বৈরী বসন্ত পর্ব-১৫+১৬

0
4

#বৈরী_বসন্ত ১৫
লেখা – আয্যাহ সূচনা

আকাশটা ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে। দিনের শেষ আলোটা ক্ষীণ হয়ে এলো। রোদ এখন আর আগের মতো চটপটে নয়। সে ধীর, ক্লান্ত, বিদায়ী। পুরনো বিল্ডিংগুলোর কার্নিশে কাকেরা ফিরে আসছে দল বেঁধে। এই শহরের ব্যস্ততা থামবে না, কিন্তু তারা সময়ের পাকা, সময়মতো ফেরাই নিয়ম। ফ্ল্যাটগুলোর জানালায় একে একে জ্বলে উঠছে আলো। কোথাও টিউবলাইট, কোথাও হালকা হলুদ বাতি। কলোনিটা যেন ধীরে ধীরে আলোয় সেজে উঠছে।

নাফিয়ার মাথায় কাপড় টানা। ফ্লাক্সে করে চা এনেছিল ছাদে। আজ খুব করে মন চেয়েছে সন্ধ্যা নামতে দেখবে। রেশমা বেগম বারণ করা সত্ত্বেও শোনেনি। আকাশ যে অব্দি পুরোপুরি আঁধারে ঘনিয়ে না যাবে সেই অব্দি চেয়ে থাকবে। নতুন শখ, আজকাল কত অনুভূতিইতো নতুন।

কানের কাছে এসে কেউ ফু দিল। চুলগুলো ক্ষণিকের জন্য উড়ল নাফিয়ার। আবারও থমকে যায়। কিন্তু নাফিয়া থমকায়নি বরং ঘাবড়ে উঠেছে।

পেছনে তাকানোর সাথে সাথেই কেউ একজন বলল,

-“ভয় পেয়েছিলেন?”

নাফিয়ার চক্ষু চড়কগাছ। এই আঁধভাঙ্গা পা নিয়ে এই লোক এখানে কী করে? উঁচু টেবিলটা থেকে লাফিয়ে নামল। ভ্রু কুঁচকে বলল,

-“আপনি? আপনি কীভাবে এলেন? কেন এলেন? ডাক্তার না বলেছে রেস্ট করতে? পায়ের উপর চাপ পড়ল তো?”

আরিভ হাত তুলে নাফিয়াকে থামবার ইঙ্গিত দিল। বলল,

-“রিল্যাক্স! রিল্যাক্স! এত প্রশ্ন করলে উত্তর কোনটার দিব?”

-“আপনি এমন কেন বলুন তো? শুধু আমার পিছু পিছু ছুটেন! এখন পায়ে যদি কোনো সমস্যা হয়?”

আরিভ হাসে। এক মত্ত প্রেমিক পুরুষের কন্ঠে জবাব দেয়,

-“ আপনাকে ছাড়া আর কার পিছু ছুটব? কেউ আছে?”

নাফিয়া সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

– “ফ্লার্ট করছেন?”

আরিভ ন্যাকা সুরে জবাব দেয়,

-“ছিঃ! এসব আমি করি না। আমি একজন ভদ্র ঘরের ছেলে।”

নাফিয়া ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলল। পায়ের দিকে তাকাল। মায়া হল তার। এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,

-“ব্যাথা করছে না?”

-“করছে তো।”

-“বেশি?”

-“হু, কিন্তু পায়ে না।”

নাফিয়া ঝট করে মুখ তুলে প্রশ্ন করে,

-“আবার কোথায়? আরও কোথাও ব্যাথা পেয়েছেন?”

-“হ্যাঁ।”

নাফিয়ার খারাপ লাগা যেন পিছু ছাড়ে না। এই সামান্য কথাটায়ও অন্তরাত্মা মুষড়ে উঠল। নেতানো চোখজোড়া আরিভের মুখে রেখে বলল,

-“কোথায়?”

আরিভ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। নাফিয়ার হাত টেনে বলিষ্ঠ বুকের বাম দিকে রেখে বলল,

-“এখানে।”

নাফিয়া চমকায়। হাত সরিয়ে নেয় সাথে সাথে। দৃষ্টিও নত হলো তৎক্ষণাৎ। কী ভয়ংকর লোক! কী ভয়ংকর কর্মকাণ্ড। এইভাবে চলতে থাকলে নাফিয়ার পতন খুব কাছে। এই লোকের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

-“জরুরী কাজ ছিল তাই ব্যাথা ভুলে এসেছি।”

-“কী কাজ?”

-“তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে। প্রশ্ন করবে না? করো। জবাব দিতে বান্দা হাজির।”

আরিভ জমিনে বসেছে। পিঠ ঠেকে আছে দেয়ালে। ছাদের আলো জ্বালানো। আশপাশের আলোতেও আলোকিত সম্পূর্ণ ছাদটা। আরিভ শুধু বসে নেই। হাত এগিয়ে রেখে স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে থাকা নাফিয়ার দিকে। সে সঙ্গ চায়, পাশে চাইছে নাফিয়াকে। নাফিয়ার মনে সংকোচ। যদি এতটা কাছাকাছি আসার পর দূরত্ব চলে আসে? অনুভূতিগুলো বিষাদে পরিণত হয়?

নাফিয়ার চিন্তিত মুখের দিকে চেয়ে আরিভ বলল,

-“পাবার আগে হারাবার ভয়?”

চমকে উঠে নাফিয়া। চোখ বড় বড় করে তাকায়। কী করে বুঝল? আজকাল মন পড়তে শুরু করেছে নাকি?

নাফিয়া হাতে হাত রাখল না। তবে পাশে এসে বসল, নিরাপদ দুরত্ব নিয়ে। এই দুরত্বটুকুও আরিভের সইল না। পাশ ঘেঁষে বসে। তার প্রিয় কাজ, নাফিয়ার আঙুলের ভাঁজে নিজের হাত গলিয়ে মুখ ফিরিয়ে চাইল। মৃদু কম্পিত হাতখানা শক্ত করে চেপে প্রশ্ন করল ভারী কন্ঠে,

-“কীসের এত ভয়?”

-“জানি না।”

-“আমাকে ভয় করে? মনে হয় আমি তোমার ফয়দা নিচ্ছি? নোংরা চিন্তা আসে?”

নাফিয়া এমন কথায় আরিভের দিকে তাকায়। আরিভের মুখটা অতি নিকটে। চোখে চোখ পড়তেই হচকচিয়ে উঠল। চোখজোড়া যেন কোনো মহাসাগরের চেয়েও গভীরতার চেয়েও গভীর। এভাবে চেয়ে থাকা যায়?

-“বলো? আমার ছোঁয়া কীভাবে অনুভব করছো? খারাপ লাগছে?”

-“অন্য বিষয়ে কথা বলি?”

-“নাহ। আমি আগে এটার জবাব চাই।”

-“বুঝি না।”

-“বুঝো। অবশ্যই বুঝো।”

নাফিয়া কোনো জবাব দিল না। আরিভকে আশ্চর্যের চরম সীমায় পৌছে দিয়ে কাঁধে মাথা রাখল। আরিভ কিছু সময়ের জন্য বিমূঢ় হয়ে উঠে। নাফিয়ার কান্নার ধ্বনিতে হুশ ফিরল।

-“আমার নিজেকে বোঝা মনে হচ্ছে। বাবা আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা করছেন। সে বলছেন, তারা না থাকলে আমাকে কে দেখবে?”

কান্না কেন যেন সহ্য হচ্ছেনা। কোথাও অশান্তির অনুভূতির সৃষ্টি হল আরিভের। মাথা টগবগ করে উঠল। জবাবে বলল,

-“দেখবে, দেখার মানুষ আছে।”

-“আমি কেন কারও উপর নির্ভরশীল হব?”

-“মানুষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল নাফি।”

-“আপনারা তো সুস্থ, স্বাভাবিক। আমি উটকো ঝামেলা।”

-“ধমক খেতে ইচ্ছে হচ্ছে? এমন রোমান্টিক একটা সময়ে আমি তোমাকে ধমক দিতে চাইছি না। একদমই চাইছি না।”

নাফিয়া নাক টানল। সরে যেতে চাইল। বলল,

-“ধুর! আপনি কখনোই সিরিয়াস হবেন না।”

আরিভ নাফিয়াকে টেনে আনে নিজের কাছে পুনরায়। মাথায় হাত রেখে নিজের কাঁধে রাখল। বলল,

-“আ’ম ড্যাম সিরিয়াস এবাউট ইউ।”

আরিভের হুটহাট বলা কথাগুলো হৃদয়ে ড্রাম বাজায়। কেমন অনুভূত হয় সেটি ভাষায় প্রকাশ করবার মত হয়। নিজেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সুখী অনুভব হয়। এই অস্থিরতাগুলো ভীষণ সুন্দর।

-“এইযে কাঁধে মাথা রেখে আছো? এর বিশেষ কোনো কারণ? নাকি যার কাঁধে মাথা রেখেছো সে নিজেই বিশেষ?”

-“বেশি কথা বলবেন না। আমি তাহলে উঠে যাব।”

-“হুমকি দেওয়া হচ্ছে?”

-“হ্যাঁ।”

-“সয়ে নিলাম হুমকিটুকু বিনাবাক্যে।”

নাফিয়া মুচকি হাসে। চোখ নামিয়ে নেয়। বলতে চেয়েও পারছে না, আরিভের শরীর থেকে ভেসে আসা ঘ্রাণ তার ভালো লাগছে। হয়ত বলতে পারবেও না।

-“চা খাওয়াবে নাফি?”

নাফিয়া মাথা তুলল। সামনেই চায়ের কাপ আর ফ্ল্যাক্স। উঠে কাপে চা ঢেলে আরিভের দিকে এগিয়ে দেয়। নাফিয়ার এই চঞ্চলতা উপভোগ করল আরিভ। এইযে তাকে সামান্য চা এগিয়ে দেওয়ার তাড়াহুড়ো? এটিও যেন অগাধ মোহনীয়তা ধারণ করছে নিজের মধ্যেই।

নাফিয়া পাশে এসে বসে। এবার আর কাঁধে মাথা রাখেনি। লোকটাকে বেশি লাই দিলে আরও মাথায় চড়বে।

আরিভ চায়ের কাপ নিজে না নিয়ে নাফিয়ার দিকে এগিয়ে দেয়। বলে,

-“তুমি খাও আগে।”

-“আপনি না চাইলেন?”

-“খাব, তুমি খেয়ে দাও।”

“কিন্তু…”

-আরিভ নিজের ঠোঁট তর্জনী আঙুল চেপে বলল,

-“হুশ! অর্ধেকটা খেয়ে বাকিটুকু আমাকে দাও।”

নাফিয়া চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ায়। চা খাওয়ার দৃশ্যটুকুও চোখে ধারণ করল আরিভ। দুয়েক চুমুক দিয়ে আরিভের দিকে এগিয়ে দিল কাপটা। আরিভ এক চুমুক দিয়ে বলল,

-“একটি চায়ের কাপে ভাগীদার যেমন দুইজন, সুখ দুঃখের বেলায়ও হিসেবটা প্রায় এমনই।”

_________

নীরবে খুন করছে এই লোক। যেই খুনে কোনো আঘাত পাওয়া যায় না, দেহের মৃত্যু হয়না কিন্তু, রক্তক্ষরণ হয়না। ঘোরের মতো নিজেকে বিলীন হতে দেখা যায়। কান্না, অভিমান, তর্ক আর এক কাপ চা। সবকিছু শেষ করে ঘরে ফিরল নাফিয়া। এসেছে বহু কষ্টে। আরিভ আটকে রেখেছিল তাকে। যেতে দিতে চাইছিল না।

ঘরে ফিরেই লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। চুলগুলো একহাতে বাঁধতে বাঁধতে অভ্যাস হয়ে গেছে। দাঁতে চুলের কাটা আটকে চুলগুলো পেঁচিয়ে নিতে লাগল। ঠিক তখনই ধপ করে আওয়াজ পাওয়া যায় কিছুর। নাফিয়ার অদ্ভুত কারণে আতঙ্ক জেগে উঠে। আচ্ছা আরিভ কী ঠিকঠাক মতো বাড়ি গিয়েছে?

সিদ্দিক সাহেবের জোরালো ডাকে নাফির মুখ থেকে কাটা পড়ে গেল। চুলগুলোও বাঁধা হলো না। হৃদয়ে চাপ অনুভব করছে। বাবা এভাবে ডাকল কেন?

রেশমা বেগমের সাথে সিঁড়ি বেয়ে নেমে প্রশ্ন করে,

-“কী হয়েছে বাবা?”

প্রশ্ন করতে না করতেই চোখ গেল জমিনে। সিঁড়ির ঠিক গোড়ায়। কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে, নাক দিয়েও অনবরত রক্ত পড়ছে আরিভের। সিদ্দিক সাহেব মাথাটা কোলে রেখে কপালে হাত দিয়ে রেখেছেন। থম ধরে গেল নাফিয়া।

রেশমা বেগম আতঙ্কিত হয়ে এগিয়ে বললেন,

– “ও পড়ে গেল কীভাবে? অনেক রক্ত বেরোচ্ছে তো!”

আরিভ অর্ধজ্ঞান। নাফিয়া প্রতিক্রিয়াহীন চেয়ে আছে রক্তের দিকে। সিদ্দিক সাহেব আরিভকে কোনো রকম টেনে তুলতে তুলতে বললেন,

-“নাফি! শিরীন আপা আর আতাউর ভাইকে ডেকে আনো জলদি। ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।”

এতক্ষণ যেন নিঃশ্বাসটাও আটকে ছিল। লম্বা শ্বাস ফেলতে না ফেলতেই কেঁদে ফেলে নাফিয়া। ক্রন্দনরত অবস্থায় দৌঁড়ে গেল আরিভদের বাড়িতে। অনবরত কলিং বেল বাজাল।

শিরীন বেগম দরজা খুলতেই নাফিয়া হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-“আন্টি.. আন্টি উনি সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে..”

কথা গলায় আটকে আসছে। শিরীন বেগম বুঝল না। এগিয়ে নাফিয়ার হাত ধরে বলল,

-“কে পড়ে গেছে?”

এই অল্পসময়ের কান্নায় শ্বাস টানতেও অসুবিধে হচ্ছে নাফিয়ার। কোনরকম বলে উঠল,

-“আরি… আপনার ছেলে। রক্ত বেরোচ্ছে, হাসপাতালে নিতে হবে।”

আকাশ ভেঙে পড়ল যেন শিরীন বেগমের মাথায়। চিৎকার করে আতাউর সাহেবকে ডাকে। বাড়ির পাশ দিয়ে সাদিফ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ভেতরে আসে। আরিভকে এই অবস্থায় দেখে বলল,

-“কীভাবে হলো?”

সিদ্দিক সাহেব বললেন,

-“এত কথা পরে হবে বাবা। দয়া করে তোমাদের গাড়ি বের করো। হাসপাতালে নিতে হবে ওকে।”

-“এক্ষুনি আনছি আংকেল।”

শিরীন বেগম কাঁদছেন। সাথে নাফিয়াও। রেশমা বেগম তাকে সান্ত্বনা দিয়েও লাভ হচ্ছে না। অন্যদিকে নাফি। মেয়েটা একদিকে দাঁড়িয়ে কেঁদেই চলেছে। আতাউর সাহেব আর সিদ্দিক সাহেব দুজনেই আরিভকে ধরে গাড়িতে বসাল। শিরীন বেগমও উঠল গাড়িতে।

হুট করে নাফিয়া বলে উঠল,

-“আমিও যাব। আমাকেও নেও।”

সিদ্দিক সাহেব বললেন,

– “না তোমার যাওয়া লাগবে না।”

-“প্লীজ বাবা।”

-“নাফি গাড়িতে জায়গা নেই। বাসায় থাকো।”

নাফিয়ার কান্না আরও বেড়ে যায়। কী বীভৎস এই রক্ত! নাক, কপাল কপাল বেয়ে গড়িয়েই চলেছে। আরিভের এই অবস্থার জন্য সে নিজেকে দায়ী করতে শুরু করে। দৌঁড়ে চলে গেল উপরে। রেশমা বেগম মেয়ের দিকে তাকালেন। আরিভের জন্য এভাবে কান্না করছে?

রেশমা বেগমও তার সাথে সাথেই গেল। নাফিয়া দ্রুত কদমে ঘরে এসে বিছানায় হাঁটু গুটিয়ে বসেছে। অসহ্য রকমের যন্ত্রণা হচ্ছে তার বুকে। কেন আরিভ এলো তার সাথে দেখা করতে? পায়ের অবস্থা এমনিতেই নাজেহাল, তার মাঝে এত ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে গেল।

রেশমা বেগম মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। নাফিয়ার কান্নার আওয়াজ বৃদ্ধি পেল। রেশমা বেগম বেগম পাশে বসে বললেন,

-“কাঁদছিস কেন মা? ঠিক হয়ে যাবে আরিভ।”

-“মা! তুমি দেখলে না কত রক্ত পড়ছিল। মা আমার রক্ত ভীষণ ভয় করে তুমিতো জানো।”

নাফিয়ার অবস্থা খারাপ। মুখ চোখের জলে ভিজে একাকার। হেঁচকি উঠে গেছে মেয়েটার। কী রকম ভাবে কাঁদছে! রেশমা বেগম জড়িয়ে ধরলেন নাফিয়াকে। বললেন,

-“কাঁদিস না। কিচ্ছু হবেনা বললাম তো।”

-“মা! ওনার এমনিতেই পায়ে ব্যাথা তার মধ্যে…”

সিদ্দিক সাহেবের কল এল। ফোন পেয়ে লাফিয়ে উঠল নাফিয়া, দ্রুত মুখ মুছে কান্না থামায়। কাছের হাসপাতালেই আছে তারা। শঙ্কার কিছু না থাকলেও কপালে সেলাই পড়েছে। আজ রাতটা হাসপাতালেই কাটাতে হবে আরিভের। কথাটি শুনে নাফিয়া ফের কাঁদতে শুরু করল।

-“আহহা আবার কেন কাঁদছিস? ডাক্তার বলেছে ভয়ের কিছু নেই।”

-“আমার খারাপ লাগছে মা। উনি ঠিক হয়ে যাবে তো? যদি না হয়! আমি কী করব মা?”

-“তুই তো আরিভকে পছন্দই করতি না। ওর জন্য এভাবে….”

হুট করেই নাফিয়ার কান্না থেমে গেল। ভেজা চোখজোড়া নত করে ফেলে। রেশমা বেগম মেয়েকে খুব ভালো করেই চেনেন। সে কান্না খুব কম করে, খুব আঘাত না পেলে তার চোখ দিয়ে পানি ঝরে না। কাছের মানুষের কষ্টেই তার অশ্রু ঝরে। আজকাল মেয়েটা তার বড়ই উদাসীন। কিছুদিন যাবত খেয়াল করেছেন তবে বুঝে উঠতে পারেননি। তবে আজ কেন যেন ভিন্ন কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে। মেয়ের এমন কান্না অযথা হতেই পারেনা।

রেশমা বেগম নাফিয়ার থুতনিতে হাত রেখে মুখ তুললেন। প্রশ্ন করলেন,

-“তুই কী আরিভকে পছন্দ করিস?”

চলবে….

#বৈরী_বসন্ত ১৬
লেখা – আয্যাহ সূচনা

দীর্ঘ একটি রাত কেটেছে। এক একটা ঘন্টা অনেক বেশি লম্বা ছিল। নাফিয়া ঘুমোয়নি। এক মুহূর্তের জন্যও চোখ থেকে ওই রক্তমাখা দৃশ্যটুকু সরেনি। দোষটাতো তারই ছিল। সেই বলেছিল আরিভকে, বলেছিল তার প্রশ্ন আছে। নাফিয়ার বোঝা উচিত ছিল লোকটা পাগল। সে খুব ভালোভাবেই মজেছে নাফিয়াতে। কোনো কিছু তোয়াক্কা করবে না। তবে এই ভাঙ্গা পা নিয়ে এসে পড়বে জবাব দিতে সেটি কল্পনাতীত ছিল।

কতটা কষ্ট পেয়েছে আরিভ? সেটা অনুভবও করতে পারছে না নাফিয়া। অনেকটা আঘাত পেয়েছে। লাল টকটকে রক্ত কী ভয়াবহ!

আরিভ ব্যতীত আরও একটি চিন্তন ঘর করেছে মস্তিষ্কে। মায়ের করা প্রশ্নটি। নাফিয়া কোনো জবাব দিতে পারেনি। শুধু মুখ নুয়ে ছিল। রেশমা বেগম আর প্রশ্নও করেননি। কেন কোনো প্রশ্ন করল না এটাও একটি বিশাল প্রশ্ন নাফিয়ার কাছে।

-“আপনি কেন আসতে গেলেন বলুনতো! কেন আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়া এত জরুরী ছিল? নিজের দিকে একটুও খেয়াল দিলেন না? আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে জানেন? সব আমার কারণেই হয়েছে। আপনি বাড়ি ফিরলে আমি আপনার সাথে একদম কথা বলব না। দেখাও করব না। আপনি শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।”

জানে মেসেজটির জবাব আসবে না। তারপরও দিয়ে রাখল নাফিয়া। সিদ্দিক সাহেব বাড়ি ফেরেননি। সেখানেই আছেন, সাথে সাদিফও। হুট করেই নাফিয়ার মনে পড়ল সাদিফের কথা। চোখ মুছে চট জলদি মেসেজ করল তাকে,

-“ভাইয়া।”

মিনিট খানেক বাদে সাদিফ জবাব দেয়,

-“বল। ঘুমাসনি?”

-“ভাইয়া উনি ঠিক আছেন?”

-“উনিটা কে?”

-“যে হাসপাতালে ভর্তি।”

-“তার কোনো নাম নেই?”

এমন সময়েও সাদিফের কৌতুকের সুরে কথায় অবাক হয় নাফিয়া। রেগে বলল,

-“ভাইয়া আমার মজা ভালো লাগছে না।”

-“আমি কী তোর বেয়াই হই? মজা করব কেন? হাসপতালে অনেকেই ভর্তি। তুই কার খবর জানতে চাচ্ছিস?”

নাফিয়ার ভীষণ রাগ হল। অন্যদিকে দাঁত বের করে হাসছে সাদিফ। মেয়েটাকে অল্পতে রাগানো যায়। এটা তার ছোটবেলার স্বভাব। আরিভের সাথে তার প্রেম প্রেম ভাব খুব ভালো করেই বুঝেছে। জ্বালাতন করতেই হয়!

-“কীরে! কার কথা জানতে চাইছিস বল?”

-“আরিভ… ভাই।”

-“ভাই?”

-“উফ! তুমি বলবে? কথা পেচাচ্ছো কেন?”

এবার রাগের পরিমাণ দ্বিগুণ মনে হল। সাদিফ হেসে উঠে। জবাব দেয়,

-“আরিভ ভাই ঠিক আছে, জ্ঞানে আছে। চোখ খুলেই আমাকে ডেকে কী বলেছে জানিস?”

নাফিয়া নড়েচড়ে বসে। উৎসুক কন্ঠে জানতে চাইল,

-“কী বলেছে? বলো?”

-“কী খাওয়াবি বললে?”

-“ভাইয়া!”

-“আচ্ছা আচ্ছা বলছি।”

-“বলো।”

-“তোর কথা জিজ্ঞেস করেছিল। আমি বলেছি তুই কেঁদেকেটে পুরো এলাকায় বন্যা করে ফেলেছিস। ভীষণ কষ্ট পেয়েছে সে।”

নাফিয়ার চোখে আবার জল জমলো। নাক টেনে বলল,

-“কেন বলতে গেলে?”

-“আমি সত্যবাদী জানিস না?”

সাদিফ কখনোই বদলাবে না। সিরিয়াস সময়ে মজা করা তাদের দুই ভাইয়ের স্বভাব। এর পরিবর্তন ইহজনমে সম্ভব নয়। নাফিয়া ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

-“কাল ফিরবেন উনি?”

-“তুই বললে সে আজই ফিরতে রাজি।”

-“কোনো দরকার নেই। একদম বেশি বেশি করে লোকটা!”

সাদিফ উচ্চস্বরে হাসল। সে এক গুণী ব্যক্তির কাছে শুনেছিল ঝগড়া থেকে যে সম্পর্কের সৃষ্টি হয় সেই সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি মজবুত হয়। নাফিয়া আর আরিভের মধ্যেও তাই হচ্ছে যেন। সাদিফ নাফিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

-“তাহলে তোদের বিয়ে খাচ্ছি কবে? আমাকে কিন্তু আস্ত খাসির লেগপিস দিতে হবে বলে দিলাম।”

বিয়ের কথা শুনতেই লজ্জায় লাল নীল হতে শুরু করে নাফিয়া। এতদূর অব্দিতো ভাবেনি। ‘ ধুর ’ বলে ফোনটা কেটে দিল। আঁধার রজনীতে অর্ধ তন্দ্রায় মগ্ন হতে না হতেই ভাবনায় এল আরিভকে বর হিসেবে কেমন দেখাবে?

______

-“পাশের বাড়ির পোলার লেইগা তোর মাইয়া কাইন্দা দুনিয়া ভাসায় ফালাইছে। আমরা কী এসব বুঝি না? আমি এই কারণেই কইছিলাম মাইয়ারে টাইট দে। তুই আহ্লাদ কইরা মাথায় তুললি, এবার হইলো তো!”

সবে মাত্র বাড়ি ফিরেছেন সিদ্দিক সাহেব। সারারাত হাসপাতালেই ছিলেন। একজন প্রতিবেশীর দায়িত্ব পালন করে আরিভকে নিয়েই বাড়ি এসেছেন। পুরোটা রাত ধকল গেছে। এসেই ফ্রেশ হয়ে খেতে বসেছিলেন। পেটে রুটির এক টুকরো পড়তে না পড়তেই মায়ের এমন বানী শুনে মুখটা কালো হয়ে আসে সিদ্দিক সাহেবের। তিনি জবাবে বললেন,

-“নাফিয়া রক্ত সহ্য করতে পারেনা মা। ভয় পেয়ে গিয়েছিল, তাই কেঁদেছে।”

-“এই কান্দা ডরের কান্দা না। এই কান্দা পিরিতির কান্দা। ওরে ডাক! ডাইকা জিজ্ঞেস কর। পানি মাথার উপর দিয়া গেলে এলাকার মানুষ মুখে চুনকালি মাখাইব।”

-“আম্মা, আপনি সবসময়ের মত বেশি ভাবছেন।”

-“আমিতো সবসময় বেশিই ভাবি। ওই সারাদিন বারান্দায় ওই পোলার লগে আলাপ করে।”

রেশমা বেগম সবটাই শুনছেন দূরে দাঁড়িয়ে। সেও নাফিয়ার আচার আচরণে ভিন্নতা লক্ষ্য করেছে। আরিভের জন্য অদ্ভুত পরিবর্তন দেখেছেন মেয়ের চোখে। তবে এতটা জঘন্যভাবে চিন্তা করেননি। জমিলা বেগম আরও জলঘোলা করবেন বিষয়টি।

তিনি ডিম ভেজে এনে টেবলে রাখলেন। বললেন,

-“আম্মা আরিভ ভালো ছেলে। সাদিফ জোহানের মতই।”

জমিলা বেগম তেজি গলায় বলে উঠেন,

-“ওগো হিসাব আলাদা। কিন্তু ওই পাশের বাড়ির পোলার তাগড়া জোয়ান। একটা কিছু হইব পুরা এলাকা বদনাম হইব আমার পোলার।”

রেশমা বেগমের অবাক লাগল। নাতনীকে নিচু করতে ভিত্তিহীন কথাবার্তা বলে চলেছেন। সাদিফ জোহানের সাথে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু আরিভের সাথে আছে। এই কথার কোনো অর্থ দাঁড়াচ্ছে?

সিদ্দিক সাহেব বলে উঠলেন,

-“রেশমা ঠিক বলেছে। ভদ্র দায়িত্বশীল একটা ছেলে। তাকে নিয়ে না জেনে এসব বলা উচিত না।”

জমিলা বেগম বললেন,

-“তুই কইলেই হইল। আমি তোর চেয়ে দুনিয়া বেশি দেখছি। এই পোলারে ওর কাছ থিকা দূরে সরানোর ব্যবস্থা আমি করতাছি। ওর মায়ের লগে কথা কমু আমি।”

-“আম্মা আপনি কিছুই করবেন না। এমনেই ছেলেটা অসুস্থ।”

-“মাইয়া নষ্ট হওয়ার পর তোর হুশ ফিরব সিদ্দিক।”

-“মা থামুন আপনি। আর ভাষা সংযত করুন দয়া করে।”

জমিলা বেগম কান্নার ভান করে বললেন, – “আমারই তো থামাবি! তুই তোর মাইয়ারে ডাক দিয়া প্রশ্ন কর এই ভরা সন্ধ্যা ওই পোলা আমাগো বাড়িতে কী করতাছিল? জিগা। নিশ্চয়ই ছাদে গেছে। তোর মাইয়া ছাদে ছিল তখন।”

রেশমা বেগমের এসব শুনতে অস্বস্তি হচ্ছে। ঘরের শত্রু বিভীষণ যেন। মেয়েটাকে মানসিক রোগী বানিয়েই ছাড়বে সে। রেশমা বেগম নাফিয়ার ঘরের দিকে তাকালেন। পর্দার আড়ালে তার অবছায়া দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই শুনেছে সব। কোমল মনে অদৃশ্য আঘাত হানছে কথাগুলো?

আজ স্বামীর সামনেই মুখ খুললেন, – “আসলে কী আম্মা, সমস্যা আরিভ, জোহান, সাদিফ কেউই না। আপনার কাছে সমস্যা আমার নাফি। আপনি ওর দাদী, ওর রক্ত অথচ আপনিই ওকে নিজের শত্রুর চোখে দেখছেন। আপনি চান ওর জীবনের সবকিছুর সিদ্ধান্ত আপনি নিন, যত দ্রুত হোক আপনার পছন্দের কারো সাথে যেন তাকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করি। আপনি এটিও চান আপনি যেমন আমার মেয়েটার সাথে আচরণ করে সবাই যেন করে। অথচ নাফি আপনার কোনো ক্ষতি করেনি, আপনার আর আপনার ছেলের ভালোবাসায় ভাগ বসাতে আসেনি। আপনি বলেন নাফি অপয়া আপনার ছেলের ঘাড়ে বসে অন্ন ধ্বংস করছে এটাই তার সাথে আপনার আক্রোশ কিন্তু নাহ, আপনি নিজেই জানেন না আপনি নাফিকে কেন অপছন্দ করেন। হয়ত জানেন কিন্তু স্বীকার করেননা। যখন অনেক বছর অপেক্ষার পর একটি ফুটফুটে মেয়ে সন্তান আমার কোলে এল তখন সবাই খুশি ছিল শুধু আপনি ব্যতীত। কারণ আপনার মতে আপনার ছেলে ও স্বামীর সম্পত্তির ভাগ এখন বাহিরের মানুষ খাবে। ছেলে আপনার মতে বংশের প্রদীপ আর মেয়েরা আঁধার।”

সিদ্দিক সাহেব খাবার শেষ না করেই উঠে গেলেন। পুরুষ মানুষ এতশত কথা পছন্দ করেননা। সে বিরক্ত, কিন্তু জানেন এই সমস্যা সমাধান হবার নয়। সরাসরি গেলেন মেয়ের ঘরে। পড়ার টেবিলে মুখ লুকিয়ে বসে থাকা নাফিয়ার পাশে বসে বললেন,

-“কান্না করেছ?”

নাফিয়া সিদ্দিক সাহেবের পায়ের ধ্বনি শুনেই নিজেকে সতর্ক করেছে। চোখ মুছে মুখখানা শুষ্ক করে নিয়েছে আগেই। মাথা দুলিয়ে না বোধক উত্তর দেয়। কিন্তু চোখের লালচে ভাব? সেটি নজরে পড়ে গেল সিদ্দিক সাহেবের। পাশে বসলেন তিনি।

মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, -“যে যাই বলুক, আমি জানি আমার মেয়ে কোনো খারাপ পথে কখনোই যাবেনা। আমার অগাধ বিশ্বাস আছে তার প্রতি। যার সাথে তার বাবা দাঁড়িয়ে তার কী কারো কথায় গুরুত্ব দেওয়া উচিত?”

সিদ্দিক সাহেবের কথার সুর মনোমুগ্ধকর। বারবার এই লোকটাকে নিয়ে গর্ব হয় নাফিয়ার। অন্য বাবারাও কী এভাবেই তার মেয়েদের বুঝে? জ্বলজ্বল চোখে চেয়ে রইল নাফিয়া। বলল,

-“আমি কারো কথায় গুরুত্ব দেইনা বাবা। শুধু তোমার আর মায়ের কথায় দেই।”

-“শুনো মা, যুগ ভেদে মানুষের নানান চিন্তাধারা আসে আবার চলে যায়। তারতম্য হবেই, স্বাভাবিক এটি। আমরা চেষ্টা করব বদলাতে, যদি বদলানো অসম্ভব হয়ে উঠে তাহলে এড়িয়ে যাব।”

-“আমি দাদীকে ভালোবাসি বাবা। তার কাছ থেকেও যে ভালোবাসাটা আশা করি সেটা পাই না। আমার কষ্ট হয় যখন আমার আশপাশের মানুষগুলো তাদের দাদা দাদীদের নিয়ে মজার গল্প শোনায়। আমার কাছে কোনো গল্প নেই বলার মত।”

সিদ্দিক সাহেবের মনটা যেন খানখান হয়ে গেল। মেয়েকে আলতো হাতে বুকে জড়িয়ে মাথায় চুমু খেলেন। বললেন,

-“আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী আমার মায়ের তরফ থেকে।”

নাফিয়া মাথা তুলল দ্রুত। বলল,

-“এসব কী বলছো বাবা? আমার কথার অর্থ সেটা ছিল না। ক্ষমা চাইছো কেন?”

-“আরেহ বোকা মেয়ে! ছোট বড় সবার কাছে ক্ষমা চাওয়া যায়।”

-“না বাবা। তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাইবে না প্লীজ।”

সিদ্দিক সাহেবকে খুব কমই হাসতে দেখা যায়। মেয়ের কথায় ম্লান হেসে বললেন,

-“তুমি কষ্ট পাবে এমন কোনোকিছু আমি কখনোই করব না, ওয়াদা রইল।”

আর কী করেই বা বুঝাবেন মেয়েকে? বুঝালে বুঝে যায়, পরে ঠিক সেই কষ্টের পুনরাবৃত্তি ঘটে। উঠে যেতে লাগলেন সিদ্দিক সাহেব। ঠিক তখনই নাফিয়া ডেকে বলল,

-“বাবা।”

সিদ্দিক সাহেব ঘুরে তাকালেন। নাফিয়ার মুখ ছোট হয়ে আছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। ঢোক গিলল ছোট করে। সাহসে কুলাচ্ছে না কেন যেন কথাটি বলতে।

-“কী বলবে মা?”

-“বাবা… তুমি কী রেগে যাবে?”

আশ্চর্য হন সিদ্দিক সাহেব। সেই সুরেই প্রশ্ন করলেন,

-“কেন রাগ করব? যা মনে আছে নির্দ্বিধায় বলো।”

ঠোঁট শুকিয়ে এসেছে নাফিয়ার। সাথে গলাটাও। জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। সাথে সাথে চোখ নামাল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

-“বাবা… আর.. আরিভ ভাই উনি ভালো মানুষ। দাদী ওনার ব্যাপারে ভুল ভাবছেন। উনি এসেছিলেন… আমরা কথা বলি কিন্তু…”

কন্ঠ কেঁপে উঠে নাফিয়ার। আরিভ তার সাথে দেখা করতে এসেই যে আঘাত পেয়েছে সেটা বলতে চাইছিল। কিন্তু পারল না। কী বলতে কী বলে ফেলল। সিদ্দিক সাহেব গম্ভীর মুখে তাকালেন মেয়ের দিকে। হুট করেই রাশভারী গলায় প্রশ্ন করলেন,

-“তোমার ওকে পছন্দ?”

আত্মাটা উড়ে গেল বোধহয়। মা জিজ্ঞেস করায় এতটা অস্বস্তি হয়নি। বাবা প্রশ্নটি করে ভীত করে তুলেছে তাকে। কাঁপুনি উঠে যাবে যে কোনো সময়।

সিদ্দিক সাহেব কাছে এলেন। প্রশ্ন করলেন,

-“ বড় হয়েছ তুমি। জীবনের সিদ্ধান্ত বুঝে শুনে নিবে। এমন পুরুষকে জীবনে জায়গা দিবে যে বাবার পরে তোমাকে আগলে রাখে। তোমার চোখের পানি যেমন আমি সহ্য করতে পারিনা, তেমন সেও যেন না পারে।”

বলে চলে গেলেন সিদ্দিক সাহেব। নাফিয়া চোখ তুলে তাকাল। বুঝল না কী বলল বাবা? ভয়ে মাথাটাও কাজ করছে না। কিছুক্ষণ থম মেরে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।

আরিভ তার নোটপ্যাডে লিখা বাক্যগুলো পড়ছে। কপালে ব্যান্ডেজ, পায়ে ব্যান্ডেজ। ঠোঁটের কোণে ক্ষত স্থানের সাথে জুড়ে আছে হাসি। বাড়ি ফিরে ঘুম আসেনি। বুকটা হাহাকার করছে, শুষ্ক মরুভূমি হয়ে আছে। প্রিয়তমা নামক মিঠা বারিধারার বর্ষণ চাই। নোটপ্যাডে লিখাগুলো নাফিয়ার। ঘরে এসেছিল সেদিন, তখনই হয়তো লিখেছে।

আরিভ ফোন হাতে নিল সাথে সাথে। পুরো দেহটা যেন ভঙ্গুর তার। তবে মনে ব্যাপক জোর আছে। নাফিয়ার দেওয়া মেসেজটি পড়ে হৃদয়ের অদৃশ্য রক্তক্ষরণ বাড়ল। চোখ বুঁজে ফেলে আরিভ। ভেসে উঠল নাফিয়ার কান্নামাখা মুখ।

-“একটাবার এলে না আমার কাছে। আমি মরিয়া হয়ে আছি তোমার জন্য। মনে হচ্ছে তুমি এলে ভিতর- বাহিরের সকল ব্যাথা শেষ হয়ে যাবে।”

পরপর আবার লিখল আরিভ,

-“আমি অর্ধ জ্ঞানে তোমার কান্নারত মুখ দেখেছি। বিশ্বাস করো নাফিয়া, আমার বাহ্যিক আঘাতের চেয়ে বেশি হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল। আমি তোমার কান্নার কারণ কেন হলাম?”

চলবে…