#বৈরী_বসন্ত ৫
লেখা – আয্যাহ সূচনা
আরিভের কথামতই তার ঘরের পাশে বড় খোলা লাগোয়া ব্যালকনি থাকবে। বাড়ি তৈরি করার সময় আগেই বলেছিল ঘরটা তার। অফিস থেকে ফিরে বেশিরভাগ সময় খোলা আকাশের নিচেই কাটে। দখিনা বাতাস বয়। আশপাশে বিভিন্ন ধরনের গাছ। আরিভের মতে এই এলাকায় কোনোদিন অক্সিজেনের অভাব হবে না। চারিদিকে গাছ গাছালিতে ভরপুর। আরিভ কখনও গান করে এখানে গিটার নিয়ে, কখনও গান শুনে আবার কখনও অফিস থেকে বয়ে আনা কাজ করে বসে বসে। চঞ্চল প্রাণ সে। বয়সের ভার স্বভাব চরিত্রে ভর হতে দেয়নি। প্রাণ খুলে বেঁচেছে সর্বদাই।
তিনদিন যাবত এক ভিন্ন চিন্তায় মগ্ন সে। চিন্তার কারণ তারই তর্কের সঙ্গী নাফিয়া। মেয়েটির হদিস নেই। তিনদিনে কয়েকবার পাশের বাড়ির বারান্দায় উঁকি দিয়েছে। পায়নি মেয়েটিকে। গাছগুলোকে দেখল। পানি না পেয়ে কেমন যেন নুয়ে গেছে। ভাবনা চিন্তার ভার দ্বিগুণ হল। গাছের মায়া ত্যাগ করল কেন? ফেসবুকে একবার মেসেজ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো জবাব পায়নি আরিভ।
নিচে রাস্তা দিয়ে জোহানকে যেতে দেখে ডাকল আরিভ,
-“কীরে?”
-“জি ভাই?”
-“কোথায় যাচ্ছিস?”
-“সন্ধ্যার নাস্তা আনতে যাচ্ছিলাম ভাই।”
আরিভ থামল। ভেবে চিন্তে জিজ্ঞাসা ছুড়লো,
– “নাফির খবর জানিস?”
জোহান অবাক হয়। তার চাহনীও অদ্ভুত। নাফির কথা জিজ্ঞাসা করছে আরিভ? সে সেই আশ্চর্য সুরে জানতে চাইল,
-“নাফি আপুর কথা জানতে চাইছেন আপনি?”
-“তো এই এলাকায় আরো কয়েকটা নাফি আছে নাকি?”
-“অবাক হচ্ছি ভাই।”
-“তোর অবাককে মাটিচাপা দে। বল নাফি কোথায়?”
জোহান বলল,
– “তার সাথে আমার কিছুদিন যাবত কথা, সাক্ষাৎ কোনোটাই হয়নি।”
-“বিলুপ্ত হয়ে গেল নাকি?”
-“গেলে তো আপনিই খুশি হবেন।”
আরিভের কাছ থেকে সরাসরি হ্যাঁ বোধক উত্তর এল না। সে ভাবল কি যেন। জোহান চেয়ে আছে। আরিভ তার ভাবনা চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
-“আচ্ছা তুই তোর কাজে যা।”
জোহান মাথা চুলকায়। বুঝে উঠতে পারল না কিছু। বোকার মত না বুঝেই নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল।
আবারও চিন্তামগ্ন আরিভ। আঁধার বারান্দার দিকে এক পলক চেয়ে ঘরে চলে আসে। ল্যাপটপ খুলে বসল। এক পা নিচে ঝুলছে। কিবোর্ডে আঙুল চালাতে চালাতে বিছানার হার্ডবোর্ডে পিঠ ঠেকে। কাজে কেন যেন মনোযোগ দিতে পারল না। মস্তিষ্ক জুড়ে আছে একটি প্রশ্ন,
-“তিনবেলা খাবারের বদলে ঝগড়া করে পেট ভরা মেয়েটি একেবারে উধাও। কিন্তু কি কারণে?”
কারণটা কিছুটা হলেও আরিভের কাছে স্পষ্ট। তার ঘরে থাকা এক বৃদ্ধা ছাড়া আর কেউই হতে পারে না। নিশ্চয়ই কিছু একটা বলেছে সে। নাফিয়ার শেষ মেসেজ সেটিই ইঙ্গিত করে।
আরিভ ফোন হাতে তুলে। বার্তা লিখল। জবাব আসবে না সে জানে। তারপরও লিখল,
-“তোমার প্রিয় গাছগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে অসভ্য মেয়ে।”
______
দেখতে দেখতে জুম্মাবার হাজির হল। আরিভের বাবা আজ বাড়িতে। অল্প কয়েকদিন থাকেন বাসায়। বাবা ছেলে একসাথে নামাজ আদায় করার সুযোগ পায় এটাই অনেক। সাথে বাবা আসা উপলক্ষে মায়ের হাতের মজার মজার খাবার। আজও তাই। আযানের আগে যত তোড়জোড়। গোসল সেরে শুভ্র পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়েছে আরিভ। সাদা রংটা ভীষণ প্রিয় তার। গায়ে আতর মেখে বাবার সাথে বাড়ির সদর দরজায় যাওয়ার সাথে সাথে দেখা মিলল সাদিফ আর জোহনের। তারাও মসজিদের দিকে যাচ্ছে।
আরিভের আনচান করতে থাকা মন সাদিফের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে বসে,
– “এই চন্ডালের দেখা নেই আজ অনেকদিন। কোথায় গেছে জানিস?”
-“কে, নাফি?”
-“আর কাকে চন্ডাল ডাকি আমি?”
-“জানি না ভাই। আমিও কয়েকবার মেসেজ করলাম। পাত্তাই দিল না।”
অর্থাৎ কারো সাথেই যোগাযোগ নেই এই মেয়ের। কি এমন হয়ে গেল যে তার প্রিয় দুজনের সাথেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে? এমনিতেতো সাদিফ জোহানের সাথে চিপকে থাকে। আরিভ বিরক্ত সুরে বলল,
-“মহিলা মানুষের যত নাটক!”
-“আপনি কেন ওর তলব করছেন?”
-“হিসাব নিকাশ বাকি কিছু।”
-“তাই নাকি ভাই?”
আরিভ আড়চোখে তাকাল সাদিফের দিকে। তার মুখে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি। মতলব ভালো না। বিরক্তিকর চাহনী ছুঁড়ে সামনে হাঁটতে শুরু করল।
নামাজ শেষে বাড়ি ফিরেছে ঘন্টাখানেক হল। খেয়ে দেয়ে অলস শরীর বিছানায় ঠেকাবার আগেই শিরীন বেগমের উঁচু গলায় চিৎকারে নড়েচড়ে উঠে আরিভ। তাকেই ডাকা হচ্ছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে সে। ডাকছে নিশ্চয়ই কোনো কাজ ধরিয়ে দিবে। উদাস মুখে হেলেদুলে গিয়ে হাজির হল রান্না ঘরের কাছে। দেখল মা বড় প্লেটে খাবার সার্ভ করছেন। করেই ঢেকে দিয়ে রাগী গলায় বললেন,
-“জমিদারের বাচ্চা কানে শুনিস না? কয়টা ডাক দিয়েছি তোকে?”
আরিভের মাথায় এই বিষয়টি আসে না মা জাতি অযথা কেন রেগে থাকে? মাঝে বলির পাঁঠা হতে হয় স্বামী আর সন্তানদের। শিরীন বেগম খাবারের প্লেট এগিয়ে দিলেন। বললেন,
-“এই খাবার সিদ্দিক ভাইদের বাসায় দিয়ে আয়। আর হ্যাঁ ভালো মানুষের মতো যাবি, নাফির সাথে…”
-“দাও দাও নিয়ে যাচ্ছি।”
আরিভের মধ্যে চঞ্চলতা দেখে অবাক হল শিরীন বেগম। একবার বলাতেই রাজি হয়ে গেল? সে ভেবেছিল সরাসরি না করে দিবে। আরিভ খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে দ্রুত গতিতে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। শিরীন বেগম ফের চেঁচালেন। বললেন,
-“ট্রেন ছুটে যাচ্ছে না তোর। আস্তে যা।”
আরিভের মাঝে এক অদ্ভুত তাড়াহুড়ো। যেন সুযোগ পেয়েছে। উধাও হয়ে থাকা নাফিয়ার খোঁজ পাওয়া গেলে যেতেও পারে। নিজের অজান্তেই হন্তদন্ত কদম তার। থামলো একেবারে নাফিয়াদের দরজার ধারে। দরজার সামনে যেন জুতোর মেলা বসেছে। এত জুতো কারই বা হতে পারে?
কলিং বেল চাপল আরিভ। দরজা খুলতেই দেখল রেশমা বেগমকে। মুখটা তার কেমন যেন ভার হয়ে আছে। খাবারের প্লেট এগিয়ে দিতে না দিতেই পেছনের দৃশ্যে কপালে গাঢ় তিনটে ভাঁজ পরে। নাফিয়া দাঁড়ানো। ভিন্ন রূপে, শাড়ি পরিহিত সঙ্গে মাথায় কাপড় টানা। বেজার তার মুখমন্ডল। পাশে তার দাদী দাঁড়িয়ে আছে তার হাত চেপে। ঠিক ওই হাতটা। অদ্ভুতভাবে চেপে ধরে আছে সে।
-“ভিতরে এসো আরিভ।”
রেশমা বেগমের কন্ঠে ঘোর কাটলো আরিভের। এতক্ষণ নাফিয়ার দিকেই চেয়ে ছিল। বিষয়টা ঠিক স্পষ্ট না তার কাছে। আরিভ জোর পূর্বক ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
-“না.. আন্টি আসলে আম্মা খাবার দিয়েছেন।”
-“আবার কীসের খাবার? আমাদের বাড়িতেই আজ আয়োজন হয়েছে। তোমার মা অযথা কষ্ট করলেন। তুমি ভেতরে এসো।”
আরিভ অন্যমনস্ক নাফিয়ার দিকে চেয়েই বলল,
– “আজ না আন্টি। আপনাদের বাসায় হয়ত মেহমান।”
মনটা উসখুস করল জানতে, এসব মেহমান কীসের? কী কারণে এসেছে? কিন্তু প্রশ্নটা অনুচিত। রেশমা বেগম জোর করেননি। আজ তার নিজেরই মন ভালো নেই। নাফিয়ার দিকে আরো এক দফা চেয়ে চলে এল বাড়িতে।
______
এতগুলো পুরুষ আর নারীর মধ্যে পুতুল সেজে বসে আছে নাফিয়া। রেশমা বেগম বাঁধা দিতে পারেননি। বাড়াবাড়ি সীমা অতিক্রম করে গেছেন জমিলা বেগম। গ্রাম থেকে বারোজন মানুষ এসেছে পাত্রী দেখতে। তাদের ভাবভঙ্গি কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না রেশমা বেগমের। সিদ্দিক সাহেবকে বিষয়টি জানালে সে রেগে যান। কিন্তু ছেলেকে ‘ আমার মরা মুখ দেখবি ’ বানী ছুঁড়ে দমিয়ে ফেলেছেন জমিলা বেগম। তার মুখেই একমাত্র হাসি। পাত্রের বয়স পঁয়ত্রিশ এর ঊর্ধ্বে। এমন বয়সের পুরুষের সাথে নাতনীকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করেই সে ভীষন খুশি। তার মতে সোনার আংটি বাঁকাও ভালো, পুরুষ মানুষের বয়স বেশি হলেও তাতে কিছু যায় আসেনা।
একজন নারী প্রশ্ন করলেন, – “তোমার পুরো নামটা বলোতো?”
নাফিয়া আলতো স্বরে জবাব দিল, – “ নাফিয়া বিনতে সিদ্দিক”
আরেকজন বলে উঠল, -“নাফিয়া? এটা আমার কেমন নাম?”
পাশ থেকেই আরো একজন পুরুষের আওয়াজ ভেসে আসে, – “শহুরে মাইয়াগো নাম। বুঝেন না?”
নারী ব্যতীত পুরুষদের উদ্ভট চাহনীতে ও প্রশ্নে বুক কেঁপে উঠছে নাফিয়ার। রেশমা বেগম মেহমানদের অপমান করতে চাইছেন না। সিদ্দিক সাহেব বাড়ি ফিরলেই জমিলা বেগমেরও গ্রামে ফেরার টিকেট কাটবেন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।
এসবের মধ্যেই একজন নাফিয়ার চুল দেখতে চাইল। কেউ উঠে হেঁটে দেখাতে বলল। এই যুগেও এসব হয়! রেশমা বেগম বাঁধা হয়ে দাঁড়ান। বলেন,
-“আপা আমার মেয়েটা ছোট। ভয় পাচ্ছে, আপনারা যদি কিছু মনে না করেন ওকে নিয়ে যাই ঘরে?”
-“কীসের ছোট? ওর বয়সে আমার দুইটা বাচ্চা ছিল।” মুখের উপর বলে উঠলেন পাত্রের মা।
-“সে যুগ কী আর আছে আপা?” হেসেই বললেন রেশমা বেগম।
-“সেই যুগই ভালো ছিল। আজকালকার মাইয়ারা তেজ নিয়ে ঘুরে।”
চুপসে গেলেন রেশমা বেগম। জমিলা বেগম নিজ হাতে
নাফিয়ার মাথার কাপড় সরিয়ে সবার সামনে চুল উন্মুক্ত করে ধরেন। রেশমা বেগম কম যান না। সাথে সাথে মেয়ের মাথায় কাপড় টেনে বললেন,
-“আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা খেয়ে যাবেন।”
জমিলা বেগম কিছু বলতে চাইলে রেশমা বেগম নিচু স্বরে বলে উঠেন,
– “অনেক সহ্য করেছি মা। আর এক মুহুর্ত না।”
পাত্রের মা মুখ বাঁকা করে বললেন, -“মাইয়ার এক হাত কানা। তার মধ্যেই মাইয়ার মায়ের এত তেজ। বাবাহ! আমরা কি এদিকে খাইতে আসছি? আমগো ঘরে খাবার নাই?”
সিটিং রুমের ঠিক বরাবর নাফিয়ার শখের বারান্দা। বারান্দা ভেদ করে একজোড়া বিমূঢ় চোখ চেয়ে ছিল এতক্ষণ। অল্পস্বল্প অস্পষ্ট কিছু কথাও শুনেছে সাথে দেখেছে নাফিয়ার ভীত-সন্ত্রস্ত মুখখানা। এতগুলো মানুষের সামনে তাকে পণ্যের মতো বসিয়ে রাখা হয়েছিল। আরিভ কিছু ভাবতেই পারল না, শূন্য হয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।
_______
ছাদে খুব কম আসা হয়। কিন্তু আজ কেন যেন মনে হল ছাদে আসা উচিত। ঘরে মা আর দাদীর মধ্যে তুমুল তর্ক চলছে। মেহমান না খেয়ে চলে গেছে। এসব শুনতে শুনতে মস্তিষ্কে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। বদ্ধ অসহ্যকর স্থান থেকে বেরিয়ে এসেছে নাফিয়া। ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে রেলিং ধরে দাঁড়াল। সূর্য পশ্চিম আকাশে আর অল্প কিছুক্ষণের মেহমান। এরপর আঁধার নামবে উজ্জ্বল অম্বরের বুক চিরে।
রেলিং এর সাথে ঝোলানো কয়েকটা গাছ আছে। সেগুলো রেশমা বেগম দেখাশোনা করেন। সবজি গাছ। নাফিয়া হাত বাড়ায়। গাছের শুকিয়ে যাওয়া পাতাগুলো একটা একটা করে ছিঁড়ে ফেলে দিতে লাগল। সে ভাবতে চাইছে না কিছু, কাঁদতে চাইছে না। কিছুক্ষণ জ্ঞানশূন্য থাকতে চাইছে।
-“শুনলাম, বিয়ে করছো?”
কন্ঠ অদ্ভুত। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কথা বলছে আরিভ। নাফিয়া ঘুরে তাকাল। ভাবল, এই লোক কোথা থেকে এলো ওদের ছাদে? আরিভ ঠোঁট গোল করে ভারী ভারী নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে আসে। নাফিয়ার পাশে থাকা টেবিলের উপর চড়ে বসলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
-“ভাই দৌঁড়ে এসেছি তোমার দাদীর ভয়ে। মনে হচ্ছে লিভার, কিডনী, নাড়িভুড়িতে ঝড় বয়ে গেছে।”
নাফিয়া কোনো প্রকার গুরুত্ব দিল না আরিভের কথায়। তাকে অদেখা করে নিজের কাজে মনোযোগী হল। আরিভ দেখল এই এড়িয়ে যাওয়া। বলল,
-“আমাকে ইগনোর করছ কেন? আমি কী তোমার ভাতে ছাই দিয়েছি?”
নাফিয়া আড়চোখে তাকায় আরিভের দিকে। দৃষ্টিপাত করেছে বিরক্তির সহিত। ফের চোখ ঘুরায়। আরিভ থেমে নেই। টেবিল আরও একটু কাছে টেনে বলল,
-“বিয়ে কী ঠিক নাকি?”
এবার উত্তর এলো নাফিয়ার তরফ থেকে, – “জানি না।”
-“এমা! এটা কেমন কথা? দেখতে এলো, বিয়ে কবে সেটা জানো না? নাকি লজ্জায় বলতে চাচ্ছোনা?”
নাফিয়ার মুখভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং আরিভের দিকে চেয়ে বোঝালো সে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। আরিভের গলা শুকিয়ে এসেছে। ঢোক গিলে গলা ভেজায়। বলে,
-“কবে বিদায় হচ্ছো? তুমি গেলে এলাকায় একটা শান্তি বিরাজ করবে জানো?”
নাফিয়া স্মিত হেসে বলল, -“শীঘ্রই।”
আরিভ কিছুটা থতমত খেল। পুনরায় শুধায়, -“এর মানে বিয়ে ঠিক?”
-“জানি না।”
-“আরেহ আজব মেয়ে তো তুমি! তোমার সাথে দুটো ভালো কথা বলা পাপ। তর্ক ছাড়া আসলেই কিছু জানো না তুমি।”
-“আপনার এত আগ্রহ কেন?”
প্রশ্নটির উত্তরতো আরিভের নিজেরও জানা নেই। হুট করে প্রশ্ন আসায় নীরব রইল। ঠোঁট কামড়ে ভাবল কয়েক সেকেন্ড। পরপর বলে উঠে,
-“তোমার বিয়েতে ভরপেট খাওয়া যাবে। তুমি জানো না আমি কতটা ভোজনরসিক।”
-“আপনার ফালতু কথা শেষ?”
-“খাবার দাবারের কথা তোমার ফালতু মনে হচ্ছে?”
“আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই না। সেধে সেধে ঝগড়া করতে এসেছেন ভালোই বুঝি।”
আরিভ ব্যাঙ্গ করে হাসল। বলল, -“কে ঝগড়া করে? আমি? নাইস জোক!”
-“আপনি একটা জোক।” বিড়বিড় করে বলল নাফিয়া।
-“কিছু বললে?”
-“আপনি কানে বেশি শোনেন নাকি?”
-“বেশি শোনাতো ভালো।”
-“একেবারেই না। কানে কম শোনা যেমন রোগ তেমন বেশি শোনাও একটা রোগ।”
-“তুমি কি কানের ডাক্তার নাকি?”
-“আমি কবিরাজ।”
-“এসব ভন্ডামি করো তাহলে?”
তর্ক জমে উঠেছিল। কিন্তু নাফিয়া হুট করেই থেমে গেল। হাতে লেগে থাকা ময়লা ঝেড়ে নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। আরিভও ঝটপট উঠে এল। সিঁড়ি ঘরের কাছে পৌঁছানোর পূর্বেই আরিভ দাম্ভিক গলায় বলে উঠল,
-“বিয়ে করার তো ইচ্ছে তোমার মধ্যে নেই, তাহলে ওদের সামনে কেন গেলে?”
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে থেমে গেল নাফিয়া। হুট করেই মনে পড়ে গেল সেসব যা ভুলে থাকতে চাইছে সে। জবাব দিল না। উল্টো ঘুরেই দাঁড়িয়ে রইল। আরিভ বলল,
-“নিশ্চয়ই তোমার দাদী জোর করছে তোমাকে?”
-“আমার দাদী আমাকে জোর করলেই কী?”
-“কী? এই প্রশ্নটা করতে পারলে? জোর করে সম্পর্কে বাঁধা পড়ার অর্থ জানো? সারাজীবন মাশুল দিতে হবে।”
নাফিয়া ঘুরে তাকায়। তীর্যক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
-“আপনি খুব জানেন? আপনার কয়টা বিয়ের অভিজ্ঞতা আছে।”
-“নাফিয়া আমি সিরিয়াসলি কথা বলছি। ত্যাড়া উত্তর দিবে না। এক্সপিরিয়েন্স গ্যাদার করার জন্য বিয়ে করতে হবে কেন? মানুষ বয়সের সাথে অভিজ্ঞ হয়। যেটা তুমি নও।”
নাফিয়ার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এল। অবলীলায় প্রশ্ন করে,
– “ দাদীওতো অভিজ্ঞ।”
-“ওই বুড়ির মাথায় সমস্যা আছে। পাগলের ডাক্তার দেখানো উচিত।”
-“এটা আপনার সিরিয়াসনেস?”
আরিভ ঠোঁট চেপে নিঃশ্বাস ফেলে। বলে,
– “লিসেন বিয়েটা তুমি করছো না।”
-“অর্ডার দিচ্ছেন নাকি?”
আরিভ প্রশ্নের বিপরীতে নির্বিকার ভাবে তাকাল। মুখমন্ডল আকস্মিক গাম্ভীর্যে ঢেকে যায়। নাফিয়া বুঝল না এই নীরবতার অর্থ। কিছুটা সময় কেটে যায় এখানেই। নাফিয়া বোকার মত চেয়ে আছে। বুঝবার চেষ্টা করছে মতিগতি। কিন্তু কিচ্ছুটি মাথায় ঢুকছে না। এভাবে মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ কি?
-“আমি কি যাব?”
-“যাবে?”
-“হ্যাঁ মা অপেক্ষা করছে হয়ত।”
আরিভ লম্বাটে নিঃশ্বাস ফেলে নত গলায় বলল,
-“যাও।”
চলবে…