#বৈরী_বসন্ত ৪
লেখা – আয্যাহ সূচনা
সূর্য গগন পোড়াচ্ছে, সাথে জমিনে থাকা মানবজাতিকেও। চলাচল করা মানুষের মাঝে অস্থিরতা, ক্লান্তি। কিন্তু জীবিকা নির্বাহ করতে হবে, এই সূর্যের তেজকে উপেক্ষা করেই হাঁটতে হবে। কেউ যাচ্ছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার কেউবা কাজে।
বাস স্টপে দাঁড়িয়ে নাফিয়া। পরপর তিনটে বাস মিস হল। এটা প্রায় সময়ই হয় তার সাথে। মানুষ ঠেলে ধাক্কা দিয়ে বাসে উঠে পড়ে। পারেনা শুধু সেই। সূর্যমামা মাথার উপর বিরাজমান। কপালে চুল লেপ্টে গেছে ঘামে। ক্যাম্পাসে যেতে হবে। আজ পরীক্ষা আছে। কিন্তু কিছুতেই যে বাস ধরতে পারছে না।
ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই কানের কাছে জোরে কেউ হর্ন দিল। নাফিয়া কান চেপে ধরে। ভড়কে পাশে তাকায়। হেলমেটের গ্লাস তুলে আরিভ বলল,
-“কী অবস্থা?”
মশকরা করছে নাকি মাঝরাস্তায়। নাফিয়া তেড়ে যাচ্ছিল তীক্ষ্ম জবাব দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু হুট করেই মনে পড়ল গতরাতের কথা। সে বলেছিল ঝগড়া করবে না। দমে গেল সাথে সাথে। মুখ ঘুরিয়ে অন্যপাশে চেয়ে রইল।
আরিভ বাইক এগিয়ে নাফিয়ার সামনে দাঁড় করিয়ে বলে,
-“কানে শুনো না?”
-“নাহ!”
-“শ্রবণশক্তি লোপ পেয়েছে হয়তো গরমে।”
নাফিয়া উত্তর দিল না। আরিভ হেলমেট খুলে রাখে। চুলে হাত চালিয়ে বলল,
-“ক্যাম্পাসে যাচ্ছ?”
-“হ্যাঁ।”
-“বাস তো নেই।”
-“এসে যাবে।”
আরিভ ঠোঁট কামড়ে ভাবল। বলল,
-“নামিয়ে দিব?”
নাফিয়া ঘুরে তাকায়। চোখ যায় বাইকে। শরীরে কেমন যেন একটা ঝাঁকুনি দিল। সেদিনের কথা মনে পড়ে গেছে। এক্সিডেন্টের পর থেকে বাইকে চড়ে নি সে। কেমন যেন ফোবিয়া হয়ে গেছে। দুয়েক কদম পিছিয়ে বলল,
-“নাহ! একদম না!”
নাফিয়াকে ভীত দেখে আরিভ বলল,
-“কেন দেরি হচ্ছে না?”
-“আমি বাইকে চড়ব না। একদম চড়ব না।”
আরিভের বুঝতে বাকি নেই ঘটনা কি। সে বলল,
-“উঠে বসো, হেলমেট দিচ্ছি।”
-“বললাম তো যাব না।”
-“উঠো নাফি।”
-“নাহ!”
আরিভ শক্ত দৃষ্টিতে তাকায়। মুখটা গাম্ভীর্যে ভরে উঠল। কথা মানানোর জন্য এই রূপ যথেষ্ট। আরিভ রাগী সুর টেনে বলে উঠে,
-“ভয় ভাঙাব তোমার, দ্রুত এসো।”
-“আপনাকে আমি কী বলছি বুঝতে পারছেন না?”
-“এক লাইন বেশি বুঝতে পারছি। উঠে বসো নাফিয়া, আমি কথাটি আরেকবার বলব না। তুলে নিয়ে যাব। হারি আপ!”
-“আমি মরেই যাব ভয়ে। প্লীজ জোর করবেন না।”
-“ফালতু কথা বলবে না। সারাজীবন ভয় নিয়ে থাকবে? ভয় নিয়ে থাকলে সুস্থভাবে বাঁচতে পারবে না। আমার রাগ উঠার আগে উঠে বসো। এক থেকে তিন গুনছি।”
বলার সাথে সাথে আরিভ ‘ ১, ২’ বলে গুনতে শুরু করল। নাফিয়া কেঁপে উঠছে বারবার। কম্পিত হাতে হেলমেট নেয়। মাথায় দিতে দিতে গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে যেন। হেলমেট এডজাস্ট করতে পারছে না ভয়ে। আরিভ হাত এগিয়ে হেলমেট ঠিক করে দেয়। বলে,
-“হুম, এবার উঠো।”
আরিভ পেছনে থাকা ব্যাগ সামনে আনে। নাফিয়ার ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও উঠে বসল। আরিভ ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিল। বলল,
-“খাও আগে।”
পানি পেয়ে যেন জীবন ফিরে পেয়েছে। পানিকে বারণ করল না। গটগট করে গিলল। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছিল। আরিভ আবার বলে উঠে,
-“শুনো, ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। আমি ধীরে চালাব। ধরে বসো।”
-“এক হাতে কিভাবে ধরে বসব?”
আরিভ বিষয়টি নিয়ে আগে ভাবেনি। মাথায় ছিল না একদম। হুট করে বলে উঠল,
-“নামো।”
-“আবার নেমে যাব?”
-“হ্যাঁ। নেমে আমি যেইভাবে বসেছি সেইভাবে বসো।”
রেগে রেগে আদেশ ছুঁড়ে চলেছে। হলো কি তার? এভাবে কথা কখনোই বলেনি আগে। তাদের তর্কের সময়ও না। এত যন্ত্রণা ভালো লাগছে না নাফিয়ার। নেমে গিয়ে আবার বসল ছেলেদের মত করে। অদ্ভুত লাগছে। পা ঢেকে নেয় ওড়নার সাহায্যে। আরিভ পিছন ফিরে বলল,
-“এবার একহাতেই আমাকে ধরে বসো।”
-“না আপনাকে ধরব না।” সাথে সাথে জবাব দিল নাফিয়া।
-“কেন আমার গায়ে কি পোকা ধরেছে?”
-“হ্যাঁ।”
আরিভ নাফিয়ার হাত নিজে থেকে টেনেই কাঁধে রাখল। নাফিয়া ভড়কে উঠে। সাথে সাথে অন্যপাশে ঘুরে আরেক হাত টেনে কাঁধে রাখল। প্রথম স্পর্শ অনুভব করতে পারলেও দ্বিতীয়টি পারেনি। দ্বিতীয় হাত কিছুই অনুভব করতে পারেনা।
-“হাত সরাবে না।”
বাইক চলতে শুরু করেছে। নাফিয়া চোখ বন্ধ করে নেয়। দুয়া দুরুদ পড়তে শুরু করল। একহাতে শার্ট খামচে ধরল আরিভের। আরিভ জবাব দেয়,
-“ভয়ের কিছু নেই। চোখ খুলো।”
-“আপনি চুপ থাকুন।”
-“বেয়াদব মেয়ে!”
-“যে বলে সেই।”
আরিভ প্রতুত্তরে কিছু বলেনি। হেসেছে শুধু। ছোটবেলায় এই প্রচলন ছিল। কেউ কাউকে খারাপ কিছু বললে এই উত্তর আসতো ‘ যে বলে সেই ’।
নাফিয়ার ভার্সিটি বাড়ি থেকে চল্লিশ মিনিটের দূরত্বে। বাইক চলছে দশ মিনিট যাবত। নাফিয়ার মধ্যে কোনো নড়চড় নেই। খিচে চোখ বন্ধ করে আছে, শক্ত হয়ে বসে আছে। মুখ জুড়ে ভয়ের ছাপ। আরিভ দেখল তাকে। চলন্ত বাইকে আওয়াজ উঁচিয়ে বলল,
-“চোখ খুলো।”
-“উহু।”
-“আবার উহু করে! চোখ খুলো বলছি।”
-“আপনি এমন করছেন কেন?”
-“এত কথা শুনতে চাইনি। চোখ খুলো।”
নাফিয়া ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকায়। বাতাসের ঝাপটা এবার চোখেও লাগল। খামচে ধরল আরিভের শার্ট আরও শক্ত করে। আরিভ বলে উঠে,
-“শার্ট ছিঁড়ে ফেলার ইচ্ছা আছে আমার? ছিঁড়লে তোমাকে দিয়ে নতুন একটা কিনিয়ে নিব।”
-“আমার ভয় করছে তো!”
-“ভয়কে জয় করো।”
-“ডায়লগ মারা বন্ধ করে আমাকে নামিয়ে দিন দ্রুত।”
-“মাঝরাস্তায় নামিয়ে দিব?”
-“এই নাহ!”
-“তুমিই তো বললে।”
-“বলেছি ক্যাম্পাসে নামিয়ে দিতে।”
লুকিং গ্লাসে ভীত কুঁকড়ে থাকা নাফিয়াকে দেখে হাসছে আরিভ। যথাসম্ভব ধীরে চালাচ্ছে। যেন সে ভয় না পায়। হুট করেই মাথায় একটি বিষয় এলো। মা ব্যতীত কোনো নারী তার বাইকের সিটে আজ অব্দি জায়গা পায়নি। নাফিয়াই প্রথম। ভ্রুযুগল উঁচু করে আরিভ। কোথায় ভেবেছিল বউকে বসাবে, সেখানে বসে আছে অসভ্য একটি মেয়ে।
ক্যাম্পাস গেটের সামনে আসতেই লাফিয়ে নেমে যায় নাফিয়া। যেন জানে পানি এলো মাত্র। দাঁড়িয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। তোড়জোড় শুরু করল হেলমেট খুলবে বলে। পারছে না সেটিও। আরিভ হতাশায় দুদিকে মাথা দুলিয়ে হাত এগিয়ে দিল। বলল,
-“একটা কাজ পারো না। পারো শুধু পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করতে।”
ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়ে রইল নাফিয়া। জবাব দিল না কোনো। মনে অন্য একটি কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। বলবে? কি বলবে না? ভাবতে ভাবতেই মুখের সামনে তুড়ি বাজায় আরিভ। বলে,
-“কী?”
-“শুনুন, আপনি আমাকে নামিয়ে দিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি আর আপনার সাথে ঝগড়াতো দূরে থাকুক, কথাও বলতে চাইনা। আপনাকে অপমান করছি না। কিন্তু আমার দাদী বিষয়টা খারাপ চোখে দেখছেন। আমি চাই না..”
-“থামো! তোমার এক্সাম শেষ কখন?”
নাফিয়াকে থামিয়ে দিয়ে আরিভ প্রশ্ন করে। নাফিয়া অবাক সুরে শুধায়,
-“কেন?”
-“প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন করো কেন? জানতে চেয়েছি জবাব দাও।”
-“১ টায় শেষ। কিন্তু কেন?”
-“আমার কাজ শেষ সাড়ে বারোটায়। এখানেই দাঁড়াব আমি। সোজা চলে আসবে।”
-“অর্ডার দিচ্ছেন নাকি হুমকি?”
-“দুটোই।”
-“আমি আপনার সাথে যাব না।”
-“তোমার দাদী এমনিতেই বিষয়টা খারাপভাবে নিচ্ছে। আমি যদি আরো ইনিয়ে বিনিয়ে বলি তুমি আমি প্রেম করি তাহলে বিষয়টা কেমন হবে বলো তো?”
-“ছিঃ!”
-“ছিঃ মানে?”
-“আপনার সাথে প্রেম! অসম্ভব!”
-“আমরা তো সত্যি সত্যি প্রেম করছি না। কিন্তু তোমার দাদী জানবে করছি। এখন চয়েজ তোমার। আসি আমি। যা বলেছি মনে থাকে যেন।”
_______
আরিভের কাজ দ্রুতই শেষ হল। তখন এগারোটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বাবা ঢাকার বাহির থেকে কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ পাঠিয়েছেন। ব্যবসার কাজে তিনি ঢাকার বাহিরেই থাকেন সপ্তাহের চারদিন। বাকি তিনদিন বাড়িতে। বয়স হওয়া সত্ত্বেও এখনও ভীষণ ফিট আতাউর সাহেব। অথচ ছেলে তার বাবার কাছেও যেতে পারেনি। নয়টা থেকে পাঁচটা অফিস করে এই বয়সেই হাঁপিয়ে যায়।
পার্সেল নিয়ে রওনা হতে গিয়ে মনে পড়ল ওই অসভ্য মেয়েটাকে নিয়ে যেতে হবে। হয়তো বাসের আশায় রাস্তায় হা করে দাঁড়িয়ে থাকবে অধমটা। এসব বিড়বিড় করতে করতেই বাইক স্টার্ট দেয়। আধ ঘণ্টার মধ্যে এসে পৌঁছায় নাফিয়ার ক্যাম্পাস গেটে। হাত ঘড়িতে দেখল অনেকটা সময় বাকি এখনও তার পরীক্ষা শেষ হতে। গাছের নিচে বাইক পার্ক করল। অপেক্ষা ছাড়া আর কিই বা করবার আছে? পাশে ঠান্ডা ঠান্ডা গেন্ডারির শরবত বিক্রি হচ্ছে। আপাতত এটাই উপায় সময় পাড় করার। সানগ্লাস চোখে দিয়ে কনুই ঠেকিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে বলল,
-“মামা একগ্লাস শরবত দাও। সেই এক গ্লাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে আরেক গ্লাস দিবে। কোনো থামাথামি চলবেনা।”
গুণে গুণে পাঁচ গ্লাস শরবত শেষ হয়েছে। দোকানী শরবত দিতে দিতে ক্লান্ত। সাথে আলাপ চলছে তাদের। আরিভ নানান প্রশ্ন করছে তাকে তার জীবন নিয়ে। এক পর্যায়ে মামা বলল,
-“প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করছেন মামা?”
আরিভ ফিক করে হেসে উঠে,
– “প্রেমিকা না মামা, যার জন্য অপেক্ষা করছি সে আমার শত্রু।”
অবাক হলেন তিনি। বললেন,
– “শত্রুর লেইগা কেউ এই গরমে অপেক্ষা করে?”
আরিভ স্মিত হেসে জবাব দেয়,
– “আমার শত্রুটা একটু ছোটখাটো, নাজুক। বেচারীর প্রতি মায়া হচ্ছে আজকাল। তাই আরকি!”
-“দেখবেন এমনে একদিন শত্রু থিকা প্রেমটাও হইয়া যাইব?”
আরিভ তাকায় তার দিকে। ভ্রূদ্বয় নাচিয়ে প্রশ্ন করল,
-“তাই নাকি?”
-“হ দেখেন না নাটক সিনেমায় এমনই হয়।”
-“আমার বেলায় হবে না মামা।”
-“হইবো দেইখেন আপনি। আমি কইলাম। আপনি যেমনে অপেক্ষা করতেছেন ওমনে প্রেমিক পুরুষরা করে।”
মামার কথা শেষ হতে না হতেই সামনে তাকাল আরিভ। তার বলা কথা নিয়ে ভাববার সময় পায়নি। সামনে থাকা ক্লান্ত শুভ্র বদনে চোখ গেল। দৃষ্টি প্রখর তার। রোডের অন্যপাশে নাফিয়ার একেবারেই স্পষ্ট। ঘাড় এদিক ওদিক ঘুরিয়ে একা মেয়েটি খুঁজছে কাউকে। নিশ্চয়ই আরিভকে। আরিভ কিছুক্ষণ নীরবে নিভৃতে তাকিয়ে নাফিয়ার চঞ্চলতা দেখল। হুট করেই লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে হাত তুলে ডাকে। চিৎকার করে বলে,
-“আমি এখানে।”
শব্দ শুনে নাফিয়া সামনে তাকায়। তাড়াহুড়ো কদম ফেলে রোড পাড় করে এলো। এসেই মুখ কুঁচকে ফেলে। আরিভ বাইকে ঠিক হয়ে বসল। নাফিয়ার দিকে হেলমেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছি। এবার তুমি আমাকে লাঞ্চ করাবে।”
নাফিয়া জবাব দিল, -“করাবো না।”
-“হুশ! উঠো তাড়াতাড়ি।”
-“বাইকে যাওয়া কি অনেক জরুরী?”
-“নাহ তোমার জন্য হেলিকপ্টার আনাই?”
আরিভ ব্যাঙ্গ করল। নাফিয়ার মুখটা আরো ঝুলে যায়। কেন যেন না শব্দটা তার মুখ দিয়ে বেরোতে চায় না। অন্যরা সবসময়ই তার উপর ইচ্ছা চাপিয়ে দিয়েছে। সে মেনে নিয়েছে নীরবে। প্রতিবাদ করতে পারেনি। যেমন এখন আরিভ।
নাফিয়ার নিরীহ মুখখানা দেখে আরিভ বলল,
-“আমার সাথে তোমার সম্পর্ক সাপে নেউলের হতে পারে। কিন্তু ট্রাস্ট মি, তোমার ভালোর জন্যই জোর করে তোমাকে বাইকে নিয়ে যাচ্ছি। ভয় না কাটলে সারাজীবন ট্রমাতে থাকবে নাফি। ভয় একবার কেটে গেলে রিলিফ পাবে।”
নাফিয়া চোখ তুলে তাকায়। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হেলমেট পড়ল। কিন্তু লক করতে পারল না। নিজে থেকে এগিয়ে গিয়েই বলে,
-“এটা লাগিয়ে দিন।”
আরিভ নাফিয়ার আবদার আর বোচা মুখখানা দেখে আলগোছে হাসে। সাহায্য চাইছে মুখ লটকে। সুন্দর করে নিজে থেকে এসেই আবদার করে বসল।
_______
জমিলা বেগম অনেকক্ষণ যাবত কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন। মুখ খানা উজ্জ্বল তার। নিশ্চয়ই তার পছন্দের কারো সাথে কথা বলছেন। নাফিয়া ঘরে ঢুকতেই তিনি চেঁচিয়ে বললেন,
-“এই সিদ্দিকের বউ। তোমার মাইয়ারে এই শুক্কুরবার ছেলেপক্ষ দেখতে আইব। আয়োজন শুরু কর।”
নাফিয়া সবে মাত্র ঘরে ঢুকছিল। কথাটি শুনে থেমে গেল। রেশমা বেগম এ যাত্রায় রেগে গেলেন। বলেন,
-“মা আপনি আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন?”
-“তোমাগো থিকা এখন আবার অনুমতি নিতে হইব নাকি?”
-“আমরা নাফির বাবা – মা। অনুমতি নেওয়া কি জরুরী না?”
-“এসব নয়া যুগের কথা আমার লগে কইয়া লাভ নাই। আমি কথা দিয়া ফেলছি। ওরা আইব।”
নাফিয়ার বাবা ঢাকায় নেই। ফিরবেন সপ্তাহখানেক পরে। এই সুযোগে জমিলা বেগম তার স্বার্থ উদ্ধারে লেগে পড়েছেন। নাফিয়া শান্তশিষ্ট মেয়ে। আজ নিজের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারল না। কাছে এসে বলল,
-“আমি বিয়ে করব না দাদী।”
-“তো কি সারাজীবন আমার পোলার ঘাড়ে বইসা অন্ন ধ্বংস করবি অপয়া!”
অকস্মাৎ রাগান্বিত সুরে জমিলা বেগম কটু বাক্য ছুড়লেন। নাফিয়ার চোখের কোণে জল জমতে এক মুহুর্ত সময় নেয় নি। ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপতে শুরু করল। অপয়া কথাটি শুনতে শুনতে অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আজ হৃদয়ে এসে আঘাত করে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ার পূর্বেই দৌঁড়ে ঘরে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে দিল।
জমিলা বেগম বলেন, -“তোমার মাইয়ার তেজ কমাইতে কইবা। বিয়ার পর এগুলা চলব না। আর পাশের বাড়ির পোলার লগে নোংরামি যেন না করে। পোলা বাড়ির মানুষ খোঁজখবর নিলে সমাজে মুখ থাকব না।”
রেশমা বেগম বলেন, -“মা! আপনি বাড়াবাড়ি করছেন।”
-“এটা আমার পোলার বাড়ি, পোলার ঘর। দশমাস দশদিন পেটে ধরছি। সারাজীবন পালছি ওর বাপ মরার পর। মাইনষের বাড়ি বাড়ি কাম করছি। আমার হক আছে এদিকে। তুমি পরের মাইয়া বিয়া কইরা রাজরানীর হালে থাকছ এই কারণে এত তেজ।”
রেশমা আর কিছু বললেন না। চলে গেলেন নিজের ঘরে। সিদ্দিক সাহেবকে কল করে জানাতে হবে। উনি যতদিন ঢাকায় আছেন তার মেয়েটিকে শান্তিতে বাঁচতে দিবেন না। তাকে গ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
হেঁচকি তুলে কান্না করছে নাফিয়া। আওয়াজ যেন বাহির অব্দি না যায় সে কারণে মুখটা চেপে ধরলো। কি দোষ তার? শুধু এই একটা প্রশ্ন মনের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। উত্তরও আছে এই প্রশ্নের। কোনো দোষইতো নেই তার। কোনো অপরাধ না করা সত্ত্বেও কেন শাস্তি পেতে হচ্ছে?
টুং শব্দ করে ফোনে একটি মেসেজ এল। নাফিয়া কান্না থামায় কিছুক্ষণের জন্য। ফোন হাতে নিয়ে দেখল আরিভ তার কুঁচকে যাওয়া শার্টের ছবি দিয়েছে। লিখেছে,
-“এমনভাবে খামচে ধরে কেউ শার্ট? সকালেই আয়রন করেছিলাম। তুমি আমার প্রিয় শার্টের অর্ধেক জান বের করে ফেলেছ। আয়রন তোমাকে দিয়েই করাব চন্ডাল মেয়ে।”
শেষে চন্ডাল কথাটি শুনে অজান্তে ঠোঁটে হাসি ফুটল। পরপর মিয়ে গেল। মনে পড়ল দাদীর কথা। ফিরতি মেসেজে লিখল,
-“আপনি আমার সাথে দয়া করে আর কোনো কথা বলবেন না। আমি চাই না আমার কারণে আপনাকেও নোংরা কথা শুনতে হোক। আমাকে মেসেজ করবেন না। দেখা হলে এড়িয়ে যাবেন প্লীজ।”
চলবে….