিক হচ্ছে না। সানা এখানে সুরক্ষিত থাকতে এসেছে। এটা তার যুদ্ধ‚ তুমি তাই অ্যালাওড না। চলে যাও তুমি।”
“গ্র্যান্ট আস আ ফিউ মিনিটস ইন প্রাইভেট‚ প্লিজ‚ ভাই”‚ বলল শারফান রায়হানকে‚ কিন্তু স্থির চাউনি তার সানাতেই৷
“থাকুক”‚ রায়হানকে অবাক করে হঠাৎ অনুমতি দিল সানা—নিচু কণ্ঠে।
রায়হান তাই চলে গেল। সানা তখন নির্দ্বিধায় চোখে চোখ রাখল শারফানের৷ আজ আর ওর চোখে কোনো জল ভিড়ল না‚ ঘৃণাও ফুটল না‚ আবার ভালোবাসাও না। ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল‚ “কী চান এবার?”
মুখে কোনো উত্তর দিল না শারফান৷ চেয়ে রইল কতক্ষণ নীরবে সানার বিষণ্ণ মুখে। কেবল মনে মনেই বলল‚ “তোমাকে দেখার পর আমি কনফিউজড‚ সানা৷ এটাই তোমার আমার শেষ দেখা হোক‚ না-কি আবারও দেখা হোক আমাদের—কী চাই আমি আসলে?”
“কেন এসেছেন?” জিজ্ঞেস করে উঠল সানা।
কথা দ্রুত গুছিয়ে জবাব দিল শারফান‚ “আমার অপরাধ সম্পর্কে আব্বু এখনো অবগত না৷ কিন্তু হবে খুব শীঘ্রই। তারপর সে যাবে তোমার কাছে৷ মাথাটা নিচু করেই দাঁড়াবে হয়ত। তখন তাকে ফিরিয়ে দেবে না প্লিজ—এই রিকুয়েস্টই জানাতে এসেছি।”
শাফিউল সাহেবের আগমন হবে কি ছেলের হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে? না-কি অন্য কোনো কারণে? প্রশ্নগুলো মনে আসতেই সানার কঠিন মুখভঙ্গি বদলে কৌতূহল ফুটল।
কিন্তু জিজ্ঞাসার সুযোগটুকুই দিল না শারফান৷ “হিল ওয়েল‚ মাই সেলিনি”‚ সানার আরও কাছে এসে ফিসফিসাল‚ “শাইন এগেইন। আমি আর কখনোই তোমার আলোতে ছায়া হব না—প্রমিজ।” আর একটা মুহূর্তও দাঁড়াল না এরপর। অপ্রত্যাশিত যে ঝড়ের মতো হয়ে এসেছিল‚ সে ঝড়ের মতোই আবার বেরিয়েও গেল—সানাকে ভাবনার গভীরে তলিয়ে।
চঞ্চল পায়ে হেঁটে এসে সেডানে উঠে বসল শারফান। ইঞ্জিন চালু হতেই একঝলক সূক্ষ্ম কম্পন ছড়িয়ে গেল পুরো গাড়িজুড়ে—যেন ঘুম ভাঙল কোনো বিশাল যন্ত্রচালিত জন্তুর। ড্যাশবোর্ডে সব চেকলাইট একবার জ্বলে নিভল। সব শেষে গাড়ি গড়াতে শুরু করল ভদ্রভাবে‚ এক নিখুঁত নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু শারফানের ভেতরটা ঠিক যেন উলটো। বুকের গহিনে তার প্রলয়ঙ্কারী তুফান বয়ে যাচ্ছে সানার মুখোমুখি হওয়ার পর থেকেই৷ এসেছিল সে কোনো কথা বলার উদ্দেশ্যে নয়—শুধু এক নজর দেখার উদ্দেশ্যে। কারণ‚ কয়েক ঘণ্টা বাদেই সে এগোবে এক মহাপ্রলয়ের দিকে। যা তার নিজের হাতেই গড়া। এরপর কী হবে তা তো আর জানা নেই…
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৪৫.
মেরুল বাড্ডা
সন্ধ্যা ৬: ৩০ মিনিট ।
নির্জন এক পুরনো চারতলা বাড়ির ছাদ। পাশের গলি থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ডাক আর দূরের মসজিদের মাইকের মৃদু আওয়াজ। আকাশে ঝুলে থাকা মেঘগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে‚ আজকের রাত আরও গভীর হবে‚ এবং আরও যেন বিপজ্জনক।
সন্ধ্যার হলুদ আলোয় ছাদের একপাশে দাঁড়িয়ে শারফান। গায়ে শুধু কালো রিব বডি স্লিভলেস গেঞ্জি‚ ঘামে মাথার লম্বা চুলগুলো আঠালোভাব হয়ে আছে। গলায় ঝুলছে সাদা হেডফোন। কিন্তু আপাতত বাজছে না কিছুই। শরীরটা পাথরের মতো শক্ত‚ চোখের কোণে রক্তবর্ণের হালকা রেখা‚ যেন ঘুম ছাড়া বছরের পর বছর কেটেছে ওর। সে চোখে কঠিন এক জেদ।
ওর সামনে দাঁড়িয়ে অমিত ভাই। ওর মারামারির কোচ। সাবেক মিলিটারি ট্রেনার তিনি। কাঠের মতো কড়া শরীর তার। বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই। গায়ের রং ঘন শ্যামলা‚ চোখদুটো ধূসর‚ ঠান্ডা অথচ অন্তর ভেদ করা দৃষ্টি। মুখের এক পাশে পুরনো ক্ষতচিহ্ন‚ চোয়াল কাটা-কাটা‚ দাড়ি ছাঁটা‚ কিন্তু রুক্ষ চেহারা‚ ঘন কালো চুলের কপালের পাশে কয়েকটা চুল সাদা। যুদ্ধের ছাপ যেন গায়ে লেগে আছে তার এখনো। পেশিবহুল শরীর‚ কাঁধ চওড়া‚ চলাফেরা নির্ভুল। কন্ঠস্বর নিচু কিন্তু দৃঢ়। প্রতি শব্দেই যেন হুকুম মনে হয়। এক সময় দেশের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সে ছিলেন তিনি। ক্লোজ কমব্যাট ফাইটিং আর ডিফেন্সিভ স্ট্রাইকিং-এ এক্সপার্ট। সাতাশ মার্চের সকালে তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় শারফানের। এবং পরিচয়ের মাধ্যমটা ইয়াজ৷
গত ছাব্বিশ মার্চের মাঝরাতে ইয়াজের সঙ্গে কথা হয়েছিল শারফানের অনেকটা সময়। সানার জন্য ব্যাকুলিত মনটাকে স্থির করতে এবং রাজনের বিষয়টি নিয়ে কিছু বুদ্ধি ধার আর পরামর্শ নিতেই দীর্ঘদিন পর সে ইয়াজকে বার্তা পাঠিয়েছিল। সে বার্তা পেয়ে ইয়াজ একটুও দেরি করেনি ওকে কল করতে। ঘণ্টা সময় ধরে দুজনের কথা চলেছিল সেদিন রাতে৷ কথার মাঝে দুজনের তর্কবিতর্কও হয়েছিল বেশ।
শারফান যা চাইছে তাতে ঘোর আপত্তি ইয়াজের। কিন্তু শারফান দৃঢ় জেদি সুরে জানায় তাকে‚ তার থেকে কোনো সাহায্য বা পরামর্শ না পেলে ওর যা প্রয়োজন তা ও নিজেই ব্যবস্থা করে নেবে। অনেকটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ইয়াজ খুব ভেবেচিন্তে তখন অমিতের কাছে পাঠিয়ে দেয় ওকে৷ আর সেদিন থেকেই শারফানের প্রচণ্ড আবদারে অমিত হয়ে যান ওর কোচ‚ এবং ওর পরামর্শকও।
এই ছাদের এক কোণে হালকা প্যাডিং দেওয়া একটা প্র্যাকটিস এরিয়া বানানো হয়েছে। দুটো হেভি বক্সিং ব্যাগ ঝুলছে‚ আর চারপাশে ডাম্বেল‚ রড‚ রাবার র্যাগ।
পায়ের ক্ষত শুকিয়েছে অনেকটাই। তাই নির্দ্বিধায় স্কিপিং শুরু করল শারফান। চলল মিনিট পাঁচেক৷ প্রতিটি লাফ যেন নিজেকে ছিঁড়ে ফেলার মতো। এরপরই ত্রিশবার পুশআপ। তারপরই হঠাৎ ব্যাগের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। একের পর এক ঘুসি‚ লাথি‚ হাঁটুর আঘাত হানল সেখানে। প্যাড ফেটে যাচ্ছে‚ ব্যাগ দুলে উঠছে।
অদূরে দাঁড়িয়ে ওর মাঝে প্রচণ্ড এক মানসিক অস্থিরতা বুঝতে পারলেন অমিত। ইয়াজের সঙ্গে কথা বলে জারার বিষয়ে সমস্তটাই অবগত হয়েছেন তিনি। বর্তমান সরকারের পোষা আইনের কাছে সত্যিই সুষ্ঠু বিচার প্রত্যাশা করা নিছক বোকামিই। তবুও নিজের হাতে বিচারের ভার তুলে নেওয়ার বিষয়টি মানতে পারছিলেন না শুরুতে তিনিও৷ কিন্তু শারফান যখন ওর পরিকল্পনা খোলাখুলি জানাল তাকে‚ তখন আর ব্যাপারটিতে কোনো বাড়াবাড়ি লাগেনি তার৷ তবে জীবন ঝুঁকি নিতে চলেছে শারফান‚ কেবল তা নিয়েই আপত্তি ছিল ইয়াজের আর তারও। আর তাদের সে আপত্তিকে তোয়াক্কা করার মতো ছেলে যে শারফান নয়‚ তা তিনি বুঝে গেছেন পরিচয়ের প্রথম দিনেই৷ এবং অদ্ভুতভাবে তার খুব ভালো লেগে গেছে শারফানকে৷ ইয়াজের থেকে যতটুকু জেনেছেন আর নিজে যতখানি ওজন করতে পেরেছেন ওকে‚ তাতে তিনি ঢের চিনতে পেরেছেন এই ডানপিটে ছেলের প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা কেবলই নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষগুলোর জন্য। যারা সংক্রমাক ব্যাধির মতোই নিজেদের অন্তরের দূষণ সমাজের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। শারফানকে দেখতে দেখতে তিনি স্পষ্টই টের পেলেন‚ কিছু একটা ওর মধ্যে চাপা পড়ে আছে। সেটা কী তা জিজ্ঞেস করবেন কি করবেন না‚ তা ভেবে পেলেন না।
শরীরটা আগুনের মতো জ্বলছে যেন শারফানের। তাই একটু থেমে গায়ের গেঞ্জিটাও খুলে ফেলল। মনের ভেতরটা এখনো ঘোলাটে‚ ছন্নছাড়া। সানাকে মাথা থেকে সরাতে পারছে না একদমই৷ যদি কটা কথাও শুনিয়ে দিত মেয়েটা‚ কিংবা দুটো থাপ্পড়ও যদি মারত‚ তাও খুব হালকা লাগত ওর। মনে হচ্ছে মরে গিয়েও বুকের মধ্যে বয়ে চলা আনকোরা ভালোবাসার অনুভূতি আর অপরাধবোধ ওকে সুচ ফোঁটার মতো বিঁধিয়েই যাবে।
গেঞ্জিটা মেঝেতে ছুড়ে মেরে ব্যাগে নতুন করে ঘুসি মারতে উদ্যত হলেই অমিত বাধ সাধলেন ওকে‚ “টেক আ ডিপ ব্রেথ‚ শায়াফ।”
শারফান ফিরে তাকালে ওর কাছে এসে বললেন তিনি‚ “তোমাকে শুধু ফিজিক্যালি না‚ মানসিকভাবেও লড়াকু হতে হবে। লড়াইয়ের সময় মাথার ভেতরে কিচ্ছু রাখা যাবে না। কোনোরকম অনুভূতিও না। অনুভূতি বাঁচার জন্য‚ ফাইট করার জন্য না।”
শারফানের কপাল দিয়ে‚ বুক বেয়ে টপটপ করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। মুখ থমথমে। সে বুঝতে পারল‚ কোচ কোনোভাবে টের পেয়েছে মনটা ওর অশান্ত। কিন্তু সম্পর্কটা ওদের ভদ্রতাসূচক সৌজন্যতাতেই সীমাবদ্ধ। সেখানে আন্তরিকতা আসেনি এখনো৷ তাই অনুভূতির কথা উঠলেও কোনো জবাব দিল না। তাছাড়া সানা এমনই এক অনুভূতি‚ যা নিয়ে সে নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষ বা বন্ধুর সঙ্গেও খোলামেলা হতে দ্বিধা-সঙ্কোচ বোধ করে। তাই তো জানাতে পারেনি ইয়াজকেও‚ আর মুখ ফুটে বলতে পারেনি বাপকেও।
ওর নিরুত্তর থাকায় অমিতও আর কিছু বললেন না। ক্লোজ কমব্যাট ট্রেইনিঙের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলের দুজন। অমিত নিজেই হাতে প্যাড পরে নিলেন। এক হাতে ছুরির ডামি‚ অন্য হাতে ভারী গ্লাভস।
চারদিকের বাতিগুলো এখন নরম হলুদ আলো ছড়াচ্ছে‚ ছায়া লম্বা হয়ে পড়ছে ম্যাটের চারপাশে। একটা নিঃসৃত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে পরিবেশে। দৃষ্টি শারফানের ঠান্ডা‚ কিন্তু দৃঢ়তা সেখানে। তা লক্ষ করে কাঁধে প্যাড চাপাতে চাপাতে বললেন অমিত‚ “ভেতর থেকে কী যেন তোমাকে ছিঁড়ে ফেলছে‚ সেটা আমি জানি না। আর জানতে চাওয়াটাও আমার কাজ না। তোমার স্পিড ভালো৷ কিন্তু একটা কথা শোনো‚ মাথা জ্যাম থাকলে প্রতিপক্ষ আগে পড়ে যাবে না‚ তুমি যাবে। মন ফাঁকা রাখো। তুমি এখন যুদ্ধের মুখে। তোমার ভেতরে যা চলছে‚ সেটা এখন থামা উচিত। না হলে তুমি যুদ্ধ করতে নামার আগেই হেরে যাবে।”
চোখ তুলে তার দিকে চাইল শারফান। অমিত ওর চোখে চোখ রেখে বললেন‚ “যে তোমাকে ভেঙেছে ভুলে যাও তাকে এখনই।”
শারফান নিঃশ্বাস ছাড়ল ধীরে। ঘাড়ের পিছের ঘাম মুছে নিয়ে শেষবারের মতো মনে করল সানার বিষণ্ণ মুখ‚ তার ভেজা চোখের নিষ্পলক চাহনি। তারপর বিড়বিড় করল‚ “আমার যুদ্ধ শুধু বাইরের না‚ অমিত ভাই‚ ভেতরেরও। আমি কেবল ভেতরটা ঠান্ডা করতে চাই।”
অমিত ঠিকঠাক শুনতে পেলেন না৷ তবে জিজ্ঞাসাও আর করলেন না। ছুরির ডামি সামনে এনে শুরু করলেন ট্রেইনিং। আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল শারফান তার দিকে। বাঁ হাত ছুরির ডামির বাঁ দিক থেকে অমিতের কাঁধের কাছে ফাঁকি দিয়ে পাস করল‚ তারপরই ঘুরে গিয়ে ডান হাতে একটি পাঞ্চ আর নিচু থাপ্পড় মারল সোজা তার প্যাডে। একই সময়ে বাঁ হাত দিয়ে শরীরের ভার ফেলে তার বুকে দিল ধাক্কা।
অমিত দ্রুত পেছনে সরলেন৷ চোখে তার মৃদু প্রশংসা। আরও উৎসাহ দিতে লাগলেন ওকে। তাতে শারফান নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবার আরও তীব্রভাবে‚ আরও নিখুঁত কৌশলে।
এরপর শুরু হলো অস্ত্র চেক‚ পকেট গিয়ার প্রস্তুতি‚ কনসিলড ব্লেড ট্রেইনিং। যথেষ্ট চর্চা হলো৷ এক পর্যায়ে থেমে গেলেন অমিত। কাঁধ থেকে প্যাড খুলতে খুলতে বললেন‚ “মারামারিতে তোমার যে দক্ষতা দেখছি‚ শায়াফ‚ তা সত্যিই খুব প্রশংসনীয়। মাত্র নদিনেই ক্লোজ কমব্যাটে বেস্ট না হতে পারলেও বেটার তো হয়েছই। ভেতরের এই আগুন আর নিভতে দিয়ো না অন্য কিছু মাথাতে এনে। আজ রাতে যা করতে যাচ্ছ‚ তার জন্য এই আগুনটা লাগবেই।”
দুজনের মাঝখানে কয়েক মুহূর্ত নীরবতা চলল। তারপর অমিত পেছনে গিয়ে একটা কালো বক্স খুলে ওকে ভারী ছুরির কেস এনে দিল একটা‚ “রাখো এটা। যেখানে যাবে সেখানে তোমার জন্য জাহান্নাম বনে যেতে পারে যখন তখন। তাই মাথা‚ মন খুব স্থির রাখবে।”
ছোটো পকেট নাইফটা আগে হাতে নিল শারফান। তারপর অন্য ছুরিগুলো। ওজনটাও বুঝে নিল একবার। প্রলম্বিত শ্বাসটা ছেড়ে চোখটা ফেলল এবার সুদূর আকাশের বুকে। মেঘ গর্জন করছে সেখানে। বোঝা যাচ্ছে‚ তুমুল বৃষ্টি হবে আজ।
ঘড়িতে রাত বাজে আটটা সাঁইত্রিশ। শারফান গায়ে গেঞ্জি‚ শার্ট ঢুকিয়ে ঝুলতে থাকা ঘামে ভেজা চুলটা চোখের ওপর থেকে সরিয়ে নিল। তারপর ধীরে ধীরে অমিতের দিকে তাকিয়ে শুধু একটি বাক্য বলল‚ “আমার বোনের জন্য আমি জাহান্নাম পর্যন্তও দেখতে রাজি।”
অমিত মাথা নাড়লেন‚ “তাহলে যাও। জাহান্নামটাই তোমার অপারেশন এরিয়া আজ। কিন্তু ফিরে আসবে অবশ্যই।”
“ইনশা আল্লাহ”‚ বলেই নেমে পড়ল সে ছাদ থেকে।
গলা ছেড়ে বিদায় জানালেন অমিত৷ তার জবাব দিতে শারফান আর পেছনে তাকাল না। আজ রাত বারোটা বাজলেই রাজনের রাজত্বে এক রক্তাক্ত ফয়সালার রাত নামাবে সে। তাতে কারও বাধাই মানা সম্ভব নয়। ওর বোনটা ভাগ্যের জোরে বেঁচে ফিরলেও আরও কতজনের বোনের সর্বনাশ রোজ করছে রাজন! তার হিসেব পুলিশের খাতায় থাকলেও পুলিশের বড়ো মাথায় যে রাজনের মতো মানুষদের একনিষ্ঠ বন্ধু।
***
বাসার সবাইকে আজ অবাক করে সানা রাত নটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ তাও গভীর ঘুমে। এমনটাই দেখানোর চেষ্টা করছে সে ঘরের দরজা আটকে৷
কত শত ভাবনা‚ কত হিসেব মেলাতে গিয়ে সেই একই মানসিক দ্বন্দ! কিন্তু তার মাঝে শারফানের চিঠির কথাগুলো আর ওর মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্ত সানার ভাবনায় নতুন মোড় এনেছে৷ সেদিন বৃষ্টির রাতে শারফানের চোখের ভাষা পড়তে ব্যর্থ হলেও আজ সে ব্যর্থ হয়নি৷ ওর চিঠির ভাষা আর চোখের ভাষায় যতখানি অনুতাপ ছিল‚ ঠিক ততখানিই ছিল আকুলতা। কিন্তু সে আকুলতা কিসের? ভালোবাসার? এ প্রশ্নেই সানা আটকে যাচ্ছে বারবার। এর জবাব না মেলা পর্যন্ত বাকি রাতটা আজও তার নির্ঘুমই কাটবে।
ঠিক এ সময়ই দরজার ওপাশে বসার ঘরে বসে ভেঙে পড়া নাজমা বেগমকে সামলানোর চেষ্টা করছেন তার ভাবি৷ সানার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতিই ঘটেনি এতদিনেও। মেয়ের মানসিক সুস্থতার ওপরই তো নির্ভর করছে ওর স্বাভাবিক জীবনটা৷ তাই মোস্তফা সাহেবের সঙ্গে ফোনের মাঝে আলোচনায় বসেছেন ওয়াজিদ সাহেব৷ তারা মনে করছেন‚ সানাকে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে আনতে হলে ওর পাশে ভালো একজন জীবনসঙ্গীর প্রয়োজন৷ ভালো ছেলে পেতে তো সময়ও লাগবে। তাই ছেলে খোঁজার কাজটা এখন থেকেই শুরু করতে চান ওয়াজিদ৷ দেশে থাকাকালীনই তিনি ভাগনির বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলবেন বলে জানালেন ভগ্নীপতিকে৷ তাতে সম্মতিও দিলেন মোস্তফা সাহেব।
***
কামরাঙ্গীচর
রাত ১২: ২০ মিনিট ।
ঢাকার একটি জনবহুল ও ঘিঞ্জি এলাকা। এ এলাকায় অবৈধ দখল‚ চাঁদাবাজি‚ মাদক চলাচল নিত্যদিনের গল্প৷ এর পশ্চিম সীমানায় বুড়িগঙ্গা নদী। নদীপথ ব্যবহার করেই রাতে নৌকা বা ট্রলারে অবৈধ ড্রাগস ও অস্ত্র আসে‚ এবং নারী পাচার হয়। এই নির্জন‚ আলোবিহীন এলাকায় পুলিশের নিয়মিত টহল নেই বলেই কামরাঙ্গীরচর অনেকাংশেই দক্ষিণাঞ্চলের গ্রাম্য চোরাচালানকারীদের সঙ্গে সংযুক্ত। হাজারীবাগে চামড়াশিল্প সরে যাওয়ার পর ফাঁকা পড়ে থাকা বেশ কিছু ভবন ও প্লট আছে। আধা-নির্মিত ফ্ল্যাটবাড়ি বা হাউজিং প্রজেক্ট‚ যা কখনোই শেষ হয়নি। সেগুলোর নিচতলায় অনেক সময় অপরাধীদের আস্তানা হয়ে ওঠে।
নূর আলী বিল্ডিংটা আধা নির্মিত‚ দোতলা বাড়িটাও তেমনই একটি বাড়ি৷ নিচতলায় দুইটা বড়ো হল রুম। একটিতে মাদকের গুদাম‚ অন্যটায় অবৈধ অস্ত্র SMG, পিস্তল‚ গ্রেনেড আর কিছু বোমা পর্যন্তও রয়েছে। দোতলায় তিনটা ছোটো ঘর। দুটোতে ড্রাগসের প্রভাবে কজন নারী ও কিশোরী বন্দি‚ আরেকটিতে রাজনের আবাস। ভবনের চারপাশে সীমানা প্রাচীর ভাঙা‚ পেছনে নদীর খালঘেঁষা পথ। ভেতরে প্রবেশ করার জন্য পেছনের দিকেও গোপন একটি ফাঁকা জায়গা রয়েছে।
আকাশ ঢেকে আছে কালো মেঘে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামছে সবে। ভবনের ভেতরে বড়ো এক চেম্বারে চলছে প্রস্তুতি। রাজনের একদল পোষা বাহিনী নেশায় বুঁদ থাকা মেয়েদের ট্রাকে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরেকপাশে ছোটো ছোটো প্যাকেটে ড্রাগস‚ টেবিলে কালো ব্যাগে সকল আধুনিক অস্ত্র।
ভবনের পেছনে প্রথমে কালো একটি এসইউভি এসে থামল‚ আর তার পেছনে থামল সাদা রঙা আরও একটি মাইক্রো বাস। এসইউভির প্যাসেঞ্জার সিটে ভেতরে দেখা গেল বাবলু আর শারফানকে পাশাপাশি। সামনে ড্রাইভারের পাশে বসা বাবলুর একমাত্র ডান হাত সানি। মুখে এক রাশভারী ভাব বাবলুর। শরীরে তার কালো রঙের কটি জ্যাকেট‚ পেছনে পিস্তল ঢোকানো‚ চোখে ধোঁয়াচোখা সানগ্লাস‚ যদিও রাত। আর ঠোঁটে অর্ধেক জ্বলন্ত সিগারেট। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তাকাল শারফানের দিকে। জিজ্ঞেস করল‚ “ঠিক আছ তো?”
ভবনের চারপাশটা ভালোভাবে দেখছিল শারফান৷ বাবলুর প্রশ্নে ফিরে না চেয়েই নির্বিকার গলাতে পালটা প্রশ্ন ছুড়ল‚ “তোমার প্ল্যান ফ্লপ খাবে না তো?”
ঠান্ডা এক হাসি ফুটল বাবলুর চেহারায়‚ “প্ল্যান? আমি লড়াই করি শত্রুর মুখোমুখি হইয়া। খালি তুমার সেইফটির চিন্তা কইরা পিছন দিয়া ঢুকা লাগব আইজ। এহন কও‚ তুমি প্রস্তুত? দেহো‚ আমি শ্যাষবারের মতো কইতাছি‚ রাজনের সাথে আমার হিসাব আলাদা আর তা পুরান হিসাব৷ ও আমার ক্ষতি করে‚ প্রতিশোধে আমিও ওর ক্ষতি করি। কিন্তু লাস্ট টাইম ও আমার চালান ধরায় দিছিল এসবি অফিসারের কাছে৷ বহুত টাকা খাওয়াইয়া সেই চালান ছাড়াইছিলাম৷ এই শোধ আমি আজ নিয়াই ছাড়তাম। সেইডা এক্কেরে সামনের গেট দিয়া ঢুইকা ওর কুত্তাগোরে গুলি খাওয়াইতে খাওয়াইতে। দুই চাইরডা আমার পোলাও খাইত। এহন তুমি আমাগের মতো এসব কামে অভ্যস্তু না। গোলাগুলি মইধ্যে পইড়া তুমার কিছু হইয়া গেলে তার জন্যি আবার আমার ভুগান্তিতে পড়া লাগে যদি‚ ব্যাপারডা মুটেও ভালা হইব না কইলাম।”
শান্ত চোখে তাকাল শারফান। বাবলুর গোলগাল‚ খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ভরা মুখটা দেখল চুপচাপ কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলল কাঠিন্য স্বরে‚ “আমি যেহেতু বলেছি তোমাকে আইনি বা রাজনৈতিক মহলের কোনো ঝামেলায় ফেইস করতে হবে না‚ তার মানে হবে না৷ বারবার কেন এক কথা বলাচ্ছ আমাকে দিয়ে?”
জবাবে অদ্ভুরকম এক হাসি দিল বাবলু। চাপা এক অস্পষ্ট হাসি। হাসতে হাসতে আপাদমস্তক দেখতে লাগল শারফানকে। পরনে ওর কালো কমব্যাট প্যান্ট‚ সাদা ফুলস্লিভ শার্টের হাতা গুটানো আর বুকের ওপর হালকা ওজনের চেস্ট বডি আর্মার‚ আর কোমরে গোঁজা Glock 19। চোখে-মুখে কঠিন এক শীতলতা ওর। সেখানে কোথাও এতটুকুও আতঙ্ক নেই দেখে মনে মনে অবাকই হলো সে।
একদিকে ট্রাকে মাত্রই আটকে রাখা হলো ছয়জন কিশোরী ও নারীকে। অন্যদিকে রাজন সিগন্যালের অপেক্ষায়। সিগন্যাল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোরাই অস্ত্র ও ড্রাগস এসে পৌঁছাবে নদীপথে।
শারফান‚ বাবলু গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে। বাবলুর ছেলেগুলো হাতে AK47 নিয়ে ওদের দুজনকে কভার দিতে দিতে ভবনের গোপন প্রবেশ পথে ঢুকে পড়ল৷ সাবধানে চারদিক থেকে এগোতে থাকল ওরা। দক্ষিণ দিকের দেয়াল ঘেঁষে শারফান ও বাবলু‚ পশ্চিম দিকে দুইজন‚ আর উত্তরের গার্ড টাওয়ারের দিকে একজন স্নাইপার। মাদকের গুদামঘরের সামনে দুজনকে দেখা যেতেই বাবলু সাইলেন্সার লাগানো কোল্ট পিস্তলের গুলিদুটো খরচা করল৷ চিৎকার করার সুযোগটুকুও পেল না ওরা। কিন্তু আজ চালান বিধায় লোকের অভাব নেই৷ হঠাৎ করে ওদেরকে পড়ে যেতে দেখল অন্য একজন। সঙ্গে সঙ্গেই চিৎকার করে সবাইকে সতর্ক করে দিল৷ বাবলু আর তার সঙ্গীরাও আর দেরি করল না লড়াইতে নেমে পড়তে৷
হাতে একটা AK47 নিয়ে শারফান নিজের মতোই এগোতে থাকল৷ এখন অবধি খরচা করেনি সে একটা গুলিও৷ রাজনের আবাস দোতলায়৷ সেখানে যেতে পথে দুজন বাধা হয়ে দাঁড়ালে পিস্তলের পরিবর্তে অনায়াসে ব্লেড ব্যবহার করেই ওদেরকে দুনিয়া ছাড়া করতে পারল সে৷ দোতলায় উঠতেই একটি ঘর থেকে গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসতে থাকল‚ কিশোরী দু-তিন জন মেয়ের কান্নাকাটি। মারধর করে তাদেরকে বের করার চেষ্টা করছে দুজন লোক। সেদিকে পা বাড়াতেই টের পেল কেউ ওর খুব কাছে চলে এসেছে৷ ঝট করে পেছন ফিরতেই প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হলো সে রাজনের৷ ওর চেয়েও দুই ইঞ্চি বেশি লম্বা রাজন। চেহারা ভর্তি কাটাকুটি আর সেলাইয়ের অস্পষ্ট দাগ। কালো শরীরটা যেন দানবেরই এক রূপ। ধাঁই করে ওর চোয়ালে শক্ত এক ঘুসি বসিয়ে দিল রাজন। সেই সাথে মুখ থেকে বের হলো কতগুলো গালি। ছিটকে তিন পা পিছে সরে এল শারফান৷ ঘুসির ওজনটা মারাত্মক। চোখের সামনে কয়েক মুহূর্ত ঘোলাটে হয়ে থাকল ওর৷ ধাতস্থ হওয়ার আগেই রাজন ডান পা তুলে দ্বিতীয় আক্রমণ চালাল ওর পাঁজর লক্ষ করে। কিন্তু লাগল না। শারফান সরে পড়েই ঘুরে এক উড়ন্ত লাথি ছুড়ল রাজনের তলপেটে। ককিয়ে উঠে পেট চেপে ধরলে তারপরই এক ঘুসি বসাল তার মুখের মধ্যে৷ দাঁতে লেগে নিচের ঠোঁট কেটে অর্ধেক ঝুলে পড়ল তার। হাতে ধরা পিস্তলটা তাক করতে একটা পলও দেরি করল না শারফান৷ কিন্তু গুলিটা বের হলো না সেখান থেকে৷ বলা ভালো সে সুযোগটা পেল না ও৷ কারণ‚ ডান দিক থেকে তখন ছুটে এল বাবলুর গুলি৷ লাগল ওর পায়ের হাঁটুর নিচে। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল ও। যন্ত্রণায় শরীর নিথর হয়ে আসতে চাইল। কিন্তু দমে গেল না। বাবলুর দিকে তাকানোর প্রয়োজনবোধ করল না ও। কারণ‚ তার লোকজন চারদিক থেকে প্রায় ঘিরে ফেলেছে ওকে। হঠাৎ ও ঝুঁকে পড়ে ডানদিকে গড়িয়ে পড়ে কাভার নিল পিলারের পেছনে। রাইফেল থেকে তিন রাউন্ড ছুড়তেই দুজন পড়ে গেল। কিন্তু তার মাঝেই একজন ছুরি হাতে ছুটে এল। শারফান বাঁহাতে ঘুরিয়ে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে ঘাড়ে বসিয়ে দিল তার। আরেকজন এলে মাটিতে আবারও গড়িয়ে পড়ে তার হাঁটুর পেছনে লাথি মেরে উলটে ফেলল। তবে বেশি সময় আর পারল না ব্যথাকে অগ্রাহ্য করে লড়াই চালাতে। চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করল৷ হাতে লোহার রড নিয়ে আহত বাঘের মতো রাজন তখনই দৌড়ে এসে আঘাত করে বসল ওর গুলিবিদ্ধ জায়গাতেই। চিৎকার করে উঠল শারফান সারা ভবন কাঁপিয়ে৷ বাবলু দ্রুত এসে দাঁড়াল রাজনের পাশে। আরেকবার আঘাত করার আগেই সে ঠেকাল রাজনকে‚ “খান*র পোলা থাম! মইরে গেলে পাঁচ কোটি পাবি কহান থেইকা?”
খেপা রাজন রডটা দিয়ে বাবলুকেই আঘাত করতে গেল। তবে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলাল সে। মা তুলে সেও গালি দিয়ে বলল‚ “তুই নাটক চো**বি চো**! আমার পোলাগুলারে মারলি ক্যা‚ শুয়া** বাচ্চা?”
বাবলুর সেই চাপা অস্পষ্ট হাসিটা এবার স্পষ্ট হলো৷ বলল‚ “প্রতিশোধ। তুই আমার ওপর ঝাল মিটাইতে আমার চালান ঠেকায় দিয়া আমার ছেলেগুলারে মাইরা দিছিলি‚ মনে নাই?”
“তার আগে তুই কী করা চো**ইছিলি‚ খান** বাচ্চা?” রাগে পাগল হয়ে গেছে যেন রাজন৷ শারফান ওকে ধরতে যেদিন থেকে বাবলুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে‚ সেদিন থেকেই সে সবটাই জানে৷ বাবলুই জানিয়েছে৷ বাইরে থেকে ওরা এক অপরের মাঝে শত্রুতা বোঝালেও গোপনে সবটাই ঠিক। এই ভণ্ডামির উদ্দেশ্য মূলতঃ নিজেদের শত্রুদের বোকা বানিয়ে তারপর সুযোগ বুঝে তাদেরকে হয় খতম করা‚ নয়ত নিজেদের হাতের পুতুল বানানো। যেমনটি আজ বোকা বানিয়েছে ওরা শারফানকে।
নারী পাচার ও অবৈধ অস্ত্রের বড়ো বড়ো ডিল মাঝে মধ্যে দুজন এক সঙ্গেই পরিচালনা করে ওরা । রাজন ও বাবলু ঢাকার কুখ্যাত এমন দুই অপরাধী‚ যারা এই লেনদেনের আড়ালে বহু তরুণীকে পাচার করে দেয় আন্তর্জাতিক রুটে।
তবে শারফানকে এখনই জানে শেষ করবে না ওরা৷ শাফিউল সাহেবের থেকে পাঁচ কোটি মুক্তিপণ আদায়ের পর রাজন নির্ধারণ করবে শারফানের মৃত্যু ঠিক কীভাবে দেবে সে। ওদের দু ভাইয়ের মাঝে পুরনো হিসাব নিয়ে ঝামেলার মাঝে আচমকা ঘটে গেল এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
পুরো চেম্বারকে চমকে দিয়ে ভবনের বাইরে হঠাৎ সাইরেন বেজে উঠল। হেলিকপ্টারের শব্দে কাঁপতে থাকল চারদিক। রেড লাইট ফ্ল্যাশ করল চারপাশে। আর্মির কমান্ডার তারপরই হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিল‚ “বিল্ডিংসহ পুরো এলাকা ঘিরে ফেলা হয়েছে। যে যেখানে আছেন অস্ত্র ফেলে দিন সবাই। পালানোর চেষ্টা করবেন না। ড্রপ উইপন! বাংলাদেশ স্পেশাল ফোর্স। মাথা নিচু করে পড়ে থাকুন!”
রাজন আর বাবলু তাজ্জব বনে গেল৷ বিস্ফারিত চোখে শারফানের দিকে তাকাল রাজন‚ তারপর বাবলুর দিকে৷ বাবলু নিজেও অবাক৷ সে ভেবেছিল সর্বোচ্চ পুলিশের সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে শারফান। তাই আগে থেকেই পুলিশকে ঠিক রাখার ব্যবস্থা করে রেখেছিল ওরা। কিন্তু স্পেশাল ফোর্সের সাথে যোগাযোগ হতে পারে এই ছেলের‚ এ তো চিন্তাতেও আসেনি ওদের! আদৌ কি শারফানই যোগাযোগ করেছে? ভাবতে লাগল বাবলু৷ সে তো জানতে পেরেছিল‚ এসবি অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ আর পরিকল্পনা করে ঢুকেছিল শারফান।
নিস্তেজ শারফানের নিভু নিভু চোখদুটোর দিকে তাকাল বাবলু। সে কিছু করার আগেই রাগে অস্থির হয়ে রাজন জ্ঞান হারাতে বসা শারফানের বুকে‚ পেটে‚ আর আঘাতপ্রাপ্ত পায়ে রডের বাড়ি দিতে লাগল বিরতিহীন। চিৎকার করে তখন একবার মা’কে ডেকে উঠল শারফান। নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে কষ্ট হলো। পা ভেঙে যাওয়ার মতো জখম বুক চেপে ধরে পড়ে থাকলেও শেষমেশ একেবারে জ্ঞান হারাল সে।
তবুও ওকে গালাগাল করতে করতে ওর বুকের আর্মার জ্যাকেট খুলে নিয়ে রাজন বলল‚ “এই মাদার** আমার জীবনের কাল৷ এর কেস হাতে নেয়ার পর থেইকাই আমি খালি বিপদে পড়তাছি৷ আমি যদি আইজ ধরা পড়িই… তার আগে ওরে আমি জবাই কইরা যামু।”
তবে জবাই করার মতো অস্ত্র হাতে না থাকায় রাজন শারফানের পেটে চালাল একটা গুলি‚ আরেকটা চালাল বুকে। গলগলিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসে সারা মেঝে ভেসে যেতে লাগল। পেটে আর বুকে গুলিটা যাওয়ার পরই ওর চেতনাশূন্য দেহটা কেবল দুবার ঝাঁকি দিয়ে এক পর্যায়ে থেমে গেল একদম।
চলবে।
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৪৬.
বাবলু আর রাজনের মতোই ওদের ছেলেরাও বিভ্রান্ত‚ আতঙ্কিত। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করল না ওরা৷ এ মুহূর্তে পালাতে হলেও অস্ত্রকেই ব্যবহার করতে হবে৷ পজিশন নিয়ে নিল সকলে নিজেদের মতো।
স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডোরা ছায়ার মতো ভেতরে ঢুকে পড়ল৷ M4A1 রাইফেল হাতে‚ চোখে থার্মাল গগলস৷ তাদের দেখা মাত্রই আক্রমণ করল রাজনরা। তীব্র গোলাগুলি শুরু হলো দু পক্ষের মাঝে। কিন্তু একেকজন দুঃসাহসিক কমান্ডোর কাছে বেশিক্ষণ টিকতে পারল না কেউ। অল্প সময়ের মধ্যেই শুইয়ে দিল ওদের৷ তবে রাজনের অবস্থা হলো শঙ্কাজনক। একটা গুলি ঢুকে পড়েছে তার পিঠের মাঝে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে সে।
দোতলায় পৌঁছে তাকে আর বাবলুকেসহ বেঁচে থাকা ছেলেগুলোকে ধরে ফেলল স্পেশাল ফোর্স। তারপরই কমান্ডার দেখতে পেল নিথর দেহের শারফানকে। মিশনে নামার পূর্বে ওর ডোশিয়ে দেখে এসেছিল সে। চেঁচিয়ে ডেকে উঠল‚ “মেডিক!” তারপরই দুজন কমান্ডোকে ডেকে বলল‚ “ওনাকে সরাও ফাস্ট! উনিই শারফান শায়াফ৷ মিশন শোডাউনের মাস্টারমাইন্ড।”
মেডিক দ্রুত শারফানের কাছে এল৷ শরীরের আঘাতপ্রাপ্ত জায়গাগুলো থেকে রক্ত ভেসে সারা জায়গাটুকু একাকার। মুখ থেকেও গড়িয়ে আসছে রক্ত। ওর পালস পরীক্ষা করে দেখল মেডিক। বেঁচে আছে এখনো৷ তবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে খুব ধীরে চলছে পালস। যে-কোনো মুহূর্তেই একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যাবে‚ তা বুঝতে পেরে জলদি ওকে স্ট্রেচারে তুলে নিল দুজন কমান্ডো। বেরিয়ে পড়ল তারা ভবন থেকে৷
মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে বাইরে৷ ভিজে জবজবে সকলে৷ ভিজে গেছে শারফানের রক্তভেজ দেহটাও। রক্ত আর বৃষ্টির পানি একত্রে মিশে গিয়ে টপটপ করে পড়ছে ওর চুলের ডগা থেকে। নিভু নিভু করছে প্রাণপ্রদীপটা। ওর বুকের ভেতর দাউদাউ করে জ্বলা প্রতিশোধের আগুনকেই যেন নিভিয়ে দিচ্ছে এই বৃষ্টিধারা। কিন্তু চোখজোড়া মেলে দেখার ভাগ্যটুকু হলো না‚ ওর সকল পরিকল্পনা সফল হয়েছে।
হেলিকপ্টারে তুলেই ছুটল ওকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
***
সিএমএইচ‚ ঢাকা
রাত ১টা ৪৭ মিনিট থেকে ভোর ৫টা ২৫ মিনিট ।
হাসপাতালের করিডোর দিয়ে ছুটে স্ট্রেচারে করে শারফানকে নিয়ে আসা হলো অপারেশন ব্লকে। ডান পা আর পেটের নিচ থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। স্ট্রেচারের নিচে লাল দাগ ছড়িয়ে যাচ্ছে করিডোরজুড়ে। ওর হাত-পা বরফ শীতল‚ চোখের পাতা আধা খোলা কিন্তু দৃষ্টিতে কোনো চেতনা নেই‚ চোয়াল ঝুলে পড়েছে। বাদামী ত্বক ছাইয়ের মতো ফ্যাকাসে‚ যেন রক্ত শুষে নেওয়া হয়েছে। ঠোঁটদুটো নীলচে‚ নখের নিচে অক্সিজেনের ঘাটতির ছায়া। ভেন্টিলেটরের টিউব ওর মুখে। যন্ত্রের চাপে বুক ধীরে ধীরে উঠছে-নামছে৷
“দ্রুত ওটিতে তোলো ওকে”‚ বললেন ডা. ইমরান৷ ব্রিগেডিয়ার র্যাঙ্কের একজন অভিজ্ঞ ট্রমা সার্জন তিনি। এবং অপারেশন টিমের প্রধান হতে চলেছেন।
দু’জন করে স্ট্রেচারের দুই পাশে ধরে রেখেছে সেনা সদস্য। তাদের চোখেও উদ্বেগ‚ যদিও তারা যুদ্ধের মানুষ। পেছনে ছুটছে এক নার্স‚ এক টেকনিশিয়ান‚ সঙ্গে মেজর তৌফিক। যিনি অ্যানেসথেসিয়োলজিস্ট। তার কাঁধে ঝুলছে রেসকিউ ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর স্যালাইন‚ রক্ত দেওয়ার কিট‚ অ্যাম্বু ব্যাগ‚ অক্সিমিটার‚ সব কিছু।
রক্তে গোসল করা শারফানকে সোজা তুলে দেওয়া হলো সার্জিকাল টেবিলে। মৃতের মতো পড়ে রইল সে৷ ডা. ইমরান এক ঝলকে দেখেই বুঝে গেলেন—সময় শূন্যের কোঠায় চলছে এখন। এক মুহূর্ত দেরি মানেই মৃত্যু। মুহূর্তেই গর্জে উঠল তার কণ্ঠ‚ “স্কিজরস‚ কাট এভরিথিং অফ। উই নিড ফুল অ্যাক্সেস।”
নার্সরা সঙ্গে সঙ্গে শারফানের রক্তে ভেজা জামা-প্যান্ট কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলল। কাপড়গুলো ছিঁড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ল। জমাট রক্তে ভিজে থকথকে হয়ে আছে কাপড়ের টুকরোগুলো। নগ্ন দেহে দ্রুত স্টেরাইল ড্রেপ চাপিয়ে দিয়ে কেবল ওর বুক‚ পেট ও পায়ের অংশ অপারেশনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হলো।
গুলির তিনটি জায়গা দিয়ে ইতোমধ্যে প্রায় দুই লিটার রক্ত বেরিয়ে গেছে। মনিটরের অ্যালার্ম বেজে উঠল‚ রক্তচাপ ৭০/৩০‚ পালস দুর্বল।
অ্যানেসথেসিয়োলজিস্ট তাড়াতাড়ি বললেন‚ “ব্লাড গ্রুপ এখনো নিশ্চিত হয়নি‚ ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।”
“সময় নেই।” ডা. ইমরান আদেশ করলেন‚ “এখনই এমারজেন্সি ‘ও পজিটিভ’ রক্ত দিতে হবে। শুরু করো আর ব্লাড ব্যাঙ্কে জানাও।”
তারপরই প্রথম ব্যাগ ও-পজিটিভ রক্ত ভেইন লাইনে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে স্যালাইন। শারফান তখনো জ্ঞানহীন।
“স্ক্যালপেল দাও। চেস্ট খুলব আগে”‚ গ্লাভস পরা হলেই বললেন ডা. ইমরান।
রাত ২: ০৩ মিনিট
শুরু হলো অপারেশনের প্রথম ধাপ। ওর বুকে কেটে থোরাক্স খোলার পর সঙ্গে সঙ্গে জমাট রক্ত বের হয়ে আসলো‚ সাথে ধাতব গন্ধ মেশানো উষ্ণ বাষ্প ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে।
“সাকশন”‚ চকিতে আদেশ করে উঠলেন ডা. ইমরান৷
ভেতরে জমে থাকা প্রায় এক লিটার কালচে রক্ত তখন দ্রুত টেন নিল নার্স মেশিন দিয়ে। ডান ফুসফুস সঙ্কুচিত হয়ে প্রায় নিস্ক্রিয় হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে একটি চেস্ট টিউব বসানো হলো।
চোখ কুঁচকে কার্ডিয়াক সার্জন ডা. মাহবুব বলে উঠলেন‚ “হার্টের এক ইঞ্চি পাশ দিয়ে গিয়েছে। এক সেন্টিমিটারও ভেদ করলে জানটা আর থাকত না।”
রক্তপাত থামাতে ছিন্ন ধমনীতে ক্ল্যাম্প বসানো হলো। শরীরের ভেতরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রক্তের তোড় সামলানোই ছিল সবচেয়ে জরুরি কাজ। ওটি টিম ধমনী চিহ্নিত করে দ্রুত ক্ল্যাম্প করে দিল‚ যাতে রক্তপাত বন্ধ হয়।
“হেমোথোরাক্স ক্লিয়ার হচ্ছে‚ স্লো স্লো ব্রিদিং আসছে”‚ ডা. ইমরান গম্ভীর স্বরে বললেন।
হৃৎপিণ্ডের চারপাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার করা হলো। অতঃপর হালকা কম্পনে ধুকপুক করতে থাকা হৃদস্পন্দন একটু একটু করে স্থিতিশীল হতে থাকল। তবে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা তখনো আশঙ্কাজনকভাবে কম।
“হার্ট রেট নেমে যাচ্ছে”‚ বললেন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট তৌফিক‚ “কেটামিনের মাত্রা বাড়াতে হবে।”
রাত ২: ২৩ মিনিট
শারফানের ব্লাড প্রেসার তখন ৬৫/৪২। মনিটরে হৃৎস্পন্দনের ওঠানামা অস্থিরভাবে কাঁপছে। ডা. ইমরান চোখ স্থির করলেন ওপরের ইনজুরি স্ক্যানের দিকে। তারপর বললেন‚ “ইনসিশন নিচ্ছি পেটের ওপর। রিট্র্যাক্টর ধরা থাকুক।”
দ্বিতীয় ধাপে শুরু হলো পেটের অপারেশন। পেট কাটার পর খুলে দেখা গেল যকৃতের বাঁ পাশ ছেঁড়া‚ পাশাপাশি ছোটো অন্ত্রে দুটি গুলির ছিদ্র। তার একটিতে গুলি ঢুকেছে আর বেরিয়ে গেছে। ডা. ইমরান বললেন‚ “সাকশন দাও! অন্ত্রে দুটি হোল। একটা ঢুকে আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে।”
সঙ্গে সঙ্গে ভাইক্রল স্যাচারে অন্ত্র সেলাই করা হলো। যকৃতের ছেঁড়া জায়গায় চাপ দিয়ে হেমোস্ট্যাটিক গজ বসিয়ে রক্তপাত বন্ধ করার চেষ্টা চলছিল। ঠিক তখনই মনিটরের স্ক্রিনে ভেসে উঠল সতর্ক সংকেত।
“বি-পি: আটান্ন বাই বত্রিশ…”
“পালস: বাহাত্তর থেকে নেমে এখন বেয়াল্লিশ…”
অ্যানেসথেসিয়া মনিটরে একেকটা বিট যেন ধীরে ধীরে থেমে যেতে চাইছে। স্ক্রিনের লাইনটা কাঁপছে‚ উঠছে-নামছে। কিন্তু যতটা না আত্মবিশ্বাসী গতিতে‚ তার চেয়ে বেশি যেন ক্লান্ত আর অনিশ্চিত গতিবিধি বোঝাতে।
ডা. তৌফিক শ্বাস চেপে বললেন‚ “প্রেশার ড্রপ করছে ভয়ানকভাবে… রক্তসঞ্চালন কমে গেছে‚ হার্ট ধীর হয়ে যাচ্ছে… এখনই কিছু না করলে ব্রেডিকার্ডিয়া হতে পারে। সেকেন্ড ইউনিট ফুল ব্লাড দাও! রিঙ্গার ল্যাকটেট পুশ করো!”
একজন নার্স চটজলদি স্যালাইন স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে দিল দ্বিতীয় ব্যাগ। আরেকজন রিঙ্গারের ইনজেকশন দিয়ে রক্তনালিতে সাপ্লাই চালু করল। কিছু সেকেন্ডের জন্য টেবিলের চারপাশে সবাই তীব্র উৎকণ্ঠায় টান টান। চোখে মুখে শুধু একটাই প্রশ্ন তাদের‚ “ছেলেটা কি টিকবে?”
হঠাৎ মনিটরে একটা সোজা লাইন ভেসে উঠল। ডা. মাহবুব চোখ বড়ো করে চিৎকার করে উঠলেন‚ “হার্ট স্টপড! সিপিআর শুরু করো! অ্যাড্রেনালিন ইনজেকশন আনো… তাড়াতাড়ি!”
অভিজ্ঞ নার্স সেকেন্ডের ভেতর ওর বুকের ওপর চাপ দিতে শুরু করল। এক‚ দুই‚ তিন… প্রতিবার চাপের সঙ্গে শারফানের দেহ সামান্য কেঁপে উঠতে থাকল।
অন্যপাশে ইনজেকশন ট্রলিতে নার্স ফারজানা এগিয়ে এল অ্যাড্রেনালিন হাতে। দ্রুত শারফানের শিরায় ইনজেকশন দিল। ডিফিব্রিলেটরের ইলেকট্রোড প্যাড দুই হাতে নিয়ে বুকে চেপে ধরার ঠিক আগ মুহূর্তে বলে উঠল‚ “চার্জিং‚ ওয়ান ফিফটি জুল। সবাই পেছনে সরুন… ক্লিয়ার!”
টেবিলের সবাই এক সঙ্গে পিছু হটল। শারফানের বুকে তারপরই ইলেকট্রোড প্যাড ছোঁয়ানো হলো। তীব্র বিদ্যুৎ শকে শূন্য সেকেন্ডের মাঝে ওর বুকটা হঠাৎ আকাশে লাফিয়ে উঠল‚ যেন পুরো শরীরই শূন্যে লাফ দিল। এরপর এক নিস্তব্ধতা। এক সেকেন্ড‚ দুই সেকেন্ড করে গড়াতে লাগল সময়। মনিটরে তখনো নীরবতা। তারপর হঠাৎ মনিটরে একটা শব্দ ভেসে এল বিপ… বিপ!
“সিনাস রিদম ফিরে আসছে…” হালকা হাঁপাতে হাঁপাতে নার্স ফারজানা বলল‚ “হার্টবিট ধীরে ধীরে ফিরছে।”
ডা. ইমরান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন স্ক্রিনে। “শরীরটা এখনো লড়ছে”‚ আস্তে করে বললেন তিনি‚ “আমরাও আর থামব না। সেলাই চালিয়ে যাও।”
এরপর রক্তচাপ নামতেই তৃতীয় ইউনিট রক্ত দেওয়া হলো।
রাত ৪: ০৫ মিনিট
তৃতীয় ধাপে শুরু হলো অস্থি সার্জারি—ভাঙা হাড় ও শিরা ঠিক করার লড়াই।
বুকের ও পেটের অপারেশন শেষ হতেই টেবিল সামান্য ঘোরানো হলো। আলো নামিয়ে আনা হলো শারফানের ডান পায়ের গুলির জায়গায়। আর্থোপেডিক সার্জন মেজর ডা. মারুফ সরাসরি বললেন‚ “টিবিয়া পুরো ভেঙে গেছে। এবং শিরা ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ এখনো থামেনি। ইন্টারনাল ফিক্সেশন লাগবে‚ স্টিল রড।”
নার্স একজন পায়ের ভাঙা হাড়ের একপাশ ধরল‚ অপর পাশে ধরল একজন সহকারী ডাক্তার। ডা. মারুফ নির্দেশ দিলেন তারপরই‚ “স্টেরিল রড‚ লকিং স্ক্রু‚ ইন্টারলক ড্রিল আনো।”
এদিকে পায়ের নিচে রক্ত জমে থাকায় আবারও সাকশন চালু হলো। ওর অস্থির মধ্যে রক্ত আর ঘামের একধরনের উৎকট গন্ধ। ডা. মারুফ বললেন‚ “নরম টিস্যু ছিঁড়ে গেছে। ভেতরের শিরা ফেটে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। রড বসাতে হলে আগে ভাস্কুলার রিপেয়ার করতে হবে। নাহলে ফিক্সেশন ধরে রাখা যাবে না।”
ডা. ইমরান তখনই তার পাশে এসে দাঁড়ালেন‚ “ও.কে। আগে ভাস্কুলার সেলাই শেষ করো। তারপর ইন্টারনাল ফিক্সেশন করব। সাপোর্টিং ইনফিউশন চালু আছে‚ প্রেশার ধরে রাখো।”
সাড়ে চারটা নাগাদ হাড়ে রড বসানো হলো। স্ক্রু দিয়ে ঠিকঠাক সেঁটে দেওয়া হলো। তারপর ছিন্ন শিরার সংযোগ তৈরি করা হলো ভাইক্রল স্যাচারে সেলাইয়ের মাধ্যমে।
রাত ৪: ৪৫ মিনিট
সমাপ্তি ধাপ। চতুর্থ ইউনিট রক্ত দেওয়া হলো শারফানকে। পায়ের ক্ষত ঢেকে দেওয়া হলো সার্জিকাল গজ ও স্টেপল দিয়ে। ডা. ইমরান চোখ তুলে বললেন‚ “সেলাই শুরু করি। সব লেয়ার ক্লোজিং‚ ইনফেকশন প্রটেকশন দিতে হবে।”
এরপর পেট ও বুকের ইনসিশনেও প্রতিটি স্তর আলাদা করে সেলাই করা হলো। ফ্যাসিয়া ও মাসল সেলাই করা হলো ভাইক্র স্যাচারে। ত্বক সেলাইয়ে ব্যবহার হলো নাইলন স্যাচার। বুকে চেস্ট টিউব রেখে দেওয়া হলো‚ যাতে হেমোথোরাক্স আর না জমে। শেষবারের মতো মনিটরে শারফানের বিট‚ প্রেসার‚ অক্সিজেন লেভেল দেখে ডা. তৌকির নিশ্চিত করলেন‚ “বিপি ৮৫/৫৫‚ হার্টবিট প্রতি মিনিটে ৯৮। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ ৯১%।” অর্থাৎ লাইফ সাপোর্টে এখনো সাড়া দিচ্ছে শারফান।
শেষে তিনি জানালেন‚ “ভেন্টিলেটর সেটিং ঠিক আছে। শেষ ব্যাগ ব্লাড দিয়ে দিচ্ছি।”
ঘড়ির কাঁটা ৫টা বেজে ২৫ মিনিট।
তিনটি গুরুতর আঘাত—বুক‚ পেট আর ডান পা‚ সবগুলোতেই জরুরি সার্জারি শেষ। টানা সাড়ে তিন ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে সার্জনরা একে একে শারফানের শরীরের ভেতরের ক্ষত সেলাই করেছেন‚ রক্তপাত নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। ডা. ইমরান ক্লান্ত হাতে গ্লাভস খুলে ফেললেন। কিন্তু ভারমুক্ত হতে পারলেন না একদম। কারণ‚ এখনো জীবন ঝুঁকি থেকেই গেছে তার রোগীর।
শারফানকে ধীরে ধীরে রিকভারি বেডে তোলা হলো‚ এরপর আনা হলো আইসিইউতে। মুখে ভেন্টিলেটরের টিউব‚ বুকের চেস্ট টিউবের পাইপ বেয়ে ধীরে ধীরে রক্ত নেমে যাচ্ছে কালো ড্রেন ব্যাগে। বুকে বাঁধা ব্যান্ডেজের নিচে সেই গুলির ক্ষত‚ পেটে স্টেরাইল অ্যাবডমিনাল ড্রেসিং‚ পায়ে রড। শারীরিক যুদ্ধের পুরো মানচিত্র আঁকা যেন ওর শরীরে। বন্ধ চোখের ফ্যাকাসে মুখটা দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধ শেষে জাগতিক দুনিয়ার সব কিছু ভুলে কামনাহীন‚ বাসনাহীন এক অলস বা অবসন্ন সৈনিক নিশ্চিন্তে ঘুমের দেশে ঠাঁই নিয়েছে।
ডাক্তারেরা অক্লান্ত মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন ওকে৷ এক সময় বলে উঠলেন ডা. ইমরান‚ “বাহাত্তর ঘণ্টার আগে কিছুই বলা যাবে না। সেন্সলেস থাকলেও হার্টবিট চলছে‚ এটাই কেবল স্বস্তির।”
“রিফ্লেক্স আস্তে হলেও আছে”‚ একজন নার্স প্যুপিলারি লাইট চেক করে জানাল।
পাঁচ ইউনিট রক্ত দেওয়ার পরও ওর শরীর ক্লান্ত‚ সাড়া ধীর। জ্ঞান ফেরার সম্ভাবনার স্কেল আটের ওপর আছে। এখনো আশা ফুরিয়ে যায়নি। কিন্তু বাহাত্তর ঘণ্টায় যা ঝুঁকি রয়ে গেছে তা নিয়ে প্রতিটি ডাক্তারের মাঝে ছড়িয়ে আছে উদ্বেগ।
শারফানের শরীরটা এখন নিস্তব্ধ এক যুদ্ধক্ষেত্র। সেলাই করা রক্তনালিগুলো ঠিকমতো জোড়া না থাকলে ভেতর থেকেই আবার শুরু হতে পারে রক্তস্রোত। অদৃশ্য ক্ষরণ‚ যেটা বুঝে উঠতে না উঠতেই নিভে যেতে পারে ওর জীবনপ্রদীপটা।
ফুসফুসটা তো একবার হাল ছেড়ে দিয়েছিল। এখন যদি আবার বুকের ভেতর রক্ত বা বাতাস জমে যায়‚ তবেও শ্বাস আটকে যাবে।
অস্ত্রোপচারের প্রতিটা জায়গা যেন একেকটা খোলা দুয়ার হয়ে আছে। যদি সেখানে জীবাণু ঢুকে পড়ে‚ তাহলে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে পুঁজ‚ বইবে জ্বর আর দুর্বলতা। সেলাইও খুলে যেতে পারে৷ তখন আবার সার্জারি লাগতে পারে।
জরুরি রক্ত লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ইউনিটের পর ইউনিট। কিন্তু সেই রক্ত যদি নিজেই হয়ে ওঠে বিষ? যদি তার ভেতর লুকিয়ে থাকে সংক্রমণ? তাহলে কিডনি থেমে যাবে‚ প্রেসার নামবে‚ আর কিচ্ছু করার থাকবে না তখন। হৃৎপিণ্ডটাও আগে একবার থেমে গিয়েছিল। এখন যদি আবারও থেমে যায়! ঝুঁকি এখানেও।
অস্ত্রোপচারে ওর শরীরটা ভেতর থেকে একদম নেতিয়ে গেছে। এই ধকল কিডনির পক্ষে সামলানো কঠিন। প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেলেই তা বিপদ সঙ্কেত। আর ওর পায়ে গুলিটা শুধু হাড় না‚ ছিঁড়েছে বড়ো শিরাও। যদি সেখানে ঠিকমতো রক্ত না পৌঁছায়‚ তাহলে সেই পা-ই হয়ে দাঁড়াবে নতুন এক যুদ্ধের কেন্দ্র। বাঁচলেও হয়ত আর হাঁটতে পারবে না কখনো।
আবার রক্ত যখন গাঢ় হয়ে জমে‚ তখন সেটা ফুসফুসে গিয়ে আটকালে শ্বাসও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এমনকি মস্তিষ্ক পর্যন্ত অক্সিজেন যদি না পৌঁছায়‚ চোখ না খুলে ও রয়ে যায় অনন্ত নিদ্রায়‚ তাহলে সবার এত যুদ্ধ‚ এত কষ্ট‚ এত প্রতীক্ষা… সব মিলিয়ে হার মানবে নিয়তির কাছে।
***
ফরিদপুর
সকাল ৬: ০৭ মিনিট ।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর শাফিউল সাহেব আরও নিয়মতান্ত্রিক জীবনে ঢুকে পড়েছেন৷ হাঁটাহাঁটির জন্য এখন আর একটা সকালও তিনি বাদ দেন না৷ ফজরের নামাজ শেষে তাই রোজকার মতো হাঁটতে হাঁটতে সারা বাড়ির চারপাশ ঘুরছেন‚ যেন টহল দিচ্ছেন৷ এরই মাঝে মূল ফটকের সামনে গাড়ির হর্ন বেজে উঠল। দারোয়ান দ্রুত গেট খুলে দিতেই শাফিউল সাহেব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন‚ ছেলের কোটি টাকা দামের নতুন গাড়িটা দেখার আশায়৷ এই গাড়ি যতবারই ওঁর চোখের সামনে আসে‚ টাকার জন্য বুকটা ততবারই খাঁখাঁ করে ওঠে তার। ছেলের গাড়ি কেনার খবরটা যখন জানতে পেরেছিলেন‚ তখনো হাসপাতালের বিছানাতে তিনি। ছেলেকে গালাগাল করতে করতেই সে সময় বাকি দিনগুলো পার করেছিলন।
শাফিউল সাহেবের ধারণাকে সত্যি করেই বিএমডব্লিউর কালো সেডানটা এসে দাঁড়াল বাসার নিচে। মাথার টুপিটা খুলে পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে তিনি এগোলেন গাড়ির দিকে৷ এই গাড়ি দেখলে তার মুখ থেকে আপনা-আপনিই গালাগাল বেরিয়ে আসে৷ তাছাড়া এমনিতেও শারফান বকা খাওয়ার মতোই কাজ করে বসে আছে৷ গতকাল জন্মদিন গেছে ওর‚ সকালবেলা মা-বোনের সঙ্গে দায়সারা দুটো কথা বলে আর সারাটাদিনেও কোনো কল করেনি‚ কল ধরেনি৷ আর তারপর তো সারাটা রাত ফোনই বন্ধ। এ নিয়ে জেসমিন বেগম আর জারার মাঝে গোটা রাত এত দুশ্চিন্তা চলেছে যে‚ ঠিকমতো ভাতটাও তারা খায়নি রাতে আর তাকেও একটু শান্তিতে থাকতে দেয়নি। কারণ‚ জীবনে হাজার অন্যায় করলেও ফোন বন্ধের মতো অকাজটা শারফান ওর ফোন ব্যবহারের জীবনে কোনোদিনও করেনি।
অপ্রকাশিত সত্য হলো‚ এ কারণে দুশ্চিন্তা শাফিউল সাহেবেরও হচ্ছিল। এহসানের সাথে কথা বলেও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি ওর।
“কীরে নবাবের বাচ্চা নবাব”‚ জানালার কাছে এসেই চেঁচামেচি শুরু করলেন তিনি‚ “তোকে বলেছি না ছয় মাসের ভেতরে আর বাড়ি আসবি না তুই? আর কালকে রাতে কোন ক্লাবে গিয়ে মরে ছিলি‚ হ্যাঁ? নাম বল… তোর প্রত্যেকটা মেম্বারশিপ আমি ক্যান্সেল করার ব্যবস্থা করব আজই।”
অপ্রস্তুত চেহারায় তখন এহসান গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। সালাম দিল সৌজন্যপূর্ণ হাসি টেনে৷ তাকে দেখে একটু বিব্রত হলেন শাফিউল সাহেবও। তারপরই ভ্রু কুঁচকে ফেললেন শারফানের গাড়ি তার কাছে দেখে। “কী ব্যাপার?” স্বভাবজাত গম্ভীর গলায় বললেন‚ “সকাল সকাল হাজির হলে যে? কী এমন দরকার পড়ল? গতকাল যখন কল করলাম তখনো তো কিছু বললে না দরকারের কথা। শায়াফের গাড়িইবা তোমার কাছে কী করে? দিল তোমাকে ও?”
“ইয়ে… মানে”‚ বিব্রত মুখ করে বলল এহসান‚ “শায়াফ স্যারই দিল। আর গতকাল কিছু না বলতে নিষেধ করেছিল স্যারই। স্বশরীরে আজ সকাল সকাল হাজির হতে বলল আপনার সামনে।”
“কেন?” প্রশ্নটা করেই বাসার ভেতরে পা বাড়ালেন তিনি। পিছু পিছু চলল এহসানও।
লিভিংরুমে ঢুকেই শাফিউল সাহেব কাজের মেয়েটাকে ডাকলেন চা করার জন্য৷ তারপর বসলেন সোফায় এহসানকে নিয়ে। তার হাতে ব্যাগ দেখে বেশ কৌতূহল আর খানিকটা সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন‚ “আবার কী ক্যাচাল করেছে ও? কী করতে পাঠিয়েছে তোমাকে?”
“আমি কিছু জানি না‚ স্যার”‚ বলে অফিস ব্যাগ থেকে শারফানের দেওয়া ফাইলগুলো আর ট্যাবটা তুলে দিল সে শাফিউল সাহেবের হাতে৷
ফাইলগুলোর মাঝে দুটো ফাইল দেখেই চিনতে পারলেন তিনি‚ কালো ফাইলটাতে শারফানের নতুন কোম্পানির প্রয়োজনীয় যাবতীয় কাগজপত্র‚ আর লাল ফাইলটাতে ওর শেয়ারের দললিপত্র। বাকিগুলোতে হয়ত কোম্পানির নানান কাজের জরুরি কিছু কাগজপত্র হবে৷ কিন্তু এগুলো পাঠানোর মানে কী? বেশ চিন্তা নিয়ে সেসব হাতে নিলেন। আর ট্যাবটা রাখলেন কোলের ওপর৷ এহসানের দিকে প্রশ্ন চোখে একবার তাকিয়ে লাল ফাইলটা খুললেন আগে। তখনই দু ভাঁজ করা একটা কাগজ পড়ল হাতে—চিঠি! রীতিমতো অবাকের পর অবাক তিনি৷ ছেলে তার আবার চিঠিও লিখতে জানে? তাও আবার বাপকে লিখে পাঠিয়েছে? আশ্চর্য তো!
ফাইলটা রেখে দিয়ে চিঠিটা মেললেন শাফিউল সাহেব। ছেলে যেমনই হোক‚ বরাবরই ওর হাতের লেখায় সন্তুষ্ট হন তিনি৷ তবে এ মুহূর্তে আর পারলেন না সন্তুষ্ট হতে৷ ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া বাচ্চাদের মতো লিখতে গিয়ে চিঠির কতগুলো জায়গায় কাটাকাটি করেছে শারফান। চিঠিটা লিখেছেও নিয়ম ছাড়া—কোনো সম্বোধন নেই।অসীম কৌতূহল নিয়ে সেটাই পড়তে শুরু করলেন তিনি।
“পাঠিয়ে দিলাম তোমার দুই চক্ষুশূল আর আমার প্রিয় কালামানিককে। খবরদার! বিক্রি করার কথা চিন্তাও করবা না। বানি সুস্থ হওয়ার পর ওকে ড্রাইভ করা শেখাবে আমার কালামানিকটা দিয়েই৷ এবার শোনো‚ তোমার অস্ত্রটা আবারও চুরি করেছি আমি৷ রিল্যাক্স‚ আগেই গালাগালি দিয়ো না৷ ভেবেছিলাম কাজে লাগাব। পরে ভাবলাম‚ এই বুড়ো বয়সে যদি হাজতে গিয়ে থাকতে হয় তোমাকে! আম্মুর কষ্টের কথা ভেবে তাই একটু মায়া হলো। ওটা আমার বেডরুমে বালিশের নিচে রেখে দিয়েছি।”
চিঠির এ পর্যায়ে এসে শারফান প্রথমবার সম্বোধন করল—
আব্বু‚
বানি হওয়ার পর তুমি প্রায়ই বলতে‚ আমিও যদি মেয়ে হতাম তাহলে তুমি বেশি খুশি হতে। আমার মতো ছেলের চেয়ে দশটা মেয়ে সন্তানের বাপ হওয়া তোমার জন্য শান্তির বলতে। কথাটা এখন আমিও মানি‚ বুঝেছ? সেদিন তুমি বলেছিলে না‚ বানির পরিণতির দায়ভার সব থেকে বেশি আমারই? রাগের মাথায় বলেছিলে জানি। কিন্তু আদতেই সেটা সত্য৷ আমার বানির জীবনটা শেষ করার জন্য আমিই দায়ী‚ তা আমি দেরিতে বুঝলেও শাস্তিটা গ্রহণ করতে দেরি করছি না৷ কোন কথা থেকে কোন কথাই চলে এলাম! পরের কথা আগে বলার অভ্যাস আমার‚ তা তো জানোই৷ তাই একটু কষ্ট করে বুঝে নিয়ো৷
আব্বু‚ আমি না শুধু আমার জারার জীবনটাই শেষ করিনি৷ আমার ধ্বংসাত্মক রাগ আমার সানাকেও শেষ করে দিয়েছে৷ আমি যা করেছি তার সঙ্গে‚ তার সমস্ত স্বীকারোক্তি আমি ট্যাবটাতে রেকর্ড করে রেখেছি৷ স্বীকারোক্তিটা কাজে লাগবে বলেই রেকর্ড করেছি। ওটা শোনার আগে আমার কথাগুলো পড়া শেষ করো।
সাতটা দিন সানাকে বন্দি রেখে যে অমানবিক নির্যাতন করেছি‚ তার ফল ভোগ করছে ও খুব করুণভাবে৷ আমার একমাত্র চাওয়া হলো‚ জারার ভবিষ্যতকে তুমি যতটা স্নেহ আর দায়িত্বের সঙ্গে সুন্দর করার চেষ্টা করবে‚ ততটাই দায়িত্ব নেবে তুমি সানার ভবিষ্যতকেও সুন্দর করতে। জারার থেকে এক বিন্দুও কম স্নেহ করবে না ওকে‚ বলে দিলাম! এটা হয়ত তোমার শেষ মাশুল আমার অন্যায়ের। আমার চাওয়া বলো আর আবদারই বলো‚ ও বা ওর পরিবার তোমাকে ফেরালেও তুমি হাল ছাড়বে না‚ আব্বু৷ আরও মেয়ের আশা করতে না তুমি? ধরে নাও আমি সেই আশা পূরণ করে দিলাম বিরাট এক পাপ করে৷ শুধু খাতা কলমেই ওকে মেয়ে বলে স্বীকৃতি দিতে পারবে না‚ এই আরকি। ও খুব সুন্দর সরল আর ভীষণ ভালো‚ আব্বু৷ ওকে দেখলে আর ওর কণ্ঠ শুনলেই তোমার আদর করতে মন চাইবে। শুধু ওর জন্যই এত কষ্ট করে চিঠি লিখতে বসেছি। বুঝতে পারছ তাহলে‚ ও কতটা প্রেশিয়াস গুরুত্বপূর্ণ?
আজকে রাতে আমাকে যেতে হবে কামরাঙ্গীচর৷ রাজনের ডেরা ওখানেই৷ কোন রাজন চিনতে পেরেছ নিশ্চয়ই। এবার চমক দিই তোমাকে‚ ও সর্বপ্রথম ফারনাজের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল আমাকে খুন করার জন্য৷ আমার কার অ্যাক্সিডেন্টের কাজটা ফারনাজ যে ওকেই দিয়েছিল‚ তা বুঝতে পেরেছি আমি৷ তারপরই ওরা হাত বাড়াল আমার জারার দিকে৷ মাফিয়া বাবলু ভুঁইয়া ওরই আপন চাচাত ভাই৷ কতবার বাবলুকে আমার কত কাজে ব্যবহার করেছি! তখনো জানতাম‚ বাবলুর রোজগারের বিরাট একটা মাধ্যম বিদেশে নারী পাচার। কিন্তু সে সময়ে কখনো মনে হয়নি‚ এই শুয়োরের বাচ্চাদের চিরতরে নির্মূল করা উচিত। যদি না জারার সঙ্গে আজ খারাপটা হত‚ এই রিয়েলাইজেশন আমার কখনোই হত না হয়ত৷
রাজন আর বাবলুকে এক সঙ্গে শিকার করার জন্যই আমি নিজেকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করছি‚ আব্বু। নয়ত ওদেরকে হাতেনাতে প্রমাণসমেত কেউ কোনোদিন ধরতে পারবে না। যদি আমি ফিরতে পারি‚ তাহলে আমার অন্যায়ের সাজা আমিই ভোগ করব। তোমাকে কোনো ভোগান্তিতে পড়তে হবে না। রেকর্ডিংটা এজন্য সামলে রেখো। আর যদি ফেরা না-ই হয়‚ সেই মানসিক প্রস্তুতও আমি নিয়ে নিয়েছি৷ ধরে নেব ওটাই হবে আমার পাপের খেসারত। তুমি তখন আবার নতুন করে স্ট্রোক করতে যেয়ো না! এই মোটা শরীর বানানোর জন্য যদি বারবার স্ট্রোক ফিস্ট্রোক করো‚ তাহলে অমন মোটা হয়ে লাভ কী?
শোনো আব্বু‚ আমি সবটা হিসাব-নিকাশ করেই ডিসিশন নিয়েছি। বানিকে কিছু বোলো না। আম্মুকে সামলে নিয়ো।
– শায়াফ
শাফিউল সাহেবের মনে হলো‚ যত সব আজগুবি কথা শুনলেন তিনি এতক্ষণ। কথাগুলো পড়ার সময় শারফানের কণ্ঠটাই কানে বাজছিল তার৷ সবটা বুঝেও কিছুই যেন বুঝলেন না৷ কেবল এক জায়গায় জমে রইলেন বরফের মতো। রাজন আর বাবলুর মতো মাফিয়া বা সন্ত্রাসের বিষয়ে পুরোদস্তুর জ্ঞান আছে তার৷ তাদের কাছে নিজেকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে যাচ্ছে শারফান‚ তারপর আর নাও ফিরতে পারে ও—চিঠির এখানেই তিনি আটকে রইলেন। বুঝতেই পারলেন না‚ চিঠি ধরা হাতদুটো তার কাঁপতে শুরু করেছে৷
এহসান বসে চুপচাপ ফোন ঘাঁটছিল। তাই খেয়াল করল না কিছুই৷ এর ভেতরে দোতলা থেকে নেমে এলেন জেসমিন বেগম। হাতে শাফিউল সাহেবের ফোন। সেটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন‚ “অনেকক্ষণ ধরেই বাজছে মনে হয়। দেখেন‚ কে কল করছে।”
ফোনটা রাত হলে সাইলেন্ট করে সরিয়ে রাখা হয় শাফিউল সাহেবের কাছ থেকে৷ ঘুমের মাঝে হঠাৎ ফোন বেজে উঠলে চমকে উঠে তার হৃৎস্পন্দন বেকায়দারকম বেড়ে যায় বলেই ফোন ব্যবহারে এখন অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে তাকে। তাই জন্যই ভোরবেলা থেকে আসা ফোনকলগুলোর ব্যাপারে কিছুই টের পাননি।
স্ক্রিনের ওপর ভেসে উঠেছে বিদেশি একটি নম্বর। শাফিউল সেদিকে রোবটের মতো চেয়ে থেকে হঠাৎ কী যেন ভেবে জলদি রিসিভ করলেন কলটা।
“আঙ্কেল?” ডেকে উঠল ইয়াজ।
কিন্তু কণ্ঠটা চিনতে পারলেন না শাফিউল। “কে?” উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। মন বলছে তার‚ শারফান সম্পর্কিতই হবে কলটা।
নিজের পরিচয় দিয়ে ইয়াজ অস্থির সুরে বলল‚ “আপনাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। ঢাকা সিএমএইচ থেকে মেজর শুভ কল করেছিলেন অনেকবার।”
“কী হয়েছে‚ ইয়াজ?” অস্বাভাবিক শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি‚ “তুমি কি শায়াফের বিষয়ে জানো কিছু?”
এক মুহূর্ত চুপ থেকে ইয়াজ জানাল শারফানের প্রতিশোধ পূরণের কথা আর ওর বর্তমান অবস্থানও৷ কিন্তু কতটা বিপদের মাঝে আছে সে‚ কেবল সেটুকুই এড়িয়ে গেল।
শারফান নিজে থেকে কোনো নিরপত্তা না চাইলেও সে জানত‚ ইয়াজ সবটা জানার পর ওই সুদূর আমেরিকা বসেই সে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে ওকে সবরকম সাহায্য করতে চেষ্টা করবে। এমনকি এ চেষ্টাও করবে‚ যেন কোনোভাবেই ও না যেতে পারে রাজনের আবাসে। সে জন্যই নির্ধারিত সময়ের আগে গতরাতে বেরিয়ে পড়েছিল সে বাবলুর সঙ্গে৷ এবং এ কারণেই স্পেশাল ফোর্স সঠিক সময়ে পৌঁছালেও ওকে বিপদমুক্ত করতে পারেনি।
বাবলু কতটা বিপজ্জনক আর লোভী‚ তা শারফান জানত বলেই তার সহায়তা নিতে দ্বিধায় পড়েছিল৷ এবং রাজনের সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক। দুজনের মাঝে দ্বন্দ-কলহ থাকলেও বাবলু পরের জন্য নিজের রক্তকে বিনাশ করতে চাইবে‚ ভ্রাতৃত্ববোধ কাজ করবে না তার মাঝে‚ এ বিশ্বাস মোটেও করেনি শারফান। অনেক ভাবনাচিন্তা করেই তারপর সে পরিকল্পনা সাজিয়েছিল‚ ঠিক কী করলে ওদের দুজনকে একসঙ্গে জালে আটকানো যাবে। তাছাড়া একমাত্র বাবলু ছাড়া রাজনের কাছ অবধি পৌঁছানো সম্ভবও ছিল না কারও। একমাত্র বাবলুই জানত‚ ঠিক কোথায় মূল আস্তানা ছিল রাজনের। এবং যেখানে কোনোদিনও পুলিশের পা পড়বে না।
ইয়াজের একমাত্র চাচা বাংলাদেশ সেনাপ্রধান। ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য প্রার্থনা করেছিল সে তার কাছেই। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা রাজন আর বাবলুর মতো মাফিয়া গোছের সন্ত্রাস‚ মাদক ব্যবসায়ী ও নারী পাচারকারীকে শিকার করতে যেহেতু পুলিশ থেকে শুরু করে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হাত-পা গুটিয়ে রেখেছে‚ ইয়াজের সমস্ত তথ্যকে যাচাই করার পর সেহেতু তিনি ফোর্স পাঠাতে কোনো দ্বিধা করেননি।
ফোনটা কান থেকে নামিয়েই শাফিউল সাহেব দাঁড়িয়ে পড়লেন তড়াক করে। চিৎকার করে ডেকে উঠলেন ড্রাইভারকে‚ “খালিদ‚ গাড়ি বের কর আমার।”
মাত্রই দোতলায় পৌঁছালেন জেসমিন বেগম। স্বামীর আচমকা চিৎকার শুনে কেঁপে উঠলেন। ফিরে তাকিয়ে দেখলেন‚ টলমল করছে শাফিউল সাহেবের পা দুটো‚ পড়ে যাবে এক মুহূর্তের মাঝেই৷ ভয় পেয়ে ছুটে গেলেন তার দিকে৷ তবে তার আগেই এহসান উঠে জলদি চেপে ধরলেন শাফিউল সাহেবকে। বসিয়ে দিতে চাইলেও বসলেন না তিনি৷ হাঁসফাঁস করে বললেন শুধু‚ “গাড়িতে নিয়ে চলো আমাকে। সিএমএইচ হাসপাতাল… আমার শায়াফ… আমার পাগল ছেলেটা ওখানে!”
***
মালিবাগ
বিকাল ৪: ২০ মিনিট।
আজ জোর করেই সানাকে নিয়ে ছাদে এসেছেন মামি রেশমা৷ এ বিল্ডিংয়ের ছাদটা বিকাল হলেই জমে ওঠে বিল্ডিংয়ের সকল গৃহিণী আর ছেলে-মেয়েদের আড্ডায়৷ প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের অবশ্য আসার সুযোগ হয় না এই মহিলাদের মাঝে।
সবার সঙ্গে সানাকে আলাপ করিয়ে দেওয়ার পর হঠাৎ একজন মহিলার গল্প শুনতে শুনতে রেশমা সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। মহিলাটি পেশায় একজন নার্স। চাকরি করেন সিএমএইচ হাসপাতালে৷ ফারজানা তার নাম। তার গল্প শোনার মতো ধৈর্য সানার একদমই নেই। কিন্তু চলে যাওয়াটা অভদ্রতা হয়ে যেতে পারে বলে বাধ্য হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল সে মামির পাশেই। মনটা অবশ্য উদাস ওর। তাই মহিলার গল্প চললেও সেসব পুরোপুরি কানে ঢুকল না।
“ভিআইপি মানুষের ছেলে বলেই কথা না শুধু। সরাসরি সেনাবাহিনীর প্রধান আসিফ চৌধুরীর নির্দেশ ছিল নাকি! কী যে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় নিয়ে আসছিল ছেলেটাকে! চোখ ভরা ঘুম থাকলেও অপারেশনের সময় ঘুম পালায় গেছিল। আমি তো ভাবছিলাম মরেই যাবে৷ শক দেওয়ার পর যে টিকে যাবে‚ তা কেউ-ই ভাবি নাই।”
“কোন ভিআইপির ছেলে গো‚ ভাবি?” গল্পের মাঝে জিজ্ঞেস করলেন একজন।
“কোন এমপির ছেলে না ভাতিজা যেন। এমপির নাম মনে নেই৷ আরে ওই যে হক গ্রুপ চেনেন তো?”
সবাই হ্যাঁ জানালে তিনি বললেন‚ “ওই হক গ্রুপের মালিকের ছেলে৷ নাম শারফান শায়াফ।”
***
চলবে।