মনাকাশে ধ্রুবতারা বেশে পর্ব-৫৫ এবং শেষ পর্ব

0
2

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
#সমাপ্তি.

২৩ জুলাই
বর্ষার এক বিকাল।
ছাদের চারপাশে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে‚ মেঘের ফাঁক দিয়ে নরম আলো এসে পড়েছে টবে সাজানো ফুলগাছের পাতায়। সারি সারি বেলি-চামেলি যেন সাদা মুক্তোর মালা হয়ে ছাদ জুড়ে ফুটে আছে। পাশে গন্ধরাজের কচি ডালে ফুটে আছে কয়েকটি বড়ো সাদা ফুল‚ তার ভারি মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। মনে হচ্ছে এই ছাদ যেন শহরের কোলাহল থেকে আলাদা এক ছোট্ট বাগান। যেখানে প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিশে আছে ফুলের সৌরভ। পাশের রেলিং ঘেঁষে রাখা টগর আর গোলাপের গাছগুলোও কোমল গন্ধে ভরিয়ে দিয়েছে চারপাশ। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে সুবাসগুলো আরও ঘন হয়ে ওঠে। ছাদের সামান্য কাছে এলেই এমন এক মাদকতা অনুভব হয়‚ যা শহরের ধুলো‚ শব্দ আর ক্লান্তিকে মুহূর্তেই ভুলিয়ে দেয়।

ব্যালকনিটা আজ-কাল এজন্যও প্রিয় হয়ে উঠেছে শারফানের। সানার সঙ্গে জড়িত সব কিছুই ওর কাছে লাগে ভীষণ মিষ্টি‚ ভীষণ সুন্দর। এইতো সেদিন মোস্তফা সাহেব এশার নামাজ শেষে ওকে ডেকে বললেন‚ “শোনো শায়াফ‚ ফজর নামাজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি। আর এটা পরিত্যাগ করা কবিরা গুনাহ। কবিরা গুনাহ কী তা তো জানো। তাহলে ফজরের ওয়াক্ত কেন মসজিদে আসো না? ফজর নামাজ জামাতের সাথে আদায় করলে সারা রাত নফল ইবাদতের সওয়াব পাওয়া যায়।”

শারফান সেদিন প্রথমবার কারও কথাই লজ্জা অনুভব করেছিল খুব৷ কিন্তু একটুও রাগ হয়নি ওর। বরঞ্চ ভীষণ মিষ্টি লেগেছিল মোস্তফা সাহেবের বাচনভঙ্গি থেকে শুরু করে তার চমৎকার ওই কথাগুলোও। এরপর মোস্তফা সাহেব আরও একটি কথা বলেছিলেন সেদিন‚ “আমরা যেমন খারাপ কোনো গন্ধ নাকে এলে ভীষণ অস্বস্তিবোধ করি‚ কষ্ট পাই। সেরকম ফেরেশতারাও আমাদের থেকে আসা সিগারেটের দুর্গন্ধ বা এরকম অন্যান্য দুর্গন্ধযুক্ত জিনিসের গন্ধে কারণে কষ্ট পায়। যতটা সম্ভব চেষ্টা কোরো সিগারেটটা ছেড়ে দেওয়ার। শরীরকে সুস্থ রাখতে হলেও তো এটা ছাড়া উচিত।”

এ কথাগুলোতেও শারফান বিরক্ত হয়নি একটুও৷ অথচ অতীতে কারও জ্ঞান বাণী সে এক কানে ঢুকিয়ে অন্য কানে বের করা তো পরের কথা‚ কানেই তুলত না৷ উপরন্তু দু চক্ষে সহ্যই করতে পারত না জ্ঞানদানকারীকে!

চেয়ারে বসে বাপের নির্দেশে কিছু জরুরি কাগজপত্র দেখছিল সে ম্যাকবুকের স্ক্রিনে। কিছুক্ষণ পর জরুরি কটা মিটিঙেও অংশ নিতে হবে স্কাইপে। কাজের মাঝে থেকে থেকে সানার ছাদের একেক ফুলের ঘ্রাণ এসে ঝাপটা দিচ্ছিল ওর নাকে। প্রাণ ভরে ততবার টেনে নিচ্ছিল সেই সুবাস। এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সে ঘরের মধ্যে দামী শোভা বর্ধক গাছের মাঝেও অনুভব করেনি কখনো।

কাজের ফাঁকে হঠাৎ আরেকটি অনুভব হলো ওর—খু্ব কাছ থেকে কেউ যেন ওকে দেখছে। ম্যাকবুক থেকে চোখদুটো তুলে সরাসরি ছাদের দিকে চাইল সে৷ বসে থাকায় কেবল চোখে পড়ল ছাদের মাঝখানে টাঙানো তারের ওপর কাপড়গুলো নড়ছে। সামনের কফি টেবিলে ম্যাকবুকটা রেখে সে উঠে পড়ল তখন‚ এগিয়ে গেল গ্রিলের কাছে৷ কাপড়চোপড় তুলছে কেউ৷ তবে আড়াল হয়ে আছে সে চাদরের ওপাশে। তাই বুঝতে পারল না শারফান‚ মানুষটা কে। একটু পর ব্যক্তিটি চাদর তোলার সময় চাদরের আড়াল থেকে হঠাৎ উঁকি দিল ওর ব্যালকনির দিকে। তা দেখে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই শারফান মস্ত এক হাসি ফুটিয়ে বলল‚ “চুপিচুপি দেখার ফিলিংসটা মনে হয় অন্যরকম মজার‚ তাই না? কখনো ট্রাই করিনি। একবার করব ভাবছি।”

অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল সানা। লজ্জায় চাদরটা দ্রুত টান দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই শারফান পিছু ডেকে উঠল‚ “ওই‚ পালাও কেন খালি? এত ভয় আমাকে?”

“কিসের ভয়?” চড়া গলায় বলেই সানা ঘুরে তাকাল ওর দিকে।

শারফান হাসতে লাগল। ভয় পাওয়ার কথাটা বললেই সানাকে খেপানো যায় বলে বারবার এ সুযোগটাই কাজে লাগায় সে। আবারও তাই সেটাই বলল‚ “আমাকে বিশাল কিছু ভাবো‚ সেই ভয়। নয়তো কি আর ছাদে আসা বন্ধ করতে? না-কি আজকে তোমার প্রতিবেশীর হলুদ সন্ধ্যায় আসতে মানা করতে?”

শারফান দোতলা থেকে যাদেরকে চারতলায় পাঠিয়েছে‚ সেই ভাড়াটের বড়ো মেয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান আজ। সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি গানবাজনা‚ নাচানাচি চলবে ছাদে। তাই সানা আর মেহাকেও দাওয়াত করে গেছে তারা৷ কিন্তু সানা যেতে রাজি নয় সেখানে৷ অথচ মেহা যাওয়ার জন্য পাগল৷ মায়ের মাধ্যমে বোনকে রাজি করানোর চেষ্টাও করছিল সকালে‚ তা জানালা থেকে দেখতে পেয়েছিল শারফান। দাওয়াত ওকেও করা হয়েছে৷ তবে সেই দাওয়াত রক্ষার ইচ্ছা ওরও নেই৷ ওসব মেয়েলি বিষয়ে আগ্রহ ওর সারাজীবনই শূন্য৷ এমনকি সানা গেলেও যেত না সে। ওর পরিকল্পনা তো অন্য কিছু।

কাপড়ের বোঝা হাতে নিয়েই সানা একটু এগিয়ে এল রেলিঙের ধারে। নয়তো জোরে জোরে কথা বলতে হয়‚ আর তখন নিচ থেকে শুনতে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শারফানকে সে বলল‚ “আপনার শরীরটা আসলেই দৈত্যের মতো বিশাল৷ তাই এ কথা সত্য‚ ভয় এক সময় লাগতও৷ কিন্তু সেই ভয়টা আপনিই ভেঙে দিয়েছেন। কীভাবে তা আর ব্যাখ্যা করতে হবে না আশা করি।”

অতীতের ভুলগুলোকে স্মরণ করিয়ে শারফানকে সানা অপ্রতিভ করতে চাইলেও শারফান একটুও আর বিব্রত হলো না। গত এক মাসে ওর আত্মবিশ্বাসটা মজবুত হয়েছে কিনা! সানাকে জবাবও দিল দৃঢ় সুরে‚ “এ ভয়টা কিন্তু আমি অন্য কিছু বুঝিয়েছি। তুমি এখনো ফিলিংস রাখো আমার জন্য। তা তুমি গোপন রাখতেই আমার থেকে পালাও বারবার। আর ভয়টা পাও এখানেই‚ যেন তুমি প্রকাশ না করে ফেলো কোনোভাবে।”

চোখের তারায় এক অস্বস্তির ছায়া পড়ল সানার৷ সে কিছু বলার আগে শারফানই বলল‚ “আমি ধৈর্য রাখতে শিখছি‚ সানা। নিজেকে শান্ত করতে মেডিটেশন‚ তালিম‚ সব কিছুর শরণাপন্ন হচ্ছি। আমি দেখতে চাই‚ কতটা সময় আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। কিসের অপেক্ষা‚ সেটা জিজ্ঞেস কোরো না৷ আমার উত্তর দিতে লজ্জা লাগবে না। তোমার শুনতে লজ্জা লাগতে পারে”‚ শেষ কথাদুটো বলার সময় মুচকি মুচকি হাসল শারফান।

সানা আর দাঁড়ালই না তারপর। গম্ভীর মুখে শারফানকে ক’মুহূর্ত দেখে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল। পেছন থেকে তখন শুনতে পেল শারফানের বিদ্রুপ‚ “আমাকে ভয় করে আমার বিল্ডিঙে আসতে চাইছ না! আর যদি নিজের ঘরেই আমাকে দেখো‚ তখন কই পালাবে?”

***

রাত ৭ টা।
ছাদ থেকে সাউন্ডবক্সে বলিউডের গান আর হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। সেই শব্দে মেহার দুঃখও বাড়ছে ততটাই। কনের ছোটোবোন ওর ভালো বন্ধু। দুপুর থেকে সে কতবার কল করেছে আসার জন্য! কিন্তু নাজমা বেগম ওকে একা যেতে দিতে কোনোভাবেই রাজি নন। তাই মন খারাপ আর সানার প্রতি রাগ থেকে পড়ার বদলে বইয়ের মধ্যে শুধু শুধুই হিজিবিজি কলমের দাগ ফেলছে। ফোন হাতে নিয়ে সানা বিছানাতে বসা। মেহার ভাবগতিত সবটাই লক্ষ করছে সে। দশটা মিনিটেও তার কোনো পরিবর্তন না দেখে উঠে এল। বইটা সামনে থেকে এক টানে সরিয়ে নিয়েই মেহাকে ধমক দিল‚ “বই নষ্ট করছিস কেন? থাপ্পড়ে তোর মুখেও ছাপ বসাই?”

“তোর কী? আমার বই আমি যা খুশি করব!” নিমিষেই চেঁচিয়ে উঠল মেহা।

সানা দুম করে বইটা দিয়ে তার মাথার পিছে বাড়ি মারল আর বলল‚ “পাঁচ মিনিটের মধ্যে জামা পরবি আর চুল বাঁধবি। কোনো মেকআপ করবি না।”

খুশিতে মারের কথা আর মনে রাখল না মেহা। জলদি উঠে পড়ে দৌড় লাগাল জামা পছন্দ করতে। দু বোন প্রস্তুত হওয়ার পর নাজমা বেগম সঙ্গে গেলেন এগিয়ে দেওয়ার জন্য৷ ছাদে গিয়ে কনের মায়ের সঙ্গে দেখা হলো তার৷ ওদের দু বোনকে খেয়াল রাখতে বললেন তাকে‚ ছাদের পরিবেশটাও দেখে নিলেন সেই সাথে৷ ছেলে মানুষ কজন থাকলেও তারা কিশোর বয়সের। তাই আর চিন্তা করলেন না বেশি৷ মেয়েদের ঘণ্টাখানিক সময় বেঁধে দিয়ে বাসায় ফিরে গেলেন তিনি।

মিনিট দশেক পর শারফানের বাসার কলিংবেলটা বেজে উঠল। এ সময় ও বাসায় থাকে না কখনোই। কিন্তু আজ অফিসের কাজের জন্য ঘরেই ছিল। দরজাটা খুলল তাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। দোতলার ফ্লোরে আলো জ্বালানো হয়নি এখনো। অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়ানো দেখতে পেল ছোটো ভালুক দেহী একটা মানুষকে। তবুও তাকে চিনতে সমস্যা হলো না শারফানের। চোখ থেকে রিমলেস ব্লু লাইট ব্লকিং চশমাটা নামিয়ে নিল। দীর্ঘক্ষণ ল্যাপটপে কাজ করতে হলে চোখে চাপ কমাতে চশমাটা তখন ব্যবহার করতে হয় ওকে।

“কী খবর‚ হান্টার বিয়ার?” সামনের মানুষটিকে ডেকে উঠল সে।

কিন্তু ডাকটা শুনেই রেগে উঠল মানুষটি‚ “আপনি আবারও ভালুক ডাকলেন? আরেকবার ডাকলে আপনার কাজই করব না বললাম।”

“তোর মতো পুচকে মাল হুমকি দিস আমাকে! সময় খারাপ বলে পিঠটা বেঁচে গেল তোর৷ আয়‚ ভেতরে আয়।”

বাচ্চাটা কনের ছোটো ভাই। বয়স হবে এগারো‚ বারোর আশেপাশে। সিয়াম নাম। শরীরটা তার বেজায় ভারী৷ তাই প্রথম পরিচয়েই শারফান তাকে ‘মিনি পান্ডা’ বলে ডেকেছিল। তারপর যতবার দেখা হয়েছে‚ ততবারই তাকে ভালুক বলেই খেপিয়েছে সে।

শারফানের ডাকে সিয়াম ভেতরে এসেই ওকে জানাল‚ “সানা আপু আসছে‚ মেহা আপুও আসছে।”

ঠোঁটের কোণে ছোট্ট হাসি ঝিলিক দিল শারফানের৷ দরজাটা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করল‚ “ওদের মা নেই সাথে?”

“আন্টি ছিল৷ চলে গেছে আপুদের রেখে।”

বাসার ছাদে অনুষ্ঠান করার জন্য কনের অভিভাবক অনুমতি নিতে এসেছিল শারফানের কাছে৷ কারণ‚ সে আসার পর থেকে মাঝেমধ্যেই সোহানদের নিয়ে সময় কাটায় সেখানে। না বলে তাই অনুষ্ঠানটা করার সাহস পাচ্ছিল না তারা। কারণ অবশ্য আরও একটি আছে৷ দোতলা থেকে চারতলায় যেতে রাজি ছিল না বলে শারফানের থেকে ভালোই দুর্ব্যবহার পেয়েছিল। নেহাৎ তাদের মতো বড়ো পরিবারের জন্য এই বাসাটা বেশ উপযোগী। ঘরগুলো বেশ বড়ো বড়ো। সে কারণেই বাসা আর ছেড়ে যেতে চায়নি। শারফানকে দাওয়াতটাও দিয়েছে কেবল বাধ্য হয়েই। মালিক কিনা!

যেদিন তারা অনুমতি নিতে এসেছিল‚ সেদিনই সিয়ামের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছিল শারফানের৷ সানা যদি হলুদ সন্ধ্যাতে আসে‚ আর সিয়াম যদি শারফানের কথামতো ওকে দোতলায় আনতে পারে‚ তাহলে সিয়ামকে একটি রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার কিনে দেবে শারফান। সেই সাথে আরও একটি শর্ত হলো‚ এই পুরো ব্যাপারটি সিয়ামকে গোপন রাখতে হবে।

শারফানের পিছু পিছু ওর শোবার ঘরে এল সিয়াম। জিজ্ঞেস করল‚ “সানা আপুকে ক্যামনে এখানে আনব‚ বলেন?”

তার প্রশ্নকে পাত্তা না দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে ব্লু দ্য শানেলের পারফিউমটা শরীরে মেখে নিল শারফান৷ পরনে কালো পোলোশার্ট আর ট্রাউজার। চুলটাও ঠিকঠাক গোছানো। বেশভূষা মন্দ না একদম। তাই আর পরিবর্তন করল না কিছুই৷ আয়নায় নিজেকে পুরোপুরি দেখা শেষে সিয়ামের দিকে ফিরল৷ এতক্ষণ উজবুকের মতো তাকিয়ে দেখছিল সিয়াম‚ ওর কাজকর্ম।

শারফান তাকে ধীর স্বরে বলল‚ “সানাকে আগে আলাদা ডেকে নিবি। তারপর নার্ভাস চেহারায় ওকে বলবি…” অভিনয় করে দেখাল সে‚ “আপু… আপু‚ তোমার আব্বুকে দেখলাম দোতলায় এক ভাইয়ার সঙ্গে প্রচুর রাগারাগি করছে৷ তার কলার চেপে ধরে থাপ্পড় মারতেও দেখেছি। বুঝেছিস তো কী বললাম? নার্ভাস চেহারা মানে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিস তুই‚ সেরকমভাবে কথাগুলো বলবি৷ আশেপাশে কেউ যেন না শোনে‚ সাবধান!”

সিয়াম মাথা নেড়ে সায় জানাল। “আর কিছু?”

“ওর ছোটো বোনও যেন টের না পায়।”

“ও.কে। যাচ্ছি তাহলে”‚ বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সিয়াম।

পেছন থেকে শারফান গলা উঁচু করে হুঁশিয়ারি দিল আবারও‚ “ও ছাড়া কেউ যেন না শোনে। মাথায় রাখবি।”

সিয়াম ছাদে আসার পর দেখল‚ সানা কথা বলছে এ পাড়ারই কয়েকটা মেয়ের সাথে। মেহাকে ওর আশপাশে দেখা গেল না৷ তবে সিয়াম তাকে খুঁজে পেল নিজের ছোটো আপুর সাথে৷ কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে সানার কাছে গিয়ে বলল সে‚ “আপু‚ একটু সিঁড়ির কাছে আসবা? দরকার ছিল।”

সানার সঙ্গে হঠাৎ তার মতো বাচ্চা মানুষের কী দরকার‚ তা নিয়ে মেয়েগুলো দুষ্টুমি শুরু করলে সিয়াম হাসার বদলে মুখটা গম্ভীর রাখল৷ নয়তো সানা যে তাকে গুরুত্ব দেবে না! কতক্ষণ ধরে সবাই তাকে খুঁচিয়েও কোনো কথা বের করতে পারল না বলে সানাও দুষ্টুমি করে বলল‚ “তোর আবার আমার সাথে কী এমন দরকার হলো রে? আড়ালে ডাকছিস কেন‚ হুঁ? তোর মাকে বলব?”

“মা সিঁড়িতেই আছে৷ চলো‚ মা-ই বলবে তোমাকে।”

“আন্টি বলবে? আন্টি ডাকছে না-কি?”

সিয়াম মাথা ঝাঁকাল শুধু। তখন ওর মাথায় একটা টোকা দিয়ে বলল সানা‚ “সেটা তাহলে আগে বলবি না? খালি খালি দেরি করলাম।”

সিয়ামের সঙ্গে সিঁড়িতে এল সে। কিন্তু সিয়ামের মাকে না দেখে জিজ্ঞেস করতে চাইল‚ “আন্টি কি ঘরে?” তার আগেই সিয়াম ভীত কণ্ঠে ফিসফিসানির সুরে জানাল‚ শারফানের থেকে শিখে আসা কথাগুলোই৷

অভিনয়টা সিয়ামের ঠিকঠাকই হলো৷ যেটা দেখেই আতঙ্কে বুকের মধ্যে সানার হঠাৎ বাড়ি দিয়ে উঠল। দোতলায় তো শারফানই থাকে। সে ছাড়া আর কার কাছেই বা আসবে আব্বু? তবে কি আব্বু কোনোভাবে জেনে গেল ওর অপরাধটা? এ কথাটাই সর্বপ্রথম মনে এল সানার। রাগের চোটে নিশ্চয়ই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেনি আব্বু? তাই লোক জানাজানির কথাটাও মাথাতে নেই বোধ হয়!

ছতলা থেকে দৌড়ে নেমে এল সানা। শারফানের ঘরের সামনে এসে থামল। দরজাটা অর্ধেক খোলা৷ ভেতর থেকে দুমদাম শব্দ আসছে একটা। ভারী কিছুর ওপর ক্রমাগত আঘাত করার মতো শব্দটা। শারফানের কণ্ঠ থেকে চাপা আর্তনাদও ভেসে আসতে লাগল। তা শুনতে পেয়েই মাথার মধ্যে সবটা ফাঁকা হয়ে গেল ওর। প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেল সে। দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল জলদি। তারপরই গেল চমকে। ঘরের নীলচে আলোয় শারফানকে দেখতে পেল ফোল্ডেবল এয়ার সোফায় গা টানটান করে বসে আছে। তাকে ওভাবে দেখে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে পড়ল এবার—আব্বু কি সত্যিই এসেছিল?

সোফা থেকে উঠে এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়াল শারফান। হাতে একটা মোটা রড তার‚ আর মুখটা থমথমে ভাব। রডটা খেয়াল করল না সানা। তার মুখের দিকে উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে রইল শুধু—মারের চিহ্ন খুঁজল বোধ হয়।

“আব্বুকে ঠেকাতে এলে?” ঘরের নিস্তব্ধতার মাঝে রাশভারী গলায় বলে উঠল শারফান।

“কী… কী হয়েছে”‚ ভয় আর উৎকণ্ঠায় কথা জড়িয়ে এল সানার‚ “আব্বু মেরেছে আপনাকে?”

“তোমার আব্বু আসেনি।”

“আসেনি?” ভ্রু কুঁচকে গেল সানার৷ একটু আগে যে কাতর ধ্বনি শুনতে পেল শারফানের! সেটা কী ছিল তাহলে? অভিনয়! সিয়ামও মিথ্যা বলেছে তবে?

একটু ভাবতেই সবটা বুঝে গেল সানা—সিয়ামকে মিথ্যা বলিয়েই তাকে ডেকে আনা হয়েছে! শারফানের দিকে রোষাগ্নি চোখে চাইল। ওকে ঘরে ডেকে আনার এই জঘন্য পরিকল্পনাতে এতটা ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল সে‚ অতীতে যেটা কখনো করেনি‚ আজ সেটাই করে বসল! চড়াৎ করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল শারফানের গালে। নীরব ঘরে থাপ্পড়টা বেজে উঠল মৃদু শব্দে।

গালে হাত দিয়ে বিস্ময়ে তখন জমে গেছে শারফান। এভাবে থাপ্পড় খেয়েছে সে শেষ কবে? মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা পড়তে যাওয়া নিয়ে বাবার সঙ্গে ঝামেলা করায় সেবারই বোধ হয় শেষ থাপ্পড়টা পড়েছিল ওর গালে! এরপর আজ অবধি কেউ কখনো এভাবে মারেনি। স্বয়ং শাফিউল সাহেবও ওর রাগ‚ জেদকে ভয় করে সেই সাহসটা করেননি৷ চোখ-মুখ কঠিন হয়ে উঠল ওর মুহূর্তেই।

কিন্তু থাপ্পড়টা মারার পরও সানার মাথা ঠান্ডা হলো না। অবিলম্বেই ওর বুকের মাঝে ধাক্কা মারল‚ আর ক্রুদ্ধস্বরে বলতে লাগল‚ “আপনি আসলে একটা জানোয়ার! আপনাকে ঘেন্না করার কারণটা প্রতিবার আপনিই দেন। কী করে একটা মানুষ সব কিছু ভুলবে তাহলে? এতটা অমানুষ কেউ কীভাবে হয়?”

শেষ কথাটা বলার মুহূর্তে আবারও শারফানকে ধাক্কা মারল সে৷ তারপর আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে চাইল না। দরজার দিকে পা দুটো বাড়াতেই পেছন থেকে আচমকা এগিয়ে গিয়ে দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দিল শারফান। সেটা দেখেই ভয় পেয়ে সানা চিৎকার করতে গেল‚ তখনই ওর মুখটা চেপে ধরে ধমক দিল সে‚ “চোপ্! কোনো সাউন্ড না! আমার হাতের থাপ্পড় খেলে চোখে অন্ধকার দেখা লাগবে বলে দিলাম!”

সানার শরীর কাঁপতে শুরু করল। নীল রঙা আলোতেও ওর দু চোখের কার্নিশ স্পষ্ট ভিজে উঠতে দেখল শারফান। কাঁপুনিটাও টের পেল৷ এ পরিস্থিতি দেখে হঠাৎ একই সঙ্গে দুজনেরই মনের পর্দায় হাজির হলো জঙ্গলের সেই দিনগুলোর কথা! কতটা কষ্টে রেখেছিল শারফান তখন সানাকে‚ তা মনে পড়তেই রাগটা তার নেমে গেল চকিতেই। সানার কান্না দেখে এতটা উতলা হয়ে পড়ল সে‚ কী করে ওকে শান্ত করবে তা বুঝতে না পেরে এক ঝটকায় ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল।

“সরি‚ সানা… আই অ্যাম সো সরি…”‚ মৃদুস্বরে বলতে বলতে সানার মাথায় হাত বুলাতে থাকল‚ “প্লিজ… প্লিজ‚ ভয় পেয়ো না! ভুল বুঝো না আমাকে‚ প্লিজ! আল্লাহর কসম‚ আমি তৃতীয়বারের মতো কোনো অন্যায় করতে ডেকে আনিনি তোমাকে। যা করেছি‚ তার খেসারতই সারা জীবনভর দিয়ে যেতে হবে। এরপর আবারও কিছু করব! তোমার চোখে আবারও ঘেন্না দেখার মতো মানসিক শক্তি আমার হবে না।”

ছটফট করে উঠে সানা সরে এল ওর বুক থেকে। সে সময়ে শারফান জলদি বলে উঠল‚ “আমাকে তোমার আব্বু মারছে শুনে তুমি আমাকে বাঁচাতে ছুটে আসো কিনা‚ শুধু এটাই দেখতে চেয়েছিলাম। তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম‚ আমার জন্য তোমার ভালোবাসা তুমি আটকে রাখতে পারবে না কখনো।”

ভয়টা কাটলেও রাগটা আর কমল না সানার। কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে কান্না রুদ্ধ গলায় বলল‚ “আজকে শেষবারের মতো কিছু কথা আপনাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি। আপনার জন্য ভালোবাসা থাকুক বা না থাকুক‚ আমি আপনাকে মেনে নিতে পারব না। কোনো না কোনো সময়‚ বা হয়ত আপনার থেকে কোনো কারণবশত কষ্ট পেলে আমার সেদিন আবারও মনে পড়ে যাবে আপনার হিংস্রতার কথাগুলো। তখন আমার কষ্ট হবে সেই সব মনে চাপা রেখে আপনার সঙ্গে ভালো থাকাটা। আপনাকে না মানতে পারার আরও একটা কারণ বলি‚ আজকে আপনি আমার আব্বুর কাছে যতটা স্নেহ পাচ্ছেন‚ ভবিষ্যতে কোনোভাবে যদি আব্বু জেনে যায় সবটা‚ সেদিন আপনার সাথে তার সম্পর্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আপনি জানেন না। প্রথমত বিশ্বাস ভাঙার কষ্ট পাবে আব্বু৷ সে না পারবে সইতে আর না পারবে কিছু বলতে৷ সেদিন আমিও তার চোখে নিচে নেমে যাব। কারণ সে এই প্রশ্নটা করবে‚ আমি কেন তাকে কিছু না জানিয়ে আপনাকে বিয়ে করলাম? কীভাবে আপনাকে গ্রহণ করতে পারলাম আমি? আপনিও তো মুখোমুখি হবেন তার প্রশ্নের৷ কী জবাব দেবেন আপনি? শুনুন‚ আপনি চলে যান৷ শুধু শুধু এখানে পড়ে থেকেন না। আপনার কোনো না কোনো কাজ‚ কোনো ব্যবহার আজকের মতো ভবিষ্যতেও আমাকে মনে করিয়ে দেবে ওই দিনগুলোর কথা। আমি নিজে তখন না সুখী হতে পারব‚ আর না আপনি হবেন। আমার জন্য আসা বিয়ের প্রস্তাবটা আপনিই ভেঙে দিয়েছিলেন বোধ হয়! এমনটা আর করবেন না৷ আমি মনে করি‚ আপনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক না হলেই আমি ভালো থাকব৷ আমার ভালো থাকাটা যদি আপনার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট না হয়‚ তাহলে থেকে যেয়েন।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকল সানা। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজাটা খুলতে গেলেই স্থবিরতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শারফান তখন বলে উঠল‚ “তোমার ভালো থাকাটা অবশ্যই আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট। কিন্তু তুমি কি একবার সুযোগ দিতে পারতে না আমাকে? ভবিষ্যতে না গিয়ে ভবিষ্যতে কী হবে তার আশঙ্কায় তুমি কী করে আমাকে চলে যেতে বলছ? তোমার আব্বুর মুখোমুখি যদি হওয়ায় লাগে‚ আমি তার থেকেও ক্ষমা চাইব। তার মেয়েকে আমি ভালো রাখতে পারলে সে কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। আমি চিনেছি তাকে। সে তোমার মতো অবুঝ না‚ বোকা না। তুমি নিজের ফিলিংস‚ নানান দ্বিধাদ্বন্দ‚ সব কিছুকে রং জাজমেন্ট করছ‚ সানা৷”

“আমার ফিলিংস‚ আমার ভাবনাচিন্তা কী‚ সেটা আমার থেকে ভালো আপনি জানেন না”‚ ঔদ্ধত্যের ভঙ্গিমায় সানা কথাটা বলে কতক্ষণ দুজনই চুপ থাকল একে অপরের দিকে চেয়ে৷ তারপর নীরবতা ভেঙে সানা শান্ত সুরে বলল‚ “আমাকে আর আকটাবেন না। যেতে দিন প্লিজ!”

“যাও… চলে যাও”‚ সহসাই চেঁচিয়ে উঠল শারফান ‚ “ছেড়ে দিলাম‚ যাও…! ভালো থাকো তুমি তোমার মতো। আসব না আর কোনোদিন। ভালোবাসা! ভালোবাসার গুষ্টি মারি!” শেষ গালিটা দিয়েই দরজার পাশে থাকা জুতোর র‍্যাকে লাথি মেরে বসল।

সানা চমকাল খুব। কিন্তু মানুষ জানাজানির ভয়ে সে সত্যিই আর দাঁড়াল না। শেষবারের মতো শারফানকে দেখে নিয়ে বেরিয়ে গেল দ্রুত৷ আর তা দেখেই যেন শারফানের রাগটা সর্বোচ্চ সীমা পেরোলো।

গত একটা মাসের মতো সে এতখানি ধৈর্যশীল‚ এতখানি শান্ত কোনোদিনও হতে পারেনি‚ রাগ দমন করা শিখতে পারেনি। কিন্তু যা কিছু সে অর্জন করেছিল‚ আজ সেই সব কিছু নিঃশেষ হয়ে গেল আবার৷ ধৈর্যের পাহাড়টুকু ওর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ধসে পড়ল যেন। কিছুক্ষণ আগে যে রডটা দিয়ে আঘাত করার শব্দটা করেছিল‚ সেটা পায়ের কাছেই পড়ে ছিল। চোখের পলকে তা তুলে নিয়ে ঘরের মধ্যে তুফান ঘটিয়ে বসল। একটা একটা করে ঘরের প্রতিটি জিনিস ভেঙে চুরমার করতে লাগল। সেই বিকট শব্দে ওপর তলার‚ নিচ তলার সকল ভাড়াটে জড়ো হয়ে গেল৷ কাউকে ভেতরে আসার সুযোগ দিল না সে৷ দরজা আটকে সবটা তছনছ করা হয়ে গেলে তারপর থামল সে। ততক্ষণে পুরো মহল্লার মানুষ জড়ো হয়ে গেছে বিল্ডিংয়ের নিচে৷ শাফিউল সাহেবের কাছেও খবর পৌঁছে গেছে ইতোমধ্যে। কিন্তু তিনি ঢাকা। তাই দ্রুত ফোন করে দিলেন অনি‚ সাদ্দাম‚ সোহান‚ ওদেরকে৷ ওরা এসে যখন পৌঁছাল‚ শারফানকে তখন পাওয়া গেল না। তার আগেই শারফান বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে৷

সে রাতে ওর কোনো হদিস আর পেল না কেউ। ফোনটা পর্যন্ত ভেঙেচুরে ফেলে গিয়েছে সে।

মোস্তফা সাহেব সেদিন বেশ রাত করে বাড়ি ফেরেন। হঠাৎ করে শারফানের এই আচরণ জেনে প্রথমে খুব অবাক হলেও তারপর কী মনে করে যেন সানাকে খেয়াল করেন তিনি৷ বেশ অস্থিরতা আর চিন্তা দেখতে পান মেয়ের চেহারায়৷ কান্নাও করছিল সানা‚ তাও বুঝতে পারেন ওর চোখের ভেজা পাপড়ি দেখে৷ সে রাতে কিছু জিজ্ঞাসা না করলেও পরদিন সকালে নাজমা বেগমকে কথা বলতে পাঠান তিনি৷ কিন্তু মায়ের প্রশ্নের কোনো সঠিক জবাব দেয়নি সে। যতটা সম্ভব সব গোপন করে যায়।

***

আগস্টের শেষ ভাগ।
বর্ষার জল এখনো নদীর বুকে টলমল করছে। আকাশে পূর্ণিমা চাঁদ। যেন রুপার থালা তুলে দিয়েছে কেউ রাতের আকাশে। চারদিক সেই রুপালি আলোয় ভরে উঠে দেখতে লাগছে যেন মাঠ-ঘাট‚ নদী-নালা‚ গাছপালা‚ সবই আলোয় ধোয়া।

নদীর ধারে বিশাল একটি আমগাছ। গাঢ় সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে নদীর কিনারে। ছায়াগুলো জলের ওপর লম্বা হয়ে পড়ে আছে। মাঝেমধ্যে হালকা বাতাস এসে পাতাগুলো দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে‚ আর আলো-ছায়ার ঢেউ খেলছে জলের বুকে। আমগাছের পেছনে বিস্তৃত এক মাঠ৷ ভেজা ঘাসের ডগায় কিছুক্ষণ আগে থেমে যাওয়া ঝিরিঝিরি বৃষ্টির জল শিশিরের মতো জমে আছে। মাঠের পাশ দিয়ে চলে গেছে চিকন রাস্তা। যেখানে ভিজে মাটির হালকা সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে। রাস্তার ওপারে গ্রামের বসতবাড়ি‚ বাঁশঝাড় আর আম-কাঁঠাল গাছের সারি। প্রতিটি ঘরের চালে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। যেন সাদা কাপড় বিছিয়ে রাখা। আর দূরে কোথাও ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক… মাঝে মাঝে নদীর ছলছল শব্দ… সব কিছু মিলিয়ে রাতটা এক মোহনীয় সৌন্দর্যে ডুবে আছে। যে চাঁদনি রাত শুধু দেখা যায় না… শোনা যায়‚ অনুভব করা যায় বাতাসে‚ আলোতে‚ জলে আর ছায়ায়।

“কীরে‚ তোর মন কোথায়? কুঁচিগুলো ধর!” বিরক্ত হয়ে সানাকে বলে উঠল দিনা‚ “এত সুন্দর শাড়িটা! পরিয়ে দিলাম তখন কত সুন্দর করে। আবার খুলতে গেলি কেন?”

চোখে-মুখে প্রসাধনী‚ সিঁদুর লাল শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে ঠোঁটে রাঙা লিপস্টিক‚ আর চুলগুলোকে খোঁপা করে ঘাড়ের ওপর রাখা—মাথায় ঘোমটাটা তুলে দিলেই যেন সদ্য বিয়ে হওয়া নতুন বউ সানা। অথচ কেউ ওর চোখে চোখ রাখলেই দেখতে পেত ওর হৃদয়ের দহন। মায়ের কড়া শাসনে আর আদর-যত্নে স্বাস্থ্য ভাঙেনি‚ চোখের নিচে কালো ছায়াও নামেনি ঠিকই। কিন্তু বুকের ভেতর বসত করা চঞ্চল মনটা ওর মরে আছে কতগুলো দিন যাবৎ! কেউ তা জানে না।

শাড়িটা ঠিকঠাক করে দিয়ে দিনা উঠে পড়ল। ওর আঁচলটাও ঠিক আছে কিনা তা দেখার পর বলল‚ “চল এবার‚ বের হই।”

“আমি বাড়ি যাব রে। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না”‚ কেমন দুর্বলই শোনাল সানার কণ্ঠটা৷

কিন্তু দিনা তবুও পাত্তা দিল না৷ উলটো ধমক দিয়ে বলল‚ “কোনো বাহানা দিবি না‚ সানা৷ দিন দিন ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছিস। কোথাও আসিস না‚ বাসা থেকে বের হোস না‚ বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন গেলেও ঘরে বসে থাকিস‚ কথা বলিস না কারও সঙ্গে৷ এমন অসামাজিক হয়ে গেলি কেন হঠাৎ? সবাই কী বলাবলি করে এখন তোকে নিয়ে‚ তা শুনিস না? কত আজেবাজে কথা রটাচ্ছে নিজেদের ভেতরের মানুষই। এরকম চলতে থাকলে ভালো একটা ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসবে? আসার পরই তোর এলাকা মানুষ ভেঙে দেবে‚ যখন খোঁজ নেবে তোর সম্পর্কে৷ কাকা-কাকির কথা না ভাবিস‚ মেহার কথা তো ভাববি! তোকে দিয়ে তো মানুষ ওকেও বিচার করবে৷ যে বড়োটাও যেমন‚ ছোটোটাও তো তেমনই হবে।”

“এসব কথাবার্তা বলার জন্য আমাকে নিয়ে আসছিস তুই?” বিরক্তিতে কপালে ভাঁজ পড়ল সানার‚ “রাত বেশি হয়নি৷ আব্বুকে ফোন দিচ্ছি‚ বাড়ি যাব আমি।”

“আমার ভুল হয়ে গেছে‚ বোন”‚ কপট ক্ষমা চেয়ে হাতজোড় করল দিনা‚ “আমি আর কিছু বলতেছি না৷ যাওয়ার কথা বলিস না আর৷ চল‚ বাইরে বের হই। মনটা ভালো হয়ে যাবে৷ বাইরে আজকে জ্যোৎস্না ফুটছে অনেক।”

“আমার সত্যিই ভালো লাগছে না এই শাড়ি পরে‚ এত সাজগোজ করে। পিকনিকে এরকম বিয়ের সাজ কবে থেকে দেয় মেয়ে মানুষ! তাও যদি কোনো ভালো রিজন থাকত।”

“তুই তো আজ-কাল নিরামিষ হয়ে গেছিস। মেয়ে মানুষের সাজগোজ করার জন্য‚ শাড়ি পরার জন্য কোনো রিজন থাকতে হবে কেন? কোথায় লেখা আছে তা?”

কথা বলতে বলতেই ওরা দুজন বের হলো ঘর থেকে৷ রওনা হলো সামনের রাস্তাটার দিকে। বিদ্যুৎ নেই বলে সবাই হাঁটতে বের হয়ে গেছে বাইরে। কেবল সানার শাড়ি ঠিক করার জন্য ওরাই থেকে গেছিল।

এখন দিনার শ্বশুরবাড়িতে সানা আর মেহা৷ নিশাও এসেছে। সবগুলো দেবর‚ ননদ আর নিজের ভাই-বোনদের নিয়ে দিনা পিকনিকের আয়োজন করেছে আজ। সেই সাথে পরিকল্পনা ছিল বোনেরা আর ননদেরা সবাই মিলে এক রঙা লাল শাড়ি পরবে আর ছবি তুলবে। কিন্তু ছবি আর তোলা হয়নি বৃষ্টির জন্য। তবে পিকনিকের রান্নাবান্না শেষ। বিদ্যুৎ এলেই সবাই খেতে বসবে এক সঙ্গে।

হাঁটতে হাঁটতে মেহাদের কাছে পৌঁছে গেল ওরা দুজন। গল্পে মশগুল সকলে৷ দিনা আর ওদের কাছে গেল না সানাকে নিয়ে৷ অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ উশখুশ করার পর সে হঠাৎ বলে উঠল‚ “সানা‚ একটা কথা বলব তোকে।৷ শুনে রাগ করবি না তো?”

সানা নির্লিপ্ত চোখে চাইল। কোনো কিছুতেই আগ্রহ আসছে না ওর। বাড়ি ফিরে নিজের ঘরটাই যেতে পারলে বড়ো বাঁচা বাঁচত।

ওর স্বাভাবিক চাউনিটা দেখে দিনা বলল‚ “তোর আমার সম্পর্ক বোনের থেকেও বান্ধবী বেশি। তাই কথাটা তোকে আগেভাগে জানিয়ে রাখা উচিত বলে আমার মনে হলো৷ যাতে পরে দোষ না দিতে পারিস আমাকে।”

বিরক্ত ক্রমাগত বাড়ছেই সানার। বলল‚ “এত ঘুরিয়ে নাক দেখাচ্ছিস কেন? সরাসরি বল যা বলার!”

“সাদ্দাম ভাইয়ারও বিমানবন্দরে চাকরি হইছে‚ শুনছিস তো। ইব্রাহীমের মতোই কাস্টমস অফিসার৷ সেদিন সবাই তোদের বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে আসার পর সাদ্দাম ভাইয়ার জন্য তোকে পছন্দ করছে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি। আজকে তোকে দেখার জন্যই আমার সব চাচা শ্বশুর‚ চাচি শাশুড়ি আসছে বাড়িতে। সবারই পছন্দ হইছে তোকে। মনে হয় কালকেই কাকার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাবে আমার শ্বশুর।”

একদম সঙ্গে সঙ্গেই থমকে পড়ল সানার পা দুটো। দিনার কথাগুলো শোনার পর চট করেই একটা বিষয় আজ মাথাতে ঢুকল ওর৷ দিনারা ওদের বাড়িতে দাওয়াত রক্ষা করতে আসার পর দিন থেকেই মায়ের মুখে একবার সাদ্দামের প্রসঙ্গ শুনেছিল সে। মামির সঙ্গে ফোনে আলোচনা করছিল সাদ্দামকে নিয়েই৷ কিন্তু ইদানীং মন উদাস থাকায় অত গুরুত্ব দেয়নি সেদিন বিষয়টা। তার মানে দু পরিবারেই ইতিবাচক মনোভাব আছে এ সম্পর্ক করা নিয়ে!

অথচ এখন অন্য কোনো পুরুষকে বিয়ের করার কথা ভাবলেই ওর দম আটকে আসতে চায় কেমন। যেদিন রাতে ওই সর্বনাশা লোকটা ভাংচুর করে একেবারে গায়েব হয়ে গেল‚ সেদিনের পর আজ একটা মাস হতে চলেছে হাসি কী‚ আনন্দ কী‚ তাই-ই যেন সে হারিয়ে ফেলেছে ছোট্ট এই জীবনটা থেকে৷ রাগের মাথায় বলা ওই কথাগুলো যে পরবর্তীতে নিজের ওপরই ভারী হয়ে পড়বে‚ এ কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিল সেদিন? পেলে কি আর তাড়িয়ে দিতে পারত? চোখের সামনে থাকতেও যাকে চোখ ফিরিয়ে দেখার ছটফটানি অনুভব হয়নি‚ তার বিদায় বেলার পর সেই ছটফটানি জাগবে মনে—এও তো আগাম বুঝতে পারেনি সে।

চাইলেও‚ না চাইলেও শূন্য পড়ে থাকা দোতলা ঘরের ওই জানালাতে‚ ব্যালকনিতে শারফানকে খুঁজে ফেরে ওর চোখদুটো৷ কোথায় আছে সে এখন‚ কেমন আছে… সত্যিই কি আর আসবে না কোনোদিন… ভুলে গেছে ওকে? এসব ভাবনাতেই ওর সারাটা দিন‚ সারাটা রাত চলে যায় যেন কোন দিক থেকে! তার খোঁজ জানার জন্য অনিকে ফোন করতে গিয়েও শেষে সামলে নেয় নিজেকে কতবার! এত চাপ লাগে আজ-কাল বুকের মধ্যে… অস্থির লাগে‚ যে এক দণ্ড শান্তি খুঁজে পায় না সে কারও কাছে গিয়ে! তাই তো নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে সে।

“সাদ্দাম ভাই কিন্তু খুব ভালো একজন মানুষ”‚ দিনা বোঝাল সানাকে‚ “হাসিখুশি একটা মানুষ। ওনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই কারও মন ভালো হয়ে যায়। আজকেই না হয় একটু বলে দ্যাখ তার সঙ্গে।”

স্তব্ধ বেশে দাঁড়িয়ে সানা‚ নুইয়ে রাখা দৃষ্টি জোড়া মাটিতে স্থির৷ দিনার কথার জবাবে বলল সে‚ “তুই একটু মেহাদের কাছে যা৷ আমি কিছুক্ষণ একা একা ভাবনাচিন্তা করব।”

“আচ্ছা চল‚ বাসায় দিয়ে আসি।”

চোখ তুলে সানা সামনে চাইলো৷ অদূরে নিরিবিলি ওই নদীর পারের আম গাছটাই গিয়ে চোখে পড়তেই হঠাৎ স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে উঠে এল‚ ওইখানেই দাঁড়িয়ে এক বিকালে ঝগড়ায় মেতেছিল সে শারফানের সঙ্গে। আর শারফান ব্যস্ত ছিল দুষ্টুমি করে কেবল ওকে খেপিয়ে তুলতে। বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল সানার। সেদিকে চেয়ে দিনাকে জানাল‚ “বাসায় যাব না৷ তোরা আশেপাশেই থাক। আমি একটু হেঁটে আসি ওই আম গাছের নিচ থেকে।”

দিনার উত্তরের অপেক্ষা করল না। রাস্তা থেকে মাঠে নেমে এল৷ আম গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়াতেই কত শত ভাবনা এসে হাজির হলো মনে! সবই শারফানকে ঘিরে৷ সে চলে যাওয়ার কদিনের মাঝেই পাড়ায় নতুন গুজব রটে গেল৷ সেই গুজবটা রটেছিল কাজের মহিলা নিকুর মায়ের মাধ্যমে। শারফান তাকেই নিজের বাসার কাজে নিযুক্ত করেছিল৷ মাঝেমধ্যে তার থেকেই ওর বিষয়ে হদিস নিত। তাই তার অমন অস্বাভাবিক বিদায়ের পর নিকুর মা ছড়িয়ে দিল‚ সানা আর সে সম্পর্কে যুক্ত ছিল৷ সেই সম্পর্ক ভেঙে গেছে বলেই শারফান রাগ করে ওভাবে চলে গেছে। এখন ওকে নিয়ে পাড়ার মানুষ নতুন গল্প পেয়েছে। তবে ভালো থেকে মন্দ কথাটাই শোনা যায় তাদের মুখে। সানার কেন জানি সেসবে আর খারাপ লাগে না৷ কারণটা যে একটুখানি হলেও সত্যিই। তারা কোনো সম্পর্কে না থাকলেও অস্বীকৃত ভালোবাসাটা যে ঠিকই ছিল।

কিন্তু এবার সময় এসেছে জীবনকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে নিয়ে যাওয়ার৷ এভাবে আর দিনগুলো কাটানো সম্ভব নয়৷ তার আগে একটাবার ওই পাগলটার খোঁজ জানা দরকার যে! কীভাবে জানবে তা‚ সেটা ভাবতেই সাদ্দামের কথা খেয়ালে এল। এতক্ষণে কেন তার কথা মাথাতে আসেনি‚ তার জন্য নিজের ওপরই খানিকটা বিরক্ত হলো সে। তারপর কল দিল দিনাকে। তাকে জানাল‚ সাদ্দামকে এক্ষুনি যেন পাঠিয়ে দেয় ওর কাছে।

মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর সাদ্দাম এল৷ মুখে জোরপূর্বক একটা মুচকি হাসি টেনে সানাকে জিজ্ঞেস করল‚ “কেমন আছ?”

“ভালো”‚ ভারী কণ্ঠে উত্তরটা দিয়ে সানা নিজে কোনো সৌজন্যপূর্ণ আচরণ দিল না। হঠাৎ সাদ্দামের দিকে তাকাতেই ওর মনে হলো‚ লোকটা কেমন অস্থির হয়ে আছে। ওর দিকে চোখ তুলে তাকাতে অবধি চাইছে না‚ তাই দাঁড়িয়ে ইতি-উতি করছে শুধু। বিয়ের কথা চলছে বলে লজ্জা পাচ্ছে না-কি? তার সঙ্গে বিয়ের কথাটা ভাবতেই কী বিশ্রীরকম অস্বস্তি লাগল ওর।

“শায়াফ কই আছে জানেন?” দেরি না করে আসল কথাটা জিজ্ঞেস করেই বসল সানা‚ “সে কেমন আছে?”

ঝটকা খেল যেন সাদ্দাম‚ সেভাবেই চমকে গিয়ে তাকাল সানার দিকে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না‚ সানা জিজ্ঞেস করছে শারফানের খবর! বিস্ময়টুকু নিয়েই উত্তর দিল‚ “আছে আপাতত দেশেই৷”

“আপাতত দেশেই মানে?” ভ্রু কুঁচকে ফেলল সে কথাটা শুনে।

সাদ্দাম উত্তর দিতে দেরি করল না‚ “ওকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে ওর বাপ। ও-ও আর থাকতে চাইছে না এখানে।”

হৃদয়ের গহিনে ঝড়টা বোধ হয় উঠল সানার। তার আভাস পাওয়া গেল ওর ভিজে ওঠা চোখজোড়ায়। সাদ্দাম যেন তা না দেখতে পায় চোখদুটো তাই জলদি নামিয়ে নিল। কিন্তু কান্নাটা যে ঠেকানোর উপায় নেই! ভেতরটা ভেঙেচুরে আসতে চাইছে।

“আপনি আসতে পারেন এবার”‚ কথাটা বলতে গিয়ে গলাটা কাঁপল ওর।

সাদ্দাম আরও কিছু বলতে চাইল। কিন্তু মুখটা সবে খুলতেই ফোনটা বেজে উঠল তার৷ আর কিছু বলা হলো না। চুপচাপ চলে গেল সে।

তারপরই সানা ঠোঁট চেপে ধরে কেঁদে ফেলল। একই সাথে কী যেন ভাবতেও লাগল। খু্ব বেশি সময় ভাবনাটা চলল না। কারণ‚ বেশি ভাবলেই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হবে ওর। মায়ের কাছে ফোন করল৷ নাজমা বেগম ‘হ্যালো’ বলতেই ওর আরও কান্না পেল৷ “আম্মু”‚ কাঁদতে কাঁদতেই ডেকে উঠল সে।

ওদিকে মেয়ের কান্না শুনে ভয় পেয়ে গেলেন নাজমা বেগম। তিনি অস্থির হয়ে “কী হয়েছে রে? সানা‚ কাঁদছিস কেন?” জিজ্ঞেস করতেই সানা একটুখানি সামলে উঠে তাকে জানাল‚ “আমি দিনার দেবরকে বিয়ে করব না৷ আগে যে প্রস্তাবটা এসেছিল‚ আমি রাজি ওই প্রস্তাবে।”

বেশ হতবুদ্ধি হলেন নাজমা বেগম‚ “কোন প্রস্তাব? আর কোনো প্রস্তাবই তো আসেনি।”

“আমার শেষ পরীক্ষার দিন যার কথা বলেছিলে‚ আমি তার কথা বলছি।”

মেয়ে শারফানের কথা বলছে এতদিন পরে এসে! তাও আবার কান্নাকাটি করে! ভারি অবাক হলেন নাজমা বেগম। সাদ্দামের প্রস্তাবটা শুনেই তবে রাজি হলো? সেসব আর এখন ফোনে জিজ্ঞেস করলেন না৷ ওকে কান্নাকাটি থামিয়ে শান্ত হতে বললেন। বাসায় ফিরে আসার কথাও বললেন‚ “তোর আব্বুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি৷ বাড়ি আয়‚ তারপর কথাবার্তা ঠান্ডা মাথায় বলা যাবে। মাস দুই আগের ফিরিয়ে দেওয়া প্রস্তাবে এখন রাজি হয়ে লাভ আছে? কীভাবে কী করা যায় তা ভেবে দেখা যাবে৷ আগে বাড়ি আয়।”

সানার ভীষণ অসহায় লাগল এবার৷ এই প্রথমবার সে অনুভব করল কিনা শারফানকে হারিয়ে ফেলার ভয়টা! বারবার কান্নায় ভরে ওঠা চোখদুটো মুছতে মুছতে নিজেকে খুব বকতে লাগল মনে মনে৷ বহু আগেই তো উপলব্ধি করেছিল সে শারফানের প্রতি বেঁচে থাকা সেই পুরনো টানটা! কিন্তু সেই টানটার প্রতিই ভরসা পায়নি সে। ভাবত‚ সময় গেলে একদিন ওই টানটুকু ওর ফুরিয়ে যাবে। ভরসা পেত না শারফানের ভালোবাসাকেও। ভাবত‚ কেবল অপরাধবোধ থেকেই মানুষটার মনে হচ্ছে ওকে ভালোবেসে ফেলেছে হয়ত। কিন্তু সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার পর দেখা যাবে‚ স্রেফ ঝোঁকের বশে বা আবেগে পড়েই ওকে চেয়েছিল। কিন্তু ও সত্যিই বোকা‚ পৃথিবীর সব থেকে বড়ো বোকা। ভুল ভাবনায় ডুবে থেকে আজ নিজেই নিজের কপালে দুঃখ লিখে ফেলল সে। এখন ওই খেপাটে পাগলটা ছাড়া কী করে অন্য কাউকে মেনে নেবে?

ঠোঁট ভেঙে সে কেঁদে উঠতেই হঠাৎ রাস্তার দিক থেকে চাকার ঘর্ষণের তীক্ষ্ণ এক শব্দ এসে কানে বিঁধল ওর। নির্জন পরিবেশে শব্দটা ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে৷ কান্নায় ডোবা ঝাপসা দৃষ্টিতে সে সামনে দেখল‚ একটা কালো গাড়ি ব্রেক কষেছে। চোখ দুটো মুছে নিয়ে ভালোভাবে তাকাল আবার।

গাড়ি থেকে নামল এক পুরুষ। পরনে সাদা রঙা সুট আর কালো রঙা প্যান্ট। দড়াম করে গাড়ির দরজাটা বন্ধ করল সে। মনে হলো রাগের সঙ্গে ধাক্কাটা দিল। তারপর হঠাৎ গটগটিয়ে নেমে পড়ল মাঠের মধ্যে। আসতে লাগল আম গাছের দিকেই। তা দেখে কপালের মাঝে ভাঁজ পড়ল সানার—সে কি ঠিক দেখছে? লোকটা হনহনিয়ে কিছুটা এগিয়ে এল যখন‚ মুহূর্তেই হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল ওর। আর কোনো সন্দেহ নেই নিজের চোখের প্রতি। ভীষণ বিস্ময়ে ফিসফিসিয়ে উঠল‚ “শায়াফ!”

তারপরই আবার ভাবল‚ সত্যিই তো দেখছে তাকে? না-কি জিন-ভূত হবে? নয়তো হঠাৎ করে এখনই উদয় হলো কোথা থেকে‚ কী করে?

শারফান এসে থামল একদম ওর কাছাকাছি। মাত্র আধ হাতের দূরত্ব রাখল মাঝখানে৷ সানার ঠোঁটজোড়া কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে রইল তাকে এভাবে চোখের সামনে হাজির হতে দেখে। দূর থেকে সুটের রংটা সাদা মনে হলেও এটা হালকা আইভরি রঙা আর ফরমাল প্যান্টটা ধূসর‚ সুটের নিচে থাকা শার্টটা প্যাশমিনা গোলাপি রঙা।

অবিশ্বাস্য চোখে সানা তাকে আপাদমস্তক দেখার মাঝেই আচমকা শারফান বর্জ্রকণ্ঠে বলে উঠল‚ “কত বড়ো সাহস তোমার! আমাকে রিজেক্ট করে আমারই বন্ধুকে বিয়ে করার কথা ভাবো? আমাকে দেখিয়ে আমাকে জ্বালা দিতেই সাদ্দামকে বিয়ে করতে চাইছ‚ না? এত কুটিল বুদ্ধি! আর এত বড়ো আস্পর্ধা পাও কার থেকে? আমিই মনে হয় বেশি সহজ হয়ে গিয়েছিলাম। যার জন্য এই সাহসটা দেখাতে পারলে! আমাকে দূরছাই করেছ‚ মেনে নিয়ে চলে গেছি৷ কিন্তু আমাকে এভাবে অপমান করতে চাইলে খোদার কসম…”‚ বলতে বলতে গলার স্বর শারফানের উঁচু হতে লাগল‚ “আরেকবার তোমাকে আমার নোংরা চেহারা দেখতে হবে৷ দুনিয়ার যাকে খুশি তাকে বিয়ে করা মারাও! শুধু আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ত্রিসীমানায় ঢুকতে এসো না বলছি!”

“আমি কখন আপনার বন্ধুকে বিয়ে করতে চেয়েছি?” বিস্ময়ে আর দুঃখে গলাটা বুঁজে আসতে চাইল সানার।

শারফান সে কথার উত্তর না দিয়ে আশপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে খুঁজতে লাগল। সেই ফাঁকে সানা আবারও বলল‚ “আপনার বন্ধু আমাকে বিয়ে করতে চাইছে‚ এ কথা তো আমি আজই জানলাম।”

প্রথম বাক্যটা শোনা মাত্রই শারফান মুহূর্তের মধ্যে মুখ ঘুরাল ওর দিকে৷ তার জ্বলন্ত চোখদুটো দেখে একটু থমকাল সানা।

ধমকে উঠল শারফান‚ “তোমাদের জন্মের বিয়ে পড়াব আমি! দাঁড়াও…” বলেই চেঁচিয়ে ডেকে উঠল সাদ্দামকে‚ “এই সাদ্দাম…. কই লুকিয়েছিস‚ বান্দির ছা? ভালো মানুষের বাচ্চার মতো আমার সামনে আসিস কিন্তু।”

সাদ্দাম সত্যিই লুকিয়ে আছে। শারফানের হেঁড়ে গলার ডাক মনে হয় পাশের গ্রামগুলোতেও পৌঁছে গেছে। আর সে কি রাস্তায় থেকে না শুনে পারে? কিন্তু ভুলেও উত্তর নিল না।

আর শারফানও জানে‚ সে আশেপাশেই কোথাও আছে। উত্তর না নেওয়ায় রাগটা তার তরতর করে বাড়ল। একটু সামনে এগিয়ে আবারও চেঁচিয়ে উঠল‚ “আমি কি তোর বাড়ি আসব‚ কুত্তার…”

গালিটা সম্পূর্ণ করার আগেই সানা চেঁচিয়ে উঠে বলল‚ “আরে থামুন! কী শুরু করলেন? মানুষ জড়ো করে ফেলবেন না-কি? কে বলল আপনাকে‚ আমি বিয়ে করতে চাইছি?”

“চোপ্! নাটক মারাবে না একদম!” ধমকটা দিয়েই সানার কাছে ফিরে এল। হুমকিস্বরে বলল‚ “তুমি চৌদ্দটা বিয়ে করো৷ আটকাতে যাব না আমি৷ শুধু সাদ্দামের থেকে দূরে থাকবে বলে দিলাম! ওর ব্যবস্থা তো আজকেই করে যাব।”

কথাটা বলে আর দাঁড়াল না সে৷ যেতে যেতে চেঁচিয়ে সাদ্দামকে ডাকল আর হুমকি দিল‚ “বান**দ‚ আমার সামনে আয়! টেনে একেবারে ফেড়ে ফেলব তোকে!”

“প্লিজ… মাথা গরম করে কিছু কোরেন না‚ শায়াফ”‚ ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ল সানা। পেছন থেকে চিৎকার করে বলল তাকে‚ “আমি সাদ্দামকে জীবনেও বিয়ে করব না৷ আম্মুকে তো একটু আগে আপনার জন্য রাজি বলে দিয়েছি।”

বেশ কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল শারফান। সানার বারণ শুনে না দাঁড়ালেও শেষ কথাতে আটকা পড়ল সে। ভুল শুনল কিনা‚ তা বুঝতে পারল না। ফিরে তাকাল সানার দিকে‚ “কী বললে?”

“ঝামেলা কোরেন না প্লিজ”‚ মিনতিপূর্ণ কণ্ঠে সানা বলল৷ “আমি একদম রাজি না আপনার বন্ধুকে বিয়ে করতে‚ বিশ্বাস করুন৷ আম্মুকে একটু আগেই ফোন করে বলেছি তা।”

“এটা না‚ এর আগে কী বললে?” ধমকে জিজ্ঞেস করল শারফান।

দ্বিতীয়বার সেই কথাটা উচ্চারণ করতে লজ্জায় পড়ল সানা। আর শারফান হলো অধৈর্য। আবার ফিরে এল ওর কাছে। জিজ্ঞেস করল‚ “তুমি তোমার মাকে কী বলেছ?”

“বলেছি…”‚ মুখটা নুইয়ে বিব্রত স্বরে জানাল সানা‚ “আমি রাজি আপনার প্রস্তাবে।”

“ফাজলামি?” আস্তে করেই কথাটা বলল শারফান। বিশ্বাস গেল না একদম৷ “এখন ভয় লাগছে আমাকে‚ না? আমাকে ঠেকাতে এখন যা কিছু তাই বলে দিচ্ছ‚ আর সেটা আমি কানার মতো বিশ্বাস করে নেব!”

আহত চোখে চাইল সানা‚ “মিথ্যা বলছি আমি? সত্যিই আম্মুকে ফোন করে কথাটা বলেছি‚ কসম! সাদ্দাম ভাইয়ের বাড়ি থেকে কাল প্রস্তাব নিয়ে যাবে শুনেই আমি দ্রুত জানিয়ে দিয়েছি আম্মুকে।”

শারফান কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ওকে বলল‚ “আবার ফোন করো। আমার সামনেই বলো তো দেখি! তাহলেই বিশ্বাস যাব। নয়তো এখনই গিয়ে সাদ্দামকে পাড়া দিয়ে ধরে পাছা দিয়ে ওর নাড়িভুঁড়ি বের করব আমি।”

রাগটা যে মিথ্যা নয়‚ সানা তা ভালো করেই টের পেল। ফোনে কাজ করতে গিয়ে স্নায়বিক উত্তেজনায় হাতটা কাঁপতে লাগল বেচারির৷ শারফান তখনো সেই ধারাল দৃষ্টিতে দেখছিল ওকে। ফোনটা সত্যিই ওকে করতে দেখে বলল‚ “তোমার বাপ কালকের ভেতরই আমার বাপকে ফোন করে যেন বিয়ের কথা বলে‚ এ কথাও বলতে হবে কিন্তু।”

“ছিঃ ছিঃ! এটা বললে কী ভাববে আব্বু-আম্মু?”

“তা আমার দেখার বিষয় না। বলতে না পারলে…”

কথাটা শেষ করার আগেই সানা কথা বলে উঠল ফোনে। রিসিভ করেছেন নাজমা বেগম। শারফান তখন ফোনটা হঠাৎ টেনে নিয়ে স্পিকার বাড়িয়ে দিল। থতমত খেল সানা। লজ্জা আর ভয়ে থেমে থেমে মাকে সে বলল‚ “আম্মু‚ ওই ব্যাপারে আব্বুকে বোলো যেন…” এটুকুর পরের কথাটা মুখে নিতে গিয়েই আটকে পড়ল সে। এমন নির্লজ্জের মতো নাকি নিজের বিয়ের কথা বলতে হবে আজ! শারফানের দিকে তাকাল একবার। তার কঠিন চাউনি দেখে চোখদুটো বন্ধ করে হড়বড় করে মাকে বলে দিল‚ “কালই যেন শাফিউল আঙ্কেলকে কল করে বলে দেয় আব্বু আমার রাজি হওয়ার কথাটা।”

“এত পাগল হয়ে গেলি কেন হঠাৎ?” তাজ্জব হয়ে গেছেন নাজমা বেগম। ফোনের ওপাশ থেকে কটাক্ষ করে বললেন‚ “তারা প্রস্তাব পাঠাল‚ ছেলেটা এসে পিছু পিছু ঘুরল কীভাবে‚ তখন রাজি হলি না! আর এখন পাগল হয়ে যাচ্ছিস তার জন্য… লজ্জাশরমও খেয়ে ফেলেছিস একদম!”

খট করে ফোনটা কেটে দিল সানা৷ ওভাবে কেন বলতে গেল মা? কী ভাবছে এখন শারফান! ছিঃ! লজ্জাটা এত বেশি লাগছে ওর‚ শারফানের দিকে একটিবারের জন্যও আর তাকাল না। তাকে পাশ কেটে চলে যেতে চাইলেই সে পথ রোধ করল। ওকে মৃদু ঠেলে আম গাছটার সাথে দাঁড় করাল। আলো-ছায়ার খেলা চলতে লাগল তখন সানার মুখের ওপর। কিন্তু শারফানের মুখখানি চাঁদের আলোয় পুরোপুরি স্পষ্ট৷ সানা তাকাল না বলে জানলও না‚ তার ঠোঁটের প্রান্তে ঢেউ খেলছে এক টুকরো বাঁকা হাসি।

“সত্যিই বলেছিলে তাহলে?” কণ্ঠে একটু আগের ক্ষিপ্ততা আর নেই শারফানের৷ মৃদুস্বরে বলল‚ “কী বলেছিলে? বলো তো শুনি।”

“মরে গেলেও আর বলতে পারব না”‚ হাঁসফাঁস করে ওঠা সুরে সানা উত্তরটা দিল। আর লাজুক দৃষ্টিটা ফেলে রাখল শারফানের পায়ের দিকে।

জোর করল না আর শারফান। ওর মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে আজকের তারিখটা হৃদয়ে গেঁথে রাখল—বাইশে আগস্ট। এর মাঝে হঠাৎ লক্ষ করল‚ একদম ভিন্ন বেশে আজ সানাকে দেখছে সে—লাল শাড়ি! ওর পা থেকে মাথা অবধি পরখ করতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা হলো পড়ল তার। কিন্তু হঠাৎ কী মনে হতেই বলে উঠল‚ “কার জন্য সেজেছ তুমি? সাদ্দামের জন্য লাল শাড়ি‚ চুরি পরেছিলে আজ?” ভাবতেই মাথাটা খারাপ হয়ে গেল যেন। দাঁতে দাঁত চেপে বলল‚ “আমি ওকে সত্যি আজ গিলেই খাব!”

“ধুরঃ!” বিরক্ত হলো সানা‚ “কী সব ভাবেন! ওনার জন্য সাজতে যাব কেন? পিকনিক ছিল বলে সবাই-ই শাড়ি পরে সেজেছি।”

একটু শান্ত হলো শারফান৷ সাজটাই ওকে সত্যি একদম বউয়ের মতো লাগছে দেখে ওর কাছে আসার লোভ সামলাতে পারল না একদম৷ তাতে আরও মিশে দাঁড়াল সানা গাছের গায়ে। মুগ্ধতার আবেশে বুঁদ হয়ে কতক্ষণ চুপচাপ দেখল ওকে শারফান। বুকের মধ্যে তখন ঢিপঢিপ করতে থাকল সানার। অন্যদিকে ফিরে নিচুস্বরে বলে উঠল‚ “সরে দাঁড়ান৷ কেউ দেখলে খারাপ কিছু ভাববে।”

বরং অবাধ্য হলো শারফান৷ আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে সানার বাহু ঘেঁষে ডান হাতটা ঠেকাল গাছের গায়ে। তারপর ওর মতোই নিচুস্বরে বলল‚ “এতদিন আমাকে কী পরিমাণ ভোগালে তুমি! কী করব এর জন্য? সেদিন থাপ্পড়টা দিয়ে সম্মতিটাও তো দিয়ে দিতে পারতে।”

“কী করে দিতাম? চলে যাওয়ার পরই তো বুঝলাম ভালো করে…”

কথাটা শেষ করার আগেই শারফান বলে উঠল‚ “আর এর মাঝেই ফ্লাইটে চড়ে বসতাম যদি? মিনিমাম পাঁচ বছরের নিচে দেশেই ফিরতাম না। তখন কী হত?”

“আপনি সত্যিই বিদেশ চলে যেতে চেয়েছিলেন?”

“জানতে তুমি? তাও একবার খোঁজ নাওনি?”

“আজকেই জানলাম সাদ্দাম ভাইয়ের থেকে৷ জিজ্ঞেস করতেই বলল আপনার বাবা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে আপনাকে৷ তারপরই তো আম্মুকে কল করে বললাম।”

“তুমি নিজে থেকে জিজ্ঞেস করেছিলে?”

“হুঁ।”

শারফান মুচকি হাসল। তা দেখে লজ্জায় আবার অন্য দিকে চাইল সানা। জিজ্ঞেস করল তারপর‚ “আপনি ঠিকই আমার খোঁজ রাখতেন‚ তাই না?”

“তোমার নামটাও যাতে না শুনতে হয়‚ তোমার বিয়ের খবর যেন কানে না আসে‚ সে ব্যবস্থা নিচ্ছিলাম আমি! আর বলছ খোঁজ রাখতাম?”

“তাহলে বন্ধুর সাথে বিয়ের খবরটা জানলেন কী করে?” কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে তাকাল সানা।

“সাদ্দামই জানাল দুপুরে ফোন করে। বলল আজকে ওর বাড়িতেও আসছ নাকি৷ মাথায় তো খুন চেপে গেল। কাজ ফেলে রেখেই ছুটলাম। পৌঁছানোর পর কল করলাম ওকে। তখন বলল তুমি ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছ৷ নিরিবিলিতে এসে নাকি কথা বলছ দুজনে।”

“এর জন্য ওভাবে তেড়েফুঁড়ে আসছিলেন?”

জবাব দিল না শারফান। সানা বলল‚ “তাহলে রাগছেন কেন বন্ধুর ওপর? উনি খবর না দিলে কি আজ জানতেন? না আসতেন?”

“ও তোমাকে বউ বউ করছিল ফোনে। এমনি এমনিই কি ওকে চো…”

গালিটা উচ্চারণের আগেই সানা বাধ সাধল‚ “এত নোংরা গালাগালি আর করবেন না প্লিজ।”

“আচ্ছা”‚ হাসল শারফান‚ “তোমার সামনে করব না।”

“আর সেদিন কী ভয়াবহ কাণ্ড করে গেছেন? বাড়িতে এসেও শুনতে পাচ্ছিলাম আমি। কী ভয় পেয়েছিলাম‚ আল্লাহ! নিজেকে কিছু করে বসেন কিনা ভেবেই আমার প্যানিক অ্যাটাক হতে যাচ্ছিল৷ রেগে গেলে ওরকম ঝড় তোলেন ঘরের ভেতর? আমি তো আপনাকে ওভাবে দেখলে ভয়েই নির্ঘাত মরে যাব। রাগটা কমাবেন প্লিজ!”

সেদিনের ভয়টা যেন এখনো রয়ে গেছে ওর মাঝে৷ তা স্পষ্টই শারফান দেখতে পেল ওর চেহারাতে। কিন্তু মায়া হওয়ার বদলে তার ভালো লাগল খুব। কারণ‚ তার ক্ষতি হওয়ার ভয় করছিল যে সানা! বিভোর হয়ে ওর ভীত-সন্ত্রস্ত মুখটা দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল‚ “আর কী করতে হবে‚ বলো!”

গা থেকে সিগারেটের তীব্র গন্ধটা আসছে দেখে সানা উত্তর দিল‚ “এত সিগারেট খান কেন? সিগারেট কমাবেন।”

মুখটা বুঁজেই হেসে ফেলল শারফান। বলল‚ “কমিয়েছিলামই তো‚ তোমার বাপের উপদেশে। তুমিই তো আবার সব লণ্ডভণ্ড করে দিলে। আচ্ছা… সেকেন্ড টাইম ট্রাই করব না হয়৷ তারপর? আর কী?” বলতে বলতে নজর গিয়ে থমকাল তার সানার রাঙা ঠোঁটজোড়ায়।

আর সানার তার ভালোমানুষি ভাব এবং বাধ্য ছেলে হওয়ার চেষ্টাটা দেখে হাসি পেল খুব। ঠোঁট চেপে হাসিটা আটকে উত্তর দিল‚ “ধমকটা কম কম দেবেন। কথায় কথায় ধমক দেওয়ার স্বভাব আপনার।”

কথাটা বলেই সে মুখ ফিরিয়ে চাইল শারফানের দিকে। অমনিই ধড়াস করে উঠল ভেতরটাই। আর একটু এগোলেই ছুঁয়ে ফেলত সে শারফানের ঠোঁটটা। এত কাছে কখন এল ছেলেটা? নিজের ঠোঁটের দিকে তার গভীর দৃষ্টিজোড়া লক্ষ করে আরও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল। আবারও কিছু সে ঘটাবে ভেবেই ঠোঁটদুটো ভেতরে ঢুকিয়ে নিল জলদি৷

তা দেখে সেখান থেকে চোখ তুলে ওর চোখে চাইল শারফান। ঠোঁটের কোণ বাঁকিয়ে হেসে বক্রোক্তি করল‚ “ভয় নেই। ন্যাড়া বেলতলা একবারই যায়।”

“কী?” বিব্রত স্বর সানার।

“বললাম‚ ন্যাড়াটা হলাম আমি৷ আর বেলতলা হলো এটা”‚ ইশারায় ওর ঠোঁটটা দেখাল শারফান।

এবার আর হাসি আটকাল না সানা। মাথা নুইয়ে হাসতে থাকলে আচমকা ওর হাতটা ধরে নিজের বুকের মাঝে ঠেকাল শারফান। চমকে উঠে তার দিকে চাইতেই সে বলল‚ “টের পাচ্ছ‚ কী লেভেলে লাফাচ্ছে যন্ত্রটা?”

হ্যাঁ‚ সানা টের পেল‚ ঠিক ওর মতোই কাঁপছে শারফানের হৃদয়টাও। ওর জবাব পাওয়ার অপেক্ষা না করে শারফান বলল‚ “আমাকে কারও কাছেই বাঁধা পড়তে না দেখে বন্ধুরা বলত আমার এই জায়গাটা নাকি শিল। তাই কারও জন্যই এখানে প্রেম জাগে না৷ তাহলে তোমার জন্য কী হলো?”

শেষে মজা করে বলল সে‚ “আমার তো এখন কাব্যিক করে বলতে মন চাচ্ছে‚ তুমি শায়াফের পাথর হৃদয়ে প্রেমের ফুল জন্ম দিলে। লাল একটা ফুল।”

কথাগুলো শুনে সানার হাসি এল না। কেমন গাঢ় চাউনি মেলে শারফানের চঞ্চল হাসিটা দেখতে দেখতে সে মনে মনে বলল‚ “আর আপনি যেন আমার ধ্রুবতারা। যতবার আপনাকে দূরে সরানোর চেষ্টা করেছি‚ ততবারই আপনি আরও দৃঢ়ভাবে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। শায়াফ‚ আমার মনে আপনার স্থান এখন চিরস্থায়ী। ঠিক ধ্রুবতারার মতোই। স্থির‚ অম্লান আর চিরন্তন।”
____________________

ফেসবুক ভার্সনের ইতি।
সর্বমোট শব্দসংখ্যা – ১৭৬০০০+