#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৫১.
৯ মে
বিকাল ৪:৩০
রিহানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে না পেরে বিছানায় বসে একদম যেন খাঁচায় আটকা বাঘের মতো গজরাচ্ছে শারফান। হাতের কাছেও এমন কিছু নেই‚ যেটা ছুড়ে মারতে পারে রিহানকে। ওর কোনো হুমকিতেও ভয় পাওয়ার লক্ষণ নেই রিহানের মাঝে। সে নির্বিকারভাবে চেয়ারে বসে নিজের কাজে ব্যস্ত। শারফানের ফোন‚ ল্যাপটপ‚ ট্যাব‚ সবগুলো ডিভাইসে খুঁজে বেড়াচ্ছে ওর সেই ভয়েজ রেকর্ডটা—পেলেই সে ডিলিট করবে। শারফান গর্জন ছেড়ে উঠল‚ “বান্দির বাচ্চা… আমি উঠতে না পারলেও তোকে ধরার মতো মানুষের অভাব আছে? তোর মার কসম! লোক ভাড়া করে তোকে রামচো** দেওয়াব আমি!”
বিরতিহীন গালি-গালাজ করেই চলেছে শারফান৷ সেসবে রিহান আজ মোটেও জবাব দিতে আগ্রহী না। ঘরের দরজাও বন্ধ‚ তাই বাইরে থেকে কেউ টেরও পাচ্ছে না ভেতরে কী চলছে৷ এর মাঝে মনের ভুলে একবার দাঁড়াতে গিয়ে পায়ে প্রচণ্ড ব্যথাও পেয়েছে শারফান। তবুও কোনো মায়া করেনি রিহান।
শেষ পর্যায়ে শারফান রাগে অস্থির হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে তাকে বলল‚ “নিজে গিয়ে সারেন্ডার করি‚ সেটাই বাধ্য করছিস আমাকে?”
এবার হেলদোল দেখা গেল রিহানের মাঝে। ফোন থেকে চোখটা তুলে আগুন দৃষ্টিতে তাকাল৷ তারপর হঠাৎ করে সেও অনর্গল গালি ছুড়তে থাকল শারফানকে। যা শারফানের গালিগুলো থেকেও ভয়ানক। সে সময়ই দরজায় ঠকঠক করে ডাকল জারা‚ “ওই‚ রিহান ভাইয়া? দরজা খুলুন৷ কী করছেন আপনারা দরজা বন্ধ করে?”
সঙ্গে সঙ্গেই চুপ করে গেল রিহান৷ শারফানও মুখটা স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করল। রিহান গিয়ে দরজা খুলতেই জারা এক বাটি হালিম নিয়ে ঘরে ঢুকল৷ দরজায় এসে দাঁড়াতে তখন রিহানের চেঁচামেচি হালকা কানে আসছিল তার। তাই দুজনের দিকেই সন্দেহ নিয়ে তাকাল একবার। কারণ‚ এদের দুজনের মাঝে প্রায়ই মারামারি আর ঝগড়াঝাঁটি হতে দেখেছে সে। কিন্তু এখন তার অসুস্থ ভাইয়ের সঙ্গে রিহান কী নিয়ে চেঁচামেচি করতে পারে? তা জিজ্ঞেস করেই বসল সে শারফানকে‚ “ঝগড়া করছিলি তোরা?”
“ফকিন্নির বাচ্চা আমার ফোন‚ ল্যাপটপ সব হাইজ্যাক করছে”‚ রিহানের দিকে আঙুল তুলে শারফন জবাব দিল জারাকে। “তাড়াতাড়ি কেড়ে নে তো ওর কাছ থেকে!”
“তোর দাদা ফকিনির বাচ্চা‚ শালা ল্যাংড়া”‚ মুহূর্তেই খেপে গেল রিহান। তারপর জারাকে বলল‚ “তোর ভাই তোর ভাবির ছবি লুকিয়ে রেখেছে এগুলোর একটাতে। আমাকে দেখতে দেবে না‚ বুঝেছিস?”
“আমার ভাবি”‚ জারার কণ্ঠে প্রশ্ন আর বিস্ময় এক সঙ্গে। কিন্তু সে বিশ্বাস করল না‚ “ধুর! আজগুবি কথা বলছেন৷ ভাইয়ার সঙ্গে জীবনেও কোনো মেয়ে কোনোদিন প্রেম করবে না। করলেও টিকবে না সে।”
“হ্যাঁ‚ একদম সত্যি। মেয়েদের রুচি অত খারাপ না-কি? কিন্তু তোর ভাইয়ের রুচি ভালো৷ আমাদের কাউকে না জানিয়ে একা একা মেয়ে পছন্দ করে রেখেছে।”
এবার জারা বিস্ময় চোখে শারফানের রাগান্বিত চেহারাটার দিকে তাকাল‚ “ভাইয়া‚ সত্যি?”
“আরে সত্যি”‚ কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই রিহান গড়গড় করে মিথ্যা চালিয়ে গেল‚ “মেয়েটার নামেই কোনো ফোল্ডার বানিয়ে তার ছবি লুকিয়ে রেখেছে ও। দেখতে চাইলে আয় এক সঙ্গে খুঁজে বের করি।”
ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে গেল শারফানের। “রিহান…” সারা ঘরটা কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল সে‚ “বের হ আমার ঘর থেকে… এখনই বের হ তুই… আমার চোখের সামনে থেকে সর‚ কুত্তার বাচ্চা!”
“আর একবার বাপ-মা তুলে গালি দিবি‚ জুতা দিয়ে তোর মুখ ভাঙব!” চাপা গলায় রিহান হুমকিটা দিতেই শারফানের ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে ‘জিসান ভাই’ নামটা দেখে রিসিভ করল সে-ই‚ “হ্যাঁ‚ ভাইয়া‚ আমি রিহান বলছি।”
জিসান ফোনের ওপাশ থেকে কী যেন বলল‚ আর অমনি রিহানের চোখে-মুখে তাড়াহুড়ো ভাব ফুটে উঠল। তারপর কলটা কেটেই শারফানকে জিজ্ঞেস করল‚ “তুই সত্যিই প্রেসের সামনে বসে কনফেশন দিবি?”
“নাটক চো**চ্ছি আমি?” খেঁকিয়ে উঠল শারফান।
“তোর বাপ-মা‚ বোনের কথা ভাববি না?”
“কী কনফেশন দেবে ভাইয়া?” অবাক হওয়ার পালা শেষই হচ্ছে না জারার। জিজ্ঞেস করল রিহানকে‚ “কী ভাববে আমাদের কথা? আর প্রেস মিডিয়া বসবে না-কি বাড়িতে?”
রাগ সরিয়ে শারফান বোনের মুখটার দিকে তাকাল তখন৷ বোনের জন্য নেওয়া ওর পদক্ষেপে সারা দেশের মানুষ সম্মানের যে উচ্চ আসনে বসিয়েছে ওকে‚ অথচ সে-ই কী বর্বর নির্যাতন করেছে অন্য একটি মেয়েকে—তা জানার পর ওর জন্য ওর বোনের প্রতি সকলের সহানুভূতির দৃষ্টিভঙ্গিটুকু বদলা যাবে না তো? আবারও তারা ওর বোনটাকে ভুল বুঝে চরিত্রহীন মেয়ে বলবে না তো? ভীষণ এক দ্বিধা ফুটে উঠল শারফানের চোখে। কিন্তু তারপরই মনে পড়ে গেল সানার কথা‚ তার পরিবারের কথা। ওর কথা শুনেই তো কোনো সত্য স্বীকার করেনি সানা‚ ওর জন্যই কোনো প্রমাণ দেয়নি সে পুলিশকে। অথচ বিচার পাওয়ার অধিকার তো তারও রয়েছে।
“চল‚ তোকে নিয়ে বের হব আজ”‚ হঠাৎ শারফানের চিন্তাভাবনার মাঝেই রিহান বলে উঠল।
“ভাইয়া‚ কী বলছেন আপনারা?” জারা চিন্তিত হয়ে জানতে চাইল‚ “আর এই অবস্থায় ওকে নিয়ে কোথায় যাবেন? কী করতে চাইছেন আপনারা আসলে?”
“বানি”‚ শারফান শান্ত গলায় ডেকে জারাকে বলল‚ “গুরুত্বপূর্ণ কিছু না৷ টেনশন নেওয়ার মতো কিছু হয়নি। ঘরে যা‚ কথা বলব আমরা।”
“টেনশন নেওয়ার মতো কিছু না হলে রিহান ভাই আমাদের কথা তোকে ভাবতে বলল কেন?”
রিহানের দিকে তখন ক্ষিপ্ত চোখে তাকাল শারফান। ও জবাব দেওয়ার আগেই রিহান বলল জারাকে‚ “তোর ভাই দেখিস না কারও কোনো কথা মানে না? ডাক্তার বলেছে হাঁটার মতো পরিস্থিতি এখনো হয়নি ওর পায়ের৷ তাও ও একটু আগে হাঁটতে গিয়েছিল৷ সেজন্যই বললাম তোদের কথা ভেবে যেন নিজেকে সুস্থ রাখে।”
“কিন্তু প্রেসের সামনে বসে কিসের কনফেশন দেবে ও? সেটা নিয়ে আপনি বলেছিলেন আমাদের কথা ভাবতে‚ তাই না?” বিভ্রান্ত চোখে চাইল জারা দুজনের দিকেই।
শারফান এবার অনিচ্ছা থেকেই একটা ধমক বসাল তাকে‚ “তোকে এত কথা জিজ্ঞেস করতে বলেছে কে? কোনো প্রেস ফ্রেসের সামনে বসছি না আমি৷ ঘরে যা এবার! নিচে নামবি না আর৷ তোকে সিঁড়ি বাইতে নিষেধ করা হয়েছে না?”
শারফান আপাতত নিচতলার একটি ঘরে থাকছে—সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা অসুবিধা বিধায়। আর সঙ্গে থাকছেন শাফিউল সাহেব। ছেলের ব্যক্তিগত কাজগুলোতে সহায়তা করছেন তিনিই।
ধমক খেয়ে জারা উলটো রাগ দেখিয়ে হালিমের বাটিটা আর দিল না ভাইকে। হাতে নিয়েই ফিরে গেল সে৷ তারপরই শারফান ধমকে উঠল রিহানকে‚ “এই শুয়ার‚ কোন সাহসে তুই ওর সামনে এসব কথা তুললি?”
“আচ্ছা নে… সরি বলছি। কিন্তু আদতে আমি মোটেও সরি না। ওর সামনে বললাম যেন ওর প্রশ্নের মুখে পড়ে তুই ভাবতে বসিস যে‚ যা করতে চাইছিস তা কতটা ঠিক।”
শারফান জবাব দেওয়ার আগেই সে এবার জানাল‚ “জিসান ভাই একটা জায়গায় যেতে বলেছে তোকে। চল‚ রেডি করে দিই।”
“কোথায়‚ আগে সেটা বল।”
“বের হলেই জানতে পারবি।”
বাইরে বের হওয়ার জন্য শারফানেরও মনটা খুব ছটফট করছিল৷ তাই আর নাকচ করল না। রিহানের সাহায্যে বাথরুমে ঢুকে গোঁফ-দাড়ি হালকা ছেঁটে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে তারপর পোশাক বদলাল। কালো লুস কার্গো প্যান্টের সঙ্গে কালো টি শার্ট আর সাদা শার্ট ঢোকাল গায়ে। শার্টের বোতামগুলো ছেড়ে রেখে বহুদিন বাদে আজ শখের চুলগুলোতে হাত দিল সে৷ ক্রিম মেখে মন মতো চুলগুলোকে গুছিয়ে পায়ে যখন সাদা স্নিকার্সজোড়া পরতে নিল‚ তার আগেই রিহান এসে বসে তা পরিয়ে দিল ওকে। পরানোর মুহূর্তে অবশ্য মুখটা থেমে ছিল না তার৷ কিন্তু শারফান কিছু বলল না‚ রাগলও না তার গালাগাল শুনে‚ চুপচাপ শান্তভাবে দেখতে লাগল শুধু৷
কিন্তু ঝামেলা দুজনের হলো আবার বের হওয়ার আগ মুহূর্তে। শারফান ক্রাচ ছাড়া হুইল চেয়ারের সাহায্য নিয়ে বের হবে না৷ আর ফিজিওথেরাপিস্টের আদেশ ক্রাচে ভর দিয়ে বড়োজোর তিন থেকে পাঁচ মিনিট করে দু’তিনবার হাঁটতে পারবে শুধু৷ আরও সপ্তাহ দুটো যাবে‚ তারপর সে ক্রাচের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারবে৷ কিন্তু এ মুহূর্তে ওকে নিয়ে যাওয়া হবে যেখানে‚ সেটা বেশখানিকটা হাঁটাহাঁটির পথ৷ তাই হুইলচেয়ার ছাড়া গতি নেই ওর৷ সেটাই শারফান মানতে রাজি না৷ কেননা‚ হুইলচেয়ার মানেই ওর কাছে অথর্ব‚ অক্ষম মানুষের ব্যবহারযোগ্য বস্তু মনে হয়৷
বাড়ির সকলে মিলে ওকে রাজি করাতে গিয়ে যখন হিমশিম খাচ্ছিল‚ ঠিক তখনই রিহান কানে কানে ওকে হুমকি দিল‚ “মামার কাছে কি বলে দেব তুই কী করতে চাচ্ছিস? মামাকে তো চিনিসই। যদি জানে তোর মগজে কী চলছে‚ তাহলে তোর দেশে থাকার আয়ু শেষ। অজ্ঞান করে হলেও তোকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে। যতদিন না সোজা হবি‚ ততদিন পর্যন্ত তোকে কীভাবে বাইরে আটকে রাখা যায়‚ তার সবই করবে কিন্তু।”
টনিকের মতো কাজে দিল যেন হুমকিটা৷ রিহানের দিকে কেবল রক্তচোখে তাকাল শুধু শারফান। আর কিছুই বলল না। গাড়িতে উঠল রিহান আর ট্যারা মামার সাহায্যে। যেতে পথে জিসান একবার ফোন করে খোঁজ নিল‚ কতদূর এগোল ওরা।
***
শুটিং পয়েন্ট—ধানমন্ডি লেকের এক নিবিড় সৌন্দর্যে মোড়ানো দৃশ্যপট। লাল ইটের হাঁটার পথ ধরে গেলে যেখানে একপাশে সবুজ‚ শান্ত জলরাশি আর অন্যপাশে ছায়াঘেরা গাছের সারি। পাতায় পাতায় খেলে যায় আলো-ছায়ার ছন্দ। বটগাছ‚ পাকুড় আর কৃষ্ণচূড়ারা এখানে যেন শতাব্দীর সাক্ষী। স্নিগ্ধ বাতাস‚ পাতার ফাঁক গলে আসা রোদেরা করে জলে ঝিকমিক‚ আবার হঠাৎ মেঘ এসে সেই আলোকে করে দেয় নরম। আর জলের কিনার ঘেঁষে থাকা লাল ইটের তৈরি বসার ঘাটগুলো যেন অনন্তকাল ধরে কারও অপেক্ষা আছে। কেউ এসে বসে হয়ত কবিতা পড়বে‚ কেউ গল্প বলবে‚ কেউ আবার কেবল চুপচাপ বসে থাকবে। আকাশের রং‚ জলের স্পন্দন‚ পাতার মৃদু আন্দোলন‚ সব মিলিয়ে এখানে এসে বসলে মনে হয়‚ জীবন একটু থেমে গেছে‚ একটু গভীর হয়ে উঠেছে।
ঝিমধরা বিকেলটাই শারফান এসে বসল এই শুটিং পয়েন্টের ঘাটে। ওকে বসিয়ে ট্যারা মামা হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে যখন আসছিল‚ লেকের সবাই তখন কেমন দৃষ্টিতে চেয়ে ওকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল৷ ক’দিন আগে ফেসবুকে তোলপাড় করা ছেলেটাকে কেউ চিনতে পেরে অবাক চোখে দেখছিল‚ কেউবা চোখে শোকাচ্ছন্ন ‘আহারে’ ভাষা নিয়ে দেখছিল‚ কেউবা এমন তাগড়া যুবকের হাঁটার ক্ষমতা নেই দেখে আফসোস ভরে দেখছিল৷ তাদের চোখের ভাষা অনায়াসেই পড়তে পেরে চোয়ালদুটো শক্ত করে বসে শারফান এগোচ্ছিল চুপচাপ। আর ধানমন্ডি লেক কি জীবনে দেখেনি ও‚ যে জিসান ওকে এখানে ধরে নিয়ে এল?
দুইয়ে মিলিয়েই মাথা খুব গরম হয়ে আছে ওর। তা বুঝতে পেরেই ওকে বসিয়ে জিসান দ্রুত গেছে ফুডকোর্ট থেকে কোল্ড কফি আনতে। প্রায় আধা ঘণ্টা হয়ে চলল‚ কিন্তু এখনো তার ফেরার কোনো খবর নেই। বাতাসে ঢেউ খেলা লেকের জলের দিকে চেয়ে রিহান আর ট্যারা মামার বকবকানি শুনছিল সে একরাশ বিরক্তি নিয়ে। তারপর হঠাৎ করেই ঘাড়টা ডানে ঘুরাল‚ আর সামনের পথটার দিকে তাকাতেই সময় যেন কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল ওর। চোখদুটো একবার বুজে আবার খুলল তখন৷ তারপর আবার মেলে সামনে চাইল। সানা! হ্যাঁ‚ সানাকেই তো দেখতে পাচ্ছে! লাল ইটের পথটা ধরে হেঁটে আসছে সে। ধীর‚ নির্লিপ্ত কিন্তু আত্মবিশ্বাসী কদম ফেলে। পরনে হালকা সাদা রঙা জামা। যেন দুধের সঙ্গে গোধুলির একফোঁটা রোদ মিশে আছে। কানে সাদা পাথরের ছোট্ট দুলটা ঝিলিক দিচ্ছে৷ দু’হাতে একগাছা রুপালী চুড়িগুলোও রোদ লেগে ঝলমল করছে। মাঝখানে সিঁথি করা লম্বা‚ রেশমি খোলা চুলগুলো হালকা বাতাসে সামান্য উড়ছে। শেষবার দেখা শীর্ণ রূপের শরীটা তার ভরেছে বেশে। সেই আগের সানার সঙ্গে বেশ মিল এখন। কিন্তু সারা মুখে ছড়িয়ে আছে অচেনা এক গাম্ভীর্য। যেন জলরঙে আঁকা এক দৃঢ় প্রতিচ্ছবি। যে কারও চোখে আর প্রেম খোঁজে না‚ কেবল অটল অভিমান রাখে নিজের দু’চোখে।
শারফান তাকিয়ে থাকে অসীম বিস্ময়‚ প্রগাঢ় মুগ্ধতা‚ গভীর তৃষ্ণা নিয়ে। সেই তৃষ্ণা মেটাতে মেটাতে হাতটা বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরে সে—হৃদয়টা কী বিপজ্জনক গতিতে লাফঝাঁপ করছে! আরে… ও মেয়ে কি ওর দিকেই আসছে? শারফান আঁতকে উঠল সহসাই… আরও বেসামালভাবে ধুকপুক করতে লাগল ওর বুকটা। কয়েক মুহূর্তের মাঝেই একদম ওর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল সানা‚ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে।
কত দিন পর… কত কাছ থেকে আজ মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে শারফান! হিসেবটা মাথায় এল না‚ চোখের পাতাও পড়ল না ওর৷ চুপচাপ চেয়ে রইল দুজনই দুজনের চোখে। মিনিটখানিক কাটার পর সানাই চোখটা সরাল‚ তারপর তাকাল একবার রিহানের দিকেও আর ট্যারা মামার দিকেও৷ সেই দৃষ্টিতে কী বুঝল ওরা কে জানে! রিহান চট করেই ট্যারা মামাকে বগলদাবা করে সরে পড়ল সেখান থেকে। কিছু না জানা ট্যারা মামাও কিছু একটা আন্দাজ করে কোনো দ্বিরুক্তি করল না৷ কিন্তু একাকী ওরা হতে পারল না৷ আচমকা দ্রুত পায়ে এসে সানার পেছনে হাজির হলো প্রিন্স আর একটি মেয়ে। মেয়েটা তার প্রেমিকা রিনি৷ দুজনের চোখেই দারুণ কৌতূহল আর বিস্ময়। তারপরই হাজির হলো জিসান‚ হাতে কোল্ড কফি সমেত। শারফানও সবাইকে দেখতে লাগল কৌতূহল নিয়ে৷ ওর চেহারাতেই ফুটে উঠেছে‚ ঠিক কী হবে এখন তা সে কিছুই বুঝতে পারছে না! বোঝার জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষাও করতে হলো না ওকে।
“কী করছেন আপনি?” জিজ্ঞেস করে উঠল সানা সহসাই। কণ্ঠে তার শীতলতা‚ কিন্তু রাগটাও স্পষ্ট।
ড্যাবডেবিয়ে তার দিকে চেয়ে কয়েক পল নিস্তব্ধতায় কাটাল শারফান৷ বিমূঢ়তার মাঝে সে৷ নিরীহ মুখে মিনমিনিয়ে জবাব দিল‚ “এইতো… বসে আছি।”
“বসে থাকুন আর দাঁড়িয়ে থাকুন‚ যা খুশি করুন”‚ ঝাড়ি মেরে উঠল সানা। রাগটা ক্রমশ চেহারাতেও ভেসে উঠল তার। “আমি জানতে চাইছি আপনি আবার কেন আমার শান্তি কেড়ে নিতে চাইছেন?”
নির্বাক শারফান এবার বিমূঢ়তা কাটিয়ে উঠলেও চুপচাপই চেয়ে রইল—সানার কথা শেষ হয়নি তা বুঝতে পেরে।
“আপনি সমস্ত রিপোর্টার‚ সাংবাদিক ডেকে নিজের সকল অন্যায়ের স্বীকারোক্তি দেবেন‚ না-কি নিজের সকল গুণগান গাইবেন‚ তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু আমাকে ঘিরে স্বীকারোক্তি দেবেন মানে কী? এটা চান‚ সারা দুনিয়া মনে করুক আমি আর শুদ্ধ নেই? সাত সাতটা দিন একটা ছেলে মানুষের কাছে বন্দি থাকা মানে কী ধরে নেবে সবাই‚ এই বোধটুকু আপনার না থাকলেও আমার তো আছে৷ কারণ‚ ভুক্তভোগী মেয়ে মানুষটা আমি।” কথাগুলো একটানা বলতে গিয়ে সানা হাঁপিয়ে উঠল। তাই দম নিতেই যেন বিরতি নিল কিছুক্ষণে জন্য।
সে সুযোগে শারফান বলল শান্ত গলাতে‚ “তুমি আমাকে নির্দিষ্ট কয়েকটা দিনের জন্য সময় দিয়েছিলে। কারণ‚ আমি চেয়েছিলাম। এখন সেই সময়টা শেষ।”
“তখন আমি কী বলেছিলাম‚ কী চেয়েছিলাম‚ তা নিয়ে আর ভাবতেও চাই না। আমি কেবল চাই আপনি আর কোনোভাবে‚ কোনো সুযোগে আমার সীমানায় না ঢুকুন।”
“মানে তুমি চাইছ না আমি পুলিশের কাছেও সবটা স্বীকার করে নিই?”
“না‚ চাইছি না। আপনার কোনো কিছুতেই আমি আর জড়াতে চাই না।”
“কিন্তু তোমার আব্বু চেয়েছিল তোমাকে যে আটকে রেখেছিল তাকে খুঁজে বের করুক পুলিশ। শুধু আমার রিকুয়েস্ট রাখতেই তুমি আমার কথা জানাওনি পুলিশকে।”
“উফঃ”‚ অধৈর্য হয়ে পড়ল সানা। রাগটাও বাড়ল তার। আর কোনো কথাই বলল না সে শারফানকে৷ ঘুরে দাঁড়িয়ে জিসানকে দেখে বলল‚ “আমি আর ওনার সাথে কথা বাড়াতে চাই না। আমার যা বলার তা সরাসরি বলেছি৷ উনি যদি সত্যি মানুষ হয়ে থাকেন তাহলে আর যেন আমার ক্ষতি না করার কথা ভাবেন। আমার সম্মান যতটুকু নষ্ট করেছেন‚ সেটুকুই আর ফিরিয়ে আনতে পারব না। এরপর যদি সারা দেশের মানুষ জানে‚ তাহলে লজ্জা‚ অপমান আর অসম্মানে আমার আব্বু-আম্মুর জীবন্ত মৃত্যু হবে।”
কথাটুকু শেষ করেই সে চলে যেতে চাইলে শারফান পেছন থেকে দ্রুত বলে উঠল‚ “তোমার বাবা কেস করেছিল মালিবাগ থানাতে সম্ভবত৷ আমি যদি সারেন্ডার করি‚ তার কারণ থানার বাইরে না গেলেই তো হলো‚ তাই না?”
রিহানের ইচ্ছে করল রাস্তা থেকে একটা খুলে এনে ওর মাথাটা ফাটিয়ে দিক। রাগটা চেপে না রাখতে পেরে সে চেঁচিয়েই উঠল‚ “থানা‚ কোর্টের সব পুলিশ আর উকিল তোর শ্বশুর লাগে‚ না-কি বাপ লাগে রে? যে কেউ কিছু জানাবে না কোথাও?”
শারফান এবার খুনে দৃষ্টি ছুড়ল রিহানের দিকে৷ হাতের নাগালে তাকে পেলে সত্যিই ধাঁ করে একটা ঘুসি লাগিয়ে চোয়ালটা ফাটিয়ে দিত৷ রাগ জিসানেরও হলেও সে এসে রিহানকে থামাল আর চোখের ইশারায় সানার দিকে লক্ষ করতে বলল।
চোখে-মুখে কেমন এক অভিব্যক্তি সানার। কিছুটা বিস্ময়‚ কিছুটা বিরক্তিও। শারফান সেসব খেয়াল না করে বলল‚ “সারা দেশের মানুষ না জানুক‚ তোমাকে চেনা মানুষগুলো না জানুক‚ এটাই তুমি বলতে চাইছিলে৷ কিন্তু যে অফিসারের হাতে তোমার কেসটা ছিল‚ সে তো জানেই৷ আমি সরাসরি সারেন্ডার করলে বড়োজোর সপ্তাহখানিকের মাঝে সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে কোর্টে৷”
“আমি কী চাইছি‚ তা আমি যথেষ্ট সাফ সাফ করে বলেছি”‚ গম্ভীর হয়ে বলল সানা‚ “আপনি কি তা বুঝতে পারেননি?”
“কিন্তু যে কারণে চাইছিলে না সেটা হবে না‚ আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে।”
“আরে… আমি আপনাকে ছেড়ে দিলে আপনি কেন উঠে পড়ে লাগছেন ধরা দিতে?” তিক্ত মেজাজের সুরে বলে উঠল সানা।
“ছেড়ে দিতে চাইছ?” ফিসফিসিয়ে কথাটা পুনরুক্তি করল শারফান। ওর প্রশ্নে চোখে ফুটল বিস্ময়ও‚ “সত্যি ছেড়ে দিতে চাইছ?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
কিছুক্ষণ নীরব থেকে সানা অন্যদিকে ফিরে প্রলম্বিত শ্বাসটা ফেলল। জবাব দিল মৃদুস্বরে‚ “মুক্তির জন্য।”
“আমার?” আরও বিস্মিত হলো শারফান।
“না”‚ চকিতেই কঠিন স্বরে বলল সানা‚ “আমার নিজের মুক্তির জন্য। আমি শান্তিতে বাঁচতে চাই‚ কারও দেওয়া কোনো ব্যথার ভার চেপে নিয়ে আমি সেই শান্তিটুকু পাচ্ছিলাম না। সেখান থেকে মুক্তি পেতেই আমি ছেড়ে দিচ্ছি আপনাকে৷”
“কী বলছ…! বুঝে বলছ তো‚ সানা? আমি যা করেছি তা কতটা ক্ষমার অযোগ্য তা আমিও জানি‚ আর তুমি তো জানোই।”
“আমি সব বুঝেই বলছি৷ আর আমি যা বুঝছি‚ তা আপনি বুঝবেন না। বোঝানোর প্রয়োজনও আমার নেই। কিন্তু এটা ক্লিয়ার করে বুঝিয়ে দিই‚ ক্ষমাটা আপনার জন্য‚ বা আপনার প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা থেকে আসেনি৷ সেটা এসেছে আমি নিজেকে ভালো রাখতে চাই‚ কেবল সেজন্যই। আপনি আপনার অপরাধের সাজা নিজে থেকে ভোগ করতে চাইলে তা করতেই পারেন৷ কিন্তু সেখানে যেন আমি আর না জড়িত হই‚ আমার চাওয়া শুধু এটুকুই।”
কথাগুলো চুপচাপ শুনতে লাগলেও শারফান এমন গভীর দৃষ্টিতে নিষ্পলক চেয়ে রইল সানার চোখে‚ যেন মুখের ভাষা নয়‚ সে চোখের ভাষা থেকে সানার মনের চাওয়াটা জানতে চাইছে৷ খুঁজতে চাইছে সেদিনের সেই ঘৃণা‚ যে ঘৃণাই ওকে উৎসাহ দিয়েছিল‚ “নিজেকে কঠিন এক যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দাও‚ শায়াফ।”
প্রথমবার যেদিন সানা মুখোমুখি হয়েছিল ওর‚ সেদিনও ঠিক এভাবেই চেয়ে ছিল শারফান। কিন্তু সেদিন ভয় আর অস্বস্তিতে সে চোখ নামিয়ে নিলেও আজ কোনো ভয়‚ কোনো অস্বস্তি বিঁধল না তার বুকে৷ কেবল এক শিরশিরানি অনুভব ছড়িয়ে গেল বুকের বাঁ দিকে। এ কারণেই চোখটা সরিয়ে নিল সে।
শারফানও সেটা ঠিক খেয়াল করল‚ সানা আজও ওর চোখে চোখ রাখতে পারে না। তাকে বলল‚ “তুমি যদি তোমার শান্তির জন্য আমাকে ক্ষমা করো‚ আমার মনে হয় না তাতে তোমার শান্তিটা পরিপূর্ণভাবে মিলবে৷ সব থেকে ভালো হবে তুমি নিজে কোনো শাস্তি নির্ধারণ করো আমার জন্য‚ নিজে হাতে এমন কোনো শাস্তি দাও আমাকে৷ যেটা তোমার আত্মাকে তুষ্ট করবে। আমি তোমার যে-কোনো শাস্তি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত‚ সানা।”
না‚ ধৈর্যের আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না সানার৷ জিসানের কথামতো যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল ঠান্ডাভাবে কথা বলার। কিন্তু শয়তান লোকটা আসলে জন্মেইছে যে-কোনোভাবে শুধু তাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করার জন্য‚ আর যে-কোনো মূল্যে তার শান্তিটুকু কেড়ে নেওয়ার জন্য৷ কেবল এই শয়তানের বাপ-মার অসহায় পরিণতির কথা ভেবেই আবার মানবিক টানে বাঁধা পড়েছিল সে‚ জারার অসুস্থতার কথাও ভেবেছিল। নয়ত কার ক্ষমতা ছিল এমন এক ব্যক্তির সামনে তাকে টেনে আনতে‚ যাকে এ জীবনে আর চোখের দেখাও সে দেখতে চায় না কখনো? তার যতটুকু বোঝানোর প্রয়োজন‚ সে বুঝিয়েছে৷ এরপর যা খুশি করুক এই লোক! তাতে আর কিছুই এসে যায় না তার। কেবল সাবধান করল শারফানকে‚ “আমাকে ফারদার আর কোনোভাবে টানবেন না আপনার কোনো কিছুতে‚ যদি সত্যি অনুতপ্ত হয়ে থাকেন নিজের অপরাধের জন্য।”
“তার মানে তুমি নিজেও আমাকে কোনো শাস্তি দেবে না?”
ভাঙা রেকর্ডের মতো একই সুর বারবার শোনাবার মতোই শারফানের প্রশ্নটা শোনাল সানার কাছে৷ রাগে‚ বিরক্তিতে চেঁচিয়ে বলল‚ “না… দেব না।” তারপর আর দাঁড়ালই না।
কিন্তু তার ‘না‚ দেব না’ বলার ঢংটা ছিল একদম রাগী‚ জেদি বাচ্চাদের না বলার ঢঙের মতো৷ শারফানের মনে তখন কী খেলে গেল কে জানে! চলে যেতে থাকা সানার দিকে কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থেকে তারপর হঠাৎ ঠোঁট খুলে হেসে ফেলল। ওর কানে বাজতে থাকল তখনো ওই ‘না‚ দেব না’ বলার সুরটাই৷
ওর হাসি দেখে আবার হতবুদ্ধি অবস্থা হলো জিসান আর রিহানের। সে অবস্থাতেই তাদেরকে আরও বেশি হতবাক করে দিয়ে শারফান চিৎকার করে সানাকে বলল‚ “আমি তোমাকে ভাবার সময় দিলাম‚ সানা৷ তিন মাস সময় দিলাম। এর মাঝে যদি নিজে কোনো শাস্তি আমাকে না দাও… তাহলেই আমি পুলিশের কাছে যাব।”
হাঁটা থেমে গেল সানার৷ থেমে পড়ল প্রিন্স আর রিনিও৷ তারা যেন সিনেমার টানটান উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত দেখছে৷ তাই অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকল সানা কী জবাব দেয় এবার‚ তা দেখার জন্য।
আশেপাশের মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টির মুখে পড়ে বেশ বিব্রত হওয়ায় মেজাজ আরও চটে গেল সানার৷ ক্ষিপ্ত চোখে তাকাল শারফানের দিকে। কিন্তু ওর মতো আর চেঁচিয়ে জবাব দিতে পারল না সে। চুপচাপই ফিরতি পথ ধরল আবার।
তা দেখে শারফান অস্থির হয়ে রিহানকে বলল‚ “এই… এই‚ ও তো চলে যাচ্ছে৷ ঠেকাস না কেন তোরা?”
“ঠেকাব?” সমস্বরেই জিজ্ঞেস করে উঠল রিহান আর জিসান।
“আরে ঠেকাবি না? দরকার আছে তো… জলদি ডাক।”
দুজনের কেউ-ই নড়ল না৷ কারণ‚ তাদের মনে হলো অপারেশনের ধাক্কায় আর ট্রমা থেকে শারফানের মাথাটা গেছে একেবারেই। রায়হান হয়ত টেরই পায়নি‚ ও মানসিক ভারসাম্যও হারিয়েছে। কিন্তু ট্যারা মামা আর দাঁড়িয়ে রইল না৷ সে শারফানকে সব সময়ই অতি ভক্তি করে… স্নেহও করে খুব৷ ওর অস্থিরতা দেখে সে লুঙ্গি উঁচু করে মারল দৌড়। এক দৌড়ে পৌঁছে গেল সানার কাছে। লুঙ্গিটা ওভাবে উঁচু করা অবস্থাতেই সানার পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়ল সোজা।
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৫২. (প্রথম অংশ)
“এ মামুনি‚ দাঁইড়াও দাঁইড়াও! আমার মামার পিশারডা অয় না বাইড়া গেইছে। দাপাদাপি কইরা তুমারে ডাকতাছে। কিতা জানি কইতে চায়। একবার চইলা আইসো না‚ আবার!”
লুঙ্গিটা অদ্ভুতরকমভাবে হাঁটুর ওপর তুলে রাখা অবস্থাতেই সানার পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়ল ট্যারা মামা। তার হ্যাংলা-পাতলা কালো শরীরে একটা বিবর্ণ হাফ হাত শার্ট‚ চোখে-মুখে বেখেয়ালি ছেলেমানুষি। আচমকা সে সামনে এসে দাঁড়াতে চমকে উঠে একপা পেছনে সরে এল সানা। অচেনা কণ্ঠ‚ অদ্ভুত ভঙ্গি—কাকে বলছে বুঝতেই কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল ওর। কিন্তু লোকটাকে আগেই শারফানের পাশে দেখেছিল বলে বুঝে গেল তারপরই‚ ওকেই উদ্দেশ্য করে ডাকছে।
“ধুরো মিয়া”‚ ঠিক তখনই পেছন থেকে এগিয়ে এসে প্রিন্স হালকা ধমক দিয়ে বলল‚ “লুঙ্গি নামান!”
ট্যারা মামা যেন হুঁশ ফিরে পেয়ে জলদি লুঙ্গিটা নিচে নামাল। আবার সানার দিকে ফিরে মিনতির সুরে বলল‚ “ও মামুনি‚ যাইও না কই! চইলা আই না‚ একটুখান… মামা অস্থির অইয়া তুমারে ডাকতাছে!”
তাদের তিনজনের দৃষ্টি তখন ঘুরে গেল পেছনে। দূরে শারফানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে জিসান আর রিহান। দুজনেই যেন কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে ওকে‚ আর শারফান অস্থিরভাবে মাথা নাড়িয়ে তাদের কথাগুলো নাকচ করছে। দূর থেকে দেখা যায়‚ ওর চোখেমুখে চরম রকমের ছটফটানি।
প্রিন্স এবার সানার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “যাবি?”
তা শুনেই আবার মিনতির সুরে ট্যারা মামা বলে উঠল‚ “আরে যাইবা না ক্যান রে? দয়া করো না একটুরে‚ মামুনি! চইলা যাই না কই!”
সানা কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকাতেই প্রিন্স হঠাৎ একটু গম্ভীরভাবে বলল‚ “বাড়ি ফিরে তো আবার এই ভেবেই রাত পার করবি। তার থেকে ভালো‚ কথা একেবারে শেষ করে আয়। কিন্তু এ নিয়ে আর কোনো চাপ নিতে পারবি না পরে।”
ভাইয়ের কথার মধ্যে একটা বাস্তব বোধ ছিল। সানা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। ওর আসলে চারপাশের এত কৌতূহলী চোখ ক্রমাগত বিব্রত করছিল। তাই এই ভিড় থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে যেতে চাইছিল সে।
প্রিন্সের হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে এক ঢোঁক খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিল সানা। তারপর ধীরপায়ে এগিয়ে গেল শারফানের দিকে। পেছনে প্রিন্স আর রিনি চুপচাপ হাঁটতে লাগল।
শারফান সব সময় চেয়েছিল সানা অন্তত একবার অভিযোগ করুক‚ রাগ করুক‚ কিছু একটা বলুক‚ অপমান করুক‚ আঘাত করুক‚ যেভাবে খুশি শাস্তি দিক ওকে। কিন্তু তার বদলে সে পেয়েছে সানার নির্লিপ্ততা‚ অভিযোগহীন নীরবতা‚ তীব্র অভিমানভরা চোখের ঘৃণা—যা ওর ভেতরটাকে প্রতিনিয়ত গভীরভাবে করেছে ক্ষত-বিক্ষত। আজ সানা সেই দীর্ঘ অভিমান থেকে একটু বেরিয়ে এসে ওর সেই চাওয়াকে একটুখানি পূরণ করেছে‚ ওকে কিছু বলেছে৷ সেটাই এখন ওকে আশ্চর্যরকম ব্যাকুল করে তুলেছে। সে আরও কিছুক্ষণ চায়‚ সানা নিজের ইচ্ছামতো আরও বকুনি দিক ওকে‚ ওর ওপর যত খুশি রাগ ঝাড়ুক। তাই চাইছিল সানার পিছু যেতে। সে নিয়েই বকাঝকা করছিল রিহান‚ আর জিসান চেষ্টা করছিল ভালোভাবে ওকে বোঝানোর।
এর মাঝেই শারফান দেখতে পেল‚ সানা আসছে আবার। আনন্দে‚ উত্তেজনায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিহানকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল সে‚ যেন সানার দাঁড়ানোর জায়গাটা ফাঁকা করল! রিহান তাতে চটে যেতেই থামল ওর দৃষ্টি লক্ষ করে। সানাকে সত্যি আসতে দেখে অবাকই হলো সে। তবে জিসান খুশিই হলো৷ ওরা দুজন সরে পড়তেই সানা গম্ভীর চোখে-মুখে এবার বিরক্তি নিয়ে এসে দাঁড়াল শারফানের সামনে‚ “আর কী বলতে চান?”
শারফানের চোখদুটোই তখন দারুণ আনন্দোচ্ছ্বাস‚ “আমি শুধু শুনতে চাই৷ তোমার যা বলতে মন চায় বলো। প্লিজ…!”
“আপনাকে আর কী বলার থাকতে পারে আমার”‚ বিরক্তের সঙ্গেই বলে উঠল সানা।
কিন্তু শারফানের মনে হলো ওই কথার গভীরে ছিল অতলস্পর্শ মনঃকষ্ট আর অভিমান। আর তা মনে হতেই এই প্রথম ওর মনটা অপরাধবোধ থেকে নিজেকে ধ্বংস করতে চাওয়ার পরিবর্তে বলে উঠল‚ “কী করলে আমি তোমার মনের সবটুকু ক্ষত সারাতে পারব‚ সানা?”
“আমার যা বলার আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি। আরও স্পষ্ট করে শুনতে চান?”
“চাই”‚ সরল মুখ করে মাথাটা ওপর-নিচ দুলিয়ে বলল শারফান। নিবিড় চোখে দেখতে থাকল সানাকে।
এদিকে অদূরে দাঁড়িয়ে ওদেরকে পরখ করতে করতে প্রিন্স হঠাৎ স্বগতোক্তি করে উঠল‚ “ওনার মতো ছেলের প্রেমে কীভাবে পড়ল আমার বোন? আকাশ-পাতাল পার্থক্য ওদের সব কিছুতে!”
ভাগ্যবশত কথাটা শুনতে পেল রিহান। এগিয়ে এসে দাঁড়াল প্রিন্সের পাশে৷ তার কথাতে একমত জানিয়ে বলল‚ “আমারও ভাবতে অবাকই লাগে এটা। আমার ভাই একখান কঠিন চিজ ছিল৷ প্রেম-ভালোবাসাতে মান্থলি কোনো ইনকাম নেই বিধায় বলত এসব নিয়ে ভাবার সময়ও ওর নেই। এখন দেখছ‚ কী পাগলামি ওর সানার জন্য!”
প্রিন্স একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও রিহানের আন্তরিক কথার ধরনে তা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করল৷ জবাব দিল সে‚ “পাগলামি কি সানাও কম করেছে? সেদিন থেরাপি সেশনের জন্য বেরিয়েছি। হঠাৎ মাঝরাস্তায় এসে বলে সিএমএইচ যাবে আপনার ভাইকে দেখার জন্য। কত কাহিনি করে তারপর ভিজিটিং পাস ম্যানেজ করে দিয়েছিলাম সেদিন! কিন্তু আমার প্রশ্ন‚ আপনার ভাই যদি ভালোবাসে ওকে‚ তাহলে সে কী করে পারল ওকে টর্চার করতে? আমি স্রেফ সানার কথা শুনেই চুপ করে আছি। ও যদি চাইত সবাই জানুক‚ আমি এত সহজে এই দেখা করার ব্যাপারটা মেনে নিতাম না। তাছাড় ও কিছুটা সুস্থ হয়েছে এখন৷ ওর মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করেও কিছু জানাতে চাইছি না বাড়ির কাউকে। জানলে তো আর কেউ বসে থাকবে না৷ তখন আবার এ নিয়ে ওর মানসিক চাপটা বাড়বে।”
রিহান কেবল আটকে গেছে প্রিন্সের বলা একটা কথাতে—সানা হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিল শারফানকে! অবাক হলেও মুখটা স্বাভাবিক রেখেই সে বলল‚ “কেন যে শায়াফ করেছিল অত বড়ো অন্যায়‚ তার জবাব দিতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে রে‚ ভাই। আর নিজের অপরাধের বোঝা এখন নিজেই বইতে পারছে না ও৷ দেখছ না‚ এজন্যই তো এই হাল ওর।”
প্রিন্স আর কিছু বলল না জবাবে৷ রিহান একটু সময় চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল‚ “সানাকে নিয়ে গিয়েছিলে কবে‚ ভাই?”
“গত মাসের আট তারিখে বোধ হয়।”
“ও আচ্ছা… পরদিনই তো শায়াফ রেসপন্স করেছিল প্রথম। তা কখন এসেছিলে তোমরা?”
“বিকালে।”
ওদের কথাবার্তা চলার মাঝে হঠাৎ রিনির কণ্ঠে তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে চমকে উঠল ওরা৷ তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে সানা আর শারফানের দিকে চাইতেই প্রত্যেকের চোখ ছানাবড়া হওয়ার দশা যেন। জিসান ফোনে কথা বলতে বলতে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেও এসে ওদের দুজনকে দেখার পর বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল‚ “আরে কী হলো ওদের?”
শারফান তখন ‘চাই’ বলতেই সানা জিজ্ঞেস করে‚ “ঠিক কোন কথাটা আরও স্পষ্ট করে বলতে হবে‚ বলুন?”
“তুমি যেটা স্পষ্ট করে বলতে চাও‚ সেটাই শুনব আমি।”
এমন একটা উত্তর আশা করেনি সানা। সে বুঝতে পারে‚ অকারণেই শারফান কথা বাড়াতে চাইছে৷ তাই অত্যন্ত কঠিন করে বলে ওকে‚ “আপনি আমাকে একটা সময় চিনতেন না। আমিও না৷ আমাদের তখন দেখাও হত না‚ কথাও হত না। ওই সময়টাতে আমার যে জীবনটা ছিল‚ আমি ওই জীবনটাতে ফিরতে চাই৷ তার মানে আপনার কোনো অস্তিত্বই আমার জীবনে না থাকুক‚ আমি সেটা চাইছি৷ এবার বুঝেছেন… ক্লিয়ারলি?”
“কথাগুলো যদি আমার পাশে বসে বলো‚ তাহলে আরও ক্লিয়ারলি বুঝব”‚ একদম নির্বিকার চেহারায় শারফান তখন এ কথাই বলে সানাকে।
কথাটা শোনা মাত্রই সানা খেপে যায়‚ “কী বললেন? আবার বলুন?”
ওর রাগটা বোঝার পরও শারফান মনের চাওয়াটাকে প্রকাশ করে আবার‚ “আমার কাছে এসে বসো‚ বসে কথা বলি আমরা?”
তিক্ত দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে সানা। মেজাজের লাগাম সে হারিয়ে ফেলে একদম। ওর হাতে থাকা পানির বোতলের ক্যাপটা তখন খোলাই ছিল। এক মুহূর্তেই পানিটুকু ছুড়ে মারে শারফানের মুখে। “আপনার সঙ্গে আমি ডেট করতে এসেছি?” চেঁচিয়ে ওঠে সে তারপরই‚ “সাহস কী করে হয় এ কথা বলার?”
বোতলটা শারফানের পায়ের কাছে ছুড়ে ফেলে চলে আসতেই সে দেখতে পেল সবার হতভম্ব মুখগুলো৷ প্রিন্সের কাছে এসেই রুক্ষস্বরে বলল‚ “চলো এখান থেকে।”
শারফানের কাছে ছুটে এল আগে ট্যারা মামা‚ তারপর রিহান আর জিসান।
“ওই‚ তুই কী বলেছিস ওকে?” বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল জিসান‚ “অমন রিয়্যাক্ট করল কেন মেয়েটা?”
মুখটা মুছতে মুছতে জানাল শারফান‚ “পাশে এসে একটু বসতে বলেছিলাম।”
কথাটা শুনেই রিহান ধমক লাগাল‚ “এই খচ্চর‚ তোদের কি পাশাপাশি বসার মতো সম্পর্ক আছে?”
শারফান মুচকি হেসে উঠল। হাসতে হাসতে মৃদুস্বরে বলল‚ “আরাম লাগছে খুব।”
ওরা বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেল না৷ বিহ্বল অবস্থা হওয়া জিসানের দিকে চেয়ে শারফান বলল‚ “তুমিই ওকে কনভিন্স করেছিলে‚ ভাই‚ তাই না? থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ! আমার পরাণটা ভীষণ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে ওকে দেখে।”
জিসান কোনো উত্তর না দিয়ে বাঁকা দৃষ্টিতে ওকে দেখতে দেখতে কল লাগাল রায়হানকে। সে রিসিভ করতেই শারফানের থেকে সরে গিয়ে ঘটনার সবটা জানাল। সানার প্রতিক্রিয়াগুলোও বলতে ভুলল না৷ কথাগুলো চুপচাপ শুনে রায়হান কলটা কেটে দিল৷ জিসান একটু ভ্যাবাচ্যাকাই খেল তাতে৷ এখনো যে রেগে থাকবে রায়হান‚ তা সে ধারণা করেনি।
রায়হানের রেগে থাকার কারণ‚ একরকম জোরজবরদস্তি করেই জিসান তার থেকে সানার ফোন নম্বরটা আদায় করেছিল৷ এই নম্বরটা সানার পরিবারের বাইরে একমাত্র সে-ই জানে। তাহলে জিসান কলটা করার পর নিশ্চয়ই সানা ধারণা করতে পারবে‚ সে কী করে ওর নম্বরটার হদিস পেয়েছে! এতে কি তার মতো একজন মনোচিকিৎসকের পেশাদারিত্ব নিয়ে অনায়াসেই সন্দেহ জাগবে না সানার মনে? রায়হান জিসানকে সে এও বোঝানোর চেষ্টা করেছিল‚ এ মুহূর্তে শারফান আর সানা‚ দুজনই তার রোগী‚ আর দুজনই তার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। এখন আর একজনের তথ্য আরেকজনের কাছে দেওয়াটা একদম উচিত নয়। এমনকি শারফানকেও সে আর জানায়নি‚ সানার মানসিক অবস্থা এখন কোন পর্যায়ে।
জিসান যখন সানাকে কল করেছিল‚ সানা তখন রিনি আর প্রিন্সের সঙ্গে সবে এসে বসেছে ধানমন্ডি লেকের একটি ফুডকোর্টে। তার পরিচয়ের জন্যই সানা তখন তার কথাগুলো শুনতে রাজি হয়েছিল৷ শারফানের সকল বিষয় জানার পর বিমূঢ় কণ্ঠে সানা ফিসফিসিয়ে উঠেছিল‚ “আমি তো মরে গিয়ে তাকে শাস্তি নিতে বলিনি! এখন যে সবাই তবে জানবে‚ সে আমার জন্য মরতে চেয়েছিল… আবার তাহলে অপরাধী হয়ে যাব আমি সবার চোখে!”
সানার চোখে-মুখে প্রকাশ পাচ্ছিল তখন শারফানের জন্য সহানুভূতিও‚ আর বিনা দোষে আবারও অপরাধী হয়ে যাওয়ার ভয়ও। প্রিন্স ওর পাশেই বসেছিল। ফোন থেকে আসা সমস্ত কথাই সে শুনতে পাচ্ছিল৷ শারফানের কারণেই সানার আজকের পরিণতি—ব্যাপারটা ভীষণ অবাক করেছিল তাকে। সানার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করার পর সে ফোনটা হঠাৎ নিয়ে নিয়েছিল ওর থেকে‚ তারপর সে-ই কথা বলেছিল জিসানের সঙ্গে৷ কোনোভাবেই সে রাজি হচ্ছিল না‚ সানার সঙ্গে শারফানের আর দেখা হোক। সে মুহূর্তে তাকে রাজি করাতে জিসান একটি এমএমএস পাঠিয়েছিল সানার নম্বরে। সেটা দেখার পর প্রিন্স কিছুটা ঠান্ডা হয়েছিল৷ তবে সানার সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছিল সে—সানা যদি রাজি হয় তবে তার কোনো আপত্তি থাকবে না।
যে ব্যথা‚ যে মানসিক দ্বন্দ থেকে মুক্তির চেষ্টা করছিল সানা‚ শারফানের অপরাধ স্বীকারোক্তির কারণে সেই পুরনো ব্যথা আবার নতুন করে তাজা হোক‚ নিজের নিখোঁজ থাকার সংবাদটা আরও কেউ জানুক—তা আর চায়নি সে। আর হয়ত এও চায়নি‚ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মানুষটা নতুন করে আর কোনো শাস্তি ভোগ করুক৷ কারণ‚ সেই শাস্তি কেবল সে একাই ভোগ করবে না৷ তার ভুক্তভোগী হবে তার পরিবারের মানুষগুলোও। তাই শেষমেশ রাজি হয়েছিল সানা আরও একবার শারফানের মুখোমুখি হতে।
***
সেদিন লেক থেকে ফেরার পর শারফানের মাঝে হঠাৎ এক পরিবর্তন ঘটেছে। এক সময়ের সেই শক্ত‚ রগচটা দাম্ভিক পুরুষটা যেন একেবারে অন্য এক মানুষ এখন। ওর চেহারায় আগের মতো বেপরোয়া ছাপটা নেই‚ চোখে কাঠিন্যতা নেই‚ গলায় স্পষ্ট দুর্বলতা। কারণে‚ অকারণে আর কারও প্রতি মেজাজ হারাচ্ছে না সে৷ এমনকি প্রতিটি থেরাপি সেশনেও চুপচাপ রায়হানের কথা শুনতে থাকে কোনো তর্ক ছাড়াই। কিন্তু ওর সবচেয়ে বড়ো যে সমস্যাটি—আত্মশাস্তির আকাঙ্ক্ষা। তা এখনো রয়ে গেছে ওর মাঝে। কারণ‚ সানার চোখে সে নিজের জন্য কোনো ভালোবাসা‚ ক্ষমা‚ সম্পর্ক‚ কিছুই দাবি করার যোগ্য মনে করতে পারে না নিজেকে। ও শুধু অপেক্ষা করছে‚ কবে ওকে সঠিক শাস্তি দেবে সানা! আর সানা তা না দিলেই আত্মসমর্পণ করবে সে পুলিশের কাছে। এ কথা একদিন সে স্মরণও করিয়ে দিয়েছে সানাকে মেসেজ করে। তার কোনো জবাব অবশ্য দেয়নি ওকে সানা। বরং ওর নম্বরটাকেই ব্ল্যাকলিস্ট করে রেখেছে।
অন্যদিকে‚ সানার আচরণে এখন ঠান্ডা এক যুক্তিবোধ স্পষ্ট। হৃদয়ের ক্ষতটা এখন আর রক্তাক্ত না হলেও জায়গাটা যেন ফুলে আছে। ওর মনে এখনো প্রশ্ন‚ রাগ‚ অস্পষ্ট ভালোবাসা‚ আর একরাশ ঘৃণা একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শারফানের প্রতি অদৃশ্য টানও অনুভব করে সে‚ আবার চায় শারফান নিজেই তার পাপের মুখোমুখি হোক। এই জটিল অনুভূতিরা ওর আত্মপরিচয়ের সঙ্গে মিশে আছে। সানা এখন ‘ভিকটিম’ পরিচয় ছাপিয়ে একটা নতুন পরিচয় খুঁজছে‚ একটা সুস্থ‚ স্বাধীন‚ আত্মসম্মানী মানুষ হয়ে ওঠার সংগ্রামে আছে। তবে রায়হান জানে‚ সানা নিজেই তার আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ থেকে বেরিয়ে আসবে একদিন৷ হয়ত আরেকটু সময় লাগবে৷ কারণ‚ ওর মাঝে যা বইছে তা যে সাধারণ রাগ বা অভিমান নয়। তা মিশ্র আবেগ থেকে আসা কষ্ট‚ ঘৃণা‚ ভালোবাসার প্রতি দোটানা‚ সন্দেহ আর অবিশ্বাস।
অর্থাৎ দুজনেরই মানসিক অবস্থা এখনো অস্বাভাবিক। শারফান আত্মদণ্ড ও মানসিক যন্ত্রণায় ডুবে আছে‚ আর সানা তার নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তির জন্য লড়াই করছে। রায়হান তাই চেয়েছিল ওদেরকে দীর্ঘমেয়েদি থেরাপির মাঝে রাখতে। সানার ক্ষেত্রে জরুরি আত্ম-সম্মান পুনর্গঠন‚ বিকল্প চিন্তা গঠন আর আবেগ নিয়ন্ত্রণের থেরাপি। আর অপরদিকে শারফানের দরকার অপরাধবোধ নিয়ন্ত্রণ‚ ট্রমা-সচেতন থেরাপি আর আত্ম-দণ্ড প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু সানা নিজেকে থেরাপির মাঝে রাখলেও শারফানকে আর ধরে রাখতে পারল না রায়হান।
***
১৩ জুন
বিকাল ৪: ৩০
ফরিদপুর
দুপুরের ঝাঁঝাল রোদ কেবল একটু আগে ফুরিয়েছে। আকাশে এখন মেঘের খেলা। কখনো তুলোর মতো সাদা‚ আবার কখনো বাদামি-ছাই রঙের ভারী দল এসে ঢেকে দেয় সূর্যকে। দক্ষিণ দিক থেকে ভেসে আসে কাঁচা মাটির গন্ধ মেশানো একটুকরো ঠান্ডা বাতাস। দুলিয়ে দেয় মাঠের ঘাস আর রাস্তার পাশের সারি সারি আকাশমণি গাছের পাতাগুলো। পথের দু’ধারে বিছিয়ে আছে আগুন লাল কৃষ্ণচূড়া আর ঝরে পড়া শিউলি—পথটা যেন ফুলের চাদরে ঢাকা। অফিসের প্রাঙ্গণ আর রাস্তার কিনারা জুড়ে থোকা থোকা জারুল ফুল‚ তাদের রঙে আকাশও যেন হালকা বেগুনি হয়ে উঠেছে। আর চারপাশের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা কাঁঠালের মিষ্টি ঘ্রাণ। মনে হয় গ্রীষ্ম তার বিদায়বার্তাটা কাঁঠালের ঘ্রাণেই মিশিয়ে দিয়ে গেছে।
চায়ের দোকানের ছাউনির নিচে কয়েকজন বয়স্ক মানুষ আর যুবকের ভিড়৷ সেখানে চলে দাবা খেলা। দর্শক হিসেবে কজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করে। কারও হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ‚ কিংবা পানের খিলি। অদূরে দেখা যায় স্কুল ছুটি শেষে বাড়ি ফেরে কিছু ছেলে-মেয়ে৷ তাদের স্কুলড্রেসে সারা দিনের ধুলো। কেউ হেঁটে‚ কেউ সাইকেলে। কারও চেহারায় সারা দিনের দুষ্টুমির হালকা ক্লান্তি‚ চোখ-মুখ একটু মলিন‚ এলোমেলো চুল‚ হাঁটাও ধীর। আবার কারও চোখে জমে থাকা গল্পের উচ্ছ্বাস এখনো। যেন বাড়ি পৌঁছেই মায়ের কাছে এক নিঃশ্বাসে সব বলে দেবে।
মুদি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সানা অপেক্ষা করছে এমবি কার্ড কেনার জন্য। আর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে নিজের শহরের এই পরিচিত দৃশ্যগুলো। মাত্র দু মাস হয়েছে‚ অথচ ওর মনে হচ্ছে যেন এক যুগ পর ফিরেছে সে নিজ শহরে। গত মাসের আঠারো তারিখ থেকে শুরু হয়েছে ওর পরীক্ষা। শারফানের সঙ্গে দেখা হওয়ার ঠিক পরদিনই সে ফিরে এসেছে ফরিদপুরে। তবে থেরাপি থেমে নেই। শারফানকে ঘিরে ওর মনে চলমান দ্বন্দ্ব‚ ভালোবাসা ও ঘৃণার টানাপোড়েন‚ মানসিক ক্লান্তি‚ এর মধ্যে পরীক্ষা আর পড়াশোনা—সব মিলিয়ে মানসিক চাপটা বাড়বে বই কমবে না। তাই এই মুহূর্তে থেরাপিস্টের মানসিক সহায়তা ছাড়া এত কিছুর ভার সে বইতে পারবে না। চাপটা সামলাতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ভিডিয়ো কলে রায়হানের সঙ্গে তাই কথা বলে সানা। এজন্যই দোকানে এমবি কার্ড কিনতে দাঁড়িয়েছে সে৷ কিন্তু খদ্দেরের বেজায় ভিড়। কার্ডটা কিনে তারপর যাবে ও অনির বাসায়। পরশু অডিটিং পরীক্ষা। বিষয়টা একটু কঠিন লাগে ওর কাছে। তাই যা কিছু সমস্যা মনে হয়‚ সেখানে বুঝতে অনি সাহায্য করবে। শুধু মোস্তফা সাহেবের ব্যক্তিগত অনুরোধে নয়‚ নিজের আগ্রহেও এই বাড়তি সু্বিধাটুকু পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকেই ওকে দিচ্ছে অনি। যেদিন ও পড়তে আসে‚ সেদিন বাইকে করে ওকে দিয়ে যান মোস্তফা সাহেব। পড়া শেষ হলে আবার নিয়েও যান। আজও তিনি দিয়ে গেছেন‚ সন্ধ্যায় আবার নিয়ে যাবেন।
দোকানদার কার্ডটা দিতেই পাশের চায়ের দোকান থেকে আচমকা “চেকমেট” বলে কোলাহল করে উঠল সবাই৷ এটা সেই দোকান‚ যেখানে শারফান তিনটি ছেলেকে শাস্তি দিয়েছিল ওকে ঢিল ছোড়ার অপরাধে৷ দিনটার কথা মনে পড়লেও সেই স্মৃতি ওর ভাবনাতে আসত দিল না সহজে৷ এক পলক সেদিকে চেয়ে দোকানদারকে কার্ডের দামটা দিল৷ পাঁচশো টাকার নোট—ভাংতির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল এবার। এই ফাঁকে চায়ের দোকানের মানুষও কমতে লাগল৷ দাবা খেলাতে টান টান উত্তেজনার মুহূর্ত চলছিল বিধায় সবাই ভিড় করেছিল৷ ভাংতিটা পেতেই সানা রওনা হলো অনির বাসার উদ্দেশ্যে। দৃষ্টি তার সরাসরি সামনে৷ চায়ের দোকানটা পেরোনোর মুহূর্তে রাস্তার মধ্যে থাকা ভাঙা ইটের টুকরোটা তাই দেখতে পেল না। সেটাতে গুঁতো খেতেই পায়ের বৃদ্ধা আঙুলে ব্যথা পেল খুব। মেজাজটাই ওর খারাপ হয়ে গেল ব্যথার চোটে। চোখ-মুখ কুঁচকে টুকরোটা একবার দেখে নিয়ে আবার চলতে শুরু করলে তখন দোকানটা থেকে আকস্মিক এক পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠল‚ “ওটা সরিয়ে দিয়ে যাও। অন্যদের চলতে উপকার হবে তাহলে।”
ধক করে উঠল সানার বুকের ভেতর—কণ্ঠটা শুনতেই৷ এক ঝটকায় ঘাড়টা ফেরাল পেছনে৷ দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে শারফান। পরনে কোরাল রঙা শার্ট‚ হালকা নীল জিন্স প্যান্ট। ওপরের বোতাম দুটো-তিনটা খোলা আর শার্টের আস্তিন গোটানো ডান হাতে রোলেক্স। বরাবরের মতোই তার ফিটফাট সাজপোশাক। দোকানের ছোটো চার্জার ফ্যানটার সামনে বসে থাকার জন্য ফুরফুরে বাতাসে চুলগুলো তার উড়ছে যেন মনের সুখে। সামনে দাবার কোর্টটা রাখা৷ তার মানে সে-ই খেলছিল—বুঝতে পারল সানা৷ তবে জিতেও ছিল সে-ই‚ সেটা অবশ্য জানল না।
সানার অবাক হওয়া চোখদুটোর দৃষ্টি পালটে হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল৷ সে মোটেও আশা করেনি‚ লোকটা আবারও ওর আশেপাশে এসে ভিড়বে। কোনো জবাব দিল না। গম্ভীর চেহারায় সোজা হাঁটতে আরম্ভ করল আবার৷ শারফানও তখন আবার বলে উঠল পেছন থেকে‚ “ইটটা সরিয়ে দিয়ে যেতে?”
শোনা মাত্রই মেজাজ আরও বিগড়ে গেল সানার। দাঁড়িয়ে পড়ে কঠিন এক ধমক লাগিয়ে বলল‚ “বেয়াদব লোক কোথাকার! ডাকাডাকি করছেন কোন সাহসে? উপকার করতে ইচ্ছে হলে নিজে এসে সরাতে পারছেন না?”
দোকানদার সেই চাচা মানুষটি চা বানাতে বানাতে ফিক করে হেসে ফেললেন৷ শারফানের মনের মতিগতি তিনি ধরতে পেরেছেন কিনা!
শারফানের চোখে-মুখেও কেমন চাপা হাসির মতো অভিব্যক্তি। তবে তা ধরা যায় না। সানার ক্রোধান্বিত মুখটা দেখতে দেখতে সে উঠে দাঁড়াল৷ বেঞ্চির পাশে রাখা ওয়াকিং স্টিকটা হাতে নিয়ে হালকা খোঁড়াতে খোঁড়াতে এল ইটটার কাছে৷
সানা যেন তখন চমকাল ওর হাতের স্টিকটা দেখে৷ সেদিনও সে বুঝতে পারেনি‚ হুইল চেয়ারটা শারফানেরই ছিল৷ তার মানে লোকটার পা ঠিক হয়নি! তীক্ষ্ণ চাউনিজোড়া একটু যেন শান্ত হয়ে এল ওর।
“সেদিন জুমার খুৎবাতে ইমামের কাছে শুনলাম‚ রাস্তার মাঝে ইটের টুকরো বা অন্য কোনো কষ্টদায়ক বস্তু থাকলে তা সরিয়ে দেওয়া নাকি সওয়াবের কাজ। এটাকে সদকা হিসেবে ধরা হয়। যা মানুষকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেয় আর এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।” কথাগুলো বলা শেষে নিচে ঝুঁকে পড়ে ইটটা উঠিয়ে রাস্তার বাঁ দিকে ছুড়ে মারল শারফান।
অবাক হলো সানা‚ অপ্রস্তুতও হয়ে পড়ল চকিতেই৷ এ হাদিস তার জানা থাকলেও শারফান যে এ কারণেই ইটটা ওকে সরাতে বলেছে‚ তা তো একটুও ধারণা করেনি৷ কে জানত‚ এই শয়তানের মুখে ধর্মীয় ভাষণও ওকে শুনতে হবে একদিন!
শারফান আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল‚ ঠিক তখনই রাস্তার বাঁ দিক থেকে এক বাচ্চা ছেলের গালাগাল শোনা গেল‚ “ওই শালার বেটা শালা… ওই! ওই চু**র ভাই… ইট মারলি ক্যা আমারে?”
তলপেটের নিচে চেপে ধরে কান্না আর গালি এক সঙ্গে চালাতে চালাতে এসে দাঁড়াল বাচ্চাটা শারফানের সামনে৷ গায়ে তার ম্যাগি হাতার গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট। বয়সটা বড়োজোর সাত। সঙ্গে তারই বয়সী আরও চারটে বাচ্চা। একজনের হাতে ধরা ফুটবল। মাঠে খেলতে যাচ্ছিল তারা। শারফান না দেখেই তখন ইটটা ছুড়ে ফেলায় সেটা গিয়ে লেগেছে সরাসরি বাচ্চাটার স্পর্শকাতর স্থানে৷ বেজায় ব্যথাও পেয়েছে বাচ্চাটা। কাঁদতে কাঁদতে সে আরও ভয়ানক সব গালি দিতে থাকল ওকে‚ ওর মা তুলে আর বাপ তুলে৷ আর সেই গালিগুলো শুনে বিস্মিত সানার মনে হলো‚ যেন শারফানেরই কোনো ক্ষুদ্র সংস্করণ দেখছে সে এ মুহূর্তে৷
“চোপ্! থাম শালা”‚ সহসাই বাচ্চাটিকে ধমক দিয়ে বসল শারফান‚ ওর চিরাচরিত জলদগম্ভীর গলায়। গালিগুলো শুনতে শুনতে ওর নিজেরই চোখ ছানাবড়া হওয়ার দশা। কারণ‚ এইটুকু বয়সে ওর ভাণ্ডারের গালিগুলো এতখানিও উন্নত ছিল না যে৷
কিন্তু বাচ্চাটা এতই রাগী‚ জেদি আর দুঃসাহসী যে‚ ওর ধমকে ভয় পাওয়া তো দূর‚ ওর মতো বিরাট দেহী মানুষটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেও একটুখানি ভয় হলো না তার৷ আরও জোরে কেঁদে উঠে আর গালাগাল করতে করতে দুমদাম কিল বসাতে থাকল ওর পেটে৷ যদিও পেটে নাগাল পাচ্ছিল না সে পুরোপুরি।
তাজ্জব হয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে শারফান দেখতে থাকল বাচ্চাটার কাণ্ড৷ কান্নার মাঝে তার একটা কথাই কেবল বুঝতে পারল সে‚ “আমার বিচিতি মারলি ক্যা তুই‚ এই কুত্তো? তোরে মাইরে ফেলাব আমি!”
এবার আর রাগ করল না শারফান‚ তার কষ্টটা উপলব্ধি করে। “আচ্ছা আচ্ছা… থাম” ‚ তাকে সামলানোর চেষ্টা করে বলল‚ “আমি দেখিনি তো। ভুল হয়ে গেছে আমার। আচ্ছা যা‚ মাফ চাচ্ছি।”
“না…”‚ চেঁচিয়ে উঠল বাচ্চাটা‚ “মাফ করব না তরে। আমার ব্যথা করতেছে ওইজাগা। তুই মারলি ক্যা?”
শারফানের চিন্তা হলো এবার—যেখানে লেগেছে‚ বাচ্চাটার পুরো ভবিষ্যত নির্ভর করছে সেটার ওপর৷ কোনো ক্ষতি হয়ে যায়নি তো সেখানে? হলে এর ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মতো ক্ষমতা তো ওর হবে না৷ ওখানে হাত দিয়ে বলল‚ “প্যান্টটা খোল তো… দেখি কিছু হলো কি-না!”
অমনি কান্না থেমে গেল বাচ্চাটার‚ গালিও থামল। লজ্জা পেয়েছে বেশ৷ শারফানের হাতটা জলদি সরিয়ে রাগ নিয়ে বলল‚ “না… সর! রাস্তার ভিতর দেখাবু না।”
“আরে খোল…”‚ ধমক লাগাল শারফান। বিদ্রুপ করল তারপর “এইটুকু একটা জিনিস। তার আবার দেখাতে লজ্জা।”
“তুই খোল‚ বুকাচু** ”‚ চেঁচিয়ে উঠল সে আবারও‚ “তুই মারলি ক্যা আমারে? এহনে তোর বিচিও আমি ফাটাবু। তারপর বুঝবি কীরামডা লাগে!”
এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে থাকা সানা এবার দ্রুত মুখ চেপে ধরে হেসে ফেলল খুব। এমন হাসি পেল ওর‚ যে অন্যদিকে ফিরে সে হাসতে থাকল গা কাঁপিয়ে। আশেপাশে থাকা কয়েকজন লোকের কানেও গেল কথাটা‚ তারাও খিলখিল করে হেসে উঠল তখন৷
অবশ্য কপট রাগ দেখাতে গিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকল শারফান নিজেও৷ তবে বুঝতে পারল‚ এই পিচ্চি ওর চেয়েও বিপজ্জনক। আর কিছুক্ষণ এর সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে বলা যায় না‚ সত্যি সত্যি ওর প্যান্ট খোলার জন্য টানাটানি শুরু করে দেবে। মানিব্যাগ থেকে দ্রুত একশো টাকার একটা নোট বের করে বাচ্চাটাকে বলল‚ “নে ধর… আইসক্রিম কিনে খা। আর বাড়ি যেয়ে মাকে বলবি‚ ওখানে ভালো করে মালিশ করে দিতে৷”
একদম সঙ্গে সঙ্গেই টাকার কাছে কাবু হয়ে গেল বাচ্চাটা। ভেজা চোখে দাঁত বের করে একখানা হাসি দিয়ে টাকাটা নিয়েই ছুট দিল সে৷ সানাও আর দাঁড়াল না এরপর৷ শারফান পিছু নেবে ভেবে সে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল৷
কিন্তু শারফান যে নড়ল না নিজের জায়গা থেকে! আর সানার চলার গতি দেখেও টের পেয়ে গেল‚ কেন জলদি কেটে পড়ল সে। বাঁকা হাসল‚ আর নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল শুধু ওর যাওয়ার দিকে। এবং সেই সাথে একটা পরীক্ষাও করতে থাকল তীব্র অপেক্ষা নিয়ে। সানা তো অবশ্যই বুঝবে‚ ও যায়নি তার পিছু পিছু৷ তবুও যদি সে ফিরে চায় একবার তার দিকে‚ তবেই সে বুঝবে‚ আগামীতে ওর পিছু চলার সুযোগটুকু সে পেয়ে গেছে।
যেতে যেতে অনেকটা সামনে গিয়ে সানা সত্যিই থামল‚ ডান দিকের গলিতে ঢুকে পড়ার পর। লুকিয়ে একবার উঁকি দিয়ে দেখতে চাইল‚ শারফান আছে না-কি চলে গেছে সেখান থেকে!
আর দূর থেকে ওর উঁকিঝুঁকি দেখতে পেয়েই ঠোঁট চেপে ধরা হাসিটা নিয়ে হাতটা উঁচু করে শারফান নিমিষেই জানান দিল ওর উপস্থিতি‚ যেন সানার অভিসন্ধি বুঝেই কাজটা করল সে। প্রচণ্ড বিব্রত হয়ে পড়ল সানা মুহূর্তেই৷ লজ্জায় তার হৃৎস্পন্দনের গতিবেগ বেড়ে গেল সাংঘাতিক।
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৫২. (শেষ অংশ)
আকাশে তখনো একটু আলো বাকি। তবে অন্ধকারের ছায়া দ্রুত গাঢ় হচ্ছে। পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরে যাচ্ছে গাছের ডালে। দোকানপাটে হালকা হলুদ আলো জ্বলে উঠেছে‚ চায়ের দোকানে ধোঁয়া ওঠা কাপে ভিড় জমেছে কয়েকজন চেনা মুখের। রিকশার বেল বাজার শব্দ আর এলাকার মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজানের সুর একসাথে মিশে একটা অদ্ভুত শান্তির আবহ তৈরি করেছে যেন। অন্তত শারফানের কাছে তো শান্তিরই লাগছে। সেও যে কতগুলো দিন বাদে জন্মভূমিতে পা রেখেছে! অথচ এর আগে কখনো এতখানি উতলা হয়নি সে ফরিদপুরে ফেরার জন্য‚ চেনা-জানা পথ‚ চেনা মানুষ‚ বন্ধুবান্ধব‚ কাউকেই এবারের মতো এতটা মিস করেনি। সে তো ভাবেইনি আবারও দুচোখ ভরে এই পৃথিবীকে দেখার সুযোগ পাবে। ঢাকাতে যেন আর টিকছিলই না মনটা। রিহানটাও গত মাসেই দেশ ছেড়েছে। ফরিদপুরে আসার জন্য শারফান এমন ছটফট শুরু করল যে‚ কোনোভাবেই কেউ ওকে বোঝাতে পারেনি‚ সাইকোথেরাপি আর ফিজিয়োথেরাপি শেষ করে তারপর না হয় বাড়িতে যাবে! উপরন্তু বাপের ধমক আর সবার ‘না না’ শুনে প্রচণ্ড খেপে গিয়ে ভোরবেলা কাউকে না বলেই সে বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ি থেকে। ফেরি ঘাটে পৌঁছানোর পর ড্রাইভারকে দিয়ে জানিয়েছিল‚ ফরিদপুর রওনা হয়েছে সে৷ তারপর আর কী করার থাকতে পারে শাফিউল সাহেবের? হতাশ হন খুব। বাধ্য হয়ে সবাইকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন সেদিনই৷ থেকে যান শুধু তিনিই। তবে সাইকোথেরাপিটা আর না চললেও ফিজিয়োথেরাপি বন্ধ হয়নি ওর। নতুন এক ফিজিয়োথেরাপিস্ট এখন পায়ের সেবা দিচ্ছেন ওকে।
রিকশাটা বাসার সামনে দাঁড়াতেই গেটের ভেতর থেকে ঘেউঘেউ করতে করতে ছুটে এল জাং। রাগারাগি করছে সে শারফানকে‚ এতক্ষণ বাসার বাইরে গিয়ে থাকার জন্য। ভাড়া মেটাতে মেটাতে মুচকি হাসল ও। জাঙের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে নিয়ে বাসায় ঢুকতেই ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ—অনির কল। কানে ঠেকিয়ে এগোল সিঁড়ির দিকে‚ “হুঁ বল।”
“চলে গেছিস বাসায়?” জিজ্ঞেস করল অনি।
“মাত্রই ঢুকলাম।”
“বাহ! একটু দাঁড়াবি না আমার জন্য? এসে দেখি তুই দোকানে নাই।”
“তুই আসবি তা কি বলেছিলি? আমার কাজ শেষ‚ তাই চলে আসছি।”
“ওরে আমার মজনু শালা! তোর কাজ তো আমার ছাত্রীর ওপর নজর দেওয়া খালি। নজরদারি শেষ… আর বসে থেকে কী করবি? ঠিকই তো!”
“মেয়ে মানুষের মতো সেন্টি খাচ্ছিস কেন?”
“চোপ্ হারামজাদা! রাখ… ফোন রাখ!” বলে নিজেই কলটা কেটে দিল অনি।
নির্লিপ্তভাবে ফোনটা কান থেকে সরিয়ে শারফান নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল৷ কিন্তু ঢুকতে গিয়েও থেমে গেল গিটারের টুংটাং আওয়াজে। জারার ঘর থেকে আসছে। সেদিকে এগোল হঠাৎ। দরজার পর্দাটা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিল—নীল নরম আলো জ্বেলে‚ খোলা জানালার ধারে বিন ব্যাগে বসে গিটারে সুর তোলার চেষ্টা করছে জারা। কিন্তু চোখে-মুখে হঠাৎ বিরক্তি ফুটে উঠল ওর‚ তার থেকেও হাতটা সরিয়ে নিল৷ শারফান বলল তখন‚ “হচ্ছিল তো… থামলি কেন?”
একটু চমকে তাকাল জারা। কারও হঠাৎ উপস্থিতি কিনা! ভাইকে দেখে হতাশ চোখে চাইল‚ “সত্যিই হচ্ছিল? আমার তো মনে হলো তোর মতো পারছি না।”
“এক-দুদিনেই পুরোপুরি শিখে যেতে চাস না-কি? ট্রাই করতে থাক… হয়ে যাবে।”
“তুই এসে একটু কর না! আমি আবার দেখি।”
শারফান ভেতরে এল। গিটারটা ওর ঢাকার বাসাতে পড়েই ছিল। ফেরার সময় নিয়ে এসেছে জারা। তারপর আবদার ধরে ভাইয়ের কাছে‚ গিটার বাজানো শিখবে সে৷ গানের গলাটাও তার মন্দ নয়৷ পড়াশোনার চাপ যেহেতু নিচ্ছে না আপাতত‚ তাই আর আপত্তি করেনি শারফান। ওরা এসেছে আজ তিনদিন হলো। এই তিনদিন ঘরে বসে বোনের সাথে শারফান নিজেও সময় কাটিয়েছে গিটারটা নিয়ে৷ শেষবার হাতে নিয়েছিল যখন বন্ধুরা সবাই মিলে টাঙ্গুয়ার হাওরে নদী ভ্রমণে বেরিয়েছিল। সে কি আজকের কথা? বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষ সবে শুরু হয়েছিল তখন।
গিটারটা নিয়ে বিছানার পাশে বসল শারফান। জারার তোলা সুরটাই তুলল সে। জারা চুপচাপ দেখতে থাকল‚ শিখতে থাকল৷ তারপর হঠাৎ আবদার ধরে বসল‚ “গানটা গা তো‚ ভাইয়া। জীবনে তো কোনোদিন গেয়ে শুনালি না বাড়ির কাউকে৷ আজ একটু গা না!”
বন্ধুদের দেখে স্রেফ শখের বশেই শিখেছিল শারফান। কিন্তু কখনো বাড়ির কাউকে জানায়নি। শাফিউল সাহেব অন্যদের মুখ থেকে শুনেই জানতে পেরেছিলেন এ বিষয়ে। সে থেকেই বাড়ির সকলে জানে ওর গান করার কথা৷ কিন্তু জীবনে কত শখই তো পূরণ করেছে তাদের ছেলে! সেসব শখ পূরণ শেষে আবার ছেড়েও দিয়েছে। গিটারের শখটাও ছিল সেরকমই একটা শখ। জারার বদৌলতেই বহু বছর পর আজ এ সঙ্গীতযন্ত্রটা যেন আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
কিন্তু বোনের আবদার রাখতে সহজে রাজি হলো না শারফান। অনাগ্রহের সঙ্গে বলল‚ “আমার গানের গলা টলা অত ভালো না। তার ওপর কত বছর গাই টাই নাই।”
“তোর গানের গলা ভালো হবে না তা আমিও জানি৷ অমন ভারী গলায় আবার গান হয় নাকি! তাও একটু গা… শুনি৷ আমিই তো শুনব৷ বাইরের কেউ তো না। লজ্জা পেতে হবে না।” মিটিমিটি হাসল জারা‚ বলা শেষে।
সরু দৃষ্টিতে তাকাল তখন শারফান—চোখদুটো একটু ছোটো ছোটো করে৷ বোন যে তাকে খোঁচ মেরে গান গাইতে উস্কাচ্ছে‚ তা ঢের বুঝল সে। কী যেন ভাবল কয়েক পল। তারপর রাজি হয়ে গেল। তবে গাইবার আগে জারাকে বলল‚ “দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে আয়৷”
জারা দারুণ উত্তেজনায় দরজাটা দ্রুত চাপিয়ে দিয়ে এল৷ শারফানকে বলল‚ “বিন ব্যাগে গিয়ে বস। ভালো ফিল পাবি৷ বাতাস আসছে জানালা থেকে।”
অমত করল না শারফান। উঠে এসে বসল বিন ব্যাগে৷ দৃষ্টি চলে গেল তখন জানালার বাইরে৷ আবছা আলোয় দেখতে লাগল মায়াবী সন্ধ্যার পরিবেশকে। গাছের ডালে আশ্রয় নেওয়া পাখপাখালির কিচিরমিচির শুনতে শুনতেই গিটারে সুর তুলল। প্রকৃতির মাঝে দৃষ্টি হারিয়ে গাইতে শুরু করল—
“আমি সেই সুতো হব
যে তোমায় আলোকিত করে
নিজে জ্বলে যাব
আমি সেই নৌকো হব
যে তোমায় পার করে
নিজেই ডুবে যাব…”
গাইতে গাইতে একসময় পিঠটা এলিয়ে দিল শারফান‚ নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে। আনমনে চোখ দুটোও বুঁজে ফেলল। বন্ধ চোখের দুয়ারে এসে হাজির হলো তখন সানা‚ আর তার উঁকি দিয়ে দেখার সেই মুহূর্তটা। মৃদু হাসি ভেসে উঠল ওর ঠোঁটের কোণে। চোখদুটো বুঁজেও কী নিখুঁতভাবে বাজতে থাকল প্রতিটা কর্ড‚ প্রতিটা নোট। আঙুলগুলো চলছিল ওর আপন ছন্দে। সানাকে দেখতে দেখতেই দুর্দান্ত সুর তুলে গেয়ে চলল সে—
“হব সেই চোখ
যে তোমায় দেখেই বুঁজে যাব
হব সেই সুর
যে তোমায় মাতিয়ে করুণ হব
হব সেই চাঁদ
যে হয়ে গেলে রাত
তোমাকে আলো দেবে
দিন ফিরে এলে
আবার ফুরিয়ে যাব
শুধু ভালবেসো আমায়
ঝরিয়ে আমার চোখের বৃষ্টি
আনব রংধনু
শুধু আপন থেকো‚ ভালবেসো
ভালবেসো আমায়…”
হঠাৎ মাঝপথে থেমে গেল শারফান৷ কারণ‚ গানের বাকি কথাগুলো ভুলে গেছে। চোখ খুলতেই দেখতে পেল জারার পাগলামি—মুচকি হাসতে হাসতে মেয়েটা এতক্ষণ ভিডিয়ো করছিল ওকে! কপট রাগ চোখে সে তাকালে জারা আরও দুষ্টুমি করে ভিডিয়োটা মিথির কাছে পাঠিয়ে দিল চুপিচুপি৷ আর ক্যাপশনে লিখে দিল তাকে‚ “দ্যাখ‚ তোর জন্য গাইল‚ ভাইয়া।”
শারফান কাজটা টের পেল না৷ গম্ভীরমুখে আদেশ করল কেবল‚ “ডিলিট করে দে‚ বজ্জাত। কাউকে পাঠাবি না খবরদার!”
“তাহলে তোকেই আগে পাঠাই”‚ হাসতে হাসতে জারা ওকেও সেন্ড করল ভিডিয়োটা৷ আর বলল‚ “পরিবেশটা সেই লাগছে ভিডিয়োতে৷ মনে হচ্ছে এক ছ্যাঁকাখোর পোলা কষ্টে-দুঃখে গান গাইছে বসে বসে।”
উঠে এসেই জারার মাথার পিছে একটা চাটি মারল শারফান‚ “এটা ছ্যাঁকা খাওয়া গান?”
জারা কিছু বলতে যাবে‚ তখনই মিথির কল এল। তা দেখেই শয়তানি হাসি খেলে গেল জারার চেহারায়। বেচারি মিথি সত্যিই ভেবে নিয়েছে বোধ হয়! কিন্তু রিসিভ করে সে বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলবে‚ তার ভাই অন্য কারও প্রেমে পড়ে গাইছিল। তাই সে চুপিচুপি ভিডিয়ো করে নিয়েছে৷ আচ্ছা‚ তখন কেমন লাগবে মিথির? মনটা ভেঙেচুরে খানখান হয়ে যাবে নিশ্চয়ই? তারপর মায়ের কাছে গিয়ে স্বামী মরার মতো শোক নিয়ে আহাজারি করে কাঁদতে শুরু করবে! ব্যাপারগুলো ভাবতেই জারার আত্মাটা আনন্দে নাচতে আরম্ভ করল যেন। মিথিকে এমন একটা ছ্যাঁকা যদি সত্যিই দিতে পারত ভাইয়া! তাহলে পৃথিবীর সব থেকে বেশি খুশি সে-ই হত।
জরুরি একটা কল এল শারফানেরও। তাই দ্রুত জারার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে এল৷ রিসিভ করেই ফোনের ওপাশে ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করল‚ “কী ব্যাপার রে‚ সেন্টু? সবে গতকাল কাজে নিয়োগ হলি‚ আর আজই ব্রেকিং নিউজ পেয়ে গেলি?”
“হ‚ ভাই৷ আপনি কইছেন না? আপনার কাজ মানেই আমার কাছে সবার আগে।”
“গুউউড”‚ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বিদ্রুপপূর্ণ হাসল শারফান। ওর এত মূল্যায়ন যে ক’মাস আগের সেই থাপ্পড় থেরাপি খাওয়ার পর থেকে হয়েছে সেন্টুর কাছে‚ তা আর বুঝতে বাকি নেই।
“ভাই‚ সুবিধা হইছে হলো সানা আফারা ম্যালাদিন ঢাকা ছিল না? তহন নিকুর মারে কামে রাখছিল মোস্তফা চাচা। এহনো কাজে আছে সে৷ সানা আফার দাদীর সাতে তার মেলা গল্প অয়। পঞ্চাশ ট্যাহা ঘুষ দিয়ে খবর নিতি পারিছি তার কাইছতে। কিন্তু খবরডা ভালো না‚ ভাই।”
জানালার পাশে বসানো ছোট্ট টেপেস্ট্রি সোফাসেট। সামনে একটি মার্বেলের কফি টেবিল৷ সেন্টুর কথাগুলো গাঢ় মনোযোগ নিয়ে শোনার ফাঁকে শার্টটা ছুড়ে ফেলল সেই সোফার দিকে। কিন্তু পড়ল গিয়ে কফি টেবিলটার ওপর। সেদিকে কোনো লক্ষ করল না সে৷ চিন্তিত মুখে এগিয়ে বেডসাইড টেবিলটাতে ওয়ালেট আর সিগারেট বক্স রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করল‚ “কী খারাপ খবর? অসুস্থ হয়ে পড়ল না-কি ও? কিছুক্ষণ আগেই তো বাপের সাথে বাসায় গেল সুস্থ বেশে।”
“আরে না‚ সানা আফার শরীল ভালো৷ খারাপ খবর হইল উনার জন্নি ছাওয়াল দেকতেছে। ইটু আগে আমিও আলম ঘটকরে ঢুকবার দেহিছি উনাগের বাড়ি৷ তাই দেহেই তো নিকুর মারে ঘুষ দিয়ে খবর বাইর করলাম কেবল। সামনের মাসে সানা আফার পরীক্ষা শ্যাষ হবি। তহন নাকি পাত্তোর আসবি দেকবার। ঢাকাইরতে আসবি নাকি৷ ছাওয়াল আর্মিতি চাকরি করে বলে৷ মনে অয় মিজর কইছিল নিকুর মা।”
কথাগুলো শোনা মাত্রই সারা শরীরে ঘাম ছুটে গেল শারফানের। কোমরের এক পাশে হাত ঠেকিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে সে। ফোনটা কানে ধরে কতক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। কোনো শব্দ‚ কোনো নড়াচড়া নেই। ভেতরে শুধু জমাটবাঁধা বিস্ময় ওর। তবে চোখে-মুখে তা স্পষ্ট নয়। তারপর হঠাৎ ওর বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে‚ কিন্তু ভীষণ ঠান্ডা সুরে জিজ্ঞেস করল‚ “ওকে দেখতে আসবে? না-কি দিনক্ষণ পাকা করতে আসবে?”
“না না… দেকবারই আসবি। আমি দেহি আরো কুনো খবর পাই নাকি কাইলকে। জানাবানে আপনারে।”
“হুঁ।”
কলটা কেটে দিল শারফান। ফোনটা হাতে ধরেই দ্রুত বসে পড়ল বিছানাতে। কেমন অস্থির লাগতে শুরু করল ওর৷ ঘামের চোটেই‚ না-কি সানার খবরটাতে‚ কে জানে! এক টানে সাদা ট্যাঙ্ক টপটা খুলে ফেলল সে। বলিষ্ঠ‚ লোমশ বুকের মাঝখানের বিভৎস ক্ষতটা বেরিয়ে পড়ল তখন। গাঢ় দাগ বিধায় সহজেই চোখে বাঁধে ক্ষতটা। সেখানটাই তাকিয়ে কী যেন ভাবনায় ডুবল সে৷ বিড়বিড়িয়ে উঠল কিছুক্ষণ পরই‚ “মরেই তো যেতাম। তখন তো অন্য কাউকেই বিয়ে করত ও। কিংবা এখনো আমার ভাবা উচিত নয়‚ ওকে আমি পাবো৷ এটা তো হওয়ারই ছিল।”
বুকের গহিন থেকে উঠে আসা এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তারপর। সে দীর্ঘশ্বাসে মিশে ছিল না পাওয়ার আর ‘ভালোবাসি’ না বলতে পারার তীব্র আফসোস… নিদারুণ দুঃখ।
ফোনটা বেডসাইড টেবিলটাতে রেখে উঠে পড়ল সে৷ দুর্বল পায়ে হেঁটে বাথরুমে ঢুকল৷ মনে হচ্ছে যেন সারা শরীরটাই ভেঙে পড়তে চাইছে৷ অস্থিরতাও দূর হচ্ছে না৷ তাই সোজা শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল। অথচ তবুও কেমন হাঁসফাঁস লাগতে থাকল৷ বুঝতে পারল তখন‚ এ অস্থিরতা দেহের ভেতরের—বাইরের নয় যে৷ ভিজতে ভিজতেই নানানরকম চিন্তা করতে লাগল৷ শেষমেশ দৃঢ় এক সিদ্ধান্তে পৌঁছাল সে—ঢাকা চলে যাবে কালই। সে যে ছুটে এসেছিলই সানার জন্য। কিন্তু এখন আর থাকার কোনো মানে নেই৷ তোয়ালেটা পরনে জড়িয়ে বেরিয়ে এল। ফোনটা হাতে নিল আবার৷ বাবাকে জানাবে‚ পরশু থেকেই অফিস শুরু করবে সে। শুয়ে‚ বসে থাকার আর কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু তখনই রিহানের কল ঢুকল হোয়াটসঅ্যাপে৷ কথা বলার আগ্রহ হলো না একটুও৷ তাও ধরল এই ভেবেই‚ ওর শরীরের খোঁজ নেওয়ার জন্যই ছেলেটা কল করে রোজ।
“কীরে‚ কী খবর?” ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠল রিহান‚ “ভালো টালো আছিস তো?”
কথার মধ্যে তার মুখে খাবার চিবানোর শব্দও পেল শারফান৷ জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “ডিনার করছিস না-কি?”
“হ‚ মাখন লাগিয়ে রুটি খাচ্ছি। খাবি না-কি? ভিডিয়ো কল দিই‚ দাঁড়া।”
“না… তোর ভ্যাটকাইন্না থোবড়া দেখার মুড নাই এখন। পরে ফোন দিস‚ তোর মামাকে কল লাগাব।”
“দাঁড়া… দাঁড়া”‚ মুখের মধ্যে আস্ত একটা রুটি পুরে বলতে শুরু করল রিহান‚ “ঠ্যাঙের ব্যারাম সাড়তে না সাড়তেই আবার মুডের ব্যারাম হলো কেন? কী ব্যারাম আগে বল? তারপর ফোন কাটব।”
কথাগুলো এমনভাবে জড়িয়ে জড়িয়ে আসল যে‚ শুনতে গিয়ে শারফানের মেজাজটাই চটে গেল৷ বিচ্ছিরি একটা গালি দিতে গিয়েও থামল। শুধু হুমকি স্বরে বলল‚ “মুখের খাবার শেষ করে কথা বলিস কিন্তু। অসহ্য লাগছে শুনতে।”
ঢকঢক করে দ্রুত পানি গিলে নিল রিহান। সে শব্দও শুনতে পেল শারফান৷
“নে… এখন বল। খাবার নাই আর মুখের মধ্যে। খাইয়ালাইছি সব।”
“সানার বিয়ে ঠিক হচ্ছে”‚ খুব শান্তভাবেই কথাটা জানাল শারফান‚ “ওর পরীক্ষার পর ছেলে দেখতে আসবে।”
সঙ্গে সঙ্গেই রসিকতার মেজাজটা হাওয়া হয়ে গেল রিহানের৷ শারফানের মানসিক অবস্থার কথা ভেবেই তারও অস্থির লাগতে শুরু করল যেন৷ কারণ‚ আর সবার থেকে একমাত্র সে-ই তো সব থেকে বেশি ভালো জানে‚ যখন ভালোবাসাটা বোঝেনি শারফান‚ তখন থেকেই সানার প্রতি ওর কতটা উন্মাদ আকর্ষণ ছিল! যা ছিল সকল যুক্তির ঊর্ধ্বে। সেজন্যই তো সেই নির্বাচনের দিনটাতে আগে-পিছে কিছুই না ভেবে ছুঁয়ে ফেলেছিল সানাকে অনৈতিকভাবে! আর সেই আকর্ষণের কারণ যখন ‘আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ভালোবাসা’ বলে আবিষ্কার করতে পারল‚ তখনই নিজের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি বেছে নিল ও। সেই মেয়েটাকে এখন যদি চোখের সামনে অন্য কাউকে বিয়ে করতে দেখে সে‚ কী হবে তখন ওর? কতদিন নিজেকে সামলে রাখতে পারবে ও? ঠিক আগের মতোই তো বুঝতেও দেবে না‚ ভেতরে ভেতরে রোজ কী পরিমাণ জখম তৈরি হচ্ছে ওর!
রিহানের নিজের কোনো ভাই-বোন নেই। শারফানের সঙ্গে ছোটো থেকেই ওর সম্পর্কটা ছিল আপন ভাইয়ের মতো। এজন্যই বোধ হয় শারফানের প্রতি ওর টানটাও এতখানি অকৃত্রিম। তাই বরাবরের মতো এবারও সে শারফানের ভালো ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারল না৷ সানার দিকটা তো একেবারেই নয়৷ মাথায় কেবল চলতে থাকল তার‚ শারফানকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে৷
ফোনের মাঝে অনেকটা ক্ষণ দুজনের কেউ-ই কথা বলল না৷ রিহানের চিন্তাভাবনা শেষ হলে শারফানকে জিজ্ঞেস করল‚ “আজ তো সানাকে দেখতে যাবি বলেছিলি৷ গিয়েছিলি? দেখা হয়নি ওর সঙ্গে?”
“হয়েছে।”
“কোনো কথা বলিসনি?”
“বলেছি… আর ওর বকাঝকা শুনেছি৷ রাগ বেড়ে গেছে খুব। আর একদম ফিট হয়ে গেছে ও‚ জানিস? ভালো লাগছিল দেখতে। কিন্তু রাগ বাড়লেও আমাকে দেখে সেই পালাতে চাওয়ার অভ্যাসটা যায়নি আজও”‚ বলেই শারফান হাসল একটু।
হাসতে পারল না রিহান৷ শারফানের মনে কী চলছে সেটা বোঝার জন্য সরাসরিই জিজ্ঞেস করল এবার‚ “তাহলে কী করবি এখন? কী ভেবেছিস?”
“কী করব আবার? কিছুই না”‚ নির্বিকার সুরে বলল‚ “অফিসে গিয়ে বসব ভাবছি৷ কালই চলে যাব ঢাকা।”
ওর এই শান্ত‚ নির্বিকার ভঙ্গিটাই রিহানকে আরও ভয় পাইয়ে দিল। ওর এই অভিব্যক্তি মানেই তো আগামীতে কারও না কারও জন্য ঝড় বয়ে আনা৷ কিন্তু এবার আর অন্য কারও জন্য আসবে না সেই ঝড়। আসবে ওর নিজের জন্যই—ঠিক মাস দুই আগের মতো! দুশ্চিন্তার মাঝে রিহান হতাশাপূর্ণ গলায় বলল‚ “আমি আরও কত কী ভেবে ফেলেছিলাম‚ তোকে ও হসপিটাল দেখতে গিয়েছিল শুনে। ভেবেছিলাম শত রাগ আর ঘৃণা থাকলেও তোর প্রতি ভালোবাসাটাও রয়ে গেছে ওর৷ যেটা ও উপেক্ষা করতে পারবে না সহজে।”
“কী বললি?” শারফানের মনে হলো ও ভুল শুনেছে হয়ত৷ ভ্রু কুঁচকে মুহূর্তেই জিজ্ঞেস করল‚ “ও হসপিটাল গিয়েছিল আমাকে দেখতে—এরকম কিছু বললি না-কি?”
কথাটা রিহান জানাতে চায়নি৷ এখনো বলে ফেলল ভুলবশতই। কারণ‚ সেদিন লেকে শারফানের পাগলামি কাণ্ড কারখানা দেখে সে ভেবেছিল‚ এ কথা শোনার পর যদি আরও পাগলামি শুরু করে শারফান? কিন্তু এখন যখন বলেই ফেলেছে‚ তাই আর লুকাল না‚ “হুঁ‚ ওর কাজিন যে ছেলেটা—প্রিন্স৷ ওর থেকে সেদিন শুনেছিলাম।”
সানা কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে গিয়েছিল ওকে দেখতে‚ তা সবটাই বলল রিহান৷ শুনতে শুনতে শারফানের বুকের ভেতরটা দ্রিমিদ্রিমি করে কাঁপতে শুরু করল৷ হৃদয় নিংড়ে ওর সকল বিষণ্ণতা আর অপূর্ণতার কষ্টটুকুও বের হয়ে গেল যেন। চোখদুটোতেও ছড়িয়ে পড়ল উচ্ছ্বাস। কিন্তু তারপরই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে গালি দিল রিহানকে‚ “পাঠাচো**‚ আমাকে এতদিন পর জানালি কেন? হাতের কাছে থাকলে তোর পুট** ফাটাতাম আমি। এরকম একটা কথা তুই কী করে জানালি না আমাকে?”
উত্তরে রিহানও গালাগাল করতে যাচ্ছিল‚ কিন্তু বলার সুযোগটুকুই দিল না শারফান৷ ফোনটা কেটে দিয়ে কতক্ষণ থমকে রইল সে। তারপর হঠাৎ ক্যাবিনেটের কাছে এল। ভেতরের ড্রয়ার থেকে বের করে আনল গাঢ় নীল মখমলের আবরণে ঢাকা একটা কেস। কেসটা খুলে ভেতরের বস্তুটাকে দেখল কিছুক্ষণ। সেটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘরময় পায়চারি করতে করতে ভাবল আজকের মুহূর্তগুলো৷ সানা ওকে বকেছে ঠিকই‚ রাগও স্পষ্ট ছিল তার চোখে-মুখে‚ আর কিছুটা বিরক্তিও৷ কিন্তু তার মাঝে ঘৃণার অস্তিত্ব অনুভব হয়নি আজও৷ তারপর চলে গিয়েও শেষ বেলায় ওর উপস্থিতি আছে কি-না‚ তা দেখার চেষ্টা—এতেও কি বোঝা যায় না‚ ওকে আর আগের মতো ঘৃণা করে না সানা? ছটফট করা মনটা নিয়ে বিছানাতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল সে। তারপর ভাবনায় হারাল—ওকে মৃতের মতো দেখার পর কি সানার সত্যিই কষ্ট লেগেছিল? চোখটা কি একটু ভিজেছিল তার? একবারও কি ভালোবাসাটুকু অনুভব হয়নি তখন? এর জবাবগুলো এখনই খু্ব জানতে ইচ্ছা হলো ওর। কিন্তু কীভাবে জানবে? রায়হানকে কল করবে একবার? না‚ রায়হানকে কল করা যাবে না৷ কারণ‚ সে কিছুই জানাবে না৷ উলটে ওর অসমাপ্ত থেরাপির জন্য জ্ঞান দিতে শুরু করবে৷ তাহলে কার থেকে জানতে পারবে? সানা ছাড়া আর তো কোনো সুযোগ নেই! কিন্তু সানা কি জবাব দেবে?
চঞ্চল মনটা নিয়ে আবার উঠে বসল শারফান। মিনিটখানিক ভাবনা চালিয়ে ফোনটা হাতে নিল। একপেশে হাসিটা হঠাৎ ঠোঁটে কিনারায় ফুটল ওর। জারার দেওয়া ভিডিয়োটা পাঠিয়ে দিল সানার নতুন নম্বরটির হোয়াটসঅ্যাপে। গানটা শোনার পর হয়ত আবারও ওর নম্বরটাকে ব্লক করবে সানা। কিন্তু ওর প্রেমের ভাষা তো ততক্ষণে পৌঁছেই যাবে! এই-ই ঢের।
***
মায়ের জোরাজুরিতে প্রচণ্ড অনীহা নিয়ে মুখের মধ্যে ফেসপ্যাক মেখেছে সানা। ঘরে এসে বসল সবেই। এমন অনীহা তার আগে ছিল না কখনো। বরং চন্দন বর্ণ চেহারার জৌলুস বাড়াতে সে নিজ গরজেই রূপচর্চা করত এক সময়৷ কিন্তু আজ এই অনীহার কারণটা বেশ স্পর্শকাতর৷ তার বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বাড়ি থেকে৷ স্বয়ং মোস্তফা সাহেব এসে মত নিয়েছেন তার থেকে—কোনো আপত্তি আছে কিনা বিয়েতে!
পড়াশোনা ছেড়ে দীর্ঘ দু মাস বাড়ির বাইরে থাকার সঠিক কারণটা কেউ না জানলেও পাড়াপড়শির মুখে মুখে আজ-কাল তাকে নিয়েই চর্চা হচ্ছে। যা হওয়া স্বাভাবিক বইকি! বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা‚ সে হয়ত প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করেই সবাই বাড়ি ফিরেছে৷ অবশ্য যা রটেছে‚ তার আংশিক তো সত্য বটেই৷ কেবল পালানো আর প্রেমিক শব্দদুটো ভুল। এ এলাকাতে যে আর কারও মেয়ের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা যে ঘটেনি কখনো‚ ব্যাপারটা তা নয়৷ কিন্তু তাদের পরিবারের কর্তা যে মোস্তফা সাহেবের মতো সমাজের সম্মানিত আর শ্রদ্ধেয় পর্যায়ের মানুষ ছিল না৷ ছিল সাধারণ পর্যায়ের মানুষ৷ সেজন্যই তাদের বাড়ির মেয়েদের নিয়ে কেউ কখনো এতখানি আগ্রহের সঙ্গে প্রতিদিন আলোচনার আসর জমায়নি৷ মানুষ তো আগ্রহ আর আনন্দ পায়-ই অভিজাত আর সম্মানজনক ব্যক্তিদের নিয়ে চর্চা করতে। তাছাড়া তাদের দু বোনকে নাজমা বেগম আর মোস্তফা সাহেব এলাকার বাকি অভিভাবকদের তুলনায় অনেকটাই রক্ষণশীলতার মাঝে বড়ো করেছেন৷ পাড়ার অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে মিশতে দেননি তারা কখনোই৷ এ নিয়েও তারা দু বোন হয়ে ছিল প্রতিবেশীদের কাছে আলোচনার বিষয়বস্তু। সেই মেয়েদের কেউ বদনাম হওয়ার মতো কাজ করে বসলে কি চর্চাটা রোজ না করে পারে তারা?
এসব জেনেই সানা মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বাবাকে সম্মতি দিয়েছে বিয়ের জন্য৷ তার জন্য বাবা-মায়ের আর কোনো অসম্মান হোক‚ তা সে চায় না। আজ এই রূপচর্চা করতে হচ্ছে বিয়েকে কেন্দ্র করেই। এজন্যই আজ এত অনীহা তার।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা হাতে নিল সে‚ নিরালায় বসে একটু গান শুনে মনটা ভালো করবে বলে। আর ঠিক তখনই হোয়াটসঅ্যাপে সেভ না করা একটা অচেনা নম্বর থেকে মেসেজ এল—ভিডিয়োর একটা স্ট্যাটিক থাম্বনেইল। প্রোফাইলে কোনো ছবি নেই। তাই জানতে পারল না ব্যক্তিটি কে। অটো ডাউনলোড চালু থাকায় ভিডিয়োটা জমা হলো ফোনের গ্যালারিতে হোয়াটসঅ্যাপ ফোল্ডারে। সেখানে ঢুকে ভিডিয়োটা চালু করল সে‚ বেজে উঠল গিটারের টুংটাং ধ্বনি। তারপর এক মুহূর্তও ব্যয় হলো না তার‚ আবছা নীল আলোর মাঝে গিটার হাতে জানালার ধারে বসে থাকা মানুষটিকে চিনতে। ছলাৎ করে উঠল যেন সানার বুকের মধ্যে৷ তারপরই বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়ল শারফানের গানটা আরম্ভ হলে। একটা পলকও ফেরাতে পারল না চোখ বুঁজে গাইতে থাকা মানুষটির ওপর থেকে। বাতাসে মৃদু উড়ছে ওর এলোমেলো বড়ো চুলগুলো‚ মুখের ডান পাশটায় এসে ছুুঁয়ে যাচ্ছে দিনের শেষ আলোটুকু। আর মনে হলো‚ পুরু ঠোঁটের এক কোণে একটুখানি হাসিও খেলে যাচ্ছে লোকটার। গানটা সুন্দর‚ না-কি যে গাইছে তার গাওয়াটা চমৎকার‚ না-কি গাইতে থাকা ব্যক্তিটিই তাকে টানছে? সানা বুঝল না৷ কিন্তু বিভোর হয়ে চেয়ে রইল সে ফোনের স্ক্রিনে।
ওদিকে‚ শারফান সানার লাস্ট সিন দেখে বুঝল ভিডিয়োটা দেখেছে সানা। এবং ওকে এখনো ব্লক করেনি৷ অথচ সময় পেরিয়েছে পাঁচটা মিনিট৷ আনন্দে আত্মহারা শারফানের এমন অবস্থা হলো যে‚ সে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে‚ সানা কী প্রতিক্রিয়া দেবে‚ তা আর চিন্তা না করে অকস্মাৎ কল করে বসল।
তখনই কেঁপে উঠল সানা—মনে হলো যেন ঘোর থেকে বের হলো সে৷ বুকের মধ্যেও কাঁপন আরম্ভ হলো তার। রিসিভ করল না কলটা। ব্লক যে করে দেবে‚ সেটাও তার মাথায় এল না। মাথার মধ্যে যেন সবটাই এলোমেলো হয়ে গেছে। শারফানের দ্বিতীয় মেসেজ এল তারপরই—অডিয়ো মেসেজ৷ সেটা চালু করতেই শারফানের অনুরোধ শুনতে পেল‚ “সানা… প্লিজ মাত্র পাঁচটা মিনিট দাও আমাকে! খুব আর্জেন্ট৷ প্রমিজ করছি‚ তারপর আর কল করব না তোমাকে।”
দ্বিধায় পড়ল সানা। মন একবার বলছে রিসিভ করতে‚ আবার বলছে আর কোনোই সুযোগ না দিতে। কিন্তু ‘আর্জেন্ট’ কথাটা তাকে ভাবাচ্ছে৷ গত মাসেও লোকটা মেসেজ করেছিল। জানিয়েছিল‚ ওকে সে শাস্তি দিতে না পারলেই ও আত্মসমর্পণ করবে পুলিশের কাছে৷ এ নিয়েই কি কথা বলবে? সত্যি সত্যিই কি যাবে শয়তানটা পুলিশের কাছে? ভাবনাচিন্তার মাঝে কল করল শারফান আবারও।
এই দ্বিধায় ভোগা মনটা নিয়ে আজ কটা মাস সানা তিক্তবিরক্ত হয়ে উঠেছে৷ কেন কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তেই সে পৌঁছাতে পারে না এখন? চোখটা বুঁজে লম্বা করে একটা শ্বাসটা টেনে নিয়ে শেষবােরের মতো ভাবল‚ ফোনটা রিসিভ করা উচিত কি-না? এবার প্রথমে নিজের ইতিবাচক চাওয়াটাই অনুভব করল সে। তাই সেটাকেই প্রাধান্য দিল৷ রিসিভ করে কানে ঠেকাল ফোনটা। কিন্তু কোনো কথা বলল না শুরুতেই৷
অপরদিকে‚ শারফানও তার কোনো কণ্ঠ না পেয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকল৷ তারপর ডেকে উঠল পেলব সুরে‚ “শুনছ‚ সানা?”
কণ্ঠের সঙ্গে শারফানের ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ার শব্দটাও শুনতে পেল সানা৷ এত স্পষ্ট আসছে কেন নিঃশ্বাসের শব্দগুলো? কই‚ আগে তো কথা বলার সময় কখনো এমনটা শোনেনি! অসুস্থ না-কি দানবটা? মনে মনে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে শারফানের মৃদুস্বরটা আবার শুনতে পেল‚ “অ্যাই শুনছ? আছ তুমি?”
ভাবনার দৌড় থামিয়ে এবার জবাব নিল সানা গম্ভীর স্বরে‚ “আছি। আর্জেন্টটা কী‚ বলুন।”
“পাঁচ মিনিট সময়টা দেবে তো? কেটে দেবে না তো কথার মাঝপথে?”
আবদারের ধরনটা একদম বাচ্চাদের আবদারের ঢং যেন—মনে হলো সানার। কথার সুর এত কোমল‚ এত ধীর আর অনুদ্ধত শারফানের! কণ্ঠে ওর সেই অতীতের দম্ভ‚ অহংকার‚ রুক্ষ সুরটা নেই দেখে সে অবাকই হলো।
“কথা প্রয়োজনীয় মনে হলেই লাইন থাকবে”‚ জবাব দিল সানা একটু থেমে থেকেই।
আর শারফানের মনে হলো‚ ফোনের ওপাশে যেন কথা বলছে স্কুলের রাগী‚ কড়া প্রকৃতির কোনো অঙ্কের শিক্ষিকা। যে ছাত্রদের মনে ভয় ধরে রাখতে স্বাভাবিক কথাটাও বলে গাম্ভীর্যের সঙ্গে—ভাবতেই নিঃশব্দে হাসল সে। তারপরই জিজ্ঞেস করল‚ “আমি আইসিইউ থাকতে তুমি দেখতে এসেছিলে আমায়?”
চমকে গেল সানা৷ ভ্রু‚ কপাল কুঁচকে চকিতেই পালটা প্রশ্ন ছুড়ল‚ “কে বলেছে আপনাকে?”
“তার মানে সত্যিই এসেছিলে!”
এর উত্তর দিল না সানা৷ আগের প্রশ্নটাই আবার করতে চাইল‚ কিন্তু তার আগেই শারফান বলল‚ “এটা গোপন থাকার মতো কোনো ঘটনা না৷ জানতে পারা অস্বাভাবিক কিছু না৷ কিন্তু তুমি কি গোপন রাখতে চেয়েছিলে? কেন?”
“গোপন কেন রাখতে চাইব? আপনি এ কথা শোনার জন্য কল করেছেন? তাহলে সময় দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না”‚ বলেই কলটা কাটতে উদ্যত হলো সে।
ওপাশ থেকে ভেসে এল তখন শারফানের কাকুতি-মিনতি‚ “প্লিজ সানা‚ জাস্ট হিয়ার মি আউট ওয়ান্স! প্রমিজ করেছি তো‚ এরপর আর কল করে বিরক্ত করব না।”
ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলল সানা‚ “এসব অপ্রয়োজনী কথা আমি শুনতে রাজি নই। ও.কে?”
জবাবে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল শারফান। তারপর বলতে শুরু করল‚ “আমি সেদিন দ্বিতীয়বারের মতো মরতে যাচ্ছিলাম…”
কথাটুকু শোনা মাত্রই সানার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেদিনের চিত্রটা৷ হ্যাঁ‚ সত্যিই এই লোকটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল সবাই কী মরিয়া হয়ে! যে চিত্র দেখার মুহূর্তে তার নিজেরই শ্বাস আটকে আসার মতো অনুভব হচ্ছিল কেমন।
শারফান বলেই চলেছে‚ “মরে গেলে আজ এই কথাগুলো বলার সুযোগ হত না আমার৷ যেহেতু বাঁচিয়েই দিল আল্লাহ‚ তাই না বলে থাকতে পারছি না৷ আমার করা অন্যায়ের বিচার আমি করতে পারিনি‚ সানা। তুমিও আর পুলিশের কাছে কিছু বললে না৷ আবার অন্য কোনোভাবেও শাস্তি দিলে না আমায়। আর আজ জানলাম‚ এই জানোয়ারকে দেখতেও নাকি ছুটে এসেছিলে। তুমি কি জানো‚ এটা আমাকে আরও কতটা অপরাধবোধে দগ্ধ করছে? আমি তো কিছু করেই এ থেকে মুক্তি পাচ্ছি না‚ সানা। তোমাকে টর্চার করা অমানুষটার প্রতি কীভাবে মানবিক হতে পারলে? আদৌ কি মানবিকতা আসা উচিত ছিল আমার প্রতি? তোমার বদলে অন্য কেউ হলে আমার পরিণতিতে আনন্দিত হত। তুমি কেন হতে পারোনি‚ সানা? কেন কষ্ট পেয়েছিলে? এর জবাবটুকু পেলেই আমি কিছুটা পরিত্রাণ পাবো৷ নয়ত তোমার থেকে ছাড় পাওয়াটা আমাকে শেষ করে ফেলছে একটু একটু করে। এভাবে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। মুক্তি চাই আমি৷ আর মুক্তি পেতে হলে আমার মরে যাওয়া উচিত বলেই মনে হচ্ছে শুধু। জবাবটুকু দাও প্লিজ!”
এই প্রশ্নের সঠিক জবাব সে তো নিজেও খুঁজছে প্রতিনিয়ত৷ কী করে তাহলে জবাব দেবে সে শারফানকে? শারফানের কাছেই বা কেন এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো তাকে? চুপচাপ কলটা কেটে দিতে গিয়েও সানা থামল শেষে—শারফানের আত্মধ্বংসের মানসিকতা সৃষ্টি হওয়ার কথাগুলো মনে পড়ে৷ জিসান তো বলেছিল সেদিন সবটাই৷ এখনো শারফান এই মানসিকতা থেকে বের হতে পারেনি? নয়ত কেন মরে যাওয়ার কথা বলছে?
“সানা…”‚ কোমল সুরে ডেকে উঠল শারফান আবারও। “চুপ আছ কেন? বলো উত্তরটা।”
“কিসের উত্তর? আমি কোনো উত্তর দিতে পারব না”‚ কাটকাট কণ্ঠে বলে উঠল সানা।
“প্লিজ…”‚ আকুলতায় কণ্ঠটা ফিসফিসানির মতো শোনাল ওর। “তোমার এই কোল্ডনেস আমাকে অস্থির করে তুলছে সব সময়৷ আমি যে কী করব… ভেবে পাচ্ছি না! কী করা উচিত আমার‚ একটু বলবে?”
“আপনি অস্থির হলে আমার কী? আমি কেন বলব? আপনার যা ইচ্ছে হয় তাই করুন। আমাকে কেন শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেন না? আমাকে বরং বলুন‚ আমি কী করলে আপনার থেকে মুক্তি পাবো?”
“আমি তোমার শান্তি কেড়ে নিতে চাই না আর। আমি তো বলেছিলাম‚ আর কখনোই তোমার ভালো থাকার পথে বাধা হব না। সত্যিই হব না৷ তোমার যদি মনে হয় এখনো তুমি মুক্তি পাওনি আমার থেকে‚ তাহলে আমার প্রশ্নের জবাবটা দাও শুধু৷ তারপর আর কোনোদিনও তোমাকে বিরক্ত করব না।”
অসহ্য লাগল এবার সানার। প্রশ্নগুলোর জবাব তার কাছে থাকলে তো সে দেবে! সহ্যের সীমা পেরিয়ে যাওয়ায় সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল‚ “আপনার প্রশ্নের কোনো জবাব নেই আমার কাছে। বুঝেছেন? আমি জানি না… আমি নিজেই জানি না কিসের জন্য ছুটে গিয়েছিলাম আমি?” শেষ কথাটাই সানা প্রশ্নবিদ্ধ করল যেন নিজেকেই।
শারফান উত্তর দিল তখন‚ “মানবিকতা থেকেই হয়ত। কিন্তু আমার প্রতি তো তোমার মানবিকতাও আসা উচিত নয়… শুধু ঘেন্না ছাড়া। তাই না? আমার মরে যাওয়াতেই তোমার খুশি হওয়ার কথা। তাহলে আমার জন্য মানবিকতাই বা কেন কাজ করল তোমার মাঝে?”
“আমি জানি না বললাম তো”‚ ধমকে বলল সানা‚ “আপনি ফোন রাখুন।”
“তুমি জানো‚ সানা। তোমার ভেতরের অনুভবকে তুমি ছাড়া আর কে জানবে?”
সানা চুপ করে রইল৷ কিন্তু মনের ভেতরে শুরু হলো সেই পুরনো দ্বন্দ। শারফানের কথা মতোই বুঝতে চেষ্টা করল নিজের অনুভবকে।
শারফান হঠাৎ অনুশোচনা থেকে বলতে লাগল‚ “আমি আমার বোনের কষ্টে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কোনো কিছু আলাদা করে বাছ বিচার করার মতো বোধটুকুই আমার ছিল না তখন। তারপর যখন আমার মন আমাকে ভুল বোঝাল‚ তুমি ফারনাজকে ভালোবাসো‚ আমি তখন রাগে-ক্ষোভে একেবারেই পাগল হয়ে গেলাম যেন৷ সহ্যই হচ্ছিল না কথাটা ভাবলে৷ সব কিছু মিলিয়ে নিরপরাধ তোমাকে ভুক্তভোগী হতে হলো। আমি নিজেও ভাবতে পারি না‚ প্রতিটিদিন কী করে তোমাকে শারীরিক‚ মানসিকভাবে শেষ করে দিচ্ছিলাম। নির্মম এক শাস্তি দিতে মন চায় তখন নিজেকে। স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তাই তখন নিজের বোনের কষ্টটাই শুধু প্রাধান্য পাচ্ছিল আমার কাছে। আমি জানি না‚ আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে বোনের ওই ক্ষতিতে আমার মতোই এমন স্বার্থপর হয়ে উঠত কিনা। হয়ত হত না।”
‘স্বার্থপর’ কথাটা কানে আসতেই সানার হঠাৎ নিজেরও সেই দিনকার একটা স্বার্থপরতার কথা মনে পড়ল। যখন শারফান মেহাকে তুলে আনার কথা বলল‚ সেও তো তখন বোনের ক্ষতির ভয়েই স্বার্থপর হয়ে গেল—জানিয়ে দিল হাসিবের কথা। নিজের আপনজনের বেলাতে সবাই-ই তবে স্বার্থপর হয়ে ওঠে? আর এটাই কি বাস্তবতা নয়?
“সানা?” বলে উঠল শারফান‚ “তোমারও নিশ্চয়ই আজও মনে পড়ে আমার দেওয়া কষ্টগুলোর কথা? তারপরও তুমি পারলে না আমাকে পুরোপুরি ঘেন্না করতে? কেন পারলে না‚ বলো? তোমার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকেই আমার জন্য তুমি প্রতিনিয়ত যন্ত্রণায় ভুগছিলে। এমন একটা মানুষকে সব সময় মরার অভিশাপ দেওয়া ছাড়া আর কি কিছু আসতে পারে মনে? ইলেকশনের দিনটাই ঠিক যেমন অভিশাপ দিয়েছিলে‚ আমি তেমন অভিশাপ পাওয়ারই যোগ্য শুধু‚ তাই না? আমি তো কখনোই ভালো কিছু করিনি তোমার সঙ্গে। তবুও কেন আমার পরিণতিতে মায়া হয়েছিল তোমার?”
“সত্যিই তো”‚ মনে মনে ভাবতে শুরু করল সানা‚ “এই মানুষটা আমার জীবনে আসার পর থেকে ভালো কিছুই করেনি আমার সঙ্গে। তাও কেন তাকে ঘেন্না করতে পারিনি আমি? না-কি কিছু ভালোও করেছিল সে? যার জন্য তার প্রতি ভালোবাসার মতো অনুভবটুকু জন্মেছিল আমার মধ্যে!”
শেষ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সানার মনে পড়ল ফেলে আসা মুহূর্তগুলোর কথা৷ যে মুহূর্তগুলোর মাঝে ছিল রাতের পর রাত জেগে এই লোকটার কথা শোনা‚ জবাব দেওয়া‚ তারপর ওর অনুপস্থিতি আর ওর ফোনকল না আসায় হঠাৎ ওকে মিস করা‚ আর বাপ্পির মৃত্যুতে তার প্রতি রাগ থাকা সত্ত্বেও তাকে মৃত্যুর মুখ থেকে লোকটার রক্ষা করা। কিন্তু এ সব কিছু ছাপিয়ে সানার মনে আবারও ভেসে উঠল শারফানের হিংস্রতা৷ অথচ এরপরও তো সে ওকে একটাবার দেখার জন্য ছুটে গিয়েছিল হাসপাতালে! তাহলে কি ভালোবাসাটুকু এখনো জীবিত আছে তার মাঝে? নয়ত কেন মায়া লেগেছিল সেদিন ওকে বাঁচা-মরার লড়াইয়ে দেখে? না-কি স্রেফ মানবিকতাই ছিল সেখানে? কিন্তু এই মানবিকতাবোধও তো যুক্তিযুক্ত নয়—যদি পুরনো অনুভূতিগুলো না-ই বেঁচে থাকে!
অবশেষে আজ তার মনের মধ্যের দ্বিধার সুতোর একটা গিঁট খুলল যেন৷ ওদিকে‚ দীর্ঘক্ষণ তার নীরবতায় শারফান ডেকে উঠল‚ “তুমি আছ‚ সানা?”
সানা উত্তর নিল আরও কিছুক্ষণ পর‚ “আছি৷” কেমন মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল‚ “ফোনটা রাখতে হবে আমায়৷ কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আর।”
“আমাকে জবাবটা দেবে না তবে?”
একটু সময় থেমে থেকে বলল সানা‚ “জবাব দিতে কি বাধ্য আমি?”
হতাশাপূর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল শারফান। “না… একেবারেই বাধ্য নও তুমি। আমাকে আমার কষ্ট থেকে মুক্তি দিতেও তুমি বাধ্য নও৷ আমার মুক্তির পথ আমিই খোঁজার চেষ্টা করব।”
জবাবে সানা বলল না কিছু৷ কিন্তু মনে ঠিকই শঙ্কা জাগল‚ প্রশ্ন জাগল‚ কী পথ খুঁজে নেবে সে? পুলিশের কাছে যাবে? না-কি আবারও আত্মঘাতীর মতো কোনো সিদ্ধান্ত নেবে?
“এবার তুমি রাখতে পারো”‚ ভারাক্রান্ত সুরে বলল শারফান।
সানা দ্বিধায় ভুগছিল তখনো‚ কী পথ খুঁজে নেবে শারফান—তা জানতে চাইবে কি-না! এদিকে‚ তার ভাবনার মাঝেই কলটা কেটে গেল। ফোনটা কান থেকে নামাতেই চ্যাটে সেই ভিডিয়োর থাম্বনেইলে চোখ আটকাল সানার৷ কিসের আকর্ষণে যেন সে ভিডিয়োটা চালু করল তখন পুনরায়। গান গাওয়াটা আর আবছা আলোয় বসে থাকা শারফান‚ দুটোই কেমন বিহ্বল করে তুলতে চাইছে তাকে আবারও৷ অন্যদিকে‚ মাথায় ছোটাছুটি করছে শারফান কী করবে‚ সেই কথাটাও৷ চিন্তাতে অস্থির হয়ে উঠতেই সে আগে-পিছে কিছু ভাবল না আর। কল করে বসল শারফানকে।
কলটা অপ্রত্যাশিত লাগার কথা শারফানের কাছে৷ কিন্তু রিং বাজতেই শারফান মুচকি হাসল। অর্থাৎ‚ সে যেন জানতই কলটা আসবে‚ আর শুয়ে শুয়ে তারই অপেক্ষা করছিল যেন৷ রিসিভ করল দ্রুতই‚ “কল করলে যে? কিছু বলবে?”
“নয়ত কেন কল করব?” থমথমে সুরে উত্তরটা দিয়ে একটু সময় ইতস্তত করল সানা। তারপর জিজ্ঞেস করেই বসল‚ “আপনার মুক্তির পথটা কী? জানাটা জরুরি মনে হলো।”
“কেন জরুরি মনে হলো?” হাসিটা শারফানের মুখে জড়িয়ে তখনো।
“জরুরি কেন তা আপনিও জানেন। আমি কিন্তু বলেছি‚ আমি চাই না আপনি সব কিছুর স্বীকারোক্তি দিন পুলিশের কাছে।”
“দেব না। যে কাজে তোমাকে আবারও বদনাম হতে হবে‚ তোমার বাবা-মাকে অসম্মানিত হতে হবে‚ সে কাজে আমি যাব না। নিশ্চিন্তে থাকো৷ এ বাদেই কিছু করব।”
“কী করবেন?”
“ওই যে বললে‚ যা ইচ্ছে হয় তাই করতে। সেটাই! ”
বিরক্ত লাগল সানার। “আশ্চর্য! যা ইচ্ছে তাই মানেটা কী?” প্রশ্নটা কেবল মনেই রাখল সে। আর মুখে বলল‚ “ঠিক আছে‚ যা ভালো মনে করেন। রাখছি আমি।”
কোনো উত্তর করল না শারফান। ফোনটা কেটে গেল তারপরই।
কিন্তু শারফানের বলা সব কথাগুলো মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে থাকল সানার। সময়ের খেয়াল নেই‚ অনেকটা সময় ধরে সেসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে পড়ল‚ জিসান যে এমএমএসটা পাঠিয়েছিল—সেটা দেখা হয়নি। দেখা হয়নি বলা থেকে ভালো‚ দেখার আগ্রহ জাগেনি তার। দেখেছিল শুধু প্রিন্সই। একটা চিঠির ছবি ছিল নাকি ওটা!
এক মাসের বেশি সময় পর আজ সেই ছবিটা দেখার ইচ্ছা হলো সানার৷ ফোন থেকে খুঁজে বের করল এমএমএসটা—ছোটো ছোটো অক্ষরে লেখা বড়ো একটা চিঠি। ভালোভাবে বোঝার জন্য একটু জুম করে নিল সে। চিঠিটা পড়তে পড়তে একটা সময় সানা খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারল শারফানের অপরাধবোধ‚ আর ওর তীব্র অনুশোচনাকে। কিন্তু নিজেকে নিয়ে লেখা কথাগুলো পড়ার সময়ই ধাক্কাটা খেল সে। যদিও কাটাকুটি সে লেখাগুলো৷ কিন্তু তবুও বুঝল‚ সরাসরি না বলেও খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছে শারফান—সে ভালোবাসে তাকে! চমকটা পেল সানা সাংঘাতিক। তার মন-মস্তিষ্কে চলমান দ্বন্দকে নতুনভাবে শক্তপোক্ত করে দিল আবার এই চিঠিটাই।
আর শারফান? চোখ বুঁজে শুয়ে থেকে সে অনুভব করছে যেন কোনো প্রজাপতির বাগানে শুয়ে আছে সে। যেন ওর চারপাশ জুড়ে হাজারো রঙিন প্রজাপতির উড়াউড়ি! শারফানের বিশ্বাস‚ ওর জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো ছিল আজকের এই কথাগুলোই। যে কথাগুলো ঠিক স্থানে গিয়ে পৌঁছালে ওর কাছে ধরা দেবে এ জীবনের মূল্যবান সুখটুকু৷ না দেখতে পেলেও ও বুঝেছে‚ সানা প্রভাবিত হয়েছে ওর কথাতে। আশা করা যায় খু্ব জলদিই নিজের অনুভূতিকে সঠিকভাবে যাচাইও করতে পারবে সে। তবে শারফান এও বুঝেছে‚ সানার আনকোরা সেই ভালোবাসাটুকু একেবারেই হারিয়ে গেছে‚ নয়ত গাঢ় অভিমান আর কষ্টের নিচে চাপা পড়ে আছে। চোখদুটো খুলে কঠিন আফসোস আর আক্ষেপে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
“সানা”‚ বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল‚ “ভালোবাসার গাছটা হয়ত শুকিয়ে গেছে। কিন্তু তোমার হৃদয়ের গভীরে তার শেকড়টা এখনো বেঁচে আছে। আমি ঠিক সেখান থেকেই যত্ন শুরু করব এবার। আর সেই সুযোগটা তুমিই আমাকে দিয়েছ। মনে রেখো তা।”
চলবে।