#বৈরী_বসন্ত ১১
লেখা – আয্যাহ সূচনা
নাফিয়া তার কথা রেখেছে। তার কথামতই ধরা দেয়নি। পালিয়ে বেড়াচ্ছে। জ্বালাতন করতে চাইছে ইচ্ছে করে। আরিভের মাথা গরম। ফোন হাতে নিয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করে যাচ্ছে ঘরে। কীভাবে জব্দ করল তাকে! এ কয়েকদিনে দুয়েকবার দূর থেকে আরিভের দেখা পাওয়া মাত্র দৌঁড়ে স্থান ত্যাগ করেছে নাফিয়া। পঞ্চম দিনে এসে মাথা দ্বিগুণ পরিমাণে গরম। ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে মেয়েটি। ফোনে হুমকি ধামকি দিয়েও লাভ হয়নি। সে তার কথায় অনড়। নব্য অনুভূতির শুরুতেই দহনে পোড়াল। শাস্তিস্বরূপ মাথা দুভাগ করে দিলেও পোষাবে না।
শিরীন বেগম এলেন চা নিয়ে। আজ মারধর করতে আসেননি। ঘরে এসে ছেলের অস্থির চলন পর্যবেক্ষণ করছেন। হাত টেনে তাকে থামিয়ে বলল,
-“চা ধর।”
আরিভ ব্যস্ত স্বরে বলল,
-“টেবিলে রেখে যাও।”
-“কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ করছিস ফোনে?”
-“মহাভারত অশুদ্ধ করতে চাইছি আম্মা। কিন্তু পারছি না।”
শিরীন বেগম ধরেই নিলেন অফিস সম্পর্কিত কোনো কাজ। তিনি বললেন,
-“কোনো কাজই পারিস না। পড়ালেখাও ঘোড়ার আন্ডা ছিলি আর এখন কাজেও।”
মা কী বলল কিছুই বুঝল না আরিভ। অবাক চোখে তাকাল। কথার অর্থ বুঝতে চেয়ে রইল। শিরীন বেগম বললেন,
-“চা খেয়ে কাপ ধুয়ে রাখবি। আমি যদি এসে দেখেছি কাপ এখানেই পড়ে আছে, তাহলে তো জানিসই।”
-“আম্মা আমি জানি। ছোটবেলা থেকে মার খেয়ে আসছি। এখন সয়ে গেছে। তুমি পারলে এক সপ্তাহের মার একবারে দিয়ে যাও। প্রতিদিন কষ্ট করতে হবেনা।”
আরিভের পিঠে চড় দিয়ে চলে গেলেন শিরীন বেগম। এসব চড় থাপ্পড় প্রতিদিনের। মার খেতে খেতে গন্ডারের চামড়া হয়ে গেছে। এখন গায়ে লাগেনা। আরিভ দাঁত কিড়মিড় করে দশ নম্বর মেসেজ লিখল,
-“নাফিয়ার বাচ্চা! হাতের কাছে পাই একবার!”
এবার জবাব এল,
-“হুমকি দিচ্ছেন কাকে? আন্টিকে বিচার দিব এসে।”
-“দাও। সাহস থাকলে দিয়ে যাও। একবার আমার বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে এসো ছাদে নিয়ে বেঁধে রেখে দিব।”
-“দিবই। আপনি আমার কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করলে আন্টিকে মিথ্যে বানিয়ে বানিয়ে বলব। এমনিতেই সারাদিন মার খান। এসব শুনলে আপনাকে ত্যাজ্য করবে।”
-“কোনসব?”
-“এইযে পর নারীদের হাত ধরে টানাটানি করেন।”
-“তোমাকে আমি দেখে নিব।”
-“ভয় পেলাম প্রচুর।”
হুট করেই অধৈর্য হয়ে উঠে আরিভ। কথার মাঝেও সেই ব্যাকুলতার প্রকাশ ঘটিয়ে বলল,
-“কেন দেখা দিচ্ছ না নাফি? আচ্ছা! আমি তোমার থেকে অন্তত দুইহাত দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলব। সেসব বাদ, অন্তত বারান্দায় এসো।”
-“উহু।”
-“কেন জ্বালাচ্ছো?”
-“আপনাকে জ্বালাতে ভালোই লাগছে।”
দূর্বলতার সুযোগ নিতে শিখে গেল না তো? নাহ! তার সামনে নিজেকে কঠোর দেখাতে হবে। নাহয় এভাবেই জব্দ করে দিন পাড় করবে এই মেয়ে। আরিভ লিখল,
-“বেশ! তবে আমি জ্বলছি না আর। তোমার দেখা করতে ইচ্ছে হলে করো, না করতে ইচ্ছে হলে নেই। আই ডোন্ট কেয়ার।”
মেসেজটি পড়ে অবাক হয় নাফিয়া। ভালোইতো লাগছিল বিরক্ত করতে। হুট করে রূপ বদলে নিল কেন? এবার কী হবে?
কারো ঘরে উঁকিঝুঁকি দেওয়া মোটেও শোভনীয় কাজ নয়। কিন্তু না চাইতেও আরিভের চোখ যাচ্ছে রেশমা বেগমের ঘরের দিকে। তার ব্যালকনি বরাবর নাফিয়াদের বারান্দা আর ঘরের ঠিক সামনে রেশমা বেগমের ঘর। তাদের ঘরটাই কেন হতে হলো এখানে? নাফিয়ার ঘরও হতে পারত। তাতে কী? আড়াল হয়ে দেখল নাফিয়ার মুখ খানা। মায়ের পাশে বসে আয়েশ করে টিভি দেখছে। আশপাশের কোথাও তার খেয়াল নেই। হাসছে কী যেন দেখে। আরিভের মেজাজ আরও বেশি খারাপ হলো তার হাসি দেখে। তাকে যন্ত্রণায় রেখে এই মেয়ের মনে কত সুখ।
হুট করেই নাফিয়ার চোখ গেল জানালার দিকে। আরিভকে সং সেজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুখ ভেংচি দিল। এগিয়ে গিয়ে পর্দা টেনে দিল। ফোন হাতে তুলে বলল,
-“এভাবে কারো বেড রুমে উঁকি দেওয়া অসভ্য মানুষের কাজ।”
কোনো জবাব আসেনি আরিভের তরফ থেকে। মেসেজটি দেখেও উত্তর দেয়নি। রেশমা বেগম চা করতে গেলেন। সেই সুযোগে নাফিয়া উঠে গেল জানালার দিকে। পর্দার ফাঁক দিয়ে একটুখানি দেখবার চেষ্টা করল। আরিভ বিছানায় বসে আছে। পায়ের উপর ল্যাপটপ, মুখটা ভার। নাফিয়া চেয়ে রইল কিছুক্ষন। পর্যবেক্ষণ করল তার অপ্রিয় শত্রুকে। তার মাঝে কোনো নড়চড় নেই। এক ধ্যানে কাজ করছে।
নাফিয়া ঠোঁট উল্টে ভাবল, জ্বালাতন কী বেশি হয়ে যাচ্ছে? নতুন আরিভকে অতিরিক্ত বিরক্ত করে ভুল করছে না তো কোনো?
________
নোহা আপুর বিয়ের দাওয়াত পড়েছে। নাফিয়াদের প্রতিবেশী তারাও। হুট করেই বিয়ে ঠিক হওয়াতে আশপাশের কয়েকজন প্রতিবেশীকে দাওয়াত করবার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র। আজ সন্ধ্যায় হলুদ, আগামীকাল আকদ। নোহার বিয়ের কথা শুনতেই লাফিয়ে উঠল নাফিয়া। এইতো বছর খানেক আগে তার সাথে ভালোই যোগাযোগ ছিল। প্রতিদিন তার কাছে অংক বুঝতে যেত। কিন্তু পড়ালেখার সুবাদে সে ঢাকার বাহিরে চলে যায়। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ফিরেছে মাত্র পাঁচ ছয়দিন হবে।
মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই চলে গেল নোহাদের বাড়িতে। হাসিমুখে এসে বসল তার পাশে। নোহা নাফিয়াকে দেখে বলল,
-“এসেছিস? কতদিন দেখিনি তোকে। আমি ফেরার পর একটাবার দেখা করতেও এলি না।”
হাতে মেহেদী দিতে দিতে খানিক অভিমানের সুরে বলল নোহা। নাফিয়া বলল,
-“আসতে চেয়েছিলাম তো আপু। কিন্তু তোমরা চারতলায় থাকো উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে যাই আমি। তার মধ্যে লিফটটাও নষ্ট।”
-“হয়েছে হয়েছে। নিজের কষ্টের কথা ভেবে আসিস নি।”
-“তুমিওতো আসোনি।”
-“এসেছিলাম, তুই পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিলি। আর বিয়ের শপিং করতে করতে সময়ও পাই নি।”
নাফিয়া ঠোঁট কামড়ে মেহেদীর দিকে তাকাল। খুব ইচ্ছে হচ্ছে সেও মেহেদী পড়ুক। কিন্তু মুখ ফুটে বলার মত অভ্যাস তার নেই। কয়েকজন মেয়ে গোল হয়ে মেহেদী দিচ্ছে। নোহা নাফিয়ার আগ্রহী দৃষ্টি দেখে নিজে থেকেই বলল,
-“মেহেদী দিবি?”
নাফিয়া ঠোঁট কামড়ে মাথা দোলায় উপর নীচ। নোহা বলল,
– “সেটা মুখ ফুটে বলা যায় না বোকা মেয়ে?”
নোহা একজন মেহেদী আর্টিস্টকে ডেকে বলল,
-“ওর দুহাতে মেহেদী দিয়ে দিন।”
নাফিয়া হাত পাতল সাথেসাথে। ডান হাত নোহা নিজে থেকে এগিয়ে দিল। বালিশের উপর রাখল। আবার বলল,
-“ডান হাতে যত্ন করে মেহেদী দিবেন। বেশি চাপ প্রয়োগ করবেন না।”
মেহেদী দিতে দিতে আচমকা জোহান এসে হাজির। তার পেছনেই বড় ডালা নিয়ে সাদিফ। নোহার মা এই দুটোকে কাজে লাগিয়েছেন। কোনো ছেলে নেই তার। সেই সুবাদে সাহায্য করছে কাজে। সাদিফ বলল,
-“গাধার খাটুনি খাটছি। তোর জামাই যদি গেটে এক লক্ষ টাকা না দেয় তাহলে বিয়েই হতে দিব না।”
নাফিয়া চট করে বলে উঠল,
– “তোমরা যে গাধা তাহলে সেটা স্বীকার করলে?”
সাদিফের মুখ কুঁচকে যায় এমন কথায়। নাফিয়া আর নোহা হাসছে। মাঝেই জোহান বলল,
-“আরিভ ভাইকে একটা ফোন করা উচিত। আমরা একা কাজ করব কেন? তাকেও কাজে লাগাতে হবে।”
আরিভের নাম শুনে নাফিয়া চোখ তুলে তাকায়। তাকে কল করে লাভ হবেনা। সে অফিসে, ভালো করেই জানা আছে নাফিয়ার। কিন্তু বলল না কিছু। জোহান কল করে ফোন স্পিকারে দিল। বলল,
-“ভাই কই আপনি?”
-“জাহান্নামে।”
ভড়কে থাকা আরিভের কণ্ঠস্বরে নাফিয়া ঠোঁট কামড়ে হাসে। জোহান বলল,
-“জাহান্নামের ওয়েদার কেমন ভাই? বেশি গরম নাতো?”
সবাই মিটিমিটি হাসছে। অন্যদিকে রাগে ফুঁসছে আরিভ। জবাবে বলল,
-“তুই আমাকে কী রঙ্গের আলাপ করার জন্য কল করেছিস?”
-“না ভাই। আসলে নোহা আপার বিয়েতে বিনা টাকায় কামলা খোঁজা হচ্ছে। আমি আর ভাইয়া জয়েন করেছি কামলা সংগঠনে আমরা চাইছি বড় ভাই হিসেবে আপনিও আসুন। লিড দিন আমাদের।”
আরিভ চেঁচাল,
– “অফিসে বসে কামলা দিচ্ছি আর তুই আমার সাথে আজাইরা আলাপ শুরু করেছিস। ফোন রাখ নয়তো বাড়ি ফিরে জান কবজ করে নিব।”
ফোনটা কেটে দেয় জোহান। নাফিয়া মনে মনে ভাবল, আগুনের গোলা হয়ে ঘুরছে। নিশ্চয়ই অফিসের চাপ একমাত্র কারণ নয়। কারণ আরও একটা আছে। এটাই মনে হল নাফিয়ার। নাফিয়া নোহার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো,
-“আরিভ ভাইরাও আসবে বিয়েতে?”
-“হ্যাঁ।”
বিয়েতে কীভাবে এড়িয়ে যাবে? যদি এতগুলো মানুষের সামনে আরিভ কিছু বলে বসে? হাত ধরে টানাটানি করে? মান সম্মান কোনোটাই থাকবে না। হুট করেই নাফিয়ার বোধগম্য হল এসব আরিভ কোনোদিন করবে না। তার চেয়ে যথেষ্ট বুঝদার মানুষ সে। নাফিয়া নিজেই উল্টোপাল্টা ভাবে।
_______
সূর্যের তেজ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। আঁধার নামছে আকাশ জুড়ে। ঠিক তখনই পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে মরিচা বাতি ঝিরঝির করে জ্বলে উঠল। কৃত্রিম আলো ছড়াতে লাগল চারিদিকে।
আরিভ সদ্য গোসল সেরে বেরিয়েছে। মা কুসুম হলুদ রঙের একটি পাঞ্জাবি আয়রন করে দিয়ে গেছেন। এটি পরেই যেতে হবে নোহার হলুদ ছোঁয়ার অনুষ্ঠানে। কিন্তু শরীরে একফোঁটা শক্তি অবশিষ্ট নেই। দেহের সাথে মন অবসন্ন। দূর থেকে শুনতে পেল নাফিয়াও আসছে। আসলেই কী? আসবে কিন্তু থাকবে দূরে। দেখা হলেও কথা হবেনা।
শিরীন বেগম এসে ডাকলেন। বললেন,
– “তৈরি হয়ে নে।”
আরিভ মনমরা ভঙ্গিতে জবাব দিল,
-“হুম।”
-“হয়েছেটা কী তোর?”
আরিভ নত সুরে জবাব দিল,
-“শত্রুর স্বল্প মায়ায় ডুবে বিষন্ন অসুখে ভুগছি।”
-“কী বললি?”
-“কিছু না।”
-“যাবি ভালো কথা। নাফির সাথে তর্ক করলে ভালো হবেনা।”
-“আচ্ছা আম্মা।”
ছেলেটা রাজি হয়ে গেল। কেমন যেন দেখাচ্ছে আরিভকে। কিছু একটা তো হয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারছেন না শিরীন বেগম। আরিভ কাপড় বদলাতে বদলাতে বলল,
-“তর্ক না কথা বলতে চাই, একবার দেখতে মন আনচান করছে। কিন্তু সেই সুযোগটাই দেওয়া হচ্ছেনা আমাকে।”
সেঁজেগুঁজে তৈরি নাফিয়া। শাড়ি পড়ার উটকো ঝামেলা মাথায় নিতে চায়নি। কুসুম হলুদ আর সাদা রঙের মিশ্রণে একটি সেলোয়ার কামিজ জড়িয়ে পা বাড়ালো নোহাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আরিভদের বাড়ি পেরিয়ে যেতে যেতে ভেংচি কাটল সেখানে চেয়ে। আচমকাই কেউ হাত টেনে দরজার ভেতরে নিয়ে এল। কী হল কয়েক সেকেন্ডের জন্য বুঝে উঠতে পারেনি নাফিয়া।
সামনে তাকাতেই আরিভকে দেখল। বিস্ফোরিত চোখে তাকাল সঙ্গেসঙ্গে। হাত টেনে এনে নিজের সামনে দাঁড় করিয়েছে। নাফিয়ার দুটোহাত নিজের একহাতে শক্ত করে চেপে ধরে আছে আসামীর মত করে। অন্য হাত দেয়ালে ঠেকানো। বন্দী হাতেই নাফিয়া দুয়েক কদম পেছনে সরে গেল। বলল,
-“এগুলো কেমন অভদ্রতা?”
আরিভের মুখমন্ডল আরও কঠিন হয়ে উঠে। নাকের পাটা ফুলে আছে। দাম্ভিক স্বরে বলল,
-“এতদিন তুমি যা করছিলে সেটাকে কী ভদ্রতা বলে?”
-“কী করেছি আমি?”
-“ইগনোর! এড়িয়ে যাচ্ছ আমাকে। সমস্যা কোথায়?”
-“আপনি সমস্যা!”
আরিভ হিম শীতল সুরে আওড়ায়,
-“তুমি সমাধান হয়ে যাও।”
হাতজোড়া আবদ্ধ, তার মধ্যে এতটা কাছে দাঁড়িয়ে অস্বস্তি আগের চেয়ে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কন্ঠ আর কথায় কী দারুন পরিবর্তন। নাফিয়ার সন্দেহ নব্বই শতাংশ ঠিক প্রমাণিত হচ্ছে। নাফিয়া একবার চোখ তুলে তাকায় আবার নামিয়ে ফেলে। মুখ ফুলিয়ে বলল,
-“আপনার মাথা গেছে।”
আরিভ সামান্য মাথা ঝুঁকায়। নাফিয়াকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করল। চোখ এসে ঠেকল মুখমণ্ডলে। ঘন পাপড়ির আড়ালে গাঢ় কালো রংয়ের কাজল শোভা পাচ্ছে। ঠোঁটে হালকা গোলাপী রঙের লিপস্টিক দারুণ রকমের ঝংকার তুলল হৃদগহ্বরে। এলোমেলো চুল থেকে মোহনীয় ঘ্রাণ ভেসে আসছে। সম্মোহনী চাহনী আরিভের।
-“এভাবে চেয়ে আছেন কেন? নেশাটেশা করেননি তো আবার? দেখেই মাতাল মনে হচ্ছে। ছাড়েন আমাকে!”
আরিভের চোখের গভীরতা পরিমাপ করা এই মুহূর্তে অসম্ভব। নাফিয়া আতঙ্কিত হয়ে উল্টোপাল্টা বকছে। স্বাভাবিক করতে চাইছে মুহুর্তটাকে। কিন্তু আরিভ সেটি করতে দিতে নারাজ। আছড়ে পড়া নিঃশ্বাস ব্যাকুল করছে নাফিয়ার অপরিপক্ব হৃদয়ের অনুভূতিগুলোকে।
-“ পুরুষ দু’ ধরনের নেশায় মজে। এক মাদকদ্রব্যে আরেক কোনো নারীর সুগভীর চোখে। তোমার কী মনে হয় আমি এই মুহূর্তে কোনটায় আসক্ত?”
চলবে….
#বৈরী_বসন্ত ১২
লেখা – আয্যাহ সূচনা
নাফিয়া অদ্ভুত ব্যবহার করছে। হুটহাট হাসছে, আবার কখনও থম মেরে বসে পড়ছে এদিক – ওদিক। গতকালকের আরিভের সেই গভীর দৃষ্টি তাকে বারবার মনে করাচ্ছে। শীতলতা নামছে অঙ্গে প্রত্যঙ্গে। স্বস্তি পেল না সারাটি দিন। তার মধ্যেই মায়ের ডাক পড়ল,
-“নাফি গোসল করে আয় জলদি, তৈরি হতে হবে।”
তৈরিতো হতে হবে। এরপর ওই লোকের মুখোমুখিও হতে হবে। সেটি কীভাবে সহ্য করবে নাফিয়া?এবার তো শতভাগ নিশ্চিত লোকটির ফিউজ উড়ে গেছে। আকাশে বাতাসে উড়ছে। সাথে নাফিয়াকেও উড়াতে চাচ্ছে।
ফোনে নটিফিক্যাশন এল। নাম নিতে না নিতেই হাজির মহাশয়ের মেসেজ,
-“আজ যেন কোনো তিড়িং বিড়িং না করা হয়।”
নাফিয়া জবাব দিল না। মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। আরও একটি মেসেজ আসে,
-“আবার ইগনোর করছো?”
-“ইগনোর করব নাতো কী পূজো করব? আপনার মতলব ভালো না সেটা আমি ঠিকই বুঝেছি।”
-“কী বুঝেছো?”
-“আমাকে ফাঁসাতে চাইছেন না?”
-“হ্যাঁ চাইছি।”
-“আমি ফাঁসবো না।”
-“সেটা সময় বলে দিবে। দ্রুত তৈরি হয়ে এসো, আ’ম ওয়েটিং।”
-“আপনার ওয়েটিং এর গুষ্টি কিলাই। একশোহাত দূরে থাকবেন।”
-“যদি না থাকি?”
-“বিচার দিব আপনার মায়ের কাছে।”
-“দিও। আমার জন্যই ভালো। মা’কে আলাদা করে আর কিছু বলতে হবেনা।
-“কী বলতে হবেনা?”
আরিভ হেসে জবাব দেয়, – “এইযে তোমাকে ফাঁসাতে চাইছি অন্তর্জালে।”
কাকতালীয়ভাবে আজও পোশাকের রং মিলে গেল আরিভের সাথে। সেও কালো শার্ট পড়েছে। আর নাফিয়া কালো রংয়ের ড্রেস। দূর থেকে নাফিয়াকে দেখেই ঠোঁটে এক উজ্জ্বল হাসি ফুটে। অথচ সেই মেয়েটিই চোখ ফিরিয়ে নিল। আরিভের মুখ চুপসে যায়। চায় কী এই মেয়ে? এমন কেন করে?
শিরীন বেগম এবং রেশমা বেগম দুজনেই কুশল বিনিময় করল। বেশ কিছুক্ষণ যাবত আলাপ চলছে রেশমা বেগম আর শিরীন বেগমের মধ্যে। সাংসারিক আর অন্যান্য আলোচনা নারীদের বরাবরই পছন্দের। সেখানে নির্বিকার ভঙ্গিতে কথা বলতে চাইছে আরিভ, দৃষ্টি দিয়ে। কিন্তু কোনো লাভ হল না। একবারের জন্যও তাকায়নি নাফিয়া। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে চেয়ে আছে।
নোহার বাবা মায়ের সাথে দেখা করে খাবার টেবিলের দিকে এগোলেন। হুট করেই নাফিয়ার পাশে এসে বসে আরিভ। ডান দিকে নাফিয়া আর বাম দিকে মা’কে ডেকে বসাল।
এতগুলো মানুষের সামনে বাম হাতে খাওয়া সম্ভব না। নাফিয়ার মা কোনো চিন্তাভাবনা না করেই মেয়েকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে শুরু করেন।
আরিভ সবার নজর এড়িয়ে কানের কাছে এসে বলল,
-“কী জমিদারি তোমার! এখানেও খাইয়ে দিতে হচ্ছে।”
নাফিয়া শুনল, কিন্তু প্রতিক্রিয়া দিতে পারল না। মা সামনে। কোনরকম সরে যেতে পারলেই বাঁচে। লোকটা আশেপাশে থাকলেই কেমন যেন অস্বস্তি লাগা শুরু হয়।
এই অস্বস্তির পরিমাণ দ্বিগুণ করল আরিভ। জ্বালাতন করার সীমা ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। এবার তার পালা। খেতে খেতেই টেবিলের আড়ালে থাকা নাফিয়ার হাতে হাত গলিয়ে দিল। আজ ডান হাত নয় বাম হাতটা ধরেছে। আঙুলের ভাঁজে শক্ত করে চেপে আছে।
নাফিয়ার চোখ বিশাল আকৃতি ধারণ করে। মেয়ের বড় বড় চোখ দেখে বলল,
-“কী হল?”
-“নাহ! কিছু না মা।”
আরিভ বলল,
-“ঝাল লেগেছে বোধহয় আন্টি। পানি দিন ওকে।”
রেশমা বেগম চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
– “সত্যিই ঝাল লেগেছে?”
-“না মা কিছুই হয়নি। প্রতিবেশীদের কথায় কান দিবে না তো।”
রেশমা বেগম মেয়েকে শাসিয়ে বলল,
-“এগুলো কেমন আচরণ?”
নাফিয়া মিনমিনে গলায় বলল, -“সরি মা।”
আরিভ হাসে। একটু সাবধানতা অবলম্বন করে। তার বাম দিকে তার মা রানী ভিক্টোরিয়া বসে। যদি দেখে তার গুণধর পুত্রের হাতে অন্য কোনো নারীর হাত সেটি কেটে ভাসিয়ে দিতেও দ্বিধা বোধ করবেন না।
নাফিয়া ছটফট করছে। নড়চড় করছে অতিরিক্ত। হুট করেই আরিভ বলে উঠল,
-“এত নড়চড় করছ কেন নাফিয়া? কোনো সমস্যা?”
আরিভের মাস্টারক্লাস অভিনয় দেখে অবাক না হয়ে পারছে না নাফিয়া। না পেরে নখ দাবিয়ে দিল আরিভের হাতে। আরিভ আতকে উঠে। সাথে সাথে হাত ছেড়ে দেয়। অন্যদিকে শিরীন বেগম ছেলেকে এমন লাফিয়ে উঠতে দেখে বললেন,
-“কী সমস্যা তোর? ব্যাঙের মতো লাফ দিলি কেন?”
-“নাহ কিছুনা।”
এত নরম তুলতুলে হাত অথচ আঁচড় ভয়াবহ। নাফিয়া ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল। এবার উচিত শিক্ষা হয়েছে। আরিভ নিজের হাতের দিকে তাকায়। গুণে গুণে চার আঙুলের চারটি চাপ পড়েছে হাতে। ফুঁসে তাকাল নাফিয়ার দিকে। নাফিয়া খাওয়া শেষে উঠতে গিয়ে নীচু স্বরে বলে গেল,
-“টিট ফর ট্যাট।”
________
-“আমি প্রশংসায় কাঁচা। আগে কখনও কোনো মেয়ের প্রশংসা করিনি। কীভাবে করব বলো? ছোট বাক্যে লিখি? তোমাকে অসম্ভব রকমের সুন্দর দেখাচ্ছে। আমি তোমার মাঝে কেন সৌন্দর্য খুঁজে বেড়াচ্ছি? এটাতো হওয়ার কথা ছিল না।”
কানের দুল খুলতে খুলতে মেসেজটি পড়ল নাফিয়া। আনমনেই হেসে ফেলে। আয়নায় নিজের মুখটা দেখল। সত্যিই কী সে কারো পছন্দের তালিকায় আসার যোগ্য? তবে তার হাতটা?
নাফিয়ার মন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সে প্রশ্নটি তার অপ্রিয় মানুষের কাছেই রাখল,
-“আমি আদৌ কারো পছন্দের কেউ হওয়ার যোগ্য?”
-“কেনো নয়?”
-“হয়ত কিছু অযোগ্যতা আছে আমার।”
আরিভ বিরক্ত হয়ে লিখল, -“তোমার শক থেরাপি দরকার। সব অযোগ্যতা পালাবে।”
এরপরই হাতের ছবি এলো। ফর্সা হাত লাল টকটকে হয়ে আছে। আঁচড় এর দাগ স্পষ্ট। নাফিয়া জ্বিভ কাটল দাঁত দিয়ে। বেশি জোরে আঘাত করে ফেলেছে। আরিভ লিখল,
-“কাজটা কী ভালো হল?”
-“বেশ হয়েছে। এগুলো আপনার অসভ্যতার শাস্তি।”
-“কারো হাত ধরা অসভ্যতা?”
-“অবশ্যই অসভ্যতা।”
-“হাত ধরার আগেও অসভ্য বলতে। এর অর্থ এটাই দাঁড়াচ্ছে আমি জন্মগত অসভ্য। এখন উপায়?”
নাফিয়া জবাব দেওয়ার চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় অনুভব করল আরিভের হাতটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাকে। হাতভর্তি ঘন কালো লোম। গুণে গুণে তিনটি রগ ফুলে আছে। মধ্যেই তার দেওয়া আঘাতের দাগ। অনুশোচনা হচ্ছে না কেন? উল্টো হাসি পাচ্ছে।
-“কালকের দিনটি আমার চাই নাফি, তোমার সঙ্গ চাই।”
হুট করে মেসেজটি এসেছে। সাথে সাথে আরও একটি মেসেজ এল,
-“না করবে না প্লীজ। এক সপ্তাহের জন্য ঢাকার বাহিরে যাচ্ছি, বাবা ডেকেছেন। একটাদিন তোমায় জ্বালাই? এক সপ্তাহের ছুটি পাবে আমার জ্বালাতন থেকে।”
________
আরিভের আবদার ফেলতে পারেনি নাফিয়া। একেবারেই পারেনি। হুট করে মনে একবার শঙ্কা জেগেছিল। যা হচ্ছে সেটি সঠিক নাকি ভুল? পথটা উচিত নাকি অনুচিত? ভয় হয়েছিল। কিন্তু অবচেতন মন চেয়ে বসল, এই অপ্রিয় মানুষকে একটি দিনের কিছু মুহূর্ত উপহার দেওয়াই যায়। সে তার পরিবর্তনগুলো প্রকাশ করছে। ব্যাকুলতা মেলে ধরছে। এভাবে প্রত্যাখান করা কী উচিত হবে? মস্তিষ্ক হাজার দ্বিধায় ফেললেও, মন সিদ্ধান্তে অটল। হুট করেই কেমন অদ্ভুত অনুভবের উদয় হল অন্তরস্থলে।
নাফিয়া ডায়েরীতে লিখল, “এক অপ্রিয় পুরুষের ছোঁয়া ভয়ংকর হয়ে দাঁড়াল, দৃষ্টি এলোমেলো করে দিল, কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলল।”
গতকাল আরিভ নাফিয়ার প্রশংসা করেছিল। নাফিয়া নিজেকে পরিপাটি করেছে। ভীষণ লজ্জা পাওয়া সত্ত্বেও হালকা সেঁজেছে। এবার তো নিজের সাথেই চোখ মেলাতে পারল না আয়নায়। না দেখেই বেরিয়ে গেল। সে জানে আরিভ ঠিক গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে। মাথা নত করেই এগোয় সেখানে।
আরিভ সর্বদাই হাস্যোজ্জ্বল। তবে নাফিয়ার দিকে ছোঁড়া হাসি ভিন্ন ঠেকছে। নাফিয়া চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আরিভ বলল,
-“মুখ তুলে তাকাও।”
-“কীহ?” সাথে সাথে চোখ তুলে নাফিয়া।
আরিভ চোখে চোখ রাখল। চোখের মনে এদিক ওদিক নাচিয়ে বলল,
-“উহু! তোমার কাজল দেওয়া ঠিক হয়নি। এক চোখে মোটা আরেক চোখে চিকন।”
নাফিয়ার মন উদাস হয়ে গেল। মলিন সুরে বলে বলল,
-“খেয়াল করিনি এতটা।”
-“মন খারাপ করছো কেন?”
-“কই?”
আরিভ হেলমেট নিয়ে নাফিয়ার মাথায় দিল। বলল,
-“খেয়াল যদি আমার দিকে থেকে থাকে তাহলে ভুল মাফ করা যায়।”
নাফিয়া বাইকে উঠে বসে। বলে,
-“আমার তো বয়েই গেছে আপনার দিকে খেয়াল দিব।”
-“বয়ে যাক।”
বলেই হাসল আরিভ। সাথে নাফিয়াও। তার হাসিটুকু আরিভের দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেল। বাইক দ্রুত গতিতে চলেছে। আশ্চর্যভাবে ভয় পেল না আজ নাফিয়া। বাতাসের ঝাপটা অনুভব করছে চোখ বুঁজে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে ক্ষণে ক্ষণে। সেটি উপভোগ করছে আরিভ লুকিং গ্লাসের সাহায্যে।
ঘন্টাখানেক পর বাইক এসে থামল লেকের পাশে। জায়গার নাম নাফিয়ার জানা নেই। কিন্তু সামনের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আরিভকে ফেলেই সামনের দিকে এগিয়ে গেল। পায়ের গতি দ্রুত করে নাফিয়া সরাসরি এসে দাঁড়ায় কাঠের তৈরি ব্রিজের উপর। ঠান্ডা বাতাস বইছে এখানে।
আরিভ পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, -“ভালো লাগছে?”
-“খুব!” উচ্ছ্বাসের সাথেই জবাব দিল নাফিয়া।
আরিভ জুতো খুলে বসল। নাফিয়াকেও হাতের ইশারায় ডাকে। বিনা বাক্যে নাফিয়া এসে বসল পাশে। বলল,
-“জায়গাটা কি সুন্দর, ইস! আগে কেন এলাম না?”
-“কারণ আমি নিয়েই আসিনি।”
-“আপনার কথা বলছি না। বাবা মায়ের সাথেও আসতে পারতাম।”
-“সেটা নাহয় তোমার বাবা মাকে জিজ্ঞেস করো।”
হুট করেই মুখ নামাল নাফিয়া। মন খারাপ হয়ে আসে। বলে,
-“বাবাকে মিস করছি।”
আরিভ বলল, -“কোথায় সে?”
-“দাদীকে নিয়ে গ্রামে গিয়েছে।”
আরিভ উঁচু গলায় বলে উঠে,- “আলহামদুলিল্লাহ!”
নাফিয়া ঘুরে তাকাল। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে জানতে চাইল,
-“খুশি হলেন বুঝি?”
-“অবশ্যই! বুড়িটা নেই, জ্বালাও নেই।”
নাফিয়া ঠোঁট কামড়ে হাসে। কী যেন ভাবল, সেই ভাবনার কারণেই হাসির উৎপত্তি। আরিভের ইচ্ছে হল হাসির কারণ জানতে। শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
-“হাসির কারণ?”
-“কিছু টক্সিক মানুষ আশপাশে না থাকলে জীবন আসলেই সুন্দর।”
-“ঠিক! যেমন তোমার দাদী। পুরো দুনিয়াতে একটামাত্র পিস, তাও ফল্টি!”
নাফিয়া এবার আর আরিভকে শাসায়নি। দাদীর হয়ে তর্ক করেনি। মানুষটি সত্যিই তাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। হুট করেই মনে পড়লে কান্না পায়।
প্রকৃতির ঘোরে আচ্ছন্ন নাফিয়ার চোখ পড়ল না আরিভের দিকে। একজোড়া চোখ তার মাঝে কীভাবে আবদ্ধ সেকি খেয়াল আছে তার। তার ছোটখাটো নড়চড়, চোখের পলক কারো অন্তরে ভীষণভাবে গিয়ে গেঁথে যাচ্ছে। কী থেকে কী হয়ে গেল? এই প্রশ্নে জর্জরিত আরিভ।
-“আমার সাথে দুর্ঘটনা না হলে আমার জীবনটা আরও সুন্দর হতো তাই না?”
-“এখন কী সুন্দর নয়?”
-“কিছুটা অসম্পূর্ণ।”
-“ভুল ধারণা তোমার।”
-“আপনিও সহানুভূতির জেরে…”
আর বলতে ইচ্ছে হল না নাফিয়ার। চুপ করে গেল। আরিভ পাশ ঘেঁষে বসে। ভারী মাথাটা তার দূর্বল কাঁধে এলিয়ে দিল। চমকে উঠে নাফিয়া। আরিভ ধীর গলায় বলল,
-“অনুভূতির কিছু ধাপ থাকে। সহানুভূতি প্রথম ধাপ, এরপর মায়া, এরপর…”
-“এরপর কী?”
-“এরপর তোমার নড়চড় আমার ভালো লাগছে না। স্থির থাকো!”
হুট করেই ধমকে উঠল আরিভ। এড়িয়ে গেল আরিভ। অদ্ভুত এক শান্তি অনুভব করছে নাফিয়ার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে। মুহূর্ত এখানে থেমে যাওয়ার প্রার্থনাটুকু করল।
-“এড়িয়ে গেলেন কিন্তু?”
-“হুউউম।”
-“আপনি মাথা সরান আপনার। উফ! পুরো একটা দানবের মতো মাথা।”
-“উহু!”
-“আমার নাজুক কাঁধ এই ভার নিতে পারছে না। আর মানুষই বা কী ভাববে?”
-“যা তুমি ভাবছো তাই ভাববে।”
আরিভের চুলগুলো গালে এসে স্পর্শ করছে। নাফিয়া চোরের মত এদিক ওদিক তাকাল। কেউ চেয়ে নেই তো? লোকটা ভারী নির্লজ্জ! কোনো কান্ডজ্ঞান নেই তার। কীভাবে সরানো যায়? পাঁয়তারা শুরু করল নাফিয়া। হুট করেই বুদ্ধি খেলে যায়। বলে,
-“আপনার ক্ষিদে পায়নি?”
-“দূর্বল জায়গায় হাত দিবে না বলে দিচ্ছি।”
নাফিয়া ঠোঁট টিপে হাসল। বলল,
-“আমারতো ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। দেখুন না সামনের রেস্টুরেন্ট থেকে কী সুন্দর খাবারের ঘ্রাণ আসছে। সেখানে চলুন।”
মেয়েটা স্বস্তিতে থাকতে দিল না। তার কথা শুনে ঘ্রাণ তার নাকেও ভাসছে। মাথা তুলে তাকাল পাশে। দুপুরের খাবারের সময়। কাপড় ঝাড়া দিয়ে উঠে বলল,
-“আমাকে কীভাবে জব্দ করতে হয় ভালোই শিখেছ।”
-“আমি কী করলাম আশ্চর্য!”
-“ আমার অন্তরের দফারফা করে জানতে চাইছে, কী করেছে সে!”
-“সেটা একান্তই আপনার দোষ।”
বলে হাঁটতে শুরু করে নাফিয়া। তার পিছু নিল আরিভ। বিভিন্ন ধরনের খাবার আছে এখানে। কিন্তু মন টানলো বাঙালি খাবারে। হরেক রকমের ভর্তা অর্ডার করেছে আরিভ। নাফিয়া শুধু চেয়ে দেখল। কিছু খাবারের নাম সে নিজেও জানেনা।
-“যা যা দিবে সব খেতে হবে তোমার।”
-“যা ভালো লাগবে তাই খাব।”
-“উহু! খেতে শিখ, রাঁধতেও শিখো। ভবিষ্যতে কাজে দিবে।”
কথার অর্থ বুঝেনি নাফিয়া। খাবার আসার সাথে সাথেই আরিভের মনোযোগ সম্পূর্ণ সরে যায় নাফিয়ার কাছ থেকে। নাফিয়া অবাক হয়ে দেখল শুধু। খাবার সার্ভ করে দেওয়ার পর তাকে কোনো পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না। একটা মানুষ এত বড় ভোজনরসিক কী করে হতে পারে? মুখ ফুলিয়ে রইল নাফিয়া।
আরিভ এক পলক তার দিকে চেয়ে বলে, – “অভিমান করে লাভ নেই। খাবার আমার প্রথম ভালোবাসা।”
খাবার শেষে হাঁটছে আরিভ। অতিরিক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। হজম করার জন্য হাঁটছে, সাথে নাফিয়াকেও কসরত করাচ্ছে। ভারী অদ্ভুত লোক!
নাফিয়ার নজর গেল কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে। দৌঁড়ে গেল সেখানে। আরিভের দিকে চেয়ে বলল,
-“আমাকে এখানে কিছু ছবি তুলে দিন না। দেখুন কী সুন্দর গাছ।”
আবদারের কন্ঠ সুন্দর শোনাচ্ছে। প্রথম আবদার তার। আহামরি কিছু চায়নি, কিন্তু তার মনে হল এর চেয়ে প্রয়োজনীয় আর কিছু নেই এই মুহূর্তে। আরিভ এগিয়ে এল। কিছু ফুল কুড়িয়ে নাফিয়ার কানে গুঁজে দিল। সম্মোহনী দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। বলল,
-“এভাবে আবদার করলে জানটুকু হাজির করে দিব।”
চলবে…