#বিষবিন্দু (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
মায়ের মৃ ত্যুর কথা শুনে আমাদের বাড়িতে আশেপাশের সবাই আসতে শুরু করে। সবাই আসলেও এলো না আমার বোন। পাশের গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলের সঙ্গে আমার বোনের বিয়ে হয়েছে। আমাদের বাড়ি আসতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। তবুও সে আসছে না। এটা দেখে আমি প্রিয়ার কাছে জানতে চাইলাম,“তুমি রুবিকে ফোন করে মায়ের মৃ ত্যুর কথা জানিয়েছো?”
“হ্যাঁ।”
প্রিয়ার কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়লাম। রুবির কিছু হলো না তো। মায়ের মৃ ত্যুর কথা জেনেও আসলো না। আমি এই বিষয়টি নিয়ে আর না ভেবে বাবার কাছে গেলাম। শান্ত গলায় বললাম,“আমার সন্দেহ হচ্ছে। মায়ের মৃ ত্যুটা স্বাভাবিক নয়। আমি তোমাকে না জিজ্ঞেস করে পুলিশ খবর দিয়েছি বাবা।”
আমার কথা শুনে বাবা জবাব দিলো না। সে পাথরের মতো একপাশে বসে রয়েছে। তবে এই কথা প্রিয়া এবং বাকিদের কাছে পৌঁছালে তারা দ্বিমত পোষণ করে। সবার কথা কাজটি আমি ঠিক করিনি। এখন আমার মায়ের মৃ ত দেহ নিয়ে তারা কাটা ছেঁড়া করবে। প্রিয়া তো খুব কঠিন গলায় বললো,“তাশামা শুরু করছো? ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক করে বোধহয় মা রা গেছে। তুমি এটা নিয়ে এখন রঙ তামাশা শুরু করছো। ছি। এই বাড়িতে এখন পুলিশ আসবে? আমার মায়ের দেহটা নিয়ে যাবে। এসবে তার আত্মার কত কষ্ট হবে জানো?”
“জানি না। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। আমার সুস্থ মা হঠাৎ করে মা রা গেল। এটা আমার মন মানছে না। আমি জানতে চাই আমার মা কেন মা রা গেছে?”
আমার মুখে এই কথা শুনে অনেক মুরব্বিরাই আমাকে এসব করতে বারণ করছিলো। বিশেষ করে প্রিয়া এবং তার বাবা, মা। আমি তাদের কথা কোন গুরুত্ব দিলাম না। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বাবা বললে হয়তো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতাম। এলাকার কয়েকজন বাবাকে আমাকে এসব করতে বারণ করতে বলছিলো। আমারও মনে হচ্ছিলো বাবাও হয়তো আমাকে বারণ করবে। কিন্তু! না বাবা তেমন কিছু করেননি। বরং বললেন,“রাফি পুলিশ খবর না দিলেও আমি দিতাম। আমাকেও জানতে হবে আমার রানু কেন মা রা গেল।”
বাবার সম্মতি আছে জানতে পেরে সবাই চুপ করে যায়। আমিও খুশি হই। গতকাল রাতে যখন আমার মা আমার হাতের পায়েসের বাটি কেড়ে নিয়ে বলে,“এক পয়সা টাকা ইনকাম করার মুরোদ নেই, শুধু খাই খাই করিস কেন?”
এটা বলে সে পায়েসটা আমার চোখের সামনেই খেয়ে ফেলে। মায়ের খাবার কেড়ে নেওয়া এবং খোঁটা দেওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে আমি অনেকটা কষ্ট পাই। কিন্তু ঘন্টা খানেক পর যখন আমার জন্য আমার মা অন্য বাটিতে করে পায়েস নিয়ে আসে তখন এক নিমিষেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। যদিও অভিমানের গলায় বলছিলাম,“তখন খেতে দিলে না এখন দিচ্ছো কেন? এক পয়সাও তো এখনো ইনকাম করি না?”
“বাবা, মা এমন অনেক কথা বলে বাবা। সব কথা ধরতে নেই। তাছাড়া সেই সময়ে আমার যে কী হয়েছিলো, আমি ঝোঁকের মাথায় কাজটি করে ফেলেছি।”
মা আমাকে বুঝিয়ে পায়েস নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। গত রাতের এই কান্ডের কথা মনে পড়তেই আমার মন বলে,“আমার হাত থেকে কেড়ে নেওয়া পায়েস খেয়েই আমার মায়ের কিছু হলো না তো?”
এখানেই আমার সন্দেহ হচ্ছে। সেই সন্দেহ দূর করতেই আমি পুলিশ ডেকেছি। তারা এসে মায়ের মৃত দেহ নিয়ে ময়না তদন্ত করলে সব বেরিয়ে যাবে। কিছু সময়ের মাঝে বাড়িতে পুলিশ আসে। তারা আমার মায়ের মৃত দেহ ময়না তদন্তের জন্য নিয়ে যায়। পুলিশ চলে যাবার কয়েক মিনিট পর প্রিয়া আমার কাছে আসে। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,“তোমার সত্যি মনে হয় মায়ের মৃ ত্যুটা অস্বাভাবিক?”
“জানি না। তোমার কী মনে হয়?”
আমার এই প্রশ্নে প্রিয়া কয়েক মূহুর্ত চুপ থাকে। তারপর বলে,“আমিও জানি না। আমার তো মনে হয়েছিলো মা হার্ট অ্যাটাক করেছেন।”
“মায়ের মৃ ত্যু, আজ সকালে আমাদের সবার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়া সবটা মিলিয়ে তোমার মনে হয় না বিষয়টি স্বাভাবিক নয়।”
আমার কথা শুনে প্রিয়া অবাক হয়। বিষ্ময় নিয়ে বলে,“কই আমার তো তেমন কিছু মনে হলো না। সব অন্য দিনের মতোই লাগলো।”
“আমি জানি না আমার সাথে কী হচ্ছে। তবে আমি এসব স্বাভাবিক নিতে পারছি না প্রিয়া।”
“হয়তো তুমি সন্তান বলে মায়ের জন্য যে টান অনুভব করছো সেই টান থেকেই এমনটা ভাবছো।”
“হয়তো। আচ্ছা রুবি এবং তার শ্বশুড়বাড়ির কেউ আসলো না কেন? তুমি কিছু জানো?”
“জানি না। তবে মনে হয় রুবির সঙ্গে তার স্বামীর সম্পর্ক ঠিক নাই। যতটা জানি তার শাশুড়ী তাকে খুব অত্যাচার করে। কিন্তু স্বামী তার হয়ে কোন প্রতিবাদ করে না।”
প্রিয়ার মুখে এই কথা শুনে আমি কিছুটা অবাক হলাম। আমার বোন খারাপ আছে এটা আমি জানি। যদিও বিয়ের পর রুবির সঙ্গে আমার তেমন যোগাযোগ নেই। তাই জানি না। কিন্তু এসবের সঙ্গে মায়ের মৃ ত্যুর কথা শুনে না আসার কারণ কী? এই বিষয়টি আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। তাই রুবির নাম্বারে ফোন দিলাম। ফোনটা ধরলো রুবির শাশুড়ী। সে ফোন ধরে বলে,“কেন ফোন দিয়েছো? আমরা যাইনি বলে? তোমার বোন আমাদের নেইনি। সে তার মায়ের মৃ ত্যুর সময় পাশে না থাকতে পারার জন্য আমাদের দোষারোপ করছে। তাই আমাদের কাউকে সেই বাড়িতে যেতে বারণ করেছে। তার কথা এতটা অপমানজনক ছিলো যে আমরা বাধ্য হয়েছি আমাদের ছেলেকেও সেখানে যেতে না দিতে।”
“কি!”
আমি প্রচন্ডরকম অবাক হয়ে গেলাম। রুবির শাশুড়ীর কথামতো রুবি মায়ের মৃ ত্যুর কথা শুনেই বাড়ি থেকে বের হয়েছে। অথচ সে বাসায় আসেনি। আমি যখন বললাম, রুবি বাড়ি আসেনি। তখন তার শাশুড়ী বলে,“বাড়ি যাইনি? তারমানে ওর ভা তারের সঙ্গে পলাইছে? আমি জানতাম এই ছেমড়ি এই কাজ করবে, আমাদের মান ডুবাইবে। আমার পোলা কিছু না বলতে বলতে লাই পাইয়ে দিয়েছে। ছিহ। তাই বলে মায়ের মৃ ত্যুর কথা শুনে তার কাছে না গিয়ে পালাবে। ছিহ।”
এখানে তার কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। রুবির অন্যকারো সাথে সম্পর্ক চলছে এই কথা রুবির শ্বশুড়বাড়ির সবাই জানে। তারা আমার বাবা, মাকেও জানিয়েছিলো। কিন্তু আমার বাবা, মা রুবিকে থামাতে পারেনি। রুবির স্বামীও তাকে প্রচন্ড ভালোবেসেও থামাতে পারেনি। সে নিজের মতো অবৈধ একটা সম্পর্ক চালিয়ে গিয়েছে। তার শাশুড়ীর কথা মতো,যেহেতু আজ আমাদের বাড়ি আসেনি সেহেতু সে পালিয়েছে। এসব শুনে আমি ফোন রেখে দিলাম। প্রিয়াকে সব বললাম। এই কথা শুনে প্রিয়া মনমরা হয়ে বলে,“আমি একটু একটু এসব শুনছিলাম। কিন্তু সত্যি কি-না জানি না।”
“অবশ্যই মিথ্যা। আমার বোন এমন নয়। আমি আমার বোনকে চিনি। ও এসব করতেই পারে না। নিশ্চয় ওরা কিছু লুকাচ্ছে।”
আমি এই কথা বলে থানার উদ্দেশ্য বের হলাম। এবার মায়ের সঙ্গে বোনের নিখোঁজ মামলাও দিতে হবে।
__
একদিন কেটে যায়। ময়না তদন্তের রিপোর্ট হাতে পেয়ে পুলিশ আমাদের বাড়ি আসে। আজ বাড়িতে রুবির স্বামী জাফরও উপস্থিত ছিলো। যদিও তার কথা তার মায়ের মতোই তবে আমি সেসব বিশ্বাস করিনি। পুলিশ আসতে আমি রুবির ঘটনা বললে সে বলে,“আমরা আপনার বোনের বিষয়ে তদন্ত করবো। তবে আগে আপনার মায়ের খু নের বিষয়ে তদন্ত করতে চাই।”
”খু ন?”
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম। পুলিশ মাথা নাড়ালো। তারপর বলে,“হ্যাঁ আপনার মাকে খু ন করা হয়েছে। তাকে কেউ খাবারের সঙ্গে বিষ দিয়েছে। যার জন্য তার মৃ ত্যু ঘটেছে। তবে….।”
“তবে?”
“আমি অবাক হচ্ছি সে যখন বিষের যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো সেই মূহুর্তে আপনাদের ঘরের কেউ সজাগ হলো না? এতটা গভীর ঘুমে আপনারা মগ্ন ছিলেন?”
পুলিশের এই কথার জবাব দিতে পারলাম না। সত্যি তো তাই। সেদিন আমরা বেশ বেলা অব্দি ঘুমিয়েছি। পুলিশ একে একে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। আমাদের সবাইকেই আলাদা আলাদা জিজ্ঞেস করলো। আমাকে ঐ রাতের ঘটনা জিজ্ঞেস করার সময় বলে,“আপনার হাত থেকে পায়েস কেড়ে নিয়ে সে খেয়েছে তাই তো?”
“হ্যাঁ।”
পুলিশ অফিসারের চোখ দেখে মনে হলো সে কিছু একটা সন্দেহ করছে। আমি সেটা বুঝতে পেরে বললাম,“ঐ পায়েসে বিষ ছিলো এমনটা ভাবছেন আপনি?”
“হতেই পারে। এটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”
এই কথা শুনে আমি তেমন অবাক হলাম না। আমারও এটাই মনে হয়। তবে কৌতূহলবসত জিজ্ঞেস করলাম,“কিন্তু আমরা তো সবাই পায়েস খেয়েছি, পায়েসে বিষ থাকলে আমাদের কিছু হলো না কেন?”
এই কথার জবাব পুলিশ অফিসার দেয় না। সে ঠান্ডা গলায় বলে,“এতটা ভাবতে হবে না আপনাকে। এটা আমাদের কাজ। আমরা ঠিক তদন্ত করে বের করে ফেলবো। আপনি একদম চিন্তা করবেন না। তবে হ্যাঁ সত্যি অব্দি পৌঁছাতে চাইলে অবশ্যই সব সত্যি সত্যি বলবেন।”
পুলিশ অফিসার তার এই কথার মাধ্যমে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলো তার সন্দেহে আমিও রয়েছি। আমি এটা বুঝতে পেরে কথা বাড়ালাম না। সে যতটা জানতে চাচ্ছিলো ততটাই বললাম।
’
’
চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন।)