#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৫৩. (প্রথম অংশ)
বিকাল ৪: ২০
দুপুরে ভাতঘুমের পর জেগে উঠেই সানা দেখে‚ বিকালটা ধূসর মেঘের। কোথায় গেল সারাদিনের সেই ঝাঁজালো রোদ? বৃষ্টি নামার পূর্বেই ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নেয় সে। তারপর অনির কাছে ওকে পৌঁছে দিয়ে যান মোস্তফা সাহেব। আগামীকালই পরীক্ষা সানার৷ কিন্তু আত্মবিশ্বাস পাচ্ছিল না সে‚ অঙ্কগুলো ঠিকঠাক করে আসতে পারবে কি-না। দীর্ঘদিনের বিরতিটা ওর পড়াশোনাতে ক্ষতি করেছে খুব৷ পরীক্ষাগুলো যতটা ভালো হওয়া দরকার ছিল‚ ততটা হচ্ছে না তাই৷ মোস্তফা সাহেব এ নিয়ে কোনো অভিযোগ করছেন না মোটেও৷ কিন্তু সানার ভীষণ মন খারাপ হয়।
রিয়ার ঘরে বসে সানা আর রিয়া দুজনকেই অঙ্ক দেখিয়ে দিচ্ছিল অনি৷ বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। পড়ানোর ফাঁকে কিছু সময়ের জন্য সে অন্য ছাত্রদের কাছেও যাচ্ছিল৷ এর মাঝেই পাশের ঘর থেকে তার উত্তেজিত কণ্ঠ শুনতে পায় সানা‚ “এই বৃষ্টির মধ্যে তুই ওকে গাড়ি দিতে গেলি কেন?” তারপর এক মুহূর্ত চুপ থাকে অনি।
এরপর আবার শোনা যায় তার উচ্চস্বর‚ “পায়েও লেগেছে? তাহলে হাসপাতাল নিয়ে চেকআপ করানো দরকার জলদি৷ রড সরে নড়ে গেছে নাকি কে জানে!”
কয়েক মুহূর্ত আবার চুপ থাকার পর অনির মেজাজ খারাপ হওয়া কণ্ঠ শোনা যায় এবার‚ “হাসপাতাল যাবে না কেন‚ বান**দ? ও কি তাহলে ইচ্ছা করে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে? ওর জন্য ওর বাপ-মা অকালেই মরবে। আমি বের হচ্ছি এখনই।” কথা শেষ করেই ছাত্রগুলোকে ছেড়ে দিল সে।
“কার অ্যাক্সিডেন্ট হলো?” ভাইয়ের কথা শুনতে পেয়ে রিয়া আপনা-আপনিই বলে উঠল।
মাথার মধ্যে একজনের নামটাই বারবার আসতে লাগল সানার—শায়াফ! গতকাল রাতেই যে বলেছিল ওকে‚ নিজের পাপবোধ থেকে মুক্তির জন্য সে যা ইচ্ছা হয় তাই করবে! সেই কথাটা এখন মনের কোথাও ঝড় তুলতে চাইছে যেন। সেই মনেরই কোথাও একটা যেন এ কামনাও করছে‚ “অ্যাক্সিডেন্টটা ওই বদমাশ ছেলেটার না হোক… না হোক!”
ঠিক তখনই বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে অনি ঢুকল রিয়ার ঘরে৷ খুব তাড়াহুড়োর সঙ্গে সানাকে বলল‚ “আমি খুব সরি‚ সানা। আজকে আর সম্ভব হবে না পড়ানো৷ আমার ফ্রেন্ড অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ওর কাছে যেতে হবে এখনই। বৃষ্টি একটু কমলে তুমি বেরিয়ে পোড়ো।”
“কে অ্যাক্সিডেন্ট করছে‚ ভাইয়া? কোথায় করছে?” জিজ্ঞেস করল রিয়া।
“শায়াফ করেছে… স্টেডিয়াম রোডে।”
“কীহ্! মাত্রই তো সুস্থ হলেন উনি। আবার অ্যাক্সিডেন্ট”‚ আঁতকে উঠল রিয়া। “ কীভাবে করল? সিরিয়াস সিচুয়েশন না-কি?”
“বৃষ্টির মধ্যে বাইক চালাতে যেয়ে রাস্তায় স্লিপ কেটে পড়েছে নাকি! কপাল টপাল আর হাতে-পায়ে লেগেছে। দোকানদার ধরে নিয়ে দোকানে বসিয়ে রেখেছে। হাসপাতাল নিয়ে যেতে চেয়েছে তারা… যাচ্ছে না ও৷ গিয়ে দেখি কী কন্ডিশন”‚ বলে আর দাঁড়াল না অনি। বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল রিকশা করে।
ছাত্রগুলোও বৃষ্টিতে ভেজার জন্য বই অনির ক্লাসেই রেখে বেরিয়ে পড়ল। এদিকে‚ রিয়া ভীষণ আকুলতার সঙ্গে শারফানের জন্য প্রার্থনা করতে লাগল আর সানাকে বলতে থাকল‚ “কিছুদিন আগে ওনার কী অবস্থা হইছিল! মরেই যাচ্ছিল নাকি। ভাইয়া দেখে এসে আমাদের কাছে বলার সময় কান্নাও করে ফেলছিল৷ আজকে আবার অ্যাক্সিডেন্ট করল! ওনার এত বিপদ আল্লাহ কেন দেয়‚ বুঝি না।”
কথাগুলো শুনতে শুনতে উদ্বেগ থেকে আনমনেই নখ কামড়াতে থাকল সানা। আইসিইউতে শারফানকে দেখার পর যে ভয়টা অনুভব হয়েছিল সেদিন‚ এখনো ঠিক তেমন ভয়টাই হচ্ছে ওর। জীবন নিয়ে ছেলেটা ইচ্ছা করেই যেন খেলছে বারবার। তবে শুধুই কি ভয় হচ্ছে ওর শারফানকে নিয়ে? সেখানে মিশে আছে গভীর দুশ্চিন্তাও৷ যে দুশ্চিন্তা থেকে ওর মনে হচ্ছে‚ ছেলেটার অবস্থা কী—তা না জেনে যেতে পারবে না ও। এমনিতেও সে বের হতে পারবে না এ মুহূর্তে। বৃষ্টির তেজ ধীরে ধীরে শুধু বেড়েই চলেছে৷ এর মাঝে মোস্তফা সাহেব আসবেনইবা কী করে?
পাঁচটা বাজতে দশ মিনিট বাকি—সে সময়ই বৃষ্টিটা একটু কমে আসে৷ সানাও ভাবে‚ এবার বেরিয়ে পড়া জরুরি তার৷ শারফানের খবরটা আগামীকাল পরীক্ষা শেষ করে জেনে নেবে না হয় রিয়ার থেকে। বই আর খাতা ব্যাগে ভরে রিয়াকে সে ডাকল‚ “এই রিয়া‚ আমি এখনই বের হব রে।”
রিয়া রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করছিল৷ মা দুপুরের পর গেছেন তার ননদের বাসায়। দূরে নয় ননদের বাড়ি৷ ওদের বাড়ি থেকে মাত্র কটা বাড়ি পরেই৷ ফেরার কথা তো এখনই। বৃষ্টিতে আটকা পড়েছেন বোধ হয়। তাই কাজ কিছু এগিয়ে রাখছিল রিয়া। সানার ডাক শুনে আসার পথে মূল দরজায় চোখ আটকাল তার—শারফান ভিজেপুরে ঢুকল আচমকা। তবে একা নয় সে৷ অনি তাকে এক বাহুতে জড়িয়ে ধরে আছে।
বসার ঘরে এসে শারফান পৌঁছাতেই রিয়ার ঘর থেকে তখন বের হলো সানা। পা জোড়া থমকে পড়ল ওর সেখানেই৷ শারফান অবশ্য মাথা নিচু করা বিধায় দেখল না। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে অনির ঘরের দিকে যাচ্ছিল। নিচে তার জংলি ছাপার কমব্যাট প্যান্ট‚ ওপরে কালো টি-শার্ট‚ পায়ে বাদামী স্নিকার্স আর মাথায় একটা কালো ক্যাপ। সবই ভিজে একাকার। ক্যাপের জন্য নিচু করা মুখটা ঠিকঠাক দেখা না গেলেও বাঁ হাতের কনুইতে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেল সানা। ওকে শারফান দেখার আগেই দ্রুত রিয়ার ঘরে ঢুকে পড়ল আবার।
আর রিয়া অনির পিছু পিছুই গেল৷ তখনই অনি জিজ্ঞেস করল তাকে‚ “মা কি আসছে?”
“না। ফোন করলাম‚ ধরল না।”
“গিয়ে ডেকে আন তো। আমিও বের হব। উৎপল ডাক্তারকে ডেকে আনি। এসে একটু দেখুক ওকে আর ড্রেসিং করিয়ে দিক।”
“আরে ডাক্তার লাগবে না”‚ বিছানায় বসতে বসতে বলল শারফান‚ “ওরকম কিছু লাগেনি৷ তুই তুলো আর হেক্সিসল এনে দে৷ আমি নিজেই ড্রেসিং করে নিচ্ছি।”
“তুই চুপ থাক‚ বোকা**দা”‚ ধমক দিয়ে বলল অনি‚ “হাসপাতাল যেতে কি তোর চুলকায়?”
“আসলেই চুলকায়। তুই চাচিকে টেনশনে ফেলিস না। যা বললাম তাই কর। কপালের ফোলাটা কমলেই বাড়ি যাব। তার চেয়ে সাদ্দামকে জানা‚ আমাকে নিয়ে আসছিস। ও টেনশনে আছে। ভাবির বাড়ি থেকে আদর সোহাগ না খেয়েই দ্যাখ বেরিয়ে পড়ল নাকি!”
অনি চেঁচামেচি‚ রাগারাগি করে বলল‚ “তোর কোনোদিন শিক্ষা হবে না আসলে৷ তুই নিজের কথা না ভাব‚ তোর বাপ-মার কথাটাও কি ভাববি না? আমি বলব‚ তুই ইচ্ছে করে ওরকম ঝড়ের বেগে বাইক টানছিলি৷ যাতে গাড়ির নিচে পড়ে ডলা খেতে পারিস। তোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত হলো কঞ্চি দিয়ে চো**ন মারা উচিত।”
একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেল শারফান‚ অপ্রস্তুতও হলো রিয়ার উপস্থিতিতে৷ আঁড়চোখে রিয়াকে একবার দেখে নিয়ে চাপাস্বরে বলল‚ “ডায়ালগগুলো কি সিরিয়াস টোনে দিচ্ছিস?”
“সিরিয়াস লাগছে শুনতে?”
“হুঁ”‚ ছোট্ট করে বলে কটমট চোখে চাইল অনির দিকে।
অনি পাত্তাই দিল না সেই দৃষ্টি৷ বলল‚ “তাহলে সিরিয়াসই বলছি। ভালো হ… নয়ত মাথা ঠিক করতে পাবনায় পার্মানেন্টলি রেখে আসব।”
বলেই বেরিয়ে পড়ল সে চেম্বারে বসা উৎপল ডাক্তারকে আনতে। তবে বের হওয়ার আগে বেশ গুরুগম্ভীর মুখভঙ্গিতে রিয়াকেও পাঠিয়ে দিল ফুপু বাড়িতে। পাঠানোর পূর্বে বোনকে যখন জানাল‚ সে কল না করা অবধি যেন মাকে নিয়ে ফেরত না আসে৷ তখনই রিয়া বেঁকে বসে। কিছু একটা লুকোচুরি বা রহস্য টের পেয়ে যায় সে৷ কিন্তু ভাইয়ের ধমকের কাছে আর টিকতে পারেনি। সানার কথা ভুলে রেগেমেগে বেরিয়ে পড়ে।
সানাও যে বসে ছিল‚ তা নয়৷ অনি আর রিয়ার বেরিয়ে পড়ার আভাস টের পাওয়া মাত্রই সেও দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হলো‚ যেন শারফান ওকে দেখা মাত্রই আটকে ফেলবে—এই ভয়ে। বসার ঘর ছেড়ে মূল দরজার দিকে এগোনোর মুহূর্তেই হঠাৎ শুনতে পেল‚ কাতর স্বরে শারফান ডাকছে‚ “রিয়া আছ? একটু পানি দিয়ে যেতে পারবা?”
বলার পরই বেজায় কাশতে আরম্ভ করল‚ তারপর নাকটাও টানল—ঠান্ডাটা গতরাতেই লেগেছে তার৷ আজ বৃষ্টিতে ভেজায় সেটা আরও বেড়ে গেছে। কোনো উত্তর না পেয়ে আবারও ডাকল সে রিয়াকে‚ “এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও‚ রিয়া।”
রিয়াও যে ঘরে নেই‚ তা শারফান জানে না—বুঝতে পারল সানা। পুরনো সেই দ্বিধাদ্বন্দের অসুখটা ঠেলে উঠল ওর মাঝে আবারও৷ একবার সে ভাবছে‚ একটা মুহূর্তও আর দাঁড়ানো উচিত নয় এখানে। আরেকবার ভাবছে‚ মানবিকতার খাতিরে আহত ব্যক্তিটিকে অন্তত পানিটা দিয়ে আসা উচিত।
ওদিকে‚ থেমে গেল শারফান। আর ডাকল না৷ বুঝতে পারল‚ ঘরে কেউ-ই নেই হয়ত। ভেজা প্যান্ট আর টি শার্টটা খুলে অনির দেওয়া লুঙ্গি‚ টি শার্ট পরে নিল সে৷ বসে বসে এখন মাথাটা মুছতে লাগল৷ সেই সাথে চলতে থাকল অনবরত হাঁচি আর কাশি৷
বিরতিহীন কাশির আওয়াজটাই সানাকে যেতে দিল না৷ ডাইনিং থেকে পানির গ্লাসটা ভরে আরও একবার চিন্তাতে পড়ল সে—যাওয়া ঠিক হবে? না-কি হবে না? তখনই ঘরের মধ্যে ভারী কিছু পতনের আওয়াজ হলো৷ শারফানের কণ্ঠ থেকেও একটা বিরক্তিসূচক শব্দ বের হলো‚ “ধুরঃ বাল!”
পানির গ্লাসটা হাতে করে মন্থর পায়ে তখন এগোল সানা ঘরের দিকে৷ দরজার কাছে এসে পর্দাটা সাবধানে ফাঁক করে উঁকি দিল ভেতরে। বিছানায় পা দুটো তুলে‚ ডান পায়ের বৃদ্ধা আঙুল চেপে ধরে‚ চোখ বুঁজে আধশোয়া হয়ে বসে আছে শারফান। আর মেঝেতে পড়ে আছে কাঠের চেয়ারটা৷ কোনোভাবে ওটার সঙ্গে ব্যাটা গুঁতো খেয়েছে বোধ হয়—ভাবল সানা‚ ব্যথাও বোধ হয় পেয়েছে ভালোই৷ তাই আঙুলটা অমন করে চেপে ধরে রেখেছে৷
এর ভেতর আবার কাশি উঠল শারফানের। তা দেখেই দ্বিধা নিয়ে সানা আরেকটু সময় ব্যয় করে অবশেষে জানান দিল নিজের অস্তিত্ব।
“পানি এনেছি”‚ এতটুকুই বলল সে গম্ভীরভাবে।
শারফান চমকাল যেন। দরজার দিকে তাকাল। সানাকে দেখে স্বপ্নের আবেশ নিয়ে সে ড্যাবড্যাব চোখে দেখতে লাগল।
সানা একটু অধৈর্য হলো তখন। তাই বিরক্ত স্বরে আবারও জানাল‚ “পানি চাইছিলেন… এনেছি।”
তার মানে সানার উপস্থিতি সত্যি! বুঝতে পেরেই শারফান সোজা হয়ে বসল এবার। কিন্তু উঠল না বিছানা ছেড়ে৷ শুধু চাউনিটা বদলাল—তৃষিত চোখে দেখতে লাগল ওকে।
সেই অপলক চাউনিতে আবার বিরক্তি বাড়ল সানার। শারফান যে উঠে আসবে না‚ সেটা ওর খেয়াল হলো পায়ের অবস্থাটা খেয়াল করে। নিজেই তাই ভেতরে এসে গ্লাসটা রাখল বিছানার পাশের টেবিলটাতে। তারপর চুপচাপ বেরিয়ে আসতে গিয়েও দরজার মুখে দাঁড়াল হঠাৎ। ফিরে তাকিয়ে দেখল‚ শারফান চেয়ে আছে আগের মতো করেই৷ তা পাত্তা না দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল‚ “অ্যাক্সিডেন্টটা কি ইচ্ছাকৃত ছিল?”
একটু সময় নীরব থেকে শারফান জবাব দিল‚ “মনে হয়… জানি না।”
“এটা কেমন কথা? আপনি জানেন না তো কে জানে?”
“আমার কথাও তো এটাই ছিল গতরাতে”‚ মৃদুস্বরে বলল সে‚ “তোমার অনুভবগুলোকে তুমি ছাড়া আর কে জানে? তবুও জবাবটা দাওনি।”
“কালকের কথা আবার কেন তুলছেন?”
“তুলছি কারণ‚ পানিটা তুমি দিতে এসেছ।”
“রিয়া নেই বলেই আমি দিলাম। এখানে বেশি কিছু ভাবার আছে কি?”
“না দিলেও তো পারতে। যাকে তোমার জীবনের অভিশাপ মনে করো… অশান্তি ভাবো। সে পানির অভাবে মরে গেলেই বা কী তোমার?”
“আমি অমানুষ নই… অমানবিক নই”‚ কঠোর গলায় বলে উঠল সানা।
জবাবের পূর্বে শারফান কেশে উঠল আবারও৷ গ্লাসটা হাতে নিল তখন। চুমুক দিতে শুরু করলেই সানা বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। তা দেখে আর পানিটা খাওয়া হলো না শারফানের৷ ডেকে উঠল ওকে ব্যাকুল হয়ে‚ “আমার শেষ দুটো কথা শুনে যাও‚ সানা…”
চেঁচিয়েই ডাকল শারফান। তাই ফিরে আসতে বাধ্য হলো সানা। দরজার মুখে ওকে দেখা মাত্রই শারফান বলল‚ “যার প্রতি ঘৃণা থাকে‚ তার প্রতি মানবিকতা আসে না সব সময়। এটা বিশ্বাস করো তো?”
“কিছু সময় তো আসে।”
“হুঁ‚ কিন্তু সেই সময়গুলো এমন সাধারণ পরিস্থিতির জন্য নয়৷ আমি পানির জন্য না হয় অপেক্ষাই করতাম… কিংবা না-ই পেতাম পানি। তাতে মরে যেতাম না। মরে যাচ্ছিলাম আইসিইউতে৷ সেখানে তোমার মানবিকতা মানায়৷ তোমার দেখতে আসাকে মানবিকতাই স্বীকার করলাম৷ কিন্তু এখানে কি মানায়?”
সানা জবাব খুঁজে পেল না বিধায় দাঁড়িয়ে থাকার আগ্রহও আর পেল না। কিন্তু ওর যাওয়া পূর্বেই শারফান উঠে এসে দাঁড়াল ওর মুখোমুখি। চকিতেই দু পা তখন পিছিয়ে এল সানা। কঠিন কিছু বলার জন্য মুখটা খুলতে যাচ্ছিল‚ তখনই ওকে বলল শারফান‚ “আমার বদলে এখন যদি সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ হত‚ তবে কি এই মানবিকবোধটুকু আসত তোমার মাঝে? পানি দিতে ছুটে আসতে তার কাছে? এটা ভাবতে না‚ অপরিচিতের কাছে যাওয়াটাই উচিত নয়? বরং তাকে পানি দিতে আসাটা অস্বাভাবিক‚ তাই না?”
বিভ্রান্ত দেখাল যেন সানাকে। যখন ওর আরেক ভাবনায় এল‚ মানবিকতা থেকেই পানিটা দেবে সে‚ তখন তো এ কথাগুলো আসেইনি ওর মনে। বরঞ্চ শারফানের কষ্টটা বুঝে ও অবচেতনভাবেই তাগিদ অনুভব করেছে‚ তাকে পানি দেওয়ার জন্য। একবারের জন্যও মনে হয়নি শারফান ওর চেনা কেউ নয়… ওর আপন কেউ নয়৷ আর এও তো সত্যই‚ শারফানের বদলে এ মুহূর্তে অন্য কেউ হলে তার কষ্টটাকে গুরুত্বই দিত না সে… তাড়াও অনুভব করত না তাকে পানি দেওয়ার জন্য।
দুজন দুজনের চোখে চেয়ে যেন নীরব বাক্য আদান-প্রদান করছে। সেই নীরবতা ভেঙে শারফান এবার বলে উঠল‚ “কিন্তু ব্যক্তিটি ছিল শায়াফ। শায়াফ ছিল বলেই তোমার মানবিক সত্ত্বাটা আবারও জাগল আজ। কিন্তু এই মানবিকতা আসে কেন‚ সানা? কোন অনুভূতি থেকে আসে? ঘৃণা থেকে? না-কি দয়া থেকে? দয়া করছ তুমি আমাকে? আমি তো দয়া গ্রহণ করা মানুষ নই। আমার অপরাধের সাজা তুমি মওকুফ করে দিলে দয়া করে… আমাকে দেখতে এসেছিলে দয়া করে… পানি দিলে দয়া করে! আমি দয়া কেন নেব‚ সানা?” শেষ কথাগুলো বলতে বলতে শারফানের চোয়ালদুটো কঠিন হয়ে উঠল‚ কণ্ঠটাও কর্কশ হয়ে গেল।
“আমি কেন তোমার দয়া নিয়ে বাঁচব? আমার বাপ-মা আমার জান ভিক্ষা চেয়েছে তোমার কাছে? বলেছে‚ ‘দয়া করে আমাকে মাফ করে দাও?’ তাহলে কিসের জন্য আমাকে দয়া দেখাও তুমি?” ধমকেই উঠল শারফান শেষোক্তিতে।
আর এ পর্যায়ে এসে সানাও চটে গেল‚ “একদম চুপ! খবরদার ধমকাবেন না? কোনো দয়া করিনি আমি আপনাকে‚ বুঝেছেন? আমি আপনাকে ছেড়ে দিয়েছি আমার নিজের শান্তির জন্য—এ কথা কতবার করে‚ কীভাবে বললে বোঝাতে পারব আপনাকে?”
“মানলাম…” শান্ত হলো শারফান‚ “নিজের আত্মমুক্তির জন্য আমাকে শাস্তি থেকে মাফ করে দিয়েছ৷ তাহলে এই মানবিকতাও কি তোমার আত্মমুক্তির জন্য?”
এবারে সানা যেন দমল। শারফানের একটু আগে বলা কথাগুলোই ভাবতে শুরু করল আবার। কিন্তু শারফানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে অদ্ভুত এক জড়তা অনুভব করায় দায়সারা জবাবে বলতে চাইল‚ “আমি জানি না অত শত।”
শারফান যেন তা কেমন করে বুঝে যেতেই ও বলার আগেই বলল সে‚ “কিছুই জানো না—এ কথা বলবে না একদম। তুমি কোনো বাচ্চা না। সব পরিস্থিতি আর নিজের অনুভূতি বোঝার মতো অ্যাবিলিটি তুমি রাখো।”
“আমি আপনাকে জবাবদিহি করতে যাব কেন?” চেঁচিয়ে বলল সানা‚ “কোন সাহসে আমাকে চার্জ করেন আপনি?”
“আমি তোমাকে মোটেও চার্জ করছি না। না রেগে মাথাটা ঠান্ডা করে বুঝতে চেষ্টা করো! প্রশ্নগুলো করছি‚ কারণ তোমার দ্বিধাদ্বন্দের কেন্দ্রবিন্দুটা আমিই হচ্ছি সব সময়৷ এই যে চাইতেও‚ না চাইতেও আমার জন্য যে মানবিকতাটুকু খরচ করছ বারবার—তা শুধুই কি মানবিকতা‚ এটাই তোমাকে বুঝতে বলছি৷ এছাড়া আর কিছু না… আমি তোমাকে কখনোই বাধ্য করব না আমাকে জবাবদিহি করতে।”
কথাগুলো শুনতে শুনতে সানার চোখ পড়ল ভেজা চুলের ফাঁকে শারফানের কপালের কোণটাই। সেখানে ছিলে গিয়ে ফুলে উঠেছে কিছুটা। এখনো কোনো ওষুধ লাগানো হয়নি। মনে পড়ল‚ পায়েও তো আঘাত পেয়েছিল সে। তাই দৃষ্টি ঝুঁকিয়ে পায়ের দিকে তাকাল। কিন্তু লুঙ্গির জন্য তা তো আর দেখার উপায় নেই। আর কোনো কথা না বলে চলে এল ডাইনিং রুমে। সেখান থেকে নিজের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে গেলেই পেছন থেকে বলল শারফান‚ “বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার।”
তার দিকে একবার ফিরে চেয়ে মূল দরজার সামনে গিয়ে বাইরে উঁকি দিল সানা। সত্যিই আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে বৃষ্টিটা৷ তবুও কল করল বাবাকে। জানিয়ে দিল‚ বৃষ্টি কমার জন্য অপেক্ষা না করে রিকশা বা অটো করে যেন নিতে চলে আসেন।
পেছন থেকে তা শুনতে পেয়ে মেজাজটা খারাপ হলো শারফানের। গিয়ে ওর মাথার পেছনে একটা চাটি মারার ইচ্ছাটা গিলে নিল ধৈর্যের সঙ্গে। সানা ফিরল না সদর দরজার কাছ থেকে৷ তাই সে-ই এগিয়ে এসে দাঁড়াল ওর পাশে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল‚ “তোমার নিখোঁজ থাকার কথাটা কি জানে ওই ছেলেটা?”
ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল সানা‚ “কোন ছেলে?”
“যার সঙ্গে তোমার রিলেশন।”
“আমার আবার কার সঙ্গে রিলেশন?” রেগে গিয়ে বলল সানা।
শারফান অবশ্য ওর রাগের ধার ধারল না‚ “সে তো তোমার থেকেই শুনেছিলাম। নাম ভুলে গেছি ছেলেটার।”
“পান্থ?”
“হ্যাঁ… হ্যাঁ‚ পান্থ না শান্ত যেন। ওটাই।”
“আমার ওর সঙ্গে ব্রেকআপ হয়ে গেছে না?” ঝাঁজাল গলায় কথাটা বলতে চেয়েও শেষে কী ভেবে যেন থামল সানা। অধিকন্তু ধমকে উঠে বলল‚ “আমার পার্সোনাল ব্যাপারে প্রশ্ন করার আপনি কে? ও জানুক বা না জানুক‚ সেটা জিজ্ঞেসইবা করছেন কী কারণে‚ হুঁ?”
সানার ধমকানিতে বাকি মেজাজটুকু চটল না শারফানের। চটল ‘আপনি কে’ আর পান্থকে সানা ব্যক্তিগত বলায়। থমথমে মুখে ওর দিকে শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে কয়েক পল চুপ রইল সে। তারপর বলল ঠান্ডা সুরেই‚ “আই নো… আই অ্যাম নট ইনটাইটাল্ড টু আস্ক দিস কোয়েশ্চন। বাট কেন জিজ্ঞেস করছি‚ তার কারণ তুমি সত্যি জানতে চাও?”
“না… চাই না”‚ কাটকাট সুরে বলল সানা।
“কী চাওটা তাহলে‚ হ্যাঁ?” একটু যেন বিরক্তই ফুটল শারফানের কণ্ঠে‚ “আমার থেকে দূরে থাকতে চাও… আবার নিজেই এসে তোমার ভাষার মানবিকতা মারাও।”
“কী বললেন?” চেঁচিয়ে উঠল সানা ‘মারাও’ শব্দটা শোনা মাত্রই।
সেটা ধরতে পেরেই শারফান অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তবে এটাও বুঝতে পারল‚ ধৈর্যশীল প্রেমিক তো দূর… ধৈর্যশীল ছেলেটাই সে কখনো হতে পারবে না বোধ হয়। তাই এই ধৈর্যের মুখোশ খুলে ছুড়ে ফেলে আচমকা সেও চেঁচিয়ে উঠল‚ “তোমার মুখে ওই মানবিকতা শব্দটা শুনলে আমার নিজেকে অভাগা চাষাভুষা লাগে। যেন চাষবাসের জমিজমা হারিয়ে আমি ভাত না পেয়ে মরছি। কাইন্ডলি ওই শব্দটাকে কারেকশন করো‚ ডিয়ার৷ ওই যে আমার মরার কথা শুনে ছুটে এসেছিলে‚ আজ পানি দিতেও ছুটে এলে—এটা তোমার আত্মার টান এই বেচারা চাষার প্রতি৷ আর এই টান তোমার মানবিকতা ডট কম থেকে আসছে না‚ আপা। আসছে তোমার ভালোবাসার ডিপার্টমেন্ট থেকে। ক্লিয়ার?”
চলবে।
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৫৩. (দ্বিতীয় অংশ)
রাগের মাথায় হড়বড়িয়ে কথাগুলো বলতে বলতে শারফান যে আপা বলে বসল সানাকে‚ তা সে একবারও টের পেল না।
আর ওর স্বরূপে ফিরে আসায় সানার গোল গোল চোখদুটোই এবার সত্যি সত্যি রাগের স্ফুরণ ঘটল যেন। এতদিন ধরে তবে মেনি বিড়াল সেজে ছিল বেয়াদবটা! শয়তানের কিছুই বদলায়নি! আবার তার ওপর চেঁচামেচিও করে—কত বড়ো স্পর্ধা! পুরনো সেই ভেঙে পড়া‚ ভিতু মেয়েটা ভাবছে ওকে এখনো? মাফ করে দিয়েছে বলে তার মাথায় চড়বে না-কি? কী করবে… কী বলবে শারফানকে‚ রাগের মাথায় ঠিকঠাক বুঝতে না পেরে মুঠো পাকিয়ে আচমকা জোর এক ঘুসি মেরে দিল ওর নাকে।
মুহূর্তেই “আহ্” করে উঠে নাকের ডগা চেপে ধরল শারফান৷ ব্যথাটা মোটামুটি লাগলেও সানার আকস্মিক আক্রমণে সে চমকে উঠল প্রচণ্ড। তাই ব্যথা অনুভবের চেয়েও হতবাকই হলো বেশি। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই ক্ষিপ্ত সানা আবারও আক্রমণাত্মক হলো—হাতের ব্যাগটা দিয়ে দুম করে বাড়ি মেরে বসল ওর চোট পাওয়া কপালে। যদিও সে মুখেই মেরেছে আবারও। কিন্তু লেগেছে কপালে। মারার পরই আঙুল তুলে কঠিন স্বরে হুমকি দিল‚ “ফারদার আমার ওপর চোটপাট দেখালে কলম দিয়েই চোখদুটো একদম খুঁচিয়ে বের করে আনব! নেড়ি কুত্তার গু একটা!”
তারপর করল সে আরেক হঠকারী কাণ্ড৷ বৃষ্টির মধ্যেই নেমে পড়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল অনির বাসা থেকে।
জড়ীভূত শারফান শুধু প্রতিক্রিয়া জানাতেই ভুলল না‚ সানাকে ঠেকানোর কথাও ওর মাথাতে এল না তখন—এতখানিই বিস্মিত সে! যখন চোখের আড়াল হলো সানা‚ তখন যেন পৃথিবী গ্রহে ফিরল ওর আত্মাটা৷ কিন্তু ততক্ষণে সানা নাগালের বাইরে চলে গেছে৷ কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে নাকের ডগাটা সে ছুঁয়ে দেখল আবারও।
“সত্যিই হিট করল”‚ বিস্ময় কণ্ঠেই বিড়বিড়িয়ে উঠল‚ “এত বড়ো শরীর আমার… একটু ভয়ও পেল না আমাকে! গালি দিল কী? নেড়ি কুত্তার গু! মানে নেড়ি কুত্তাও না… তার চেয়েও জঘন্য আমি! কী সাহস! শালার সত্যিই একখান খানেদজ্জাল!”
এরপরই ছাতা মাথায় করে গেটের ভেতর ঢুকল অনির অন্য ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীগুলো। তাদের দেখে ও সদর দরজার কাছ থেকে সরে এল‚ বসল সোফাতে। বসে বসে ভাবতে লাগল সানার সাহসের কথা। তার মারের মুহূর্তটা কোনোভাবেই ভুলতে পারছে না৷ ভাবতে ভাবতে স্বগতোকথন করল‚ “আমার চেয়েও কি বেশি রাগ ওর? বিয়ে হলে টিকবে তো আমাদের ঘর?”
এবার সে বিয়ের আগেই সংসার বাঁচানোর চিন্তাতে মশগুল হলো। তারপর বলে উঠল‚ “আমিই না হয় রাগ কমার থেরাপি নেব। রায়হান ভাইকে দেখি দরকার হবে আবার!”
ওর সুদূরপ্রসারী ভাবনা-চিন্তার ইতি ঘটাল অনি৷ ভেজা ছাতাটা ঘরের এক কোণে রেখে তড়িঘড়ি করে এসে দাঁড়াল ওর সামনে৷ জিজ্ঞেস করল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত‚ ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে‚ “এ হারামজাদা‚ কী করেছিস সানাকে? ও বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়ল কেন‚ হ্যাঁ?”
বন্ধুর দিকে বিরক্তিপূর্ণ চাউনি ছুড়ল শারফান৷ তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল‚ “আমার করার দিন তো শেষ। করা শুরু করেছে আমার ছানার সন্দেশ।”
হেঁয়ালি করা দেখে অনি রেগে উঠল। ধমক দেওয়ার আগেই তার কাছে কপালটা এগিয়ে এনে জিজ্ঞেস করল শারফান‚ “দ্যাখ তো ফুলেছে না-কি আরও?”
কপালের কোণটা ভালো করে দেখল অনি‚ “হুঁ‚ ফোলা বেশি লাগছে। বরফ এনে দিচ্ছি‚ বস।”
“নেব না। যে মেরেছে‚ সে বরফ লাগালে নিতাম।”
ভ্রু কুঁচকাল অনি‚ “সানা মেরেছে বলতে চাচ্ছিস?”
“কেন? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না?” গম্ভীরমুখে বলল শারফান‚ “নাকটা শক্ত আমার‚ নয়তো ওর ঘুসি নরম। তাই এটাকে আর আলু বানাতে পারেনি।”
“বলিস কী?” অবাক হলো অনি খুব‚ “ও মেরেছে তোকে! কীভাবে?”
সানা অমন দুঃসাহসিক কাজ করে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়ায় বদমেজাজির মেজাজটা এমনিতেই তেতো হয়ে আছে। মনও আর টিকছে না এখানে। তার মধ্যে অনির ‘কীভাবে’ শুনে মেজাজ আরও খিঁচড়ে গেল ওর৷ ওদের কথাবার্তার মাঝেই এক ছাত্র ঢুকছিল ক্লাসে৷ তাকে ডেকে উঠল শারফান‚ “ওই‚ এদিকে আয় তো।”
ছেলেটা কাছে আসতেই তার ব্যাগটা হঠাৎ নিয়ে নিল সে। আদেশ গলায় বলল তাকে‚ “ক্লাসে গিয়ে বস। ব্যাগ নিয়ে যাবে তোর ভাই।”
ছেলেটা প্রশ্ন চোখে চাইলেও কোনো প্রশ্ন করল না। চলে গেল ক্লাসে। আর অনি বোকা চোখে দেখল শারফানের কাজ৷ “ওর ব্যাগ দিয়ে তুই কী করবি?” কথাটা সে জিজ্ঞেস করতেই যাচ্ছিল‚ ধুপ করে তখনই তার মুখের মধ্যে ব্যাগটা দিয়ে বাড়ি মেরে বসল শারফান।
ব্যাগে বই থাকায় ভালোই ব্যথা পেল অনি৷ “উহঃ” করেই রেগেমেগে খিস্তি দিয়ে উঠল শারফানকে। হাতে-পায়ে ইতোমধ্যে ওর আঘাত থাকার ফলেই কেবল হাতটা চালাল না অনি। কিন্তু গালাগাল করা ছাড়ল না‚ ধমকে উঠল‚ “শালা বান**দ মদ ছাড়াই টাল হয়ে আছিস?”
“কীভাবে মারল সানা জিজ্ঞেস করলি—প্র্যাক্টিক্যাল দেখিয়ে দিলাম”‚ নির্বিকার গলায় বলে ব্যাগটা সোফায় ছুড়ে ফেলে সে বলল আবার‚ “তাও তো ওর ঘুসিটা দেখালাম না৷”
বন্ধুর মস্তিষ্কের ফাংশন নিশ্চয়ই উলটে-পালটে গেছে—এটাই বিশ্বাস করল অনি৷ এ ভাবনাতেই সে নরম হলো একটু৷ ডান ভ্রুটা ডলতে ডলতে জিজ্ঞেস করল‚ “ঘুসিও দিল তোকে? কোথায় দিল?”
“নাকে। সেরকম কিছু হয়নি। একটু ব্যথা পেয়েছি।”
“আর তুই মারলে কি আমি একটু পেতাম? আমার নাকের বলটু ছুটে দৌড় মারত।”
কোনো কথা বলল না শারফান। ওকে মনমরার মতো দেখে অনি বুঝতে পারল‚ সানার প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই মনেও আঘাত করেছে বন্ধুর। তাই সান্ত্বনা দিতে বলল‚ “বাদ দে তো ওর কথা। ওর থেকেও আরও কত বেটার বেস্ট সানা পাবি তুই! বললেই তোর বাপ এখনই ধরে এনে তোর গলায় ঝুলিয়ে দেবে৷ চাস তো আমিই কথা বলি কাকার সাথে? বিয়ে করলে সব ঠিক হয়ে যাবে তোর। দেখিস বাসর রাতেই ভুলে গেছিস সানাকে।”
শারফান চমকে তাকাল। চোখদুটোই ওর ঝিলিক দিল যেন‚ “ভালো বুদ্ধি দিলি তো! আব্বার বাড়ি চলে আসার কথা এতক্ষণে। গিয়েই কথা বলতে হবে।”
“সত্যি রাজি তুই!” অবিশ্বাস্য লাগলেও খুশি হলো অনি। ভাগ্যিস দেবদাসের আধুনিক সংস্করণ হবে না তার বন্ধুটা। সে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল‚ “একটু নরম সরম কিন্তু বুঝদার মেয়ে খুঁজতে বলিস কাকাকে। যাতে তোর মেজাজ বুঝে চলতে পারে‚ আবার তোর ভালোবাসা পেয়ে যেন তাড়াতাড়ি গলেও যেতে পারে।”
“বোকা**দা‚ আমি ওকে ছাড়া আর কাকে বিয়ে করব?” ধমকে বলল শারফান‚ “তোর ছাত্রীর কথাই বলব হক সাহেবকে।”
একটু হতবুদ্ধি দেখাল অনিকে৷ উত্তরে কিছু বলতে যাবে‚ এর আগেই ক্লাস থেকে ছাত্রদের ডাক এল। তাই ক্লাসে চলে গেল সে৷ আর শারফান গেল ওর ঘরে৷ লুঙ্গি ছেড়ে অনির একটা প্যান্ট পরে নিল৷ কারণ‚ বেরিয়ে পড়বে সে এখনই।
এর মাঝেই রিয়া ফিরল মাকে নিয়ে। তিনি এসেই শারফানের খোঁজ নিলেন… ওর কপালের আঘাত আর হাতের আঘাত দেখে জলদি গেলেন ওষুধপত্র আনতে। শারফানের বারণ শুনলেন না কোনোক্রমেই। বাধ্য হয়ে বসে বসে তার আর রিয়ার কাছ থেকে সেবা নিতে হলো কিছুক্ষণ। তবে রিয়াকে দেখে একটা কথা মাথায় এল ওর। সানার সঙ্গে পান্থর যোগাযোগটা সত্যিই হয় কি-না—তা নিশ্চয়ই রিয়া জানবে? তাই আরও কিছুক্ষণ পর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে।
পড়ানোর ফাঁকে অনি বেরিয়ে এসে দেখল‚ শারফান ওর ঘর ছেড়ে‚ বসার ঘর ছেড়ে বসে আছে তার ফাঁকা আরেকটি ক্লাসে৷ জিজ্ঞেস করল ওকে‚ “ঘরে গিয়ে রেস্ট কর। এখানে বসে কী করিস?”
জবাবে শারফান কথা পাড়ল সরাসরি‚ “সানা একটা ছেলের সঙ্গে রিলেশনে ছিল‚ কিংবা এখনো আছে৷ ছেলের তথ্যও চাই‚ সঠিক খবরটাও চাই আমার। সেটা তোর বোন দিতে পারবে। তুই গিয়ে আমার কথা বলে এখনই জিজ্ঞেস করবি।”
“তা আজকেই কেন জানতে হবে? কাল জানলে কি বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে?” মেজাজ খারাপ হলো অনির। ছাত্র পড়ানো রেখে পাগল ছাগল বন্ধুর বালখিল্যতার সঙ্গ দিতে হচ্ছে তাকে।
“আমি আজই জানব‚ তারপর এখান থেকে নড়ব”‚ একদম বাচ্চামো জেদটাই দেখাল শারফান।
কতক্ষণ ওর দিকে গরম চোখে তাকিয়ে থেকে তারপর হঠাৎ দাঁত খিঁচিয়ে বলল অনি‚ “তোকে প্রেমে পড়তে বলেছিল কোন সুমুন্দির পোলা? প্রেমের বাল বুঝতি না‚ সে-ই তো ভালো ছিল৷ আমার জান জীবন ঝালাপালা করে দিচ্ছিস একদিনেই। সাদ্দামের ফোন পেয়ে আমি কীভাবে ছুটেছিলাম‚ জানিস? কী ভয়টা পাইয়ে দিয়েছিলি তোরা! কোনো মানুষের বাচ্চা এরকম ফাইজলামি করে? ওকে সামনে পেলে আমি তো আরও চারটা থাবড়া দেব। তোকে তো দিতে পারছি না‚ তাই তোর দুইটাও ওকেই দেব।”
শারফানের অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনাটা ছিল সম্পূর্ণই মিথ্যা। এবং এর বুদ্ধিদাতা ছিল সাদ্দাম৷ কিন্তু সেই বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে গিয়ে শারফান মিছেমিছি আঘাতের দাগ সাজানোর বদলে সত্যিই আঘাত করে নিয়েছিল কপালে আর হাতে। সানা যে অনির কাছে পড়তে এসেছে—এ খোঁজ জেনে সে সময়েই কাজটা করেছিল সে৷ কেবল অনিকেই আগাম কিছু জানায়নি ওরা দুজন। কেননা‚ যতই বন্ধু হোক সে শারফানের৷ তার আরও একটি সম্মানজনক পরিচয় আছে—সে সানার শিক্ষক। এই নীতিবোধ থেকেই সে যে শারফানের পাগলামিতে সায় দেবে না‚ তা জানত শারফান৷ সে তো কেবল তার প্রতি সানার ঘুমন্ত অনুভূতিকে জাগ্রত করার পরিকল্পনায় দিশাহারা। কিসের মধ্যে কী করছে… সে হুঁশটাও ওর নেই। বন্ধুর দিকটা অত শত ভেবে দেখার‚ বা বিবেচনা করার প্রয়োজনবোধও করেনি। এবং এখনো সে করছে না।
শারফানের জেদ দেখে অনি কঠিন বিরক্তিটা গিলে নিয়ে গেল রিয়ার কাছে৷ সানার প্রেমিকের ব্যাপারে প্রশ্ন করতে গিয়ে উত্তর পেল ঠিকই। কিন্তু বোনেরও দ্বিগুণ প্রশ্নের মুখোমুখিও হলো সে৷ শেষে রাগের মাথায় বলেই দিল তাকে‚ “শারফান বউ করবে তোর বান্ধবীকে!”
বলার পর রিয়ার প্রতিক্রিয়াটুকুও দেখার অপেক্ষায় রইল না সে৷ পান্থর ফেসবুক আইডিটা চিনে নিয়েই ফিরে এল শারফানের কাছে৷ তাকে দেখে তখন মুচকি একটা হাসি ফোটাল শারফান‚ আর বন্ধুকে দিল সেলুট। শ্যাম মুখে টোল পড়া ওর মুচকি হাসিটা যে ভীষণ সরল আর সুন্দর—এ কথা ওর শত্রুরাও স্বীকার করতে বাধ্য। অনির রাগটা অবশ্য ওর হাসিতে মুগ্ধ হয়ে পড়ল না। পড়ল ওই মুচকি হাসির মাঝে বন্ধুর পাগল প্রেমী হওয়ার লক্ষণ দেখতে পেয়ে—যে লক্ষণগুলো দেখা যায় তরুণ বয়সের শুরুতে প্রথম প্রেমে পড়ার সময়ে। চেয়ারটা টেনে নিয়ে ওর মুখোমুখি বসল সে। তারপর বলল‚ “তুই পিছু লাগবি ওই মেজর পাত্রের। সেটাকে কী করে আউট করবি এই চিন্তা না করে পড়ে আছিস এই হাবিজাবিকে নিয়ে!”
হাসল শারফান আবারও‚ “ওটা তো ফিল্ডেরই বাইরে। খেলবে আর কী? তার সেট আপ ইয়াজ করে ফেলবে আজ-কালের মধ্যে। ঘটক শালার ঘটকালির ব্যবস্থা করাও শেষ। এবার এই হাবিজাবিও পরিষ্কার করতে হবে। মাঠে রাঘববোয়াল থেকে চুনোপুঁটি‚ কোনো প্রতিযোগীই চাই না আমি। অত সময় নেই খেলাধুলা করার।”
“আচ্ছা… শয়তানি শুরু হয়ে গেছে? ইয়াজ লোকটা নাকি দেশের বাইরে আছে ট্রেনিঙে। তাকেও শান্তি দিচ্ছিস না! তুই ভাব তো‚ তুই একা একটা বেয়াদব দুনিয়ার কোণায় কোণায় থাকা সবাইকেই জ্বালিয়ে খাচ্ছিস কীভাবে?”
“বেয়াদবের বন্ধু হয়েছিলি কী জন্য?” বলে একটা সিগারেট ধরাল শারফান।
কথা আর বাড়াল না অনি৷ কারণ‚ বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই জানে৷ “পান্থ ফয়সাল ছেলেটার নাম”‚ রিমলেস চশমাটার গ্লাস টিস্যুতে পরিষ্কার করতে করতে জানাল ওকে‚ “হাইস্কুলে থাকতে আমাদের থ্রি ইয়ারস জুনিয়র ছিল। তুইও চিনবি ওকে। তোর এক্সের কেমন ভাই হত যেন। ছুটির পর এসে প্রতিদিন ফুটবল খেলতে চাইত আমাদের সাথে। নিতাম না বলে তোয়া এসে একবার কত রিকুয়েস্ট করেছিল তোকে! সেদিন দিয়েছিলি এক ঝাড়ি মেরে৷ মনে আছে?” বলেই হেসে ফেলল অনি।
“আছে”‚ তোয়ার ভাই শুনে মনটাই তিক্ত হয়ে উঠল ওর। সিগারেটে এক টান দিয়ে বলল‚ “ছবি দেখা তো। ফেইসটা মনে নাই৷ করছে কী ছেলে?”
“আপাতত কিছুই না। ডেফোডিল থেকে বিএসসি কমপ্লিট করে বসেই আছে৷ কানাডা ঢোকার লাইন করছে এমএসসি’র জন্য… এইতো”‚ কথার ফাঁকে ফোনটা এগিয়ে ধরল সে শারফানের কাছে‚ “এই যে‚ প্রোফাইল দ্যাখ।”
ঘন দাড়ির চিবুকটা চুলকাতে চুলকাতে শারফান পান্থকে দেখল খুঁটে খুঁটে—পালসারের ওপর ফরসা বর্ণের সুদর্শন পান্থ বসে আছে। হাতে ডিএসএলআর ক্যামেরা‚ পরিপাটি রাখা চুল‚ ক্লিন শেইভ‚ টকটকে গোলাপি ঠোঁট আর বাদামী চোখে চঞ্চলতা। হাসছে মুচকি মুচকি আকাশে মুখ তুলে। ছবির পটভূমি কোনো এক পার্ক।
দেখা শেষে হঠাৎ ঠোঁট বাঁকিয়ে মৃদু হাসল শারফান‚ “এ তো দেখি চকলেট বয়! জীবনে সিগারেট টানেনি মনে হচ্ছে৷ আর ছবিতে এ কী ফিল্টার মেরেছে রে?” হাসতে লাগল খুব‚ “আমার না হওয়া শালা… মেয়েদের মতো ঠোঁট পিংকি পিংকি করে রেখেছে‚ দ্যাখ!”
“এমন চকলেট বয়দেরই কিন্তু মেয়েরা চায়‚ বাডি।”
“বয়ফ্রেন্ড হিসেবে বেটার আছে। কিন্তু হাজবেন্ড হলেই চৌকিদার হয়ে রাত জেগে তার ফোন পাহাড়া দিতে হবে। আর দিনের বেলা গোয়েন্দা হয়ে সাথে সাথে চিপকে থাকতে হবে।”
“হুঁ‚ ক্যারেক্টার অত ফ্রেশ না‚ রিয়া বলল।”
“আরে বুদ্ধিমতী মেয়েরা বোঝে এসব চকলেট বয়দের সাথে প্রেম পর্যন্তই যায়। ওরা জানে এদের মন অনেক বড়ো। তাই কাউকেই ফেরায় না। সব ললনাকেই ঠাঁই দেয় মনে।”
চশমার ফাঁক দিয়ে সরু চোখ করে তাকাল অনি‚ “সানা কিন্তু সেরকমও বুদ্ধিমতী না।”
সামনের রুমে তার ছাত্র-ছাত্রী বসা। তাদের দিকে একবার লক্ষ করল শারফান। না‚ কারও মনোযোগ এদিকে নেই৷ তাই পা দুটো সামনের বেঞ্চে টানটান করে দিল৷ মাথার পেছনে হাত দিয়ে আরাম করে বসে হাসতে হাসতে বলল‚ “মাই কমপেটিটর ইজ নট অ্যাট মাই লেভেল। সে আমার পর্যায়ে আসতে পারবে কেবল স্বপ্নে। সানাকে তার থেকে তাই ছিনিয়ে নেওয়ার কোনো প্রয়োজনই পড়ছে না।”
“তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে”‚ তিরস্কার করে বলল অনি‚ “তুই সামনে যেয়ে দাঁড়ালেই সানা তোর কোলে লাফ দিয়ে উঠবে যেন!”
“কোলে লাফ দিয়ে না উঠলেও বুকে ঝাঁপ দিয়ে পড়বে”‚ এক চোখ মেরে শয়তানি হাসি দিল শারফান‚ “সেভাবেই খেলব।”
“পান্থর সঙ্গে খেলাখেলির কিছু নেই। ওর সঙ্গে সানা ব্রেকআপ করেছে আরও ক’মাস আগেই৷ কোনো যোগাযোগ নেই ওদের মধ্যে।”
বেশ নিশ্চিন্ত হতে দেখা গেল শারফানকে৷ এরপর আর বসল না বেশিক্ষণ। ফুরফুরে মেজাজে সিগারেটটা টানতে টানতেই বেরিয়ে পড়ল বন্ধুর বাসা থেকে৷ বাড়ির উদ্দেশ্যেই রওনা হলো। কারণ‚ এবার যে শাফিউর হকের মাথা খেতে হবে। তবে একটু চিন্তিতও দেখাল ওকে৷ সে যে প্রেমে পড়েছে—এ কথা বাপকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জানানোর পর বাপের চোখে চোখ রাখতেই তো কতদিন সময় লাগল! সেখানে বিয়ের কথা বলবে কী করে? বাপের সামনে হুটহাট বেফাঁস কথা বলা আর নির্লজ্জের মতো নিজের বিয়ের কথা নিজেই বলার মাঝে একটা পার্থক্য আছে না? এত বেশি নির্লজ্জ কি হতে পারবে সে?
***
২২ জুন
বিকাল ৫: ০৭
কী এক বিরক্তিকর ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে কটা দিন যাবৎ! সারাটা দিন ধরেই বৃষ্টির ফোঁটা কখনো টিপ টিপ করে নামে‚ তো কখনো ঢল নামে। কোনো থামাথামি নেই। মেঘের ঘনঘটায় দিনের বেলাতেই আঁধার হয়ে যায় প্রকৃতি… ঝড়‚ বাতাসের তাণ্ডব লেগে যায় চারদিকে। তখন বিদ্যুৎটাও থাকে না। সেজন্য পরীক্ষার হলগুলোতে সবাইকে মোমবাতি জ্বালিয়ে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই৷ এতদিন এ গল্প শুনলেও আজকের শেষ পরীক্ষাতে সানাদেরও তাই করতে হলো।
সানার পরীক্ষার কেন্দ্র ফরিদপুর ইয়াসিন কলেজ৷ পরীক্ষা শেষে দোতলা থেকে নিচে নেমে ক্লাসের বারান্দায় এসে দাঁড়াল সানা৷ আশেপাশে তাকিয়ে রিয়াকে আর দিনাকে খুঁজতে লাগল৷ ওদের দুজনের সিট পড়েছে একই রুমে‚ আর ওর সিট পড়েছে ভিন্ন রুমে৷ এজন্য খুব একটা দেখা হয় না ওদের সঙ্গে৷ কারণ‚ মোস্তফা সাহেব আগেই এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাই পরীক্ষা শেষ করেই সে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু আজ জরুরি এক কাজ পড়ে যাওয়ায় তিনি আসতে পারবেন না৷ তাই বলেছেন একা একা না এসে দিনা অথবা রিয়া‚ ওদের কারও সঙ্গে করে যেন অটোতে উঠে পড়ে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর রিয়ার দেখা পেল সে অবশেষে। হাত উঁচু করে তাকে ডাকল‚ “রিয়া‚ আমি এদিকে।”
তাকাল বটে রিয়া। কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড‚ সে মোটেও দাঁড়াল না। অধিকন্তু মুখটা কেমন ভার ভার লাগল তার৷ অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে পড়ল৷ সেসব দেখে ভারি অবাক হলো সানা। বুঝতে পারল‚ কোনো কারণে সে রেগে ওর ওপর৷ কিন্তু রাগার মতো করলটা কী? সপ্তাহখানিক তো কোনো কথাই হয়দি ওদের মাঝে… অনির কাছেও আর পড়তে যায়নি ও!
রিয়ার আচরণে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল সানার৷ বিষণ্ণ মনেই দিনার খোঁজ শুরু করল এবার। কিন্তু জানতে পারল‚ শেষ ঘণ্টা পড়ার দশ মিনিট আগেই পরীক্ষা শেষ করে চলে গেছে দিনা৷ বোধ হয় তার বর নিতে এসেছিল৷ ছুটিতে বাড়ি ফিরেছে দিনার বর। এতদিন বাবার বাড়ি থেকেই পরীক্ষা দিচ্ছিল সে। গত পরশু আবার ফিরে গেছে শ্বশুর বাড়িতে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে আর কী হবে? বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা মাথায় করে বেরিয়ে পড়ল সানা। রাস্তায় আসার পর দেখল‚ সমস্ত অটোই ভাড়া হয়ে গেছে। কোনোটাতেই সিট খালি নেই৷ এইটুকু সময় দেরি না করলে বোধ হয় ফাঁকা অটো পেতে পারত। রিকশার অবস্থাও তাই—খালি রিকশা চোখে পড়ল না। মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর হতাশ হয়ে সিদ্ধান্ত নিল‚ কিছুদূর হেঁটেই যাবে ও৷ সামনে থেকে নিশ্চয়ই ফাঁকা অটো‚ রিকশা মিলবে।
রাস্তার বাঁ দিক ধরে হাঁটতে হাঁটতে সামনে দাঁড় করা বিএমডব্লিউর একটা কালো সেডান দেখতে পেল সানা৷ সেই গাড়িটা থেকে ভেসে আসতে লাগল—
“তোমায় ঘিরে এতগুলো রাত অধীর হয়ে জেগে থাকা
তোমায় ঘিরে আমার ভালো লাগা
আকাশ ভরা তারার আলোয় তোমায় দেখে দেখে
ভালবাসার পাখি মেলে মন ভোলানো পাখা।
ভাবনা আমার শিমুল ডালে লালচে আগুন জ্বালে
মহুয়ার বনে মাতাল হাওয়া খেলে
এক মুঠো রোদ আকাশ ভরা তারা
ভিজে মাটিতে জলের নকশা করা
মনকে শুধু পাগল করে ফেলে।”
চকিতেই পাদু’টো থামল সানার—কয়েকটা মুহূর্তের জন্যই কেবল৷ গানটা ওর ভীষণ প্রিয়। তবে থেমে পড়ার কারণটা এটা নয়। গানটা শুনেই ওর মনের মধ্যে এক ডঙ্কা বাজল! মনে হলো যেন‚ এই গান বাজানো ব্যক্তিটি শারফান ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না! ধুকপুকানি শুরু হলো ওর বুকের মধ্যে। গত সতেরো তারিখের পরীক্ষা শেষে এই গাড়িটাই দেখেছিল সে যেতে পথে। সেদিন অত খেয়াল করেনি বলেই হয়ত আজকের মতো ওর উপস্থিতির অনুভবটা হয়নি।
দ্রুত পায়ে হেঁটে গাড়িটা পেরিয়ে যেতে চাইল সানা। কিন্তু কার থেকে আর পালাবে? যার থেকে পালাতে চাইছিল তাকে দেখা গেল ছাতা মাথায় করে মুখে মিটিমিটি হাসি নিয়ে সামনে থেকেই হেঁটে আসছে৷ বৃষ্টির জন্য মাথায় তার কালো স্পোর্টস ক্যাপ‚ পরনে লিনেনের হালকা সবুজ রঙা হাফ হাতা শার্ট‚ শার্টের বোতামগুলো খুলে রাখা‚ ভেতরে সাদা একটা টি শার্ট‚ নিচে কালো রঙের স্লিম ফিট ট্রাউজার আর পায়ে লোফার। তাকে দেখে সানা চমকালেও হাঁটা থামাল না৷ কাছাকাছি আসার পর শারফানকে সে পাশ কেটে যেতে চাইল‚ তখনই শুনতে পেল‚ “হেঁটে কেন? বাপ কই?”
উত্তর তো দিলই না সানা। হাঁটার গতি আরও বাড়াল সে‚ সেই সাথে ইলশেগুঁড়িও ভারী বৃষ্টিতে পরিণত হলো৷ তা দেখে শারফান দাঁড়িয়ে পড়েই গলা উঁচিয়ে ওকে পেছন থেকে বলল‚ “এই রাস্তায় এখন কোনো রিকশা‚ ভ্যান‚ অটো‚ কিছুই পাবে না।”
শুনলেও সানা দাঁড়াল না। তা দেখে শারফান এগোল ওর দিকে৷ পাঁচটা বাজার আগেই সেও এসে দাঁড়িয়েছিল সানার বের হওয়ার অপেক্ষায়। গাড়িতে না বসে রাস্তার পাশের কোনো একটা দোকানের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে‚ বিধায় সানা দেখতে পায়নি তাকে গতদিন। আজও একই দোকানেই দাঁড়িয়ে ছিল৷ হঠাৎ সানাকে হেঁটে আসতে দেখেই এগিয়ে আসলো সে৷
বৃষ্টি ভেজা পিচের ওপর জুতোর চপচপ আওয়াজটা সানা শুনতে পাচ্ছিল পেছন থেকে৷ নীরব থাকলেও শারফানের উপস্থিতি সে ভালোই বোঝে এখন। দুটো মিনিট দুজনই নিশ্চুপভাবে হাঁটল। এরপরই শারফান বলে উঠল‚ “ভিজে যাচ্ছ একদম। কিছুক্ষণ দেরি করো কোথাও দাঁড়িয়ে।”
বৃষ্টির ঝাপটায় অর্ধেকটাই ভিজে গেছে সানা। জামার নিচের অংশ ভিজে জবজবে অবস্থা। তবুও সে থামতে চাইল না। তবে শারফান যদি না থাকত‚ সে দাঁড়াত কোনো দোকানের নিচে।
এদিকে‚ ওর অকারণ জেদ দেখে শারফান খোঁচা মেরে বলল‚ “তোমাকে প্রেম করার জন্য কেউ কিডন্যাপ করছে না৷ তাই তাকে আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই… এভাবে পালানোরও কোনো দরকার নেই।”
খোঁচাটা কাজে দিল। চট করেই দাঁড়িয়ে গেল সানা৷ তাই থেমে গেল শারফানও। শান্ত মুখভঙ্গি‚ অথচ চোখের চাউনিতে খ্যাপা ভাব নিয়ে তাকাল সানা তার দিকে‚ “কাকে ভয় পাচ্ছি?”
“পাচ্ছ না?”
“আমি জিজ্ঞেস করেছি কাকে ভয় পাচ্ছি?”
“সে তো তুমিই জানো। না হলে এরকম ঘোড়ার মতো দৌড়ে দৌড়ে হাঁটছ কেন?”
“আপনি কেন ছোঁচা কুকুরের মতো আমার পিছু পিছু আসছেন? আমি কি হাতে রুটি নিয়ে হাঁটছি?”
ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকল শারফান‚ “বারবার কুকুর সম্বোধন করছ! যদিও আপত্তিও করছি না৷ তোমার দৃষ্টিতে আমি সত্যিই হয়ত কুকুর।”
কথাটুকু বলে গভীর একটা শ্বাস ফেলল সে। তারপর জানাল‚ “একা একা যাচ্ছ বলেই পিছু পিছু আসছি৷ অটো‚ রিকাশতে উঠে পড়লে চলে যেতাম।”
সে তো স্রেফ ঘোড়া সম্বোধনের জবাবেই কুকুরটা বলল। তবে সেদিনও যেহেতু বলেছিল একবার। এজন্যই বোধ হয় বেয়াদবটার দুঃখ লেগেছে। মনে মনে একটু যেন অনুতপ্তই হলো সানা৷ চেহারাতে অবশ্য তা প্রকাশ পেতে দিল না কোনোভাবেই৷ রুক্ষস্বরে বলল‚ “আপনাকে আমার বেতনভুক্ত বডিগার্ড বানায়নি আমার বাপ। আর আমি স্কুলের বাচ্চাও না‚ যে পথ চিনে বাড়ি যেতে পারব না। এবং আপনার মতো আর কোনো কিডন্যাপারের চোখে আমি অপরাধী নই‚ যে আবারও কিডন্যাপ হওয়ার আশঙ্কায় থাকব।”
শারফানের চেহারাটা আরও বেশি গম্ভীর হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করল‚ “এই কথাটা শোনালে কেন? যদি আমাকে মাফই করে থাকো‚ তাহলে কি আমার অপরাধের কথা এভাবে শোনাতে? তার মানে মন থেকে তুমি আমাকে মাফ করতে পারোনি‚ রাইট?”
“কিসের মধ্যে কী?” বিরক্তে চিড়বিড়িয়ে উঠল সানা‚ “আমি কি এখন পোস্টার টাঙিয়ে ঘোষণা করব‚ না-কি টিভিতে টিভিতে নিউজ করাব ‘জনগণের হিরো শারফান শায়াফকে এই অধমনী সানা ক্ষমা দান করিয়া কৃতার্থ হইয়াছে?’ আর আপনাকে আমার সামনে আসতে নিষেধ করেছি না? তাও আসেন কেন বারবার? যেচে পড়ে অপমানিত হতে এত ভালো লাগে কেন?”
জবাবটা দেওয়ার জন্য শারফান মুখটা খুলতে গেলে তার আগেই সানা সাবধান করল‚ “আর একবার আমার পিছু পিছু এলে ভাবব‚ আপনার মধ্যে সামান্য পরিমাণ সেল্ফ রেসপেক্ট নেই। লজ্জার কথা বললাম না। কারণ‚ ওটা আপনার মাঝে আগে থেকেই নেই।” বলা শেষেই চলতে আরম্ভ করল সে।
তবে শারফান আর সত্যিই এগোল না৷ কারণ‚ সানার শেষে আচরণে আজও ও মেজাজ হারিয়েছে। কষ্টেসৃষ্টে তা সামলে রেখেছিল কেবল। সেই সাথে এও বুঝল‚ রোড সাইড রোমিওদের মতো এভাবে পিছু নিয়ে মেয়ে মানুষের মন গলানোর মতো ধৈর্যও ওর নেই। বাড়ি ফিরে আজ বাপের সাথে একচোট হাঙ্গামা শুরু করবে সে। যেই হক ব্যাটার এত কিছু করার ক্ষমতা‚ তার নাকি এই মেয়ের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠানোর ক্ষমতা নেই! এ কথাও ওকে বিশ্বাস করতে হবে? যতসব ভণ্ডামি! সবাই ওর সঙ্গে ফাজলামি শুরু করেছে!
চলে যাওয়ার জন্য মাত্রই ঘুরে দাঁড়াল‚ আর তক্ষুনি সানার চিৎকারের আওয়াজ। চমকে উঠে ফিরে তাকাতেই সামনে দেখতে পেল ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি৷ উদভ্রান্তের মতো সানা দৌড়ে আসছে আবার এদিকেই। কিন্তু শারফান নিজেও আতঙ্কিত হয়ে পড়ল কুকুরগুলোকে ওর পিছু পিছু দৌড় আসতে দেখে৷ কুকুরকে তাড়াতে মুহূর্তেই বজ্রকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে “হেই… হেই” করতে করতে সানার কাছে ছুটতে গেল৷ তবে তার মাঝেই সানা দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে সামনে ওকে পেয়ে ওর বুকেই ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ তখন প্রতিক্রিয়াশীলভাবে শারফানের হাতদুটোও উঠে গেল সানার পিঠে… আচমকা বুকে এসে পড়ায় ছিটকে দু পা পিছিয়ে এল সে সানাকে জাপটে ধরেই।
ঘটনার প্রভাবে ওদের দু দুটো ছাতা কোথা থেকে কোথায় উড়ে চলে গেল‚ তা খেয়ালও হলো না ওদের৷ রাস্তার কিছু পথচারীরা একটু সহযোগিতা করল। হাতে দু’চারটা পাটকেল তুলে ছুড়ে মেরে তাড়িয়ে দিল কুকুরগুলোকে৷ মূলত দুটো দল ছিল কুকুরের৷ এক দল আরেক দলের সঙ্গে মারামারি লাগিয়ে ধাওয়া করছিল তারা৷ তা দেখে সানা ভয় পেয়ে দৌড় দিতেই স্বভাবগত আচরণ থেকে কুকুরগুলোও ঘেউঘেউ করতে করতে ওর পিছু পিছু দৌড়াতে শুরু করে।
বুকের সাথে একদম মিশে থাকায় শারফান স্পষ্ট অনুভব করতে পারল‚ সানার বুকের ভেতরের কাঁপুনি আর শরীরের কাঁপুনিও। ভয়ের চোটে সে অস্থির হয়ে পড়ে ওর টি শার্ট এত শক্ত করে খামচে‚ টেনেহিঁচড়ে ধরেছে যে‚ বুকের মাঝখানে নেমে এসে নেমেছে টি শার্টের গলা। জাঙের কারণেই নিশ্চয় এতখানি কুকুর ভীতি কাজ করছে সানার মাঝে—ভাবল শারফান৷ নিজের ওপর রাগ আর ধিক্কার তো বাড়লই ওর‚ রায়হানের ওপরও রাগ হলো৷ মৃদুস্বরে সানাকে বলল‚ “কুকুরগুলো নেই। ভয় পেয়ো না আর৷ ভিজে গেছ তো একদম। গাড়িতে চলো‚ বসে একটু স্থির হয়ে নেবে।”
এবার হুঁশ ফিরল সানার৷ কিন্তু শারফানের কাছ থেকে সরতে গিয়েই সে জমে গেল আবার। বুকের ঠিক মাঝখানে হালকা বাদামি একটা লম্বা দাগ তার—বুক কেটে সার্জারি করার চিহ্ন! বোঝার পরই কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো সানার। সেটা কষ্ট‚ না-কি মায়া‚ না করুণা? তা সে বুঝল না। অবচেতনভাবেই দাগটার ওপর আঙুল ছোঁয়াল। সেলাইয়ের রেখাটা সামান্য উঁচু হয়ে আছে। ছুঁতেই টের পেল ত্বকের নিচের শক্ত অংশটা।
“অ্যাই‚ সবাই দেখছে”‚ হঠাৎ নিচুস্বরে বলে উঠল শারফান‚ “ছাড়ো একটু।”
কথাটা কানে পৌঁছাতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ছিটকে সরে এল সানা। শারফান তখন চড়া গলায় বলল‚ “রায়হান কী ঘোড়ার মাথার থেরাপি দিয়েছে? তার ট্রিটমেন্ট শুনি এত ভালো… এত ভালো! এই তার নমুনা? এখনো তোমার কুকুরে ফোবিয়া সারাতে পারেনি কেন? ব্যাটাকে ফোন লাগাব আজই।”
সেলাইয়ের দাগটা দেখে মনের এক কোণ যাওবা একটু ভিজেছিল সানার‚ শারফানের আজগুবি হম্বিতম্বি দেখে পূর্বের বিরক্তটা ওর ফিরল আবার। ধমকে উঠে বলল‚ “এই‚ থামুন তো! তার ট্রিটমেন্ট সে ঠিকই দিয়েছে৷ কুকুরে ফোবিয়াও আলহামদুলিল্লাহ অতখানিও নেই‚ যতখানি থাকার কথা ছিল৷ নয়ত মৃগীরোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে শুয়ে পড়তাম এতক্ষণে৷ ওরকম এক পাল কুকুরের ধাওয়া খেলে যে কেউ-ই প্যানিক হয়ে পড়বে‚ ঠিক আছে?”
“হেহ্”‚ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল শারফান‚ “কে বলেছে তোমাকে যে কেউ-ই এরকম প্যানিক হত? তোমার মতো কি সবাই-ই অমন ছাগলের মতো দৌড় লাগাত? কুকুর দেখে দৌড় দিলে যে কুকুরও পিছু পিছু দৌড়াবে‚ এটা তো সবাই-ই জানে৷ তুমিও জানতে৷ কিন্তু ফোবিয়া থেকেই মাথা আর ঠিক রাখতে পারোনি৷ তাই দৌড় লাগিয়েছিলে।”
“আসছে বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শারফানুল্লাহ শায়াফ”‚ তাচ্ছিল্যটা শারফানের সুরেই প্রকাশ করল সানা।
এর মাঝেই হঠাৎ ওদের পেছন থেকে একটা গাড়ি হর্ন বাজিয়ে উঠল। এক সঙ্গেই সেদিকে ফিরে তাকাল দুজন—রাস্তার ডান দিকে একটা ল্যান্ড ক্রুজার দাঁড়িয়ে‚ দেখতে পেল ওরা। গাড়ির কাছে একা হাতে দুটো ছাতা ধরে আর মাথার ওপর একটা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন ড্রাইভার ফরিদ। তাকে না দেখলেও অবশ্য বুঝতে পারত শারফান‚ স্বয়ং শাফিউল হক হাজির হয়েছেন। কিন্তু বাপকে এখানে‚ এ মুহূর্তে সে মোটেও প্রত্যাশা করেনি৷ নিশ্চয়ই ওর গাড়ির ড্রাইভারের থেকে খোঁজ জেনেছেন! তাই বলে সরাসরি চলে আসতে হবে? এমন কী দরকার পড়ল?
শারফানকে তাকাতে দেখেই শাফিউল সাহেব নামলেন৷ ফরিদের থেকে ছাতা দুটো নিয়ে রাস্তা পার হয়ে চলে এলেন ওদের কাছে৷ চুপচাপ একটা ছাতা এগিয়ে দিলেন সানাকে৷ ছাতাটা ধরতেই বেশ বিব্রত হলো সানা‚ কিছুটা আড়ষ্টতাও অনুভব করল লজ্জায় পড়ে—ছেলের সঙ্গে তিনি নিশ্চয়ই ওকে আপত্তিকর অবস্থাতে দেখে নিয়েছেন! মুখটাও বেজায় গাম্ভীর্যপূর্ণ তার৷ একদম শারফানের মতোই ভারী স্বাস্থ্যের৷ দেখলেই কেমন রাগী রাগী লাগে তাকে। অন্তত সানার কাছে তা-ই মনে হলো৷
ওর সেই ধারণাকে সত্যি করে থমথমে সুরে শারফানকে বলে উঠলেন শাফিউল সাহেব‚ “গাড়িতে গান ছেড়ে রেখে আর বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ভিজে নিজেকে সিনেমার হিরো বানাতে চাচ্ছিস না-কি? তোকে দেখে তো কোনো ডিরেক্টরই হিরো হিসেবে পছন্দ করবে না। করতে পারে শুধু ভিলেন হিসেবে৷ সেই সুরত আর সেই গুণই আছে তোর মধ্যে।”
চটে গেল শারফানের মেজাজ৷ কোথা থেকে বাপটা উড়ে এসে কী সব ফালতু কথা বলে অপমান শুরু করল সানার সামনে! নিশ্চয়ই ইচ্ছা করেই করছে‚ যাতে সানা আরও বেশি অপছন্দ করে ওকে!
কিন্তু দুঃখের বিষয়‚ সানা সামনে আছে বলেই শারফান একদম চোটপাট করতে পারল না বাবার সঙ্গে৷ কেবল কটমটিয়ে বলল‚ “তোমার কী কাজ এখানে? কী চাই?”
“আমার কী কাজ তা তো বাড়ি গিয়েই জানতে পারবি”‚ চকিতেই ধমক লাগালেন তিনি। “ফোন গাড়িতে ফেলে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির পানি খাচ্ছিস‚ সেটা কি আর তোর মা জানতে পারছে ঘরে বসে? তার যে চিন্তা হয় এখন বেশি বেশি‚ সেটা জানিস না? এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ফোন ধরছিস না‚ কোথায় পড়ে আছিস‚ বাড়ির লোকের চিন্তা হয় না? বাড়ি যাবি এক্ষুনি‚ যা গাড়িতে গিয়ে বস”‚ শেষে আবারও এক ধমক বসালেন শারফানকে৷
তবে শারফান ভয় না পেলেও কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা সানা বেশ ভয় পেল শাফিউল সাহেবের ধমকানোটা দেখে৷ দ্রুত কেটে পড়ার চিন্তা করল সে৷ তখনই শারফান ওর দিকে ইশারা করে কড়া গলায় বলল‚ “ওকে রিকশায় তুলে দিয়ে তারপর যাব। তুমি যাও।”
বুকটা ধড়াস করে উঠল সানার। “কী বেয়াবদ একটা লোক! ছিহ্! কী ভাববেন এবার উনি”‚ মনে মনে শারফানকে বকার পরই সে তাড়াতাড়ি বলল‚ “আমি একাই রিকশা ডেকে নিতে পারব।”
“দাঁড়াও”‚ সানা এক পা এগোনোর সঙ্গে সঙ্গেই গম্ভীর গলায় ডেকে উঠলেন শাফিউল সাহেব।
কলিজাসহ যেন বুকটা এবার কেঁপে উঠল সানার। কী বলে বসবেন ওকে আল্লাহই জানেন! শাফিউল সাহেবের দিকে তাকাতেই ওকে চমকে দিয়ে তিনি ললিত স্বরে বলে উঠলেন‚ “রিকশায় যেতে হবে না‚ মা। এরকম ভিজেপুরে রিকশা টিকশাই যাওয়ার কোনো দরকার নেই৷ চলো সোনা‚ আমি বাড়িতে পৌঁছে দেব।”
এমন মিষ্টি আচরণে সানা প্রথমে থতমত খেলেও পরে দেখাল ওকে দ্বিধাগ্রস্ত। সামান্য চেনা-জানা একজন মানুষের গাড়িতে এভাবে এক ডাকেই উঠে পড়া যায়? শারফানের গাড়িতে যখন উঠত‚ তখনের পরিস্থিতিগুলো তো আলাদা ছিল।
এদিকে‚ তপ্ত মাথাটা এক লহমায় যেন বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল শারফানের। ঠোঁটের কোণে চোরা হাসিটা নিয়ে সে চলে গেল গাড়িতে। তবে নিজের গাড়িতে নয়‚ সভ্য-শান্ত ছেলের মতো সোজা গিয়ে বসল বাবার গাড়িতে। ঘাড় ফিরিয়ে তা দেখে শাফিউল সাহেব না পারলেন কিছু বলতে‚ আর না পারলেন সরাসরি হাসতে। তবে চোখদুটোতে হাসিটা খেলেই গেল। সানার দিকে ফিরে মৃদু হেসে বললেন‚ “তোমার আব্বুর ভয় কোরো না। কিছু বলবে না তোমাকে। আমি কথা বলে নেব দরকারে। এভাবে ভিজে অবস্থায় ঠান্ডা লেগে যাবে তো৷ চলো চলো… তাড়াতাড়ি চলো৷”
“আমি চলে যেতে পারব‚ আঙ্কেল”‚ জড়তাপূর্ণ কণ্ঠে সানা বলল‚ “কোনো সমস্যা হবে না।”
“কিন্তু আমি তো তোমাকে না নিয়ে যেতে পারব না। আঙ্কেল বলছি না? শুনতে হয় আঙ্কেলের কথা।”
এমন কথাকে আর কী কথা দিয়ে কাটবে সানা‚ খুঁজে পেল না একদম৷ কাজেই শাফিউল সাহেবের কথা মান্য করে তার সঙ্গে এসে গাড়িতে চড়ে বসল৷ ওঠার সময় শারফানের সঙ্গে চোখাচোখি হলো তার৷ স্পষ্ট দেখতে পেল‚ শয়তানটা তখনের মতো হাসছে মিটিমিটি৷ বসেছে পেছনের সিটেই আবার‚ জানালার পাশে৷ সানাও বসল জানালা ঘেঁষেই৷ তবে শাফিউল সাহেব দুজনের মাঝখানে। ভাগ্যবশত গাড়িতে একটা তোয়ালে ছিল। সেটা ফরিদ বাড়িয়ে দিলেন পেছনে। শাফিউল সাহেব নিয়ে তা সানাকে এগিয়ে দিলেন আর স্নেহময় সুরেই বললেন‚ “মাথাটা মুছে নাও তো‚ মা।”
চুপচাপ তোয়ালেটা নিয়ে মাথাটা মুছতে শুরু করল সানা। তার মাঝে হঠাৎ আবারও চোখ পড়ল শারফানের দিকে। জানালার কোণায় হাতে ঠেকিয়ে চিবুকের দাড়ি টানছে আর দেখছে ওকে। ঠোঁটে তখনো লেগে আছে চোরা হাসিটা। মাথাটা মোছা শেষে সানা আর ভুল করেও তাকাল না তার দিকে৷ কোনো নড়চড়ও করল না। একদম পুতুলের মতো হয়ে গেল যেন৷ একনাগাড়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল সে৷ এর মাঝে শারফান হঠাৎ তোয়ালেটা ওর থেকে চেয়ে নিয়ে নিজ তাগিদেই মাথাটা মুছতে লাগল। ছেলের এই নতুন সব কাণ্ড কারখানা দেখে শাফিউল সাহেব ভেবে পান না‚ কী প্রতিক্রিয়া দেবেন! কোনোদিন তো ভাবেনইনি‚ তার ছেলেও প্রেমে পড়তে পারে অন্যদের মতো।
গাড়ির মধ্যে কেউ-ই তেমন কোনো কথা বলল না আর। সানা যেন কোনোরকম অস্বস্তিতে না পারে‚ সেজন্য আরও কোনো কথা বললেন না শাফিউল সাহেব৷ শুধু একটু পর পর আঁড়চোখে চেয়ে ছেলের ছটফটানি দেখতে থাকলেন।
গাড়িটা যখন সানার বাসার সামনে পৌঁছাল‚ তখন বৃষ্টিটা একদম থেমে গেছে। পাড়ার মহিলারা বাইরে বেরিয়ে নিজ নিজ ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছিল। বহুদিন পর সানার বাসার সামনে তারা দামী গাড়িটা দেখে শুরুতে ভাবল‚ কবির সাহেব এসেছেন হয়ত। কিন্তু সানা নেমে পড়ার পর যখন শাফিউল সাহেব জানালার কাছে এসে ওর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন‚ তখন যেন সবাই আলোচনার নতুন বিষয় খুঁজে পেল। শাফিউল সাহেবকে যারা চেনে‚ তারা অবাক হয়ে বলাবলি করতে লাগল‚ “তার সঙ্গে হঠাৎ কিসের সম্পর্ক সানাদের?”
স্রেফ ভদ্রতা রক্ষার্থেই সানা কপট হাসিমুখে অনুরোধ করল‚ “ভেতরে এসে একটু বসে যেতেন‚ আঙ্কেল। বাসার সবাই খুশি হত অনেক।”
কথাটা শুনে হঠাৎ হেসে ফেললেন শাফিউল সাহেব‚ “আসব‚ মা৷ আজকে না। অন্য একদিন নিশ্চয়ই আসব। আর তুমি টেনশন কোরো না‚ যে আব্বু বকা দেবে আমার সঙ্গে আসার জন্য। আমি কথা বলে নেব ওনার সঙ্গে। কিছুই বলবে না।”
ঘাড় কাত করে ‘ঠিক আছে’ বুঝিয়ে বিদায় জানাল সানা—সালামটা দিয়ে৷ শারফান তখন একটু মুখটা বাড়িয়ে ওকে দেখার চেষ্টা করেছিল একবার। কিন্তু ব্যর্থ হলো বেচারা।
চলবে।