#বৈরী_বসন্ত ৬
লেখা – আয্যাহ সূচনা
পরনে লাল বেনারসি শাড়ি। হাত ভর্তি চুড়ি, চকচক করা গহনা লেপ্টে আছে নাফিয়া। অদ্ভুতরকমের মায়াবী দেখাচ্ছে তাকে। কিন্তু মুখে কোনো হাসি নেই। কেঁদে চলেছে অনবরত। সাহায্য চাইছে। আশপাশের সবাই যেন তার আকুতি দেখেও দেখল না। তার বাবা মাও গুরুত্ব দিল না তার আর্তনাদকে। শেষ পর্যন্ত আরিভের কাছে এসে আর্জি করল নাফিয়া। কেঁদেকেটে নাজেহাল অবস্থা করেছে। আরিভের হৃদয়ের কোনো এক কোণে গিয়ে বিঁধেছে কান্নামাখা মুখশ্রী। নাফিয়া বলল,
-“আমি বিয়েটা করতে চাই না। আমাকে সাহায্য করুন।”
আরিভ কিছু বলার সুযোগ পায়নি। জমিলা বেগম এসে নাফিয়ার হাত টেনে নিয়ে গেছে। ঘন্টাখানেক এর মাঝে জোর করে বিয়েটাও হয়ে গেল। আরিভ শুধু দেখে গেছে। মেয়েটি সাহায্য চেয়েছিল। পারেনি কোনো সাহায্য করতে। নাফিয়া কবুল বলার সাথে সাথেই আরিভের অস্থিরতার মাত্রা বাড়ে। ঘেমে পরনের পাঞ্জাবী একাকার হয়ে গেছে। মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে গেল।
মাঝরাতে উঠে বসে আরিভ। মাথা ঝিমঝিম করছে খুবই উদ্ভট স্বপ্ন ছিল। এখনও হৃদপিন্ড কাঁপছে। আশপাশ সম্পূর্ণ অন্ধকার। আরিভ এদিক ওদিক তাকায়। কিছুসময় পর বিড়বিড় করল একাকী,
-“স্বপ্ন ছিল।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো সাথে সাথে। পানির গ্লাস খুঁজে পানি পান করে। উঠে গেল ব্যালকনিতে। কেমন যেন দমবন্ধ লাগছিল ঘরে। ডান দিকে তাকাতেই বিষম খেল। অনেকদিন পর পাশের বাড়ির বারান্দার বাতি জ্বলছে। দ্রুত কদমে এগিয়ে যায় আরিভ। গিয়েই বলল,
-“রাত বিরেতে এখানে কি করো?”
-“ধান চাষ করছি।”
উত্তর যেন মুখের আগায় এসে ছিল। ত্যাড়া জবাবে মুখ কুঁচকে গেল আরিভের। তার বোঝা উচিত ছিল মেয়েটি ভালো হবার নয়।
আরিভ নাফিয়াকে দেখল ঘরের পোশাকে। মুখে রংচং মাখা নেই। এই মাত্র বউ রূপে দেখে এলো তাকে স্বপ্নে। হেসে উঠে আরিভ। নাফিয়া বাঁকা চোখে চেয়ে বলে,
-“পাগল হয়ে গেছেন?”
-“নাতো!”
-“তাহলে হাসছেন কেন এইভাবে?”
আরিভ রেলিংয়ে কনুই ঠেকিয়ে ঝুঁকে বলল,
-“মজার একটা স্বপ্ন দেখেছি বুঝলে? দেখলাম তোমার কূটনী দাদী তোমাকে ধরে বেঁধে ৬০ বছর বয়সী এক হ্যান্ডসাম লোকের সাথে তোমার বিয়ে দিচ্ছে।”
নাফিয়ার মুখটা বোচা হয়ে গেল। ঠোঁট ফুলিয়ে চেয়ে আছে আরিভের দিকে। আরিভ আরও বলল,
-“তুমি কান্না করছিলে। আর আমি সেগুলো ক্যামেরাবন্দী করছিলাম। কী জঘন্য লাগছিল তোমাকে বলে বোঝানো যাবে না।”
-“সেটা স্বপ্ন ছিল জনাব। বাস্তবে আপনার কিছু সুন্দর ছবি আমার কাছে আছে। তাই কথা বুঝে শুনে বলবেন।”
আরিভ আরেকদফা হাসল। বলল,
– “বাচ্চা মানুষ, বাচ্চা টাইপ ব্ল্যাকমেইল। কিন্তু বিয়ে হবে এক বুড়ো লোকের সাথে।”
নাফিয়া বলে বসল, – “আপনিতো এটাই চান।”
আরিভ থমকালো কিছু মুহূর্তের জন্য। মস্তিষ্কে স্বপ্নে দেখা সেই দৃশ্যের পুনঃপ্রচার ঘটছে। কি নাজেহাল অবস্থাটাই না হচ্ছিল তার। আনমনে জবাব দিল,
-“হয়ত।”
-“হয়ত?”
আরিভ নড়েচড়ে উঠে,
– “কী হয়ত? তোমার দাদীকে বলব দ্রুত তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে।”
অন্ধকার ঘর। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। জানালা ভেদ করে ঘরে এসে প্রবেশ করছে। ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ ব্যতীত পুরো রাতটাই অদ্ভুত। বিছানায় বলিষ্ঠ পিঠ ঠেকলেও চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। ঘুম নেই। একটু পরই ভোরের আলো ফুটবে। আরিভের মধ্যে দ্বিমুখী দ্বন্দ্ব চলছে। মন যেন দুভাগে বিভক্ত। এক মন বলছে নাফিয়ার ব্যাপার নিয়ে ভাবা উচিত, অন্য মন শাসাচ্ছে। বলছে, এই ব্যাপারে ভাবনার কোনো অর্থই দাঁড়ায় না,অহেতুক। কার কথা শুনবে?
হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় পড়ে থাকা আরিভ ফোন হাতে নিল। ফেসবুকে গিয়ে সরাসরি নাফিয়ার একাউন্টে গিয়েছে। অবচেতন মন চাইল একটু ঘুরে আসা যাক। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। স্ক্রল করতে করতে পেল শুধু গাছ আর ফুলের ছবি। নিজের কোনো ছবি নেই। একটি আছে বটে। সেটিতে ক্লিক করে আরিভ। জুম করল ছবিটি। এই চেহারা আর স্বপ্নের মাঝে দেখা নাফিয়ার চেহারা মিলালো। চেয়ে রইল কিছুক্ষন, পর্যবেক্ষণ করল। ঠোঁট কামড়ে ফোনটি পাশে ছুঁড়ে ফেলে আলতোভাবে। সঙ্গে সঙ্গে উপুড় হয়ে চোখ বুঁজে আরিভ।
______
মাঝেই কেটেছে কয়েকদিন,
-“মা।”
ডাকটি ভীষণ মধুর। সুন্দর শোনায়। রেশমা বেগম সৃষ্টিকর্তার কাছে ভীষণ আকুতি মিনতী করে পেয়েছেন তার মেয়েটিকে। বিয়ের সাত বছর পর তার খালি কোল পূর্ণ করে এসেছিল নাফিয়া। সেদিন সন্ধ্যায় ভারী বর্ষণে মেতেছিল বাতাবরণ সাথে সিদ্দিক সাহেব এবং রেশমা বেগমের চোখজোড়াও। একটা সন্তান পাওয়ার লোভে কত অশ্রুই না ঝরিয়েছেন তারা।
রেশমা বেগম আলমারি বন্ধ করতে করতে ঘুরে তাকালেন। নাফিয়া চট জলদি এসে দাঁড়ায়। বলে,
-“আলমারি বন্ধ করো না মা।”
রেশমা বেগম হেসে বললেন, -“কিছু লাগবে নাকি তোর?”
নাফিয়া ঠোঁট কামড়ে তাকাল। রেশমা বেগম বুঝে গেলেন। নিশ্চয়ই কোনো আবদার নিয়ে এসেছে। নাফিয়া নরম সুরে বলে,
-“ভার্সিটিতে নবীন বরণ অনুষ্ঠান মা।”
রেশমা বেগম নাফিয়ার ডান হাত নিজের হাতে নিয়ে বুলিয়ে দিতে লাগলেন। জানেন মেয়েটি কিছুই অনুভব করবে না এই হাতে। তারপরও এক আশা। যদি মায়ের স্পর্শে হাতের শিরা উপশিরা জেগে উঠে? রেশমা বেগম ধরে ফেললেন কি চাই মেয়ের। তারপরও শুধালেন,
-“শাড়ি চাই?”
নাফিয়া সংকোচ নিয়ে প্রশ্ন করে,
-“পড়ব মা? সেদিনের মত যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে?”
-“ধুর বোকা মেয়ে। কিছু হবে না।”
বলেই পুনরায় আলমারি খুললেন। একটা একটা করে শাড়ি বের করে বিছানায় রাখতে শুরু করলেন। বললেন,
-“দেখ কোনটা ভালো লাগে।”
-“তোমার সব শাড়িইতো সুন্দর মা। কোনটা রেখে কোনটা নিব? তুমি চুজ করে দাও।”
রেশমা বেগম নাফিয়ার মত করেই বললেন,
-“তোকে তো সব শাড়িতেই সুন্দর লাগবে। কোনটা রেখে কোনটা দিব?”
নাফিয়া হেসে উঠল। এই হাসিটা বিলীন ছিল কিছুদিন যাবত। পাত্রপক্ষের দেখে যাওয়া, দাদীর সাথে ঝামেলা সবকিছু মিলিয়ে মনমরা হয়ে ছিল সে। আজ হাসল, প্রাণ জুড়াল রেশমা বেগমের।
নাফিয়া নিজ থেকেই এগিয়ে যায়। সাদা রঙের শাড়ি হাতে নিল। সাদার মাঝে কালো কারুকাজ করা। স্নিগ্ধ সুন্দর শাড়ি। নাফিয়া বলল,
-“এটা পড়ি? তুমি আমাকে একটা কালো ব্লাউজ বানিয়ে দাও না।”
-“কাল কয়টায় বেরোবি?”
-“১২ টায় মা।”
-“ঠিক আছে। আজ রাতেই বানিয়ে ফেলব।”
-“তোমার কষ্ট হবে না?”
-“একটু কষ্ট তো হবে, নাফি। কিন্তু আমাদের কারণে তুই যে কষ্ট পাচ্ছিস তার কাছে এসব কিছুই না।”
নাফিয়া এগিয়ে এলো। মাকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু কিছু বলল না। মমতার উষ্ণতায় রইল কিছুক্ষন। মিথ্যে বলতে গেলেও কেঁদে দিবে। নীরবতাই শ্রেয়।
______
সাজসজ্জা বলতে শুধু চোখের কাজল আর লিপস্টিককেই বুঝে নাফিয়া। মা খুব যত্ন করে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছেন। কাজল লিপস্টিক আর পাশাপাশি কপালে ছোট্ট একটি কালো টিপ দিয়ে দিলেন। অষ্টাদশী মেয়েকে কেমন যেন পরিপূর্ণ নারী নারী লাগছে। রেশমা বেগম নিজের নজর বারবার সরিয়ে নেন।
শরীরে জং ধরে গেছে। বাইকে করে অফিসে যায় আরিভ। সেখানে বসে বসে কাজ করে, বাড়ি ফিরে আবারও চিৎপটাং হয়ে পড়ে থাকে বিছানায়। মাঝেমধ্যে খেলাধুলা করলেও হুট করেই আবিষ্কার করল বয়স্ক লোকেদের মত ভুঁড়ি বাড়ছে তার। ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। ব্যালকনি গিয়ে একটু এক্সারসাইজ করা উচিত। যেমন চিন্তা তেমন কাজ।
কিছুসময় এক্সারসাইজ করতে না করতেই হাঁপিয়ে উঠল। অভ্যাস নেই। রেলিংয়ে উঠে বসতেই চোখ কপালে উঠে যায়। কয়েকবার পলক ঝাপটে ভালোভাবে দেখল। ভূত দেখার মত চেয়ে আছে নিচে। শাড়ির কুচি গুলো অবাধে দুলছে কদমের সাথে সাথে। বাচ্চা আকৃতির মেয়েটিকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে। চোখ ধাঁধানো সুন্দরী যাকে বলে। আচমকা হেঁচকি উঠে গেল আরিভের। পানি গিলে ডাকল,
-“এই মেয়ে!”
নাফিয়া ফিরে তাকাল ডাকে। এদিক ওদিক থেকে উপরে তাকাল। বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে গেল। আরিভ দাঁড়িয়ে। পরনে হাতা কাটা টিশার্ট।
-“কী সমস্যা? যাওয়ার পথে বাঁধা দিলেন কেন?”
-“সিনেমার নায়িকা সেঁজে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
-“আপনাকে কেন বলব?”
-“নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ডের দেখা করতে যাও।”
-“এসব নোংরা কাজ আপনাকে মানায়, আমাকে না।”
হুট করেই আরিভের মাথায় এক ভাবনা খেলে গেল। বলল,
-“এই তুমি দাঁড়াও। আমি আসছি ৫ মিনিটে। এক কদম নড়বে না বলে দিচ্ছি।”
বলেই ভেতরে চলে গেল আরিভ। আলমারি খুলল দ্রুত হাতে। সব কাপড় এলোমেলো করে ফেলেছে। খুঁজে খুঁজে সাদা পাঞ্জাবি ছাড়া কিছুই পেল না। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। পুরো আলমারির উপর ঝড় চালিয়ে একটি কালো পাঞ্জাবি পড়েছে। ওয়াশরুমে গিয়ে গুণে গুণে তিন মগ পানি ঢেলে দুই মিনিটের মাথায় বেরিয়ে গেল। ভেজা চুল, ভেজা শরীরে পাঞ্জাবি জড়িয়ে নেয়। তাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখল নাফিয়া সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে। ভেবেছিল চলে যাবে। আরিভ উঁকি দিয়ে বলল,
-“গলির মোড়ে গিয়ে দাঁড়াও, আসছি। বেশি কথা বললে তোমার দাদীকে ডাকব।”
সবটা নাফিয়ার মাথায় উপর দিয়ে যাচ্ছে। লোকটা আসলে চায় কী? কেন দাঁড়াবে সে? কোনো প্রশ্নের উত্তরই তো দিল না।
ঝড়ের গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলেই পিঠে কিল পড়ে। শক্ত হাতের কিল। এটা আরিভের মা জননী ছাড়া আর কারো হতেই পারেনা। শিরীন বেগম রেগে আগুন হয়ে বললেন,
-“দামড়ার বাচ্চা ঘরের অবস্থা কি করেছিস? এগুলো না গুছিয়ে যাবি না বলে দিলাম।”
বলে আরও এগিয়ে এলেন উত্তম মধ্যম দিবেন বলে। কিন্তু আরিভ সরে দাঁড়াল। বলল,
-“বাকি মার পড়ে মেরো মা। আমার তাড়া আছে, টাটা।”
বলে পগারপার। শিরীন বেগম রাগে গজগজ করছেন। কোমরে হাত রেখে আরিভের ঘরের দিকে এগোলেন। চোখে সানগ্লাস দিয়ে বেরিয়ে পড়ল আরিভ বাইক নিয়ে। দূর থেকে দেখল গলির মোড়ে বাধ্য মেয়ের মত দাঁড়িয়ে নাফিয়া। হাসি ফুটে আরিভের মুখে। বাইক টেনে নিয়ে দাঁড় করাল নাফিয়ার কাছে। বলল,
-“চল।”
নাফিয়া বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে,- “কোথায়? কোথায় যাব?”
-“যেখানে যাচ্ছিলে।”
-“যাচ্ছি তো আমি। আপনি ফিটফাট হয়ে এসেছেন কেন?”
-“আমিও যাচ্ছি।”
দাঁত বের করে হেসে বলল আরিভ। শরীরটা জ্বলে গেল যেন নাফিয়ার। বলল,
-“কী বিশ্রী হাসেন আপনি! আর হ্যাঁ আপনার সাথে আমি যাব না।”
নাফিয়ার কথার কোনো গুরুত্বই দিল না আরিভ। পেছন থেকে হেলমেট নিয়ে নাফিয়ার মাথায় দিয়ে দিল। বেল্ট টেনে নাফিয়াকেও টেনে কিছুটা সামনে আনে। বিমূঢ় হয়ে আছে নাফিয়া। হেলমেট ভালোভাবে মাথায় সেট করে বলল,
-“মানুষ দেখছে, উঠে বস।”
-“আপনি বাড়াবাড়ি করছেন।”
-“ট্রেইলার দেখালাম মাত্র। চল চল।”
সত্যিই আশপাশে মানুষ চেয়ে আছে। নাফিয়া বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে। লোকটা দিনদিন গায়ে পড়া স্বভাবের হয়ে যাচ্ছে। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। আরিভ বলল,
-“তুলে নিয়ে যাব কিন্তু।”
নাফিয়া তড়াক করে বাইকে উঠে বসল। আরিভ বাঁকা হাসে। এবার আর তাকে ধরে বসেনি। কোনো রকম শাড়ি সামলে পেছনে হাত আটকে রেখেছে। বিষয়টা অদ্ভুতভাবে আরিভের পছন্দ হচ্ছে না। বাইকের গতি ধীর করে প্রশ্ন করল,
-“ভয় করছে? ভয় করলে আমাকে ধরে বসো।”
-“আপনি চুপ করুন ফালতু লোক!”
আরিভ সশব্দে হেসে উঠে। পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে নাফিয়ার। বিড়বিড় করে বলল,
-“শুধু জোর করে।”
-“আচ্ছা ক্যাম্পাসে যাচ্ছো?”
-“হ্যাঁ!” তেজি গলায় জবাব এলো।
-“কী কাজ?”
-“নবীনবরণ।”
-“সেখানে তোমার কোনো বন্ধু আছে?”
-“না।”
আরিভ রাস্তার পাশে ব্রেক কষলো। নাফিয়া কিছুটা ঝুঁকে গেছে আরিভের দিকে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাহুতে হাত রাখল। এক হাতে কতই ব্যালেন্স করা যায়? আরিভ বলল,
-“তাহলে একা গিয়ে কী করবে?”
-“কী করব মানে? বসে থাকব এক জায়গায়।”
বাইক স্টার্ট দিল আরিভ। অদৃশ্য অধিকারবোধ দেখিয়ে নাফিয়ার দুহাত টেনে কাঁধে রাখল। নাফিয়া কেঁপে উঠে। অদ্ভুত লাগল আজ স্পর্শ। প্রথমদিন ভয়ে কিছু অনুভব হয়নি। আজ ভিন্ন লাগছে।
হুট করে বলে উঠে,
– “যাওয়া লাগবে না নবীনবরণে।”
বাইক এসে থামল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাছে। জমজমাট টিএসসির দিকটা। নাফিয়া দ্রুত নেমে গেছে। আরিভের দিকে চেয়ে বলল,
-“আপনি আমাকে ক্যাম্পাসে নামিয়ে দিন বলছি, নয়তো আমি একা চলে যাব।”
আরিভ কোনো ত্যাড়া উত্তর দিল না। বরং শীতল কন্ঠে বলল,
-“সেখানে তোমার কেউ নেই, এখানে আছে। আজ আমার সাথেই দিনটা কাটাও। আমি খুব বাজে কম্প্যানিয়ন নই।”
-“ভালোও নন।”
স্মিত হাসে আরিভ। বাইক পার্ক করে বলল,
-“চলো ভেতরে। মজার মজার খাবার আছে।”
-“আমি যাব না।”
-“থাকো তাহলে এখানে একা।”
বলে আরিভ হাঁটতে শুরু করে। কি মহাবিপদে পড়ল! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভাবল নাফিয়া। ভুল কিছু বলেনি আরিভ। সত্যিই সেখানে তার কেউ নেই। কোনো বন্ধু নেই। কার সাথেই বা সময় পাড় করবে গিয়ে?
আরিভ ইচ্ছে করেই পায়ের গতি ধীর করল। পেছনে চেয়ে দেখল নাফিয়া আসছে কীনা। ভাবনার রানী ভাবনা শেষে পিছু পিছু পা বাড়িয়েছে। আলগোছে হাসে আরিভ।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দরজার কাছে অনেক মানুষ। ঠেলে ধাক্কিয়ে ঢুকছে একেকজন। হুট করে আরিভ পেছনে ঘুরে বলল,
-“আমার সামনে যাও। অনেক মানুষ এখানে।”
দরজা দিয়ে যে যেভাবে পারছে ঢুকছে। পুরো নাজেহাল অবস্থা। নাফিয়া চেষ্টা করল ঢুকবার কিন্তু পারল না। আকস্মিক অনুভব করল কেউ তার দুপাশে দুহাত দিয়ে আছে। কিন্তু গায়ে কোনো স্পর্শ লাগেনি তার। অবাক হয়ে পিছনে তাকাল নাফিয়া। আরিভ ভ্রু নাচিয়ে বলে,
-“কী?”
নাফিয়া না বোধক মাথা দোলায়। আরিভ বলল,
-“আমি হাত দিয়ে রেখেছি। দ্রুত ঢুকে যাবে।”
আরিভের হাতের স্পর্শহীন বেড়াজালে থেকেই ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরে ঢুকে দম ফেলল আরিভ। কয়েক কদম হেঁটে বলল,
-“খাবারের ঘ্রাণ এই পর্যন্ত চলে এসেছে। দ্রুত চলো।”
-“এত রাক্ষস কেন আপনি? সারাক্ষণ শুধু খাই খাই করেন।”
-“পুরুষের মনের রাস্তা পেট হয়ে যায়।”
-“ওই রাস্তা মাপছেই বা কে?”
আরিভ নাফিয়ার দিকে তাকাল। সময় নিয়ে বলল,
-“আপাতত আমার মনের রাস্তা আমিই মাপছি। চলো নাফি ক্ষিদে পেয়েছে।”
আরিভ একটার পর একটা খাবার খেয়েই চলেছে। সাথে জোর করে খাওয়াচ্ছে নাফিয়াকে। হাঁপিয়ে উঠেছে নাফিয়া। হার মেনেছে অনেক আগেই কিন্তু আরিভের ক্ষিদে এখনো নিবারণ হয়নি। তাকে দেখে আরো কাহিল হয়ে পড়েছে মেয়েটি। খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে গাছতলায় বসল। নাফিয়া তার থেকে কিছুটা দূরে অবাক হয়ে চেয়ে আছে।
আরিভ বলল, – “এর চেয়ে বেশি খেতে পারি আমি বুঝলে।”
-“আরও বেশি?” অবাক হয়ে জানতে চায় নাফিয়া।
-“হ্যাঁ আরও বেশি।”
-“আপনাকে মিউজিয়ামে রাখা উচিত।”
-“আসলেই। আমি একটা এন্টিক পিস।”
নাফিয়া মুখ ভেংচি কেটে বলল, -“এন্টিক পিস না ছাই।”
আরিভ পেছনে দুহাত রেখে বসে আছে আকাশের দিকে মুখ করে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকাল নাফিয়ার দিকে। পাশে বসে আকাশ, গাছপালা দেখে যাচ্ছে মেয়েটি। আর কীই বা করার আছে তার। আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হল তার কাছে। যে যেভাবে পারে জোর খাটিয়ে নিতে পারে তার উপর। প্রথমে না করলেও পরবর্তীতে হার মানে।
নিশ্চুপ বসে থাকা মুখমন্ডল স্নিগ্ধ। শাড়িতে মায়া মায়া লাগছে। আরিভ বিষয়টিকে সুন্দর বলেই ধরে নিল। কোনো কাব্যিক বিশ্লেষণে গেল না। দেখল কিছুক্ষণ আলগোছে। সেটি নাফিয়ার দৃষ্টিগোচর হয়নি।
আরিভ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, – “চুড়ি পড়োনি?”
আচমকা এমন প্রশ্নে আরিভের দিকে তাকায় নাফিয়া। দুষ্টু নয় বরং শান্ত দৃষ্টি আর কন্ঠেই প্রশ্নটি করেছে আরিভ। তাকে কেনোই বা চুড়ির কথা জিজ্ঞাসা করল? নাফিয়া স্বাভাবিক সুরে জবাব দিল,
-“না।”
-“কেন?”
-“আপনাকে বলতে হবে নাকি?”
আরিভ স্বল্প হেসে বলে, -“দেখ আশপাশে কত চুড়ির দোকান। কিনে নাও।”
-“ইচ্ছে নেই।”
-“কেন?”
-“উফ! অনেক কথা বলেন আপনি।”
-“বললাম নাহয়।”
-“চুপ করুন। আমাকে এখানে জোর করে এনেছেন, তার মধ্যে আজগুবি কথা বলেই যাচ্ছেন।”
আরিভ উঠে গেল। পাঞ্জাবি ঝেড়ে চুড়ির দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মাপ জানে না। তবে আন্দাজ করে কিনল দুইজোড়া চুড়ি। না হলে বদলে নেওয়া যাবে। নাফিয়া পেছনে বসে দেখছে তার কীর্তি।
সন্ধ্যা নামছে। একটু পরই আঁধারে ঢেকে যাবে এই ব্যস্ত শহর। চুড়িগুলো নিয়ে নাফিয়ার দিকে এগিয়ে দেয়। বলে,
-“পড়ো।”
-“আপনার মাথায় কি শর্ট সার্কিট হয়েছে? এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছেন কেন?”
-“কেন করছি, এটার উত্তর আমিও খুঁজছি।”
মাথার উপর দিয়ে গেল সবটা। নির্ঘাত জ্বিন ভূতের আছড় হয়েছে। নয়ত এমন আচরণ করার মানুষ আরিভ নয়। চুড়িগুলো না নিলে মুখের সামনেই ধরে রাখবে এমন অবস্থা। অগত্যা বাধ্য হয়ে নিল। বাম হাত দিয়ে ডান হাতে চুড়িগুলো পড়তে পড়তে বলল,
-“আপনাকে টাকা ফেরত দিব বাড়িতে গিয়ে।”
-“নো নিড।”
-“কীসের নো নিড? আপনাকে আমি ভালোরকম ভাবে চিনি। আজ ভালোমানুষি দেখাচ্ছেন। কাল খোচা দিতে ছাড়বেন না।”
আরিভ কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। চুড়ি পড়া দেখছে গভীর মনোযোগ দিয়ে। অদ্ভুতভাবে চুড়ির সাইজ পারফেক্ট। এবার ডান হাত দিয়ে বাম হাতে পড়বার পালা। সেটি আর সম্ভব হল না। আরেকজোড়া চুড়ি নাফিয়া পাশেই রেখে দিল।
হুট করেই আরিভ এগিয়ে আসে। রেখে দেওয়া চুড়িগুলো নিজের হাতে তুলে নিল। নাফিয়ার সেই হাতটা টেনে নিজেই পড়িয়ে দিল। গম্ভীর মুখে। নাফিয়া থম মেরে চেয়ে আছে তার দিকে। না চাইতেও চট করে প্রশ্ন করে বসে,
-“আপনার এই অদ্ভুত পরির্বতনের কারণ কী?”
আরিভের মুখটা গম্ভীর। ভারী দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
-“উঠো, দেরি হচ্ছে।”
চলবে….