#বৈরী_বসন্ত ২
লেখা – আয্যাহ সূচনা
বর্ষার ধারা ঝরছে। তীব্র বেগে পড়ন্ত বৃষ্টির ফোঁটায় গাছের পাতাগুলো যেন নৃত্যে মগ্ন। নাফিয়ার মন একান্তে আনন্দিত। একাকী মনের ভালো লাগা প্রকাশ পাচ্ছে অধর কোণে ঝুলে থাকা হাসিতে। এই হাসির পাশে কোনো মানব সঙ্গী নেই। আছে শুধু এই বারিধারা আর নৃত্য করা গাছগুলো। প্রবল বৃষ্টিতে ঝরে যাওয়া ফুলগুলো কুড়ালো নাফিয়া। সুই সুতো নিয়ে বসলো ভিজে থাকা ফুলগুলো গাঁথবে বলে। এগুলো শুকিয়ে গেলে রেসিনের সাহায্যে সংরক্ষণ করবে।
সিক্ত ফুলের মালা গাঁথতে গিয়ে চিল্লানোর আওয়াজ পাওয়া গেলো বাড়ির পাশের খোলা মাঠ থেকে। ছোট থেকে বড় এক দল ছেলেপেলে বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলছে। নাফিয়া দৃষ্টি তুলে তাকায়। তার প্রিয় দুজন মানুষ আছে সেখানে। সাদিফ আর জোহান। দুজনেই প্রতিবেশী। বয়সের তারতম্য থাকলেও ছোটবেলা থেকেই নাফিয়ার সাথে বেড়ে উঠা তাদের। তাদের সাথে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর সাদা রঙের টিশার্ট পড়ে আরও একজন আছে। সে হলো সবচেয়ে অপছন্দের।
নাফিয়ার নজর পড়তেই আরিভ কাদায় পিছলে পড়ে গেলো। নাফিয়া হেসে ফেলে। দ্রুত ফোন বের করে একহাতে। আরিভের অবস্থা কাদায় মাখো-মাখো। নাফিয়া বেশ কয়েকটা ছবি তুলল। সাদিফ, জোহান আরিভকে ধরে নিয়ে আসছে বাড়ির দিকে। ঠিক তখনই নাফিয়া বলল,
-“ল্যাংড়া আমের সিজন এসেছে।”
কাদা মাখা শরীর আর মুখ নিয়ে আরিভ রাগান্বিত দৃষ্টিতে উপরে তাকায়। নাফিয়া আবারও ফোনের ক্যামেরা অন করে বলল,
-“দেখি দেখি কাদা ভূতের কয়েকটা ছবি তুলি। এগুলো ফেসবুকে আপলোড করে মানুষকে হাসবার সুযোগ করে দিব। সোয়াব হবে আমার।”
সাদিফ বয়সে বড় নাফিয়ার। এই দুজনের ঠুকাঠুকি জানা আছে তার। আরিভ উত্তেজিত সুরে বলে উঠে,
-“ছবিগুলো ভালোয় ভালোয় ডিলেট করে দিও। নয়ত এমন অবস্থা করব ফেসবুক কেন ফোন চালানোর অবস্থায় অবস্থায় থাকবে না।”
-“ঠিক আছে তাহলে আমি ফোনের বদলে ল্যাপটপ, ফেসবুক এর বদলে ইনস্টাগ্রাম চালাব কেমন?”
জোহান বুঝতে পারল এবার একটা তুল কালাম হবে। আরিভের কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“ভাই নাফি আপু পাগল। আপনি আসুন, পায়ে চোট পেয়েছেন।”
-“পাগল! ধুরন্ধর বেয়াদব একটি মেয়ে।”
নাফিয়া চিৎকার করে বলে উঠে,
-“সেম টু ইউ।”
বলে চলে গেল। নাফিয়া একহাতে ফোন আর বই নিয়ে হাজির হয় বসার ঘরে। দাদী এসেছেন গ্রাম থেকে। সারাক্ষণ বসার ঘরেই থাকেন। এটা ওটা নিয়ে খুঁত বের করতে থাকেন। নাফিয়া বিরক্ত হলেও নাফিয়ার মায়ের শ্বাশুড়ির এমন কর্মকাণ্ডে কোনো আক্রোশ নেই। তার মতে এসব বয়সের দোষ। বয়স বাড়লে নাকি মানুষের মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে অকেজো হতে থাকে। নাফিয়াকে আসতে দেখে দাদী ফোড়ন কাটলেন,
-“সিদ্দিকের বউ, তোমার মাইয়ারে একটা ঘর দেইখা বিয়া দাও জলদি। এমনেই হাত কাম করেনা একটা তার মধ্যে বয়স বাড়লে ঘরের ছাদে খুঁটি দেওয়া লাগবে।”
বৃষ্টির দিনে মন ভালো থাকে। কিন্তু এই কথাটি নাফিয়ার মন ভারী উদাস করে দিল। এভাবে না বললেও পারত। সেই ছোটবেলার এক্সিডেন্টতো ইচ্ছেকৃত ছিল না। ভাগ্যে লিখা ছিল হয়ে গেছে। রেশমা বেরিয়ে এলেন। শ্বাশুড়ির সামনে এক কাপ চা রেখে বললেন,
-“মেয়ে যেহেতু একদিন না একদিন বিয়ে দিবোই আম্মা। এমন কারো কাছেই দিব যার নাফির এক হাত অকেজো বলে কোনো সমস্যা থাকবে না।”
-“কেউ করত না বিয়া। একহাত দিয়া জামাই সামলাইব কেমনে? ঘর আর বাচ্চা? আল্লাহর ওয়াস্তে একটা ভালো ঘর পাইলে দিয়া দিবা।”
-“ভালো ঘরেই দিব আম্মা।”
-“এখনই উপযুক্ত সময়। ওর ভার্সিটি ছাড়াও সিদ্দিক আইলে কথা কমু। ওর বিয়া দিলে আমার পুতের একটু শান্তি হইব। মাইয়ার টেনশনে শুকায় কাঠ হইতাছে।”
রেশমা চুপ রইলেন না। অন্য কোনো বিষয় হলে হয়তো চুপ থাকতেন। কিন্তু বিষয়টা তার মেয়ের। তাদের ভুলের কারণে আজ তার মেয়ে আপন মানুষের কাছ থেকে দুঃখ কুড়াচ্ছে। তিনি বললেন,
-“আপনি যেমন আপনার ছেলে নিয়ে টেনশন করেন, আপনার ছেলেও তার মেয়েকে নিয়ে টেনশন করে আম্মা। এটা পরম্পরা।”
দাদীর মুখ কুঁচকে গেল। বোঝা যাচ্ছে তার উত্তর পছন্দ হয়নি। তিনি জবাবে বললেন,
-“তুমি কি আমার লগে তর্ক করতাছ?”
-“না আম্মা। আমি বোঝাতে চাইছি, আমাদের মেয়েকে কেউ যদি তাদের ঘরের বউ করে নাও নেয় আমরা আছি ওর জন্য। নিজের ঘরের পুতুল নিজের কাছেই রেখে দিব।”
-“সিনেমার ডায়লগ মারো নাকি বউ? তোমরা মরার পর ওয় কার ঘাড়ে গিয়া পড়ব?”
-“এই বিশাল জায়গা সম্পত্তি, এই বাড়ি এগুলো কে খাবে না? সবতো আমার নাফির। ওর বাবা নাফির জন্যই করেছেন। আরও করবেন যেন মেয়ে যতদিন থাকে কারো কাছে হাত পাততে না হয়।”
এযাত্রায় দমে গেলেন বৃদ্ধা। গরম চায়ের কাপ নিয়ে গটগট করে গিলতে শুরু করলেন। রেশমা মেয়ের দিকে তাকান। মেয়েটা কষ্ট পেলে চুপ হয়ে থাকে। কাঁদে না। মুখটা দেখতেই মায়া মায়া লাগে। রেশমা হাসলেন। বললেন,
-“খিচুড়ি করেছি। আয় ডিম ভাজবি।”
মা জানে কিভাবে মন ফুরফুরে করতে হয়। মলিন মুখে হাসির দোল খেলে গেল। বই আর ফোনটা পাশে রেখে এগোলো রান্না ঘরের দিকে। বলল,
-“মা আজ নাগা মরিচ দিব ডিম ভাজিতে। একদম ঝাল ঝাল, মজা হবে খেতে।”
রেশমা হেসে জবাব দেন,
-“আচ্ছা ঠিক আছে আয়।”
চা শেষ। দাদী উঠে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,
-“এক হাতে ডিমও ভাজবে। এত কানার কাছে ঠিকানা জানার মতো অবস্থা।”
নাফিয়া আবারও থেমে যায়। ঘুরে তাকায় দাদীর দিকে। কে জানে কি শত্রুতা তার সাথে? রেশমা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
-“তুই যা এক হাতে করছিস সেটা মানুষ দুহাতেও করতে পারে না। তুই কারো থেকে কম না, চল।”
_______
আরিভ ছাব্বিশ বছরের তাগড়া যুবক। কিন্তু তার মায়ের কাছে নয়। মাঝেমধ্যে মনে হয় তার জন্ম হয়েছে মায়ের হাতে মার খাওয়ার জন্য। বৃষ্টিতে ভিজে পা মচকে এসেছে। দরজার সামনে দাঁড়াতেই শিরীন বেগম খুন্তি নিয়ে হাজির। পিঠে চাপড় বসিয়েছেন এক্সট্রা বোনাস হিসেবে। খুন্তি দেখিয়ে বললেন,
-“তুই ঘরে ঢুকবি না আজ।”
আরিভ হতাশ, ভীষণ হতাশ। মায়ের কথার জবাবে বলল,
-“তাহলে কোথায় যাব তুমিই বলে দাও।”
-“জাহান্নামে যা।” সরাসরি জবাব দিলেন শিরীন বেগম।
-“ছেলেকে জাহান্নামে পাঠাতে চাইছ?”
-“তুই এসব আবর্জনা নিয়ে ঘরে ঢুকতে পারবি না ব্যাস।”
পাশে দাঁড়ানো সাদিফ এবং জোহান। ঠোঁটে আসন্ন হাসি বহু কষ্টে আটকে রেখেছে। শিরীন বেগম মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। আরিভ আরও অবাক হয়। এই মায়ের মনে কি একটুও মমতা নেই?
সাদিফ বলল,
-“ভাই একটা বুদ্ধি দেই?”
আরিভ ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে জানতে চায়,
-“ কি আইডিয়া?”
-“নিচে পানির পাইপ আছে।”
-“তো?”
-“গ্যারেজে গিয়ে পানি দিয়ে গোসল করে এসব কাদা মাটি ধুয়ে আসেন। তাহলে যদি ঘরে এন্ট্রি পান?”
কথা খারাপ বলেনি ছেলেটা। আরিভ জবাবে বলল,
-“তোকে দেখতে বলদ মনে হলেও কথাটা বুদ্ধিমানের বলেছিস।”
অপমান করলো নাকি শাবাশী দিল সেটা বুঝতে সময় লাগছে সাদিফের। অন্যদিকে জোহানের সাহায্য নিয়ে আরিভ নিচে নেমে এলো। পাইপের পানি দিয়ে গায়ের সব কাদা ধুয়ে নিচ্ছে।
অনেকটা যুদ্ধ করার পর বাড়িতে ঢুকার অনুমতি পায় আরিভ। শিরীন বেগম ফুঁসতে ফুঁসতে আসলেন ছেলের কাছে। হাতে গরম সরিষার তেল। পায়ে চোট পেয়েছে ছেলে। সেবা মায়েরই করতে হবে।
মালিশ করতে করতে আরিভ বলল,
-“আম্মা পাশের বাড়ি থেকে খিচুড়ির ঘ্রাণ আসছে।”
-“তো?”
-“ইয়ে মানে, তুমি রান্না করবে না?”
-“হ্যাঁ করব না আবার? তোমার আর তোমার বাপের জমিদারি এখানে। আমি হলাম দাসী।”
আরিভ আর কোনো কথা বাড়ায়নি। এটা হয়তো মা জাতির স্বভাব। বিপদ আসবার পূর্বে ভুক্তভুগী পালালো। এমন ভাব নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আরিভ ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। ঠিক তখনই কলিং বেল বাজলো। আরিভ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে দরজা খুলতেই মেজাজ চড়ে বসে।
নাফিয়া দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বলল,
-“আন্টিকে ডাকেন।”
-“কেন?”
-“মা খিচুড়ি পাঠিয়েছেন।”
-“আমার মত এত উঁচু লম্বা একটা মানুষকে তোমার চোখে ঠেকে না? আমার হাতে দিয়ে দিলেই তো আর বেশিক্ষণ তোমার মুখটা দেখতে হচ্ছে না।”
নাফিয়া বাঁকা হেসে বলল,
– “আপনার এই কুমড়ো পটাশের মত মুখ দেখার ইচ্ছে আমারও নেই। যার বাড়ি তাকে ডাকেন। খাবার দিয়ে চলে যাব।”
-“ফর ইউর কাইন্ড ইনফর্মেশন এটা আমারও বাড়ি।”
-“বাড়ির কর্তী ছাড়া আমি কারো সাথে কথা বলি না।”
মেয়েটার জবান ছুরির মত চলে। সাথে সাথে জবাব দেয় কথার। একটা শব্দ যেন জমিনে পড়ে না। দুজনের বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে শিরীন বেগম এসে হাজির হলেন। নাফিয়াকে দেখে চওড়া হাসি দিয়ে বললেন,
-“নাফিয়া? এসো ঘরে এসো।”
-“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
-“ওয়ালাইকুম আসসালাম। বাহিরে কেন দাঁড়িয়ে আছো? এসো।”
নাফিয়া বিনয়ের সাথে জবাব দিল,
-“না আন্টি ভিতরে আসব না। না আজ খিচুড়ি রান্না করেছিলেন। সেটাই দিতে এসেছি।”
-“দরজা থেকে চলে যাবে সেটা কি করে হয়?”
-“আন্টি অন্য আরেকদিন আসব। আজ যাই।”
নাফিয়া বসে নি। চলে গেছে। যার সব দায় শিরীন বেগম আরিভের উপর চাপালো। তার তর্কের কারণে মেয়েটি দরজা থেকে চলে গেছে। মায়ের কর্কশ কন্ঠে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি আরিভ। তার সমস্ত লোভ এখন খিচুড়ির দিকে। প্লেটটি নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেছে। বিছানার উপর আয়েশ করে বসল। স্বাদ নিয়ে খাওয়া শুরু করল।
অন্যদিকে জানালার বাহিরে ফোন বের করে এই দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করেছে নাফিয়া। চেঁচিয়ে বলল,
-“শত্রুর বাড়ির খাবার রাক্ষসের মত গপাগপ গিলছেন। ছিঃ!”
মুখে খাবার নিয়েই ঘুরে তাকায় আরিভ। আওয়াজটা এসেছে কোথা থেকে সেটি দেখতে। চোখ গেলো জানালা ভেদ করে পাশের বাড়ির জানালায়। দাঁত বের হাসছে মেয়েটি। রাগ হলো নিজের উপরই। খেতে বসেও শান্তি নেই। মেয়েটি যেন সিসিটিভি ক্যামেরা। মুখে থাকা অবশিষ্ট খাবার গিলে বলল,
-“মানুষের বাড়িতে উঁকিঝুঁকি দেওয়া আর খাবার নিয়ে খোটা দেওয়া ইতর শ্রেণীর মানুষের কাজ। যেটা অবশ্যই তুমি। মিলেছে একেবারে খাপে খাপ।”
নাফিয়া রেগে গেল। বলল,
-“আমাকে ইতর বললেন?”
আরিভ বড় একটি লোকমা মুখে তুলে। মাথা দুলিয়ে “হ্যাঁ” বোধক উত্তর দেয়। নাফিয়া ফুসে উঠে। জবাব দেয়,
-“আপনি তাহলে গিরগিটি।”
আরিভ বাম হাত থেকে প্লেট বিছানায় রেখে থাম্বস আপ দেখালো। বোঝালো সে মেনে নিয়েছে নিজেকে গিরগিটি হিসেবে। কোনো প্রকার কোনো আপত্তি নেই। নাফিয়া চলে যেতে নিল। আরিভ ডেকে উঠে। পানির গ্লাস থেকে পানি গটগট করে গিলে বারান্দায় এসে ঢেঁকুর তোলে। আরমোড়া হয়ে বলে,
-“খিচুড়ি ভালো হয়েছে।”
নাফিয়া ভেংচি কেটে বলল,
-“তো?”
-“নিশ্চয়ই তোমার রান্না না।”
পেছন থেকে কোমরে হাত রেখে দাদী এসে হাজির হল। বলল,
-“এক হাত দিয়া খিচুড়ি রানব? তুমি জানো না ওই অপয়া?”
আরিভ থতমত খেয়ে যায়। সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মুখটা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। নাফিয়া গোলগোল চোখে দাদীর দিকে চেয়ে আছে। কথাটা খুব লেগেছে হৃদয়ে। দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। অস্থির লাগছে এখানে।
দাদীও তার পিছু পিছু যায়। চেঁচিয়ে বলে রেশমার উদ্দেশ্যে,
-“পোলা মানুষের লগে এত কিসের কথা? হাত নাই আবার চরিত্রে কলঙ্ক লাগাইব নাকি তোমার মাইয়া?”
আরিভ কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পায়। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেল। অদ্ভুত মহিলাতো! এভাবে কেউ নিজের নাতনিকে এসব বলে?
চলবে….