#বিষবিন্দু (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
আমার চাকরি চলে যাওয়ার পর বাবা, মা আমাকে স্ত্রী নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে বললেন। এতদিন চাকরি থাকা অবস্থায় কখনো সংসার আলাদা করার কথা উঠেনি। অথচ আজ যখন আমার হাত শূন্য তখন তারা আমাকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বললেন। এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে এই কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এতদিন খুব সামান্য পরিমান টাকা রেখে বাকি টাকা বাবার হাতে তুলে দিতাম। এই সংসারে খরচ করার জন্য। আর আজ যখন চাকরিটা নেই। কাজের জন্য এদিক সেদিক ঘুরছি সেই মূহুর্তে বাবা, মা আমাদের আলাদা হতে বললেন।
সন্ধ্যাবেলা বাবা, মা আমাকে তাদের ঘরে ডাকলেন৷ আমি তাদের ঘরে গিয়ে উপস্থিত হতে বাবা বললেন,“কোন নতুন চাকরির ব্যবস্থা করতে পারছো?”
“না। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। দেখি কতটা কী হয়।”
আমার মুখে এই কথা শুনে মা শান্ত গলায় বলে,“তোদের বিয়ের তো অনেক দিন হলো এবার আমি আর তোর বাবা ভাবছি, তোদের সংসারটা আলাদা করে দিবো।”
মায়ের কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। বিষ্ময়ের গলায় বললাম,“মা এসব কী বলছো তুমি?”
“তোর মা ঠিকই বলছে। অনেক তো হলো একসাথে থাকা। এবার তোর এবং তোর বউয়ের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত।”
বাবা খুবই স্বাভাবিক গলায় এই কথাটি বললেন। আমি একবার বাবা এবং একবার মায়ের দিকে তাকালাম। মায়ের চেহারা কিছুটা ভয় দেখা যাচ্ছে। আমার সাথে চোখাচোখি হতে মা মাথানত করে ফেললো। আমি আমার স্ত্রী প্রিয়ার দিকে তাকালাম। প্রিয়া অসহয় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে না পেরে বাবা, মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,“আপনার ছেলে এখন তো বেকার বাবা। এই অবস্থা আমাদের আলাদা করে দিলে আমরা সংসার চালাবো কিভাবে?”
“সেজন্যই তোমাদের আলাদা করে দিচ্ছি। দশদিন হয়ে গেলো রাফি চাকরি হারিয়েছে। এখন কাজ খুঁজেও পাচ্ছে না। আমার মনে হয় ঘাড়ে দায়িত্বের ভার নাই বলেই এটা হচ্ছে। যদি তোমাদের আলাদা করে দেই তাহলে পেটের দ্বায়ে হলেও কোন না কোন কাজ ঠিকই খুঁজে পাবে রাফি।”
বাবার এই কথার পর আমি কোন কথা খুঁজে পেলাম না। শুধু শান্ত গলায় বললাম,“মাত্র দশদিনে আমরা বোঝা হয়ে গেলাম?”
এই কথা বলে আমি এবং প্রিয়া বের হয়ে আসলাম। নিজেদের ঘরে এসে হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। আমার এমন অবস্থা দেখে প্রিয়া কিছুটা উপহাস করেই বলে,“তখন বলেছিলাম কিছু টাকা জমাও। আমাদের ভবিষ্যতের জন্য জমাও। তখন আমার কথা কানে নিলে না। কিন্তু এখন কী হলো? এখন ঠিকই তোমার বাবা, মা সুযোগ বুঝে পল্টি নিয়ে নিলো। যেই দেখলো সংসারে কোন টাকা দিতে পারবে না। সেই আমাদের আলাদা হতে বললো।”
আমি বাবা, মায়ের কথা শুনে এতটাই কষ্ট পেয়েছি যে এখন প্রিয়ার কথা আমার বিরক্ত লাগছে। প্রিয়া আমার বিরক্তি না বুঝে আবার বলে,“এখন যাও তোমার বাবার হাতে এতদিন যে টাকাগুলো দিয়েছো সেটা ফেরত চাও। নয়তো আমরা এখন চলবো কিভাবে? আলাদা হয়ে যাও বললেই হলো? তাও এই সময়ে।”
“প্লীজ থামো।”
আমি খুবই শান্ত গলায় কথাটি বললাম। আমার কথায় প্রিয়া আরও তেঁতে উঠলো। এবং কঠিন গলায় বললো,“থামবো কেন? বাবা, মাকে নিয়ে বলায় গায়ে লাগছে খুব? যে বাবা, মায়ের কথা শুনে গায়ে লাগছে সেই বাবা-মা কাল তোমাকে ঘাড় ধরে বের করে দিবে। এরাই আবার যেদিন তুমি চাকরি পাবে সেদিন তোমাকে টেনে নিয়ে আসবে। সবাই নিজের স্বার্থে আসে। স্বার্থ শেষ হলে সবাই এমনই করে। সেদিন আমার কথা শুনে কিছু টাকা যদি সেভিংস করতে। তাহলে আজকের দিনটা দেখতে হতো না।”
প্রিয়ার কথা বলার ভাষাটা কিছুটা কঠিন হলেও কথাগুলো সত্য। তাই তার কথায় প্রতিবাদ করার ভাষা খুঁজে পেলাম না। তবে আমি একটা বিষয় নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। হঠাৎ করে বাবা-মা আমাকে আলাদা করার কথা কেন বললো? শুধুমাত্র চাকরি চলে যাওয়া? সংসারে আর টাকা দিতে পারবো না তাই? সত্যি এই কারণে! এসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে সেদিনের কথা মনে পড়ে যায় যেদিন চাকরি হারিয়ে প্রথম বাড়িতে পা রাখি। আমি এতদিন অব্দি ঢাকা শহরে একটি চাকরি করতাম। সেখানেই থাকতাম। মাসে দুইবার বাড়ি আসলাম। আমার স্ত্রী প্রিয়া এখানে বাবা, মায়ের সাথে থাকতো। যদিও সেই সময়ে বাবা, মা আমাকে প্রিয়াকে নিয়ে ঢাকা যেতে বলছিলো। কিন্তু আমি রাজি হইনি। শুধু যে আমি তা নয়। প্রিয়া নিজেও ঢাকা যেতে রাজি হয়নি। সেজন্য সে এখানে থাকতো। এভাবে আমাদের জীবন ভালোই কাটছিলো। হুট করে আমার চাকরি চলে যায়। আমি বাড়ি ফিরে আসি। আমার মলিন মুখ দেখে মা বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে। সে অনেক উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চায়,“কী হয়েছে বাবা? তোর মুখটা এত শুকনো কেন?”
“আমার চাকরি চলে গেছে মা।”
আমি কথাটি যতটা না ভাঙা গলায় বললাম আমার মা তার চেয়ে দ্বিগুণ সাহস দিয়ে বলে,“এই সামান্য কারণে মুখটা মলিন করে রাখে কেউ? চাকরি একটা গেছে আরও দশটা আসবে। তুই একদম ভেঙে পড়িস না বাবা।”
আমার মা এবং প্রিয়া মিলে সারাটা দিন আমার মন ভালো করার চেষ্টা করেছে। আমি ভবিষ্যতে আরও ভালো চাকরি পাবো, আমার জীবনে ভালো কিছু হবে। কত অনুপ্রেরণামূলক কথা বলেছি। শুধু তারা দুজন তা নয়। বাবাও রাতে বাড়ি এসে সব শুনে আমাকে বুঝিয়ে বলেছে,“এভাবে ভেঙে পড়িস না বাবা। হাল না ছেড়ে বরং অন্য চাকরির চেষ্টা কর। তুই আগের চেয়ে ভালো চাকরি পাবি।”
“আর না পেলে?”
আমি ভীষণ হতাশ গলায় কথাটি বলি। আমার মুখে এই কথা শুনে বাবা হাসিমুখে বলে,“তাহলে সমস্যা কোথায়? আমি তো পেনশনের টাকা পাই। সেটা দিয়ে আমাদের ছোট সংসার খুব স্বাচ্ছন্দে কেটে যাবে। এই বিষয়টি নিয়ে একদম চিন্তা করবি না।”
বাবা, মায়ের এসব কথায় আমি হতাশা থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু! সেই বাবা, মা আজ দশদিন যেতে না যেতে আমাকে ডেকে নিয়ে বলছে আলাদা হয়ে যা। এসব ভাবতেই আমার কেমন লাগছে।
___
কেটে যায় দু’দিন। প্রথমদিন বাবা, মা এই আলাদা হয়ে যাওয়া নিয়ে কোন কথাই আর তোলেনি। তবে দ্বিতীয় দিন বাবা আমাকে কিছুটা ধমক দিয়েই বলে,“তোকে আমি বলেছি না আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে তুই এখনো আমাদের সঙ্গে কেন আছিস? তোরা আলাদা হওয়ার জন্য কোন ব্যবস্থা নিচ্ছিস না কেন?”
“আমার কাছে কোন টাকা নেই বাবা। তাছাড়া একই ঘরে থেকে আলাদা হাড়ি বসানো কী ঠিক দেখাবে?”
আমার এই কথার জবাবে বাবা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলে,“একই ঘরে কেন থাকবি? অন্যত্র গিয়ে থাকবি। বাসা ভাড়া নিবি। তুই কেন এই সামান্য কথাটা বুঝতে পারছিস না?”
বাবার উত্তেজিত কন্ঠ শুনে আমি কিছুটা অবাকই হলাম। সেই মূহুর্তে আমার নজর পড়লো মা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কান্না করছে। যদিও সেই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে আমি তাদের এইসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কারণ এই মূহুর্তে আমাকে তারা আলাদা থাকার ব্যবস্থা করতে বলছে যেখানে পকেটে একটা টাকা নেই। এটাই আমার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ। সেজন্য বাবা যে কথা বলতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলো, মা যে দরজার আড়ালে বসে কান্না করছিলো এই দুটো দিক আমার মস্তিষ্কে জায়গা করে নিতে পারেনি। আমি এটাকে স্বাভাবিক বিষয় ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু এটা যে স্বাভাবিক বিষয় নয় সেটা আমি বুঝতে পারলাম পরবর্তী দিন সকালে।
সকালে যখন বাবা মাকে অনেক ডাকার পরও মা সাড়া দিচ্ছিলো না সেই সময়ে সে না পেরে আমাদের ঘরে এসে কড়া নাড়ে। বাবার ডাকে আমাদের ঘুম ভাঙে। ঘুম থেকে উঠতেই মাথাটা কেমন ঝিম মেরে উঠলো। সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে দরজা খুলে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,“এভাবে ডাকছো কেন?”
“তোর মা সাড়া দিচ্ছে না।”
“কি!”
আমি এবং প্রিয়া ছুটে মায়ের ঘরে গেলাম। আমরাও মাকে অনেকবার ডাকলাম। কিন্তু না। আমার মা সাড়া দিচ্ছে না। তার মুখ দিয়ে ফ্যানা বের হচ্ছে। আমি ভালোভাবে চেক করতে বুঝতে পারলাম মায়ের হাত, পা ঠান্ডা হয়ে আছে। তার পার্লস চলছে না। আমি ‘মা’ বলে একটি চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমার সুস্থ সবল মা হুঁট করেই মা রা গেল। এই বিষয়টি বাবা যখন বুঝতে পারে তখন সে একদম পাথরের মতো হয়ে যায়। আমি মায়ের মৃত দেহ জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ি। প্রিয়াও কান্না করছে। বাবা হাউমাউ করে কান্না করতে করতে বলে,“সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি অনেক বেলা হয়ে গেছে। এতটা বেলা অব্দি ঘুমিয়েছি বিশ্বাস হচ্ছিলো না। সেই মূহুর্তে পায়ের কাছে তোর মায়ের পড়ে থাকাটা দেহটা দেখে অবাক হলাম। তার কাছে এসে তাকে ডাকলাম। কিন্তু সে সাড়া দিচ্ছিলো না।”
এই কথা বলে মায়ের নাম ধরে চিৎকার করে কান্না করছিলো। হঠাৎ করে এটা কী হয়ে গেল! সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় আজ বাসার সবাই খুব বেলা অব্দি ঘুমিয়েছে। সচরাচর এমন হয়। এই বিষয়টি মাথায় আসতেই আমার মন তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো,“মায়ের মৃ ত্যু কী স্বাভাবিক?”
’
’
চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন।)