#বৈরী_বসন্ত ১
লেখা – আয্যাহ সূচনা
দেয়ালে বাংলা অক্ষরে বড় বড় করে লেখা ‘ ব ল দ ’। আর সেই লেখার দিকে স্থির জ্বলন্ত চোখে চেয়ে আছে। চেয়ে থাকবার কারণ অবশ্য যৌক্তিক। নিচে ছোট ছোট অক্ষরে ‘ নাফিয়া ’ নামটি দৃষ্টির আড়াল হয়নি। দেহের ভিতরে আগ্নেয়গিরি জেগে উঠে। সদ্য রং করা মূল ফটকের পাশের দেয়াল। সেখানে এই অসভ্যতামি করার সাহস একজনই করতে পারে। সে আর কেউ নয় তাদেরই ইতর প্রতিবেশী।
নাফিয়ার চোখ গেলো উপরে। খোলা বারান্দার দেয়ালে উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোকের ঠোঁটে চওড়া হাসি। সাদা দাঁতগুলো বের করে রেখেছে। উপহাসের সুরে বললো,
-“কেমন লাগে, হু? আমাদের বাড়ির নতুন গেটে চাবি দিয়ে আঁচড় দেওয়ার সময় একশবার ভাবা উচিত ছিল।”
নাফিয়া পারলে হাত লম্বা করে ঘাড়টা চেপে ধরত। কিন্তু নাহ! সে কিছুই করল না। আরিভের দিকে চেয়ে হাসলো। বাঁকা হাসি, এই হাসির পেছনে অনেক রহস্য। আরিভ অবাক হয়। সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এতক্ষণে তো লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার কথা। হলো না কেন?
-“আজব! এই মেয়ে রিয়েক্ট করল না কেন?”
মাথা চুলকাতে চুলকাতে নিজের কাছেই প্রশ্ন করে আরিভ। আরিভের চোখ পড়লো সোজাসুজি বারান্দায়। নাফিয়া এসে হাজির সেখানে। হাতে বড় বালতি আর মগ। ছোট্ট বারান্দায় দোল খেলানো গাছের লতাপাতা এখন বৃষ্টিতে ভিজবে। নাফিয়া গুনগুন গান ধরলো। গাছগুলোতে পানি দিতে দিতে একবার আড়চোখে আরিভের আশ্চর্য মুখখানা দেখেছে। সাথে সাথে কপাল কুঁচকে ফেলে।
মনে মনেই বললো,
-“কী বিশ্রী!”
আরিভ সেটি শুনতে পায়নি। আশ্চর্য হয়ে বলল,
-“আজ বাঘিনী বিড়াল হয়ে গেলো কি করে?”
নাফিয়া হাত থামিয়ে প্রশ্ন করে,
– “আমাকে কিছু বললেন ভাইয়া?”
ভাইয়া শুনে আকাশ থেকে পড়ার উপক্রম আরিভের। এত মিষ্টি কন্ঠ? সেটিও নাফিয়ার মুখ থেকে? অসম্ভব! আরিভ প্রশ্ন করলো,
-“ডেট এক্সপায়ার মাল গিলেছ নাকি?”
নাফিয়া বারান্দার গ্রীলে কনুই ঠেকিয়ে প্রশ্ন করে,
-“কেন বলুনতো?”
-“এত চুপচাপ কী কারণে?”
-“আপনার আমাকে চুপচাপ দেখতে ভালো লাগছে না বুঝি?”
আরিভ কোনোভাবেই হজম করতে পারছে না নাফিয়ার এই রূপ। নাফিয়াদের বাড়ির পাশেই নতুন একটি বাড়ি হয়েছে। আরিভ ও তার বাবার সম্মিলিত ভিটা। নিজেদের মতো করেই সাজিয়েছে। মাসখানেক হলো উঠেছে নতুন বাড়িতে। পাশে নাফিয়াদের দোতলা বাড়ি। ঠিক আরিভের ঘরের পাশাপাশি।
মেয়েটির সাথে প্রথমদিন থেকেই এক বৈরী ভাব। কেন? তার উত্তর জানা নেই। আরিভের কাছে নাফিয়ার তিক্ত, বিরক্ত মুখখানা আর তার উল্টোপাল্টা কাজ একমাত্র কারণ। এইতো সেদিন সাদা শার্টে পানি ফেলে ভিজিয়ে দিলো। অফিসে যাওয়ার পথে বড়সড় একটি বাঁধা দিয়েছে মেয়েটি। কিন্তু তার মুখে কোনো অনুশোচনা দেখা যায়নি। বরং বাঁকা হাসি দিয়ে এড়িয়ে গেছে। যেনো এটি কোনো অপরাধই নয়।
ঠিক তার পরদিন আরিভদের বাড়ির নতুন দরজায় চাবি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে। সুন্দর কালো রংয়ের দরজার অবস্থা নাজেহাল।
বর্তমানে ফিরে এলো আরিভ। বয়সে তার থেকে গুণে গুণে আট বছরের ছোট এই মেয়ে। কবি সাহিত্যিকদের ভাষায় অষ্টাদশী যুবতী। কিন্তু আরিভের ভাষায়,
-“ চন্ডাল”
চন্ডাল শুনেও বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দিল না নাফিয়া। বেকুবের মতো হাসলো। বলল,
-“বেস্ট অফ লাক ভাইয়া।”
-“কেন?”
-“শুনলাম আপনার অফিসে কাল প্রেজেন্টেশন, তাই শুভকামনা।”
সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে আরিভের। অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। নিশ্চয়ই মেয়েটির মাথায় কিছু ঘুরছে। নতুন কোনো খিচুড়ি পাকাচ্ছে নাতো আবার?
আরিভের ঘর ভর্তি কাগজপত্র। আগামীকালের জন্য সব প্রস্তুতি শেষে ঘরের সব কাগজ গুছিয়ে নিচ্ছে বিরক্তি সহকারে। বিড়বিড় করে এই নির্জীব কাগজগুলোকে গালি দিলো। আরিভ ক্লান্ত হয়। ঘর গোছানো শেষ করে বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিতে না দিতেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমায়।
______
খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠে নাফিয়া। তার পুরোনো অভ্যাস। স্কুলে থাকাকালীন এই অভ্যাসটি তার মা- ই করিয়েছে তাকে। সেটি রয়ে গেছে। সকালের সতেজ হাওয়ায় এক অপরূপ শান্তি অনুভব করে। সাথে আছে তার ছোট্ট বাগান বারান্দা। এদের সাথে সময় কাটায় একান্তে। আজও তাই।
সকাল আটটা বেজে বিশ মিনিট। বাড়ির নিচ থেকে চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পায় নাফিয়া।
-“আম্মা!”
ভয়াবহ পুরুষালি চিৎকার। গগন কাঁপিয়ে তুলেছে। এই আওয়াজটা পরিচিত। নাফিয়ার ঠোঁটের কোণে লম্বা চওড়া হাসি ফুটলো। যেন এই চিৎকারের অপেক্ষায় ছিল সে।
শিরীন বেগম শাড়ির কুচি সামলে নিচে নেমে এলেন। এসে দাঁড়ালেন বাড়ির গ্যারেজে। আরিভ ফোঁস ফোঁস করছে। মাথায় হেলমেট, কোমরে দুহাত রেখে বাইকের দিকে চেয়ে আছে। শিরীন বেগম তিক্ত সুরে বলে উঠেন,
-“ ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছিস কেন?”
আরিভ বাইকের দিকে আঙুল তাক করে প্রশ্ন করলো,
-“এই কাজটা কে করেছে আম্মা?”
শিরীন বেগম কালো রংয়ের বাইকটির দিকে তাকালেন। বিশেষ কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। ছেলের দিকে চেয়ে বললেন,
-“কী কাজ? হয়েছে কী?”
-“আম্মা আর ত্রিশ মিনিট পর আমার প্রেজেন্টেশন। আমার বাইকের টায়ার পাঞ্চার। আর দেখে মনে হচ্ছে ইচ্ছেকৃত পাঞ্চার করা হয়েছে।”
শিরীন বেগম যত শুনছেন আরও রেগে যাচ্ছেন। ছেলের জবাবে বলে উঠেন,
-“আমি করেছি পাঞ্চার। নয়তো জ্বিন ভূত এসে করেছে, খুশি?”
আরিভ আশাহত মুখে বলে উঠে,
-“আম্মা!”
-“কী আম্মা? তোর বাইক তুই জানিস। আমি কী করে বলব কে বাইকের টায়ার পাঞ্চার করেছে?”
আরিভ চোয়াল শক্ত করল। ফোঁস ফোঁস করে আরো কয়টা নিঃশ্বাস ফেলে। এই কাজ কার হতে পারে সেটা বুঝতে বাকি নেই। আরিভ চোখ তুলে তাকাল দোতলার বারান্দায়। নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। পরপর মায়ের দিকে চেয়ে বলে উঠে,
-“পাশের বাড়ির ওই ডাইনী মেয়েটার কাজ এটা। আমি শিউর।”
-“তোর শিউরের গুষ্টি কিলাই। অযথা মেয়েটাকে অপবাদ দিবি না।”
-“আম্মা আমি জানি ও করেছে এটা। গতকাল থেকেই ওর ভাবসাব ভালো না। আচ্ছা ওয়েট! চলো আমরা সিসিটিভি ফুটেজ চেক করি।”
শিরীন বেগম হাতজোড় করলেন। বললেন,
-“তোর সিসিটিভি তুই চেক কর। আমার রুটি পুড়ে যাবে।”
বলে হনহনিয়ে চলে গেলেন শিরীন বেগম। ছেলেটাকে নিয়ে পারা গেলো না। এই উক্তি ছুঁড়ে গেছেন যাওয়ার পথে। পেছন থেকে আরিভ বলছে,
-“আম্মা তুমি আমাকে কোনদিন সিরিয়াসলি নিবে প্লীজ একটু দিনক্ষণ জানিয়ে দিও। আমি এলাকাবাসীকে দাওয়াত করে খাওয়াবো।”
ঠিক তখনই মাথার উপর থেকে এক হতাশ মেয়েলি কিন্তু শোনা যায়। নাফিয়া মাথা দুদিকে দোলাচ্ছে। আর বলছে,
-“আহারে! এত স্বাধের বাইক। কী করে হলো এটা ভাইয়া?”
আরিভ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। নয়তো মুখ ফুটে ভয়াবহ গালি বেরিয়ে যাবে। এক ছোটখাটো মেয়েকে এই ধরনের গালি দেওয়ার অপরাধে জেলও হতে পারে। নাফিয়া আগুনে ঘি ঢেলে দিতে ইচ্ছুক। আবার নাটকীয় সুরে বলে উঠে,
-“আজ তো আপনার দরকারি প্রেজেন্টেশন। এই প্রেজেন্টেশনে কোনো ঝামেলা হলে নাকি আপনার চাকরিও চলে যেতে পারে? কী ভয়াবহ ব্যাপার! আচ্ছা শুনুন আপনি লোকাল বাসে করে চলে যান। আমি আপনার জন্য দুয়া করব যেন আপনার চাকরি এখনই না যায়। কয়টাদিন পরে নাহয় গেলো, অন্তত এই মাসের বেতনতো পাবেন।”
আরিভ তর্জনী আঙুল তুলে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
– “তোমাকে আমি দেখে নিব বেয়াদব মেয়ে!”
– “কেন আপনি কি দিনকানা?”
আরিভ আশ্চর্য বনে যায়। কীসের মধ্যে কী প্রশ্ন? আশ্চর্য সুরেই প্রশ্ন করল,
-“কীহ?”
-“দেখে নিবেন বললেন যে? আপনার সামনে জলজ্যান্ত একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছি দেখতে পাচ্ছেন না এখন?”
কথার মারপ্যাঁচে পড়ে গিয়েছিল আরিভ। এতক্ষণে মস্তিষ্কে বুদ্ধি উদয় হলো। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে তাকে ধাঁধায় ফেলা হচ্ছে। আরিভ হাতে থাকা ঘড়িটা দেখলো। হাতে বেশি সময় নেই। আর মাত্র বিশ মিনিট। এখানে দশ মিনিট অপচয় হয়ে গেছে। নাফিয়াকে অবাক করে দিয়ে তাদের বাড়িতেই ঢুকে পড়ে বড় বড় কদম ফেলে। নাফিয়া বলল,
-“অনুমতি ছাড়া আমাদের বাসায় ঢুকছেন কেন? ম্যনার্স নেই?”
-“তোমার বাপকে তোমার নামে বিচার দিতে আসছি। এসে বলব এই বয়সে দুই তিনটে ছেলের সাথে প্রেম করো। নতুন নতুন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে পাংখা গজিয়েছে তোমার। কাটাকুটির ব্যবস্থা করতে আসছি।”
নাফিয়া অকস্মাৎ ভয় পেয়ে গেল। সত্যিই এই মিথ্যে কথাগুলো বাবাকে বলবে? এই লোককে দিয়ে এক বিন্দু বিশ্বাস নেই। প্রতিশোধ নিতে যে কোনকিছু করতে পারে। লাফিয়ে উঠে পড়ে নাফিয়া। বাবা ঠিক সদর দরজার পাশে বসেই চা খাচ্ছেন। যদি কোনোভাবে দরজা খুলে দেন? কি একটা বিব্রত অবস্থার সৃষ্টি হবে?
নাফিয়া দরজা অব্দি আসতে আসতে কিছুটা দেরি করে ফেলে। ততক্ষণে দরজার সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সিদ্দিক সাহেব এবং আরিভ।
-“আসসালামু আলাইকুম আংকেল।”
নাফিয়ার হৃদপিণ্ডে ধক করে আওয়াজ উঠে। এই বুঝি বাবার কাছে মান সম্মান সব ধুলোয় লুটিয়ে গেলো। নাফিয়া ওড়না চেপে ধরে। সিদ্দিক সাহেব সালামের জবাব নিয়ে বলেন,
-“কী খবর আরিভ? সকাল সকাল এখানে?”
আরিভ নাফিয়ার দিকে তাকালো একবার। এই চাহনিতে নাফিয়ার জান যায় যায় অবস্থা। লোকটা কি সত্যিই বলে দিবে? কিন্তু সেতো প্রেম করে না?
আরিভ বিনয়ের সুরে বলল,
– “সরি আংকেল সকাল সকাল বিরক্ত করার জন্য। আসলে আপনার বাইকের চাবিটা লাগত। আমার বাইকের টায়ার পাঞ্চার হয়ে গেছে, ইম্পর্ট্যান্ট প্রেজেন্টেশন আছে অফিসে। হাতে সময় কম।”
সিদ্দিক সাহেব জবাব দেন,
– “হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। আমি দিচ্ছি।”
নাফিয়া নিষ্পলক বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। কানে কি বেশি শুনলো নাকি কম? লোকটা সত্যিই কিছু বলেনি? এত ভদ্র হলো কী করে? নাফিয়ার বিস্ময় ভরা মুখ দেখে আরিভ চোখ ঘুরিয়ে ফেলে বিরক্তিতে। পরপর আলগোছে হাসে। ভালো জব্দ হয়েছে। মুখজুড়ে ভয় আর ভয়। এটাই দেখতে চেয়েছিল।
বাইকের চাবি নিয়ে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে পড়ে আরিভ। আজ দিন বুধবার কিন্তু আকাশ বলছে কপালে শনি, রবি, মঙ্গল আছে।
_______
সন্ধ্যা করেই ফিরল আরিভ। তার যথাসময়ে। সন্ধ্যায় সেই বারান্দায় বসেই বই পড়ে নাফিয়া। বাইকের হর্ন শুনতে শুনতে বিগত তিনমাসে অভ্যাস হয়ে গেছে। আজ বিষয় ভিন্ন। কেউ নিচ থেকে দাঁড়িয়ে বলছে,
-“আমি জানি তুমি বারান্দায়। তোমার বাপের বাইক রেখে আমাকে উদ্ধার কর।”
নাফিয়া উকি দিল। বলল,
-“যেভাবে নিয়েছেন সেভাবে রেখে যান।”
-“চাবি কী আকাশ থেকে পড়বে?”
নাফিয়া ঠোঁট টিপে হাসলো। পাশে রাখা মেইন গেটের চাবি উপর থেকে নিচে ফেলে দিলো। সরাসরি আরিভের কাঁধে এসে পড়েছে সেটি। আরিভ চমকে উঠে। সামান্য আর্তনাদ করলো এত ভারী চাবির গোছা কাঁধে পড়ায়। কটমট চোখে উপরের দিকে তাকায়। কিছু বলে উঠার আগেই নাফিয়া বলল,
“আকাশ থেকেই তো পড়লো।”
ভীষণ ক্লান্ত আরিভ। তর্ক করার ইচ্ছা নেই আপাতত। দরজা খুলে নির্দিষ্ট স্থানে বাইক রেখে চাবি ছুঁড়ে দিলো উপরে। ঠিকঠাক নিশানা লেগেছে। চাবি গ্রিল ভেদ করে বারান্দায় গিয়ে পড়েছে। সাথে সাথে
-“অসভ্য” শব্দটিও শুনেছে।
ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই মাথায় চাপড় পড়ল। প্রথমে কাঁধে আঘাত পেয়ে এলো এখন আবার মাথায়। এই চাপড় তার মমতাময়ী মা ছাড়া আর কেউ দিতে পারেনা। আরিভ অবুঝ হতাশ চোখে তাকায় মায়ের দিকে। শিরীন বেগম তাকে শাসিয়ে প্রশ্ন করেন,
-“বয়স কত রে তোর?”
-“মা হয়ে ছেলের বয়স জানো না?”
সাথে সাথে বাহুতে দ্বিগুণ জোরে থাপ্পড় পড়ে। আরিভ বাহু চেপে ধরল। মা তো, কিছু বলা যায় না। অগত্যা চুপচাপ পরর্বতী কথার অপেক্ষা করে। শিরীন বেগম বললেন,
-“২৬ বছরের দামড়া ছেলে ওই বাচ্চা মেয়েটার সাথে লাগতে যাচ্ছিস?”
-“ঐটা বাচ্চা মেয়ে? ওর মধ্যে ৮০ বছরের এক বুড়ির বসবাস। গিয়ে দেখে জ্বিন টিন নাকি আবার।”
-“আরেকটা থাপ্পড় খাবি?”
-“ভাত খাবো আম্মা।”
– “তোর আজকে ভাত নেই। কী লজ্জায় পড়তে হয়েছে আমাদের জানিস সিদ্দিক ভাইয়ের কাছে? আমার গুণধর পুত্র তার বাড়ির দেয়ালে তারই মেয়েকে বলদ বলে সম্বোধন করে এসেছে। তোর মধ্যে কী লজ্জা বলতে কিছু দেই?”
নালিশ করা শেষ তাহলে। মেয়েটাকে আজকে সাহায্য করা উচিৎ হয়নি। ওর বাবার কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে মিথ্যে বললে উচিত শিক্ষা হতো। আরিভ জবাব দিলো,
– “আমার উপর পানি ফেলেছে, গাছের মাটি, ময়লা ফেলেছে, চাবি দিয়ে আমাদের দরজায় আঁচড় কেটেছে আজ আমার বাইকের টায়ার পাঞ্চার করে দিলো। এতকিছুর পরও তুমি চাইছো আমি ওকে দেবী বানিয়ে পূজো করি?”
– “আরিভ নাফি বাচ্চা একটা মেয়ে। ওর জন্য মায়া হয় আমার।”
– “আমাকে সারাদিন মারধর করো। আর বাহিরের মেয়ের জন্য কত দরদ!”
অভিমান করার ভঙ্গিতে বলল আরিভ। এসব তার নাটক সেটি শিরীন বেগমও জানেন। আরিভের কথায় রেগে না গিয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলেন শিরীন বেগম। শান্ত গলায় প্রশ্ন করেন,
-“ওর ডান হাত দেখেছিস?”
-“দেখব না কেন? কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো ওই হাত নড়াতে দেখিনি কখনো।”
-“কারণ ওই হাত সম্পূর্ণ অচল।”
আরিভের মুখে বিস্ময়। কাজ করে না এর অর্থ পুরোপুরি বুঝেনি। প্রশ্ন ছুড়লো,
-“মানে?”
-“মানে এক্সিডেন্টে ওর ডান হাত সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে। মানে প্যারালাইজড।”
আরিভ কিছু মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়। কেন সেই হাতে কোনো নড়চড় নেই সেটি জানবার ইচ্ছা কখনোই জাগেনি আরিভের বিগত তিনমাসে। বুঝতেও চায়নি।
শিরীন বেগম হতাশ কন্ঠে বলেন,
– “ছেলেদের সব ত্রুটি মেনে নেয় মানুষ। মেয়ে মানুষেরটা কি কেউ মানবে? সিদ্দিক সাহেব আর ভাবি বড্ড চিন্তিত মেয়েটাকে নিয়ে।”
চলবে…