#বৈরী_বসন্ত ৩
লেখা – আয্যাহ সূচনা
দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে নাফিয়া। হাতে কাঁচা আম মাখা। কাসুন্দি আর লাল মরিচ দিয়ে ঝাল ঝাল কাঁচা আমের স্বাদ নিচ্ছে। সাথে বড় মাঠে খেলা দেখছে ভাইদের। ছোটবেলায় তার শখ ছিল। ছেলেদের মত করে ক্রিকেট খেলবে। ছোট ছোট প্লাস্টিকের ব্যাট বল দিয়ে জোহান, সাদিফের সাথে খেলেছেও। সাইকেল চালিয়েছে। কিন্তু সেগুলো ছোটবেলার সময়কালের সাথেই অতিবাহিত হয়ে গেছে। আর তার সাথে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনা। সেটির কথা মনে করতেই চায় না আর। ভাবতে চায় না খারাপ সময়ের কথা।
বল এসে আমের পাতে পড়লে ধড়ফড়িয়ে উঠে নাফিয়া। পুরো বাটি উল্টে মাটিতে পড়ে গেল। বলটি কোথা থেকে এসেছে সেটি দেখতেই সামনে তাকায়। কাঁধে ব্যাট রেখে কোমড় বাঁকা করে দাঁড়ান আরিভ। জোর গলায় বলল,
-“ চন্ডাল মেয়ে এখানে থাকতে ভালো কাজ হবে কী করে? আমার ৬ মিস হল ওর জন্য।”
নাফিয়া কম যায় না। সাথে সাথে বলল,
– “আপনি যে আমার আমগুলো মাটিতে ফেলে দিলেন? সেটার ভর্তুকী কে দিবে শুনি?”
-“আম গেলে আম পাওয়া যাবে। আমার ৬ কী ফিরে পাব?”
-“খেলতে জানলে হাজারটা ছয় মারা যায়।”
-“তাহলে তুমি এসো, খেলে হাজারটা ছয় মেরে যাও।’
নাফিয়া আঙুল দিয়ে নিজের হাতের দিকে ইশারা করে বলে,
-“এই হাতটা চললে ছয় মেরে দেখিয়ে দিতাম বুঝলেন।”
আরিভ সেখানেই থেমে গেল। মুখিয়ে ছিল নাফিয়ার পরবর্তী কথার কড়া জবাব দেওয়ার জন্য। আর দিল না। অদ্ভুত অনুভূতি হল তার। মেয়েটি খুব সহজেই নিজের দুর্বলতার হিসেব দিয়ে দিল। সামান্য মন খারাপটুকু করল না।
চোখের মণি এলোমেলো ঘুরিয়ে বলে উঠে,
-“ঠিক আছে। এবার তোমার আম আর আমের বাটি নিয়ে গায়েব হও।”
-“কেন? কেন গায়েব হব? মাঠ কী আপনার সম্পত্তি নাকি?” চেঁচিয়ে উঠল নাফিয়া।
-“আজব মেয়ে তো তুমি! মাত্র বলের বারি খেলে।”
নাফিয়া মুখ ভেংচি দেয়। আবার উঠে বসে দেয়ালে। সেখান থেকেই বলে,
-“এমনিতে চলেই যেতাম। কিন্তু এখন আপনি বলেছেন, তাই যাব না।”
আরিভের কপাল কুঁচকে গেল। আসলেই আজব মেয়ে। যুদ্ধে জিততে চাওয়া মেয়ে। অযথা তর্ক করা মেয়ে। আরিভও কম যায় না। বলে উঠে,
-“এবার বল আমের বাটিতে নয় সোজা মাথায় পড়বে।”
-“পড়ুক।”
-“মেইন রোডে পাগল দেখেছ না? সেই মহিলা পাগল হল কী করে জানো? একদিন এক মাঠে ক্রিকেট খেলা দেখছিল সেখান থেকে বল এসে তার মাথায় পরে এরপর কী হচ্ছে সেটাতো জানোই….”
-“ছোটবেলায় এসব গল্প ঠাকুমার ঝুলিতে শুনতাম। এই লোক আমাকে বাচ্চাদের গল্প শুনিয়ে তাড়াতে চাইছে।” বলে হেসে ফেলে নাফিয়া।
আরিভ লম্বা নিঃশ্বাস টেনে ছেড়ে দিল। নিজেকে শান্ত করল। তর্ক এভাবে চলতে থাকলে অনেক দূর গড়াবে। বড় হিসেবে তার পা পিছিয়ে নেওয়া উচিত। এনার্জি নেই এতটা। সব শক্তি ক্রিকেটে চলে গেছে। আরিভ আর কিছু বলল না। সাদিফের হাতে ব্যাট দিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল। নাফিয়া বলল,
-“হার মানলেন তাহলে?”
আরিভ এক পলক তাকাল নাফিয়ার দিকে। কিন্তু কিছু বলল না। হুট করে নাফিয়ার যেন কী হল। আরিভের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
-“এই আপনি কী মাইন্ড করলেন?”
আরিভ অবাকের চরম সীমায়। ছোটখাটো পুঁচকে মেয়েটার গোলগাল গালের দিকে তাকিয়ে বুকে হাত বেঁধে ফিরতি প্রশ্ন করে,
-“মাইন্ড করলেই বা কী আসে যায়? আসে যায় কিছু?”
নাফিয়া খানিক ঠোঁট উল্টে জবাব দেয়,
– “না কিছুই তো আসে যায় না।”
-“তাহলে কেন জিজ্ঞেস করছ?”
-“এমনিতেই! যাই হোক, আপনি মাইন্ড খেয়ে বসে থাকুন। আমার কী?”
-“ইক্সাক্টলি! এটাই তোমার আসল রূপ। বেশি ভালো সাঁজতে আসবে না।”
-“আমি ভালো বুঝলেন।”
আরিভ মাথা দুদিকে দুলিয়ে বলে,
-“না বুঝলাম না।”
বারান্দা থেকে আবার চেঁচামেচির আওয়াজ পাওয়া গেল। দাদী ডাকছে। কীসব যেন বলছে নাফিয়ার উদ্দেশ্যে। আরিভ, নাফিয়া দুজনেই তাকালো। নাফিয়ার মুখটা লটকে গেল। আরিভ বিরক্তিসহীত তাকায়। বৃদ্ধা মহিলা ক্যাটক্যাট করছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না ভালো কিছু বলছে। নাফিয়া দ্রুত পায়ে এগোতে চায় বাড়ির দিকে। সন্ধ্যা নামছে। আরিভ নাফিয়াকে ডেকে বলল,
-“মহিলার মাথায় সমস্যা আছে। ডাক্তার দেখাও।”
-“কার কথা বলছেন?” অবুঝ ভঙ্গিতে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করে নাফিয়া।
-“তোমার ওয়ান এন্ড ওনলি দাদী।”
-“আপনি আমার দাদীর সম্পর্কে এভাবে কেন বলছেন?”
-“আরেহ বাবাহ! উনি তোমাকে অপয়া ডাকে আর তোমার তার প্রতি কত দরদ…”
-“আমার দাদী আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলবে। তাতে আপনার কী?”
আরিভ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে উঠে,
-“কেউ একজন সত্যি বলেছে, দুনিয়াতে ভালো মানুষের ভাত নেই।”
_______
সন্ধ্যার আযান পড়তে না পড়তেই ড্রয়িং রুমে হাজির জমিলা বেগম। ছেলের সামনে নাতনীর একাজ ওকাজের ঝুলি খুলে বসেছেন। কান ঝালাই করার উদ্দেশ্যে বসেছেন তিনি সিদ্দিক সাহেবের। দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে নাফিয়া। সবটাই শুনছে নিঃশব্দে। জমিলা বেগম পান চিবুতে চিবুতে বললেন,
-“দেখ সিদ্দিক তোর মাইয়ার লক্ষণ ভালো না। পাশের বাড়ির পোলার লগে এত কীসের আলাপ?”
সিদ্দিক সাহেব নির্বিকার তাকালেন মায়ের দিকে। সাথে সাথে দৃষ্টি দেন দরজার দিকে। মেয়েটা বিরস মুখে দাঁড়িয়ে দেখছে, শুনছে। সিদ্দিক সাহেব গম্ভীর সুরে জবাব দেন,
-“কোনো দরকারে কথা বলতেই পারে মা। তাছাড়া আরিভ ভালো ছেলে।”
-“আজকালকার পোলাপানের চরিত্র আমার ভালই জানা আছে।”
-“মা আপনি ভুলভাল ভাবছেন।”
-“কীয়ের ভুলভাল! ওরে বিয়া দিয়া বিদায় কর। লুলা টুন্ডা মাইয়া কে নিব? আমার কাছে ভালো বিয়ার ঘর আছে।”
সিদ্দিক সাহেবের মুখভর্তি গাম্ভীর্য। একদিকে মা আরেক দিকে মেয়ে। মায়ের সাথে অতিরিক্ত সংযম নিয়ে কথা বলছেন। এড়িয়ে যেতে চাইছেন বিষয়টা।
নাফিয়ার মা এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন,
-“মা নাফি আমার আপনার কারোই ক্ষতি করছে না। এত কেন রাগ আপনার ওর প্রতি?”
তেতে উঠলেন জমিলা বেগম,
– “চোপা কম করো বউ। ক্ষতি করে নাই ওই? আমার পোলার রক্ত ঘাম এক করা টাকা নষ্ট করছে। ওর চিকিৎসা করাইতে গিয়া গেরামের জমিনটা বেচলো। বাপের ভিটা কেউ বেচে? সব ওই অপয়াটার কারণে।”
সিদ্দিক সাহেবের কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ল। এবার শক্ত বলেন তিনি। কঠোর গলায় বললেন,
-“আমি যেমন আপনার রক্ত, নাফিও আমার রক্ত। আপনি আমাকে ছোটবেলা থেকে লালন পালন করেননি? অসুস্থ হলে বাবা চিকিৎসা করায়নি? আপনি রাত জেগে সেবা করেননি? তাহলে আমার মেয়ের বেলায় আমি কেন করব না? এটা কোথাকার ইনসাফ!”
জমিলা বেগমের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। জীবনে প্রথমবার ছেলে মুখের উপর জবাব দিয়েছে। হতভম্ব হলেন কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু থামলেন না। বললেন,
-“তুই আমার পোলা, ব্যাটাজাত। তোরে পালছি এখন তুই আমারে পালতেছিস। আর নাফি হইল মাইয়া। পরের ঘরে যাইব। বুড়া বয়সে কে দেখব তোরে? তার মধ্যে মাইয়া অপয়া।”
-“মা থামেন আপনি দয়া করে। আমার মেয়েটা এখনও ছোট। আপনি ছেলে মেয়ের ভেদাভেদ করছেন এখন বুঝলাম। সন্তান আর বাবা মায়ের মধ্যে লেনদেন এর সম্পর্ক হল কবে থেকে?”
-“যা সত্যি তাই কইছি। মাইনা নিতে হইব।”
-“না মা মানা যাবে না। নাফির এক হাত অকেজো হওয়ার পেছনে ও না আমি দায়ী। আমার বাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়েছে। আমি আমার মেয়েকে রক্ষা করতে পারিনি। দোষ আমার। এই দোষের কারণে আমার মেয়ের বিয়ে না হয় তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি আমার দোষের ভর্তুকি দিব সারাজীবন। যতদিন বেঁচে আছি মেয়েকে নিজের কাছে রাখব। যেমন আপনাকে সেবা করে সন্তানের দায়িত্ব পালন করছি, আমি বাবার দায়িত্বটাও পালন করব। আপনি সেটিতে বাঁধা দিতে পারবেন না।”
______
“শ্রাবনের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে
অঝরে নামবে বুঝি শ্রাবনেই ঝরায়ে
শ্রাবনের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে
অঝরে নামবে বুঝি শ্রাবনেই ঝরায়ে
আজ কেন মন
উদাসী হয়ে….”
গানটি গাইতে গাইতে উদাসী হয়ে লাইনে থেমে গেল আরিভ। চোখ গিয়েছে পাশের বাড়ির বারান্দায়। আঁধারে কেউ একজন বসে আছে। হাঁটু ভাঁজ করে মাথা নুয়ে আছে, এক হাত সেই হাঁটুতেই প্যাঁচানো। গাছ পালার পাতাগুলো বাতাসে নড়েচড়ে চাঁদের আলোকে যেন জায়গা করে দিল বারান্দায় অবতরণ করতে।
আরিভ অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে তাকায়। এতক্ষণ এই মানবমূর্তির হদিস পেলো না সে? গলা ছেড়ে গান গেয়েছে। তার চেয়ে আশ্চর্য বিষয় হল যে বসে আছে সে তার গান নিয়ে আজ অভিযোগটুকু করল না।
আরিভ গিটার রেখে উঠে গেল। রেলিংয়ে ঝুঁকে ডাকল,
-“ভূত ভেবে ইগনোর করছিলাম তোমার ছায়াকে, এখন ভয় করছে।”
কি বলল কিছুই মাথায় ঢুকল না নাফিয়ার। উদাসী মুখে তাকায়। ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করে,
-“কী বললেন?”
-“নাথিং! তুমি এখানে কী করছ? দুঃখবিলাস?”
নাফিয়া হুট করে মাথা তুলে বলল,
-“আপনি আমার সাথে কথা বলবেন না প্লীজ।”
অবাক হয় আরিভ। নিজের ভাবমূর্তি বজায় রেখে বলল,
-“আমার তো বয়েই গেছে তোমার সাথে কথা বলার জন্য। তুমিই গায়ে পড়ে আসো ঝগড়া করতে।”
নাফিয়ার মুখটা চাঁদের আলোয় মলিন দেখলো। কাঁদছে বোধহয় মেয়েটি। নরম গলায় বলল,
-“আর কখনও ঝগড়া করব না। কক্ষনো করব না। আমি সরি।”
কন্ঠে কোনো তেজ নেই। ঝগড়ার ঝ টুকু নেই। একদম ঠান্ডা বরফের মতো কন্ঠ। এবার আরিভ অবাকের চরম সীমায় গিয়ে পড়েই যাবে হয়তো। এতদিনের শত্রুতা একদিনে শেষ?
আরিভ গম্ভীর সুরে জানতে চায়,
-“হয়েছে কী শুনি? যুদ্ধ বিরতি কেন ঘোষণা করলে হঠাৎ?”
-“এমনিতেই” কন্ঠ নেমে এলো আরো খানিকটা নাফিয়ার।
আরিভ নড়েচড়ে উঠে। বলে,
-“নিশ্চয়ই তোমার দাদী উল্টোপাল্টা কীছু বলেছে।”
নাফিয়া অবাক চোখে তাকায়। বুঝল কি করে? লোকটাকে দেখে তো বুঝদার মনে হয়না। ছোট্ট করে জবাব দিল,
-“উহু।”
আরিভ বিশ্বাস করল না। তার ওই মহিলার উপর এক বিন্দু ভরসা নেই। আরিভ বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে। বাদ দিতে ইচ্ছে করল না কেন যেন। বলল,
-“তোমার হাত নিয়ে তোমার দাদী এত কথা শোনায় কেন? মানুষের লাইফে এক্সিডেন্ট হতেই পারে।”
-“হু।”
আরিভ জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। দুহাত কচলে প্রশ্নটি করেই ফেলল,
-“কী হয়েছিল হাতে?”
নাফিয়ার জ্বলজ্বল করা দৃষ্টি চাঁদের আলোয় পুরোপুরি স্পষ্ট হল আরিভের কাছে। মুখ ফুলে আছে। ঠোঁটগুলো তিরতির করে কাঁপছে। আরিভ বারংবার পলক ফেলল। আরও জোর দিয়ে জানতে চাইল,
-“বল কী হয়েছিল?”
নাফিয়ার ইচ্ছে হল বলতে। কেন সে জানে না। তার তথাকথিত শত্রুর কাছে উজাড় করতে ইচ্ছে হল। কারো সাথে তো ঠিকঠাক প্রকাশটুকু করা হয়না। নাফিয়া বলল,
-“সেদিন আমার স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠান ছিল। স্কুল জীবনের সমাপ্তির দিন। আমি প্রথমবার শাড়ি পড়েছিলাম। ১০ বছর যেখানে কাটিয়েছি সেই স্কুলকে বিদায় জানাতে যাচ্ছিলাম বাবার সঙ্গে বাইকে করে। রাস্তা ভাঙাচোরা, বৃষ্টির দিন ছিল। বাবা বাইক নিয়ে যেতে যেতে বড় একটি খাদ ছিল সামনে। বাবা খেয়াল করেনি। বাইকের ব্রেক কষতে কষতে বাইকটি খাদে পড়ে। আর আমি ডানদিকে রোড ডিভাইডারের উপর….”
হেঁচকি উঠে গেল নাফিয়ার। আরিভ তাড়াহুড়ো করে বলে বসে,
-“আচ্ছা থাক! আর বলতে হবে না।”
-“আমার হাতটা।”
বলে মুখ চেপে কেঁদে উঠলো নাফিয়া। আরিভ বিচলিত হয়। কী করবে এখন? এই মেয়ের কান্না কী করে থামাবে। আরিভ বলল,
-“তুমি বেঁচে আছো এটা কী বড় বিষয় নয়?”
-“এভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ? কত কথা শোনায় আমাকে দাদী।”
-“ওনার কাজই এটা। বুড়ো বয়সে মাথার বাত্তি ফিউজ হয়ে গেছে। তুমি কান্না থামাও বলছি।”
-“আমার কান্না থামছে না। খারাপ লাগছে…”
অবলীলায় আদুরে গলায় বলে উঠল নাফিয়া। আরিভের অদ্ভুত রকমের খারাপ লাগায় ভরে উঠে মন। মাথা চুলকাতে লাগলো। পরপর ফটাফট বলে উঠে,
-“আইসক্রিম খাবে?”
নাফিয়ার কান্না থেমে যায়। ভেজা চোখে বিষম খেয়ে তাকায়। সে কান্না করছে আর এই লোক তাকে আইসক্রিম অফার করছে? আরিভ বলল,
-“এখানেই বসো, আসছি।”
দ্রুত কদমে গেল, আবার ফিরেও এলো। হাতে আইসক্রিম। নাফিয়া আরও বিষম খায়। রেলিং থেকে উপুড় হয়ে এগিয়ে দিল। বলল,
-“ধরো! রাতে কাজ করতে করতে খেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোমার মত দুঃখিনীকে দেওয়া উত্তম।”
নাফিয়া আইসক্রিম না নিয়েই তাকিয়ে আছে। অধৈর্য হয়ে উঠল আরিভ। বলল,
-“নিচ্ছ না কেন? যতদূর জানি তোমাদের মত বাচ্চাদের এসব পছন্দ।”
-“আপনি আমাকে আইসক্রিম দিচ্ছেন? এটাও সম্ভব?”
-“অসম্ভবকে সম্ভব করা আরিভ ইনতিশারের কাজ। এবার নাও, আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।”
নাফিয়া হাত বাড়িয়ে আইসক্রিম নিল। আরিভ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বলে,
-“গেলাম।”
বলে হাঁটা শুরু করল আরিভ উল্টো ঘুরে। নাফিয়া ডাকলো,
-“শুনুন।”
-“বলো?”
-“ধন্যবাদ আপনাকে আমার কথাগুলো শুনবার জন্য। আর সরি আপনার সাথে ঝগড়া করার জন্য। আজকের পর থেকে আপনাকে জ্বালাব না আমি, তর্কও করব না।”
অথচ আরিভ চলে যাচ্ছিল। সে থেমে আছে। নাফিয়া গেছে। আরিভ কি যেন ভাবল কিয়ৎক্ষণ। এরপর নিজেও চলে গেল ঘরে। শুয়ে পড়ল বিছানায় উবুড় হয়ে। ফোন হাতে নিয়ে দেখল রাত বারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। আচমকা মস্তিষ্কে হানা দিতে শুরু করল ওই বাচ্চা মেয়েটির কান্না। তার কাছে নাফিয়া বাচ্চা-ই। বয়সে অনেকটা ছোট। জীবনে হয়তোবা অনেক কিছু পাবার বাকি। কিন্তু?
আরিভের মধ্যে এক অদ্ভুত খারাপ লাগা কাজ করতে শুরু করে। এতদিন যে মেয়েটিকে ‘ চন্ডাল’ বলে সম্বোধন করেছে তার জন্য মায়া হচ্ছেই বা কেন? রাতের আরও কিছু মুহূর্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর ফোন হাতে নেয় আরিভ। কোনো ভাবনা চিন্তা ছাড়া নাফিয়ার ফেসবুক আইডি খুঁজে বের করল। সঙ্গেসঙ্গে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল তার একাউন্টে। এরপর, এরপর অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ।
ঠিক আধঘন্টা পর এক্সেপ্ট হয়েছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটি। সাথে সাথে মেসেজও এসেছে,
-“আপনি আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট কেন দিলেন?”
-“তুমি এক্সেপ্ট কেন করলে?”
-“কেন দিয়েছেন সেটা জানার জন্য।”
হাসলো আরিভ। জবাবে লিখল,
-“নাফি তোমার বয়স কম। এ বয়সে দুঃখ জমিও না। দুঃখ খুব সহজেই কিনতে পাওয়া যায় কিন্তু সুখ দুর্লভ। এটা বলার জন্যই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়েছি। গুড নাইট।”
চলবে…