মনাকাশে ধ্রুবতারা বেশে পর্ব-৪৮+৪৯+৫০

0
6

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৪৮.

৮ এপ্রিল
দুপুর ৩:৪০

সিএনজি ধরে থেরাপির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল সানা। রোদে ঝিম ধরা দুপুরের ভেতর চুপচাপ বসে ছিল প্রিন্সের পাশে। আচমকা জিজ্ঞেস করল সানা‚ “সিএমএইচ হাসপাতাল চেনো‚ ভাইয়া?”

ফোনে চোখ রাখতে রাখতেই প্রিন্স বলল‚ “হুঁ, চিনি। কেন?”

“ওখানে নিয়ে চলো আমাকে”‚ ভীষণ শান্ত কণ্ঠ অথচ চোখেমুখে স্পষ্ট উদ্বেগ ওর।

প্রিন্স এবার চোখ তুলে তাকাল‚ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল‚ “হঠাৎ সিএমএইচ কেন যাবি? কী কাজ ওখানে?

মুখটা নুইয়ে সানা বসে থাকল কিছুক্ষণ। প্রিন্স বুঝতে পারল‚ কিছু একটা আছে। এমন কিছু যা সানা লুকোতে চাইছে। বছর তিনেকের বড়ো ভাই সে। এবার সন্দিগ্ধ গলায় জানতে চাইল‚ “কে ভর্তি ওখানে?”

সরাসরি চোখে তাকাতে পারল না সানা। ধীরে বলল‚ “বিশেষ কেউ না… মানে‚ পরিচিত। ফরিদপুরেরই ছেলে। আমার প্রাইভেট টিচারের ক্লোজ ফ্রেন্ড। মাঝে একবার আমাদের ক্লাস নিয়েছিল সে। ওই থেকেই চেনা… আরকি! খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছে সিএমএইচ-এ। তাই ভাবলাম একবার দেখে আসি।”

সানা যতই নিজের আবেগ ঢাকার চেষ্টা করুক বা আসল সত্য‚ কথাগুলো শুনে বুঝে গেল প্রিন্স‚ লোকটা ওর জীবনে সাধারণ কেউ নয়। তাছাড়া ওর কণ্ঠে কোনো জেদ নেই। কিন্তু একটা আবেগ লুকিয়ে আছে স্পষ্ট। সেটা ধরতে সময় লাগল না প্রিন্সের৷ গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল‚ “ওনার নাম কী?”

“শারফান শায়াফ”‚ একটু ইতস্তত করে বলল সানা।

এবার সোজা হয়ে বসল প্রিন্স। কৌতূহলে ঝিলিক দিল তার চোখদুটো‚ “ফেসবুকে যে ভাইরাল হয়েছে? যার নামে হ্যাশট্যাগ হচ্ছে?”

নীরবে সানা মাথা নেড়ে সায় দিল৷ একটু যেন চিন্তায় পড়ে গেল প্রিন্স। জিজ্ঞেস করল‚ “কোন ইউনিটে আছে জানিস?”

ডানে-বামে মাথা নেড়ে বলল সানা‚ “তুমি খুঁজে নিতে পারবে না?” এমনভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল‚ যেন একটা ছোটো বাচ্চা আস্থার জায়গা খুঁজছে।

প্রিন্সের মায়া লাগল। এমনিতেও সে ফুপাত সব বোনের মাঝে ওকেই বেশি পছন্দ করে—ওর স্বচ্ছ মনটার জন্য। উপরন্তু ওর জীবনের দুর্ঘটনায় স্নেহটা আরও বেশি কাজ করে তার৷ ওর সরল দৃষ্টি আর সহজ সুরের কথা শুনে মমতা আরও বেড়ে গেল। হাসল না‚ সান্ত্বনাও দিল না। শুধু বলল‚ “হাই প্রোফাইল রোগী হলে নিরাপত্তা কড়া হয়। লোকটা একজন এমপির ভাতিজা আর শিল্পপতির ছেলে বা নিজেই একজন শিল্পপতি। অপরাধী ধরতে গিয়ে সে আহত হয়েছে। এখন মিডিয়া কভারেজের মধ্যে আছে নিশ্চয়ই। সেখানে ঢুকবি কী করে? আর গার্ডিয়ান পারমিশন ছাড়া দেখতে পারবিই বা কী করে?”

“পারব না?” হতাশা ফুটে উঠল সানার চেহারায়। মুখটা একদম ঘুরিয়ে নিল। আর কিছু বলল না।

প্রিন্স গভীরভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ফোনটা বের করে কাউকে কল দিল৷ রিসিভ হতেই হঠাৎ বলে উঠল‚ “সায়েম ভাই‚ আমি প্রিন্স বলছি।”

ওপাশ থেকে জবাব আসার পর আধা মিনিট সৌজন্য আলাপ চলল। তারপর আসল কথা পাড়ল প্রিন্স‚ “ভাই‚ সিএমএইচে আমার এক বন্ধু ভর্তি‚ আইসিইউতে। একটু দেখতে আসছি। ভিজিটর পাস ম্যানেজ করে দেওয়া যাবে?”

সায়েম লোকটা নিরাশ করল না প্রিন্সকে৷ ফোনটা রাখতেই অবাক চোখে তাকাল সানা‚ “ভিজিটর পাস?”

প্রিন্স হাসল ওর অভিব্যক্তিতে‚ “ওখানে ঢুকতে হলে ওদের কাছ থেকে এক্সটার্নাল টোকেন লাগে। আমি তো আর এমপি না। তবে চিন্তা করিস না। এক ভাই কাজ করে এখানে। ও ম্যানেজ করে দেবে বলেছে। কাচঘেরা ইউনিট থেকে দেখা যাবে পেশেন্টকে।”

তারপর সিএনজি ঘুরিয়ে ওরা রওনা দিল সিএমএইচের দিকে। গত দুদিনে দ্বিধা‚ কষ্ট‚ অপরাধবোধ‚ সব মিলিয়ে এমনভাবে বিষণ্ণ জালে জড়িয়ে ছিল সানা‚ ওর মনে হচ্ছিল শ্বাসটাও নেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে৷ দোদুল্যমান মনে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না কিছুই। নিজেকে বোঝাচ্ছিল‚ চিরতরে ভুলে যাওয়া দরকার ওই লোকটাকে৷ ভুলে থাকায় ভালো। কিন্তু সারাটাক্ষণ রায়হানের বলা কথাগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল‚ “মন থেকে ভয় বা ঘৃণা দূর করতে হলে তুমি আগে তোমার মনের দরজাটা খুলে দাও। অনুভূতিগুলোকে আসতে দাও।”

আজ সেই চেষ্টায় করছে ও। দ্বীধাহীনভাবে মনের দরজাটা এবার খুলে দেবে। দেখবে‚ শারফানকে দেখার পর ওই মনটা কী চায়? জবাবটা নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে তখন?

ফেসবুকে দিনভর শারফান সংক্রান্ত সব স্ট্যাটাস‚ ওর ছবি‚ নিউজ লিংক চোখে পড়েছে ওর। জিসানের আবেগঘন পোস্টের পর আচমকা জাবির পুরনো ও নতুন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও আলোড়ন তৈরি হয়। তারাই একযোগে হ্যাশট্যাগ শুরু করে ফেসবুকে শীর্ষ ট্রেন্ডিং টপিকে পরিণত করে শারফানকে। ওর সকল বন্ধুমহল‚ শুভাকাঙ্ক্ষী‚ ওকে স্নেহের চোখে দেখা শিক্ষকসহ বহু মানুষই নিজেদের অনুভব প্রকাশ করছে নিজ নিজ টাইমলনইনে। যাদের মাঝে ছিলেন অমিতও৷ তার লেখায় উঠে এসেছে—
“যাদের ধরার মতো সাহস কিংবা আগ্রহ প্রশাসনের ছিল না‚ যাদের কুকর্মের প্রমাণ কোনো গোয়েন্দা ইউনিটের হাতেও ছিল না‚ সেই শত্রুদের পর্দা ফাঁস করেছে ফরিদপুরের এক দুঃসাহসিক ছেলে‚ শারফান শায়াফ। আমি তার অন্য কোনো পরিচয় দিয়ে তাকে চেনাতে চাই না৷ আমি তাকে চেনাতে চাই‚ যে ভাই নিজের ছোটো বোনের অপমানের জবাব দেওয়া থেকে শুরু করে দেশের অগণিত মেয়ের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি নিয়েছে‚ সেই ভাইকে…”

সাবেক সেনা অফিসার হওয়ায় তার পোস্টটি শেয়ার হচ্ছে প্রচুর। শারফানের এই সাহিসকতা সমগ্র ফরিদপুরবাসীকেও করেছে গর্বিত। ফরিদপুরের ছাত্রসমাজও তাই অংশ নিয়েছে হ্যাশট্যাগে। এজন্যই ফেসবুকে চোখ রাখলেই বারবার শারফানকে দেখতে হয়ে সানাকে। এমনকি ফারনাজ কবিরের শাস্তির দাবিতেও ট্রেন্ড শুরু হয়েছে।
#prayforsharfan
#justiceforhissister
#justiceforzara

একের পর এক ফেসবুক শেয়ার‚ শারফানের ছবির নিচে হাজারো প্রার্থনা‚ এসব দেখে অজান্তেই চোখ ভিজে উঠেছিল সানার। শারফানকে ভুলে থাকার কথা ভেবেছিল বারবার। কিন্তু নিজের হৃদয়ের শব্দ‚ নিজের মনের ভেতরের দোলাচল থামাতে পারেনি সে। তাই সিদ্ধান্ত নেয়‚ নিজেকে বুঝতে হলে শারফানকে দেখতে যেতে হবেই ওকে।

সিএমএইচে পৌঁছানো পর প্রিন্স ফোনে যোগাযোগ করল সায়েমের সঙ্গে। তাকে সমস্ত বিষয় ব্যাখ্যা করল সে। সানার মানসিক ট্রমা‚ শারফানের সঙ্গে ওর পূর্বপরিচয়‚ তাকে দূর থেকে দেখার ইচ্ছা। সবটা শুনে সায়েম রাজি হয়ে গেল সাহায্য করতে। মিনিট দশেক পরই হাসপাতালের মেইন লবির রিসেপশনে পৌঁছাল ওরা। প্রিন্স কাউন্টারে গিয়ে নিজের আইডি কার্ড দেখিয়ে সাইন করে নিল‚ পরিচয় দিল সংশ্লিষ্ট বড়োভাইয়ের রেফারেন্সে। কিছুক্ষণ পর এক অফিসার হাতে একটা ভিজিটর পাস কার্ড তুলে দিল। প্রিন্সকে বলল‚ “শুধু একজন ঢুকতে পারবেন এই কার্ডে। টাইম উইন্ডো পাঁচ মিনিট। পেশেন্ট ইউনিটে প্রবেশ করা যাবে না। কাচঘেরা করিডরের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখা যাবে শুধু।”

ভিজিটর কার্ডটা প্রিন্স সানার হাতে তুলে দিয়ে বলল‚ “এই কার্ডে ভেতরে ঢুকবি। কাচের এপাশ থেকে দেখতে পারবি। পেশেন্ট ইউনিটে ঢোকা যাবে না।”

কিছু না বলে মাথা ঝাঁকাল সানা। একা যেতে হবে শুনে একদিকে জড়তা আর অস্বস্তিতে কেমন গুটিয়ে গেল সে ভেতর থেকে। অন্যদিকে বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত ধুকপুকুনি শুরু হলো ওর৷ বুকের বাঁ পাশে যেন টেনে ধরল একটা চেনা আবার না চেনা অনুভূতি। সেই চেনা না চেনা অনুভূতির নামটা কী? সানা নিজেও জানে না তা।

আইসিইউ ইউনিট নিস্তব্ধ। ঘড়ির কাঁটার টিকটিক আর মনিটরের বিটের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। ঘরের আলো ম্লান। শারফানের চোখজোড়া আধা খোলা‚ কিন্তু দৃষ্টিতে স্থিরতা নেই। মুখে হাই-ফ্লো অক্সিজেন মাস্ক‚ হাত-পায়ে ইন্ট্রাভেনাস লাইনের গাঁট‚ বুকের দিকে ইসিজি লিড। মনিটরের সবুজ রেখাগুলো শ্বাসের মতোই উঠছে-নামছে। ওর নিথর শরীরটাকে ঘিরে তিনজন চিকিৎসক‚ দুজন নার্স টানা পর্যবেক্ষণে থাকে সব সময়।

ডা. তৌকির মনিটরের ডেটা যাচাই করছিলেন চুপচাপ। এর মাঝেই হঠাৎ শারফানের গলা দিয়ে এক দমবন্ধ হয়ে আসা ঘড়ঘড়ে শব্দ বের হলো। মনিটরে অ্যালার্ম বেজে উঠল‚ টিট টিট টিট টিট… শব্দটা দ্রুত বাড়ছে। তিনি চমকে উঠে মনিটরের দিকে আরও ঝুঁকে পড়লেন।

রোগীর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্স সিমি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল‚ “স্যার! রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! ঘাড়‚ বুক সব টান টান হয়ে যাচ্ছে! কনভালসিভ মুভমেন্ট শুরু!”

পাশের ওয়ার্কস্টেশন থেকে মনিটরের অ্যালার্ম শুনতেই ডা. ইমরান দ্রুত ছুটে এলেন। ততক্ষণে ডা. তৌকির নির্দেশ দিলেন‚ “ওর পজিশন ঠিক করো! মাথা সাইডে নাও। সাকশন টিউব ইনসার্ট করো। এয়ারওয়ে ব্লকড হচ্ছে!”

মনিটর দেখে তিনি যোগ করলেন‚ “রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ ছিয়াশি থেকে তিরাশিতে নেমে যাচ্ছে! প্রেশার সত্তর বাই পঁয়ত্রিশ! হার্টবিট পঞ্চান্ন!”

“রেসপিরেটরি ডিসট্রেস শুরু হয়েছে”‚ ডা. ইমরান গলা নামিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন‚ দ্রুত সাকশন চালাও। নল খুলে ট্র্যাকিয়া পরিষ্কার করো। সম্ভবত সেক্রেশন জমে গেছে ফুসফুসে।”

সিমি রিফ্লেক্সে টিউব ঢুকিয়ে সাকশন চালু করল। সেই ফাঁকে নার্স ফারজানা ইনজেকশন প্রস্তুত করছিল, তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল‚ “স্যার! শরীর ঝাঁকুনি দিচ্ছে৷ সেডেটিভ দেব?”

“না! আগে রেসপিরেশন স্ট্যাবিলাইজ করো। ব্রংকোডায়লেটর রেডি রাখো‚ যদি ব্রংকোস্পাজম হয়।”

কয়েক সেকেন্ড পর ফারজানা রিপোর্ট করল‚ “স্যার‚ মুখে ফেনা জমছে… ঠোঁট-চোখ নীলচে হয়ে যাচ্ছে… ব্লু ডিসকালারেশন!”

“অক্সিজেন মাস্ক খুলে হাই-ফ্লো বাড়াও”‚ ডা. ইমরান দ্রুত নির্দেশ দিলেন‚ “ভেন্টিলেটর ফ্লো ফুল ওপেন করো! আইভি ফ্লুইড পুশ করো এখনই। হাইপো টেনশন চলতে থাকলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে যেতে পারে!”

“স্যার‚ বুক কমপ্রেশন করব?” সিমি জিজ্ঞেস করল।

“না‚ এখনো পালস আছে। কিন্তু সবাই রেডি থাকো। অ্যারেস্ট হলে সঙ্গে সঙ্গে সিপিআর শুরু করতে হবে।”

তারপর এক মুহূর্তে হঠাৎই শারফানের পুরো শরীরটা নিস্তেজ হয়ে এল। মাথা একদিকে হেলে পড়ল। বুক ওঠা-নামা থেমে গেল একদম। মনিটরের বিপ টোনের গতি কমে এল‚ টিট… টিট… টিট…! প্রতিটি শব্দের মাঝে বাড়তে লাগল বিরতি। কাঁপা কাঁপা সবুজ রেখাগুলো কেমন যেন সোজা হয়ে আসছিল মনিটরে। যেন যেকোনো মুহূর্তে পুরো রেখাটা মিলিয়ে গিয়ে একটাই সরল দাগ হয়ে যাবে।

“স্যার”‚ ফারজানা বলে উঠল‚ “রেসপিরেটরি সাইলেন্স!”

ডা. তৌকির ঝাঁপিয়ে পড়লেন শারফানের বুকের কাছে‚ “পালস ড্রপ করছে। সিপিআর শুরু করো!”

সিমি ওর বুকের ওপর দুই হাত রেখে চাপ দিতে শুরু করল। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে চাপা গলায় গুনতে লাগল‚ “ওয়ান… টু… থ্রি… ফোর… ফাইভ…!” চাপগুলো ছিল দ্রুত‚ কিন্তু ছন্দে বাঁধা। ডা. ইমরান একপলকে মনিটরের দিক তাকিয়ে বললেন‚ “পালস আসছে না এখনো! সিপিআর চালিয়ে যাও। ফারজানা‚ অ্যাড্রেনালিন ইনজেকশন রেডি করো। ওয়ান এমজি। এখনই।”

ফারজানা বলল‚ “স্যার‚ ইনজেকশন ড্র করে ফেলেছি। নিচ্ছি এখন!” তার কণ্ঠে ব্যস্ততা।

“পুশ করো এখনই”‚ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন ডা. ইমরান‚ “আইভি লাইনে সরাসরি দাও। এবং সঙ্গে সঙ্গে মনিটর দেখো। একটু রেসপন্স দিলেই এক্সট্রা অক্সিজেন পুশ করব।”

ডা. তৌকির মনিটরের দিকে চোখ রাখলেন। মনিটরের ওপর এখন শুধু চাপা শব্দ‚ চলমান বিপ টোন। যেন শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে এক জীবন। প্রতিটি সেকেন্ড যেন ঘণ্টার মতো বাজছে ওটিতে। “রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ একেবারে নিচে… হার্টরেট ড্রপ করছে…” তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন‚ “ভেন্টিলেটর প্রেসার বাড়াও‚ সাপ্লিমেন্টারি অক্সিজেন ফুল ফ্লোতে দাও। সেক্রেশন রিমুভ হয়েছে কিনা চেক করো আবার।”

সিমি গুনতে গুনতে চাপ দিতে থাকল‚ “ফিফটিন… সিক্সটিন… সেভেন্টিন…” ঘেমে উঠেছে সে। কিন্তু হাতের গতি থেমে নেই। “স্যার‚ রিপ্লাই নেই”‚ বলে উঠল চিন্তিত সুরে।

ডা. তৌকির এবার নিজে স্টেথোস্কোপ রেখে শুনলেন শারফানের বুকের শব্দ। এক সেকেন্ড… দুই সেকেন্ড…! তখনই হঠাৎ মনিটরের রেখাটা এক মুহূর্ত থেমে গিয়ে আবার টিট… টিট… টিট…!

“হার্টবিট ফিরছে!” মৃদু চিৎকারে বলে উঠল ফারজানা।

ডা. তৌকিরও দেখলেন৷ ধীরে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন‚ “লয়াল রিদম ফিরে এসেছে। পালস স্ট্যাবল। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ছে। ব্রংকোস্পাজম কনফার্মড ছিল।”

ফারজানা জানাল‚ “হার্ট রেটও ধীরে ধীরে রেগুলার হচ্ছে‚ স্যার।”

“গুড। কমপ্রেশন বন্ধ করো। এবার ব্রিদিং পর্যবেক্ষণ করো।”

তারপর ডা. ইমরান বললেন‚ “সাকশন ধরে রাখো। ইনটেনসিভ কেয়ার বাড়াতে হবে। পরের চার ঘণ্টা ক্রিটিক্যাল।”

স্তম্ভিত বেশে সানা তখন আইসিইউ ইউনিটের গ্লাসঘেরা করিডরের ঠিক শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে। যেখানে ভিজিটররা দাঁড়িয়ে রোগীদের দূর থেকে দেখতে পারে। পাঁচ মিনিটের ভিজিটর পাস ওর হাতে। আশপাশে নির্জনতা‚ শুধু দূরে মাঝে মাঝে নরম পায়ে হাঁটার শব্দ। মাথার ওপর সাদা আলোগুলো ঝিমঝিম করছে। সামনে বিশাল কাচের জানালা দিয়ে দেখছিল আইসিইউর ভেতরের পুরো ইউনিটটা। ভেতরে ঝাপসা আলোয় একটাই শয্যা দেখতে পাচ্ছিল সে৷ যেখানে শারফান নিথর অবস্থায় শুয়ে আছে। মুখে হাই-ফ্লো অক্সিজেন মাস্ক‚ গায়ে পাতলা হাসপাতালের চাদর‚ চারদিকে সারি সারি মেডিকেল যন্ত্রপাতি আর মনিটর‚ ওর নিথর শরীরটাকে ঘিরে চিকিৎসক ও নার্সেরা টানা পর্যবেক্ষণে। তারপর আচমকা ভেতরে যেন একটা অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল। একেকজন ডাক্তার আর নার্স দ্রুত এগিয়ে আসে ওর কাছে। কেউ ওর মাথার কাছে ঝুঁকে পড়ে‚ কেউ ওর গলার ভেতর একটা টিউব ঢুকিয়ে কী যেন করতে থাকে‚ আবার বুকের ওপর চাপ দিতে থাকে অনবরত‚ মনিটরের দিকে দেখত থাকে বারবার‚ ইনজেকশন দেয়৷ কারও চোখে-মুখে ভয় নেই ঠিকই। কিন্তু প্রবল উদ্বেগ।

সানা কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না কাচের শব্দনিরোধ দেওয়ালের কারণে। তবুও বুঝতে পারছিল খুব গুরুতর কিছু ঘটছে… শারফানকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। বুকের ভেতরে সে সময় একটা অস্পষ্ট ঝাঁকুনি আর ভয় অনুভব করছিল সে। মাথার মধ্যে কোনো চিন্তাও চলছিল না সে মুহূর্তে। শুধু দৃষ্টিটা আটকে ছিল কাচের ওপারে শুয়ে থাকা ছেলেটার ওপর। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে পড়ার অনুভূতি হয়নি ঠিকই। কিন্তু ওর মনে হচ্ছিল সময়টা থেমে গেছে। কেউ যদি পাশেই গলা ফাটিয়ে কিছু বলত‚ তবুও সে হয়ত শুনতে পেত না।

এই সেই মানুষ‚ যে ওর জীবনের গভীরতম ক্ষতটা দিয়ে গেছে। তবু তাকে এমন নিঃসহায়‚ মৃতপ্রায়ের মতো দেখে বুকের বাঁ পাশে একটা ভারী মোচড় দিয়ে উঠল ওর। কিসের একটা ভার যেন গলায় এসে আটকে রইল। অথচ চোখে কোনো জল এল না। এল না কারণ‚ মনটা এখনো শারফানকে ক্ষমা করার মতো স্থির হয়নি। হৃদয়টা এখনো প্রস্তুত নয় ভুলে যাওয়ার জন্য। ক্ষমা করবে কি না‚ তাও সে জানে না। তবু এই মুহূর্তে মন থেকে একটা কথাই শুধু উঠে এল‚ “ও যেন বেঁচে থাকে।”

এই বেঁচে থাকাটা ওর জন্য নয়। ওর ভালোবাসার জন্যও নয়। এটা জারার জন্য‚ শারফানের মা-বাবার জন্য‚ আর সেই অপরিণত ভালোবাসার স্মৃতির জন্য৷ যা একদিন ওর মনে জন্ম নিয়েছিল‚ স্বীকৃতি না পেলেও।

হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য ওর দৃষ্টি সরে গেল কাচঘেরা করিডরের উলটো দিকে। আইসিইউর ঠিক বাইরের করিডরে রাখা সিটিং এরিয়ায় এক নারী মেঝেতে বসে আহাজারি করছেন। তাকে সামলাতে চেষ্টা করছেন আরও দুজন মহিলা৷ তারাও কাঁদছেন৷ পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন শাফিউল সাহেব। বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা৷ চুপচাপ তাকিয়ে আছেন কাচের ওপারে। যেন কিছু দেখছেন‚ আবার কিছুই না। তার শরীর কাঁপছে। আর চেহারায় এমন এক স্থবিরতা‚ যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। পাশে এক নার্স হাত ধরে তাকে কষ্টেসৃষ্টে শান্ত রাখতে চেষ্টা করছে আর কিছু বলছে৷ রিহানসহ আরও দুজন পুরুষকেও দেখা গেল শাফিউল সাহেবের পাশে। তাদের ঠিক পেছনে একটি ধূসর বেঞ্চ। তার পাশে একজন হাসপাতাল স্টাফ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে৷ হয়ত কোনো প্রটোকলের অপেক্ষায়।

সবার চেহারাতেই কেমন ভয় আর কান্নার আভাস দেখতে পেল সানা। আর বুঝে ফেলল‚ যে মহিলাকে সামলানোর চেষ্টা করছে সবাই‚ তিনি শারফানের মা-ই হবেন। এত দূর থেকেও তাদের মুখভঙ্গি‚ শরীরী ভাষা‚ সব বলে দিচ্ছে কী ভয়াবহ একটা মুহূর্ত পার করছেন তারা। নার্স এসে হয়ত শারফানের ক্ষণিক পূর্বের শোচনীয় অবস্থার কথা অবগত করায় ওকে হারানোর ভয় জেগে উঠেছে সবার মাঝে। তাদের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন প্রস্তরে পরিণত হলো ও। যার মাঝে কোনো শব্দ নেই‚ কান্না নেই। তবু ওর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি আর পেল না যেন। ভিজিটর পাসটা ওর হাতের মুঠোয় চেপে ধরা। ভেতরে চলা নীরব সংঘাত নিয়ে অনুভূতিশূন্যের মতো ফেরার পথে হাঁটতে শুরু করল ধীর পায়ে।

যে ঘৃণা ও বয়ে বেড়াচ্ছে‚ সেই ঘৃণার নিচে জমে আছে কিছু অতল‚ অজানা অনুভব। এটা কি ওর করুণা? না-কি অবচেতন কোনো টান‚ যা সবসময় অস্বীকার করছে সে?

***

রাত ১টা ৪৮ মিনিট
আইসিইউ ইউনিট

বাইরে নিস্তব্ধতা। করিডরের বাতাসটাও যেন থমকে আছে। আইসিইউর ভেতরের আলো ম্লান। আলো-আঁধারির এক নরম আবরণে ঘেরা ঘরটা। আর কখনো জেগে না ওঠার পণ করে যেন ঘুমিয়ে আছে শারফান। তার মাস্কের নিচে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে ধীরে। একপাশে নার্স ফারজানা নিয়মমতো রাউন্ড নিচ্ছিল৷ মনিটর‚ ইসিজি‚ লাইফ সাপোর্টের সবকিছু খেয়াল করছিল এক নজরে। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল শারফানের মুখে। ওর চোখের পাতা সামান্য কেঁপে উঠল যেন। একটু থেমে আবার নড়ল একবার। ফারজানা থেমে গেল কয়েক সেকেন্ড। বুঝতে চেষ্টা করল‚ এটা কি শুধু রিফ্লেক্স? না-কি জেগে ওঠার লক্ষণ? সে আর দেরি না করে এগিয়ে গেল ওর বেডের দিকে। চোখ রাখল মনিটরে। একটু নিচু হয়ে ভালো করে লক্ষ করল ওর চোখের পাতা আর মুখের সাড়া। “স্যার”‚ মুহূর্তেই ডা. তৌকিরকে ডেকে উঠল সে‚ “চোখে রেসপন্স আসছে।”

ডা. তৌকির বসে ছিলেন৷ সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলেন। এক হাত এগিয়ে দিলেন শারফানের চোখের ওপর। আঙুলের হালকা স্পর্শে ওর পাতাটা সামান্য নড়ে উঠল। কিছু সাড়া পেলেন ওর হাতেও। ডান কনুইটাতে একবার টান পড়ল।

“পারশিয়াল কনশাসনেস শুরু হয়েছে”‚ শান্ত গলায় বললেন তিনি‚ “ভেন্ট ফ্লো একটু কমাও। রেসপিরেশন নিজে চেষ্টা করে কিনা দেখি।”

নার্স সিমি এগিয়ে এসে ভেন্টিলেটরের সাপোর্ট মাত্রা একটু নামিয়ে দিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শারফানের বুকে অল্প ওঠানামা হলো। যেন নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করছে নিজে নিজে। ঠোঁটটা কেঁপে উঠল‚ গলার নিচের পেশিতে একটা ঢেউ খেলল। মুখের মাস্কের আড়াল থেকে ভেসে এল অস্পষ্ট‚ রুদ্ধকণ্ঠের একটা গোঙানির মতো আওয়াজ।

ডা. তৌকির ফারজানার দিকে তাকিয়ে বললেন‚ “ভালোর দিকে যাচ্ছে। স্নায়ু রেসপন্স আসছে। স্পাস্টিক মুভমেন্ট নেই। চেতনাটা ধীরে ধীরে ফিরছে।”

“স্যার‚ প্যারালাইসিসের কোনো লক্ষণ?” জিজ্ঞেস করল ফারজানা।

“এখনই বলা যাবে না। কিন্তু হাত-পা সাড়া দিচ্ছে। রিফ্লেক্স টেস্ট করতে হবে ক’ঘণ্টা পর।”

মনিটরের একপাশে তখনো স্থিরভাবে জ্বলছিল কয়েকটি গাঢ় সংকেত। যেগুলো প্রমাণ করে‚ এই মানুষটা এখনো লড়ছে।

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৪৯.

১০ এপ্রিল
বিকাল ৪: ৩০

জানালা দিয়ে বিকালেন নরম রোদ পড়ছে ঘরের ভেতরে। চন্দনের সুন্দর ঘ্রাণ ছোটাছুটি করছে সারা ঘরে—একটা হালকা ইনসেন্স বার্নার থেকে আসছে ঘ্রাণটা। ক্লান্তিতে জর্জরিত সানা থেমে থেমে ওর এলোমেলো কথাগুলো ব্যক্ত করতে শুরু করেছে রায়হানের কাছে৷ রায়হান চুপচাপ শুনছে আর পর্যবেক্ষণ করছে ওকে। কথা বলতে বলতে হাতে একটা টিস্যু মুচড়ে যাচ্ছে সানা অনবরত। একটু থামতেই ওকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিল রায়হান৷ তারপর জিজ্ঞেস করল‚ “ওই সিচুয়েশনে তোমার কেমন অনুভব হচ্ছিল?”

“রাগও না‚ ঘৃণাও না”‚ ধীর স্বরে বিষণ্ণতা নিয়ে বলল সানা‚ “শুধু ভয় লাগছিল… প্রচণ্ড ভয়। কষ্টও হচ্ছিল। এক অদ্ভুত খালি খালি লাগছিল বুকের ভেতর। মনে হচ্ছিল সময় থেমে গেছে। ওর বুকটা আর উঠছে না… ডাক্তার আর নার্সদের কী ছোটাছুটি‚ ওর মায়ের কী চিৎকার করে কান্নাকাটি!”

“তোমার চোখে পানি এসেছিল তখন?”

“হ্যাঁ…” মৃদুস্বরে বলল সানা‚ “চোখ ভিজেছিল। কিন্তু কান্না আসেনি। মনে হচ্ছিল কাঁদব। কিন্তু কোথাও যেন একটা আটকে ছিল সব। দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে শরীরটা অবশ হয়ে আসছিল কেমন। আমি তখন চাইছিলাম‚ ও যেন বেঁচে যায়।”

“বেঁচে থাকাটা তুমি ওর জন্য চাওনি‚ তাই না?”

“না। এই চাওয়াটা কোনো ভালোবাসা থেকেও ছিল না। এটা ছিল একরকমের চাওয়া‚ যেন কেউ মরে গিয়ে এত সহজে পার না পায়! আবার এটাও যেন ছিল‚ ওর মা কাঁদছিলেন যেভাবে… আমি পারছিলাম না সেই কান্না উপেক্ষা করতে। ওই লোকটা যে পৈশাচিক নির্যাতন করেছিল আমাকে‚ সে ওই মায়ের সন্তান। এখন যে শুয়ে আছে হাসপাতালে মরার মতো। এটা সহ্য হচ্ছিল না আমার। আমি বুঝতে পারছিলাম না‚ যে মানুষটা আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে‚ সে মানুষ না দানব? এই প্রশ্নটাই যেন ধোঁয়াশা হয়ে গেল হঠাৎ।”

“তুমি কি জানো‚ সানা‚ এই কথাটা বলার মধ্যেই একটা বড়ো পরিবর্তনের শুরু হয়েছে তোমার?”

সানা দ্বিধা চোখে চাইল‚ “কী পরিবর্তন? আমি তো আজও ঘুমাতে পারি না ঠিকভাবে। চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে‚ একটা হিংস্র কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমার ওপর৷ ও লেলিয়ে দিয়েছে। আমাকে খামচে‚ কামড়ে মেরে ফেলতে চাইছে কুকুরটা৷ আমার তখন মনে হয়েছিল জীবনটা শেষ আমার৷ কখনো জ্ঞান হারিয়েছি‚ কখনো জেগেছি‚ আবার কখনো স্বপ্ন দেখেছি আমার মুক্তির… আমার মৃত্যুর। আমি ক্ষুধার কষ্ট কী তা জেনেছি। কীভাবে ও আমায় জোঁক ভর্তি পুকুরে ফেলে শাস্তি দিয়েছিল…! আমি… আমি এখনো এসব স্বপ্নে দেখি। আমার তখন মনে হয় আমি ওর জন্য ঘৃণা ছাড়া আর কিছু অনুভব করি না। ক্ষমা করতে পারব না ওকে।”

“তুমি তাকে ক্ষমা করোনি। কিন্তু তুমি এক নতুন অনুভূতির মুখোমুখি হয়েছ। তোমার ভেতরের মানবতা তার মৃত্যুর আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছে। এটা দুর্বলতা না। এটা পোস্ট-ট্রমাটিক কমপ্যাশন সিনড্রোম। ভিকটিম ধীরে ধীরে এমন এক জায়গায় পৌঁছায়‚ যেখানে সে নিজেই অনুভব করতে শুরু করে‚ ‘যে মানুষটা আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে‚ সেও হয়ত একসময় মানুষ ছিল। তার ভেতরেও ছিল দুর্বলতা‚ ভ্রান্তি।’ তুমি এখন সেই বাঁকে দাঁড়িয়ে। যেখানে যন্ত্রণার উৎসটাকেও সম্পূর্ণ রূপে ঘৃণা করা আর সহজ থাকছে না। জীবনের একটা জটিলতম বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছ‚ সানা। একই ব্যক্তিকে ঘৃণা ও সহানুভূতি। দু’টো বিপরীত অনুভূতিতে একসঙ্গে অভিভূত হওয়া। এটাকে বলে ‘অ্যামবিভ্যালেন্ট ইমোশনাল রেসপন্স’। এটা স্বাভাবিক‚ আর এটা অসুস্থতা নয়।”

“কিন্তু আমি তো চাইছিলাম ওকে ভুলে যেতে! আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম ওকে দেখতে যাব না! কিন্তু পারিনি নিজেকে আটকাতে। আমি কি তাহলে দুর্বল হয়ে গেছি? আমি ওকে আবার ভালোবেসে ফেলছি না তো?” শেষ প্রশ্নদুটোই হতাশা ফুটে উঠল সানার মাঝে।

“দুর্বলতা যদি হয় মানবিক হওয়া। তাহলে হ্যাঁ‚ তুমি দুর্বল হয়েছ। কিন্তু দুর্বলতা যদি বোঝায় ভুল সিদ্ধান্ত। তাহলে না‚ তুমি দুর্বল হওনি। তুমি একধরনের পরিণত মানবিক অবস্থায় পৌঁছেছ, সানা। যেখানে তুমি বুঝতে শিখছ‚ প্রতিশোধ আর ঘৃণা‚ দুটিই আসলে তোমার নিজের ভেতরের শান্তিকে আটকে রাখছে। তুমি হয়ত এখনো জানো না এটা ভালোবাসা কিনা। জানা জরুরিও নয়। কিন্তু তুমি এখন বুঝতে পারছ‚ তোমার অনুভব শুধু সাদা‚ বা কালো নয়। ওর প্রতি ঘৃণা‚ রাগ‚ ভয়‚ এসব যেমন তোমার মধ্যে ছিল। তেমনি এখন সহানুভূতিও জন্ম নিচ্ছে। এই বিপরীত অনুভবগুলো একসঙ্গে দেখা দেয়‚ যখন মন আর শরীর দুটোই ট্রমা থেকে নিজস্ব পথ খুঁজে নিতে চায়। তখন সেটাকে বলে ‘জটিল আবেগীয় সাড়া’। এটা ট্রমার পর একটা স্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা। মনস্তত্ত্বের ভাষায় যেটাকে আমরা বলি ‘অ্যামবিভ্যালেন্ট ইমোশনাল রিকনসিলিয়েশন’। একই ব্যক্তিকে তুমি দোষী ভাবছ‚ আবার তার জন্য উদ্বেগও অনুভব করছ। এটা খুবই স্বাভাবিক। এই অবস্থাটা যেমন কনফিউজিং‚ তেমনই এর মধ্য দিয়েই একজন মানুষ নিজের মধ্যে বড়ো কোনো পরিবর্তন টের পায়।”

“এর মানে কি আমি ওকে ক্ষমা করে দিচ্ছি?” নিজের অনুভবের প্রতি সেই একই দ্বিধা-দ্বন্দ সানার মাঝে।

রায়হান ধীরে মাথা নাড়াল‚ “ক্ষমা কোনো শেষ স্টেশন না। এটা একটা যাত্রাপথ। তুমি সেই পথে হাঁটা শুরু করেছ শুধু। তুমি এখনো নিশ্চিত না তুমি কোথায় থামবে। কিন্তু তুমি ঠিক পথে এগোচ্ছ। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তুমি শারফানকে ভালোবাসো কিনা‚ এটা জানার জন্য তাড়াহুড়ো কোরো না। কারণ‚ এখন যেটা দরকার‚ সেটা হলো তোমার অনুভবগুলোকে গ্রহণ করা৷ বিচার করা না। তুমি দেখতে গিয়েছ‚ কারণ‚ তোমার হৃদয়ের একটা অংশ চেয়েছে‚ সে যেন সহজে পার না পায়… সে যেন মৃত্যু দিয়ে শাস্তি না পায়‚ আর হয়ত তার মায়ের কান্নার ভেতর তুমি অনুভব করেছ সেই মানবিক টান। এটা ক্ষমার প্রতিশ্রুতি না। এটা সেই জড়তা কাটানোর প্রথম ধাপ। নিজের ব্যথার ভার নামিয়ে রাখার শুরু। এটাই হলো তোমার মুক্তির সূচনা।”

“হ্যাঁ‚ ওকে ভালোবাসি কি-না তা আর বুঝতে চাই না আমি”‚ ক্লান্ত ভঙ্গিমায় মাথাটা একবার নুইয়ে রাখল সানা। নিচু স্বরে বলল‚ “আমি আর এই ঘৃণাটা বয়ে বেড়াতে পারছি না। এই ঘৃণাটা যেন বিষ হয়ে গেছে। আমার দম বন্ধ করে দিচ্ছে। আমি শুধু চাই‚ এই কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে।”

রায়হান ভেবে বলল‚ “তুমি বুঝতে পারছ‚ এই ঘৃণাটা তোমারই ক্ষতি করছে। এই যে বুঝতে পারাটাই হলো অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়া। এটা নিজের শান্তির দিকে এগোনো। ক্ষমা মানে ভুলে যাওয়া না। মানে সম্পর্ক মেরামত করা না। এটা একটা সিদ্ধান্ত শুধু‚ ‘আমি আর এই বোঝা বয়ে নিয়ে চলব না।’ তুমি চাইছ সুস্থ হতে। সেটাই আমাদের থেরাপির সবচেয়ে বড়ো জায়গা।”

“আমি জানি না ও বাঁচবে কি-না। জানি না আমি আসলে কী চাই। কিন্তু একটা ব্যাপার এখন বুঝতে পারছি‚ ওই মুহূর্তে আমি যেটা অনুভব করেছি ওর জন্য। সেটা লজ্জার কিছু না। আমি ভুল কিছু করিনি। আমি শুধু একজন মানুষ হিসেবেই প্রতিক্রিয়া দিয়েছি।”

“এটাই‚ সানা”‚ হাসল রায়হান। কণ্ঠে তার শান্তি‚ “তোমার অনুভবটা একদম ভুল না। এটাই মানবিক প্রতিক্রিয়া। যেটা শুধু তুমি না‚ অনেক ভুক্তভোগীই কখনো না কখনো অনুভব করে। এবং এটাই তোমার আত্মমুক্তির শুরু। তুমি যেটা এখন বলছ‚ ‘আমি শুধু চাই এই কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে’। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর তা শুরু হোক ক্ষমা থেকে। কিন্তু এটা ওর জন্য না। এটা তোমার জন্য‚ তোমার আত্মমর্যাদার জন্য‚ তোমার মানসিক সুস্থতার জন্য‚ তোমার ভবিষ্যতের জন্য।”

“আমি কি পারব?” কণ্ঠটা যেন একটু কেঁপে উঠল সানার।

মাথাটা ঝাঁকিয়ে রায়হান মুচকি হাসল‚ “তুমি তো শুরু করেই ফেলেছ। ক্ষমা কোনো শেষ সিদ্ধান্ত নয়। এটা একটা ধীর প্রক্রিয়া। যার মধ্যে দিয়ে তুমি ধীরে ধীরে নিজের অনুভূতিগুলো বুঝতে শেখো‚ আর যেটা তোমার ভেতরের ভার কিছুটা হালকা করে।”

***

সিএমএইচ
আইসিইউ ইউনিট

শারফান যখন প্রথম চোখের পাতাটা সামান্য নড়াল‚ হাত-পায়ে সামান্য সাড়া দিল‚ তখন ছিল অপারেশনের পঞ্চম দিন। ওই সামান্য কাঁপনটুকুই ছিল যেন কোনো মৃতপ্রায় মানুষের ভেতর থেকে উঠে আসা ধুকপুক শব্দ। তারপর অপারেশনের ছয় থেকে এগারোতম দিন। এই সময়টা ওর শরীর ও মন দুইই যেন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হাঁটছিল। শ্বাস নিতে গেলে ফুসফুসে ব্যথা অনুভব করছিল‚ পেটের অস্ত্রোপচারের জায়গা থেকে মাঝে মাঝে সামান্য রক্তপাত হচ্ছিল‚ পায়েও ছিল তীব্র ব্যথা। মাটিতে পা রাখার প্রশ্নই আসে না সেখানে৷ তবু শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হতে শুরু করল ধীরে ধীরে। নাকের নল দিয়ে অক্সিজেন চলতে লাগল‚ মুখ থেকে মাস্ক সরানো গেল‚ মাঝে মাঝে চোখ খুলে তাকাতে লাগল। চেনা মুখ দেখলে একটুখানি ভ্রু কুঁচকানো‚ ঠোঁট নড়ানো‚ মাঝে মাঝে অস্ফুট শব্দও করত। একদিন শাফিউল সাহেবকে দেখে বলে উঠেছিল‚ “তুমি… এখানে কী করো… সারাদিন?” বহুদিন পর ওর সেই তীক্ষ্ণ‚ জোরাল‚ পৌরুষদীপ্ত স্বর। ক্লান্ত‚ তবু স্পষ্ট ছিল শব্দগুলো। পরিচিত শারফানের আত্মা যেন ধীরে ধীরে ফিরছে। চিকিৎসকেরা স্বস্তি পান। কারণ‚ এত বড়ো শারীরিক ট্রমার পর সবচেয়ে বড়ো ভয়টাই ছিল‚ ওর মস্তিষ্ক ঠিকভাবে কাজ করবে তো?

বারো থেকে চৌদ্দতম দিনের মাঝে আরও খানিকটা সুস্থ হয় শারফান। ডাক্তাররা সাহস করে ওকে আধা উঠিয়ে বসানো শুরু করলেন। দুই পাশ দিয়ে কুশন দিয়ে ঠেসে বসানো হত। ওর শরীর তখনো দুর্বল। কিন্তু মাথা পরিষ্কার কাজ করে। কথা বলে স্পষ্টভাবে।

কখনো নার্সকে জিজ্ঞেস করে “আমি কতদিন ধরে এখানে?”

তারপরই ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে‚ “কবে ছাড়া হবে আমাকে?”

আবার নার্সকে ডেকে ঔদ্ধ্যতের সুরে বলে “এই শুনুন… আমার পা ঠিক আছে তো?”

ওর কথাই স্বভাবজাত বিরক্তি আর অধৈর্যতা প্রকাশ পাচ্ছিল। অথচ নিজের দশা দেখে কোনো ভয়ই জাগেনি ওর চোখে। সেই পুরনো বদমেজাজ‚ রাগ‚ ভেতরের সেই লড়াই করার সাহসিকতা আবার ফিরে আসতে শুরু করে।

এরপর থেকে উনিশতম দিনের মাঝে শারফান ঠান্ডা পানিতে গলা ভেজায়‚ ধীরে ধীরে অল্প করে তরল খাবার নেয়। ওর হাতের কাঁপুনি কমে আসে‚ চোখের দৃষ্টি স্থির‚ কথাবার্তা একদম গোছানো‚ যুক্তিপূর্ণ। তবে পা তখনো ড্রেসিং করা অবস্থায়। পায়ের ক্ষতস্থানে চাপ পড়তে দেওয়া নিষেধ। ফিজিওথেরাপি চলে‚ কেবল রক্ত সঞ্চালনের জন্য। ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চিকিৎসকরা বুঝে নেন‚ ছেলেটা ফিরছে খুবই ধীরে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে।

অপারেশনের বিশতম দিনে অবস্থার উন্নতি হলেও ডাক্তাররা ওকে জেনারেল ওয়ার্ডে নিতে রাজি হলেন না। কারণ‚ ফুসফুস তখনো পুরোপুরি স্বাভাবিকভাবে কাজ করছিল না। তাই শ্বাসপ্রশ্বাসের ওপর নিয়মিত নজরদারি চালাতে হবে। পেটের ভেতরের ক্ষতগুলোও পুরোপুরি শুকায়নি। মাঝে মাঝে ব্যথা ওঠে। পায়ের ক্ষত জায়গায় সংক্রমণ রোধে চলে নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক। দিনরাত ওষুধ চলে স্যালাইনে‚ ইনজেকশনে। আর সবকিছুর পাশাপাশি মানসিক আচরণেও তখনো স্থিরতা পুরোপুরি আসেনি।

একুশতম দিনের ঘটনা। দুপুর বেলা৷ সেদিন ওকে আধা উঁচু করে তোলা বেডে বসানো হয়েছিল। মুখে মাস্ক রাখেনি। কেবল নাকে পাতলা অক্সিজেন নল ছিল। গায়ে ছিল তখনো রোগীর গাউন‚ হাতে বাঁধা ছিল সাধারণ ক্যানুলা। গত সপ্তাহে সিভি লাইন সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কারণ‚ এখন আর তার শরীরকে আগের মতো জোর করে বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে না, এখন শুধু একটু একটু করে পুরনো নিজেকে ফিরে পাওয়ার পালা। বুকের দিকে তখনো সংযোগ ছিল মনিটরের‚ ইসিজি প্যাড লাগানো। সেদিন দ্বিতীয় দিনের মতো মুখে স্বাভাবিকভাবে তরল আর হালকা নরম খাবার নিচ্ছিল।

ওর পাশেই বসা ছিলেন শাফিউল সাহেব আর জেসমিন বেগম। দুচোখ ভরে তারা দেখছিলেন ওর খাওয়ার মুহূর্তটুকু। চামচটা মুখে তোলার সময় হাতটা মৃদু মৃদু কাঁপছিল শারফানের। তাই মা চেয়েছিলেন ওকে খাইয়ে দিতে৷ কিন্তু তখন চরম বিরক্তপূর্ণ চোখে একবার চাইতেই আর কোনো কথা বাড়াননি কেউ। দীর্ঘ তিন সপ্তাহ পর সেদিন প্রথম সন্তানের চোখে চোখ রাখতে চেষ্টা করছিলেন শাফিউল সাহেব৷ কিন্তু শারফানই সে চোখে চোখটা রাখতে পারছিল না৷ খেতে খেতে আড়দৃষ্টিতে লক্ষ করছিল সে‚ ভেজা চোখে নিমেষহীন তাদের চেয়ে থাকাটা। বাপকে যে চিঠিটা লিখেছিল সে‚ সেখানে সানাকে নিয়ে বলা কথাগুলোর জন্য ওই মুহূর্তে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। যেটা এক সময় বেজায় বিরক্ত করে তোলে ওকে৷ তারপর বাবার দিকে একপলক চেয়ে থেকে হালকা ভ্রু কুঁচকে নিচু গলায় বলে ওঠে‚ “তোমার কোনো কাজ-কাম নাই? অফিসের পাট একেবারে চুকিয়ে বুকিয়ে দিয়ে এসেছ নাকি ভাইয়ের ঘাড়ে? না-কি এহসান ভম্বলের ঘাড়ে?” মায়ের দিকে এরপর এক ঝলক চেয়ে আবার বলে‚ “ঘর-সংসার ছেড়ে দুজনে সারাদিন তছবি ধরে জিকির করার দায়িত্ব নিয়েছ‚ হ্যাঁ?”

জেসমিন বেগম মুহূর্তেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলেন। শাফিউল সাহেবের গলায় কান্না এসে ঠেকে যায়। আনন্দ আর কান্না মিশে গলা থেকে কোনো শব্দই বের হয়নি। চোখের কোণ মুছতে মুছতে মনে মনে আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকেন‚ “আমার বাচ্চাটাকে তুমি আর কোনো বালা-মুসিবত দিয়ো না‚ ও খোদা… !”

আর জেসমিন বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন‚ “তুই আমার বুকে ফিরে আসছিস‚ আব্বা… আমার হাতে আবার একটু খা।”

“উফঃ! ফিরে আসার কী আছে? মরে টরে গেছিলাম না-কি? খাওয়ানো লাগবে না। যাও তো… নিজেরা খানাপিনা করো গিয়ে। একেকজনকে দেখতে লাগছে যেন দুর্ভিক্ষ লেগেছিল”‚ মুখের রেখায় ক্লান্তি ‚ অথচ গলায় ছিল ওর কপট গাম্ভীর্য। বলতে বলতে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়েছিল জানালার দিকে। কারণ‚ বাবা-মায়ের এমন করুণ অবস্থা‚ আর তাদের চোখের পানিতে না চাইলেও চোখটা ওর ভিজে উঠেছিল তখন। তা লুকাতেই চোখদুটো সরিয়ে নিয়েছিল দ্রুত।

একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডা. ইমরান সে সময় নরম গলায় বলেছিলেন‚ “আপনাদের ছেলে ধীরে ধীরে সেরে উঠছেন। ব্রেন ফাংশন পুরোপুরি ঠিক আছে। সামান্য স্নায়বিক দুর্বলতা থাকলেও জটিল কিছু নয়।”

কথাটুকু শুনতেই তীক্ষ্ণ গলায় শারফান তখন বলে ওঠে‚ “আমার সামনে কেউ আমার রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করবেন না একদম। বাইরে গিয়ে করুন।”

ওর এমন অপ্রত্যাশিত আন্তরিকতাহীন আচরণে সবাই থমকে পড়েছিল মুহূর্তেই। ডাক্তার বেশ বিব্রত আর অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন। শাফিউল সাহেবের মুখে বিস্ময় থাকলেও চোখের জল আর ধরে রাখতে পারেননি৷ গড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুছে নিয়েছিলেন। এটাই তো তার ছেলে! সেই ত্যাড়া‚ দাম্ভিক‚ রগচটা আর কাঠখোট্টা গলায় কথা বলা ছেলেটা ফিরে এসেছে পুরোটাই।

ডা. ইমরানকে তারপরই আবার জিজ্ঞেস করেছিল শারফান‚ “এই জায়গায় যেন কতদিন আমি?”

“আজ একুশতম দিন। হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে আছেন। পরিস্থিতি এখন স্ট্যাবল”‚ জবাবটা দ্রুত দিয়েছিল নার্স সিমি। ডা. ইমরান যে সাংঘাতিক গম্ভীরমুখো মানুষ! তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে সবাই হিসাব-নিকাশ করে কথা বলে৷ আর তার মতো নার্সরা তো কথার আগে পরে ‘স্যার’ জপতে জপতে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। শারফান যদিও রোগী৷ কিন্তু ওর জীবনকে ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য তো এই ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। সেখানে ওর অমন চাঁচাছোলা কথাই ভারি অবাক হয়েছিল সে।

সিমিকে তখন আগাপাছতলা দেখে নিয়ে কেমন অনীহার সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল শারফান। তারপর লম্বা করে শ্বাস টেনে নিয়ে একটা কিছুর হিসেব কষছিল ভেতরে ভেতরে। সিমির দিকে আর না ফিরেই তারপর জিজ্ঞেস করেছিল‚ “ডিসচার্জের জন্য কবে অনুমতি দেওয়া হবে?”

“স্যার‚ আগে হাঁটাহাঁটি করে দেখুন ঠিকমতো পারেন কিনা! তারপর কনসালটেশন বোর্ড ডিসিশন দেবে। তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই।”

বিরক্ত ভঙ্গিতে শারফান চোখজোড়া বন্ধ করে নেয় তখন। শরীরটা একুশ দিন ধরে শুয়ে আছে ওর। অথচ তার থেকেও বেশি কষ্টকর ছিল ওই একুশ দিনের প্রতিটি মুহূর্ত। সময়টা যেন ওর সহ্যের সীমা অতিক্রম করছিল। পা’টা একটুখানি ঠিক হলেই সবাইকে রেখেই বোধ হয় ও চলে যেত একা একাই।

শাফিউল সাহেব ওর মতিগতির সবটাই টের পাচ্ছিলেন তখন৷ গলায় একবার নকল কাশি তুলে পরিষ্কার করে নিয়ে রাশভারী কণ্ঠে ওকে বলেছিলেন‚ “এত ছটফট করার কী আছে? কারও এত ঠেকা পড়েনি তোমাকে বসিয়ে বসিয়ে সেবাযত্ন দেবে অকারণে। অযথা কাউকে মেজাজ দেখালে ফল আরও খারাপ হবে তোমার৷ থাকার সময় বাড়বে বলে দিলাম। তোমাকে বাঁচিয়ে তোলা থেকে সুস্থ করা অবধি এই রুমে অবজারভেশনে থাকা প্রতিটি ডক্টর আর নার্স যে পরিমাণ ডেডিকেটেড ছিলেন‚ তা ভুলবে না কখনো। মনে থাকে যেন।”

এমন চড়া হয়ে কথা বলতে দেখে জেসমিন বেগম একটু রেগে তাকিয়েছিলেন তখন স্বামীর দিকে৷ সেসব পাত্তা না দিয়ে শাফিউল সাহেব ছেলের অপরিণত আচরণ‚ আর স্বভাব‚ বৈশিষ্টের বদনামের ঝাঁপি খুলে বসেন ডা. ইমরানের কাছে৷ যাতে তিনি অপমানিত বোধ না করেন কখনো। উপরন্তু ছেলেকে শাসন করার পুরো অধিকার তুলেন দেন তার হাতে৷ সবটা শুনে সে সময় খুব হাসেন ডা. ইমরান।

“জারাকে জানাতে নিষেধ করেছিলাম না?” বাবার কথার মাঝপথেই শারফান অসন্তোষ গলায় জিজ্ঞেস করে ওঠে। জারা এর মাঝে একদিন দেখতে এসে কান্নাকাটি জুড়ে বসেছিল এমনভাবে‚ ভাইয়ের কাছ থেকে তাকে নড়ানোই মুশকিল হয়ে পড়েছিল সেদিন।

তবে জবাবটা শাফিউল সাহেব দেননি। দিয়েছিলেন জেসমিন বেগম‚ “তুই চিন্তা নিস না‚ আমার সোনা আব্বা! সেভাবে কিছু জানাইনি তো। ও জানত তুই ব্যবসার কাজে মালয়েশিয়ায় গেছিস৷ আর আমরা তোর চাচার অসুস্থতার কথা বলে প্রতিদিন এখানে আসতাম। কিন্তু তুই ফোনে কেন কথা বলিস না ওর সঙ্গে‚ এই নিয়ে শেষ কিছুদিনে খুব রাগারাগি শুরু করে… কান্নাকাটি করে। তাই তোর আব্বু কী কী বলে যেন বুঝিয়েছে। তোর পায়ের সমস্যাটা তো আর ঢাকা যাবে না। এর জন্য শুধু বলেছে এয়ারপোর্ট থেকে রওনা হওয়ার পথে অ্যাক্সিডেন্টে তোর পা ভেঙেছে। এখনো এটাই জানে৷ কোনো ফোন‚ ট্যাব‚ ল্যাপটপ‚ কিচ্ছু ধরতে দিইনি ওকে। টিভির লাইনটাও কেটে রেখেছে তোর আব্বু৷ আর তুই বলে দিয়েছিলি না ও পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তোর চাচি আর মিথির সঙ্গে যেন কোনো যোগাযোগ করতে না দিই? করতে দিইনি একদম। ওরা কেউ আসেইনি তোর বাসায়৷ রিহানরাও কেউ কিচ্ছু জানায়নি ওকে।”

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৫০.

এপ্রিল ২৯
সিএমএইচ

অপারেশনের পর কেটে গেছে পঁচিশ দিন। প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে আজ খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে চিকিৎসক দল। ভোরবেলা রাউন্ড শেষে ডা. তৌকির ফাইল বন্ধ করে একবার তাকালেন শারফানের দিকে‚ তারপর শান্ত গলায় বললেন নার্সদের‚ “ওর অবস্থা এখন বেশ স্ট্যাবল। আজকে ওকে ভিআইপি ইউনিটে ট্রান্সফার করো।”

এই কথা জানার পর শারফানের পরিবার-পরিজনদের মাঝে অনেকটা আশার আলো ছড়িয়ে পড়ল। ঠিক যেমন ভোরের আলো ধীরে ধীরে জানালা গলে ঘরে ঢোকে, তেমন করেই শারফান ফিরে আসছে জীবনের দিকে। যদিও সম্পূর্ণ নয়। বুকের পাঁজরে‚ পেটের নিচে সেলাইয়ের তাজা ক্ষতগুলো এখনো শুকায়নি পুরোপুরি। সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দেয় ওর ডান পা। যেখানে এখনো বসানো আছে লোহার রড। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, হাঁটা একেবারেই নিষেধ। কেবল দিনে একবার ফিজিওথেরাপিস্টের সহায়তায় কিছুক্ষণের জন্য ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর অনুমতি আছে।

বেলা এগারোটার দিকে রোলিং স্ট্রেচারে করে শারফানকে আনা হলো ভিআইপি ইউনিটের কেবিনে। সাদা রঙা দেওয়ালের শান্ত‚ সুশৃঙ্খল সেই কক্ষ‚ জানালার পাশে হালকা আলো‚ পর্দা সরিয়ে বাইরে সবুজ পাতার দোল। আর কেবিনের বিছানাটা বড়ো‚ আরামদায়ক। রোগীকে যেন একটু দম নিতে দেওয়ার জন্যই বানানো। পাশেই নার্স কল-বেল‚ অক্সিজেনের পাইপলাইন‚ মনিটর‚ ইনফিউশন স্ট্যান্ড‚ সবই প্রস্তুত।

শারফানকে তোলা হলো নতুন বিছানায়। মাথার নিচে নরম বালিশ‚ একপ্রান্তে ব্যান্ডেজ করা ডান পা। যার নিচে ছোট্ট একটি সাপোর্টিং প্যাড দিয়ে রাখা আছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখতে থাকল ও। জায়গাটা পরিবর্তন হওয়ায় প্রথমবার ওর মনে হলো‚ মৃত্যুর অন্ধকার থেকে একটু দূরে এসেছে সে। যেন আলোর নিচে ফিরে এসেছে আবার। যদিও হাসপাতালে থাকাটাই ওর জন্য বিতৃষ্ণার। এতদিন আইসিইউ আর নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণের কড়া ঘেরাটোপে ছিল সে। এখন একটু বেশি আলো‚ একটু বেশি নীরবতা যেন বলে দিচ্ছে‚ এই যুদ্ধটা এখনো শেষ হয়নি। কেবল একটু বিরতি। এখানে যতদিন থাকতে হবে‚ ততদিনই ওর মনে হবে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে এখনো যায়নি ও। আর এটাই ওর সবচেয়ে অপছন্দের।

কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর থেকে ক্ষণে ক্ষণেই ওকে দেখায় খানিকটা উদাসীন‚ বিষণ্ণ। আজ সকাল থেকেও তেমনই লাগছিল। শরীরের অস্থিরতার মতো মনটাও যেন একটা অদৃশ্য অস্থিরতায় সর্বক্ষণ ছটফট করে৷ আত্মীয়-স্বজন‚ বন্ধু-বান্ধব একে একে এসে দেখা করে যাচ্ছে সবাই৷ আর শাফিউল সাহেব আর জেসমিন বেগমকে ঘন ঘন আসতে বারণ করে দিয়েছে ও। দুজনের শরীরই ভেঙে পড়েছে অনেকটা। কটা মাসের ঝড়ঝাপটায় তাদের বয়সটা যেন তিন ধাপ এগিয়ে গেছে। ওর রাগারাগি‚ চেঁচামেচির কাছে টিকতে না পেরে তাই দুজন বাধ্য হয়ে সকালের দিকটাতে আর আসেননি৷

ও মানুষটা ছিল তো বদরাগীই৷ এই ঝক্কিতে মানসিকভাবে ওর আচরণ আরও বেশি অস্থির হয়ে উঠেছে। কেবল বাবা‚ মা-ই নয়‚ যে কারও সাথেই হঠাৎ হঠাৎ রাগারাগি করছে সে‚ আবার কখনো তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করছে‚ তো কখনো আবার একেবারে নীরব৷ বাবার কঠোর নিষেধাজ্ঞাকেও অমান্য করে কখনো কখনো নার্স বা ডাক্তারদের প্রতিও আচরণ ঠিক রাখছে না সে। তাই কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন ওর অত্যধিক। কিন্তু কোনোভাবেই ওকে থেরাপির জন্য রাজি করাতে পারছে না কেউ। তাই শেষমেশ আজ জিসান দায়িত্ব নিয়েছে ওকে বোঝানোর জন্য৷

কেবিনে এখন এ মুহূর্তে রিহানও রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটা দিন কী পরিমাণ আলোড়ন তৈরি করেছিল শারফানের নামটা‚ তা নিয়ে গল্প করল ওরা শারফানের কাছে। এতে ভবিষ্যতে ফারনাজের জামিন পাওয়ার সুযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। রাজন‚ বাবলু তো গ্রেফতারই। হাত-পা ভেঙে বাসায় পড়ে থাকা দিপুকেও আটক করেছে পুলিশ। কিন্তু এসব শোনার পরও শারফানের মুখে কোনো বিশেষ পরিবর্তন নেই। চোখে এক গভীর শূন্যতা। ব্যান্ডেজ করা পায়ের দিকে চেয়ে সে যেন ডুবে আছে নিজের জগতে।

তা দেখে জিসান মূল কথাই ঢুকে পড়ল। মৃদু ধমকে বলল “এ ব্যাটা! তোর মনে এখন নতুন কী চলছে আবার‚ হ্যাঁ? সবই তো করলি। ওদের আধমরা করলি‚ নিজেও মরতে মরতে বাঁচলি। আরও কিছু বাকি আছে?”

রিহান একটু শান্ত স্বরে বলল‚ “শায়াফ‚ আমাদের কাছে অন্তত বল‚ কী হচ্ছে তোর ভেতরে?”

কিন্তু শারফান নিরুত্তর। একটু আগেও ওদের সঙ্গ ভালো লাগছিল ওর। কিন্তু এ মুহূর্তে হঠাৎ সেই ভালো লাগা গায়েব হয়ে গেছে৷ একা একা বসে নিজের ভাবনায় ডুবে থাকতে ইচ্ছা করছে শুধু। তবে তা প্রকাশ করল না৷

জবাব না পেয়ে রিহান এবার বলল‚ “দ্যাখ‚ তুই আর কিচ্ছু নিজের মধ্যে চাপা রাখবি না৷ ভাবনাচিন্তা যা করছিস তা শেয়ার কর৷ প্রয়োজনে সর্বোচ্চ সহায়তা করব তোকে৷ কিন্তু একা একা আর কিছু করতে যাস না। তোর বোনটা আর বাপ-মার কথা ভাবিস‚ দোহাই লাগে তোর!”

“তুই যে কত বড়ো হারামি”‚ জিসান ক্ষোভের সুরে বলল‚ “সব জানিয়েও সেদিন তুই কিছুই জানাস নাই আমাকে।”

তারপর একটু শাসনের গলায় বলল‚ “আমি যদি জানতাম তুই একা ঢুকবি কামরাঙ্গীচর‚ বের হওয়ার সুযোগ দিতাম তোকে? তোকে হাতে পেলে ওরা কী করতে পারে সব বুঝেও এমন বোকামি কেন করতে গেলি‚ বল তো?”

“কোনো কিছুতেই এক ফোঁটা শান্তি পাচ্ছিলাম না”‚ হঠাৎ ফিসফিসানির সুরে জবাবটা দিয়ে শারফান তাকাল একবার ওদের দিকে।

তারপর জানালার বাইরে চেয়ে নিজ আগ্রহেই বলে গেল‚ “কত মানুষের লাইফ হেল করে দিয়েছি! কিন্তু কখনো ওরকম অশান্তিতে থাকিনি। কোনো না কোনো কারণে তারা দূষিত ছিল বলেই হয়ত মন ছটফট করেনি ওদের ক্ষতি করে৷ লাস্ট কটা দিনে আমি যে কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম! বলতেও পারছিলাম না কাউকে। মনে হচ্ছিল কোনো বাতাসশূন্য পাথরের গুহায় চাপা পড়ে আছি আমি। শ্বাসটা নেওয়া দিনে দিনে কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল সেখানে৷ বোধ হয় ও আমাকে নিজে থেকে কোনো শাস্তি দিলে এতটা যন্ত্রণায় পড়তাম না৷ কিন্তু আমার বিচারের ভার ও আমাকেই দিল। কী বিচার করব আমি নিজের? ঠিক কোন শাস্তিটা দিলে আমি আমার অপরাধের যোগ্য বিচার করতে পারব? ভেবেই পাচ্ছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল নিজেকে শাস্তিস্বরূপ যা-ই দেব‚ তা-ই কম পড়বে ওর কষ্টের কাছে‚ ওকে করা মানসিক‚ শারীরিক নির্যাতনের কাছে। তাই প্রথমে ভেবেছিলাম রাজন‚ বাবলুকে ধরিয়ে দেওয়ার পর ওর বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াব। নিজে যেহেতু নিজের শাস্তি নির্ধারণ করতে পারছিলাম না‚ তাই ওর পরিবার যা শাস্তি দিতে চাইবে তাই মেনে নেব। এর মাঝে আবার রিয়েলাইজ করলাম‚ আমার বোনের কষ্টের কারণটাও তো আমিই… আমার প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা। কী হিংস্র এক জানোয়ার আমি! যাদের আমি ভালোবাসি‚ অথচ তাদের জীবন ছারখার হওয়ার পেছনে একমাত্র আমিই দায়ী। সেদিন কামরাঙ্গীচর যাওয়ার আগে মনটা হঠাৎ এমন উতলা হলো সানাকে দেখার জন্য! রায়হান ভাইকে রাগিয়েই ওর মুখোমুখি হলাম তাই৷ দেখলাম ওকে একটু সময়ের জন্য৷ মন ভরছিল না। কিন্তু তাও চলে এলাম দ্রুত৷ কারণ‚ আমি ওর চাউনিতে নিজের প্রতি যে ঘেন্না দেখেছি‚ তা সহ্য করতে পারছিলাম না৷ কিন্তু আগেও ওর ওই চোখেই নিজের জন্য রাগ‚ বিরক্ত‚ ঘেন্না‚ সবই দেখেছি আমি৷ অমন কষ্ট কখনো হয়নি আগে‚ সেদিন যে কষ্টটা হয়েছিল।”

“কারণ‚ আগে তুই গুরুত্বই দিসনি নিজের ফিলিংসকে”‚ বলল রিহান।

কথাটার বিপরীতে কিছুক্ষণ চুপ থাকল শারফান। প্রলম্বিত শ্বাসটা ফেলে বলল আবার‚ “ওর ঘেন্নায় আমার ভেতরের দমবন্ধ লাগা সমস্যাটা আরও বাড়িয়ে দিল সেদিন। যতকাল বেঁচে থাকব‚ ততকাল ও ওভাবেই তাকাবে আমার দিকে… ঘেন্না নিয়ে! এই ভাবনাটা আমার ভেতরে গেঁথে গেল একদম। আইসিইউতে বানির বাঁচা-মরার লড়াই‚ আব্বুর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট‚ এসবও মনে পড়তে থাকল। তখন রিয়েলাইজ করলাম একটা কুসন্তান জন্ম দিয়েছে আমার বাপ। তাই মনে হয়েছিল‚ বাবলুদের হাতে আমার নিৃশংসভাবে খুন হয়ে মরে যাওয়াটাই ঠিক হবে আমার জন্য৷ কারণ‚ সানাকে কথা দিয়েও তো নিজের জন্য সঠিক কোনো শাস্তিই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আবার আমার বানি সারাটা জীবন কত কষ্ট বয়ে নিয়ে বাঁচবে‚ সেখানে আমি আনন্দ-ফূর্তি করে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন পার করব? আর চোখের সামনে দেখব‚ একটা ছক বাঁধা নিয়ম-কানুনের জীবন নিয়ে হাঁসফাঁস করে ওর বেঁচে থাকাটা? ভাবতেই পারছিলাম না তা‚ আর সহ্য করব কীভাবে? সেদিন আব্বুর সাথে একবার কথা বলার ইচ্ছে হয়েছিল খুব। কিন্তু সময়টা উপযুক্ত ছিল না বলে কী সব হাবিজাবি কথা মাথায় এল‚ তা-ই লিখলাম চিঠিতে৷ এহসানকে বিরক্ত করলাম৷ চিঠিটা ওকে আমার বাড়িতে এসে নিয়ে যাওয়ার কথাটা জানিয়েই বেরিয়ে পড়লাম বাবলুর সঙ্গে। ওদের আঘাতে‚ বুলেটে যে অসহনীয় একেকটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছিল আমার শরীরে… শ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল‚ আমার তখন বাঁচার চেষ্টার বদলে মনে হচ্ছিল আমার ভালোবাসার মানুষগুলোকে যে কষ্ট দিয়েছি আমি‚ তার যোগ্য শাস্তিই নিচ্ছি আমি… আমার মৃত্যুই হোক শ্বাসটা একেবারে বেরিয়ে গিয়ে।”

“কী ভয়ঙ্কর আত্মঘাতীর মতো চিন্তাভাবনা তোর!” প্রচণ্ড বিস্ময়ে বিস্মযোক্তি করে উঠল জিসান। “ওটা তাহলে নিঃসন্দেহে সুইসাইড মিশন ছিল তোর! কোনো মিশন শোডাউন ফোডাউন না! তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিলি‚ শায়াফ?”

“বোধ হয়”‚ নির্বিকারস্বরে বলল শারফান‚ “পাগল পাগলই লাগত আমার। কী করব‚ না করব… কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।”

আর রিহানকে দেখাল স্তম্ভিত৷ শারফানকে বকাঝকা বা কোনো কিছু বলার মতোই মুখে শব্দ জুটল না তার। শুধু জিসানকে বলল‚ “আপনার সাইক্রিয়াটিস্ট ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলুন তো‚ ভাই। উনিই ওর কাউন্সেলিংটা করাক। যেহেতু সব জানেন উনি। কাইন্ডলি আজকে থেকেই ওর থেরাপি সেশনটা শুরু করতে বলুন।”

জিসানও বুঝল‚ শারীরিক চিকিৎসা যতখানি জরুরি শারফানের‚ ততখানিই জরুরি ওর মনের চিকিৎসাটাও৷ শারফানকে আবারও একচোট রাগারাগি করে সেদিনই সে কথা বলল রায়হানের সঙ্গে৷ রায়হান রাজি হলো অনায়াসেই৷ পঁচিশটা দিনের মাঝে সেও দুবার দেখতে এসেছিল শারফানকে। ওর অবস্থা দেখে বেশ খারাপ লাগত তারও।

বিশেষ অনুমতিতে সিএমএইচ এসে পরদিন থেকেই সকালের নির্দিষ্ট একটি সময়ে সে শারফানের কাউন্সেলিং শুরু করল। কেন যেন তার থেকে থেরাপি নিতে কোনো ওজর-আপত্তি করল না শারফান৷ হয়ত সানার কী অবস্থা এখন‚ তা জানার সুযোগ পাবে বলেই! কিন্তু নিজের মানসিক অবস্থাটা কতখানি বিপজ্জনক পর্যায়ে‚ তা সে বুঝতেও চেষ্টা করল না।

ওর সঙ্গে প্রথম সেশনেই রায়হান যা বুঝল‚ তার থেরাপি শুধু শারফানের জন্য কেবল চিকিৎসা নয়‚ একটি জীবনরক্ষা অভিযানও। শারফান কোনো সাধারণ ট্রমা ভিকটিম নয়। তার মানসিক অবস্থার পেছনে রয়েছে বহুস্তর জটিলতা। ওর ভেতরে কাজ করছে গভীর অপরাধবোধের ঘূর্ণি বা প্যাথোলজিক্যাল গিল্ট। ওর কথাতে সবচেয়ে বেশি ঝিলিক দিচ্ছিল অপরাধবোধ। রায়হান খেয়াল করে‚ ও নিজের কৃতকর্মের জন্য স্রেফ অনুশোচনা করছে না। বরং সানার চাওয়াকে গভীরভাবে সমর্থন করে নিজেকে বিচারকের আসনে বসিয়ে শাস্তি দিতেও চাইছে। আর ওর এই স্ব-শাস্তির আকাঙ্ক্ষা এতটাই প্রবল যে‚ সে বারবার মৃত্যুকে গৌরবময় পরিণতি হিসেবে কল্পনা করছে। পিটিএসডির প্রথম শ্রেণীর উপসর্গসহ আরও একটি বিপজ্জনক উপসর্গও আছে ওর মাঝে। চেতনা বিচ্ছিন্নতা বা ডিসোসিয়েশন। শারফানের চোখে এখন সে নিজেই যেন অপরিচিত কেউ। সে যেন নিজের শরীর আর আত্মার মাঝে একটা দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে। ওর মধ্যে এখন আর ‘আমি’ বলে কিছু নেই। বরং সে নিজেকে দূর থেকে দেখছে একটা অপরাধী সত্তা হিসেবে। আর সেই অপরাধী সত্তার একমাত্র মুক্তি‚ শাস্তি। কঠিন‚ নির্মম‚ অবসানমুখী শাস্তি। এই বোধই ওর ভেতরে জন্ম দিয়েছে এক ভয়ানক আত্ম-ধ্বংস প্রবণতা। তারপর দেখা গেছে ওর মাঝেও দ্বৈত মানসিক টানাপোড়েন বা অ্যামবিভেলেন্ট ইমোশনাল কনফ্লিক্ট। ভেতর একধরনের দ্বিমুখী আবেগীয় দ্বন্দ্ব চলছে। সানাকে কষ্ট দিয়েছে সে‚ এটা সে জানে। সে সানাকে ভালোও বাসে‚ এটাও সে অস্বীকার করছে না। কিন্তু সেই ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গি ছিল বিকৃত‚ সহিংস‚ অধিকারবোধে ভরপুর। এইসব মিলিয়ে রায়হান বহু আগেও বুঝেছিল আর এখনো বুঝল‚ শারফানের হৃদয়ে যে ভালোবাসা ছিল‚ তা ছিল অসম্পূর্ণ‚ অপরিণত এবং দখলদারি মনোভাবজাত। কিন্তু ট্রমা ও বিকৃত প্রেম মিলে এখন যে ছিন্নভিন্ন আবেগ তৈরি হয়েছে ওর মাঝে‚ সেটা ওকে গ্রাস করে নিচ্ছে।

***

৭ মে
বেলা ১ টা

কিছুক্ষণ আগে শাফিউল সাহেবকে নার্স এসে জানালেন‚ “আপনার ছেলের থেরাপিস্ট এসেছেন‚ একটু দেখা করতে বলছেন।”

শাফিউল সাহেব এলেন তারপর নার্সের সঙ্গে ভিআইপি ইউনিটের একটি নিরিবিলি রুমে। ছোট্ট কাঠের টেবিল‚ দুটো চেয়ার‚ পাশে খোলা জানালা। ওখানেই বসে ছিল রায়হান‚ একটা নোটবুক খুলে রাখা তার সামনে। শাফিউল সাহেব তার মুখোমুখি বসলে সে শান্ত গলায় বলল‚ “স্যার‚ আপনাকে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বুঝিয়ে বলা দরকার। তাই ওর থেরাপি শেষ করেই দেখা করতে বললাম।”

“কোনো সমস্যা নেই। বলুন না!” বসতে বসতে বললেন শাফিউল সাহেব।

“আমি চেষ্টা করব একটু সহজ করে বোঝাতে। বুঝতে অসু্বিধা হলে নির্দ্বিধায় আমাকে প্রশ্ন করবেন‚ স্যার”‚ কোমল‚ আবেগপূর্ণ কণ্ঠে রায়হান বলল।

শাফিউল সাহেব মনকে তখন কিছুটা প্রস্তুত করে নিলেন। রায়হানের কণ্ঠেই তিনি বুঝে গেলেন‚ যা শুনতে যাচ্ছেন তা খুব একটা সুখকর নয় হয়ত৷ তবে গত কয়েকটা মাস ধরে যে ঝড়ের মুখোমুখি হচ্ছেন‚ তার থেকে নিশ্চয়ই ভয়াবহ কিছু নয়! তিনি আলগোছে মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

“স্যার‚ শায়াফের থেরাপি চলছে আজ সাত দিন। এই এক সপ্তাহের পর্যবেক্ষণে আমি যা বুঝতে পেরেছি‚ সেটা আপনাকে জানিয়ে রাখছি। আপনার ছেলের বর্তমান সমস্যা কেবল শারীরিক নয়। এটা এক ধরনের গভীর অভ্যন্তরীণ মানসিক সংঘাত। যেটা আমরা বলি ইনার সাইকোলজিকাল কনফ্লিক্ট। এই সংঘাতের মূল কেন্দ্রে আছে ভয়াবহ অপরাধবোধ ও আত্মগ্লানি। যা ওকে ধীরে ধীরে ঠেলে দিচ্ছে আত্মধ্বংসাত্মক ন্যায়বোধে। শায়াফ মনে করে‚ সে এমন এক পাপ করেছে যার শুদ্ধি পৃথিবীর কোনো বিচারব্যবস্থায় সম্ভব নয়। তাই সে নিজেই নিজের বিচারক‚ নিজের শাস্তিদাতা হয়ে উঠেছে। ওর কাছে মৃত্যুই একমাত্র উপযুক্ত সাজা। এই চিন্তাটাকে বলা হয় সেলফ-ডেস্ট্রাকটিভ জাস্টিস ডিসঅর্ডার। একটি গুরুতর মানসিক অবস্থান‚ যেখানে মানুষ নিজেকে ধ্বংসের মধ্যেই মুক্তি খোঁজে। ওর এই মানসিক গঠনের পেছনে দুটি বিষয় স্পষ্টভাবে কাজ করছে। প্রথমত‚ শায়াফ সানার চোখে যে ঘৃণা দেখেছে। সেটাকেই সে গ্রহণ করেছে জীবন্ত বিচার হিসেবে। সেই ঘৃণা ওর কাছে আদালতের রায়‚ ন্যায়বিচারের প্রতীক। কিন্তু সে তাতেও শান্তি পায়নি। বরং সে মনে করছে‚ এই ঘৃণাই যথেষ্ট নয়। ওকে আরও বড়ো শাস্তি পেতে হবে। সেই শাস্তি হতে হবে মর্মান্তিক‚ যন্ত্রণাময়।

দ্বিতীয়ত‚ ওর মধ্যে তৈরি হয়েছে একটি ভয়ঙ্কর মূল্যহীনতার সঙ্কট। সে নিজেকে ভাবছে‚ ‘আমি আর ভালো মানুষ হওয়ার যোগ্য নই’, ‘আমি যাদের ভালোবেসেছি‚ তাদের জীবনই নষ্ট করেছি।’ এই অনুভূতি থেকে জন্ম নিয়েছে চরম হতাশা ও বেঁচে থাকার অনিচ্ছা। সেদিন মিশনে শুধু এক ভয়ঙ্কর শারীরিক যুদ্ধের মধ্য দিয়েই যায়নি ও। ওর ভেতরে চলেছিল গভীর এই মানসিক যুদ্ধও। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আবেগ-নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা৷ যা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের প্রাথমিক লক্ষণ। রেগে চিৎকার করা‚ হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়া‚ চারপাশের মানুষকে দূরে ঠেলে দেওয়া‚ সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে ও এক জটিল মানসিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ধরুন‚ এখন যদি সানা আবারও তার প্রতি ঘৃণার চোখে তাকায়‚ তাহলে সে আবারও আত্মঘাতী চিন্তার দিকে ফিরে যাবে। কারণ‚ ওর মস্তিষ্ক একটি বিকৃত মানসিক সমীকরণে বিশ্বাস করে চলছে‚ ‘ঘৃণা ইকুয়াল বিচার’। অর্থাৎ ঘৃণা যত তীব্র‚ বিচার ততই সম্পূর্ণ। আবার সেই ঘৃণা সহ্য করার মতো মানসিক সামর্থ্যও ওর নেই।

বাস্তবে বিচার মানে শুধুই ঘৃণা নয়। বিচার মানে হতে পারে স্বীকারোক্তি‚ সংশোধন‚ ক্ষমা চাওয়া‚ কিংবা নিজেকে বদলানো। কিন্তু ও এখনো এই বিকল্প মানেগুলো বুঝতে চাইছে না৷ তাই শুধু ঘৃণার মধ্যেই সে বিচার খুঁজে ফিরছে‚ যা এক ধরনের মানসিক ফাঁদ। বেশ কষ্টসাধ্য হবে ওকে বোঝাতে৷ কিন্তু আমি হাল ছাড়ব না। ও এখন ভয়ানক এক আত্ম-অভিশাপের চক্রে আটকে আছে। ও ভাবছে‚ ক্ষমা মানেই ভুলগুলো মুছে ফেলা‚ দোষ থেকে মুক্তি পাওয়া। তাই সে ক্ষমা পেলে যেন নিজের শাস্তি কমে যাবে‚ আর সে নিজেকে শাস্তি দিতে চায়। আমার থেরাপির মূল লক্ষ্য হলো‚ এই আত্ম-অভিশাপের চক্র ভাঙা এবং ওর মনে নতুন একটা বিশ্বাস গড়ে তোলা। যেখানে সে নিজের ভুল স্বীকার করবে‚ দায়ভার নেবে। কিন্তু নিজেকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেবে না। এই উপলব্ধির মূল ভিত্তি হলো ‘ক্ষমা’। তবে এখানে ক্ষমার অর্থ হচ্ছে নিজের প্রতি ক্ষমা। যদি আমরা ওকে এই উপলব্ধি দিতে পারি‚ ও তখন বুঝবে‚ বেঁচে থেকে নিজের ভুল শোধরানোই প্রকৃত ন্যায়বিচার। তখন ও আর নিজের ধ্বংসে শান্তি খুঁজবে না। বরং নতুন জীবন গড়তে চাইবে। তবে এখানে ক্ষমা মানে এই আশ্বাস দেওয়া নয়‚ ওকে আর সানা ঘৃণা করবে না। বরং মানসিক যন্ত্রণার ভার থেকে নিজেকে মুক্ত করা‚ অপরাধবোধকে এক জায়গায় থামিয়ে দিয়ে নিজের জীবনের নতুন পাতা খোলার সুযোগ দেওয়ায় ক্ষমা। কিন্তু শঙ্কাটা হলো এই উপলব্ধিগুলো যদি দিতে না পারি‚ তাহলে একদিন হয়ত শুধু সানার চোখের ঘৃণায় পূর্ণ একটা চাহনি আর তার একটা অভিমানের ঝলকই যথেষ্ট হবে ওকে আবারও ‘নিজেকে কঠিন শাস্তির মাঝে শেষ করার মতো’ সিদ্ধান্তে ঠেলে দিতে। আপনি কি বুঝতে পারছেন‚ স্যার‚ আমার কথাগুলো?”

জবাবের বদলে কেমন ফাঁকা দৃষ্টিতে শাফিউল সাহেব চেয়ে রইলেন রায়হানের দিকে৷ অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না৷ তারপর একটা পর্যায়ে স্বগতোক্তির মতো বলে উঠলেন‚ “আমার ছেলে তো এমন নাজুক হৃদয়ের ছিল না। প্রচণ্ড কনফিডেন্ট‚ ইনটেলিজেন্ট আর স্ট্রং মেনটালিটির ও। সেই ছেলে কবে থেকে এত আবেগী আর দুর্বল সত্তার হলো?”

“আমার কথা শেষ হয়নি‚ স্যার”‚ পেশাদার গলায় বলল রায়হান‚ “পুরোটা শুনুন। তাহলে ওর অবস্থাটা পরিষ্কার হবে। জিসান আর রিহানের সঙ্গে কথা বলে ওর ব্যাপারে যতটুকু জেনেছি‚ জীবনে অনেককেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ও। কিন্তু তাদের প্রতি কখনোই ওর ভেতরে কোনো অপরাধবোধ তৈরি হয়নি। কারণ‚ সেসব মানুষকে ও দেখেছে ‘টার্গেট’ হিসেবে। ক্ষমতার খেলায় বাধা বা প্রতিপক্ষ হিসেবে। ফলে ওর মস্তিষ্ক তাদের ক্ষতিকে ‘যুদ্ধক্ষেত্রের নিয়ম’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে। অনুশোচনা তৈরি হয়নি কখনো। কিন্তু সানা ছিল এই গণ্ডির বাইরে। ওর অবচেতন আবেগের কেন্দ্রবিন্দু সানা। যদিও সে এটা অতীতে কখনো স্বীকার করেনি‚ এমনকি নিজেও পরিষ্কারভাবে বোঝেনি। তবু নিজের মতো করে সানাকে সে অনুভব করত এক ধরনের অধিকার‚ আত্মীয়তা আর টান দিয়ে। সানার সঙ্গে তার একটা অন্তর্গত ‘ভেতরের মানুষ’-এর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল৷ যেটা হয়ত ভাষাহীন। কিন্তু গভীর। ভেতরের মানুষের সম্পর্ক মানে‚ সানা যেন ওর নিজের আত্মার এক অংশ হয়ে গিয়েছিল। আর ঠিক এই জায়গাতেই শায়াফ করেছে সবচেয়ে ভয়ানক ভুল। ও নিজের জীবনের সবচেয়ে গোপন‚ সবচেয়ে কোমল অনুভূতির ওপরেই ভুল করে আঘাত করেছে। ও আঘাত করেছে ওর ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে। তাই ওর এই ট্রমা কেবল কোনো আচরণগত অপরাধের পরিণতি নয়। এটা এক ধরনের হৃদয়ের নৈতিক ভাঙন। আমরা একে বলি‚ ট্রমা অব হার্মিং আ লাভড ওয়ান। একটা গভীর মানসিক অবস্থা‚ যেখানে অপরাধবোধ কেবল কাজের জন্য নয়‚ বরং ‘কার প্রতি’ তা করা হয়েছে‚ সেই সম্পর্কের মান ও প্রগাঢ়তার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। শায়াফ জানে‚ সে শুধু সানার দেহে আঘাত করেনি। সে আসলে নিজেরই অনুভূতির হৃদপিণ্ডে আঘাত করেছে। ওর ট্রমার মূল সূত্র এটাই। সানা কেবল ওর কাছে কোনো এক ভুক্তভোগী নয়। সে ছিল ওর মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসার মানুষ। এই কারণেই ওর অপরাধবোধ গভীরে গিয়ে বসেছে। সেজন্য ভাবছে‚ এই অপরাধের শুদ্ধি একমাত্র নিজের সর্বনাশের মাধ্যমেই সম্ভব। আর আমরা একে বলি‚ সেল্ফ-ডেস্ট্রাকটিভ মোরাল লজিক। মানে‚ ‘ভালোবাসার প্রতি অপরাধ’ ইকুয়াল ‘অমার্জনীয় অপরাধ’ ইকুয়াল ‘আত্ম-ধ্বংসই ন্যায্য শাস্তি’।

স্যার‚ শায়াফের ট্রমা অন্য সবার থেকে আলাদা। যেখানে অন্যরা অত্যাচার বা সহিংসতার শিকার হলে‚ অথবা কোনো ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রত্যক্ষদর্শী হলে‚ অথবা কারও মৃত্যু‚ ক্ষতি বা বিচ্ছেদ দেখলে ট্রমাটাইজ হয়। কিন্তু ওর ক্ষেত্রে ট্রমার উৎস পুরোপুরি আলাদা। এখানে সে নিজেই অত্যাচারকারী‚ নিজেই ভুল বোঝা মানুষ‚ আবার একইসাথে তার ভেতরে ছিল ভালোবাসার গোপন বীজ। এবং এখানেই আসে একটা জটিল মানসিক অসামঞ্জস্য।

নিজের ভালোবাসার মানুষকে ধ্বংস করে ফেলার ভয়ঙ্কর অপরাধবোধ আর তার জন্য আত্মঅভিশাপ‚ এমন ট্রমা সাধারণ পিটিএসডির চেয়েও বেশি গভীর। শায়াফ দুর্বল হয়ে পড়েনি। সে নিজের ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দিয়ে বড়ো একটা মানসিক ধাক্কা খেয়েছে আসলে। এখন আমাদের কাজ হলো‚ ওকে এমন এক মানসিক ভিত্তি দিতে সাহায্য করা‚ যাতে সে এই গ্লানিকে শাস্তি নয়‚ বদলে যাওয়ার শক্তি হিসেবে নিতে শেখে।”

“আমাকে তাহলে বলুন‚ আমি ঠিক কী করলে ওকে বাঁচাতে পারব? কী করতে হবে আমাকে?” যতটা সম্ভব শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন শাফিউল সাহেব। কিন্তু ভেতরে চলছিল তার আতঙ্কিত ঝড়।

“স্যার‚ শায়াফ এখন এমন এক মানসিক অবস্থায় আছে‚ যেখানে সে নিজেকেই নিজের সবচেয়ে বড়ো শত্রু মনে করছে। ওর সকল ভুল বিশ্বাস থেকে ওকে বের করতে হলে আগে দরকার একটা নিরাপদ মানসিক জায়গা। মানে এমন একটা পরিবেশ‚ যেখানে ও নিজেকে চাপমুক্তভাবে প্রকাশ করতে পারে। কাঁদতে পারে‚ চুপ থাকতে পারে‚ রাগ করতে পারে‚ কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না‚ বিচার করবে না। এবং এই জায়গাটা আপনিই হতে পারেন। আপনি যদি শুধু বোঝান আপনি ওর পাশে আছেন‚ তাহলেই ধীরে ধীরে ওর মনটা স্বাভাবিক হবে। ও বিশ্বাস করবে‚ ‘আমি একা না। আমাকে কেউ এখনো মানুষ হিসেবে দেখে।’ কারণ‚ ওকে যতটুকু বুঝেছি‚ ও অতি মাত্রায় চাপা হৃদয়ের মানুষ। ওর ভেতরের কথাকে টেনে বের না করা পর্যন্ত ও কিচ্ছু প্রকাশ করবে না। এই দুর্ঘটনার বেশ আগে থেকেই ও এই গভীর ট্রমার শিকার হয়েছে৷ যেটা বোধ হয় আপনারা কেউ বিন্দুমাত্রও টের পাননি ওকে দেখে।”

“ও বুঝতেই দেয়নি কোনোভাবে”‚ বিষণ্ণ‚ বেদনার্ত এক সুরে কথাটা বললেন শাফিউল সাহেব।

“বুঝতে পেরেছি তা”‚ ঠোঁট চেপে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল রায়হান। তারপর বলল‚ “স্যার‚ আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো সানার ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি। শায়াফ যদি দেখে আপনি সানার প্রতি সহানুভূতিশীল‚ তার কষ্টকে সম্মান করছেন‚ তাহলে ওর মনে হবে‚ ‘আমি ভুল করেছি‚ তবুও আমার প্রিয় মানুষটিকে কেউ সম্মান করছে।’ অথবা‚ ‘বাবা তো সানার দিকেই আছেন। কিন্তু আমাকেও পুরোপুরি ঘৃণা করছেন না। তাহলে কি আমি এখনো একজন মানুষ হিসেবে টিকে আছি? এখনো কি বদলাতে পারি আমি?’ ওকে অনুভব করাতে হবে‚ কেউ যদি ভালোবাসার মানুষকে কষ্টও দেয়‚ তাতেই সে ভালোবাসা পুরোপুরি ঘৃণায় রূপ নেয় না সবসময়। ভালোবাসার ভেতরেও জায়গা থাকে ক্ষমার‚ বোঝাপড়ার‚ সহানুভূতির। তাহলে ওর মনের মধ্যে একটা নতুন বিশ্বাস জন্মাবে‚ ‘আমার ভালোবাসা মানেই হয়ত আমার প্রতি সানার ঘৃণার অনুভূতি না শুধু। হয়ত এখনো সম্পর্কটা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি।’ এই অনুভবটা ওর আত্মাকে একটু হলেও আশ্বস্ত করবে। কিন্তু আপনি যদি উলটো বলেন‚ সানাই আসলে দোষী‚ তাহলে শায়াফ ভাববে‚ সে যাকে কষ্ট দিয়েছে তাকেই সবাই অপমান করছে। মানে তার অপরাধকে চাপা দিতে সবাই মিলে ভুক্তভোগীকেই দোষারোপ করছে। তাহলে এই অনুভূতি ওকে আরও বেশি পাপী‚ নষ্ট‚ অযোগ্য ভাবাবে। তাই স্যার‚ এখন আপনার সবচেয়ে দরকার একজন বিচারকের মতো কঠোর হওয়া নয়। দরকার একজন বাবা হয়েও বন্ধুর মতো হয়ে ওঠা। এমন একজন‚ যার পাশে দাঁড়িয়ে শায়াফ নিজেকে মানুষ হিসেবে ফিরে পেতে শেখে।”

“মেয়েটাকে ভালো না বাসলে ওর চিন্তাভাবনা আজ এমন হত না‚ তাই না?” ছেলেকে হারানোর ভয় আর ছেলের মানসিক পরিস্থিতি জেনে দুশ্চিন্তা‚ কষ্ট থেকে না চাইতেও ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া দিয়ে ফেললেন তিনি‚ “আর ভালোবাসা মানেই কি এই রকম ভয়ঙ্কর সব চিন্তা করতে হবে? আজকাল অন্য কোনো ছেলেরা ভালোবাসে না না-কি?”

মুচকি হাসল রায়হান‚ “ভালোবাসা তো সবার একরকম হয় না‚ স্যার। কেউ একটু ভালোবাসে‚ কেউ খুব গভীরভাবে। শায়াফ ওর অনুভবের ব্যাপারটা যেদিন বুঝেছে‚ সেদিন থেকেই সানার প্রতি ওর টানটা দিনে দিনে শুধু বেড়েই চলেছে। আর এখন সেটা একেবারে চরমে পৌঁছেছে। গভীরতাটা যত বেশি‚ প্রভাবও ততটাই গভীর হয়। এটাই স্বাভাবিক।”

“ও এরকমই‚ বাবা!” কথাটা বলতেই গলাটা কেঁপে উঠল শাফিউল সাহেবের৷ কান্নারুদ্ধ গলাতেই বললেন‚ “ও ভালোবাসলে একদম উজাড় করে বাসে। ওর জীবনে অন্য কোনো দুর্বলতা নেই। দুর্বলতায় ওর ভালোবাসার মানুষগুলো৷ মানে আমরা৷ সেটা কাজে প্রকাশ করে ফেলে। প্রচণ্ড পজেসিভ আর প্রোটেক্টিভ থাকে আমাদেরকে নিয়ে৷ এজন্যই তো ফারনাজ কবির‚ রাজন‚ এদের ওপর প্রতিশোধ নিতে উঠেপড়ে লেগেছিল৷ কিন্তু যেখানে আজ ও নিজেই আঘাত দিয়ে ফেলেছে ওর ভালোবাসার মানুষকে। সেখানে তাই নিজেই নিজের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে৷ নিজের ভালোবাসর মানুষদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের কাছে ও নিজেকেও ছাড় দিতে রাজি না।”

এ পর্যায়ে রায়হান পেশাদার মনোরোগ চিকিৎসক থেকে বেরিয়ে এসে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বলল‚ “আপনারা ওর দুর্বলতা‚ এই সত্যটা ও জানে বলেই সেই দুর্বল জায়গাটাকেই ও এখন কেটে ফেলতে চাইছে। কারণ‚ ও ভাবে‚ ভালোবাসার মানুষদের কষ্ট দিয়ে ও নিজেকে মানুষ বলার যোগ্যতা হারিয়েছে। এই একরোখা মনোভাবই এখন ওকে ভেতর থেকে গিলে খাচ্ছে।”

কথাগুলো বলার পর একটু প্রশংসা মিশল তার কণ্ঠে‚ “শায়াফ নিজের অনুভূতির দায় কাউকে দিতে পারে না‚ স্যার। তাই হয়ত ওর ভালোবাসাও যেমন গভীর‚ ভুল করলে তার প্রায়শ্চিত্তও হয় সীমা ছাড়া।”

***

৮ মে
বিকাল ৫: ২০

আজ অনেকদিন পর সানা স্বেচ্ছায় বসার ঘরে এসে সবার সঙ্গে চায়ের আসরে যোগ দিল। পাশের ফ্ল্যাটের দুজন পড়শিও আছে এই আসরে। যাদের মাঝে একজন নার্স ফারজানা। সে অবশ্য আজই প্রথম এল রেশমা বেগমের বাসায়। এমনিতে তাদের গল্পগুজব চলত বাসার ছাদে।

সবার গল্প শুনতে শুনতে মায়ের পাশে বসে এক কাপ চা হাতে নিয়ে সানা জিজ্ঞেস করল মাকে‚ “তুমি সত্যি আমাকে রেখে যাবে?”

“থাক‚ সমস্যা কী? দুটো মাসই তো।”

“আমার যদি মন না টিকে তাহলে কিন্তু থাকব না। আব্বুকে পাঠিয়ে দেবে।”

“আচ্ছা‚ ঠিক আছে। জোর করে তোকে রাখবে না কেউ।”

সানার থেরাপির সময় মাস খানিক পেরিয়েছে। চোখে পড়ার মতোই ওর মানসিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে এখন। আজকাল আর চুপচাপ থাকে না সে‚ মন খোলা হাসিও হাসে না অবশ্য। মুখে একরকম শান্ত ভাব। কিন্তু আচার-আচরণে স্বাভাবিকতা ফিরছে ওর। রাতে ঘুম না হওয়ার সমস্যাটাও ধীরে ধীরে কাটছে। নিজেকে সুস্থ করার তাগিদটা ছিল ওর মাঝে বেশ৷ যার কারণে সেদিনের পর থেরাপির প্রতিটি ধাপে সে নিজের অনুভূতিগুলোর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে নিজেই বোঝাপড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণা‚ ঘৃণা‚ ভয়‚ আবার শারফানের প্রতি অনুভব হওয়া সহানুভূতি‚ এ সব কিছু নিয়ে যে দ্বিধার জালে আটকে আছে‚ তা থেকে বেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে৷ আজ সকালেও সে ভাবছিল‚ সে কি শারফানকে ক্ষমা করতে পেরেছে?

প্রশ্নটার কোনো সরাসরি উত্তর ছিল না ওর কাছে। তবু ওর ভেতরের অনুভব বলছিল‚ হ্যাঁ‚ হয়ত করতে পেরেছে। কিন্তু সেটা শারফানকে মুক্তি দেওয়ার জন্য না। সে এখনো জানে‚ শারফান তার জীবনের ভয়ঙ্করতম অধ্যায়। যার কাছে সে নিজের শরীর আর আত্মাকে আঘাতে জর্জরিত হতে দেখেছে। ওই মানুষটিকে সে আর জীবনে কোনোদিন দেখতেও চায় না। আবার সেই ভয়াবহ অধ্যায়ের বোঝা সে বয়ে বেড়াতেও চায় না। সে চায় না নিথর বেশের শারফান ওর স্বপ্নে আসুক , আর জাগরণে ওকে অসাড় করে রাখুক। সে কেবল চায় ওর কান্নাগুলো আর ওর গলার ভেতর আটকে না থাকুক। সে চায় কেবলই নিজের মুক্তি। শারফানের প্রতি ক্ষমাটা এসেছে সেই মুক্তির খোঁজে। ওর একটাই সিদ্ধান্ত‚ ‘আর নয়। আমি আর ওর কারণে আমার শান্তিটুকু বিসর্জন দেব না।’

আজ নিরালায় নিজের অনুভূতিগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া শেষে সানা বুঝতে পেরেছে‚ ক্ষমা মানে সবটা ভুলে যাওয়া না‚ মানে সেই মানুষটাকে আবার ভালোবেসে ফেলা না‚ তার প্রতি পুরনো অনুভূতিকে মেরামত করাও না। ক্ষমা মানে হলো‚ বুকের ওপর দীর্ঘদিনের চেপে বসা বোঝাটাকে নামিয়ে রাখা। নিজের মধ্যেকার সেই কাঁটাকে ছুঁড়ে ফেলা‚ যেটা রোজ রক্ত ঝরাত ওর হৃদয়ে। অথচ কোনো দাগ ফেলত না বাইরে।

শারফান এখন কোথায় আছে‚ কেমন আছে, আদৌ বেঁচে আছে কি-না‚ সানা আর জানতে চায় না তা। জানার প্রয়োজনও আর অনুভব করে না। কারণ‚ ওর ভেতরের শান্তিটা এখন আর শারফান নামের সেই পুরুষটার জীবনের ওপর নির্ভর করে না। ওর শান্তি এখন ও নিজের ভেতর থেকেই খুঁজে নিতে চাইছে। আর সেই শান্তির দরজায় পৌঁছাতেই সে শারফানকে ক্ষমা করেছে।

***

একই দিনে শারফানও আজ মুক্তি পেয়েছে হাসপাতাল থেকে। বাসায় এখন রিহানের পরিবার‚ শাকিবুল হকের পরিবার। শারফানের কাছের কিছু বন্ধু-বান্ধবও কেউ কেউ এসেছিল৷ আর জিসান এল সন্ধ্যার পর। শোবার ঘরে ঢুকেই চওড়া এক হাসি দিল সে‚ “খাবারের গন্ধে তোর বাড়িতে তো টেকা যাচ্ছে না রে।”

বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে কী যেন করছিল শারফান নিজের ট্যাবটা হাতে নিয়ে। কথাটা শোনার পরই চোখ তুলে জিসানকে এক পলক দেখল৷ তারপর হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠল বাড়ির কাজের লোকটাকে‚ “ও ট্যারা মামা… পায়েস টায়েস‚ যা যা হয়েছে নিয়ে এসো সব।”

মুহূর্তেই বিব্রত হয়ে পড়ল জিসান। “হপ ব্যাটা…” ধমক লাগিয়েই শারফানের বাহুতে আলতো এক চাপড় বসাল।

“ও বাবা…! তুমি আবার খাওয়া নিয়ে লজ্জা শরম করা শিখলে কবে থেকে?” বিদ্রুপ সুরে বলল শারফান।

“বাড়ি ভর্তি কত লোক এখন! তাদের সামনে নির্লজ্জ হতে বলিস না-কি?”

মৃদু হাসল শারফান। তখনই একটা লোক খাবারের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। গায়ে রংচটা একটা ফুলহাতা নীল শার্ট আর চেক প্রিন্টের লুঙ্গি‚ উচ্চতা পাঁচ ফিট‚ রুগ্ন শরীর‚ মাথায় কোঁকড়া চুল‚ সামনের সারির দাঁতদুটো তার বেজায় উঁচু আর চোখদুটো ট্যারা। এই ট্যারা চোখের জন্যই তার নাম টুকু থেকে ট্যারা হয়েছে। মানুষটাও বড্ড রসিক আর কিছুটা বোকাসোকা। তবে রান্নার হাত তার বড়ো বড়ো হোটেলের শেফদের থেকে কম নয়৷ কিন্তু সে কাজ করে কেবল শারফানের বাসাতেই। বয়সটা পঁয়ত্রিশের আশেপাশে। কিন্তু এখনো কোনো বিয়ে-শাদি করেনি। করার কথা জিজ্ঞেস করলেও সোজাসুজি কোনো উত্তর দেয় না। শারফানের বাসাতেই স্থায়ীভাবে থাকে। আর বেতন নেয় যেদিন তার মন চায়‚ সেদিন।

খাবারগুলো টি-টেবিল টেনে রাখতে রাখতে বলে উঠল‚ “অতদিন পর বাড়িডা জাইন্দা অইল রে…!”

তাকাল না শারফান। ট্যাবে দৃষ্টি রেখেই তিরস্কার করে বলল‚ “আগেও কি জাইন্দা ছিল এ বাড়ি?”

“ছিলই ত‚ রাতডা থাকত বাড়িত। অইডাত্ত বাড়িডা জাইন্দা লাগত!” বলেই পায়েসের একটা বাটি বাড়িয়ে দিল জিসানের দিকে‚ “নেন মামা‚ খাইয়া দেখেন না! অই সাদ পাইবেন আমার হাতের পায়েসত। হাত দিয়া খাইলে বাড়ি যাইতে যাইতে আঙুল চাটত চাটত যাইবেন‚ কই!”

সুস্বাদু খাবারের কাছে জিসান লাজলজ্জা রাখে না তেমন৷ হাসতে হাসতে পায়েসটা মুখে দিয়েই ট্যারা মামার প্রশংসা করতে লাগল একটু বাড়িয়ে বাড়িয়েই৷ তার মাঝেই শারফান বলে উঠল হঠাৎ‚ “আগামীকাল বেলা বারোটার মাঝে প্রেস কনফারেন্সের ব্যবস্থা করে দিতে হবে তোমাকে। আর মগবাজারের ওসি শালার কাছে আমার একটা জিনিস পাঠাবে।”

বোকা চাউনিতে তাকাল জিসান। “কী বললি?” বিভ্রান্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “প্রেস কনফারেন্স করে কী করবি? আর শেষে কার কথা বললি? ওসি চাকলাদারের কথা না-কি?”

“হুঁ‚ ঠিক শুনেছ।”

“তোর নাম শুনলেই তো ওর চেহারাটা নেড়িকুত্তার মতো হয়ে যায়। যেন চোখের সামনে পেলেই ছিঁড়ে খাবে তোকে।” বিস্মিত হয়ে বলল জিসান‚ “ওই খ্যাপা ষাঁড়ের কাছে আবার কী পাঠাবি?”

শারফান হাসল। কেমন একটা হাসি যেন তা! মজা পেল‚ না-কি তাচ্ছিল্য ফুটল সেই হাসিতে‚ তা ঠিক বুঝল না জিসান। তাকে চমকে দিয়ে শারফান জানাল‚ “দ্য রেকর্ডেড ভয়েজ অফ মাই অ্যাডমিশন অফ গিল্ট।”

চলবে।